এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভোটবাক্স  লোকসভা - ২০২৪

  • যে যেখানে দাঁড়িয়ে

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভোটবাক্স | লোকসভা - ২০২৪ | ০৩ জুন ২০২৪ | ৫১৩ বার পঠিত
  • যে যেখানে দাঁড়িয়ে
    প্রবুদ্ধ বাগচী 

    সাতপাকে বাঁধা লোকসভার নির্বাচন শেষ । এবার ম্যারাপ খোলার পালা ।সেই সঙ্গে  মাঠে মাঠে গত দেড় মাসের জমা শুকনো পাতা আর চাপা পড়া ঘাসের আসন্ন বর্ষার অপেক্ষা। অনেক ধুলো উড়ল, অনেক কথা বলা হল, অনেক আশার মেঘ ভেসে বেড়াল নীল আকাশে। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই দেশের সব থেকে বড় মেগা-ইভেন্টে ছুটির ঘন্টা বাজবে। পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচনকর্মী, চ্যানেলে চ্যানেলের সাংবাদিক আর অ্যাংকররা একটু নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবেন। তারপরেই আসবে আবার সরকার তৈরির হিসেবনিকেশ। পৃথিবীর সবথেকে বড় গণতন্ত্রের জন্য এটাও এক বড় মিডিয়া হাইপ। বিশেষত এবারের নির্বাচন অনেকদিন পরে নানা কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল দেশের ভোটদাতাদের কাছে। একই কথা বলা চলে এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সব মিলিয়ে কী হবে ? এ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বিবাদ-বিতর্কের কমতি নেই। অমর্ত্য সেন মশাই ভারতীয়দের যুক্তিশীল বা আর্গুমেন্টেটিভ হওয়ার কথা বলেছিলেন। তাঁর সেই প্রত্যাশা কতদূর মিটেছে জানা নেই তবে টিভি চ্যানেলে হরেক রাজনৈতিক যুক্তিতর্কের ‘মিডিয়া শো’ আজকাল সকলে ভাল খায় যার দরুন ওই প্রাইম-টাইমে বিজ্ঞাপনী আয় প্রচুর। 

        আমরা আমাদের আলোচনা সীমিত রাখছি শুধু এই রাজ্যের কয়েকটি সম্ভাব্যতার ওপর।  নানান মাধ্যম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে ও নানা ধরনের প্রচার বিশ্লেষণ দেখে সাদা চোখে কয়েকটা কথা আমার মনে হয়েছে। এই রাজ্যে এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের ধরন ছিল খুব ঘোলাটে। বিগত বিধানসভায় রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস দলের শোচনীয় পরাজয় ও আসন সংখ্যার নিরিখে শূন্যে নেমে যাওয়ায় সাধারণভাবে মনে হয়েছিল টি এম সি ও বিজেপি যেন কিছুটা অ্যাডভান্টেজ নিয়েই খেলা শুরু করবে। কিন্তু ২০২১ সালের পরাজয়ের পর থেকে সি পি এম এর নেতৃত্বে বাম ব্রিগেড কিন্তু আস্তে আস্তে সাংগঠনিক শক্তিকে মেরামত করতে করতে এগিয়েছে। রাজ্য সম্পাদক হিসেবে মহম্মদ সেলিমের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবণতা বসে যাওয়া কর্মীদের জন্যও ছিল  স্টিমুল্যান্ট। আর বিগত বিধানসভার পরে পরেই রাজ্যের একের পর এক বিপুল দুর্নীতির ‘ভান্ডাফোড়’ টিএমসিকে খুব মসৃণভাবে পা ফেলতে দেয়নি। শিক্ষা নিয়ে চাকরি নিয়ে খাদ্যশস্য নিয়ে ঘোর দুর্নীতিতে বাংলার মন্ত্রী উপাচার্য শিক্ষা দফতরের মাথারা একসাথে জেলে ঢুকেছেন —- স্বাধীনতার পরে বাংলায় এই উদাহরণ নেই। এবং নানা মিডিয়ার চর্চায় এটাও ইঙ্গিত মিলেছে আরো উঁচুতলার প্রশাসন এর সঙ্গে যুক্ত, নানা প্রতিবন্ধকতায় তাঁদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্যপ্রমাণ কি কতটা আছে কেউ জানেন না কিন্তু পাবলিক পারসেপশন বলে একটা বিষয় আছে,  তাতে টিএমসি সুপ্রিমো থেকে তাঁর সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড সবাই একটা অদৃশ্য জিজ্ঞাসাচিহ্নের সামনে আছেন। আর কেন্দ্রীয় শাসক দলের সঙ্গে বাড়তি সখ্যের সূত্রে যে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত রাজ্যে ক্রমশ ধার হারিয়ে ফেলছে এটাও আর অস্বীকার করার জায়গায় নেই, হাইকোর্টের বিচারপতি অবধি প্রকাশ্যে একথা বলে ফেলেছেন। সারদা কান্ডের তদন্তের জন্য লোকসভার এথিক্স কমিটির অনুমোদন আজ প্রায় দশ বছরেও এসে পৌঁছায়নি, ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। প্রশ্ন উঠবে না ? শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি ও কয়লা বালি পাচারে অভিযুক্ত যুব তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্র চোখ এড়িয়ে বিদেশে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন, এটা কি কেন্দ্রের অভিবাসন দফতরের সঙ্গে যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব ? যেখানে কিছু কিছু অভিযুক্ত ‘প্রভাবশালী’ এই পরিচয়ে জেলে বন্দি সেখানে কয়লা পাচার কান্ডের আরেক অভিযুক্ত অনুপ মাজি (লালা) কীভাবে একদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে গেলে এর কৈফিয়ত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি দেবেন না ? 

        এইসব পূর্বাপর বিবেচনা করে টিএমসির এই ভোটের প্রচার ছিল একেবারেই অন্যরকম ও মূলত অপ্রাসঙ্গিক। নিজেদের সরকারের অনুদান-নীতিকে তারা সামনে এনেছেন প্রচারে —-- লোকসভা ভোটের সঙ্গে যার কোনো যোগই নেই। দেওয়ালে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ এর ছবি এঁকে বা কন্যাশ্রীর কথা আউড়ে দিল্লির ভোটে কী হবে কেউই বুঝতে পারেননি। লোকসভায় যিনিই জিতুন রাজ্য সরকারের ঘোষিত প্রকল্প বন্ধ বা চালু করার তাঁর কোনও ভূমিকা থাকে না। ভোটের বাজারে এই সত্যি না বলে তারা কি একরকম ভয় দেখিয়ে রাখলেন মানুষকে? সভায় সভায় তাঁরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, অন্য কেউ জিতলে সমস্ত অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে।  এখানে অবশ্য বিজেপির প্রধান সেনাপতি শুভেন্দুর একটা কথা খেয়াল করতে হবে। তিনি বারবার বলেছেন বিজেপি রাজ্যে কুড়িটার বেশি আসন পেলে এখনকার সরকারকে ফেলে দেওয়া হবে। এর আগেও তিনি এরকম দিন তারিখ বার ঘোষণা করে জন মানসে ‘খেলো’ প্রতিপন্ন হয়েছেন আর এই ধরনের মন্তব্য সুস্থ গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ নয়। বরং এই জুজু দেখিয়ে টিএমসি তাঁদের হরেকরকম ‘শ্রী’  আটকে দেওয়া হবে এমন এক বিকল্প প্রচারের অক্সিজেন পেয়ে যায়। গেছেও। একেকটা সভায় টিএমসি বক্তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে তারা যেন পাড়ার পুরসভার ভোটের প্রচার করতে এসেছেন।

      একইভাবে বিজেপি তাঁদের সেরা সেরা প্রচারক নিয়ে এসেও খুব আস্থা জাগানোর মতো কিছু বলেননি। তাঁদের খুব পছন্দের ‘ইয়র্কার’ ছিল  ধর্মীয় মেরুকরণ —- তবু রাম মন্দিরের মেগা ইভেন্ট যেভাবে প্রচারের পাল টেনে নিয়ে যাবে বলে তারা মনে করেছিলেন তা হয়নি। এই রাজ্য শুধু নয় কর্ণাটক, অন্ধ্র, বিহার, মহারাষ্ট্রের সাধারণ তরুণ-যুবাদের বলতে শুনেছি কাজ না পাওয়ার কথা, তারা তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন টিভির ক্যামেরায়। অথচ দেশজোড়া বেরোজগারির প্রশ্নটা বিজেপির ভাষ্যে প্রায় উপেক্ষিত। বরং ২০১৪-তে বছরে দুকোটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যে আদপে ছিল বেকারদের জন্য ধাপ্পাবাজি এটা সবাই ধরে ফেলেছেন। দশ বছর সরকার চালানোর পর কার্যত বিজেপির সামনে কোনো ইস্যুই ছিল না। তাই শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী ধ্যানে বসার আগে অবধি মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়া, মোগলাই খানা, দেশের সম্পদ কেড়ে মুসলিমদের দেওয়া হবে এইসব নির্লজ্জ মিথ্যে প্রচার করে নিজেকে টেনে নিচে নামিয়েছেন। দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রীর মুখে এত অসত্য এত অবান্তর এত কুৎসিত কথা আমরা ইতিপূর্বে শুনিনি। বিপরীতপক্ষে নিজেকে অবতার বলে প্রচার করে মানুষের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়া বা ২০৪৭ সালের উন্নত ভারতের ‘আজগুবি স্বপ্ন’  ফেরি করা —এর সবগুলোই ছিল ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ ধরনের। মাঝে মধ্যে এসে অবশ্য বিজেপি এই রাজ্যের নানা দুর্নীতির কথা তুলেছেন এবং তাঁর প্রতিবিধানের কথা বলেছেন। কিন্তু এর সারসত্য নিয়েও তো ঘোর সংশয়। রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে খোদ শুভেন্দুর নাম জড়িয়ে আছে, সারদা নারদায় তিনি আপাত অভিযুক্ত —- আছে আরো কিছু চুনোপুটির নাম যারা এখন বিজেপির ঘরে। যে ভাইপো-র দুর্নীতি নিয়ে তারা এত সরব তাঁর ‘কুকীর্তির’ জরুরি সাক্ষী কালিঘাটের কাকুর কণ্ঠস্বর আজও তদন্তের সহায় হতে পারল না, শোনা যাচ্ছে পিসির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সাক্ষাতের পরেই নাকি কয়লাপাচারের চার্জশিট থেকে ভাইপোর নাম বাদ পড়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখা গেল, ভাইপোর ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রটিতে জোরালো লড়াই দেওয়ার বদলে কার্যত দুর্বল প্রার্থী দিয়ে এবং তারকা প্রচারকদের তাঁর ধারেকাছে না নিয়ে গিয়ে বিজেপি তাঁকে একরকম ওয়াকওভার-ই দিয়ে দিল। আর দুর্নীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে তো বিজেপি চ্যাম্পিয়ন। ইলেক্টরাল বন্ড কান্ডে, পি এম কেয়ার্স ফান্ডে তাঁদের তোলাবাজির ছাপ স্পষ্ট। সেইসঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যে কোনো-না-কোনো আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নেতাদের সাদরে নিজেদের দলে ঠাই দিয়ে তারা তো ওয়াশিং মেশিন অভিধাই পেয়ে গেছেন!
       বিজেপি আর টিএমসির এই বাইনারির ভিতরে দাঁড়িয়ে এবারেই রাজ্যের বাম-কংগ্রেস জোট একটা নতুন ভাষ্য লোকসভার ভোটে নিয়ে এসেছেন। বিজেপি আর টিএমসি যে আসলে নিজেদের মধ্যে গোপন সখ্য রেখে চলে এই কথাটা এর আগেও তারা বলার চেষ্টা করেছেন — কিন্তু প্রচারটা তেমন দানা বাঁধেনি। কিন্তু গত তিন বছরের রাজ্য-রাজনীতি সেই ‘গোপন সেটিং’-কে কার্যত প্রামাণ্য করে তুলেছে। আসানসোলের দাঙ্গায় অভিযুক্ত, যাদবপুরের ছাত্রনিগ্রহে যুক্ত বাবুল সুপ্রিয়-র টিএমসিতে ফেরা ও এক ধাক্কায় মন্ত্রিত্ব পাওয়া আমাদের কাছে ভাল বার্তা দেয়নি। এর পরে শুরু হয় বিধানসভায় বিজেপির হয়ে জেতা বিধায়কদের পদত্যাগ না-করে টিএমসিতে ফিরে আসা। এঁদের সর্দার মুকুল রায় ইদানিং বলছেন যা বিজেপি তাই তৃণমূল ! সত্যিই তো এই লোকসভার প্রার্থী নির্বাচনে আমরা দেখলাম টিএমসির অনেকগুলি প্রার্থী  ‘দলবদলু’ বিজেপি হিসেবে টিকিট পেয়ে গেলেন আর একইভাবে টিএমসি-র শিবির বদল করে তারা বিজেপির ঘরেও সানন্দে ও সসম্মানে ভিড়ে গেলেন। ১০মার্চ ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সভায় অর্জুন সিং তাঁর বাহিনী নিয়ে টিএমসির সভায় এসেছিলেন, সভা থেকে যখন তাঁর নাম ব্যারাকপুরের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হল না — ফেরার পথে তিনি ভাটপাড়ায় তাঁর দলীয় অফিসে দিদির ছবি নামিয়ে মোদির ছবি টাঙিয়ে দিলেন এবং মোদির দল তাঁকে প্রার্থীপদও দিয়ে দিল —-কী অবাধ আর অনায়াস চলাচল ! যে একশো দিনের কাজ বা আবাস দুর্নীতি নিয়ে ভাজপা সরব, যেখানে তাঁদের হাতে পঞ্চায়েত ছিল তারাও একইভাবে অর্থ তছরুপ করেছেন। উদাহরণ বাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

      এই জায়গায় এবারের বাম কংগ্রেস জোট অনেকটা জোরের সঙ্গে ইস্যুগুলো সামনে এনেছেন, পর্দা ফাঁস করেছেন এই গোপন দাম্পত্যের —-- মানুষও নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন এই সখ্য। পরিবর্তে অনেকদিন বাদে বাম প্রার্থীরা কিছু মৌলিক দাবির কথা তুলেছেন যা নির্বাচনের ফাঁকা দামামায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে কাজের অধিকারের দাবি, চুক্তি চাকরির বদলে স্থায়ী চাকরির দাবি, শিক্ষাকে কলেজস্তর অবধি অবৈতনিক করার দাবি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো বেশি উন্নত করার দাবি ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশে পাশে শিল্প স্থাপনে রাষ্ট্রীয় পুঁজির বেশি অংশগ্রহণ, পরিবেশবান্ধব শিল্পের প্রসার এগুলির কথাও বলা হয়েছে। এর প্রতিটিই সংগত এবং দেশজোড়া কর্মসংস্থানের অভাবের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বামেদের তরুণ ও প্রবীণ প্রার্থীরা উদয়াস্ত খেটে এগুলোকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন যা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। যে ফ্যাসিবাদের উত্থানের আশঙ্কার কথা আজ বলা হচ্ছে, ঐতিহাসিকভাবে তার জন্য দরকার হয় এক পোক্ত বেকার বাহিনী, সেই বাহিনীর ভিত্তি ক্রমশ পাকা হচ্ছে। অনেকেই হয়তো জানেন, ২০১৯ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে আসার পরে ‘নমো ব্রিগেড’ নামক একটি সংস্থা স্বল্প বেতনে অনেক কর্মী নিয়োগ করেছেন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের জন্য। কাজেই বামপন্থীরা যে ‘রুটি রুজি হকে’র কথা বলে এবার প্রচারের অভিমুখকে কিছু অপ্রাসঙ্গিক খেউড় থেকে বার করে আনার চেষ্টা করলেন তা একটি বলার মতো কথা।  খুব সংগত কারণেই বামপন্থীরা এবারে মানুষের সমর্থন প্রত্যাশা করেন।

     কিন্তু সম্ভাব্যতা কয়েকটি। বিজেপি যদি পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং বামপন্থীরা যদি নিজেদের ক্ষমতা কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারে তাতে সংসদের ভিতর তাঁদের সোচ্চার কন্ঠ আমরা নিশ্চয়ই শুনব। কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজবে না। কারণ, তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরলে বিজেপি আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আরও জোরাল রোড রোলার চালাবে এটা সুনিশ্চিত। শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ অত্যাবশকীয় ক্ষেত্রগুলিতে আরও আরও বেসরকারি বিনিয়োগকে প্রোমোট করে তাঁরা মানুষের ওপর বোঝা চাপাতে কসুর করবে না। আর সংসদে বিরোধী কন্ঠকে এখনই তাঁরা গুরুত্বহীন বলে মনে করে, এই মনোভাব রাতারাতি পাল্টে যাবে এমন নয়। ফলে নির্বাচকমণ্ডলীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আদপে রূপায়ন করা অসাধ্য। আর যদি ইন্ডিয়া জোট সরকার গড়ার মতো অবস্থায় আসেন এবং বামপন্থীদের সমর্থন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাহলে বাম সাংসদরা কিছুটা সুবিধেজনক অবস্থায় থেকে নিজেদের দাবিগুলো পূরণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ২০০৪ সালে যেভাবে ষাটের ওপর সাংসদ নিয়ে তাঁরা ইউ পি এ সরকারের কিছুটা নিয়ামক হতে পেরেছিলেন এবার বামশক্তি যতই সংহত হোক সারা দেশে ওই পরিমাণ আসন তাঁরা প্রত্যাশা করছেন বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে টিএমসির ভূমিকা কী হবে তাও বিচার্য। টিএমসি দলের সঙ্গে কোনো নীতির যোগ আছে এত বড় ‘অভিযোগ’ আজ অবধি কেউ তুলতে পারেননি। তারা যেখানে সুবিধে সেখানেই যাবেন। ফলে ইন্ডিয়া জোটে যদি সিপিএম নিয়ামক হতে থাকে তাঁরা সেই ধার আর মাড়াবেন না —-- ইতিমধ্যেই সেই প্রসঙ্গ তাঁদের সুপ্রিমো তুলে দিয়েছেন। বিপরীতে  টিএমসির কাছে যদি ভাল সাংসদ সংখ্যা থাকে ইন্ডিয়া জোটের কাছে তার ‘দরদাম’ ভাল হবে ও তাঁরা সেটাকে কাজে লাগাবেন সিপিএমকে দূরে রাখার জন্য। আর এটাও ঠিক রাজ্যের প্রদেশকংগ্রেস যাই বলুন দিল্লির হাইকম্যান্ড কখনো মমতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছেদ করেনি। মল্লিকার্জুন খড়্গে বারবার বিবৃতি দিয়ে ওঁকে কনফিডেন্সে রেখেছেন এমনকি অধীর চৌধুরীর প্রচারেও দিল্লির কেউ সেভাবে আসেননি। এই হিসেব ঠিক থাকলে ইন্ডিয়ায় মমতার ভূমিকা জোরদার হবে আর বাম সাংসদরা নিজেদের কর্মসূচি কী কতটা রূপায়ণ করতে পারবেন সেটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মুখে।

