Big bang theory doesn’t tell you what banged, when it banged, how it banged
– Michio Kaku
২৫ মে ১৮৪২, বোহেমিয়ার (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের) প্রাগ শহরের ‘রয়্যাল বোহেমিয়ান সোসাইটি অব সায়েন্স’এর এক সভায় একটা প্রবন্ধ জমা দিলেন শহরের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গণিতের অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান ডপলার। ‘অন দ্য কালারড লাইট অব দ্য ডবল স্টার অ্যান্ড সারটেন আদার স্টারস্ অব দ্য হেভেন’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, In “Double stars … the colour of one is from the upper part of the spectrum and the other from the lower part.” এই ছত্র ক’টার মধ্যে দিয়ে অনবদ্য এক পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরেছেন ডপলার। ডপলারের নিবন্ধের এই অংশটুকু বুঝতে গেলে, ডাবল স্টার ও তাদের গতিবিধি সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে আমাদের। মহাকাশে প্রায়ই দেখা যায়, দুটো নক্ষত্র পরস্পরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে চলেছে। এই নক্ষত্র যুগলকে ডাবল স্টার বলা হয়। একে অপরকে আবর্তিত হওয়ার সময়ে একটা নক্ষত্র পৃথিবী থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়, বিপরীতে অপর নক্ষত্রটা কিছুটা পৃথিবীর দিকে সরে আসে। ডপলার বললেন, কোনও নক্ষত্র যদি পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যায় তখন তাকে ঈষৎ লাল দেখায়, বিপরীতে কোনও নক্ষত্র যদি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে তখন তাকে ঈষৎ নীল দেখায়। সাধারণত, বর্ণালীর (‘বেনীআসহকলা’ বা vibgyor) উপরের অংশে বা ডান দিকে লাল রঙের অবস্থান এবং নীচের দিকে বা বাম দিকে নীল বা বেগুনি রঙের অবস্থান হয়। এই লাল রঙ বোঝাতে ‘upper part of the spectrum’ কথাটা উল্লেখ করেছেন ডপলার। বিপরীতে ‘the lower part’ বলতে নীল রঙ বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর এই প্রতিপাদ্যই পরবর্তীকালে ‘ডপলার এফেক্ট’ নামে পরিচিত হয়।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ডপলার এফেক্টের প্রয়োগ দেখা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে এই ঘটনা দুটো যথাক্রমে ‘রেড শিফ্ট’ ও ‘ব্লু শিফ্ট’ নামে পরিচিত। সময়ের সাথে সাথে বহু বিজ্ঞানী তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মধ্য দিয়ে নক্ষত্রের রেড শিফ্ট ও ব্লু শিফ্ট তত্ত্বকে মান্যতা দিয়েছেন। বিভিন্ন নক্ষত্রের রেড শিফ্ট লক্ষ করার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, নক্ষত্রগুলো ক্রমেই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু নক্ষত্রই নয়, বিভিন্ন গ্যালাক্সির রেড শিফ্ট থেকে বিজ্ঞানীরা এও বুঝতে পারলেন হাজার হাজার নক্ষত্র সমেত পুরো গ্যালাক্সিটাই ক্রমশ আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রসারমাণ মহাবিশ্বের (Expanding Universe) তত্ত্বে পৌঁছলেন। তাঁরা বললেন, সময়ের সাথে সাথে মহাজাগতিক বস্তুগুলো একে অপরের থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের প্রসার ঘটে চলেছে প্রতিদিনই। ঠিক তখনই তাঁদের মাথায় মোক্ষম এক প্রশ্নের উদয় হল। তাঁরা বললেন, আজ মহাজাগতিক বস্তুগুলো যে দূরত্বে রয়েছে, আগামীকাল সেই দূরত্ব কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। তাহলে গতকাল নিশ্চয় তারা কিছুটা হলেও কাছাকাছি ছিল। সেই হিসেবে হাজার হাজার বছর আগে তাদের মধ্যে দূরত্ব আরও কম ছিল। তাহলে তো বলা যেতেই পারে, অতীতের কোনও এক সময়ে এই সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুগুলোর মধ্যে দূরত্ব ছিল শূন্য। অর্থাৎ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড অতি ক্ষুদ্র এক স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এরপরই বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং তত্ত্বের উপস্থাপনা করেন। তাঁরা বললেন, সৃষ্টির আদিতে বিন্দুবৎ স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ অসীম ঘনত্বের এক বিন্দু প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জেরে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। এই বিস্ফোরণকেই তাঁরা বিগ ব্যাং নামে অভিহিত করলেন।
প্রসারমাণ মহাবিশ্ব এবং বিগ ব্যাং তত্ত্বের ঊষালগ্ন তখন। প্রসারমাণ মহাবিশ্ব এবং বিগ ব্যাং নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও মতবাদ রূপ পরিগ্রহ করে নি তখনও। ঠিক সেই সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে তপন তেজে উদয় হলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যুগান্তকারী এক ধারণার জন্ম দিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হল নতুন এক শব্দ- স্পেসটাইম। অনন্ত মহাকাশ জুড়ে অদৃশ্য চাদরের মতো বিছানো রয়েছে এই স্পেসটাইম। স্পেসটাইমকে সহজে বোঝার জন্য প্রায়শই একটা উদাহরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চারিদিকে টানটান করে ধরে রাখা বিছানার চাদরের মধ্যে ভারী গোলক ছেড়ে দিলে দেখা যায়, চাদরের মাঝখানে সরে গিয়ে গভীর গর্ত সৃষ্টি করে সেই গোলক। ঠিক সেই ভাবেই ভারী নক্ষত্রগুলো স্পেসটাইমের চাদরকে (সঠিক অর্থে অবশ্য চাদর বা তল নয়) বেঁকিয়ে মহাকাশের মাঝে অদৃশ্য গভীর গর্ত সৃষ্টি করে। এই গর্তগুলোই হল মহাকর্ষ বলের উৎস। যে নক্ষত্র যত ভারী, স্পেসটাইমে সে তত গভীর গর্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। আর যে নক্ষত্র স্পেসটাইমে যত গভীর গর্ত সৃষ্টি করতে পারে সেই নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলও তত বেশি হয়। তাঁর বিখ্যাত ফিল্ড ইকুয়েশনে গাণিতিক ভাবে মহাকাশের সেই বক্রতার কথাই তুলে ধরলেন আইনস্টাইন।
অচিরেই জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে সর্বাধুনিক ও অত্যন্ত শক্তিশালী এক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ। কিন্তু মজার বিষয় হল, এহেন শক্তিশালী তত্ত্বের মধ্যে কিন্তু ধরা পড়ে নি প্রসারমাণ মহাবিশ্বের কোনও প্রতিচ্ছবিই। তার থেকেও মজার ঘটনা হল, ব্যক্তিগত ভাবেও প্রসারমাণ মহাবিশ্বের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিলেন না আইনস্টাইন। স্থির মহাবিশ্বের (Static universe) তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর মতে, দুটো নক্ষত্রের মধ্যে দূরত্ব আগেও যা ছিল, এখনও তাই আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। বিজ্ঞান মহল তো বিস্মিত হল যখন ব্ল্যাক হোলকে অবাস্তব ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলেন আইনস্টাইন। তাঁর বিখ্যাত ফিল্ড ইকুয়েশন থেকেই বিজ্ঞানীরা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করলেন, অন্তিম দশায় কোনও নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ শূন্যতে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে নক্ষত্রের ঘনত্ব হয়ে দাঁড়াচ্ছে অসীম। অর্থাৎ, বিন্দুবৎ স্থানের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে আলোহীন অসীম ঘনত্বের নক্ষত্র। এই ঘটনাটাই পরবর্তীকালে ব্ল্যাক হোল নামে পরিচিত হয়। আইনস্টাইনের জীবদ্দশার মধ্যেই কিন্তু ধীরে ধীরে সাকার হতে থাকে ব্ল্যাক হোল, বিগ ব্যাং, প্রসারমাণ বিশ্বের তত্ত্ব। আইনস্টাইন অবশ্য বড় একটা আমল দেননি এই সমস্ত তত্ত্বকে। প্রথম দিকে তো এই সমস্ত তত্ত্বকে খারিজই করে দিয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য এই সমস্ত তত্ত্বের অনেক কিছুকেই মান্যতা দিয়েছিলেন তিনি।
১৯১৯ সালের ২৯ মে, এক সূর্যগ্রহণের সময়, আইনস্টাইন প্রস্তাবিত স্পেসটাইমের বক্রতা প্রমাণ করেন ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, স্পেসটাইমের বক্রতার ফাঁদে পড়ে বেঁকে যায় আলোর গতিপথ। পাশের চিত্র থেকে বোঝা যায় স্পেসটাইমের ফাঁদের পড়ে কিভাবে বাঁক খায় আলোর গতিপথ। ভারী নক্ষত্রের প্রভাবে আলোর গতিপথ যে বেঁকে যায় তা তখন প্রমাণিত সত্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলেন, দূরবর্তী কোনও গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোক রশ্মি মাঝপথে আপনা আপনি সামান্য পরিমাণে বেঁকে যাচ্ছে। যার ফলে গ্যালাক্সির এক বিকৃত ছবি ধরা পড়ছে পৃথিবীতে। অথচ নিকষ কালো সেই আঁধারের মাঝে না আছে কোনও ব্ল্যাক হোল না রয়েছে অন্য কোনও পদার্থ। তাহলে কিসের টানে বাঁক খাচ্ছে এই আলো? এরই মধ্যে, বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখলেন, মহাবিশ্বের মোট ভর, দৃশ্যমান গ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলীর ভরের সমষ্টির থেকে বহুগুণ বেশি। যা থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছলেন, মহাকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে কিছু অদৃশ্য ভারী বস্তু। এরাই মহাবিশ্বের ভরকে বাড়িয়ে তুলেছে। অদৃশ্য এই ভারী বস্তুকে তাঁরা ডার্ক ম্যাটার নামে অভিহিত করলেন। এবার তাঁরা বুঝলেন, সুদূর কোনও গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোক রশ্মি কেন মাঝপথে সামান্য পরিমাণে বেকেঁ যাচ্ছে। তাঁরা বললেন, ওই গ্যালাক্সি আর পৃথিবীর মাঝপথে অবস্থিত ভারী ডার্ক ম্যাটারগুলো স্পেসটাইমকে বেঁকিয়ে মহাকাশের বুকে গর্ত সৃষ্টি করেছে। এই গর্তের ফাঁদে পড়েই সামান্য পরিবর্তন ঘটছে আলোর গতিপথের। মাঝপথে অবস্থিত ডার্ক ম্যাটারের কারণেই গ্যালাক্সির বিকৃত প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ছে পৃথিবীতে। গ্যালাক্সির এই বিকৃত প্রতিচ্ছবি তৈরি হওয়ার ঘটনাকে কসমিক শিয়ার (Cosmic Shear) নামে অভিহিত করলেন তাঁরা।
এপর্যন্ত আমরা দেখলাম, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে, জ্যোর্তিবিজ্ঞানের পরিসীমার মধ্যে কালক্রমে এমন অনেক নতুন নতুন ধারণা যুক্ত হতে থেকেছে যা সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণাকে বদলে ফেলতে বাধ্য করেছে বা সেই ধারণাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণাকে এমনই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন বাঙালি পদার্থবিদ অমল কুমার রায়চৌধুরী। আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশন থেকে শুরু করে নিজস্ব পদ্ধতিতে গাণিতিক ভাবে এগিয়ে নতুন একটা সমীকরণ তৈরি করেন তিনি, যা রায়চৌধুরী ইকুয়েশন নামে খ্যাত। কি লিখেছিলেন তিনি সেই সমীকরণে? রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের একটা বিশেষ সরলীকৃত রূপ হল-
বোঝাই যাচ্ছে বেশ জটিল গাণিতিক বিষয় এটা। কিন্তু না, কোনও গাণিতিক বিশ্লেষণে যাবো না আমরা। এই সমীকরণের নির্যাস থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো যে, এই সমীকরণের মধ্যে দিয়ে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন রায়চৌধুরী। কোথাইবা তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন খোদ আইনস্টাইনকে।
রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের ডানদিকে ৩টে পদ দেখতে পাচ্ছি আমরা, যার প্রথম পদটা কিন্তু রায়চৌধুরীর মৌলিক সৃষ্টি নয়। পদার্থবিজ্ঞানের আঙিনায় এই জাতীয় পদ আগেই মজুদ ছিল। সামান্য গণিতের ধারণা প্রয়োগ করলে বোঝা যায়, বামপক্ষের হরের R বা ব্যাসার্ধ ছোট হতে হতে যত শূন্যের দিকে যাবে, ডানপক্ষের প্রথম পদভুক্ত ρ বা ঘনত্ব তত অসীমের দিকে যাবে। অর্থাৎ, বিন্দুবৎ স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে সমস্ত ভর। এই প্রথম পদেই তিনি ‘গ্রাভিটেশানাল কোলাপ্স’ বা বিগ ব্যাং-এর কথা ব্যক্ত করলেন। প্রথম পদের আগে মাইনাস চিহ্নটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মাইনাস চিহ্নটা সময়ের বিপরীত দিক বা অতীতের কোনও এক সময় নির্দেশ করেছে। অর্থাৎ, সুদূর অতীতের কোনও এক সময়ে বিগ ব্যাং দশাকে নির্দেশ করে রায়চৌধুরীর ইকুয়েশনের প্রথম পদটা। রায়চৌধুরীর ইকুয়েশনের দ্বিতীয় পদের σ কসমিক শিয়ারকে (Shear) নির্দেশ করে। আমরা জেনেছি, শিয়ারের মূল কারণই হল ডার্ক ম্যাটার। নিজের সমীকরণে শিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিপক্ষে ডার্ক ম্যাটার তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দিলেন রায়চৌধুরী। প্রথম পদের বিগ ব্যাং এবং দ্বিতীয় পদের শিয়র বা ডার্ক ম্যাটার- এই দুটো তত্ত্বের কোনোটাই সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণার মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ, তাঁর সমীকরণের প্রথম দুটো পদই সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণাকে বিপক্ষেই মতদান করছে।
রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের তৃতীয় পদটাই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদের বক্তব্য বোঝার আগে গ্যালাক্সির সাধারণ গঠন সম্পর্কে ছোট্ট করে একবার নজর বুলিয়ে নিতে হবে আমাদের। দুই বা ততোধিক বাহুযুক্ত গ্যালাক্সিগুলোকে দেখতে অনেকটা চক্রের মতো। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের সাপেক্ষে হাজার হাজার গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে পুরো গ্যালাক্সিটাই চক্রাকারে ঘুরে চলেছে। স্পষ্টতই গ্যালাক্সির অন্তর্গত এই নক্ষত্রগুলোর গতিপথ তাহলে সরলরৈখিক নয়, বক্রাকার। মহাকাশে এই রকম হাজার হাজার গ্যালাক্সি ছড়িয়ে আছে। রেড শিফ্ট থেকে আমরা জেনেছি গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গ্যালাক্সিগুলো কিন্তু সরলরৈখিক পথে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না। গ্যালক্সিগুলোর এই যাত্রা পথও কিন্তু বক্রাকার। অর্থাৎ, বিগ ব্যাং-এর পর থেকে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড গ্যালাক্সির মতোই চক্রাকারে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাজাগতিক বস্তু সমূহের এই বক্রগতিকেই বলা হচ্ছে ঘূর্ণন। তাঁর সমীকরণের তৃতীয় পদে ω বা ঘূর্ণনকে স্থান দিয়েছেন অধ্যাপক রায়চৌধুরী। ব্রহ্মাণ্ডের এই ঘূর্ণন কিন্তু সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণার মধ্যে পড়ে না। তাঁর সমীকরণের তিনটে পদই তাই সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের প্রথম দু’টো পদের থেকে তৃতীয় পদেটার মাহাত্ম্য কিছুটা বেশিই। আর সেই মাহাত্ম্য লুকিয়ে রয়েছে ভিন্নতর এক বিশ্লেষণের মধ্যে। লক্ষ করে দেখা যাচ্ছে, রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের তৃতীয় পদটা কিন্তু ধনাত্মক বা প্লাস চিহ্নযুক্ত। এই প্লাস চিহ্নটাই এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বীজগণিতের প্রাথমিক ধারণা থেকে আমরা জানি, একটা মাইনাস পদ ও একটা প্লাস পদ যুক্ত হলে, যোগফলে বড় পদের চিহ্নটা বসাতে হয়। রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের প্রথম দুটো ঋণাত্মক পদের যোগফলের সাংখ্যমানের থেকে তৃতীয় পদের সাংখ্যমান ছোট হলে ডান দিকের সমগ্র রাশির মান ঋণাত্মক রয়ে যাবে। আমরা জেনেছি, ঋণাত্মক চিহ্ন বিগ ব্যাং-এর সময়কাল নির্দেশ করে। ডানদিকের পদসমূহের মোট চিহ্ন ঋণাত্মক হয়ে গেলে, সেই বিগ ব্যাংই নির্দেশ করবে রায়চৌধুরী ইকুয়েশন। কিন্তু রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের প্রথম দুটো ঋণাত্মক পদের যোগফলের সাংখ্যমানের থেকে যদি তৃতীয় পদের সাংখ্যমান বড় হয়ে যায় তাহলে ডান দিকের সমগ্র রাশির মান ধনাত্মক হয়ে পড়বে। ডানদিকের চিহ্ন ধনাত্মক হয়ে পড়লে অতীতের কোন সময়কে আর নির্দেশ করবে না সেই ইকুয়েশন। আর সুদূর অতীতে যেতে না পারলে নক্ষত্রদের মধ্যে দূরত্বও শূন্য হবে না। দূরত্ব শূন্য না হলে ভরও বিন্দুবৎ স্থানে এসে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে না। অর্থাৎ, বিগ ব্যাং-এর কোনও সম্ভাবনাই তৈরি হবে না। আর ঠিক এইখানেই নিহিত রয়েছে রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের মাহাত্ম্য। রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের মাহাত্ম্য এই যে, একটা বিশেষ ক্ষেত্রে (যদি ডান দিকটা ধনাত্মক হয়ে পড়ে) এই সমীকরণ বিগ ব্যাংকে অস্বীকার করে। আর ঠিক এই বিশেষ ক্ষেত্রেই আবার ঘোর সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণাই ব্যক্ত করছে রায়চৌধুরী ইকুয়েশন। কারণ সনাতনী আইনস্টাইনীয় ধারণায় বিগ ব্যাং-এর কোনও স্থান নেই।
রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের বিশেষত্ব এই, মোটের উপর আইনস্টাইনীয় ধারণার পরিপন্থী হলেও একটা বিশেষ ক্ষেত্রে এই সমীকরণ আবার আইনস্টাইনীয় ধারণার অনুসারী। ডানদিকের মোট চিহ্ন ধনাত্মক হলে বিগ ব্যাংকে যে প্রতিহত করা সম্ভব, তা যথেষ্ট উৎসাহের সাথে ব্যক্ত করেছেন স্বয়ং অধ্যাপক রায়চৌধুরী। নিজের সমীকরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি, বলেছেন ‘বিগ ব্যাং এড়ান সম্ভব’। প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করার বিরল দুঃসাহসের টানেই বোধহয় এই ধনাত্মক মান নিয়ে অধিক তৃপ্ত ছিলেন তিনি। তবে রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের ডানদিক মোটের উপর ধনাত্মক হয়ে পড়লে কিন্তু নতুন করে এক সমস্যা সৃষ্টি হবে। ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য মতামত ব্যক্ত করেছিল বিগ ব্যাং। এখন এই বিগ ব্যাং যদি অবধারিত না হয়, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই, কি ভাবে উৎপত্তি হয়েছিল ব্রহ্মাণ্ডের? না, এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর কিন্তু পাওয়া যায় না রায়চৌধুরী ইকুয়েশন থেকে। অধ্যাপক রায়চৌধুরীও এই বিষয়ে কোনও আলোকপাত করে যান নি। তাঁর সমীকরণ একটা অভিমতকে খারিজ করতে পারে, কিন্তু সেই মতের বিকল্প কোনও মত হাজির করতে পারে না। আর বিকল্প তত্ত্ব হাজির করতে না পারলে নৈরাজ্যের আশঙ্কা তো থেকেই যায়।
উচ্চতর স্তরে গণিত নিয়েই পড়ার ইচ্ছা ছিল তরুণ অমলের। পেশায় গণিত শিক্ষিক ছিলেন তাঁর বাবা সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরী। সুরেশচন্দ্রর আর্থিক অবস্থা মোটেও সচ্ছল ছিল না। তাই তিনি চাইতেন না যে তাঁর ছেলে বড় হয়ে তাঁর মতো গণিত নিয়ে পড়াশোনা করুক। বাবার ইচ্ছানুসারে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হলেন অমল। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করে উচ্চতর গবেষণার জন্য যাদবপুরে অবস্থিত ‘ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’এর ‘রিসার্চ ফেলো’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর এই গবেষণা অবশ্য ফলপ্রসূ হয় নি। চার বছর পর তাঁর ‘ফেলোশিপ’ বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে আশুতোষ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে একটা চাকরি পেয়ে যান তিনি। বস্তুত পক্ষে এই সময় থেকেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ সমেত পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয়ের উপর নিজস্ব একটা মতামত গড়ে উঠতে থাকে তাঁর মনের মধ্যে। এই সমস্ত মতামতকে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করার কথা ভাবলেন তিনি। ১৯৫০ সালেই, ‘ক্যালকাটা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’র মুখপত্র ‘বুলেটিন অব ক্যালকাটা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’তে ছাপা হলো তাঁর প্রথম নিবন্ধ। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদই হল তাঁর প্রথম নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। প্রথম নিবন্ধেই আইনস্টাইনীয় ধারণার বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন অমল। আইনস্টাইন মনে করতেন ব্রহ্মাণ্ড হল সমসত্ত্ব এবং সর্বদিক দিয়ে সমান (Homogeneous and Isotropic)। অমল অবশ্য সেরকম মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন ব্রহ্মাণ্ড হল অসমসত্ব। তাঁর প্রথম নিবন্ধে সে কথাই তুলে ধরেছিলেন অমল। পরে অবশ্য তিনি বুঝতে পারেন যে প্রথম নিবন্ধের যুক্তিগুলো খুব জোরালো ছিল না।
যুক্তিতে কিছু দুর্বলতা থাকলেও, মুদ্রিত আকারে নিজের নিবন্ধ দেখে, নিবন্ধ রচনায় বেশ উৎসাহ অনুভব করেন অমল। বস্তুতপক্ষে এরপর থেকে নিবন্ধ রচনাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন। এবার তিনি ভাবলেন, শুধু দেশের ম্যাগাজিন কেন, বিদেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা পাঠালে কেমন হয়? সেই ভাবনা থেকেই ইউএসএর ‘আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি’র মুখপত্র ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে একটা প্রবন্ধ পাঠালেন। ১ অক্টোবর ১৯৫১, ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে ছাপা হল অমল কুমার রায়চৌধুরীর নিবন্ধ ‘ভোলকোফ্স্ ম্যাসিভ স্ফিয়ার’। ফিজিক্যাল রিভিউতে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় নিবন্ধ রচনায় আরও উৎসাহী হয়ে পড়েন অমল। ক্লাসে গিয়ে অধ্যাপনার করার থেকেও নিজের উদ্যোগে তাত্ত্বিক গবেষণা সঞ্জাত নিবন্ধ রচনায় অধিক উৎসাহ বোধ করতে থাকেন তিনি। ঠিক এই সময়েই তিনি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি ১’। ‘১’ মানে প্রথম পর্ব। যদিও এই নিবন্ধের দ্বিতীয় পর্ব আর লেখেন নি তিনি। ১৫ মে ১৯৫৫ সালে ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে ছাপা হয় এই নিবন্ধটা। এই ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি’ নিবন্ধেই গাণিতিকভাবে একটা সমীকরণ উপস্থিত করেন তিনি, পরবর্তীকালে যা ‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’ নামে পরিচিত হয়।
১৯৫৫ সালেই জার্মানির হামবুর্গ শহরে ‘জেনারেল রিলেটিভিটি অ্যান্ড কসমোলজি’ বিষয়ক একটা সেমিনারের আয়োজন করেন হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পাসকুয়াল জর্ডন। সেই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন পাসকুয়েলের ছাত্র এঙ্গেলবার্ট শুকিং। সেমিনারে, ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে সদ্য প্রকাশিত অমল কুমার রায়চৌধুরীর ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি’ নিবন্ধটা পাঠ করেন শুকিং। সেমিনারে আলোচনা চলাকালীন শুকিংই প্রথম ওই সমীকরণকে ‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’ নামে অভিহিত করেন। সেই থেকে শুরু হয় রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের যাত্রা।
১৯৬০ সাল, ইংলন্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য তখন গবেষণা করছেন তরুণ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার। তাঁর গবেষণাপত্রে, ‘রেফারেন্স’ হিসেবে রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের উল্লেখ করেন তিনি। এটাই ছিল রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের প্রথম স্বীকৃতি। তাঁর গাইড অধ্যাপক ফ্রেড হয়েলকে এই বিষয়ে অবগত করেন নারলিকার। বছর পাঁচের পর, ২০ জুলাই ১৯৬৫ সালে ইংলন্ড থেকে প্রকাশিত হয় স্টিফেন হকিংএর নিবন্ধ ‘অন দ্য হয়েল-নারলিকার থিয়োরি অব গ্রাভিটেশন’। এই নিবন্ধে রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের উল্লেখ করেন হকিং। হকিং-এর এই স্বীকৃতির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানের আঙিনায় জোরালো ভাবে প্রোথিত হয় রায়চৌধুরী ইকুয়েশন।
হকিংএর এই নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার মাস ছয়েক আগের ঘটনা, ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ইংরেজ পদার্থবিদ রজার পেনরোজের নিবন্ধ ‘গ্রাভিটেশানাল কোলাপ্স অ্যান্ড স্পেস-টাইম সিঙ্গুলারিটিস’। এই নিবন্ধের জেরেই ৫৫ বছর পর, ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল সম্মানে ভূষিত হন পেনরোজ। পেনরোজের এই নিবন্ধটা প্রকাশের পাঁচ বছর পর, ২৭ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে, এই নিবন্ধটাই আরেকটু বিস্তার ঘটিয়ে নতুন আঙ্গিকে পুনরায় প্রকাশিত হয়। তবে এবার এই নিবন্ধ রচনায় পেনরোজের সাথে যৌথভাবে কলম ধরেন স্টিফেন হকিং। পেনরোজ-হকিং লিখিত ‘দ্য সিঙ্গুলারিটিস অব গ্রাভিটেশানাল কোলাপ্স অ্যান্ড কসমোলজি’ শীর্ষক নিবন্ধে ফের রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের উল্লেখ করা হয়। এই উল্লেখের সাথে সাথে আধুনিক কসমোলজিতে রায়চৌধুরীর ইকুয়েশনের প্রয়োজনীয়তা পরিস্ফুট হয়ে উঠে। ১৯৭৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় হকিং ও জর্জ এলিসের লেখা গ্রন্থ ‘দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম’। এই বইতে রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।
পাশ্চাত্যের জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে তখন ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করছে রায়চৌধুরী ইকুয়েশন। দেশের মাটিতে কিন্তু তখনও বেশ কিছুটা অন্ধকারেই রয়ে গেছেন অমল। ১৯৫২ সালে আশুতোষ কলেজের লেকচারার পদ ছেড়ে তাঁর পূর্বতন প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’এ ‘রিসার্চ অফিসার’ পদে চাকরি গ্রহণ করেছেন তখন অমল। সেই সময়ে এ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর ছিলেন জনপ্রিয় পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা। একদিন সাহার কাছে খবর এল, এই অমল তো কাজের কাজ কিছু করে না, শুধু নিজের মতো করে থিসিস লিখে বেড়ায়। শুনে অমলকে তলব করলেন সাহা। বললেন, কি নিয়ে গবেষণা করছো তুমি? বড় মুখ করে অমল বললেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ইত্যাদি বিষয়েই তাঁর আগ্রহ বেশি। অমলের সাথে কথা বলে সাহা বুঝলেন বেশ জটিল ও আধুনিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে অমল। সব শুনে সাহা বললেন, ‘দেখো, সব প্রতিষ্ঠানকেই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। এখানে কাজ করতে হলে, প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বিষয় নিয়েই গবেষণা করতে হবে তোমাকে’। যথেষ্ঠ যুক্তি সঙ্গতই ছিল সাহার অভিমত। কিন্তু অমল তখন স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছেন। অমল ভালোই বুঝতে পারছেন, যে সমস্ত বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করতে চাইছেন সেই সমস্ত বিষয়গুলো যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মেঘনাদ সাহা তো বকলমে তাঁকে সেই সব কাজ থেকে বিরত থাকতেই নির্দেশ দিলেন। সাহার বক্তব্য শুনে সেদিন তাই বেশ আশাহত হয়েছিলেন অমল। সাহার মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর কাছ থেকে কিছুটা সহানুভূতি আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার বদলে সাহার কাছ থেকে যেন উপেক্ষাই পেলেন অমল। সাহার বাস্তবোচিত বক্তব্য সেদিন তাই খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেন নি তিনি। সেইদিন থেকেই বুঝি সাহার উপর একরাশ অভিমান পূঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল তরুণ অমলের মনে।
একই রকমভাবে আরেক জনপ্রিয় পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সাথেও একটা শীতল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অমলের। ১৯৫৯ সাল নাগাদ মুসৌরিতে এক বিজ্ঞান ভিত্তিক অনুষ্ঠানে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সাথে আমন্ত্রিত ছিলেন অমলও। অনুষ্ঠানে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করেন অমল। আমরা জানি, তাঁর সমীকরণে ব্রহ্মাণ্ডের ঘূর্ণনকে স্থান দিয়েছিলেন তিনি। ব্রহ্মাণ্ডের এই ঘূর্ণন ছিল আইনস্টাইনীয় ধারণার পরিপন্থী। আর সত্যেন্দ্রনাথ বোস ছিলেন আইনস্টাইনীয় ধারণার অনুসারী। অমল উক্ত ব্রহ্মাণ্ডের ঘুর্ণন নিয়ে তাই সন্দেহ প্রকাশ করেন বোস। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না এই ধরণের ঘূর্ণনের ভিত্তিতে কাজ করার কোনও সদর্থক দিক আছে’। মৃদু প্রতিবাদ করে অমল বলেন, ‘কিন্তু সবাই তো মোটামুটি ভাবে আমার নিবন্ধটাকে ঠিক বলেই মেনে নিয়েছেন’। তাতেও নিজের আপত্তির কথা জানান বোস। পরে কিছুটা হালকা সুরে বোস বলেন, ‘ঠিক আছে, ও ছেলেমানুষ, দূরুহ বিষয় নিয়ে কাজ করছে, করুক। পরে আস্তে আস্তে পেকে উঠবে’। বোসের কাছ থেকে এই জাতীয় হালকা মতামত প্রত্যাশা করেন নি অমল। তাঁর সমীকরণের গুরুত্ব এখন ভালোই বোঝেন তিনি। তাই বোসের কাছ থেকে যোগ্য সমাদর প্রত্যাশা করেছিলেন অমল। কিন্তু সেই মত ঘটনা ঘটে নি। ফলে সত্যেন্দ্রনাথ বোস সম্পর্কেও একটা শীতল মনোভাব পোষণ করতেন তিনি। অমল জানতেন, আইনস্টাইনীয় ধারণার পরিবর্তনকে সহজে মেনে নিতে পারতেন না বোস। হালকা সুরে তাই অমলকেও বলতে শোনা যায়, ‘আইনস্টাইনের প্রতি তো একটা অদ্ভুত ভক্তি ছিল ওঁর (বোসের)’।
রায়চৌধুরী ইকুয়েশন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি অংশ। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এই বিজ্ঞান পরীক্ষাগার বা ল্যাব নির্ভর নয়। গণিতের উপর ভীষণ ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল এই বিজ্ঞান, কারণ ল্যাবের ভিতর বিগ ব্যাং ঘটিয়ে দেখানো কখনই সম্ভবপর হয়ে উঠে না। আর চোখের সামনে দেখাতে না পারলে সাধারণ মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তখন সেই তত্ত্ব বা মতামতকে ঘিরে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়। থাকে তর্ক-বিতর্কের অবকাশও। রায়চৌধুরী ইকুয়েশনও এই সমস্ত সন্দেহ বা তর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে রায়চৌধুরী ইকুয়েশন কতটা সঠিক তা বুঝতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে আমাদের। তবে ব্রহ্মাণ্ডের গঠন নিয়ে রায়চৌধুরীর মতামত যে বেশ রোমহর্ষক একটা চিত্র তুলে ধরে তা বোধহয় কিছুটা হলেও এখন বুঝতে পারছি আমরা। আর আমাদের এই উপলব্ধির অমল আলোকের মধ্যেই চিরকাল বেঁচে থাকবেন অমল।