এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • তিলু বিলুর নদী

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ জুন ২০১৭ | ১০৯১ বার পঠিত
  • " ইছামতী একটি ছোট নদী। অন্তত যশোর জেলার মধ্য দিয়ে এর যে অংশ প্রবাহিত, সেটুকু। দক্ষিণে ইছামতী কুমির-কামট-হাঙ্গর সংকুল বিরাট নোনা গাঙে পরিণত হয়ে কোথায় কোন সুন্দরবনে সুঁদরি-গরান জঙ্গলের আড়ালে বঙ্গোপসাগরে মিশে গিয়েছে, সে খবর যশোর জেলার গ্রাম্য অঞ্চলের কোনো লোকই রাখেনা।

    ইছামতী নদীর যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত,সে অংশটুকুর রূপ সত্যিই এত চমৎকার, যাঁরা তা দেখবার সুযোগ পেয়েচেন তাঁরা জানেন। কিন্তু তাঁরাই সব চেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করবেন, যাঁরা অনেকদিন ধরে বাস করচেন এ অঞ্চলে। ভগবানের একটি অপূর্ব সৃষ্টি এর দুই তীর, বনবনানীতে সবুজ, পক্ষীকাকলিতে মুখর।"

    এর পর তিনি এগিয়ে গিয়েছেন বাজিকরের মতো পলতেমাদার গাছের লালফুল, তিৎপল্লা লতায় ফুলের হলুদ রং, টোপাপানার দাম আর বন্যেবুড়ো ঝোপের জলজ মায়া দু'হাতে ছড়াতে ছড়াতে। বাঙালির কাছে ইছামতী নদীকে ইতিহাসের বিস্তীর্ণ পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া এক মায়াবী চরিত্রের মতো প্রতিষ্ঠা দিয়ে নিজে উইংসের আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। তিলু-বিলু-নিলু আর সন্নিসি হতে গিয়ে ফিরে আসা ভবানী বাঁড়ুজ্যে'র হাতে বেটনটি ধরিয়ে দিয়ে নিজে আরেকটা গল্প হয়ে গেছেন।



    --------------
    গত চারপুরুষে তো বঙ্গদেশে থাকিনি আমরা। দশদিক ঘোরাঘুরি। কিন্তু ভালো করে বাংলার মুখ দেখার প্রদীপটি জ্বালা হয়নি কখনও। যখন ঠিক হলো একবার ইছামতী নদীকে ছুঁয়ে দেখে আসা যাক, মাশাল্লাহ,, মঞ্জুর-এ- খুদা তো তবে বলতেই হয়।

    জায়গাটা এতো কাছে জানা ছিলোনা। ম্যাপ দেখতে গিয়ে দেখি মাত্র সত্তর কিমি। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী। নিত্য যাতায়াত ছিলো তো সেখানে। ভোরবেলা বেরোলে নতুন রাস্তা দিয়ে বড়োজোর এক ঘন্টা। কিন্তু এখানে আড়াই ঘন্টা লাগবে। রাস্তার সে জেল্লা নেই। যাকগে আমি ও ভাই নিজের নিজের গাড়ি নিয়ে সায়েন্স সিটির সামনের রাস্তা ধরি। প্রথম শীতের কুয়াশা তখনও পুরো কাটেনি। রাস্তা তো সরু। কিন্তু খুব খারাপ নয়। ধাপা পেরিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে। বানতলা, মণ্ডলপাড়া, ভোজেরহাট, পাগলাহাট, ভাঙড়। এসব তো এখন বোনাফায়েড শহরতলি। শাসকের ক্ষমতার কেন্দ্র ভারসাম্য রাখতে এই সব বসতিকে ব্যবহার করে। কাগজে নাম ওঠে। কিন্তু সব ভুলভাল কারণে। টানা দিকচক্র পর্যন্ত সবজে ভূমি। তার মধ্যে সাজানো জলের ভেড়ি। নামোজমিতে কঞ্চিবাঁধা মাছের ঘরসংসার। তার মধ্যে মধ্যে খড়বাঁশবাঁধা গরিবের ওয়াচটাওয়ার। সেই কোন কাল থেকে শুনি ভেড়িদখলের প্রাক ঐতিহাসিক কুরুক্ষেত্রের গপ্পোসপ্পো। সেই ট্র্যাডিশন তো আজও চলেছে।
    -------------------------
    মাদারিবাজার ঘিঞ্জিএলাকা। এখান থেকে দক্ষিণমুখী হয়েছে বাসন্তী হাইওয়ে আর উত্তরপূর্বদিকে গেছে বসিরহাট-মালঞ্চের রাস্তা, মালঞ্চনদীর উপর পাকা সাঁকো পেরিয়ে। রাস্তা কখনও একটু চওড়া, কখনও মনে হয় কারো উঠোনের মধ্যে ঢুকে যাবে। তবে সবুজে সবুজ। কলাবন, নারকেল-সুপুরি-তালের আকাশছোঁয়া পাতা আর মাটিতে পালং আর ফুলকপির সাম্রাজ্য। রাস্তায় গিজগিজ করে 'মায়ের আশীর্বাদ', 'পলি ও পাপন' টাইপ নামের ছোটো লরি'র সারি। নয়তো ঐ সরু রাস্তা দিয়ে গাঁকগাঁক করতে করতে ধেয়ে যাওয়া 'সত্যনারায়ণ' বা 'সাগরিকা' জাতীয় খ্যাপা বাস। এরাই তো 'চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে' ব্রিজ ভেঙে সটান জনতাসমেত নদীর জলে। সকালের খবরকাগজে তিন ইঞ্চি, ন দেবায় ন ধর্মায়, স্থানীয় সংবাদদাতার দিনের পুঁজি।

    --------------------
    গোলাঘাটা, তালতলা, হাবসপুর পেরিয়ে টাকী রোডের চৌমাথা। উত্তরে বসিরহাট, দক্ষিণে হাসনাবাদ, নাক বরাবর গেলে ইছামতীর ঘাট। রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে যেতে যেতে রাস্তা প্রায় শুকিয়ে গেছে। রিকশা, ভ্যানো, টোটো, অটো, ঠেলাগাড়ির বন্যার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট এস ইউ ভি। আমাদের দেশের ভাষায়, সড়ক নহি, বকওয়াস হ্যাঁয়। দু তরফা জখমি এড়িয়ে নদীর ধারে ক্ষীণতনু স্ট্র্যান্ড। সেখানেও নানা দোকানপাট। মোমো থেকে মাঞ্চুরিয়ান। ডাব থেকে ডেভিল। দেখেশুনে মনে হয় জায়গাটির মটো 'যেতে নাহি দিব।' তবু হায়, যেতে দিতে হয়।


    ----------------------
    সরাইখানাটি একেবারে নদীকূলে। সেটিই নাকি টাকী'র পাঁচতারা। বাংলা ফিলিম আর সিরিয়ালের দামি তারকারা নাকি শ্যুটিং করতে এসে এখানেই আতিথ্যগ্রহণ করেন। লাউঞ্জে তাঁদের নানা ছবিছাবা। সামনে নারিকেলের শাখে শাখে ঈষৎ উত্তুরে হাওয়ার ডাক। একটা সরলরেখার মতো ফৌজি ওয়াচটাওয়ার। দূরবীন চোখে ওপারের প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আসতে চাওয়া সম্ভাব্য পার্সোনা নন গ্রাটাদের উপর নজর রাখছেন তাঁরা। সরাইখানার গাড়ি ঢোকানোর পথটি ইউনিক। পটেশ্বরী মন্দির ও একটি জেদি ল্যাম্পপোস্ট এবং আগে পিছে গোটা দশেক মানে না মানা ভ্যানোগাড়ি সূচ্যগ্র মেদিনীর মধ্যে দিয়ে পেরোতে আকুল সেখানে। ব্যাক করে নিরাপদে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে সারা জীবনের জন্য ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাস। পাটনায় গাড়ি চালানো'ও এর কাছে নস্যি। সে যাকগে। গাড়ি ঢোকানো মাত্র দু'টি সেনা বাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আপাতভাবে কোনও মিল নেই তাদের মধ্যে। একদলের সর্বাঙ্গে বসিরহাটি গামছার পসরা এবং অপরদলটি 'ভ্যানো'র চালক। এবার প্রথম দফা গামছা খরিদ ও ভ্যানোচালককে প্রতিশ্রুতি দেবার পর ছাড়া পাওয়া গেলো। সঙ্গের পুঁটলি পোটলাগুলি হোটেলের ঘরে রেখে নীচে নামতেই অপেক্ষমান ভ্যানোসারথি সবলে গিরফতার করে নিলো আমাদের । আমরা ছ'জন। একটা কাঠের পাটাপাতা ঠেলাগাড়ি, সাইকেলের সঙ্গে আঁটা, তার নাম 'ভ্যানো'। চাকা আবিষ্কারের ঠিক পরেই মানুষ এই গাড়িটা বানিয়েছিলো। সম্প্রতি যোগ হয়েছে একটা মান্ধাতা আমলের বাইকের ইঞ্জিন। তাতেই পা ঝুলিয়ে বসতে হবে। পুরো 'চ্যালেঞ্জ নিবি না সালা' পরিস্থিতি।

    <


    <
    -কতোক্ষণ বসতে হবে হে?
    -এইতো ঘন্টা আড়াই...
    -মাফ করো ভাই....
    -না না শর্টেও সেরে দেওয়া যায়...
    -আরে যাবেটা কোথায়?
    -এইতো জমিদারবাড়ি, কুলেশ্বরী কালী, জোড়া শিবমন্দির, গোলপাতার জঙ্গল, মিনি সুন্দরবন, জেনারেল শংকর রায়চৌধুরীর বাড়ি...
    -জেনারেল রায়চৌধুরীর বাড়ি ???
    -ওখানে সবাই যায়...
    -কেন হে?
    -ঐ যে শুনছেন না মাইকে বলছে....

    তখন খেয়াল হয়। চারদিকে গোটা চল্লিশ পিকনিক পার্টির মাইক ছাপিয়ে নদীর বাঁধাঘাটে একটা মাইকে অম্বুলে রোগীর ঢেঁকুরের মতো মাঝে মাঝেই বেজে উঠছে" আমার নাই হলো পারে যাওয়া...' তার পর রেকর্ডেড কণ্ঠস্বরে টাকির কোথায় কোথায় যেতে হবে তার ফিরিস্তি। সেখানেই শুনি জেনারেল রায়চৌধুরীর বাড়ি কতো বড়ো একটা দ্রষ্টব্য। তিনি তো কলকাতাতেই থাকেন। শুনেছি পুজোর সময় যান গ্রামের বাড়ি। পল্টুদা ইস্টাইল।
    -দ্যাখো বাপু, অতোক্ষণ ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসা অতি পাপ। আমি মাঝে মাঝে নেমে পড়ে হেঁটে যাবো...
    'ভ্যানো'র স্প্রিংপাত্তি বলে কিসু নাই। তার উপর রাস্তাটিও ঠিক 'রাস্তা' নয়। লোকে যায়, তাই 'রাস্তা'। লাফঝাঁপ কেমন করবে তা সহজেই বোঝা যায়। পাটার উপর পদ্মাসনে বসার মতো যোগসাধনা নেই। তবু তিলু-বিলুর নদীর দেশ বলে কথা। এটুকু কষ্ট না করলে কী করে হবে। তবু তো এখানে আমাকে কেউ সিয়াচিন গিয়ে যুদ্ধ করতে বলছে না। অতএব, চরৈবেতি...

    -------------------
    চড়ে বসি এবং ভ্যানো তার যাত্রা শুরু করে। আমরা চারদিকে জলা, কচুবন, বাঁশঝাড়, নারকেল-সুপুরি, খোড়ো ঘর, নয়ানজুলি, নোনাধরা ইঁটের নিশ্চিন্দিপুর দেখতে দেখতে গড়িয়ে যাই। সাবধানতা বলতে শুধু ক্যামেরাটা সামলে রাখা। ঠোকাঠুকি না লাগে। একটা দীঘির এপার থেকে দেখি একজোড়া বাংলা মন্দির। মাঝখানে একটা একতলা শাদা বাড়ি। কপালে লেখা টাকী উত্তর পল্লীসঙ্ঘ-১৯৩৮। লাল-নীল-সবুজে মিলে চোখজুড়োনো ভিজ্যুয়াল। দাঁড়াই। ছবি নিই। মন্দির'দুটির বয়স নাকি দুশো বছরের বেশি। ১২০৮ বঙ্গাব্দে জমিদার গোপীনাথ রায়চৌধুরী এই মন্দির, পুকুর প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রংচং হয়েছে। দীঘিতে লোকজন স্নান করছে। সবুজ জলে লাল গামছা। ভ্যানো আবার চলতে শুরু করে। বনবাদাড়ঘেরা একটি জীর্ণ ইঁটের মিনার। জানা যায় সেটি একটি নলকূপ। মলিন মর্মরফলকটিতে লেখা আছে কোনও এক শ্রীমতী স্বর্ণলতা বসু প্রয়াত পতিদেবের স্মৃতিতে ১৩৩৮ সালে এই নলকূপটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরু পিচঢালা রাস্তা দিয়ে ভ্যানো দৌড়োয়। একপাশে পাঁচিল অন্যদিকে বুনো সবুজের এলোমেলো। বাঁশঝাড় আর ডোবার আশেপাশে লালচে টালিছাদের উঁকি দেওয়া ভদ্রাসনগুলি বায়োস্কোপের মতো পিছিয়ে যায়।

    -----------------------
    ইছামতীর এই দক্ষিণ-পশ্চিম পারের অঞ্চলটিতে রাজত্ব ছিলো পূর্ববঙ্গের গুহবংশীয় জমিদারদের। যাঁরা পদবি লিখতেন রায়চৌধুরী। জনৈক বিখ্যাত জমিদার কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী দাবি করতেন তাঁরা কনৌজ থেকে আগত প্রথম দলের আদি কায়স্থ বিরাট গুহের বংশজ। গুহদের সংখ্যাধিক্য পূর্ববঙ্গে হলেও পশ্চিমেও তাঁদের দেখা যায়। উভয়বঙ্গেই তাঁদের জাত্যাভিমান ব্যাপারটি বেশ প্রকট দেখেছি। আমার বাবা-মা, দুজনেরই মাতৃকুল গুহ। গুহদের দেখেছি কনৌজিয়া কানেকশন নিয়ে বেশ সচেতন থাকতে। গুহরা নানা খেতাবি পদবিও ব্যবহার করতেন । যেমন রায়চৌধুরী, মজুমদার, ঠাকুরতা, বক্সি ইত্যাদি। কৃষ্ণদাসও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে কালক্রমে রায়চৌধুরীদের বংশ বিশেষভাবে বিস্তৃত হয়। টাকীতে সম্ভবত তাঁরা অর্ধেক আকাশ। বেশিও হতে পারেন। যতো পুরোনো ঘরবাড়ি, মাঠপুকুর দেখছি সবই রায়চৌধুরীদের কোনও না কোনও শরিক বংশের।
    আগে বলতো গোলপাতার জঙ্গল। এখন নাম হয়েছে মিনি সুন্দরবন। সুন্দরবন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে শোনা গেলো এখানে সে তল্লাটের গাছপালার প্রচুর দেখা মেলে। বিশেষত সুঁদরি, গরান। সুন্দরবনের হ্যালোফাইটিক ম্যানগ্রোভ জঙ্গল বস্তুত এখান থেকে শুরু হয়ে যায়। কাজুগাছের খুব রমরমাও দেখতে পাই। নদীর দিকে এগিয়ে যাওয়া সমতলে সারি সারি কামানো খেজুর গাছ। কবি'কে মনে পড়ে যায়। "আত্মরস লক্ষ্য ছিল বলে/ ইক্ষু মরে ভিক্ষুর কবলে/ ওহে মূর্খ, ইহা দেখে শিক্ষ্য/ ফল দিয়া রক্ষা পেল বৃক্ষ"। কিন্তু হায়! ফল দিয়েও খর্জুরের রক্ষা নাই। রসের সন্ধান তার হৃদয়ে। এ তল্লাটের খেজুর রস ও গুড় দেশের সেরা সঞ্চয়। খেজুর আর কলাবনের মাঝখান দিয়ে রাস্তার ধারে একটা গুমটি। সীমাসুরক্ষাবলের দু'তিন জন জওয়ান বসে পরিচয়পত্র দেখছেন। আরেকটু এগিয়ে দেখি মাটির পথের ধারে একটা বেঞ্চি পেতে একজন সান্ত্রী বসে। ভারতভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করছেন। হ্যাট হ্যাট করতে করতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গরু-ছাগলের সারি দেখে যাচ্ছেন মন দিয়ে । আপাতত এ ছাড়া আর কোনও বিপদ চোখে পড়ছেনা তাঁর। একটা সিমেন্টবাঁধানো পথ এগিয়ে গেছে সবুজচালা দেওয়া একটা ছ'কোনা চালার দিকে। বেঁটে ওয়াচ টাওয়ার গোছের ব্যাপার। সেখান থেকে হাল্কা জঙ্গুলে একটা আবহ চারদিকে। তল্লাটটি সেলফি তোলার বৈকুণ্ঠলোক। লোকে সুযোগের সদ্ব্যবহারে পিছিয়ে থাকেনা। এভাবেই শেষ হয়ে যায় মিনি সুন্দরবনের দৌড়। দু'চার জন বেঞ্চি পেতে চনাছোলা শসার দোকান দিয়েছেন সেখানে। গ্রামীণ বিস্কুটও পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে ডাব। তেমন স্বাস্থ্যবান নয় তারা। সবাই মিলে তাদের সদ্গতি করা গেলো। আবার সেই ভ্যানোর কোলে ফিরে আসা।



    --------------------------
    ফেরার পথে যেতে হবে রায়চৌধুরীদের বাড়ি। অবশ্য মোটামুটি যেকোনও বাড়িতে ঢুকে গেলেই কাজটি হয়ে যায়। কিন্তু এবার গন্তব্য জেনারেল রায়চৌধুরীর পৈতৃক ভদ্রাসন। বেশ, দেখে আসা যাক। একটি মস্তো গাছ। বাঁধানো গোল চবুতরা। একটা ভারি সুরম্য দীঘি। মাটির গ্রাম্য রাস্তা। শাদা রং করা আড়াইতলা একটি দালানবাড়ি। পাশে চণ্ডীমণ্ডপ। টিপিক্যাল পুরোনো সম্পন্ন মানুষের বসতবাটী। এই মূহুর্তে টাকী পল্লীর দর্শনীয় আকর্ষণ। দু'দণ্ড দাঁড়াই। আশেপাশে বিলিতি ধরণের থাম দেওয়া বারান্দা, ইঁটে নোনা ধরা পুরানিদর্শনের মতো বাড়িঘর। তেলেনাপোতা নতুন করে আবিষ্কারের একটা স্বাদ পাওয়া যায়। নদীর ধার দিয়ে টানা সরু রাস্তা। রিকশা, টোটো, ভ্যানো, বাইক, সাইকেল, গরু, ছাগল, কুকুর এবং কিছু মানুষ রাস্তা জুড়ে। কেউ চলমান। কেউ নিশ্চল। তবে নদীটি বয়ে চলেছে অবিরাম।


    ----------------------------
    মাঝে মাঝেই চমকে দিয়ে বেজে ওঠা " নাই বা হলো পারে যাওয়া" এবং তার সঙ্গে কোনও বিফল কবির লেখা ট্যুরিস্ট টানার কাব্যময় আহ্বানটি বেশ বিহ্বল করেছিলো আমাদের। 'ইছামতী নদী ভ্রমণ-পরিচালনায় ফ্রেন্ডস গ্রুপ' আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো এই 'তরীতে পা দিইনি' পার্টিকে গিরফতার করার জন্য। ভেবেচিন্তে স্থির হলো যখন ততোক্ষণে শীতের বিকেল ঝপ করে নেমে এসেছে। সকালদিকে রোদ সেঁকতে যাওয়াই প্রশস্ত।

    তখন তো বেলা গড়িয়েছে। অন্তত ঘড়িতে। কিন্তু আবছা ধূসর কুয়াশাতে ইছামতীর জল ঘুমিয়ে। ওপারের সাতখিরা জেলার তটভূমি একেবারে অস্পষ্ট তখনও। আমরা মাঝির কাছে যাই। অমন একটা সকালে দরদাম করতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু হায়, করতে হয়। জালিম জমানা। পায়ে পায়ে চড়ে যাই। আমি তো ক্যামেরা সর্বস্বানন্দ। তাই ছইয়ের ছাতে চড়ে বসি নির্বিকল্প দৃশ্যের সন্ধানে। উপরে চাঁদোয়া আর সামনে তিরঙ্গা। প্রচুর আওয়াজ ও ধোঁয়ার প্রদূষণ ছড়িয়ে নৌকোটি তীর ত্যাগ করে। মাঝনদী ধরে দক্ষিণের দিকে। মাঝে মাঝে চড়া। মধ্যরেখার ওপাশে হলে বাংলাদেশী গাদানৌকো, এপাশে হলে 'ইন্ডিয়ান' ভটভটিতে মাটি কেটে তোলা হচ্ছে। জলযানগুলি সবগুলিই প্রায় বাবা নূহের টেকনোলজিতে বানানো। যতো এগোয় ততো নদী চওড়া হয়। গন্তব্য মাছরাঙা দ্বীপ।



    আরো এগিয়ে গেলে ইছামতী, মাতলা, বিদ্যাধরী, রায়মঙ্গল নানা সরিৎবাহিনী কোলাকুলি, কাটাকুটির খেলায় ব্যস্ত। ও তল্লাট এখন বাংলা ছবি আর সিরিয়াল শুটিঙের স্বর্গরাজ্য। মাঝির খুদে চ্যালাটি অতি উৎসাহে বিভিন্নদিকে আঙুল ঘুরিয়ে অসংখ্য ফিলিম-সিরিয়ালের নাম মুখস্থ বলে যাচ্ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত এই নৌকোর যাত্রীরা প্রায় কোনও নামের সঙ্গেই পরিচিত নয়। কিন্তু তাতে তার জোশ কমেনা। সেই ছোটোবেলায় স্বামীজীর লেখায় পড়েছিলুম তু-ভায়াকে লেখা চিঠিতে। উনিশ শতকের শেষ থেকেই গঙ্গানদীর দু'পার কীভাবে কলকারখানায় দূষিত হয়ে পড়েছে। শহর থেকে এতোদূরে এসেও নদীর নিস্তার নেই। এদেশ ওদেশ দুদিকেই সারি সারি ইঁটভাটা থেকে উড়ে যাওয়া চিমনির ধোঁয়া। নদীর চড়া থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইঁটকলের খিদে মেটানোর জন্য। ওপারে তীরভূমিতে ধূসর আলো মেখে হাওয়ায় ওড়ে সারি সারি ক্যাজুরিয়ানা বীথি। মাঝে মাঝে গুদামের মতো দেখতে চালাবাড়ি। আর কিছু নেই। মাঝি বলে সাতখিরা শহর ওখান থেকে আরো দু'চার কিমি যেতে হবে। নদীর বিপরীতে।

    -------------------------------------
    নদীর নাম কীর্তিনাশা কেন হয় তার একটি উদাহরণ খুব প্রকট টাকীতে। জমিদারবাড়ি নামে প্রায় বিলুপ্ত যে নির্মাণটি ইছামতীর বুকে ভেঙে পড়ছে, তাকে দেখলে স্পষ্ট হয় বিশেষণটি। সত্যিকথা বলতে কী এই ভেঙে পড়া ভদ্রাসনটিই টাকীর মূল পুরাতাত্ত্বিক আকর্ষণ। গঙ্গার ভাঙনের মুখে এখনও দাঁড়িয়ে একটি বনস্পতি। তার শিকড়-বাকড়-ডালপালা-ঝুরি-পাতা সব কিছু সাজিয়ে। তাকে জড়িয়ে আছে একটি ভেঙে পড়া প্রাসাদের অন্তর্জলী ইঁট আর দেওয়ালের ছল। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে অসহায় দেবতাদের ভাঙাচোরা বাসরিলিফ। শুধু কালের তক্ষক এখনও আড়ালে। অন্তত আমাদের সামনে আসছেনা সে। একদিন জোয়ারের হড়পা আক্ষেপে তলিয়ে যাবে এইসব রাজাগজার প্রতাপী আড়ম্বর। শুধু ছবি, হায় শুধু ছবি হয়েই থেকে যাবে তারা। একটা শিরশিরে সর্বনাশের শিস বেজে যাচ্ছে ঐ বটপাতার মুকুট ঘিরে।



    এই গাছটির অন্যদিকে ধুলোরাঙা রাস্তার উপর দু'চারটে প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ যেমনতেমন চুনসুরকির টানে বেঁধে রাখা ভদ্রাসন হয়ে টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু ভাঙনের ডাক তারাও এড়াতে পারবেনা। খিলান দেওয়া দরজা-জানালা, লাল ইঁটে নোনা ধরেছে, ভাঙা মিনারে জেগে উঠেছে সতেজ দুব্বোচারা। পাখিদের দৌলতে কার্নিশের কোণে তরতর বেড়ে উঠেছে শ্যাওড়ার নবীন কিশোর। দূরে ইছামতী যেখানে পশ্চিমে ঘুরে যায়, সেখানে সূর্য ডুবছে বহতা জলের টানে। ভাঙা মহলের শিল্যুয়েট ছায়ার আবেশে দাঁড়িয়ে দেখি। বিভূতিভূষণের রাজপাটে গথিক সর্বনাশের মানচিত্র আঁকা হয়ে যাচ্ছে আলোছায়ার ব্রাশস্ট্রোকে। পশ্চিমের সূর্য একেবারে নিভে যাবার আগে আরো একবার গিয়ে দাঁড়াই সেই বনস্পতির শিকড় সাম্রাজ্যের মায়াবী টানে। চোখ বুজে তাঁর নাম জানতে চাই। একটু দ্বিধা করে তিনি পাতার ফিসফিসে কণ্ঠে স্পষ্টস্বরে বলে ওঠেন " আমার নাম শ্রীযুত বৃক্ষনাথ রায়চৌধুরী।"

    সূর্য টুপ করে তলিয়ে যায় বিদ্যাধরীর ঘোলা জল আর দিকচক্রবালে।



    সৌজন্যে : অবসর
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ জুন ২০১৭ | ১০৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | ***:*** | ০২ জুন ২০১৭ ০৩:৫৮60395
  • খুবই ফাসক্লাস সরস লেখা।
  • Rabaahuta | ***:*** | ০২ জুন ২০১৭ ০৪:৪৯60396
  • খুব মনের মতো লেখা। তিলু বিলুর গল্প পড়েই স্থায়ী কৌতুহল তৈরী হয়েছে, এই মিনারের ছবি তুলেছিলাম মনে পড়লো, কত বছর আগে!
  • d | ***:*** | ০২ জুন ২০১৭ ০৯:০৮60394
  • আহা অনেকদিন ধরে এই রুটটা এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে।
  • de | ***:*** | ০৩ জুন ২০১৭ ০২:৫৯60397
  • আহা! চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পেলুম--

    কোথায় ছিলেন টাকীতে, শিবাংশুদা?
  • শিবাংশু | ***:*** | ০৪ জুন ২০১৭ ০২:৫৭60398
  • এই তো এইখানে..... :-)

  • de | ***:*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:২৩60401
  • আমি ছবি দেখতে পেলুম না -

    লেখাটা খুব ভালো - পুজোর সময়ে ইছামতীর বিসর্জন খুব সুন্দর হয় শুনেছি -
  • trh | ***:*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৩২60399
  • ( | ***:*** | ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:৩৩60400
  • আবনারা সব ছবিছাবা দেখতে পাচ্চেন, নয়? আমার এখেনে দেকচ্চে না কেন কে জানে!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন