অঙ্কে যত শূন্য পেলে
পর্ব ৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ক্লাস সেভেনে ওঠার আগে বার বার চেতাবনী দেওয়া হচ্ছিল, এবার কিন্তু অ্যালজেব্রা শুরু হবে, শুরু হবে জ্যামিতি। এতকাল পাটিগ্ণিতে অভ্যস্ত মন ও মগজ কীভাবে সাড়া দেবে বীজগণিতে ও জ্যামিতিতে সে নিয়ে সংশয় তো ছিলই। ব্যাপারটা ঠিক কী এবং কীভাবেই তার আউটসুইঙ্গার সামলানো যাবে সেও এক বাড়তি দুশ্চিন্তা। কারণ, অঙ্ক শিখি বা না-ই শিখি তার চূড়ান্ত মূল্যায়ন তার পরীক্ষায় ও নম্বরে —- আর আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে মাস্টারমশাইরা এই পরীক্ষার পিচের জন্য তুলে রাখেন তাদের যাবতীয় গুগলি ও দুসরা, যেহেতু তাদের কাছে এই স্কুলপাঠ্য-গণিত নিতান্তই এলেবেলে তাই পড়ুয়াদের দিকে নিজেদের অধীত জ্ঞানের মোড়কে বিষাক্ত বাউন্সার ছুড়তে তাদের বড়ই আহ্লাদ। আর তাই আমাদের ভয় আর দুর্ভাবনার অন্ত নেই।
অথচ বীজগ্ণিতের মতো ফ্যাসিনেটিং একটা বিষয় পড়ানোর আগে কেউ আমাদের বলেনি, গ্ণিতের এই আধুনিক শাখাটি আদপে মানবসভ্যতায় আরবের গণিতবিদদের অবদান, সেখান থেকেই তা ছড়িয়েছে গ্রিসে, মিশরে ও সারা দুনিয়ায়। বিজ্ঞান তো আসলে এমনই একটা বিষয় যা ভূগোলের সীমা মানে না, মানে না ধর্ম বা আর্থিক বিভাজনের পাঁচিল —- এখানে যা চর্চা হয় যা আবিষ্কৃত হয় তা গোটা পৃথিবীর সম্পদ, সমগ্র মানবজাতি তা ধারণ করতে থাকে নিজেদের প্রজ্ঞার ভিতর। আর, আজ যখন শুনতে পাই, প্রাচীন ‘বৈদিক’ বিজ্ঞানে ‘নাকি’ সব কিছুতেই আমাদের দেশের ‘অধিনায়কত্ব’ —- আমরাই হ্যান করেছি ত্যান করেছি বলে ‘বিশ্বগুরু’ সেজে বুক বাজাই—তখন বেশ কৌতুক বোধ হয়। কারণ, হিন্দুর বিজ্ঞান, ইসলামের বিজ্ঞান বা ইহুদির বিজ্ঞান এরকম কোনো ভাগ বাঁটোয়ারা হতেই পারে না —-- বিজ্ঞান বা গ্ণিত আসলে একটা ধারাবাহিকতার বিষয়, এক যুগ থেকে আরেক যুগে তা গড়িয়ে আসে। আসে বলেই ইউক্লিডের জ্যামিতির ধারণার ওপর গড়ে ওঠে পরের প্রজন্মের জ্যামিতির ভাবনা, আরবদেশের গণিতজ্ঞদের ভাবা বীজগণিত গত শতকে নিয়ে এসেছে বুলিয়ান বীজগণিতের মন্ত্র, আজকের কম্পিউটার প্রযুক্তির সবটুকুর পেছনেই এই বুলিয়ান বীজগণিত। নিউটনের গতিবিদ্যা অস্বীকার করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বিকশিত হতে পারে না, হয়ওনি। তাই রামায়ণের ‘পুষ্পক রথ’ যদি সেই যুগের বিজ্ঞানের ‘আবিষ্কার’ সত্যিই হত তাহলে সেই বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস কোথাও নথিবদ্ধ থাকত যা পরের ইতিহাসের চালিকাশক্তি হতে পারত, বাস্তবে তা হয়নি । হয়নি বলেই আগে বিজ্ঞানকে এয়ারোডাইন্যামিক্স নিয়ে ভাবতে হয়েছে, তার পরে এসেছে বিমানের প্রকৌশল। বলা বাহুল্য এগুলো ক্লাস সেভেনের ছাত্রের উপলব্ধি নয়।
তবে নতুন ক্লাসে উঠে যখন পরিচয় হল বীজগণিতের সঙ্গে, সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। অজ্ঞাত একটি সংখ্যা ‘এক্স’ কে কল্পনা করে কী নিঃসীম বিভঙ্গে স্তরে স্তরে গড়ে ওঠে এক নতুন পৃথিবী, বীজগণিত আমায় শেখাতে চাইল সেটাই । একেবারে বুনিয়াদি স্তরে ছিল , এই চলরাশির ধারণা, সঙ্গে এক্স প্লাস ওয়াই হোল স্কোয়ারের সমীকরণ ইত্যাদি। সমীকরণ কথাটাও এক নতুন আলো। কারণ, প্রতিটি সমীকরণেরই থাকে এক বা একাধিক বীজমান(Root), যা নাকি নির্ভর করে সেটি কত ঘাত বা পাওয়ারের হবে তার ওপর। এক্স স্কোয়ার হলে তার দুটি বীজ, এক্স কিউব হলে তিনটে। পরে অবশ্য উচ্চতর বীজগণিতে আরো সব বিচিত্র রীতি ও ফরমুলা নিয়ে বসত করতে হবে, সে প্রসঙ্গ পরে। আপাতত ভাবতে থাকি, একটি দ্বিঘাত সমীকরণের মধ্যে বসে আছে একজোড়া সংখ্যা —- সংখ্যা ? নাকি ভাবতেই পারি এক জুড়ি ! ঠিক যেরকম জোট নিয়েই সৃষ্টি হল মানুষের প্রাণ, সেও তো এক দ্বিত্বের জোট —- পুরুষের ঔরস আর নারীর গর্ভ না থাকলে কি প্রাণ থাকত এই মহাবিশ্বে, অন্তত যে প্রাণের প্রকাশ দেখি আমরা চারপাশে ! তাহলে কি কোথাও থেকে গেছে প্রাণ তৈরির এক অতলপ্লাবী সমীকরণ আর সেই সমীকরণের অনিবার্য সমাধান এই বস্তুবিশ্ব ? তারপর যখন আমাদের ভেঙে দেখানো হয় এক্স প্লাস ওয়াই হোল স্কোয়ারের সূত্র, সেখানে কী আশ্চর্য, প্রথম পদে এক্সের প্রাধান্য, মাঝের পদে এক্স ওয়াই সমান সমান, আবার শেষ পদে এক্স উধাও হয়ে তার দখল নিয়েছে ওয়াই —- এর মানেটা কী ? তবে কি এটা একজোড়া এক্স আর ওয়াই এর যৌথ যাত্রার সংলাপ, কখনো একজন প্রাধান্য পাচ্ছে আবার কখনো দুজনেই তুল্যমূল্য আবার শেষে আরেকজন সরে যাচ্ছে সেই মূল স্রোত থেকে —-- শুধু যাওয়া আসা/ শুধু স্রোতে ভাসা !
আসলে বীজগণিতের সব থেকে বড় মজা হল এর আলোয় দেখলে পাটিগ্ণিতের পুরো জগতটাই মিথ্যে হয়ে যায়। পাটিগণিতের সব অঙ্কই সমাধান করে ফেলা যায় বীজগণিতের হাত ধরে। যদিও মাধ্যমিক অবধি এই খোদার ওপর খোদকারি করার অনুমতি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ দিতেন না —- পাটিগ্ণিতের অঙ্ক নাকি পাটিগণিতের নিয়মেই সমাধান করতে হবে নতুবা নম্বর কেটে নেওয়া হবে। এখনো এই একুশে আইন আছে কি না আমার জানা নেই তবে এককালে এসব নিয়ম ছিল। কিন্তু মজাটা এই যে পাটিগণিতের কোনো অঙ্কে যা বলা হচ্ছে, ধরা যাক, সুদ-কষা,লাভ-ক্ষতি, শতকরা হিসেব এমনকি ট্রেনের গতির হিসেব —- এর প্রত্যেকটার মধ্যে যে লিখিত বয়ান থাকত অর্থাৎ ‘ক’ ‘খ’ এর থেকে ১০০০টাকা ধার নিল তারপরে আরো অনেক কিছু ঘটল, কেউ ধার শোধ দিল না, কেউ আংশিক দিল, কারো ক্ষেত্রে সুদের হার ওঠানামা করল এইসব আর কি —- অধুনা ইংরিজি মাধ্যমের পড়ুয়ারা একে বলে স্টোরি সাম, গণিতের গল্প না গল্পের গণিত ? এখন এই গল্পগুলোর প্রতিটি কথাকে অনুসরণ করে আদপে তৈরি করা যায় একটা সমীকরণ আর ওইটুকু গড়ে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে ! তার মানে আমাদের চারপাশের জীবনে আর্থিক বাণিজ্যিক দুনিয়ায় যা যা ঘটছে সবই কি ধরে ফেলা যায় বীজগণিতের সমীকরণের আদলে ? এই মস্ত প্রশ্নটা আমায় অনেকদিন তাড়া করে ফিরেছে। মানুষের জীবনও কি আসলে এক সমীকরণ, কখনো যার প্রত্যেকটি বীজ খাপে খাপে মিলে যায় আর কখনো সেই সমীকরণ কেবলই আবর্তিত হতে থাকে বীজভ্রষ্ট অভিশাপের কিনারায়, মিলতে চায় না কিছুতেই, কিছুতেই না। সেই না-মেলার দেশে শুধুই মাথা নিচু করে আঁক কষার মেহনত, পুনরাবৃত্তি, আক্ষেপ, হতাশ্বাস —-যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে ! গ্ণিতের বাদল-বাতাস কি সেই জীবনকে আদৌ সঞ্চারিত করতে পারে কোনও উদ্দীপ্তি ?
এই যে বীজগণিত, এর মধ্যে ‘বীজ’ কথাটির উপস্থিতি বিছিয়ে দেয় ভাবনার সূত্র। বীজ মানে কি রুট বা শিকড় ? অ্যালজেব্রার পরিভাষা বীজগণিত যিনিই করে থাকুন তিনি জানতেন এই চর্চা আসলে শিকড়ের সন্ধানে যাত্রা —- গাণিতিক সমীকরণের সমাধানের ক্ষেত্রে রুট কথাটা তো অহরহ ব্যবহার হয় বীজগণিতে। আলেক্স হেলির একটা সুবিখ্যাত বই ছিল যার নাম ‘রুটস’, আবার আমাদের বাংলার কবি অরুণ মিত্রের একমাত্র উপন্যাসের নাম ‘শিকড় যদি চেনা যায়’ —- সবই তো সেই শিকড়ের কথা! বীজগণিত কেমনভাবে সেই শিকড়ের সন্ধান করে তার আদল নিশ্চয়ই ক্লাস সেভেনের পাঠ্যক্রমে থাকার কথা ছিল না। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বাংলা ভাষার অভিধান’ এ জানাচ্ছেন ‘বীজ’ শব্দের আদিতে আছে বীর্য । যার ব্যঞ্জনা এমন হতেই পারে, গ্ণিতের এই শাখার সঙ্গে সৃষ্টির কোনো আদিরূপ কল্পিত ছিল, না ভুল বললাম, কল্পনা নয় —একটা গাণিতিক যোগের কথা ভাবা হয়েছিল। ক্লাস সেভেনের বিদ্যেয় এটুকু বুঝেছিলাম, এক্স নামক চলরাশি ( ভ্যারিয়েবল) যদি কমপক্ষে দুইঘাত অর্থাৎ এক্স স্কোয়ার না হয় তাহলে তার রুট বা সমাধান বার করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। আর যেই এক্সের মাথায় বসল দুই অমনি আমাদের আতুর অনুসন্ধান হল সেই দুইকে খুঁজে বার করার। এই এক আর দুইয়ের মধ্যেই কি ছিল সেই রহস্যের ইশারা?
এক অর্থে যদি অখণ্ড ধরি, তাহলে, তো আমাদের মহাবিশ্বের চেতনায় ও দর্শন ভাবনায় একক একটি জরুরি চিন্তা যা বলে অখণ্ড বিশ্বের কথা —-- ব্রহ্মান্ড মানে তো আসলে ব্রহ্মা নামক কোনো কল্পপুরুষের অণ্ড (হ্যাঁ, পুরুষ) —- সেই অণ্ডের মধ্যে থাকে বীর্য, সেখান থেকেই সময়ের শুরুয়াত। শুধু সনাতনী চেতনায় ( হিন্দু শব্দটি সচেতনভাবে বাদ দিলাম, কারণ হিন্দু বলে কোনো ধর্ম নেই) নয়, ইসলাম বা খ্রিষ্টীয় ভাবনাতেও আছে আদিপুরুষের গল্প । আজ্ঞে হ্যাঁ , আদিনারী বলে কোনো ধারণা কোথাও নেই যতক্ষণ অবধি না এক থেকে দুইয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছি আমরা। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী’--- তিনি তুমি-কেই বলেন, তোমরা-কে নয়, যদিও এখানে তাঁর উদ্দিষ্ট এক নারী। আসলে ‘দুই’ এলেই তার মধ্যে এল নারী, তারপর তাদের মিলন এবং নতুন প্রাণের ইশারা, এক আমি বহু হব এই তাদের গতিপথ —- এই মানব-মানবীকে আদম আর ইভ বললেই বা ক্ষতি কী? আসলে তো এটা একটা গ্ণিতের আখ্যান, থিওলজির নয়। ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীধর আচার্য খ্রিষ্টীয় নবম শতকে পাটিগ্ণিতকে আলাদা করে বীজগণিতের প্রচলন করেন বলেই ইতিহাসবিদদের অনুমান। আর তাঁর হাতেই দ্বিঘাত সমীকরণের ( কোয়াড্রাটিক ইকুয়েশন) সুনির্দিষ্ট দুটি বীজ নির্ণয়ের সূত্র আবিষ্কৃত হয়, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এই সেই বীজ আর তার বপনের ইতিকথা। বীজ আর শিকড়। শিকড় খুঁজতেই হবে আমাদের আর একই সঙ্গে সেই শিকড়ের সন্ধান যেন না হয়ে পড়ে স্থানু বা চলচ্ছক্তিহীন। কবি হিমেনেথের মন্ত্রের মতো সেই কবিতা-পঙক্তির কথা মনে করি : শিকড়ের ডানা হোক / ডানার শিকড় ।
(ক্রমশ)
পরের পর্ব ১৬ ডিসেম্বর
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।