এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভোটবাক্স  বিধানসভা-২০২১

  • 'সাদা পৃষ্ঠা,তোমার সঙ্গে' 

    Bagchi P লেখকের গ্রাহক হোন
    ভোটবাক্স | বিধানসভা-২০২১ | ০৪ মে ২০২১ | ২৭২৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)
  • 'সাদা পৃষ্ঠা, তোমার সঙ্গে' : প্রবুদ্ধ বাগচী

    আমাদের প্রজন্মটা প্রায় পুরোটাই বেড়ে উঠেছে রাজ্যের বামফ্রন্ট শাসনের আওতায়। আমাদের বাল্যকাল মানে বেশিটাই জ্যোতিবাবু। তার রাশভারি অস্তিত্ব। তার পুরো বাক্য শেষ না-করা বক্তব্য রাখা। মাঝে মাঝে শাণিত বিদ্রূপ। আমাদের কাছে বামফ্রন্ট মানে জ্যোতিবাবু। আর ছিলেন কয়েকজন শ্রদ্ধেয় মানুষ। বিনয় চৌধুরী, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়। বাবার মুখে শুনেছিলাম প্রথম বামফ্রন্টের মন্ত্রী কৃষ্ণনগরের অমৃতেন্দু মূখোপাধ্যায়ের কথা, স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার অপরাধে পুলিশ যার দুইহাতের নখ উপড়ে নিয়েছিল। ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কৃষ্ণপদ ঘোষ, পরে শান্তি ঘটক। ছিলেন শরিক দলের ত্রিদিব চৌধুরী যাকে নাকি লোকসভায় হারানো যেত না। ছিলেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সকলের দেবুদা। ফরোয়ার্ড ব্লকের কানাই ভট্টাচার্য। সিপি আই এর গীতা মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিত গুপ্ত। আর কেন্দ্র রাজ্য ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে সাড়া ফেলে দেওয়া অশোক মিত্র। বিরোধী বলতে কংগ্রেস, তখন নাম ছিল কংগ্রেস (ই)। রাজ্যে তাদের নেতা প্রিয়রঞ্জন, সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সত্য বাপুলি, জ্ঞান সিং সোহন পাল। আর দিল্লিতে প্রণব মুখার্জি, অশোক সেন, ভোলা সেন, দেবী পাল, অজিত পাঁজা। লোকসভা বা বিধানসভার ভোট হত মাঝে মাঝে। তখন বাড়ির বাবা মাকে একটু উৎসাহী হতে দেখতাম। আমাদের বাড়িতে রাখা হত ‘স্টেটসম্যান’, সেই কাগজের পাশে পাশে চোখে আসত ‘যুগান্তর’, ‘আনন্দবাজার’। ভোট এলে ইন্দিরা গান্ধী উড়ে আসতেন সভা করতে। রেডিওতে তার খবর বলত। আর ফল বেরোনোর দিন আকাশবাণী কলকাতার ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেওয়া বিশেষ বুলেটিন, যার মধ্যে একটা আশ্চর্য শব্দ ছিল “নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী”---- অদ্ভুত বিরোধাভাস, এটা উচ্চারণ না করলে খবর সম্পূর্ণ হত না। ১৯৮২র এমনই এক প্রভাতী বুলেটিনে শুনেছিলাম কাশীপুর বিধানসভা আসন থেকে পরাজিত হয়েছেন বামফ্রন্টের তরুণ প্রার্থী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

    দিন পাল্টায় । আবার সেই অর্থে দিন কখনো কখনো পাল্টায়ও না। গত ২মে টিভি চ্যানেলে একের পর এক ব্রেকিং নিউজ যখন উড়ে আসছিল, ঘরে ঢুকে পড়া চড়ুইপাখির মতো, একদিকে চাপা আনন্দ অন্যদিকে দুপুরের পর থেকে কেমন যেন এক তেতো বিষাদ। মহাপরাক্রান্ত হিন্দুত্ব বাহিনীর রথ রুখে দেওয়ায় ঢল নামা খুশি অথচ ২৯৪টি আসনের একটাতেও বসার যোগ্যতা পেলেন না রাজ্যের বামফ্রন্টের একজনও মানুষ! সম্ভবত ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম। ৭২ সালের ‘মানু’-বাহিনীর রিগিং-কলঙ্কিত ভোটেও বামফ্রন্টের হাত এমন শূন্য ছিল না। আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে বামফ্রন্টের বেড়ে ওঠা, আমাদের স্মৃতির সরণিতে বামমনস্ক কিছু মানুষের যাতায়াত। এটা অস্বীকার করি কী করে, আমাদের আলো-আঁধারি কৈশোরের অভিজ্ঞতায় আমরা জেনে গিয়েছিলাম বামফ্রন্ট গরিবের পার্টি, গ্রামই তাদের জোরের জায়গা। বালকবেলায় তো আর ভূমি-সংস্কার বা অপারেশন বর্গার তাৎপর্য বুঝবার ক্ষমতা ছিল না কিন্তু একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল ---- একেবারে ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় যেসব ভিক্ষুকদের দেখতাম গৃহস্থ বাড়িতে রোজ কড়া নাড়তে, একটা সময় তাদের আসা-যাওয়া কমে গেল। শুনলাম, ওই যারা আসতেন তারা নাকি গ্রাম থেকে জীবিকার তাগিদে চলে আসতেন শহরে। এখন গ্রামের মানুষ কাজ পাচ্ছেন তাই আর তারা শহরে আসবেন কেন? কথাটা, পরে জেনেছি, ভুল নয়। সেই সময়ের বিধানসভা নির্বাচনের যেসব আবছায়া স্মৃতি, তাতে খুঁজে পাচ্ছি, কলকাতাসহ বৃহত্তর শহুরে এলাকায় কংগ্রেসের বাঁধা ভোট, অথচ গ্রামের ভোট বছরের পর বছর টিকিয়ে রেখেছে বামফ্রন্টের সরকার। শহরের সুখী-সম্পন্ন মানুষরা বাম নেতাদের পছন্দ করেন না কারণ তাঁরা ‘ছোটলোকদের’ মাথায় তুলেছেন। আর গরিব-গুরবো মানুষ বামফ্রন্টেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের মর্যাদা, তাঁদের আত্মসম্মান --- তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন লাল পার্টি তাঁদের পার্টি, তাঁদের আপদে বিপদে সহায়। সারা দেশে সব রাজ্যে সরকার বদল হয়, আমাদের রাজ্যে হয় না। জ্যোতিবাবু প্রকাশ্যেই বলতেন, কংগ্রেস তো সমাজবিরোধীদের পার্টি! কোনো কংগ্রেস নেতার সাহস হত না এর বিরোধিতা করার। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে যেবার রাজ্যের বিধানসভা ভোটে প্রচারে এলেন, সব জায়গায় বলে বেড়ালেন, বাসুজির বয়স হয়েছে ওঁকে আপনারা রিটায়ার করিয়ে দিন। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, চিন্তা নেই, রাজীবের রিটায়ার করার ব্যবস্থাই আমরা করে দেব। প্রচুর আশা জাগিয়েও সেইবার (১৯৮৭) কংগ্রেসের আসন মোটে ৪০টা। পরিবর্তে, কংগ্রেসের নিজেদের মধ্যে তখন গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ঝগড়া। ১৯৮০-তে প্রকাশিত হওয়া ‘আজকাল’ পত্রিকা এইসব খবর টুকরো টুকরো করে ছাপিয়ে দিত। আমার এক প্রয়াত সহপাঠী বলত, ওইজন্যই বাড়িতে ‘আজকাল’ কিনি। আমরাও বাড়িতে তখন ‘আজকাল’ রাখি।

    কথাটা ঠিক, আশির দশকের মাঝামাঝি যখন আমরা কলেজ – ইউনিভার্সিটিতে তখনও রাজ্যে বামফ্রন্টের সাম্রাজ্য নিটোল এবং কার্যত কোনও বিরোধীপক্ষ নেই। যদিও দ্বিতীয় বামফ্রন্টের মাঝপথেই অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র ছেড়ে চলে গেছেন। পরে প্রকাশ্য হয়েছে মেধার থেকে দলের আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টাই ঋজু ওই মানুষটির কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আজ আর বলতে কোনও দ্বিধা নেই, এর অনেক বছর পরে আমার সঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অশোক মিত্র বলেছিলেন, তিনি দ্বিতীয় বামফ্রন্টের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরেই জ্যোতিবাবুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, আসুন আমরা সরকার ছেড়ে আবার মানুষের কাছে ফিরে যাই। কারণ, দশ বছর সরকারে থাকার পর তাঁর উপলব্ধি ছিল বামফ্রন্ট আর মানুষের পাশে থাকতে পারছে না। একথা আজ কেউ বিশ্বাস নাও করতে পারেন কারণ তাঁর নিষেধ থাকায় এই বক্তব্য কোথাও নথিবদ্ধ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব দিনগুলিতে বামফ্রন্টের ছাত্র সংগঠনের প্রতাপ আমরা দেখেছি, আর যাই হোক তাতে কোনো নিবেদিত রাজনীতির ছাঁচ ছিল বলে মনে হয় না। ওইসময়েই তো জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে সরকারের ভূমিকা আমাদের মতো তরুণদের পছন্দ হয়নি, পছন্দ হয়নি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের আন্দোলনে সরকারের খবরদারি। সেটা সেই সময় যখন রাজ্যে বন্ধ কারখানার সংখ্যা বেড়ে চলেছে একের পর এক। অথচ সবথেকে বড় দুটো শ্রমিক সংগঠন সিটু ও এ আইটিইউসি-র ভূমিকা কাছ থেকে দেখেছি, আদৌ তা শ্রমিকের পক্ষে নয়। তারাতলা ও গার্ডেনরিচ শিল্পাঞ্চলে তখন বিকল্প একটি তৃতীয় ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠতে চাইছিল, তাকে আঁতুড়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে শ্রমিক-কৃষকের দলের পান্ডারা। এমনকি এই নিয়ে প্রতিবাদ উঠে এসেছে সিটুর কোনো কোনো নেতার তরফেই ---- তারাতলা এলাকার খ্যাত সিটু নেতা কমল তেওয়ারি দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন নতুন শক্তির সঙ্গে। একই ঘটনা ঘটেছে চাপদানির নর্থ ব্রুক জুটমিলে, শ্রীরামপুরের ইন্ডিয়া জুট মিলে, বজবজের নিউ সেন্ট্রাল জুট মিলে। তখন ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকা ছিল এইসব খবর প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম আর কিছুটা ‘আজকাল’। এই দুই পত্রিকার কিছু অকুতোভয় সাংবাদিক ছিলেন যারা সরকার বিরোধী এইসব খবর করতেন। কলকাতার একটি সংগঠন সেই সময় বন্ধ কারখানার হাল হকিকত নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করেছিলেন --- ‘বোবাযুদ্ধ’ --- তাতে ধরা ছিল এইসব ছবি। শাসকদলের রোষে খুব কম জায়গাতেই এই ছবি দেখানো গিয়েছিল।

    আসলে এই সেই পর্ব যখন দরিদ্র মানুষের ‘নয়নের মণি’ বামফ্রন্ট আস্তে আস্তে খোলস ছাড়তে আরম্ভ করে। মানুষের দল থেকে ‘শাসক’ দলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তাঁদের আচরণ। ইতিমধ্যেই বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আহত করে সরকার ‘হোপ-৮৬’ নামের এক জলসার আয়োজন করে সমালোচিত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ১৯৭৮-এর বন্যায় গোটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যখন ভয়াবহ বন্যার ত্রাণে ঝাপিয়ে পড়েছিল তার আট বছরের মাথায় মানুষকে সস্তা বিনোদনে ডুবিয়ে রেখে আর্থিক ত্রাণ সংগ্রহ করতে হবে কেন? মানুষের ওপর কি নেতাদের আর ভরসা নেই? এইসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি বরং ‘হোপ – ৮৬’ র বিরুদ্ধে যখন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রতিবাদী মিছিল বেরিয়েছে তাদের কটু-কাটব্য করা হয়েছে। হয়তো সেই শুরু । এর অনেক পরে, তখন বামদল আরো আগ্রাসী, শিশির মঞ্চে মানবাধিকার বিষয়ক আলোচনাসভায় ডেপুটেশন দিতে আসা মানবাধিকার কর্মীদের পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করা হবে নভেম্বর ১৯৯৫-এ। উদ্ধত বাম পুলিশমন্ত্রী কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেবেন, তাঁদের ‘পেটানোর’; বলবেন, ‘হিউম্যান রাইট-টাইট’ তিনি বুঝে নেবেন! যার একটা উৎক্রান্তি আমরা দেখব সিঙ্গুর নন্দিগ্রাম পর্বে, যে যাত্রাপালার খলনায়কদের নাম এখন সকলেই জানেন।

    আর এই সিঙ্গুর নন্দিগ্রাম পর্বেই প্রথম খোলাখুলি দেখা গেল কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের নামতা বামফ্রন্ট বেশ ভালোভাবেই মুখস্ত করে ফেলেছে। মনে রাখতে হবে মাঝের এক-দেড় দশকে খোলা অর্থনীতির ঢেউ লেগেছে দেশের পালে, বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় দুলে উঠেছে সকলেই। নীতিগতভাবে সেই উদার অর্থনীতিকে বিরোধিতা করেছেন বাম নেতারা, প্রচুর বাংলা বনধ ডেকেছেন, নিবন্ধ লিখেছেন, লোকসভায় সোচ্চার হয়েছেন। অন্যদিকে ১৯৯৪-এ ঘোষণা করেছেন রাজ্যের নয়া শিল্পনীতি যাতে আসলে সেই কেন্দ্রীয় অর্থনীতির সঙ্গে আপসেরই সুর। হয়তো এত দূর এসে তাঁরা নতুন করে শুরু করতে চাইছিলেন ইনিংস। বলা হচ্ছিল দেশীয় ও বৃহৎ আন্তর্জাতিক পুঁজির সাহায্যে শিল্প করার কথা। তাতেই নাকি কর্মসংস্থান হবে। মনে পড়ে যায় এই আবহে অশোক মিত্র একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন সেদিন, শিরোনাম : ধীরে, টাটাবাবু বিড়লাবাবুরা, ধীরে। তিনি সমালোচিত হলেন। কারণ এইসব ‘বাবুদের’ ঘিরে উৎসাহ বাড়ছিল দলের ভিতরে। অন্যদিকে রাজ্যে জোরালো বিরোধিতার পটভূমি তৈরি হল ১৯৯৮এ তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানের পর। ইতিমধ্যে তখন পঞ্চায়েত ঘুঘুর বাসা, তাই পঞ্চায়েতে বিরোধীদের মনোনয়ন আটকে দেওয়া হয়। বিরোধী স্বর টের পেলেই তখন প্রত্যাঘাত এবং এই জলবায়ুতে গ্রামের মানুষ বুঝতে পারছিলেন তাঁরা এক ঘোর পার্টিতন্ত্রের ফাঁদে পড়েছেন। গ্রামে গাছের পাতাও আর নড়ে না দলের অনুমোদন না মিললে।নতুন প্রবাদ চালু হয়ে গেল, ওপরে ভগবান আর নীচে পঞ্চায়েত প্রধান --- এই দুই রক্ষাকর্তা ! দিন গড়ায় কিন্তু দিন পাল্টায় না। হয়তো একটু ব্যক্তিগত কথা, তবু না বলে পারছি না --- প্রশাসনিক একটা ট্রেনিং-এ গিয়ে শাসকদলের পঞ্চায়েত নীতি নিয়ে একটি খোলা আলোচনাসভায় কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্য করায় একজন জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষের হাতে বর্তমান প্রতিবেদককেও লাঞ্ছিত হতে হয়। (স্থানঃ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, সল্টলেক, সময়ঃ জুলাই ২০০০)। মনে পড়ে ২০০৩এর রক্তাক্ত পঞ্চায়েত, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার ইঙ্গিত এল আবার। এরই ষোলেকলা পূর্ণ হল ২০০৬-এ। ২৩৫ আসনের গর্ব ফুঁসে উঠল। সামনে এল সিঙ্গুর, নন্দিগ্রাম, লালগড়, নেতাই। অবাক হলেন গ্রামের মানুষ। যে মানুষগুলোকে তাঁরা এতদিন নিজেদের লোক বলে জেনে এসেছেন তাঁদের এই বিপরীত আচরণ? শুরু হল প্রতিরোধ। অবসর নেওয়া জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, আমাদের কৃষক সভার সঙ্গে আলোচনা করা হল না কেন? কে দেবেন জবাব? যিনি দিতে পারতেন তিনি তখন মনে করেন ইন্দোনেশিয়ার এক কুখ্যাত শিল্পপতির সঙ্গে তার বিনিয়োগ-চুক্তি হওয়ার দিনটাই নাকি তার জীবনের স্মরণীয় দিন! হায় গরিব মানুষের দল! হায় সর্বহারার মসিহা পার্টি ! হায় মার্ক্সবাদ! এর পরের ইতিহাস সবাই জানেন।

    ২০১৬তে সত্যিই মনে করা গেছিল তাঁরা আবার শক্তি সংহত করে ফিরে আসতে পারেন। অন্তত বিরোধী স্বর হিসেবে। কারণ প্রকাশ্যে তাঁরা বলছেন আত্মসমীক্ষার কথা। আমরা বিশ্বাস করেছি। তাই হোক। নতুন এক অগ্নিশুদ্ধ বামকেই দেখতে চাই আমরা । ইতিমধ্যে ২০১১-র নতুন সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল করছেন, কোথাও তাঁদের স্বৈরী কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় তার প্রতিস্পর্ধী স্বর? কোথায় নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সমর্থন ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় তাঁদের মরিয়া লড়াই? কোথায় মানুষের কাছে নতমস্তকে ক্ষমা চাইবার বিনতি? তাঁদের উপস্থিতি কেবল টিভি চ্যানেলে আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কোথায় গণআন্দোলন? অথচ সরকার যে কিছু লোপ্পা ক্যাচ তোলেননি তা কিন্তু নয়। হা হতোস্মি! উল্টে তাঁরা তখন হাত ধরেছেন চিরশত্রু কংগ্রেসের। সুধীর চক্রবর্তী বলেছিলেন, গ্রামগঞ্জের অনেক শহিদ বেদী আবার নতুন করে রক্তাক্ত হল! এরপর ২০১৯এর লোকসভা ভোট। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেখে আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম বিজেপির জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লোকসভায় প্রকৃত সোচ্চার হতে পারেন বামপন্থীরাই। ততদিনে বাজারে তাঁরা বের করে ফেলেছেন এক নতুন তত্ত্ব যার নাম ‘বিজেমূল’ --- তৃণমূলের বিজেপি-বিরোধিতা নাকি সাচ্চা নয়, সবই গট-আপ। বেশ, তাই হবে হয়তো। কিন্তু আবারও অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বামদলের ভোট পেয়েই রাজ্যে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধে ফেলল বিজেপির বিষাক্ত ব্রিগেড। পরিবর্তে, লোকসভায় শূন্য হয়ে গেলেন বামপন্থীরা, যে বাম সাংসদদের ধারালো বক্তব্যের জন্য কান পেতে থাকত সারা দেশের মানুষ। আর তারপরেই বেজে উঠল রাজ্যজয়ের ডঙ্কা। আর গত দু-বছরে আমরা যা যা দেখলাম সে তো সদ্য-অতীত। আর এই আবহে কী করলেন বামপন্থীরা? শাসক দলের ‘অন্যায়’ এর বিরুদ্ধে শুধু ফেসবুকে বিপ্লব করলেন, বাচালতা করলেন টিভি চ্যানেলে। আর গোড়ায় জল দিলেন ‘বিজেমূল’ থিওরির। বর্তমান শাসকদলের জনমুখী সমস্ত কাজকে নাকচ করলেন বিজেপির শেখানো ‘তোলাবাজি আর কাটমানি’র ডিসকোর্সে। ভুলেই গেলেন তাঁদেরই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ‘চোরেদের ক্যাবিনেট’ বলে একদিন ছেড়ে গিয়েছিলেন রাজ্যপাট! সবাই দেখেছেন, শুনেছেন গত তিনমাস ধরে তাঁরা কী কী করেছেন। কিন্তু আসলে টের পাননি বা হয়তো টের পাওয়ার চেষ্টা করেননি যে গরিব মানুষ আজকেও তাঁদের দিকে ফিরে আসেন নি। ‘তোলাবাজি’ বা ‘কাটমানি’ দিয়েও তাঁরা তৃণমূলের জনবাদী কর্মসূচিগুলিতেই ভরসা করছেন। শাসকদল কোনও মতাদর্শ ছাড়াই মানুষের কাছে পৌছাচ্ছেন, মানুষ তাঁদের ওপর ভরসা করছেন। ঠিক যেমন একসময় করতেন বাম নেতাদের। আর সেই পুরোনো কর্পোরেট-ভিত্তিক শিল্পায়নের মডেল নিয়ে আবারও তাঁরা মাতামাতি করলেন। বললেন সিঙ্গুরে আবার কারখানা করবেন। মানুষ আসলে এতে ভয় পেয়েছেন, ফিরে এসেছে পুরোনো দুঃস্বপ্নের ঘোর । এইসব এইসব এইসব। তারই ফল এক প্রকান্ড শূন্য । এবং শূন্য এক সাদা পাতা।

    আবারও বলি, বামফ্রন্ট আমাদের কৈশোরের অনুষঙ্গ, বাল্যের স্মৃতি। তারুণ্যের আবছা সংশয়, যৌবনের সন্দেহ। আর তা’ই উত্তর-যৌবনের এক দুঃসহ অবসানের অভিজ্ঞতা হয়ে ফিরে এলো আজ । বাংলার বিধানসভা বামহীন। যে মানুষ তাঁদের সাড়ে তিন দশক মাথায় তুলে রেখেছিলেন আজ তাঁরাই তাঁদের পথে বসালেন। নেতাদের নিয়ে ভাবি না, তাঁরা চিরকালই ঠান্ডা ঘরে থাকেন। আজ ভাবতে চাই সেইসব লাখে লাখে কর্মীবাহিনীর কথা, যারা বিনা প্রশ্নে নেতাদের ফরমাশ খেটেছেন। অনেকে নিজের জীবন অর্পণ করেছেন দলের কাজে। কেউ পরিবার ছেড়ে ,নিজের শখ শৌখিনতা ছেড়ে সময় দিয়েছেন দলের কাজে। জানি আজ সেই সংখ্যাটা কম, তবু শূন্য নয়। মনখারাপ হয়ে যায় সেই নিবেদিত কর্মীদের কথা ভেবে। অথচ রাজনীতি তো এখনো নেতাদের গজদন্ত মিনার থেকেই নেমে আসে কর্মীদের সমতলে। তাঁরা অসহায়। বিপন্ন। হয়তো বা আপাতত স্থবির বিষণ্ণতায় নিমজ্জমান। অনেকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাজি রেখে গড়ে তুলেছেন দল, দলের দুঃসময়েও ছেড়ে যাননি। আজ তাঁদের থমকে দাঁড়াবার সময়। তাঁদের রক্তশূন্য মুখের ওপর গভীর বিষাদের ছায়া। তাঁরা কেউ ‘সবজান্তা’ নেতা সাজেন নি, তাঁরা কেউ নেতাদের অপরিণামদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। আর তাঁদের শ্রমেই নেতারা বিধানসভা আলো করে বসেছেন এতদিন। আজকের এই শূন্যতার ইতিবৃত্তে তাঁরাই সবচেয়ে উপেক্ষিত। সেই সাদা হয়ে যাওয়া মুখগুলোর কথাই আজ মনে পড়ছে বারবার। তাদেরই দিকে তাকিয়ে ‘শুকনো নদীর মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শহরের রাস্তা’।

    সাদা পৃষ্ঠা, চলো, তাহলে আজ তোমার সঙ্গেই দেশান্তরে যাই। দিন সত্যিই বদলাল তাহলে! আমাদের বাল্য থেকে প্রৌঢ়ত্বের একটা টুকরো আজ মৃত তারার মতো ছাই হয়ে গেল। তারাদের কি পুনর্জন্ম হয়?

    (শিরোনাম: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা থেকে গৃহীত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভোটবাক্স | ০৪ মে ২০২১ | ২৭২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৪ মে ২০২১ ১৭:০৩105457
  • কে হায়    হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

  • কৃপাসিন্ধু ভট্টাচার্য | 2409:4060:2111:d70b::be0:***:*** | ০৯ মে ২০২১ ২৩:৪৩105789
  • বামপন্থায় বিশ্বাসী মনের অন্তরের বেদনার সময়োচিত বিশ্লেষণ, অনন্য লেখনভঙ্গিতে। 

  • রামু | 2a01:4c8:801:8dd0:1:2:f55a:***:*** | ১০ মে ২০২১ ১৩:২৯105825
  • ভয়ঙ্কর সংবেদী এবং যথার্থ বিশ্লেষণ। আশা করা যায় প্রাক্তন বামফ্রন্টের দলগুলির সৎ কর্মী-সমর্থকরা বৃহৎ বাম ঐক্য এবং ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হবেন।

  • রামু | 2a01:4c8:801:8dd0:1:2:f55a:***:*** | ১০ মে ২০২১ ১৩:২৯105824
  • ভয়ঙ্কর সংবেদী এবং যথার্থ বিশ্লেষণ। আশা করা যায় প্রাক্তন বামফ্রন্টের দলগুলির সৎ কর্মী-সমর্থকরা বৃহৎ বাম ঐক্য এবং ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হবেন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন