কিছু কি ভুল করে ফেললেন মারশাক? সময়ের স্রোত বেয়ে এগোলে অনেকের হয়তো সে রকমই মনে হতে পারে। সময় যে বড়ো চঞ্চল, সে যে কারও জন্য থেমে থাকে না। সেপ্টেম্বরের সভার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন সুদর্শন-মারশাক, ঠিক সেই সময়ে V-A তত্ত্বে মোহিত জেল-ম্যান, তাঁর অগ্রজপ্রতিম বন্ধু পদার্থবিদ রিচার্ড পি ফাইনম্যানকে শোনালেন সুদর্শনের V-A তত্ত্বের কথা। জহুরি ফাইনম্যান রত্ন চিনতে ভুল করেননি। উইক ফোর্স নিয়ে তিনি নিজেও কাজ করছেন। কাজ করছেন আরও অনেকেই। এরই মধ্যে সাং-ডাও লি এবং চেন-নিং ইয়াং-এর উইক ইন্টারেকশনের ‘পেপার’ তো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। লি-ইয়াঙের নাম নোবেল কমিটির বিচারাধীন তখন [১]। কিন্তু লি-ইয়াং তো আর V-A তত্ত্ব দিয়ে উইক ইন্টারেকশন প্রমাণ করেননি। ফাইনম্যানের হিসাব করতে দেরি হল না, V-A তত্ত্ব নোবেল পর্যন্ত এনে দিতে পারে।
তাহলে আর দেরি কেন? ফাইনম্যান-জেল-ম্যান দ্রুত হাতে সুদর্শনের কাজকে সংশোধন ও পরিবর্ধন করে সম্পূর্ণ আকার দিতে শুরু করলেন। উইক ইন্টারেকশন বিষয়ে সুদর্শনের মতামত বিশদে জানতে বোহ্ম, ওয়াপ্সট্রা, এবং স্টেচের সাথেও আলোচনা করলেন তাঁরা। সুদর্শনের লাঞ্চ টেবিলে সেদিন উপস্থিত ছিলেন এই তিন বিজ্ঞানী। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, সুদর্শনের ২৬তম জন্মদিন আজ। আজই ফাইনম্যান-জেল-ম্যান তাঁদের পরিমার্জিত রচনা পাঠিয়ে দিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ দপ্তরে। পত্রিকার বিচারকরা সেই নিবন্ধ পর্যালোচনা করে, নিবন্ধ ছাপানোর সবুজ সংকেত দিলেন। ১ জানুয়ারি ১৯৫৮, বছরের প্রথম দিনেই ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হল ফাইনম্যান-জেল-ম্যানের সাড়ে পাঁচ পাতার নিবন্ধ ‘দ্য থিয়রি অব ফের্মি ইন্টারেকশন’। এই নিবন্ধে উইক ইন্টারেকশনকে সুদর্শনের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন তাঁরা। নিবন্ধের ৫-নং পাদটীকায় তাঁরা লিখলেন, “একটা সর্বজনীন V-A ইন্টারেকশন তত্ত্বের প্রস্তাব দিয়েছেন ই সি জি সুদর্শন এবং আর ই মারশাকও (প্রকাশিতব্য)”। নিবন্ধের একদম শেষে বড়ো হরফে ‘প্রাপ্তিস্বীকার’ (Acknowledgements) শিরোনামে লিখলেন: “এফ বোহ্ম, এ এইচ ওয়াপ্সট্রা, এবং বি স্টেচের সাথে আলোচনা করে লেখকদ্বয় লাভবান হয়েছেন। মূল্যবান আলোচনার জন্য আর ই মারশাক এবং ই সি জি সুদর্শনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন আমাদের একজন (এম জি এম)”। এম জি এম অর্থ মারে জেল-ম্যান।
ফিজিক্যাল রিভিউতে লেখা প্রকাশ হওয়ার ফলে V-A ইন্টারেকশন তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে ফাইনম্যান-জেল-ম্যানের নামে সামনে চলে আসে। সুদর্শন-মারশাকের নাম আড়ালে চলে যায়। সুদর্শনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আপশোস করে বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, আগেই ‘পেপার’ প্রকাশ করা উচিত ছিল মারশাকের। এই সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষীরা দুটো বিশেষ তথ্য সম্পর্কে বোধহয় সঠিক মাত্রায় ওয়াকিবহাল নন। (১) জুলাই ১৯৫৭, ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ দপ্তরে ফাইনম্যান-জেল-ম্যানের রচনা পাঠানোর দু-মাস আগের ঘটনা। পাদুয়ার সম্মেলনে তাঁদের গবেষণাপত্র পাঠ করার জন্য, নিজেদের গবেষণার সারসংক্ষেপ পাদুয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মারশাক-সুদর্শন। সম্মেলনের নিয়মানুসারে, তাঁদের প্রেরিত পত্র সম্মেলনের পূর্বে অন্য কোথাও প্রকাশ করতে পারবেন না কোনো গবেষক। শুধু তাই নয়, সম্মেলনে পঠিত সমস্ত পত্র, একমাত্র উদ্যোক্তা কমিটিই ছাপাতে পারবে। ইচ্ছামতো অন্য কোথাও নিজের লেখা ছাপাতে পারবেন না কোনো লেখকই। বোঝাই যাচ্ছে, নিজেদের লেখা ইচ্ছামতো ছাপানোর স্বাধীনতা ছিল না মারশাকের। (২) V-A তত্ত্বকে বাস্তবে প্রমাণ করার জন্য, তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত চারটে পরীক্ষা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সুদর্শন-মারশাকের। সেই চার পরীক্ষা হল—(ক) হিলিয়াম-৬ বা আর্গন-৩৫ আইসোটোপে ইলেকট্রন-নিউট্রিনো এঙ্গুলার কোরিলেশান, (খ) গ্যালিয়াম-৬৬ আইসোটোপে মিউয়ন ক্ষয়, (গ) স্ক্যান্ডিয়াম-৪৬ আইসোটোপে পিয়ন ক্ষয়, (ঘ) অরাম-১৯৮ বা ইওরোপিয়ম-১৫২ আইসোটোপে নিউট্রন ক্ষয়। এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের অপেক্ষায়ও ছিলেন সুদর্শন ও মারশাক।
মারে জেল-ম্যান (বাঁদিকে) ও রিচার্ড পি ফাইনম্যান
২২-২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, পাদুয়ায় বসল পদার্থবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সভা। নির্দিষ্ট দিনে ডাক পড়ল সুদর্শনের। সুদর্শন-মারশাক লিখিত ‘দ্য নেচার অব দ্য ফোর-ফের্মিয়ন ইন্টারেকশন’ নিবন্ধের মধ্যে দিয়ে V-A তত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেন তাঁরা। তখনও ফাইনম্যান-জেল-ম্যান নিবন্ধের খবর কিছুই জানতে পারেননি তাঁরা। সম্মেলন শেষে ইউএসএ প্রত্যাবর্তন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন সুর্দর্শন। হার্ভার্ডে তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু শেল্ডন লি গ্লাশো জানালেন, ফাইনম্যান ও জেল-ম্যান V-A তত্ত্ব নিয়ে একটা নিবন্ধ ফিজিক্যাল রিভিউতে পাঠিয়েছেন বলে শুনেছেন তিনি। সে কী! এসব কী শুনছেন সুদর্শন! ফাইনম্যান-জেল-ম্যান তাঁর তত্ত্ব ছাপাচ্ছেন! অসম্ভব, এ হতে পারে না। স্তম্ভিত সুদর্শন শশব্যস্ত হয়ে ফোন করলেন মারশাককে। মারশাকও মনে করছেন, না, না, এটা হতে পারে না। তাঁদের তত্ত্ব সুরক্ষিতই আছে।
১ জানুয়ারি ১৯৫৮। বছরের প্রথম দিনেই স্বপ্নভঙ্গ হল তরুণ সুদর্শনের। ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হল ফাইনম্যান-জেল-ম্যানের নিবন্ধ ‘দ্য থিয়রি অব ফের্মি ইন্টারেকশন’। এ কী করলেন ফাইনম্যান-জেল-ম্যান! সবাই জানে এটা সুদর্শন-মারশাকের আবিষ্কার, অথচ সেটা বেমালুম নিজেদের নামে ছেপে দিলেন? এ তো অন্যায়! এটা যে সুদর্শন-মারশাকের আবিষ্কার, সাধারণ পাঠকদের সেটা কীভাবে বোঝাবেন তাঁরা এখন? তাঁদের মূল রচনা তো রয়েছে পাদুয়ায়, কমিটির অধীনে। সেই পত্র এখনও ছেপে বেরোয়নি। আর শর্ত অনুসারে এই মুহূর্তে সেই পত্র এখানে প্রকাশও করতে পারবেন না তাঁরা। তাহলে, কী করবেন সুদর্শন? একটা প্রতিবাদ না করলেই যে নয়।
পাদুয়ায় পঠিত তাঁদের মূল রচনার সারসংক্ষেপের সাথে আরও কয়েকটা বিষয় যুক্ত করে নতুন একটা পত্র লিখলেন সুদর্শন-মারশাক। ১৯৫৮ সালের ১০ জানুয়ারি, ফিজিক্যাল রিভিউ দপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের নতুন নিবন্ধ। পত্রিকার বিচারকরা সেই নিবন্ধ অনুমোদন করলেন। ‘চাইরালিটি ইনভেরিয়েন্স অ্যান্ড দ্য ইউনিভার্সাল ফের্মি ইন্টারেকশন’ শিরোনামে সুদর্শন-মারশাকের দেড় পাতার নিবন্ধ প্রকাশিত হল পত্রিকার ১ মার্চ সংখ্যায়। V-A তত্ত্ব নিয়ে এটাই সুদর্শন-মারশাকের প্রথম মুদ্রিত রচনা। কারণ পাদুয়ায় পঠিত মূল পত্রটা প্রকাশিত হয়নি তখনও। মে ১৯৫৮, ইতালির বোলোগ্না শহর থেকে প্রকাশিত হল ‘দ্য নেচার অব দ্য ফোর-ফের্মিয়ন ইন্টারেকশন’ শিরোনামে সুদর্শন-মারশাকের মূল রচনা। সাড়ে চার পাতার এই নিবন্ধের শেষে, ‘প্রাপ্তিস্বীকার’ শিরোনামে “মূল্যবান মতামতের জন্য অধ্যাপক এম জেল-ম্যান এবং ড. বি স্টেচ-এর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ” বলে জানালেন তাঁরা।
সুদর্শন-মারশাকের এই লেখা প্রকাশের পর থেকেই শুরু হল এক নতুন বিতর্ক। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় অনেকেই ততদিনে এই V-A তত্ত্বকে ফাইনম্যান-জেল-ম্যান তত্ত্ব হিসবেই দেখতে শুরু করেছেন। অনেকেই আবার এটাকে সুদর্শন-মারশাক তত্ত্ব হিসেবেই জানেন। প্রশ্ন দাঁড়াল, V-A তত্ত্বের প্রকৃত জনক কে? সুদর্শন-মারশাক না ফাইনম্যান-জেল-ম্যান? পদার্থবিজ্ঞান মহল দ্বিধাবিভক্ত। যতদিন যায় বিতর্ক ততই বেড়ে চলে। যদিও ততদিনে প্রত্যেকেই নিজেদের অন্যান্য গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই। কিন্তু তবুও ধিকি ধিকি করে বহু দিন ধরে জিইয়ে রইল এই বিতর্ক। বিতর্ক কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না দেখে ৫ বছর পর, ১৯৬৩ সালে, এক প্রকাশ্য বিবৃতিতে ফাইনম্যান জানান, “V-A তত্ত্বের জনক সুদর্শন-মারশাক। আমি আর জেল-ম্যান তা প্রকাশ করেছি মাত্র”।
এ তো অন্যায়। একজনের তত্ত্ব বিনা অনুমতিতে অন্যজন নিজের নামে ছাপাবেন কেন? ফাইনম্যান-জেল-ম্যানের মতো শীর্ষ স্থানীয় পদার্থবিদদের এত দিন তো গুরু বলেই মেনে এসেছেন সুদর্শন। আজও তাঁরা তাঁর গুরুই। এ হেন গুরু স্থানীয় পদার্থবিদদের থেকে এই আচরণ প্রত্যাশাই করেননি তরুণ সুদর্শন। এ তো প্লেজারিজম, কুম্ভীলকবৃত্তি! অত্যন্ত মর্মাহত হলেন সুদর্শন। তাঁর এই V-A তত্ত্ব এখন নোবেল কমিটির নজরে আছে। V-A তত্ত্বের প্রবক্তারা নোবেল পুরস্কার লাভ করতে পারেন বলে অনুমান করছেন অনেকেই। কিন্তু কে পাবেন সেই পুরস্কার? শেষ পর্যন্ত কি সুদর্শনের হাতে উঠবে নোবেল পুরস্কার? নাকি তার সমস্ত কৃতিত্বটাই পাবেন ফাইনম্যান-জেল-ম্যান? নাহ্, শেষ পর্যন্ত নোবেল জোটেনি সুদর্শনের। তবে পৃথক ভাবে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ফাইনম্যান এবং জেল-ম্যান দুজনেই। তবে V-A তত্ত্বের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেননি তাঁদের কেউই। ১৯৬৫ সালে, ‘কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স’-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ফাইনম্যান। ১৯৬৯ সালে ‘কোয়ার্ক’ কণা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জেল-ম্যান। নাহ্, V-A তত্ত্বের জন্য শেষ পর্যন্ত কেউই নোবেল পুরস্কার পাননি। না ফাইনম্যান-জেল-ম্যান, না সুদর্শন-মারশাক। তবে V-A তত্ত্বকে ব্যবহার করে পরবর্তী কালে নোবেল পুরস্কার পান সুদর্শনের বিশিষ্ট বন্ধু শেল্ডন লি গ্লাশো। ১৯৭৯ সালে শেল্ডন লি গ্লাশোর সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নেন পাকিস্তানের আব্দুস সালাম এবং ইউএসএর স্টিভেন ওয়েইনবার্গ। কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স, হিগস্ মেকানিজম্ প্রভৃতি সাম্প্রতিক গবেষণাকে যুক্ত করে, লঘু বল বা উইক ইন্টারেকশনের সাথে তড়িৎচুম্বকীয় বলের সাযুজ্য দেখান সালাম-গ্লাশো-ওয়েইনবার্গও। তাঁদের তত্ত্বের সরলীকৃত নির্যাসকে S+P-T [পর্ব ১ দ্রষ্টব্য] হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ, উইক ইন্টারেকশনকে তাঁরা স্কেলার, সিউডো স্কেলার ও টেনসারের সমন্বয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু S+P-T তো V-A পরিপূরক (complement)! বিকল্পও বলা যেতে পারে। নোবেল কমিটির তরফে বলা হল, ‘লঘু বল ও তড়িৎচুম্বকীয় বলের সাযুজ্য নির্ণয়ের জন্য’ সালাম-গ্লাশো-ওয়েইনবার্গকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হল। আশ্চর্য! এই একই সম্পর্কের কথা তো বহুদিন আগে থেকেই বলে আসছেন সুদর্শন-মারশাক। কই, তখন তো তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল না! নোবেল বঞ্চনার প্রতিক্রিয়ায় সুদর্শন বলেন “২৬ বছরের ছাত্র হিসেবে আমি যা করেছিলাম স্টিফেন ওয়েইনবার্গ, শেল্ডন গ্লাশো এবং আব্দুস সালাম তার উপরই কাজ করেছেন। আপনি যদি একটা বাড়িকে পুরস্কৃত করেন, বাড়ির এক তলাটা যে বানিয়েছে তাঁকে পুরস্কৃত না করে যাঁরা দ্বিতীয় তলাটা বানিয়েছেন তাঁদের (পুরস্কৃত) করবেন?”