অঙ্কে যত শূন্য পেলেপ্রবুদ্ধ বাগচী
পর্ব ৯
স্নাতকস্তরে যে গণিত নিয়েই পড়তে হবে, এমন কোনো বাসনা আমার ছিল না। প্রথম পছন্দ হিসেবে ভেবে রেখেছিলাম পদার্থবিদ্যা। কারণ, অন্তত উচ্চমাধ্যমিক অবধি এই বিষয়টার আকর্ষণ ছিল খুব বেশি। তার একটা বড় কারণ হল, পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটরি। আমাদের নিতান্ত মাঝারি মাপের স্কুলে খুব যে উঁচু মানের পরীক্ষাগার ছিল তা নয়, আর, কোন এক বিচিত্র দুর্বিপাকে আমাদের স্কুলের প্রধানশিক্ষক কিছুতেই চাইতেন না ছাত্রেরা ল্যাবরেটরিতে সময় কাটাক, যার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা আজও আমরা খুঁজে পাইনি। যাই হোক ওই দড়ি টানাটানির মধ্যেই সুযোগ হয়েছে ল্যাবরেটরিতে বেশ কিছু সময় কাটানোর ও ফিজিক্সের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার। এই অভিজ্ঞতা উত্তেজক। অবশ্যই একইরকম স্মরণীয় রসায়ন বা জীববিদ্যার পরীক্ষাগার। পাঠ্যবইয়ে ছবি-দেখা বুন্সেন বার্ণার বা টেস্ট টিউব কিংবা বকযন্ত্র হাতের সামনে পেলাম কেমিস্ট্রির ল্যাবে, আর আস্ত একটা মাইক্রোস্কোপ হাতে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ ঘটল জীববিদ্যার ল্যাবরেটারিতে।
রসায়নের ‘সল্ট আইডেন্টিফিকেশন’ ছিল একটা মহাসমস্যার বিষয় । স্কুলের পরীক্ষায় আড়ালে সল্টের নাম বলে দেওয়া ছিল কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরি সহায়কের, যাকে বলে ‘ওপেন সিক্রেট’ —- এর জন্য তাঁকে প্রণামীও দিতে হত। বাইরের পরীক্ষকের উপস্থিতিতে উচ্চমাধ্যমিকের ফাইনাল প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা হত স্কুলেই —-- সেখানেও এই ‘কারচুপি’ আমরা প্রায় সবাই করেছি, মাস্টারমশাইরাও এটা জানতেন না তা নয়। বায়োলজির ল্যাবে অবশ্য গাছের নরমকান্ডের প্রস্থচ্ছেদ করে জাইলেম বা ফ্লোয়েম নালিকা আমি কোনোদিন দেখতে বা চিনতে পারিনি। এই ব্যর্থতার কারণ নাকি ব্লেড দিয়ে যথেষ্ট পাতলা করে প্রস্থচ্ছেদ করতে না-পারা। হবেও বা। আর আঙুলের ডগা থেকে রক্ত নিয়ে যেদিন স্লাইডে ফেলে রক্তের যাবতীয় কণিকা চেনানোর চেষ্টা করা হল, তাও আমি তেমন চিহ্নিত করে উঠতে পারিনি। জানি না, ইদানিংকার স্বাস্থ্য নিয়ে ‘অতিসচেতন প্রজন্মের’ পড়ুয়াদের আঙুলের থেকে ওইভাবে রক্তের ফোঁটা নিয়ে পরীক্ষায় নামতে বলা হয় কি না। তবে ক্লাস টুয়েল্ভে ফিজিওলজি বা শারীরবিদ্যা বিষয়টি অত্যন্ত পছন্দ করতাম, তারই অনুষঙ্গে ল্যাবরেটরিতে ‘ব্যাং-কাটা’ ছিল উত্তেজক ঘটনা। ব্যং-নিধনের সঙ্গে গণিতের কোনো যোগাযোগ নেই ঠিকই —- কিন্তু ব্যাং-জোগানদারদের থেকে জীবন্ত ব্যাং কেনা তারপর মোমমাখানো ট্রেতে তাঁদের ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা ও বায়োলজি বক্সের ছুরি-কাঁচি দিয়ে তাঁদের পেট চিরে অঙ্গসংস্থান দেখা ও চেনা এর মধ্যে কি আমরা হননের একরকম নিরাবেগ আনন্দও পেতাম ? এখন তো মনে করা হয়, ব্যাং পারিবেশিক ভারসাম্যের সহায়ক —- আজও কি তাঁদের ওই একইভাবে হত্যা করে জীবনবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া হয়? এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটারির অভিজ্ঞতা ও উদ্দীপনা সম্পূর্ণ আলাদা। এখনো স্মরণ করতে পারি, স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি বা আপেক্ষিক ঘনত্বের সূত্র জানার পর যেদিন সরষের তেলের স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি পরিমাপ করতে পারলাম ও পরীক্ষালব্ধ ফল মোটামুটি মূল ফলাফলের কাছাকাছি গেল, সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল, বলার নয়। আর অনির্বচনীয় এক তৃপ্তি পেয়েছিলাম যেদিন পেণ্ডুলামের দোলন মেপে পৃথিবীর মহাকর্ষ ত্বরণের (Gravitational Acceleration) মান বের করতে পেরেছিলাম ৯.৬২মি/সেকেন্ড স্কোয়ার যা প্রকৃত মান ৯.৮১মি/সেকেন্ড স্কয়ার এর বেশ কাছেই —- বইয়ে-পড়া বিদ্যে এমন হাতে-কলমে করে দেখার সুযোগ আর কোথায় আছে ? একইভাবে রোমাঞ্চ হয়েছিল আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র পরীক্ষাগারে হাতে কলমে পরীক্ষা করে, শিহরিত হয়েছিলাম যখন সাদা পাতার উপর চুম্বকদন্ড রেখে ছোট্ট কম্পাসের সাহায্যে চৌম্বক ক্ষেত্রের (magnetic lines of forces) লাইনগুলি হুবহু চিহ্নিত হতে দেখে। একইভাবে কারেন্ট ইলেক্ট্রিসিটির গ্যাল্ভানোমিটার, ভোল্টমিটার বা রিওস্ট্যাট যন্ত্রগুলি ছিল নানা পরীক্ষার উপকরণ, যত সেগুলির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে উত্তেজিত ও মুগ্ধ হয়েছি ভিতরে ভিতরে। তাই স্নাতকস্তরে ভর্তির সময় প্রাথমিক পছন্দ ছিল ওই ফিজিক্স, যদিও পাশ সাবজেক্ট বা সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট হিসেবে অঙ্ক যে পড়তেই হবে তা নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু হিসেবটা গেল উলটে, যা হয় আর কি !
স্নাতকে মূল বিষয় হিসেবে পাওয়া গেল অঙ্ক, আর সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে এল ফিজিক্স ও কম্পিউটার বিজ্ঞান। যাদবপুরে স্নাতকস্তরের প্রথম বছরের প্রথম ক্লাস থেকেই বুঝতে পারছিলাম গণিত ভাললাগা আর তাকে ভালবাসায় জড়িয়ে নেওয়া খুব সহজ নয়। ব্যাপারটা ব্যক্তিপ্রেমের মতোই গোলমেলে সব সমীকরণের সঙ্গে মিশ্রিত। দূর-থেকে বা কিছুটা কাছে-থেকে যাকে প্রিয় বলে মনে হয়, ঘরকন্না করতে গেলে সে-ই তখন অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে সব নকশায় তার মুখ ঢেকে ফেলে। সবার ওপরে প্রেম সত্য, কিন্তু গেরস্তের জীবনে কোনো প্রেমের গপ্পো মানায় না। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ এই অবধি ঠিক আছে কিন্তু ‘চিরদিন কেন পাই না’ এই প্রশ্নের কোনো মানেই নেই — চিরদিন একই জিনিসের ঘর্ঘর-ধ্বনি শ্রবণকে বধির করে দেয়। স্নাতকস্তরের গণিত- সুন্দরী যখন একে একে তার নানা মুদ্রার বিভঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করতে আরম্ভ করল, ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়’। ক্যালকুলাস, ডিটারমিন্যান্ট, ম্যাট্রিক্স, মেকানিক্স, পারশিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন ইত্যাদি সারবেঁধে মিছিল করছে অঙ্কের রাজপথে —- কাকে ছেড়ে কাকে রাখি ! সত্যিই তো সবাইকে ঠিক একপাতে ধরাতে পারিনি আমি। অনেকটা বোঝার পরে মনে হচ্ছে আরো একটু খটকা থেকে গেল —- এরপরে কী? সেই ঘাটতিটুকু পুরিয়ে নেওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা লাগে, সত্যিই তা আমার ছিল না। এগুলো আসলে সেই উচ্চমাধ্যমিকের যে সব ‘আপোস’ তারই একেকরকম ফলশ্রুতি আর কি ! সব থেকে গর্তে পড়ে গেলাম ‘রিয়াল অ্যানালিসিস’ নামক একটি বিষয় নিয়ে, যার সঙ্গে জুড়ে আছে একদিকে ডিফারেন্সিয়াল অন্যদিকে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের তত্ত্ব এবং তার পরের স্তরেই তার সঙ্গে জুড়ে যাবে মডার্ণ অ্যালজেব্রার সেট-গ্রুপ-রিং-ফিল্ড এইসব ধ্যান-ধারণা। স্যারেরা ক্লাসে পাতার পর পাতা নোট দিচ্ছেন, বোর্ডে লিখছেন আর আমি কপিরাইটারের মতো তা টুকছি, অথচ মাথায় ঢুকছে না কিস্যু! এই লাইনের পর কেন এই লাইনটা হল ? ভাবতে গিয়েই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, আর জমা হচ্ছে একরকম আত্মগ্লানি আর অপরাধবোধ —-- আমি কি এইসব বিষয়ের মূল ভাবনাগুলি সত্যিই জানি ? তাহলে ? সব থেকে বড় প্রশ্ন, এইভাবে পরীক্ষায় উত্তর লিখব কীভাবে?
এত বছর পরে, স্বীকার করতে একটুও কুন্ঠা নেই, স্নাতকস্তরের গণিতের অনেক বিষয়ই এইভাবে আন্দাজে ঢিল মেরে আর স্রেফ নোট মুখস্ত করে স্টেজে মেরে দেওয়া —---- জ্ঞান-গম্যি বা কন্সেপশনের মতো বিব্রতকর প্রসঙ্গ এখানে না তোলাই ভাল। গণিত-সুন্দরী এতে লজ্জা পেতে পারে, কারণ বেশ কিছু ব্যাপারে জাস্ট চোখ মেরে বা ‘ঝাড়ি করে’ তার সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পেরেছি, সেসবের মধ্যে কোনো প্রেম-ট্রেম ছিল না —- এর সবটুকুই নিপাতনে সিদ্ধ।
অবশ্য তার মানে এই নয় সবটাই এমন। স্নাতক স্তরের তিন বছরে সব মিলিয়ে আমাদের বোধহয় ষোলোটা পেপার ছিল গণিতের, তার মধ্যে কিছু বিষয় নিশ্চয়ই আকর্ষণের। যেমন মেকানিক্সে ‘কেপলারস ল’ সংক্রান্ত পাঠ্য বা অঙ্ক বেশ পছন্দ হত, তার মূল কারণ বোধহয় ফিজিক্সের সঙ্গে এই অঙ্কগুলির নিবিড় সখ্য। বেশ অনেকটা বড় করে হিসেব করতে হলেও গতিবিদ্যায় একটি কণার অবস্থা কখন কীভাবে হিসেব করে বার করে ফেলা যায়, তার একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যেত এইসব অঙ্কে। ডিটারমিন্যান্ট আর ম্যাট্রিক্সের জগত বহু-বিস্তৃত, বিশেষত ম্যাট্রিক্স ব্যাপারটা যে গণিতের একটা গভীর আবিষ্কার তা বোঝা গেছে ধাপে ধাপে। কিছু সংখ্যার এক বিশেষ সজ্জা যে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে, আপাতভাবে তার হদিশ পাওয়া সম্ভব ছিল না। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির হিসেব-নিকেশও ছিল বেশ পছন্দের ব্যাপার, অন্তত একটা ছবি চোখের ওপর তৈরি করা যেত বলেই হয়তো বোঝাবুঝির বিষয়টা তুলনায় সহজ হয়ে যেত। ভেক্টর বীজগণিতেরও অনেকটা যোগ ছিল ফিজিক্সের সঙ্গে, তারও ছবি এঁকে সামনে থেকে বোঝা যেত বিষয়টা—--- উচ্চমাধ্যমিকে গতিবিদ্যা পড়ার সময় ভেক্টর আর স্ক্যালার এই দুই রাশি বিষয়ে একটা কাজচালানো ধারণা আমাদের সকলেরই ছিল।
আসলে এই যে সামনে একটা কিছু দেখে সেটার বিষয় ধারণা করা, এর বোধহয় একটা দার্শনিক তাৎপর্য আছে। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুদের পৌত্তলিকতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন। মানুষ যে ঈশ্বরের ধ্যান করবে, তার জন্য একটা গ্রাহ্য আকার দরকার — মূর্তি ব্যাপারটা আসলে তা-ই, সামনে রাখা একটা প্রতীক যাকে উদ্দেশ করে ভক্ত জানাবে তাঁর মনের আকুতি। এমন নয় যে, এই ভাবনার কোনো প্রতিস্পর্ধী ধারণা নেই । বেদ বা উপনিষদে মূর্তির কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি । বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম সমেত দুনিয়ার অনেক ধর্মমতই নিরাকার ঈশ্বরের সাধনায় আস্থাবান। আমাদের দেশের প্রচুর আদিবাসী ধর্মেও মূর্তিপুজোর প্রচলন নেই —-- পরিবর্তে তাঁরা গাছ, পাথর, নদী এমনকি গোটা একটা পাহাড়কেও দেবতা হিসেবে মান্য করেন। আমাদের মনে পড়তে পারে, ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ে যখন বহুজাতিক সংস্থাগুলি বক্সাইটের খনি তৈরির জন্য সেখানকার ভূমিজ আদিবাসীদের নির্বিচারে উচ্ছেদ করতে চেয়েছেন তাঁরা বারবার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে বলেছেন, নিয়মগিরি আমাদের দেবতা, তাঁর গায়ে তোমরা আঁচড় কাটতে পারো না। আশ্চর্য এই যে, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট আদিবাসী সমাজের এই আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে জানিয়ে দেন, নিজেদের মতো করে ধর্ম পালনের অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তাই সেই অধিকারকে ধ্বস্ত করে কোনো শিল্প বা বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা যাবে না। আমাদের ব্রাহ্ম আন্দোলনের মূল চিন্তাটাই ছিল পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে । উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-সন্তান ও ঈর্ষণীয় প্রজ্ঞার অধিকারী হয়েও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করতেন না, বেদান্তের দর্শনকে তিনি ভুল বলে মনে করতেন। গণিতের পাঠ্যক্রমে ওই রিয়াল অ্যানালিসিস বা সেট-গ্রুপ-রিং-ফিল্ড আসলে এক ধরনের নিরাকার বিমূর্তের চর্চা, সহজে যার নাগাল মেলে না।
রাশিবিজ্ঞান ও সম্ভাব্যতার থিওরি নিয়ে এর আগে কিছু লিখেছি। স্নাতকস্তরে এঁদের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। এর মধ্যে রাশিবিজ্ঞান নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি, বেশ তরতর করেই এগিয়ে গিয়েছে তার নৌকো, আর দুপারের অবিরল সৌন্দর্য নিয়ে মুগ্ধ করে চলেছে আমায়। কিন্তু ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ হয়ে আবার পথ আগলে দাঁড়াল ওই থিওরি অফ প্রোবাবিলিটি —- বিষয়টা বুঝতে চাই অথচ বুঝতে পারছি না, ক্লাসে হুড়হুড় করে পড়া এগিয়ে যাচ্ছে অথচ আমি এক ক্যাবলা কার্তিক মাথা চুলকে চলেছি কেবলই। কাকে বলছে স্টকাস্টিক প্রসেস ( Stochastic Process) ? কী সেটা ? ব্ল্যাকবোর্ডে স্যারের করা আঁকিবুঁকি যেন আমার কাছে গ্রিক ! এদিকে ‘স্টকাস্টিক’ শব্দের একটা ব্যাঞ্জনা হল ‘দৈবী’ —- সে আবার কেমন ব্যাপার ? প্রাক- গ্লাসনস্ত আমলে উচ্চতর গণিতের চমৎকার সব বই মিলত তখন সুল্ভে, কলেজ স্ট্রিটের ‘মনীষা গ্রন্থালয়’ এ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল প্রোবাবিলিটির একটি রাশিয়ান বই। কিন্তু এতে আমার কাদায় আটকে যাওয়া নৌকো যে কূল পেল এমন নয়। এবারও সেই আপসোস — তবে কি পূর্বতন নানা অধঃপাতের ফলাফল এই গহিন গাঙে ডুবে মরা ? অনেকদিন পরে অবশ্য আমি একটু একটু জানব, কীভাবে এই Stochastic Process কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যায় গাণিতিক মডেল — কোনো রোগাক্রান্তের শরীরে ব্যাক্টিরিয়া কতটা বাসা বেঁধে কতদূর অবধি বংশবিস্তার করে আরো জটিলতর চেহারায় নিয়ে যেতে পারে রোগকে, এর হদিশ পাওয়া যায় এই অঙ্কের হিসেবনিকেশ করে। সম্ভাব্যতার তত্ত্বের পরিধি বহুবিস্তৃত —- এমনকি সনাতনী গতিবিদ্যার পাশে পাশে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে থাকে তার প্রভাব। কিন্তু থিওরির আঁশ ছাড়িয়ে তার গভীরে গেলে নিশ্চয়ই এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। তবে ওই বিশেষ সময়ে এই বিস্ময় আমায় পেড়ে ফেলতে পারেনি।
বরং এইসব বিড়ম্বনার ভিতরেই একটি মরূদ্যান হিসেবে দেখা দিল জ্যোতির্বিদ্যা বা অ্যাস্ট্রোনমি, যা আমাদের সিলেবাসের একটা পেপার হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল তৃতীয় বছরে। এ এক গভীর বিস্ময়ের মহাসাগর —- আজ থেকে নয় —-- মানুষ যেদিন থেকে তার মাথার ওপর অনাদি অনন্ত আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে সন্ধান পেতে চেয়েছে তার কেন্দ্রের, সেই মুহূর্তটি থেকে। মানবসভ্যতার সেই বিস্মিত নিমেষাহত অনুধ্যানের গর্ভেই জ্যোতির্বিদ্যার জন্ম। আর সেই দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর্বে পর্বে তার পা আটকে জড়িয়ে ধরেছে অ্যাস্ট্রোলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্রের শিকড়-বাকড়, বারবার তাকে পথভ্রষ্ট করেছে, শিখিয়ে দিয়েছে ভুল পথের নিশানা। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যখন দিগন্ত বিস্তার করে দিচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণার, ঠিক তখনই কায়েমী স্বার্থের একটা সংগঠিত অংশ তাবিজ-কবচ-রত্ন-শেকড়-বাকড় আর ভবিষ্যৎবাণীর মরীচিকার মায়াজালে বেঁধে ফেলে মানুষকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে অবিজ্ঞানের শেওলাপড়া বদ্ধস্রোতের কিনারে। বিজ্ঞানের ইতিহাস আদিকাল থেকেই অবিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে শাণিত লড়াইয়েরই ইতিবৃত্ত, তার ভিতর দিয়েই তার স্ফূর্ত বিকাশ । কিন্তু অ্যাস্ট্রোনমির ক্ষেত্রে যেন তার বিসম্বাদ আরও তুঙ্গ ও তীব্র। এই মৌলিক জ্ঞানটুকু মগজে বাসা বেঁধে গিয়েছিল আমার অ্যাকাডেমিক জ্যোতির্বিদ্যাচর্চার গোড়াতেই।
আমাদের পরিবারে যে জ্যোতিষ-চর্চার কোনো পরম্পরা ছিল এমন নয়। ছেলেবেলা থেকে তাবিজ-কবচ বা রত্নধারণের আড়ম্বর আমরা দেখিনি, দেখিনি কোষ্ঠী-বিচারের মতন ভাঁড়ামি। তবু কী এক সুতীব্র বিজ্ঞানবোধ ও গূঢ় অভীপ্সা আমায় নিবিড়তর করেছিল এই বিশেষ গাণিতিক শাখাটির সঙ্গে। সূর্য-চন্দ্র-পৃথিবীর চলাচল বা সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহের বিষয়ে আমাদের সবারই একটা প্রাথমিক ধ্যান-ধারণা থাকে —- কিন্তু বিশেষভাবে এই গাণিতিক শাখাটি সেই চর্চাকে আরো প্রশস্ততর করে। এই সেই গাণিতিক পাঠ যা সরাসরি বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে ধর্মের মতো প্রতিষ্ঠানের —- চার্চের রক্তচোখ উপেক্ষা করে জানান দিয়েছে ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, ঘুরবেই/ যতই তাকে চোখ রাঙাও না’ । এই সেই সূচিমুখ গণিত যা হিসেব কষে বলে দিয়েছে দূর-আকাশের কোনো গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব মানুষের দৈনিক জীবনে বা জীবনরেখায় পড়তে পারে না, আঙুলে রত্নখচিত আংটি অলঙ্কার হতে পারে, ‘দৈবী বিপর্যয়’ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনও গ্যারান্টি নয়। বলা বাহুল্য, গণিতের চর্চায় এগুলো আলাদা করে ব্যাখ্যা করা থাকে না। কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা পড়তে গিয়ে যে নতুন একটা বিশ্ব-প্রেক্ষিত আমাদের সামনে খুলে খুলে যাচ্ছিল তা বহুকাল অবধি আচ্ছন্ন রেখেছে আমায়। এই পর্যায়ে এসেই জানা গেল, সমতলের জ্যামিতির অনেক হিসেব আর এখানে খাটে না। তাই এতকাল ত্রিভুজের তিনটি কোণের যোগফল যে দুই সমকোণ জেনে এসেছি , বক্রতলের ত্রিকোণমিতিতে এই সূত্র অচল। এরকম সব টুকরো টুকরো বিস্ময় পরতে পরতে জমা হচ্ছিল করোটির ভিতর। তাই পরের স্তরে যে ঠিক এই বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখেই নিজের স্পেশ্যাল পেপার বেছে নিতে হবে, তা বোধহয় ওই সময়েই আড়ালে আড়ালে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শেখার হিসেবে যে খুব বেশি কিছু শিখলাম, তা মনে হয় না। তবে খানিক প্রেম খানিক অপ্রেমে ফুরিয়ে গেল তিনটে বছর। আর মাত্র দুবছর রূপসী গণিত আমার আলো-অন্ধকারের সঙ্গী হয়ে থাকবে —- ভ্রান্তির জড়োয়া গায়ে আমায় ডাক দেবে ভিতর-পানে। তারপর অন্য এক শব্দ গন্ধের জগৎ।
ক্রমশ
পরের পর্ব ১০ মার্চ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।