এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবন শয্যার নক্সীকাঁথা - ৩

    Sudip Ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ অক্টোবর ২০২৫ | ৮ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২
    গল্প বলতে বলতে কখন যেনো মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো। সোমা জল মুছে দিলো। বললো, আর পনের দিন পরেই পুজোর ছুটি। সবাই বাড়ি যাবো। কি মজা বল। মেনকা বললো, ঠিক বলেছিস।

    কথায় বলে না ভালোলোকের শত্রুর অভাব নেই। সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই। আর এইসব গান বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি। অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে। সুমন আর রূপসী বড় শিল্পী। তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়ে নি। মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে। আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে। তাই সে খুব খুশি। সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের। বাড়ির কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়। তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো। সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে। মন খারাপ হয়েছিলো তার। ভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো, কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়। মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়। দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া। মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি। একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো। বলেছিলো, কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও। সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো, আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না। বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া। তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে। সেখানে মেনকার বাড়ি। মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য। আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো। সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে গেলো গ্রাম। পালাশেষে মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো, আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি। সুমন বললো, অনেক বড় হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে। রূপসীও নেই। মরে গেছে। মেনকা বল, কে এই রূপসী।
    -- আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি। সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো। আমি পারি নি।
    -- কেন, পারেননি কেন?
    -- আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।
    -- ও বুঝেছি।
    -- এই আড় বাঁশির আড়ালে অনেক কান্ড ঘটে গেছে মা।
    -- আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাবো। প্রণাম নেবেন।
    তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এলো নিজের গ্রামে। এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরোনো কেউ নেই। দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো। বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এলো। সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি। শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। একদিন মেনকা এলো তার গবেষণার কারণে। এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।
    তিনি বললেন, মা তোমার কোথায় বাড়ি।
    -- কোপা।
    -- তোমার বাবার নাম কি?
    -- কার্তিক মাঝি।
    ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে। কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম। যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।

    তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো। মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো। মেনকা বললো, আমি আপনার কাছে। সুমন বললো, তোমার যতদিন খুশি থাকো। আমার মধুবনিকে দেখো। আরও অনেক তথ্য পাবে। সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু বলতে পারছে না। সুযোগ এসে গেলো। সুমনবাবু বললেন, কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও। গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো। মেনকা জিজ্ঞেস করলো, তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো। কালো বললো, বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন।
    -- কই বাজাও দেখি। কালো বাঁশি বাজালো। এযেনো রাধার পোড়া বাঁশির সুর। মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো। সে বললো, আমিও এই সুর শিখবো, বাজাবো।
    -- নিশ্চয় শিখবে। বাজাবে।

    তারা দুজনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে। ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ। কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে। তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে। বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে। মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেনো তাকে মারার চক্রান্ত করছে। তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে। পুলিশ এলো। তারা তদন্তের ভার নিলেন। সুমনবাবুর ছাত্র ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো। আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র ছাত্রীরা। এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন। এই বড় শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু। কালোর মা বললেন, মেনকা তোমার মত একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে। মেনকা বললো, একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বললেন, আমরা তোমাদের বাড়ি যাবো। মেনকা আর কালো দুজনে ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে। কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে। আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে। তার নাম দেবে, আড় বাঁশির আড়ালে। মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে। আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি। এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ, মেনকা বোস। সুমনবাবুর মৃত্যুর দুবছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোাসার জয় হলো। কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো। জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে?স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? চিিিরদিনেসজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে ছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস। বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের একটা বস্তি নন্দনপাড়। নন্দনপাড়ে গরিব লােকের বাস। আর তার চারধারে বেশ কয়েক বর্গ কিলােমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে শহর। নন্দনপুকুর বলে একটি পুকুর আছে। তার পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বসতি। অংশুমান নন্দনপাড়ের কাছেই দু-কাঠা জমি কিনে তার শখের বাড়িখানা তৈরি করেছে। মােটামুটি দু-খানা ঘর, একটা ডাইনিং আর বাথরুম। অংশুমানের একটি ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর তার স্ত্রী দেবী সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। অংশুমান একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। বেতন সামান্য। তবু সংসার চলে যায় আনন্দে। আজকে অনেক পরিশ্রমের পরে অংশুমান। নন্দনপাড়ে এসে বাড়ি করে শান্তিতে বাস করছে। নন্দনপাড়ের বাসিন্দারা। সবাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কিছু লােক থাকে তারা চিরকাল নিজেদের একইরকমভাবে চালাতে চায়। মানুষের প্রতি ভালােবাসার, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। নিজেকে গুটিয নন্দনপাড়ের এইরকম আসর এই প্থম। এখনকার লােক দু-চারটে মূর্তি এনে গুজা করে শাস্তি। দিন আনা দিন খাওয় লাকে বাস এখানে। এখানে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ মন ব্যাপার। এ একদিন ছিল, যখন এই নন্দনপাড়ের নামে লোকে ভয় পেত। এই পাড়া মানেই কিছু অসামাজিক প্রকৃৃতির লােকের বাস। সবাই এই মনে করতেন। সত্যি যা রটে তা কিছুটা বটে। তখন বেশ কজন ছিল, যারা চুরি-ডাকাতি করত। নেশা করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অপরের বউকে নিয়ে টানাটানি করত। কিন্তু চিরকাল একভাবে চলে না। অন্যায়-অত্যাচারের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতিকার করে। এক নতুন পথের চিন্তায় থাকে। এ যেন মানুষের সহজাত চিন্তা। পাপী লােক দু-দিন আর গুণবান যুগে যুগে অবস্থান করে মানুষের অন্তরে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত অংশুমানের মন। । | অংশুমান ভাবে, যখন সে এল নন্দন পারে, তখন তার বাড়িঘর হয় নি। ফাঁকা মাঠে এসে বাড়ি করে ফেলল অংশুমান। চিতাভাবনা মা করে, বাড়ি ভাড়া করে থাকত গ্রথমে। তারপর ভাবনা করল। কম দাম দেখে অংশুমান একটা ঘর তৈরি করল। বাঁশের বেড়া দিল চারিদিকে। ন ছেলে পাঁচ বছরের। স্ত্রী দেবী খুব সাহসী মহিলা। তার সাহস না থাকল তো অংশুমানের এখানে এসে থাকা হত না। মানুষ মরে যাওয়ার পরে পেট ভরে ভােজনের রীতি আমাদের সমাজে। এই খাওয়ার পর্ব হয়ে আসছে পুরোনো কাল ধরে। ক্ষমতা থাক বা না থাক এই খাওয়ার রীতি। অংশুমান ভাবছে পাঁচজন মানুষকে খাওয়ালেও শান্তি। বেঁচে থাকতে যে মা ছেলের কষ্টে চোখের জল ফেলতেন, মমতা বলতে কিছু থাকে তাহলে চোখের আড়ালে থেকেও ছেলের কষ্ট সম্বরণ করতে পারবেন না। ভারতবর্ষে অনেক ছেলে আছে যা মায়ের ঠিকমতাে দাহকরতে, শ্মশানে আনার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যায়। অংশুমান ভাবে, তবুসমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হয়। চাকরি-বাকরি পেলেও শুধু বসে থেকে মাথার চুল ছিড়লে হবে না। ব্যবসা করতে হবে, ভগবান যে দু-হাত দিয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে সেই দুই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। মূলধন নেই বলেই তাে অংশুমান ভাবে, টিউশনি আরও বাড়াতে হবে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে বেরােয়। অংশুমান, সাতটা থেকে সাড়ে আটটা একটা তারপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা অবধি আর একটা দল ছাত্র পড়ায় অংশুমান। আবার রাত্রিতে দুটো ব্যাচ। এইভাবেই অংশুমানের সময় কেটে যায় কর্মের মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে সবজি-বাজার, মুদি-বাজার সব করে নিয়ে আসে। । অংশুমান কাটোয়ার বাড়িতে বসেছিল। আজ রবিবার, টিউশনি নেই। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি পুরুলে থেকে ফোন এল মায়ের, "অংশু, একবার বাড়িতে আসতে পারবি? আমার ওযুধ ফুরিয়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে আসবি।” অংশুমান ফোনে বলল, “আমি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তােমার কাছে যাচ্ছি। " স্ত্রী দেবীকে বলল, “পুরুলে থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে আজ ভাত খাব না। মায়ের কাছেই খাব।" এই বালে অংশুমান সাইকেল নিয়ে ওষুধের দেকানে ওযুধ আর তার সঙ্গে কিছু ফল-মূল, মিষ্টি নিয়ে পুরুলে মা-র কাছে গেল। অংশুমানরা চার ভাই, দুই বােন। দুই বােনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারভাই এখন পৃথক হয়েছে। যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা নেই। মা যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন সেখানেই থাকেন। চার ছেলে চার জায়গায় থাকে। বাবার চাকরি সূত্রে মাকে যেতে হল হাওড়া জেলার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় মা তিনভাইকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। বড়দা অংশুমানের কাকাবাবুর কাছে থেকে গ্রামে পড়াশোনা করে। অংশুমান ভাবে, তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে এতদিন ইলেকট্রিক আলাে দেখেনি অংশুমান। সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা বাবা সুইচ অন করে দিয়েছেন। আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে এল। কোথা থেকে আলাে আসছে অংশুমান বা তার ভাইরা বুতে পারল না। বাবা দেখিয়ে দিলেন আলাের উৎস। উপরে বাতি ঝুলে রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। অংশুর এখনও মনে আছে। তারপর সকাল বেলা বাবা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন অংশুমানদের। অংশুমানের ছোটভাই তখন মাত্র দুই বছরের ছেলে। অংশুমান এবং তার মেজদা মাত্র তিন বছরের তফাত। দু-জনে মিলে স্কুলে ভর্তি হতে গেল। দাদা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হল কিন্তু অংশুমান অঙ্ক একটু ভূল করায় একেবারে নার্সারি এসে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি হলেও এখানে নার্সারিতে ভর্তি হল। তখন থেকেই ভালাে করে পড়াশােনা করার জেদ মাথায় জাকিয়ে বসল। তারপর থেকে সে প্রত্যেকবছর ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। এসব কথা তার মনে আছে। অংশুমানের বন্ধু ছিল অশ্বিনী, মােহিনী, হার, গৌতম, গােরা, শঙ্কর প্রভৃতি বালকেরা। ধীরে ধীরে অংশুমানের পরিবার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় বেশ সুন্দরভাবে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অংশুমান ছােটবেলায় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালােবাসত। ছােট ছােট বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় একটা ভালাে ক্রিকেট দল গঠন করেছিল, ক্যাপ্টেন ছিল সে নিজেই। একটা শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ভিতরে সবাই মিলে কোদাল, কুড়ি, ঝাটা নিয়ে শীতকালে ক্রিকেট খেলার জন্য "পিচ তৈরি করা শুরু করত। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গে অংশুমানের। মাঝে মাঝে ক্রিকেট ম্যাচও খেলা হত। বন্ধুরা সবাই মিলে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার জন্য চাদা তােলা শুরু করল। নিজেরাই বাঁশ পুঁতে নিজেদের মায়েদের, দিদিদের শাড়ি এনে সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করে ফেলল। এখন ঠাকুর আনার পালা। একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে সামনের পটুয়াপাড়া থেকে মূর্তি আনা হল। মূর্তি বসানাে হল বেদিতে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলের কাজ করা হল। অংশুমান দেখেছে বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি হয়। তাই ওরাও সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করবে। কিন্তু রাত যে অনেক বড়। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার পরে অফুরন্ত সময়। এখন কি করবে? ওরা भান করল ডিম-ভাত খাওয়া হবে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জোগাড় করে ওয়া-পাওয়ার জোগাড় শুরু হয়ে গেল। খেতে বসার সময়ে অংশুমানের মনে পড়ল, সরস্বতী পুজোর আগের দিন ‘বারের উপােস না করলেও কোনাে আঁশ জাতীয় খাবার খেতে নেই। পরে কাউকে কিছু না বলে ডিম-ভাত নিয়ে মাকে দিল। আর কোনাে ছেলের কথাটা মনে নেই। কষ্ট দিতে মন চাইল না অংশুমানের। ডিম-ভাত অংশুমান খেল। ঘড়িতে দেখল এগারােটা বাজে। রাতের বেলা প্যান্ডেলে সারারাত কাটানাে মুখের কথা নয়। কিন্তু বন্ধুরা যখন এসবে মাতে তখন কোনাে বাধাই বাধা নয়। সব সমস্যা যার নতে যায়। বন্ধুত্বের শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে প্রত্যেক মানুষই তার জীবন মাধ্যমে এই তত্ত্ব বুঝে থাকেন। মশার কামড়েও যেন আনন্দের সুর। দাগ কাটে না বালক অংশুমানের মনে। পরের দিন সকালবেলা সবাই স্নান করে পুজো মণ্ডপে হাজির। ফল কাটা সব হয়ে গেছে। পুরােহিত এসে গেছেন। পুষ্পগুলি দিয়ে। পুরােহিতের সঙ্গে সবাই একসুরে বলছে, ভদ্রকালী নমঃ নিতং সরসত নমঃ নমঃ"—ভুল ইত্যাদি মন্ত্র। ঢাকের বাজনার সাথে সকলের নাচ হল। প্রসাদ বিতরণের পর মণ্ডপের সামনে একটা বেড়ার আড়াল দেওয়া হল। তারপ স্কুল যাওয়ার পালা। স্কুলে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। আবার পরের দিন সকালে দধিকর্মার পূজা। পূজাশেষে পুষ্পাঞ্জলি। রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জন। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ঢাকের বােলে তালে তালে সবাই নাচতে নাচতে গিয়ে হারুদের পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এল।

    এইভাবে ভালাে-মন্দে সুখে-দুঃখে অংশুমানের জীবন কাটছিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসও বাড়ছে। ক্লাস সেভেনে উঠে টি.আরজি.আর খেমকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিক্সে প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য অংশুমান এক বই’ পুরস্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে দেখিয়ে সে কি আনন্দ তার। এখনও সব কথা মনে আছে। অংশুমান বন্ধুদের সাথে রেইনের পাশের রাস্তা ধরে স্কুলে যেত। কোনােদিন স্কুল কামাই ত না। তার জন্য শিক্ষক মশাইরা তাকে খুব ভালােবাসতেন। অংশুমান ছাত্রদের পড়ায় আর পড়ার বাইরে জানা অজানা অনেক ইতিহাস বা অন্য বিষয়ের কথা বলে। অংশুমান আজ নারীর স্থান সম্পর্কে কথা বলছেন। পুত্রকে ঘিরেই সাধারণত দশকর্ম পদ্ধতি আয়ােজিত হত হবে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন এবং জন্মের পর নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, গ্রেশন, চূড়াকরণ কৌটিল্য মন পুত্র বেশি অংশ ?নারী অধিকার মাতা। মৃত্যুর পর সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত হবে এবং শে পাবে। পুত্রের অবর্তমানে কন্যা, জামাতা, মৃত ব্যক্তির পিতা, ভ্রাতা, | মাতা সম্পত্তির অধিকার লাভ করত। মৃত ব্যক্তির বিধবা পত্নী সম্পত্তির অংশ পাবেন কিনা সে সম্পর্কে মন কিছু বলেন নি। পেরকে, যাজ্ঞবল্ক্য পিতৃ ঋণ ও পৈত্রিক সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করার ব মতে পুত্রের অবর্তমানে তার স্ত্রী, কন্যা, পিতা-মাতা, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্ররা অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকারী হবে। সমাজে নারীর স্থান ও প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য। সমাজে নারী এতে প্রচুর উপাদান আছে। এ সম্পর্কে বেদ ও বৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, মায়েদের হাতে প্রচুর উপাদান পুরাণ, গ্রিক পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পাণিনি ও পতঞ্জলি ব্যাকরণ, বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি, বিভিন্ন চােষ এবং সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্য বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শন, শিলালিপি ও তাম্রশাসন আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। সিন্ধু সভ্যতার আমলে মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের হাতে কোনও দান নেই। তবে সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন মাতৃমূর্তিগুলি থেকে বোঝা যায় যে এই র যা যুগে মেয়েরা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ঋক-বৈদিক যুগে (খ্রিঃ পূঃ ১৫০০-খ্রিঃ পূঃ ১০০০) মেয়েরা যথেষ্ট মর্যাদার অধিকারি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত, তারা বেদ পাঠ ও উপনয়নের অধিকারি ছিলেন মন্ত্র রচনা করেন, অধ্যাপনা করতেন এবং প্রকাশ্য সভায় তর্কযুদ্ধে অবতার। হতেন। সকলের জীবন তো সমানতালে চলে না। ছন্দপতন ঘটে যায় নিয়তি আসার মতাে। কে যে আড়ালে থেকে সুতাে ধরে পুতুলের নৃত্যে, নাচায়, তা একমাত্র জগাই ক্ষ্যাপা' জানে। অংশুমানের কাকা যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। তড়িৎ, আলাককাকা, বাবলুকাকা, বুলুকাকা, দিলীপদা, অমরকাকা, টুলাদা, বুলাদা সবার নাম মুখে মুখে হেমন্তবাবু অকলে চলে যাওয়ার দূঃখ। দিলীপদা তুলে নিলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। আর যে পথিক গােপনে গােপনে নীরবে সংসারের দায়িত্ব পান করে গেছেন তিনি আর কেউ নন, অংশুমানের মেজদা। তার নাম রিলিফ। সকলের, যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার হাত আছে। অংশুমান স্বীকার করে মনের গােপনে নীরবে হাসিমুখে। যাই হােক সেবার ক্লাস সেভেনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে অংশু। গ্রামের বাড়ি পুরুলেতে সদলবলে পুনরাগমন। অংশুমানের বাবা জমি-জায়গা দেখাশোনা করেন আর লিলুয়া থেকে দুই দাদা সুবিধা-অসুবিধায় বাবাকে সাহায্য করেন। আংশুমান এবার গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্কুলে, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার বাবার সাথে স্কুলে গেল পায়ে হেটে। তখনকার দিনে পাকা পথ ছিল না। জমির আলরাস্তা ধরে স্কুলে গেল অশুমান। পায়ে ব্যথা ছিল। ধানের শিষে পা কেটে গিয়েছিল অংশমানের। স্কুলে একটা পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় খাতা দেখে বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় অংশুমান সফল। আমরা ওকে ভর্তি নেব। ভর্তি হয়ে গেলাস এইটে। এবার অন্য এক জীবন। শহর থেকে এসে গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হল এবার। পরের দিন থেকেই স্কুলে যাওয়া শুর করল অংশু। আল রাস্তা ধরে কাবে কােনাে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। মাঝে একটা কদর আছে। শীতকালে হাঁটু জল। কিন্তু হলে সর না হলে পার হওয়া যাবে না। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী অম্বুজাক্ষ দত্ত মহাশয়। ইংরাজি স্যার ছিলেন শ্রী দিলীপ উট্টোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অংশুমানের বন্ধু জুটে গেল অনেক। অমল, রবীন্দ্রনাথ, বিনয়, টাদ, বিশ্বরূপ, মিল, অধীর, পিনু, শ্যামল ও আরও অনেক ৭। সবার সঙ্গে মেশার এক সহজাত স্বভাব অংশুমানের ছিল চিরদিন। একদিন অমল বলল-সবাই আমরা একসাথে দুর্গাপুর শহরে বেড়াতে যাব। " অংশুমান বলল - "তাহলে কথাটা প্রথমে আমাদের ভূগোল সার, মহিমবাবুকে বলি। " ক্লাসে মহিম কুমার সাধু মহাশয় পড়াতে এলে অংশুমান। বলল - "স্যার, দুর্গাপুর শিল্পনগরী। যদি আপনি নিয়ে যান, তাহলে ভালাে হয়।" মহিমবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুর। সারাদিন ঘোরার পর তারা রাত্রিবেলায় ফিরেছিলাম নদীর ধারে। তখন। বর্যাকাল। অজয় নদীতে প্রবল জলের ঢেউ। রাত্রি মাঝিরা ওপারে ঘুমাচ্ছে। তাহলে নৌকা আনবে কে? মহিম বাবু বলামাত্রই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিখেশ্বর গ্রামের তিনটি সাহসী ছেলে। ভরা নদীর বুকে অতি সহজেই সাঁতার কেটে চলল তিনটি বালক। অংশগুরা পাড় থেকে চিৎকার করে বলছে, "তােরা। সবাই নিরাপদে আছিস তার?" উত্তর আসছে মাঝের নদী থেকে নেই। আমরা ঠিক আছি। ” এইভাবে সাড়া দিতে দিতে ওরা ওপ গেল। তারপর নিজেরাই দড়ি খুলে নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করল। নৌকা। এপারে এলে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল-“কি রে, মাঝিদের ডাকলি। ওরা উত্তর দিল — “সারাদিন খাটুনির পর ওরা একটু নিদ্রামগ্ন, কি করে, কোন লজ্জায় ওদের ঘুম ভাঙাই বল। ওরা আমাদের চেনে। আমরা ওদের ঘরের লােক। ”অংশুমান চিন্তা করল, মানুষকে কতটা ভালােবাসে এরা, তারই প্রমাণ এই বাক্য। আবার নতুন করে মানুষকে ভালােবাসতে ইচ্ছে করল অংশুমানের। দশজন করে একটি নৌকায় মােট পাঁচবারে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ নিরাপদে সেই রাত্রে নদীর এপারে চলে এল, ওই তিনজনের অসীম সাহসের ফলে। স্কুলে অংশুমানেরা সেই রাত্রি বেঞ্চিতে শুয়ে কাটালাে। পরদিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই হাঁটা রাস্তা ধরে চলে এল একেবারে নিজের বাড়ি পুরুলে’-তে। গ্রামের নাম ‘পুরুলিয়া’। কেতুগ্রাম থানায় অবস্থিত। সবাই ছােট করে গ্রামটিকে ‘পুরুলে’ বলেই চেনে। অংশুমানের স্বপ্নভূমি এই পুরুলে গ্রাম। - অংশুমান জানালার ধারে বসে ভাবছে গ্রামের কথা। পুরুলেতে পূজা বাড়ি আছে। এই বাড়িটি মােটামুটি দুইশত বছরের পুরােনাে বাড়ি। এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। একটি হাইস্কুল আছে। এটি দান করেছিলেন অতুলবাৰু তার বাবা মহেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। স্কুলটির নাম বর্তমানে মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। তখন স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমােদন পায়নি। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের স্কুলে পড়াশােনা করতে যেত। অংশুমান এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বর্ষা-গ্রীষ্ম-শরতে হেঁটেই স্কুলে যেত। সময় তাে আর থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে অংশুমানের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সমাপ্তও হল। শিবলুন স্টেশনে নেমে অংশুর মন খুশ। । আমের আর মাটির গন্ধে মন ভরপূর আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠত। সেখান খেকে পুরলে প্রায় তিন মাইল পথ। কিন্তু রাস্তার দু-ধারের আখ আর ফাঁকা মাঠ অংশুমানের পথের ক্লান্তি দূর করে দিত। এক পা করে আর সৰ পরিচিত লােকের কস্বর কি গাে দাদাবাবু, অনেকদিন পরে লেখার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই কথার মায়া আর মাটির আর আমি কোথাও পাওয়া যাবে না। হটিতে হটিতে আুমানের মনে পড়ে কবির লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, “এইটি আমার গ্রাম আমার স্বর্গপুরী এইখানেতে হদয় আমার গেছে চুরি। "বাবু বসে আছে বাইরের বারান্দায়। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, বাবুদা! ৩াড়াতাড়ি চলো, ও পাড়ায় একজন গলায় দড়ি দেবে বলে দোর বন্ধ করেছে, কিছুতেই খুলছে না। "বাবু চোখের পলক পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে হাজির। গোলার তলায় শাবল ছিল, শাবল দিয়ে দরজাটা ভেঙে দেখল, একটা টুল এনে ছেলেটি গলায় গামছা বেঁধে কড়িকাঠে বাঁধছে। প্রায় ঝুলে পড়ার অবস্থায় বাবু ওর পা-দুটি কাঁধে রেখে বলল, “যা বলছি কর, গলা থেকে গামছা খোল। ছেলেটি বলল, "বাবুদা আমাকে মরতে দাও। ”বাবু বলল, “তাের সুবিধা-অসুবিধার বিচার আমরা করব। তুই আগে দড়ি খােল। "বাবুর কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য ছেলেটির ছিল না। দড়ি খুলে শান্ত ছেলের মতাে কাঁধ থেকে নেমে এল। ছেলেটির বাবা-মাকে একটু বকাঝকা করার পরে বাবু ছেলেটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এল। বাবুর সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করল ছেলেটি। মন শান্ত হলে বাড়ি গেল সে। এরকম অসংখ্য কাণ্ডকারখানা বাবুর সামাজিক জীবনে মিলেমিশে আছে। বড়দার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে বৈশাখ মাসে। বিয়ে হবে লাভপুরের আবাায়। বড়দা ও রিলিফদা চাকরি করে। প্রভাতবাবু দুই ছােট ছেলে বাবু আর অংশুমানকে নিয়ে যাবতীয় জোগাড় করলেন। সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে প্রভাতবাবু মেয়েটির রুটি বেলা দেখে পছন্দ করেছিলেন। নিজের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ফলেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান। অংশুমানরা ছােট লাইনে ট্রেনে করে বরযাত্রী গেল। আর বড়দা গেলেন জিপ গাড়ি করে। খুব আদর-আপ্যায়ন হল বিয়ে বাড়ি আবাভায়। পরের দিন সকালবেলায় প্রভাতবাৰু সদলবলে চলে এলেন পুরুলেতে। আর একঘণ্টা পরে এল বরের গাড়ি। কন্যাকে নিয়ে এসে মা রক্ষাকালী’র ধুলাে মাথায় দেওয়া হল। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অংশুমানের বড়দার বিবাহ হয়ে গেল। তখন দিলীপের গ্রামের বাড়ি খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। দিলীপ মনে মনে স্থির করল পাকা বাড়ি করতেই হবে। দিলীপ বাবাকে বলল, “বাবা দেখে নিয়াে, দু-বছরের মধ্যে আমি পাকা বাড়ি করব। " বাবা প্রভাত বললেন, "মা রক্ষাকালীর কৃপা থাকলে সবই হবে। মধুসূদনের কি অশেষ কৃপা। দু-বছরের মধ্যেই দিলীপ পুরুলেতে পাকা বাড়ি গড়ে তুলল। বাবা আশীর্বাদ করলেন, “তুই আরও বড় হৰি। বার, অংশুমান, বড়দার স্ত্রী, প্রভাতবাবু আর গীতাদেবী এই পাঁচজনকে নিয়ে সংসার। দুই বােনের বিয়ে দিলীপ দিয়ে দিয়েছে। আর রিলিফ ও দিলীপ নিজে দুজনে লিলুয়ায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। প্রভাত বাবুর সংসার ভালাে-মন্দে, সুখে-দুঃখে বেশ ভালােভাবেই চলে ছিল। এখন আর বন্যায় বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় নেই। ছেলে পাকা বাড়ি করেছে। প্রভাত বাবুর কষ্টের জীবনে এটা বিরাট বড় ঘটনা। গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে অংশুমান সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজে ভর্তি হল। রাত্রিতে কলেজ আর দিনে টিউশনি করে রােজগার করে। সঙ্গে সাহিত্য চর্চা। বিভিন্ন লেখকের বই পড়াশােনা করা আর তার সঙ্গে নিজে লেখার অভ্যাস চালিয়ে যেতে লাগল অংশুমান। জোয়ার বলে একটি দেওয়াল পত্রিকা অংশুমান চালিয়েছে প্রায় দশ বছর ধরে। বন্ধু গৌতম এসে বলত, “ব্যাটা পড়াশুনার বেলায় নেই, চাকরি পাবি কি করে?সত্যিই একটা সামান্য চাকরি যে জীবনে কত প্রয়ােজনীয় তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় অংশুমান। লিলুয়ার বন্ধুদের মধ্যে গােরা, গৌতম একই স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র হয়েও ভালাে চাকরি পেয়েছে। কারণ একটাই, নিয়মিত চাকরি সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশুনা এবং তার অনুশীলন। অংশুমানের সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কোনাে ভালাে চাকরি হল না। টাকাপয়সা না থাকলে, সম্মানও নেই। কিন্তু শুধু অর্থকেই যারা জীবনের মাপকাঠি করে তাদের জীবনে সুখ অধরাই থেকে যায়। নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে যে আনন্দ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সামান্য অর্থে কিন্তু সেই আনন্দ কেনা যায় না। অর্থই অনর্থের মূল কথা মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই। অংশুমানের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই প্রেম করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে এই বয়সে সব মেয়েই ছেলেদের কাছে সুন্দরী। রমেন অংশুমানকে একদিন এসে বলল, "আমার একটা কাজ করে দিবি? অংশুমান বলল, কি?" রমেন বলল, "শুধু ফেসবুকে কথা বলে বা হােয়াটস আ্যপের যােগাযােগে কাজ হচ্ছে না। আমি একটু নিরালায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন