এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • সুরক্ষিতা - পর্ব ৩

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ জুন ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩


    পোস্টমর্টেম, পুলিশ এবং তার যাবতীয় নিয়ম কানুন সব সামলেছিল মহাজন সাঁপুই। হলধর পোল্লের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম থেকে শ্রাদ্ধশান্তি পর্যন্ত সবকিছুরই দায় সামলে দিয়েছিল মহাজন সাঁপুই। বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অফিসে মালতীর জন্যে একটা কাজ দেবে আর তার মেয়ের স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ব্যয় সে বহন করবে। তাছাড়াও নগদ দুলাখ টাকা দেবে তাদের ভবিষ্যতের সুরাহার জন্যে।

    জাগতিক নিয়মে সব শোক সন্তাপই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে আসে। তাৎক্ষণিক আর্দ্র আবেগ ও মেঘমেদুর সহানুভূতি, বাস্তবের রৌদ্রে শুকিয়ে আসে যত দিন যায়।  মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসে কাজের জন্যে ঘুরতে ঘুরতে মালতী হতাশ হতে থাকল দিনকে দিন। আজ নয় কাল। কাল নয় পরশু। এ হপ্তা নয় সামনের হপ্তা। এ মাস নয় পরের মাস। স্কুলের ফিস বাবদ টাকাটা অবিশ্যি দিয়ে দিত ওদের অফিস থেকে। প্রায় সাত আট মাস এভাবে চলার পর একদিন মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে মালতীকে ডেকে একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে খুবই স্পষ্ট ভাষায় তারা বলে দিয়েছিল, আর নয়, এই শেষ। মালতী তাও একবার দেখা করতে চেয়েছিল মহাজন সাঁপুইয়ের সঙ্গে, বেশ ঝাঁঝালো উত্তর পেয়েছিল, “ওঁনার কি কাজ-কাম নাই নাকি? বসে বসে তোমার নাকে কান্না শুনলেই ওঁনার দিন চলবে? ফালতু নোকের ব্যাজব্যাজানি শুনার টাইম নেই ওঁনার। তুমি এখন আসো তো। যা পেয়েচো যতেস্ট – আর কত দোয়ানি করবে বলো দিকি? এদিকে আর আসবে নি কোনোদিন, এ বাবদে কোন লাভ হবে নি আর – এই বলে দিলোম”।

    ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর একটা লড়াই চলছিলই, কিন্তু তার ওপরে ছিল একটা আশার প্রলেপ। একটা চাকরি, যেমন তেমন হলেও মাস গেলে কিছু টাকার নিয়মিত সংস্থান। মেয়েটার লেখাপড়াটা তো চালুই থাকল। আর দুলাখ পাওয়া গেলে, ব্যাংকে জমা করে দেবে, সুদে আসলে ওর বিয়ের সুরাহাটাও হয়ে যাবে। কতদিন আর। এই তো, এই বোশেখ মাসেই মেয়ে এগারো পার হয়ে বারোয় পা দেবে। তার মানে বড় জোর আর বছর সাত কি আট। ব্যস, মেয়েটার একটা ভালো ঘরে আর মনোমত বরে চারহাত এক করে দিতে পারলেই - মালতী ঝাড়া হাত পা। নিজেরটা বুঝে দেখবে তখন যা হোক।
     
    এই আশার প্রলেপটাও সেদিন মুছে গিয়েছিল মালতীর জীবন থেকে। যেভাবে মালতীর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল সুখ, আহ্লাদ আর স্বপ্ন। সুলক্ষণা এয়োতির সমস্ত ভূষণ। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার শাড়ির পাড়ের রং। মালতীর বাবা চলে গেছেন কয়েক বছর হলো। মা আছেন, কিন্তু তিনিও একান্তই অসহায়, তার দুই ভাইয়ের জ্বলন্ত সংসারে। উপরন্তু, তার দুই ভাইয়ের কেউই এতটাও স্বচ্ছল নয়, আর্থিক বা মানসিক কোন দিক দিয়েই, যে বিধবা বোন এবং তার মেয়ের বাড়তি বোঝার দায় বহন করবে। কাজেই মালতীর সামনে ধূ ধূ ঊষরতা ছাড়া, কিছুই অবশিষ্ট রইল না। ঘাড়ের ওপর লড়াইটা এসেই পড়ল, ধারাল নখ দাঁত শানিয়ে - হিংস্র পশুর মতো।

    মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে ফিরে, ঘরে দোর দিয়ে মালতী হিসেব নিয়ে বসল। ট্রাংক থেকে বের করল তার আর হলধর পোল্লের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাস বই। জমা টাকার অংক ছ হাজার তিনশ বত্রিশ। শাড়ির ভাঁজে রাখা নগদ আটশো পঞ্চাশ টাকা। আর তার ব্লাউজে বুকের মধ্যে ছোট্ট পার্সে রাখা আটষট্টি টাকা – নোট আর খুচরো পয়সা মিলিয়ে। এই তার জমা। আর খরচের মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া, মেয়ের স্কুলের ফিস, খাতা-বই, খাওয়া দাওয়া, তেলটা, সাবানটা, রোগ-বিপদ, দায়-ঝক্কি ...শেষ নেই যেন – খরচ, খরচ আর খরচ। আর এই খরচের কোনটাই এককালীন নয় – মাসে মাসে আসবে – আসবে বছরের পর বছর – এ খরচ কখনও কমবে তো না বরং বেড়েই চলবে।
     
    এত হিসেবপত্র কোনদিন তাকে করতে হয়নি, একে তো সে চাষী ঘরের মেয়ে। তার ওপর, বিয়ের পর হলধর পোল্লেও এসব ব্যাপারে তার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি কোনদিন। কিন্তু মালতী এতটুকুও দিশাহারা হল না। নির্দিষ্ট লক্ষ্য তার ছিলই, মেয়েকে বড়ো করা আর তার বিয়ে দেওয়া। তার জন্যে এখন দরকার নিয়মিত উপার্জন আর সম্ভব হলে কিছু সঞ্চয়, ভবিষ্যতের জন্যে। খোলা ট্রাংকের সামনে স্থির হয়ে সে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সবকিছু গুছিয়ে রেখে ট্রাংক বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বসে বসে হা হুতাশ করে কপাল চাপড়ানোর সময় আর নেই। চোয়াল শক্ত করে লড়ার দিন এসে গেছে এবং জীবনের এই যুদ্ধ তাকে জিততে হবেই।    
     
    ( ...চলবে।)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • ধারাবাহিক | ১৪ জুন ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন