অঙ্কে যত শূন্য পেলে
প্রবুদ্ধ বাগচী
পর্ব ৬
ক্লাস নাইনের অ্যাডিশনাল অঙ্কে সবথেকে নতুন বিষয় হিসেবে দেখা দিল ‘সেট থিওরি’ যাকে মডার্ন অ্যালজেব্রার একেবারে সূচনাবিন্দু বলে মনে করা হয়। সাধারণ বীজগণিতের মধ্যে ওই পেপারে তুলনায় শক্ত সমীকরণ সমাধান করতে হত, উৎপাদকে বিশ্লেষণগুলি ছিল বেশ হাড়হিম করা শীতল, তাঁদের পেড়ে ফেলতে বেশ ঘাম ঝরাতে হত। কিন্তু সেট থিওরি বা তার প্রাক-অনুশীলনে বিন্দুর বা তলের চলন (ডিসপ্লেসমেন্ট) বা পরিবর্তন (ট্রান্সফর্মেশন) এগুলো আমাদের পড়তে হত। সত্যি বলতে কি, এগুলো পড়াবার মতো উপযুক্ত শিক্ষক আমাদের স্কুলে কেউ ছিলেন না, আর অ্যাডিশনাল বিষয় বলে এই ক্লাসগুলো প্রায়ই হত না, এটাই গড়পড়তা সব স্কুলের রীতি। ফলে বাড়িতে নিজে নিজে কিছুটা চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনে বাবার শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু বাবারা যে আমলে বিজ্ঞান বা গণিত শিখেছে তখন মডার্ন অ্যালজেব্রা পাঠ্যসূচিতে ছিল না, ফলে একটা আড়ষ্টতা ছিলই। আর বইগুলোও ছিল খুবই বাজে অর্থাৎ অল্প পাতায় সব বোঝাতে গিয়ে যথেষ্ট ভালভাবে বিষয়টা প্রকাশ করতে পারেনি। এখানে অবশ্য বইয়ের লেখক বা প্রকাশকদের খুব একটা দোষ দেওয়ার জায়গা নেই। কারণ, আজ থেকে চার দশক আগে কোন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক কত পৃষ্ঠার মধ্যে ছাপাতে হবে তার একটা গাইডলাইন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পক্ষ থেকে জারি করা ছিল —- সেই নির্দেশ না মানলে ওই বই অনুমোদন পেত না। এই নির্দেশের মর্মার্থ ছিল, প্রকাশকরা যাতে অযথা মোটা বই প্রকাশ করে বেশি মূল্যে তা পড়ুয়াদের কাছে বিক্রি না করতে পারে। ভাবনাটা ভুল নয়, কারণ গত এক দেড় দশকে আমরা দেখছি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকগুলিই কী বিপুল পরিমাণ পৃথুল ও মহার্ঘ হয়ে পড়েছে। একশ্রেণির একচেটিয়া প্রকাশক প্রায় নিজেদের ব্র্যান্ডিং করে ফেলেছেন পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক পুস্তকে —-- খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে বিপুল বিজ্ঞাপন, মায় মাধ্যমিক পরীক্ষায় র্যাংক পাওয়া ছাত্র/ছাত্রীদের দিয়েও তাঁরা তাঁদের পুস্তকের বিজ্ঞাপন ও বিপণন করিয়ে চলেছেন। কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই, ক্লাস ফোর/ফাইভের বইয়ের সেট কিনতে গেলেও অভিভাবকদের পকেটে টান পড়ে, নাইন টেনের ক্ষেত্রে তো সেটা আরো বিপুল ব্যয়ভার। হতে পারে মুক্তকচ্ছ বাণিজ্যের দুনিয়ায় ওসব নিয়ম-টিয়মের আর বালাই নেই। তবে আমাদের সময়ে, অন্তত অ্যাডিশনাল বিষয়ের বইগুলি যে মাপের বিস্তৃতি দাবি করত, তা আদপে ছিল না।
আর বলতে গেলে ঠিক এখান থেকেই আমার অধঃপতনের শুরু, যা পরে আরো ডালপালায় বিকশিত করে গণিতের মূলস্রোত থেকে ক্রমেই আমায় পিছলে ফেলবে। কাকে আর দোষারোপ করি ! এ নিজেরই অপদার্থতা ও অজ্ঞতা। গণিতসুন্দরী, তোমার প্রেমে আমি কলঙ্কভাগীই হতে চেয়েছিলাম একদিন, আজও একটু একটু চাই —-- কিন্তু তোমায় পাওয়ার যে আকীর্ণ মেধাবী পথরেখা, যে সজীব নির্লিপ্তি, যে তুঙ্গ অভিনিবেশ আমি তার যোগ্য হয়ে উঠতে পারলাম না, আজও। আজ আমার শিথিল নিউরন, আমার কেন্দ্রাভিগ সংবেদন, তোমার শরীর স্পর্শ করার অভিলাষ থেকে বিচ্যুত —- ঠিক কী করব আমি ? এটা ঠিক, এক সলাজ কৈশোরের ভোরে তুমি তোমার অরুণবরণ পারিজাত-সহ আমার দুয়োরে দেখা দিয়েছিলে সতেজ দীপ্তির আভা নিয়ে— এই তো তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ! আমি জানতাম একদিন কোনো এক মোহানার ধারে তোমায় আমায় দেখা হবে, হবেই । অথচ তেমনটা আর হল কই ! ক্ষণিকের পরশ থেকে জেগে উঠল মনের বেদন আর গণিতবিহীন এক যাপনের মধ্যে প্রাচীন হয়ে এল আমার মন আর দেহ, নির্বাপিত আগুনের ছাই। অথচ কিছুকাল কিছু বছর আমরা একসাথে বেঁধে বেঁধে ছিলাম, আশ্চর্য এক রসের অবগাহনের স্নিগ্ধতায় । গণিত দিয়ে নাকি ছুঁয়ে ফেলা যায় গোটা বিশ্ব, আমাদের প্রশ্বাসের বায়ু থেকে জীবনের স্পন্দন সবই আবর্তিত হচ্ছে গণিতের ছন্দে — রিকশার চাকা থেকে চন্দ্রযান, মুঠোফোন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবধি তার বিপুল বিস্তার! এসবের স্বাদ আর আমার পাওয়া হল না এই জীবনে। তবু তুমি ছিলে আমার কাছে কয়েক ঋতুতে , অনেকদিন বার বার তোমার আরো নিবিড় কাছে যেতে চেয়েছি, হোঁচট খেয়েছি, আবার উঠে দাড়িয়েছি —- ওইটুকুই আসলে প্রেম। পেয়ে গেলে হয়তো সেই উষ্ণতার আচমন মিস করতাম । আশ্লেষ আর অবসান এসে দাঁড়ায় হাত ধরাধরি করে। তার চেয়ে এই এক অন্বিষ্ট সমাপন । সত্যি বলতে কি, ওই সেট থিওরি আমি বিশেষ বুঝিনি। মোটামুটি কাজ চালানো কিছু সংজ্ঞা আর টুকরো-টাকরা অনুশীলনীর অঙ্ক দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলাম। গণিতের উচ্চতম চর্চায় সেট থিওরির ভূমিকা অসীম, এটা জেনেছি পরে। সেটের পরে এসেছে গ্রুপ, রিং, ফিল্ড —- সেইসব আরো পরের ব্যাপার। কিন্তু গোড়ায় গলদ হলে যা হয় আর কি, ক্লাস নাইনের শিক্ষায় ফাঁক থাকলে কি তার পরের স্তরে কিছু ভেদ করা সম্ভব ? অথচ আমি কিন্তু বিষয়টা শিখতে চেষ্টা করেছি, শেখানোর মানুষ পাইনি —- যিনি আমার প্রত্যেকটা জিজ্ঞাসাকে সরল করে দিতে পারেন, সমতল করে দিতে পারেন সংশয়ের উঁচু পাথরগুলো। আজও যদি আমায় কেউ শিখিয়ে দিতে চান, আমি হাত তুলে রাখলাম। সেট নিয়ে বিভ্রান্তির পরেও কিন্তু আরো কিছু বিষয় আমায় আকর্ষণ করেছিল এই অতিরিক্ত গণিতের পেপারে। তার একটি হল সলিড জিওমেট্রি বা ত্রিতলের জ্যামিতি । এর আগে যেসব জ্যামিতির উপপাদ্য আমরা পড়েছি বা প্রমাণ করে এসেছি তা সবই দ্বিতলের অর্থাৎ সমতলের ওপর প্রযোজ্য, এখানে আমরা ভাবনা করছি তিনটি তল অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার মধ্যে। এই জ্যামিতির সদৃশ অবয়ব আমরা আমাদের চারদিকে দেখতে পাই, তাই বিষয়টা ধরে নিতে খুব অসুবিধে হয়নি । আমরা যখন একটা বাড়ি দেখি, গাছ দেখি, সেতু দেখি সবই আমাদের চোখে ত্রি-মাত্রিক অর্থাৎ তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও ভেদ (Depth) আছে । তাই দ্বিমাত্রিক সমতল ছাড়িয়ে যখন ত্রিতলে এলাম, মনে হল এই যে আমাদের চারদিকে নানা ত্রিমাত্রিক আকার —- এরও মধ্যে তাহলে আছে কিছু জ্যামিতিক নিয়ম-কানুন ! আমাদের নিজেদের দেহটাও তো আসলে ত্রিমাত্রিক, তাকে ইচ্ছে করলে কিছু জ্যামিতিক প্রতিবিম্বে ভেঙেও নেওয়া যায় — তাহলে এই জ্যামিতি নিশ্চয়ই লিপ্ত আছে আমারও শরীরে? সরাসরি এর উত্তর পাইনি, সিলেবাসে এইসব উত্তর পাওয়াও যায় না —- কিন্তু হয়তো এই অনুমান মিথ্যে নয়। মানব-শরীরে যে আশ্চর্য এক সাম্য আছে এটা বহু আলোচিত প্রসঙ্গ। যে কোনো কারণেই হোক আমাদের শরীরে দুই আর একের বিস্মিত সমবায় আছে। চোখ, হাত, পা, কান, ফুসফুস, কিডনি, শুক্রাশয়/ ডিম্বাশয় বা স্তন দুটি করে, আবার নাক, হার্ট, লিভার, অগ্ন্যাশয়, জরায়ু, জিভ বা প্রজনন অঙ্গ একটি করে — এই দুই আর একের মধ্যে অবশ্যই আছে কোনো জ্যামিতির ব্যাখ্যা, আর সেটা প্রকাশ করা যায় ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিরই মধ্যবর্তিতায়। চিকিৎসাবিদ্যার পড়ুয়াদের অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যা পড়তে হয়, তারা হয়তো এই বিষয়ে আরো বেশি বলতে পারেন। সাধারণভাবে যেমন জানা যায়, মানুষের পায়ের মাপ ( যে মাপে আমরা জুতো কিনি) আর তার সামনের হাতের (ফোর আর্ম) মাপ সমান হয় —- ফলে যার উচ্চতা যত বেশি তার পায়ের মাপ আর সামনের হাতের দৈর্ঘ্য বেশি। এর আগের কোনও এক কিস্তিতে একজন পুর কাউন্সিলার তথা অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কথা লিখেছিলাম, তিনি আমায় এই বিষয়ে বেশ কিছুটা আলোকিত করেছিলেন। বিশদে এখন কিছু আর স্মরণে নেই কিন্তু যখন শুনেছিলাম বেশ অদ্ভুত লেগেছিল। মানুষ আসলে হয়তো গণিতেরই সন্তান ! এর পরে যে প্রসঙ্গ আসবে তা হল রাশিবিজ্ঞান বা স্ট্যাটিসটিক্স। ক্লাস টেনের অ্যাডিশনাল গণিতের পাঠ্যসূচি দিয়েই এই বিষয়টির সঙ্গে আমাদের স্মরণীয় প্রথম পরিচয়। কতগুলি সংখ্যা বা তথ্যের মধ্যে সুসমন্বয় স্থাপন করতে যে এই বিদ্যার কোনও বিকল্প নেই এটা গোড়াতেই বুঝতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল। আমার সামনে কিছু এলোমেলো তথ্য, কিছু সংখ্যা, কিছু খবরের ঝুড়ি তাদের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করব কীভাবে, তার প্রাথমিক নিশানা ছিল এই রাশিতত্ত্বে। আমাদের নিচুতলার পাঠে গড় অর্থাৎ মিন (mean) কীভাবে ও কতরকম ভাবে করা যায় তার হদিশ ছিল আর তার প্রতিটিই ছিল মনে রাখার মতো। এটা ঠিক, পরীক্ষার হলে গড় নির্ণয় করার জন্য যে টেবিল বা সারণী তৈরি করতে হয় তাতে খুব মনোযোগ লাগে, নতুবা ভুল হয়ে যাওয়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা। সেদিক দিয়ে ভাবলে অবশ্য, কোন অঙ্কই বা অমনোযোগ নিয়ে করা যায় ! পরের স্তরে রাশিবিজ্ঞান পড়ে জেনেছি এই মিন বা গড় আসলে একটা কেন্দ্রীয় প্রবণতা বা সেন্ট্রাল টেন্ডেন্সির সূচক, যার সঙ্গে আগামীতে জুড়ে গেছে মিডিয়ান, মোড । আরো পরে স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন, আসলে যা থেকে জানা যায় কোনও তথ্যের অবস্থান কেন্দ্রীয় প্রবণতার কতটা কাছে বা দূরে। আর আপাতভাবে এই মিন বা গড় ব্যাপারটি যতোই সহজ মনে হয় আদপে তার ব্যঞ্জনা যে বহুধা তার নজির মিলেছে পরে। আমরা যখন মানুষের গড় আয়ু বা মাথাপিছু গড় আয় হিসেব করি, তখন এই গড় মেপে নেওয়ার নানা পদ্ধতি কাজে লাগে যার প্রয়োগ প্রচুর ঘটে অর্থনীতির পাঠে। একইভাবে ফিজিক্সে গড় গতিবেগ, গড় ত্বরণ, আলোকরশ্মির গড় বিচ্যুতি এগুলোর ওপর নির্ভর করে অনেক থিওরি — তার মূলসূত্র বুনে দেয় এই রাশিবিজ্ঞান। পুষ্টিবিজ্ঞানে যখন শিশুদের বয়স,ওজন ও আনুপাতিক উচ্চতার হিসেব কষে তাকে স্টান্টেড বা ওয়েস্টেড বা অত্যন্ত অপুষ্ট বা মাঝারি অপুষ্ট এই ধরনের শ্রেণিতে ভাগ করা হয় তখনো তার নিক্তি হল ওই স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন। মনোবিদ্যার ক্ষেত্রে একেক ধরণের গড়ের হিসেবে ঠিক হয় মানুষের মনোবিকলনের একেকটা স্তর। ডিগ্রি লেভেলের ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাসে ‘মিন ভ্যালু থিওরেম’ বলে সম্ভবত কিছু একটা আছে তবে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে রাশিবিজ্ঞানের কোনো যোগ কি আছে ? স্মরণে আনতে পারলাম না।
তবে ক্লাস টেন স্তরে না হলেও আরো পরে রাশিবিজ্ঞানে একটা বিষয় পড়েছিলাম যা জেনে শিহরিত হয়েছিলাম —- তার নাম রিগ্রেসন লাইন(Regression Line)। এর মূল কথাটা হল, কিছু প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করে আগামী কিছু সম্ভাব্যতার ইঙ্গিত দেওয়া। যদিও আমরা সবাই জানি, সাধারণভাবে ইংরিজি ভাষায় রিগ্রেসন শব্দটা ব্যবহার হয় প্রগ্রেসন এর বিপরীত অর্থে —- রাজনীতির ভাষায় প্রগতিশীলের বিপরীত রক্ষণশীল (বা প্রতিক্রিয়াশীল) হিসেবে। তবে গণিতের পরিভাষা এর থেকে আলাদা। খুব থিওরির কচকচি করে লাভ নেই, তবে এই সেই প্রক্রিয়া যা বর্তমানে দাঁড়িয়ে আসন্ন ভবিষ্যতের কিছু ইশারা দিতে পারে সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সূত্র ও নিয়ম কানুন মেনে। মানুষ তার আদিকাল থেকেই তো এর চেষ্টা করে আসছে, কারণ সে তার অতি-নিকট ভবিষ্যৎ বিষয়েও সম্পূর্ণ অন্ধ ও অজ্ঞ । নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝেছে আকাশে মেঘ করলে বৃষ্টি নামে, সাগরের তরঙ্গ উত্তাল হলে সরিয়ে নিতে হয় নিজেদের আবাস —- কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে জেনে ফেলল, পরের বজ্র-বিদ্যুৎ কবে ঠিক কবে ঝলসে উঠবে তার মাথার ওপর, সে জানে না আর ঠিক কত সময় পরে নতুন করে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে সাগর। আর তার নিজের জীবন ? সে তো নিত্যই অনিত্য —- কালকের দিন কেমন যাবে, কবে আবার আসবে মহামারি, আগামী বছর কি আমি থাকব এই বিশ্বের একজন হয়ে — এইসব জিজ্ঞাসা তার চিরসঙ্গী। এই অজানা ভবিষ্যৎ জানার জন্যই সে মাথা কুটে মরে দেবতার থানে, ফাঁদে পড়ে বুজরুক জ্যোতিষীর। প্রবঞ্চিত হয়। কিন্তু তার জিজ্ঞাসা আর আশঙ্কার কাঁপন কিন্তু থামে না, থামতে চায় না।
না, পরের মুহূর্তে আমাদের হৃদস্পন্দ থেমে যাবে কি না এর উত্তর গণিত দিতে পারে না, এই জবাব দেওয়ার কোনো দায়ও তার নেই। কিন্তু পরীক্ষা করে, তথ্য বিশ্লেষণ করে রাশিবিজ্ঞান এটুকু বলতে পারে অন্তত এই মানুষটির হৃদযন্ত্র এখনো স্বাভাবিক অথবা স্বাভাবিক নয়— এই মাপটুকুর পেছনে নিশ্চিত বিজ্ঞান আর নিখুঁত গণিত। প্রকৃতিও জীবনের মতোই খেয়ালি, তবে এখন আগের থেকে অনেক অব্যর্থভাবে বলা যায় আবহাওয়ার খবর। কোভিড-কালে আমরা দেখেছি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে পূর্বাভাস করা গেছে মারির গতিপথ, অর্থনীতিকরা আর্থিক সমীক্ষা বা কোনো আর্থিক মাপকের ক্ষেত্রেও মেনে নিয়েছেন রাশিবিজ্ঞানের অবদান। আবার,প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে নির্বাচনী ফলাফল অনুমান করা আজ আমাদের গণতন্ত্রের অনিবার্য অঙ্গই হয়ে উঠেছে, পাশে পাশে আছে একজিট পোলের সাময়িক মদির উত্তেজনা, যা জোগান দেয় ওই সেই রাশিবিজ্ঞান। সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ যখন আমরা টিভি চ্যানেলে দেখি, দেখা যায় প্রথম বলটি মাটিতে পড়া মাত্র ব্যাটিং সাইডের সম্ভাব্য শেষ স্কোর (যাকে বলে প্রোজেক্টেড স্কোর ) পর্দায় দেখানো হতে থাকে —- এখানেও আসলে সেই স্ট্যাটিসটিক্স-এরই খেলা। এইখানেই আমার মনে হয়েছিল রাশিবিজ্ঞানের ফ্যাসিনেটিং মাত্রাটুকু, সে যেন অনেকটাই মিটিয়ে দিল এই আগাম জানবার তৃষ্ণা— কোনো ব্যাভিচারি ও বুজরুক ফিকিরের পথ এড়িয়ে গিয়েই। এই গাণিতিক অনুমান যে একটা স্বীকৃত পথ, পরে তার দিশা দেখাবে সম্ভাব্যতার তত্ত্ব (Theory of Probability) , আরো জটিল তার হিসেব-নিকেশ —- কিন্তু তার কোনো মুখোশ নেই। রাশিবিজ্ঞানী বিপন্ন মানুষকে বলেন না, হাতে সবুজ পাথরের আংটি পরলে তার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হবে বা লাল পাথর পড়লে হবে ছেলের চাকরি বা মেয়ের বিয়ে—- এইখানেই তার সত্যের জোর, তার সৌন্দর্য— সত্য আর সুন্দর যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এ তো কোনো কবিরই অনন্য বাচন। তবে রাশিবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিষয়ে একটা বদনাম আছে। একদা ‘ অচলপত্র’ সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র সান্যাল-মশাই ফুট কেটে লিখেছিলেন, সরকারি দফতরের পরিসংখ্যান আর ডাঁহা মিথ্যে আসলে একই ব্যাপার। কথাটা যে ভুল নয়, তা আমাদের দেশে অন্তত বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সদ্য-শেষ-করা কোভিড মহামারির সময়েও দেখেছি, সরকারি তথ্যে যখন কোভিডের বলি হাতে-গোনা, ঠিক তখনই নাগাড়ে লাশ ভেসে আসছিল জাহ্নবীস্রোতে। সারা রাজ্যে যখন ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ায় প্রকোপ তুঙ্গে তখনও সরকারি পরিসংখ্যান মুখ লুকোয় ক্ষমতার টেবিলের নিচে। আমাদের স্বাধীন দেশে পুলিশ বা সেনাদল যতবার গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে তার সরকারি তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের তথ্যের ফারাক বিস্তর। আসলে, পরিসংখ্যান সব সময় ঠিক বলে না বা তাকে বলতে দেওয়া হয় না। অথচ তথ্য-পরিসংখ্যান জোগাড় করে নিয়েই তৈরি হয় আমাদের দেশের যাবতীয় পরিকল্পনা ; ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বা জনগণনা থেকে পাওয়া বিস্তৃত তথ্যের গাণিতিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে দেশের জনকল্যাণের অভিমুখ। এমনকি, ভোটের মরসুমে যে নির্বাচনী সমীক্ষা চ্যানেলে চ্যানেলে বিঘোষিত হতে থাকে, তার পেছনে বিজ্ঞান থাকলেও তা কি সব সময়েই খুব নিরপেক্ষ থাকতে পারে ? নাকি, সে আবার কোথাও গণিত ভুলে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হয়ে খেলতে নেমে পড়ে ?
আসলে ওই আণবিক বোমার মতোই রাশিবিজ্ঞানী-পরিসংখ্যানবিদরাও কোথাও কোথাও আপস করতে বাধ্য হন। তখন শাসকের বেপরোয়া তর্জনীতে পাল্টে যায় জি ডি পি র হিসেব, মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক, শিল্প-বিনিয়োগের খতিয়ান। ঋণ-খেলাপি ‘দেশপ্রেমিক’রা যতই বিবাগী হয়ে পরদেশি হয়ে যাক না কেন, ‘নিখুঁত’ সরকারি পরিসংখ্যানে ভ্যানিশ হয়ে যায় সব ‘বেহিসেব’। আমরা এমনও শুনতে পাই, রাশিবিজ্ঞানের ম্যাজিকে রক্তের চিনির মতোই হঠাৎ কমে যায় দেশের গরিব মানুষের সংখ্যা, বদলে যায় ঋণদায়ে আত্মঘাতী কৃষকের সচল স্কোরবোর্ড। কী আর করা যাবে, গণিত কখনও কখনো এতটাই অসহায় !
মনে পড়ে গেল, কলকাতায় ছেচল্লিশের দাঙ্গার (আগস্ট ১৯৪৬) সময় প্রখ্যাত গণিতবিদ ও পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা যাদব চক্রবর্তীর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁর পুরো পরিবারকে আক্রমণ করেছিল দুষ্কৃতিরা — গণিতের দোহাই দিয়ে তিনি চরম লাঞ্ছনা থেকে নিজেকে ও তাঁর পরিবারকে রক্ষা করতে পারেননি!
ক্রমশ
পরের পর্ব ২৭ জানুয়ারি
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।