        এর পাশাপাশি মনে রাখা দরকার, আগামী দু-বছরের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভার ভোট। অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি ও ওবিসি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত রায় এখনো সুপ্রিম কোর্টে আংশিক চাপা পড়ে আছে। সেগুলি সামনে এলে রাজ্যের সরকারি দল হিসেবে টিএমসিকে তার মোকাবিলা করতে হবে। কেন্দ্রে বিজেপি থাকলে তাঁরা এখনকার মতোই স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে বামপন্থীরা চাইবেন এগুলোকে সামনে এনে নতুন করে জনমত গড়তে। এই জায়গাটায় টিএমসির একটা রক্ষাকবচ দরকার। তারা এতদিন বিজেপির থেকে মোটামুটি একটা আশ্বাস পেয়েছিলেন —- নতুন সরকারে যোগ দিলে সেই  ‘কবচ’ তাঁরা আগেই জোগাড় করে নেবেন। সেক্ষেত্রে বামপন্থীরা কি কেন্দ্রের সরকারের থেকে খুব বেশি কিছু আদায় করতে পারবেন ? আরও একটা সম্ভাবনা হল, বিজেপি যদি অল্প কিছু আসনের জন্য ম্যাজিক ফিগার থেকে আটকে যায় তাঁরা কিন্তু টিএমসির সাহায্য চাইতে পারেন। এতদিন বিজেপি-বিরোধিতা করে তাঁদের পক্ষে কি বিজেপির হাত ধরা সম্ভব ? তাঁদের এযাবৎ ট্র্যাক রেকর্ড এর কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। তবে একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনার যে প্রাপ্য টাকার কথা টিএমসি দল বারবার বলেন তাঁর কিন্তু এখনো কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। কে বলতে পারে, ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে বিজেপি সব পুরোনো প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার শর্তে টিএমসির সমর্থন আদায় করে নেবে না? তাঁর সুবিধে হল এখানে তিনি ‘রাজ্যের স্বার্থে’ কেন্দ্রের সরকারকে সমর্থন করছেন এরকম একটা একজিট রুট পেয়ে যাবেন খুব সহজেই। তাছাড়া, রাজ্যে বামপন্থীরা বেশি আসন পেলে তাঁর পক্ষে বিজেপির পাশে থাকাই সমীচিন। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, টি এম সি প্রতিষ্ঠালগ্নেই তিনি বলেছিলেন, বিজেপি তাঁর স্বাভাবিক বন্ধু ( ন্যাচারাল অ্যালি) ।  এই  সমস্ত  প্রশ্নেরই  জবাব  মেলার জন্য আর মাত্র  কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভোটবাক্স | ০৩ জুন ২০২৪ | ৫১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ০৩ জুন ২০২৪ ২৩:৩৭532680
  • এরকম একটি পোস্টই খুঁজছিলাম। খুব সুন্দর আলোচনা। বামেদের দিকে যদি সত্যি মুখ ফেরায় ভোটারগণ ,তাহলে সত্যি একটি দারুণ ব্যাপার হবে শুধু ভারতবর্ষের জন্য না পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্যও বটে।  
  • | ০৪ জুন ২০২৪ ১১:৪৫532687
  • হুঁ বেশ গোছানো বক্তব্য। ঠিকঠাক লাগল। 
     
    (গোটা লেখাটা বোধহয় বোল্ডে পোস্ট হয়ে গেছে। একটু দেখবেন প্লীজ। বড্ড চোখে লাগছে।)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন