প্রবুদ্ধ বাগচী
পর্ব ২
আমরা যে সময়সীমায় প্রাথমিক পেরিয়ে উচ্চ- প্রাথমিক অর্থাৎ কিনা ক্লাস এইটের আওতায় এসেছি তখন আমাদের কানে আসত একেকটি ক্লাস ঘিরে একেকটি শিরোনাম। সেই হিসেবে ক্লাস ফাইভ মানে ‘লর্ড ক্লাইভ’ । কেন এমন সব নামের উৎপত্তি হয়েছিল, কীই -বা তার সামাজিক বা লৌকিক ভিত্তি এসব বিষয়ে কোনো ধারণা থাকার কথা আমাদের নয়, ছিলও না। ঠিক কোন সূত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওই প্রবল প্রতাপী রাজপুরুষটির নাম জড়িয়ে গেল ক্লাস ফাইভের সঙ্গে তার অনুসন্ধান কোনো গবেষক করেছেন কি না আমাদের জানা নেই। তবে ক্লাস ফাইভ মানে লর্ড ক্লাইভ, এটা পরিচিত গুরুজনরাও আমাদের বলতেন। অবশ্য আজকে ভাবতে বসে এটাও মনে পড়ে গেল, সেকালে ক্লাস ফোর-কে বলা হত ‘গরু চোর’ ! কালে কালে এই বিশেষ চতুষ্পদটির চৌর্যবৃত্তি যে এক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হবে, সেকালের রসিকরা সম্ভবত স্বপ্নেও এমন ভাবতে পারেননি — ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার অভিপ্রায়ে আজ এমন অভিধা নিশ্চয়ই তাঁরা ব্যবহার করার আগে দুবার ভাবতে বাধ্য হতেন।
যাই হোক, উচ্চ প্রাথমিকের পরিসীমায় যে চারটি ক্লাসের অবস্থান, সেখানে ধাপে ধাপে আর সব বিষয়ের মতো অঙ্কেরও মান ও মাত্রা বাড়তে থেকেছে সমানে। ফাইভ আর সিক্সে শুধুই অবশ্য পাটিগণিত। তার মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকেছে ‘সরল করা’, গসাগু,লসাগু,বর্গমূল বার করার মতো গণিত। ‘সরল করা’ এক আজব ব্যাপার —-- একটা বিরাট সংখ্যা নানাভাবে বিন্যস্ত, তার কিছুটা ভাগ, কিছুটা গুণ, কিছুটা ব্র্যাকেটের মধ্যে — অথচ তার মধ্যে আসলে লুকিয়ে আছে অন্য একটা সংখ্যা, আঁশ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে পৌঁছাতে হবে তার কেন্দ্রে। এ এক অদ্ভুত শৈল্পিক নির্মাণ, যেন বা এক ড্রয়িং —- গোটা ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ইশারা —- তার রসভোক্তা সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজে খুঁজে দেখবেন তার বিভঙ্গ আর সন্ধান করবেন এক অভিন্ন ‘একমেব দ্বিতীয়ম’-এর সংকেত, বস্তুত যা নিখাদ ব্রহ্মের এক আস্বাদ। কী আছে ওই চিত্রের আড়ালে, কোন সে অধরা মাধুরীর গভীর নিশীথের বাণী ! এই সরলীকরণের ছিল এক দীপ্ত অক্ষয়সূত্র —- যা সেই নিচু ক্লাস থেকে অনেক দূর অবধি মনের ভিতর ধরে রাখতে হয়। সংক্ষেপে তার নাম ‘বদমাস’ অর্থাৎ ‘BODMAS’ আসলে যা এক অ্যাক্রনিম(Acronym) —-- বি মানে ব্র্যাকেট, ও মানে অফ, ডি মানে ডিভিশন/ ভাগ, এম মানে মাল্টিপ্লিকেশন/গুণ, এ মানে অ্যাডিশন/যোগ আর সব শেষে এস মানে সাবট্র্যাকশন/ বিয়োগ। অর্থাৎ ঠিক এই ক্রম মেনে পেড়ে ফেলতে হবে ওই আপাত- প্রকান্ড সংখ্যা-দানবটিকে আর ক্রমাগত নিষ্ক্রিয় করে যেতে হবে তার অস্ত্রগুলি, আর তবেই সেই মোহানার ধারে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে সেই বীজ সংখ্যাটির। হয়তো দেখা যাবে সেটা আসলে আঠারো আর ঠিক তখনই থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, কী অপরূপ আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই সংখ্যা ! তার আড়াল খসিয়ে খসিয়ে আমরা নিরাবরণ করলাম তাকে, সংখ্যার কী অপূর্ব ছটাময় রূপ, কী প্রোজ্জ্বল তার বিভা !
লসাগু, গসাগুর বিচিত্র রসায়নেও এক আশ্চর্য মজা। গসাগু (গরিষ্ঠ সাধারণ গুণ্নীয়ক)কে আমার মনে হয় একটা বীজের ধারণা। কারণ, হয়তো তিন বা চার বা পাঁচটি সংখ্যার গসাগু (Highest Common Factor বা HCF) হল এমন এক সংখ্যা যা ওই তিন/চার/পাঁচটি সংখ্যার অন্তরে বিরাজমান অর্থাৎ গণিতের ভাষায় সাধারণ গুণ্নীয়ক —- এটাকে কি তুলনা করা চলে ক্রোমোজোমের সঙ্গে ? প্রতিটি জীবের প্রজাতির জন্যই তো একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার ক্রোমোজোম বরাদ্দ করেছে প্রকৃতি — কাকাতুয়া পাখির জন্য যার সংখ্যা ৭০টি, মানুষের জন্য তাই ৪৬ । তবে কি প্রতিটি জীবের জন্য আসলে একটা সংখ্যার ভিত্তিই গড়ে তুলছে তার স্বভাব, চালচলন, বংশের ধারা ? চড়ুই পাখির ৮০টি ক্রোমোজোম বলেই সে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে পারে আর পশুরাজ সিংহ তার ৩৮টি ক্রোমোজোম নিয়ে যতই ল্যাজ আছড়াক, ওড়ার চেষ্টা বৃথা ! আর মজাটা এই যে প্রাণী জগতে কয়েকটি প্রাণীর ক্রোমোজোম সংখ্যা একই —- তার মানে কি ওটা তাঁদের গসাগু সংখ্যা ? কে জানে ? অবশ্য ফাইভ সিক্সের গসাগু-র অঙ্ক সমাধান করতে গিয়ে যে এসব কিছু ভাবার অবসর ছিল তা নয়, তবে শুধু সংখ্যার কচকচি এড়িয়ে একটু বৃহত্তর পরিসরে গণিতকে স্থাপন করার কোনো কল্প-প্রণোদন আমাদের ক্লাসঘরের টেবিল চেয়ার বেঞ্চি বা রোল কলের খাতার মধ্যে হাজির ছিল না কোনোদিনই।
ঠিক যেমন লসাগু (লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক) ব্যাপারটার মধ্যে রয়ে গেছে একটা ভিন্ন স্বর। লসাগু (Lowest Common Multiple বা LCM) এমন একটি সংখ্যা, যা তিন/চার/পাঁচ বা তারও বেশি সংখ্যাকে ধারণ করে থাকে —- ব্যাপারটা খুব জটিল নয়। যেমন দশ, পনেরো বা কুড়ির লসাগু হল ষাট — কেন ? না, ষাটের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাকি সংখ্যাগুলি বা তার কোনো গুণিতক । ব্যাপারটা অনেকটা কি সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের মুখগহ্বরের ভিতর ফাল্গুনীকে বিশ্বরূপ দেখানোর মতো বলে মনে হয় না ? ওই সেই ব্যাদান যার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে মহাবিশ্বের প্রতিটি আনাচ-কানাচ, ব্যাপ্ত ধরণীর জীবন, যৌবন, জরা ও মৃত্যু ; প্রাণের উত্তাপ, ব্যাধির ক্লেদ, অবসানের নুয়ে পড়া শোক —-- এই সবই যেন নিখিল মুখগহ্বরের মধ্যে লসাগু হয়ে ঝুলে আছে কোথাও । এমন কি আমরা ভেবেছি কখনো ? আমাদের কাছে গণিত মানেই এক জটিল বিভীষিকা যার ভিতর কোনো সুর নেই, ছন্দ নেই নেই কোনো উদ্বোধনের মন্ত্র । সত্তরদশকে প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অগ্নিজাতক, পরের জীবনে রাজ্যের নামকরা আমলা হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন —- শুনেছি তিনি কাজের অবসরে ফাইলের মধ্যে নোটশিটের পাতায় নাকি অঙ্ক করতেন, একরকম বিনোদন হিসেবে। বিনোদনের এই চতুর্থ মাত্রাটি আমরা সচরাচর ভেবেই দেখিনি। অথচ একটা সময় গণিত নিয়ে যারা পড়তেন তাঁদের সায়েন্সের ডিগ্রি-ই (বি এসসি) দেওয়া হত না, মনে করা হত গণিত আসলে দর্শনেরই একটা চেহারা। যে কোনো দর্শন ভাবনাই মানুষকে বড় করে ভাবতে শেখায়।
তাছাড়া, গণিতকে একেবারে মজায় মুড়ে সাহিত্যর মধ্যে পরিবেশন করার কথাই বা ভেবেছেন ক’জন ? এই বিষয়েও আমাদের হাতে রয়েছেন মাত্র একজন, তিনি সুকুমার রায়। সেই যে, একজন সন্ন্যাসী এসে রাজার কাছে ভিক্ষা চাইলেন —- বললেন, বেশি না, আপনি আমায় আজ এক পয়সা ভিক্ষা দিলে পরের দিন দেবেন দুপয়সা, তার পরের দিন চার পয়সা —- এইভাবে এক বছর আমায় সামান্য মুষ্টিভিক্ষা দিলেই আমি খুশি। রাজার অহংকারে লাগল, তিনি বললেন এ আর কী ব্যাপার ! সম্মত হলেন রাজা। আসলে তিনি পড়ে গেলেন গুণোত্তর প্রগতি বা জিওমেট্রিক প্রোগ্রেসনের খপ্পরে। এক পয়সা দুই পয়সা চার পয়সা করে এক বছর চললে তা পরিণত হয় বিরাট মাপের এক অঙ্কে, রাজার সাধ্য কি সেই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার ?
প্রায় একই ধরনের এক সমস্যা হল সুবিখ্যাত ‘টাওয়ার অফ হ্যানয় সমস্যা’ — ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের নামে নামাঙ্কিত হলেও আদপে এই পিতলের প্ল্যাটফর্মটির অবস্থান বেনারসের এক মন্দিরে। সেখানে ওই প্ল্যাটফর্মের ওপর আছে পাশাপাশি তিনটে হীরের দন্ড (হীরে কি না তার পাথুরে প্রমাণ নেই) — এই তিনটি দন্ডের প্রথমটিতে আছে চৌষট্টিটি সোনার চাকতি, যা বড় থেকে ছোট ব্যাস অনুযায়ী নিচে থেকে ওপর অবধি সজ্জিত, অর্থাৎ সব থেকে ছোট চাকতি ওপরে, সব থেকে বড়টি একদম নীচে, পিরামিডের মতন। সমস্যাটা হল, মন্দিরের পুরোহিতরা স্বয়ং ব্রহ্মার নির্দেশে এই চাকতিগুলি এক দন্ড থেকে অন্য দন্ডে সাজানোর চেষ্টা করে চলেছেন । তবে দুটি শর্ত আছে, একবারে একটি চাকতিই সরানো যাবে আর কোনো অবস্থাতেই কোনো দন্ডের ওপর ছোট চাকতির ওপর বড় চাকতি রাখা যাবে না। ব্রহ্মার নির্দেশ হল, যে মুহূর্তে সবগুলি চাকতি স্থানান্তরিত হয়ে যাবে সেই মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যাবে এই মহাবিশ্ব। আসলে এটা একটা গল্প যা স্বাদু আকারে পরিবেশন করেছেন মহম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘গণিতের মজা, মজার গণিত’ বইতে (বাংলাদেশের একটি প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত)। কিন্তু তার মানে কি এই যে সত্যিই এই সমাধান করতে পারলেই লোপ পাবে এই মহাবিশ্ব ? ব্রহ্মার নির্দেশ যাই হোক, আসলে এটা একটা বিন্যাস ও সমবায়ের ( পারমুটেশন ও কম্বিনেশন) ধাঁধাঁ, যা তৈরি করেছিলেন (১৮৩৩) এডমন্ড লুকাস নামের একজন ফরাসি গণিতবিদ। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সূত্র মেনে একটা দন্ড থেকে অন্য দন্ডে একটা চাকতি সরাতে যদি মাত্র এক সেকেন্ড লাগে তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ হতে লাগবে ৫৮৫ বিলিয়ন বছর, যেখানে আমাদের ব্রহ্মান্ডের বর্তমান বয়স হল মাত্র ১৪ বিলিয়ন বছর। কাজেই বেনারসের পুরোহিতরা যতই আদাজল খেয়ে লাগুন না কেন, ব্রহ্মার কোপে আপাতত আমাদের গঙ্গাপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। এইটাই গণিতের মজা ও বিস্ময়, যেটাকে রোচক চেহারায় তুলে ধরাটাই খুব জরুরি। আর সেটা হয় খুবই কম। বাংলা ভাষায় আনন্দ পাব্লিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘জাদুগ্ণিত’ (লেখকঃ বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) এরকম কিছু কৌতূহলের বিষয় তুলে ধরেছিল, আর ছিল রাশিয়ান বই পেরেলম্যানের ‘ম্যাথমেটিক্স ক্যান বি ফান’ যার ইংরিজি অনুবাদ আজ আর পাওয়া যায় না। এর বাইরে আর তেমন বইয়ের সন্ধান আমার জানা নেই।
কিন্তু গণিতের বুনিয়াদি বিষয়েও তো কল্পনা আর বিস্ময়ের অবধি নেই। তেমনই একটা বিষয় হল এই বর্গমূল। চারের মূল দুই বা পঁচিশের বর্গমূল করলে পাঁচ পাওয়া যায় এটা খুব সহজ বিষয়। কিন্তু দুই-এর মূল কত হবে তা পাটিগ্ণিতের গোদা নিয়মে বার করতে গেলেই থই পাওয়া মুশকিল কারণ সেই সংখ্যাটির কোনও শেষই নেই, যতদিন যত রাত ওঁর পেছনে ধাওয়া করবেন সে ততই বেড়ে বেড়ে চলবে দশমিকের পরে, অনেকটা যেন সেই দ্রৌপদীর শাড়ির মতোই এক অনন্ত আবর্ত —- তবে মহাকাব্যে অপমানিত পাঞ্চালীকে বস্ত্রের জোগান দিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, এক্ষেত্রে কে জুগিয়ে চলে এই সংখ্যার স্রোতোময় বিস্ফার ? সে কি কোনো ঐশ্বরিক শক্তি ? না, মোটেও নয়। সংখ্যার আছে এক অজানা রোমাঞ্চিত পৃথিবী, রামানুজমের মতো কোনো জিনিয়াস হাজার বছরে একবার তার ব্রহ্মস্বাদ পান — জীবনানন্দের কবিতার ভাষায় বললে, এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায় না কো আর। কিন্তু আস্বাদন না পেলেও সেই ধরণীর ধূলিকণা মিছে হয়ে যায় না। বরং এরকম সব আশ্চর্য সংখ্যার বর্ণালী আমাদের নিয়ে যায় এক অসীমের চেতনায়। ইনফিনিটি ব্যাপারটা খুব সহজপাচ্য নয় ঠিকই —- গণিতের যে পর্যায়ে এই অসীমের ধারণা আমাদের দেওয়া হয় সেখানে বলা হয়, আমরা যতদূর বড় সংখ্যা ভাবতে পারি তার থেকেও বড় হল ইনফিনিটি। বক্তব্যটা একটু ধোঁয়াটে। কিন্তু দূরপাল্লার ট্রেনের জানলা দিয়ে ওই সুদূরের দিকে তাকালে সবুজিমার শেষে যে দিগন্তের হাতছানি, সেও তো এক ইনফিনিটি —- আমি যতই তার কাছে এগোবো সে ততই সরে যাবে আমার থেকে ! কী উত্তেজক রকমের রোমান্টিক ! আমি তাকে ছুঁতে চাই আর সে সরে যায় আড়ালে — যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে ! এই তো অসীম, এই তো আমাদের সেই না-বলা বাণী, সুতীব্র প্রেমের ডাক —- একটি রক্তিম মরীচিকা।
(চলবে)
পরের পর্ব ২ ডিসেম্বর