বেশ লেখা।
শুরুতে দুর্গা এক স্বাধীন নারী ছিলেন এই রেফারেন্সটা কোথায় পাব?
@'দ',
অনেক ধন্যবাদ।
রেফারেন্স তো অনেক রয়েছে। তবে তাদের এক জায়গায় করে বিশদ আলোচনা করেছি আমার 'হিন্দু দেবতা-এক অনির্বেদ অডিসি ' নামের বইটিতে।
বর্তমান শারদীয়া দুর্গোৎসব বৈদিক, অবৈদিক, দ্রাবিড়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সবার দ্বারাই প্রভাবিত। বিভিন্ন সংস্কৃতির অপূর্ব সংমিশ্রণ এই শারদীয়া পূজা। তবে এই লেখায় অনেক তথ্যগত ভুল আছে।
লেখক বলেছেন ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার পরিচয় স্বাধীন, অনার্য দেবী হিসাবে। এ তথ্য সঠিক নয়। ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার প্রথম উল্লেখ পাই যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে যেখানে দেবীকে অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তেজে শত্রুবিনাশকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই দুর্গার প্রাচীনতম বর্ণনা।
অন্যদিকে দেবীকে শবর, বর্বর, পুলিন্দ, ম্লেচছ, সকলের দ্বারা বহূপূজিতা রূপে স্তুতি করা হয়েছে। মহাভারত, হরিবংশে দেবীকে বিন্ধ্যবাসিনী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া। ভবভূতি, বাণভট্ট, সুবন্ধু প্রভৃতি লেখকদের লেখায় এই শবরপূজিতা মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই শারদীয়া উৎসবে মিলিত হয়েছে শরৎকালীন রুদ্রযজ্ঞ, সিংহবাহিনী দেবীর উপাসনা, শস্যসম্পদশালিনী পৃথিবী দেবীর উপাসনা। এই সমস্ত কিছুর মিলিত রূপ আজকের দুর্গাপূজা।
@দীপ,
'তবে এই লেখায় অনেক তথ্যগত ভুল আছে।'
....ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার প্রথম উল্লেখ পাই যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে যেখানে দেবীকে অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তেজে শত্রুবিনাশকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই দুর্গার প্রাচীনতম বর্ণনা।'
'অনেক 'তথ্যগত 'ভুল' বলতে তৈত্তিরীয় আরণ্যকের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শ্লোকটি বা তার Context কিছু লেখেননি। মনে হচ্ছে কোনও লিংক থেকে তথ্যটি জেনেছেন আপনি। বাকি যা কিছু লিখেছেন তা মূলত কিছু জনপ্রিয় গ্রন্থ থেকে পাওয়া সংক্ষিপ্ত আলোচনার অংশ। যেমন শশিভূষণবাবুর বই। তা 'ভুল' নয়। কিন্তু সামগ্রিকও নয়। আমার বইটির অতি দীর্ঘ একটি আলোচনা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি রাখছি এখানে। আপনার অবগতির জন্য। আশা করি কারও 'তথ্যগত ভুল' আবিষ্কার করার আগে ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদ পাঠ করে নেবেন। বইটিতে অসংখ্য উৎস ও আকরের তালিকা রয়েছে। আগ্রহী হলে সন্ধান করে দেখতে পারেন।
'দুর্গা' নামপদের উৎস ঠিক কোথায় তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র, অর্থাৎ পুরাণ ইত্যাদিতে সচরাচর দেবীকে দুর্গতিনাশিনী বলা হয়। এই ক্ষমতার জন্য নামটি প্রচলিত হতে পারে। শব্দকল্পদ্রুমে পাওয়া উল্লেখ অনুযায়ী এই দেবী 'দুর্গ' নামক এক দৈত্যকে নাশ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বহু ঐহিক পারত্রিক দুর্ভোগ থেকে ত্রাণ করেন। তাই হয়তো তিনি 'দুর্গা'। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গারূপে দুর্গম ভবসাগর পার করানোর কাণ্ডারী। অবশ্য এই পুরাণেই আবার বলা হয়েছে 'দুর্গম' নামক মহাসুরকে বধ করার কৃতিত্বে তিনি দুর্গা। অধিক প্রচলিত মত হলো দুর্গ ও নগররক্ষাকারিণী দেবী হিসেবে তাঁর নাম দুর্গা হয়েছিলো। এই মতটির সপক্ষে রয়েছে দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত,খিল হরিবংশ ইত্যাদি পৌরাণিক সংকলনগুলি। প্রাচীন গ্রিক শষ্যদেবী, কুমারী শক্তি ভার্গো'র (Virgo) সঙ্গেও দুর্গা নামপদের সমীকরণ করার প্রয়াস হয়ে এসেছে।
বৈদিক সাহিত্যে 'দুর্গা' নামটি দেখা যায় (তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০।৭।৭)। কিন্তু এই দেবী পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে প্রচারিত যোদ্ধৃদেবতা নন। তখন দুর্গা ছিলেন একটি বিশেষ যজ্ঞাগ্নির নাম।
তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং
বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম ।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে
সুতরসি তরসে নমঃ ।।
(নারায়ণীয় উপনিষদঃ তৈত্তিরীয় আরণ্যক)
অপর রূপটি একেবারে আলাদা। তার বর্ণনাও পাওয়া যায় নানা জায়গায়। যেমন, শব্দকল্পদ্রুমে দেওয়া হয়েছে দেবীর সম্পূর্ণ অন্য একটি রূপের ব্যাখ্যান।
" দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি ।।
মহাভয়েহতিরোগে চাপ্যাশব্দো হন্তুবাচকঃ ।
এতান হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতা ।।" (শব্দকল্পদ্রুম)
মাননীয় লেখক, আমি বেশকিছু বই এ বিষয়ে পড়েছি। তবে ব্লগে লিখতে অভ্যস্ত নই, তাই সংক্ষেপে লিখি। আপনি এখানে দুর্গাকে একটি বিশেষ যজ্ঞাগ্নি রূপে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির ব্যাখ্যা অনুযায়ী এখানে দেবীকে ই বন্দনা করা হয়েছে। দেবী শক্তিস্বরূপিণী, তাই তিনি অগ্নিরূপা। শুধুমাত্র যজ্ঞাগ্নি নন। মনে হয় শরৎকালীন রুদ্রযজ্ঞ ও দুর্গরক্ষয়িত্রী দেবীর কল্পনা মিলেমিশে গেছে।
আমার কোনো কথায় আঘাত পেলে দুঃখিত।
@দীপ,
দেখুন ভাই, বিষয় হিসেবে 'দুর্গা' একটি অত্যন্ত বিস্তৃত ও জটিল প্রপঞ্চ। তা নিয়ে ব্লগে আলোচনা হয়না। এ বিষয়ে আমি একমত। অনেকেই করেন বটে, কিন্তু তা বস্তুত অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো হয়ে যায়। এই লেখাটি একটি সংবাদপত্রের জন্য লেখা । সে কারণেই ব্লগে দিয়েছি। সর্বতোভাবে আংশিক আলোচনা। কোনও গভীর অনুসন্ধানের পরিসর নেই এখানে।
বেদের নানারকম ব্যাখ্যা হয়। মৌলত ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা। দুয়ের মধ্যেই সত্য আছে। কেউই পরিত্যজ্য নয়। তবে দু হাজার কুড়ি সালে মানুষের যুক্তিবোধের দিকচিহ্নগুলি অনেক বদলে গেছে। পাল্টে গেছে ধর্ম ও জিরাফকে একাসনে বসানোর রীতিটিও । যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রণম্য পণ্ডিত। তাঁর থেকে অনেক কিছুই শিখেছি আমরা। তিনি যে যজ্ঞাগ্নির যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই একই ধরন আমরা স্বামী অভেদানন্দের ব্যাখ্যাতেও পাই। শুধু 'দুর্গা' ন'ন, 'কালী'ও একটি যজ্ঞাগ্নি শিখার নাম। যজ্ঞশিখা থেকে আমাদের চেনা দেবীতে উত্তরণ একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। শুধু মাত্র ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা দিয়ে তার উত্তর পাওয়া যায় না। আমার 'দেবতাচর্চা'র ভিত্তি দ্বান্দ্বিক দর্শন। সেখানে ভক্তিবাদী দর্শনের মতো 'যুক্তি'কে একমুখী মাহাত্ম্য দিয়ে বিচার করা যায় না। উল্লেখিত বইটি থেকে আরেকবার সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি। কী বলতে চাই, সেটা স্পষ্ট করতে।
'দেবীর উৎস সরাসরিভাবে বেদের মধ্যে আছে এমত প্রচারও করা হয়। যাঁরা এই মতবাদ পোষণ করেন, তাঁদের জানাই, ঋগবেদ অনুযায়ী দেবীর উৎপত্তি যজ্ঞের আগুন থেকে হয়েছিলো।
" বি পাজসা পৃথুনো শোশুচানো
বাধস্ব দ্বিষো রক্ষসো অমী বাঃ ।
সুশর্মণো বৃহতঃ শর্মণি
স্যামগ্নেরহং সুহবস্য প্রণীতৌ ।।" (ঋগবেদ-৩/১৫/১)
এটি বস্তুত যজ্ঞাগ্নির প্রার্থনামন্ত্র। এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্বামী অভেদানন্দ বলেছিলেন ' ঋগবেদে অগ্নিরূপিণী দুর্গাদেবীকে শত্রুবধকারিণী ও রাক্ষসহন্ত্রী বা অসুরনাশিনী বলা হইয়াছে।" মন্ত্রটির এই ব্যাখ্যা সম্প্রসারিত অর্থের সূত্রে এসেছে। গতশতক থেকে প্রাসঙ্গিক হতে থাকা নতুন মাত্রার আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা হিসেবে তাকে ধরা যেতে পারে।
বৈদিক দুর্গার সঙ্গে পরবর্তীকালের বহুল প্রচারিত রণরঙ্গিনী দেবীর কোনও সম্পর্ক নেই। উত্তরবৈদিক ও পুরাণযুগে দুর্গা নামে এক দেবীর প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তিনি দু' ধরনের পরস্পর বিপরীতরূপে প্রকটিত হ'ন। তাঁর রণদুর্মদ যোদ্ধৃ মূর্তিটি অপেক্ষাকৃত প্রত্যক্ষ। কিন্তু, অপর অবতারটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনি প্রজননমুখী শষ্যদেবীর মূর্তি ধরে আবির্ভূতা হ'ন। উল্লেখ্য, দুই কল্পনারই আদি শিকড় রয়েছে অনার্য মনন ও সভ্যতার ভূমিতে। আর্য সভ্যতার অন্দরমহলে দুর্গাকে সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায়না। বৈদিক সাহিত্যে তাঁর মূল খোঁজা একান্তভাবে 'নিপাতনে সিদ্ধ'। আর্য পুরাণসাহিত্যে দুর্গার যাবতীয় কল্পনা পর্বত-অরণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা সে হিমালয় হোক বা বিন্ধ্য পর্বত। বিবর্তনের স্তরে তাঁর একটি কল্পিত রূপ পর্বতরাজ হিমালয় কন্যা পার্বতী। যিনি অনার্যদেবতা শিবঠাকুরের শক্তি বা সঙ্গিনী। এটি আর্য প্যান্থিয়নের সংযোজন। কিন্তু অন্যরূপটি অধিক প্রাচীন এবং ইতিহাসসম্মত। এদেশে আর্যদের আসার বহু আগে থেকে বিন্ধ্যপর্বত ও তার অরণ্যপ্রদেশে শবর, আভীর প্রভৃতি পার্বত্য আদিম উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। তাদের মাতৃশক্তি হিসেবে একজন দেবী বহুদিন ধরেই পূজিত হয়ে আসছেন। নাম, বিন্ধ্যবাসিনী। এই দেবীর পূজাপদ্ধতিতে সামিল রয়েছে মদ্য-মাংস-রুধির পানের বিধি। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ ও মহাভারতে (বিরাট পর্ব) এই পূজাপদ্ধতিকে একান্তভাবে অনার্য সুলভ বলা হয়েছে। বস্তুতঃ আর্যমতেও একসময় 'বনদুর্গা' নামে এক দেবীকে স্বীকার করা হয়েছিলো, যিনি বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর নিকটতম বিগ্রহ, সম্ভবতঃ অরিজিন্যাল 'দুর্গা'। একটা ব্যাপার মোটামুটি স্বীকৃত। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক, অর্থাৎ গুপ্তযুগের সময় থেকে দুর্গা তাঁরা অনার্য বাসভূমি ও ধারণা থেকে ক্রমশ মুক্ত হতে শুরু করেছিলেন। আর্যপুরাণের নিজস্ব রূপকল্পে যুদ্ধপরা, দানবদলনী দুর্গার মূর্তি প্রবর্তিত হয়ে যায়। '
তবু লোকে ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা দিতে এবং শেখাতে চায়।