পেন্ডুলাম দোলে একই নিশ্চিত গতিতে –ডাইনে থেকে বাঁয়ে, ফের বাঁ থেকে ডাইনে। টিক টক, টিক টক। এই দোলনগতিকেই বোধহয় স্কুল পাঠ্য বই বর্ণনা করে সিম্পল হারমোনিক মোশন বলে। আরও দুটো শব্দ শুনি—গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ এবং কাইনেটিক এনার্জি বা গতিশক্তি। কিন্তু বিশেষ অবস্থায় বোধহয় মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে গতিশক্তি জোর বেশি—যা বস্তুর অবস্থানকে বদলে দেয়।
ঘাবড়াবেন না। আমি কোন স্কুলে বিজ্ঞান পড়াই না, আমার সে যোগ্যতাও নেই। কিন্তু এতসব কথা আমার মনে এল একটি গল্প-সংকলন পড়তে গিয়ে।
বইটির হল একডজন গল্পের একটি সংকলন।
নাম—পেন্ডুলাম, লেখক জয়ন্ত দে; প্রকাশক— গুরুচণ্ডালি। ১৩৬ পাতার সুমুদ্রিত পেপারব্যাক বইটির দাম মাত্র ১১০ টাকা। প্রকাশিত হয়েছে করোনাকালীন প্রথম বইমেলাটিতে—২০২০ সালে। ঈপ্সিতা পালভৌমিকের দত্তক নেওয়া।
কিন্তু এহ বাহ্য। এর দাম ৩০০ টাকা হলেও আমি কিনতাম।
কারণ, প্রথম এবং শীর্ষক গল্প পেন্ডুলামের ছত্রে ছত্রে ফেটে বেরোচ্ছে ওই কাইনেটিক এনার্জির ভয়ংকর শক্তি এবং গতিবেগ—ঘৃণার শক্তি।
যার থেকে বুঝতে পারি কেন ভারতের পশ্চিম সাগরে গণধর্ষক এবং শিশুহত্যাকারীদের মুক্ত করে সংবর্ধনা দেন মেয়েরা! কীভাবে ঘৃণার কাইনেটিক ফোর্স সমাজে বদলে দেয় মানুষের অবস্থান, হেরে যায় শুভবুদ্ধির মাধ্যাকর্ষণ।
তবে গল্পের শেষে টের পাই যে কাইনেটিক এনার্জিও ক্ষণস্থায়ী, একটা পিরিয়ডে ওর দম ফুরিয়ে যায়। তখন মাধ্যাকর্ষণ কথা বলে। তারসপ্তকের তানকর্তব ফিরে আসে সমে, ফিরে আসে ধ্রুবপদের পুনরাবর্তনে –সিম্পল হার্মনিক মোশন। ভরসা পাই—ইয়ে রাত ভী গুজর জায়েগী।
বাকি এগারটা গল্প? না, একরঙা নয়; ওস্তাদ লেখক খেয়ালের পর ঠুংরি গাইছেন, দাদরা গাইছেন, গেয়েছেন কাজরী।
একটি চমৎকার গল্প—আমাদের ছোট নদী।
মাধব ফুলশয্যার রাতেই নতুন বৌ মালতীকে জানিয়ে দেয় যে ও পরিবারের জন্যে পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করতে এবং আয় বাড়াতে রাজি —কিন্তু সৎপথে থেকে।
কিন্তু মালতীকে গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছেন তার দিদিমা।
“কোন বেগড়বাঁই দেখলেই মিনসেকে বিছানায় তুলবি না। দু’চারদিন হামলাতে না পারলেই দেখবি ঢিট হয়ে গেছে”।
মালতী সমস্ত রকম ওষুধ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে মাধবকে লাইনে নিয়ে আসে। শুরু হয় শর্টকাটে পয়সা কামানোর পেছল পথে পা হড়কানো—একটু একটু করে। লেখক অত্যন্ত যত্নে ছোট ছোট আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন আজকের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ভেতরের দগদগে ঘা।
মানুষকে কত জায়গায় সমঝোতা করতে হয়, কাজের কোয়ালিটিতেও টান পড়ে। সমঝোতা করতে হয় নিজের বিবেকের সঙ্গেও। কিন্তু ভাঁটার টানে একবার পড়লে ফিরে আসা মুশকিল।
মাধব বোধহয় আর ফিরতেও চায় না। এইভাবে শেষ হয় আজকের মালতীমাধব উপাখ্যান।
‘রসিক স্যারের ঘোড়া’ গল্পটি অল্প কথায় আমাদের প্রথাগত শিক্ষার বাস্তবতা এবং শিক্ষকের ট্র্যাজেডিকে আঁকে চাইনিজ ইংকের অংকনে। গল্পটি শেষ করার পর পাঠকের মনে ভিড় করে আসবে প্রথম জীবনের বহুমাত্রিক স্মৃতিগুলো, আমাদের দাঁড় করিয়ে দেবে আয়নার সামনে।
একেবারে অন্যরকম গা-শিরশির করা প্রেমের গল্প “আজিবলাল ও সুন্দরী’। মন্টোর ‘ঠান্ডা গোস্ত্’ গল্পের অনুষঙ্গ মনে পড়ে, যদিও প্রেক্ষিত ভিন্ন।
আবার নামকরা সাহিত্যিকের মৃত্যুর পর তাঁর রচনার জায়গায় অপ্রকাশিত ডায়েরি থেকে ব্যক্তিগত কেচ্ছার লোভে হায়েনার মত হামলে পড়া মিডিয়ার লোকজনের অন্তঃসারশূন্যতার স্কেচ দেখতে পাই ‘কয়েকটি পাতা’ গল্পে।
এই গল্পে একের পর এক আনাড়ি নিউজ-জার্নালিস্টদের রসালো ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা এবং আজকালকার ‘পাবলিক কী চায়’ অজুহাতে বাজারি সাংবাদিকতার প্রতি নির্মম ব্যংগের সঙ্গে রয়েছে পেটের দায়ে অর্থহীন স্কুপের খোঁজে অসহায় নতুন প্রজন্মের করুণ ছবি।
হিংসা ও ভালবাসার যুগল সম্মিলনের বিচিত্র ছবি “আমি কৃষ্ণার প্রেমিক” গল্প। ছোট্ট গল্প, কিন্তু অপ্রত্যাশিত বাঁক। এই গল্প নিয়ে বেশি কথা বললে সেটা “স্পয়লার” এর পর্যায়ে দাঁড়াবে।
যৌনতার এক হিংস্র রূপ ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে সাপের মত ফণা তোলে যে গল্পে তার নাম ‘কোয়েলের কাব্য’। ভুল বললাম, যৌনতা এখানে নারীর ক্ষমতার প্রতীক, তার ধারালো অস্ত্র। স্বামীর খুনের পর তাকে সাহায্যের অছিলায় সবাই ভোগ করে কোয়েলকে। ছেড়ে দেয় না তার ভাসুরও। ধীরে ধীরে লুঠের মালের মত ব্যবহৃত হতে হতেও সে শুয়োরের মাংস হয়ে যায় না।
কারণ, ধীরে ধীরে ও চিনে ফেলে এই পুরুষের দুনিয়াকে। বুঝতে পারে যৌনতাও পুরুষের ক্ষমতার আর এক রূপ। তারপর সে ওই যৌনতাকেই করে তোলে তার ক্ষমতায়নের মাপকাঠি। এখন পুরুষ তাকে ভোগ করতে পারে না, সে ভোগ করে পুরুষকে—ঠিক ওদের মতই। যাকে চায় ডেকে নেয় বা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কোয়েল ক্লাস টুয়েল্ভের ছাত্রী নিজের মেয়েকে শিক্ষা দেয় কন্ডোম ব্যবহার করতে, নইলে কিছু হয়ে গেলে মা কিছু করতে পারবে না।
“শোনো মেয়ে, মেয়েদের শরীর বড়ো শত্রু। ছেলেরা ফুর্তি করে চলে যাবে দগ্ধাতে হবে তোমায়। কিছু করলে নিজে বুঝে নিয়ে করবে, আগে সাবধান হবে। বড়ো হয়েছিস, আমি ইচ্ছে করলেই তোকে আটকাতে পারব না”।
এমন সত্যবচন কোন মধ্যবিত্ত মা উচ্চারণ করতে পারবে না, বোধহয়।
এই ব্যতিক্রমী চরিত্র বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠের লেখকের কলমের গুণে।
আর একটি অন্যজাতের গল্প 'মৃত সাগর'।
গল্পের কথক সাগর অনিদ্রার হাত থেকে রেহাই পেতে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বোঝায় যে বিছানায় শুলেই তার মাথার ভেতর আলো ঢুকে পড়ে। সম্ভবতঃ ওর চাঁদিতে একটা ফুটো হয়েছে।
লোকে বলে ও ক্রমশঃ ফুটো দিয়ে গলে হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও ও জানে যে সাগর কখনও হারায় না। নদীর নিয়ম-- সাগরের মাঝে হারিয়ে যেতে হবে।
“অনেক নদী সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবীর কোন সাগর আজ পর্যন্ত হারায় নি”।
কিন্তু মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে---অ্যালঝাইমার্স, রাজনীতির গুমখুন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হেরে যাওয়ার দল।
ক্রমশঃ সে বুঝতে পারে সে এখন জলহীন মৃত সাগর—ডেড সী।
“সাদাকালো নারায়ণী” গল্পে কাজের মাসি নারায়ণী শিখেছে তার জ্বালা-যন্ত্রণা-রাগের চিকিৎসা—তেড়ে খিস্তি দাও!
না, সবাইকে শুনিয়ে নয়; কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে, বিড় বিড় করে। নারায়ণী খুব বিশ্বাসী। কিন্তু তার চোখ অনেক কিছু দেখে যা অন্যেরা খেয়াল করেনা। কোন ফ্ল্যাটে বৌদি-দাদাবাবুর খাটের পায়ার কাছে একটা ছোট টাওয়েল পড়ে থাকতে দেখে ও যা বোঝার বুঝে নেয়। আবার হঠাৎ এক দুপুরে যখন দাদাবাবু অফিসে, ঘর পরিষ্কার করতে গিয় ফের দেখে পড়ে থাকা টাওয়েলটিকে।
কৌশলী নারায়ণী ইশারায় বউদিকে সতর্ক করে। একইভাবে বাড়ির উঠতি মেয়েটি তার একরকম সখি হয়ে ওঠে। নারায়ণীর টিভির বিজ্ঞাপন দেখা জ্ঞান—বার্থ কন্ট্রোল বা স্মার্ট ফোনের ব্যবহার সবে সে পোক্ত।
একইভাবে টিভির পর্দায় দেখা একটি সিনেমায় করিনা কাপুরকে গালি দিয়ে ঝাল মেটাতে দেখে সে কৈশোর পেরনো মেয়েটিকে ব্রেক আপে কাঁদতে দেখে মন্ত্র দেয়—ফোন করে খিস্তি দাও।
কিন্তু মেয়েটির ভদ্র নরমসরম খিস্তি যে ভোঁতা হাতিয়ার সেটা খেয়াল করে ও নিজেই সেই অপরিচিত যুবকের মা-মাসি-চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছাড়ে। মেয়েদের এই লড়াইয়ের আমরা কতটুকু জানি?
তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কখনও সখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি বৈকি।
জয়ন্ত দে’র গল্পের ভুবন
ওঁর ভুবনের অনেকটাই আমার অচেনা। তার ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য আমাদের অবাক করে। প্রথম গল্প পেন্ডুলামের ভুবন আমার চেনা। কলকাতা কেন্দ্রিক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আহার-বিহার-আচার আমার পরিচিত, কারণ আমার বসতও সেই ভুবনেই।
কিন্তু নারায়ণীর ভুবন, কোয়েলের ভুবন আমার গণ্ডীর বাইরে। ওদের দেখি দূর থেকে। আর “আঁধারমুখো” গল্পের মত সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক গল্প? যার ঘটনা সামান্যই, কিন্তু রাগ আলাপের মত একটু একটু করে গড়ে তোলা আঁধারের রূপ? যখন বাইরের আর ভেতরের আঁধার মিলে মিশে যায়?
এই গল্পের স্বাদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বা মতি নন্দীর লেখা পড়ার মত।
একই কথা বলা যায় “মৃত সাগর” গল্পটির সম্বন্ধেও।
ভুল বললাম, কেউ ঠিক কারও মত না। প্রত্যেকে নিজস্ব স্বকীয়তায় ভাস্বর। তবে একটা কমন ডিনোমিনেটর আছে—তা হল গল্পের মেজাজ এবং বর্ণনার আঁটোসাঁটো গড়ন, মিতব্যয়িতা। একটি শব্দ বা বাক্যও যেন না ভেবে লেখা হয় নি।
ভাষার উপর এমন দখল ছোটগল্পের সাফল্যের একটি আবশ্যক শর্ত।
এবার শেষ গল্পটির কথা না বললেই নয়। আমার মতে এই “নগরকীর্তন” গল্পে জয়ন্ত সিদ্ধিলাভ করেছেন।
নৌকো করে সতীমায়ের মেলায় যাচ্ছে প্রাক্তন ডাকাত শ্যামলাল, নিয়ে যাচ্ছে জুঁই ও পূর্ণিমাকে। মেলা শুরুর দু’দিন আগে জায়গা বেছে অস্থায়ী খোলার ঘর বানিয়ে রান্নার লোক যোগাড় করে তবে রেহাই। তারপর শুরু হবে শরীর বেচে রোজগার।
হেসে গড়িয়ে পড়ে যুঁই—সতীমায়ের মেলায় আমরা দুই অসতী!
এদিকে ভালবাসার নারীকে বাঁচাতে তার স্বামীকে খুন করে পালিয়ে আসা নগরকীর্তন হয়ে যায় এই দলের কেয়ারটেকার। ধীরে ধীরে পরতে পরতে খুলে যায় এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনী।
কিন্তু এই গল্পের নায়ক আসলে এর ঘোর লাগা পরিবেশ, এর পটভূমি।
নদীর ভাঙন, তার হঠাৎ বাঁক নেওয়া মোচড় ঘর ভাসিয়ে নিঃস্ব করে গ্রামের মানুষকে।
খাবার নেই, কাজ নেই। মেলার জায়গা সরে যায়, কিন্তু বাবার থান অজর অচল।
বাঁচার তাগিদে ঘরের গেরস্ত বৌয়েরা অন্ধকারে লাইনে দাঁড়ায়। পূর্ণিমা যুঁইয়ের খদ্দেররা আর এদিকে আসে না।
কিন্তু কাহিনীর শেষে মাথা তুলে দাঁড়ায় মানুষ। হিংসা কখনও কখনও জীবনের প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ায় বৈকি!
আমাদের শহুরে মানুষদের অচেনা নদীযাত্রা, চরে ঘর বাঁধা, পূর্ণিমা যুঁইদের জীবনযাত্রা, ক্লান্তি, বিশ্রাম ও আনন্দের ছবি লেখক তুলে ধরেছেন পরম মমতায়।
বইটি শেষ করে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকি।
বুঝতে পারি, বারোটি গল্পের কথামালার ভেতরের গোপন কথা কোন তত্ত্ব, কোন রাজনীতি, সমাজনীতি নয়—এগুলো আসলে মানুষের ভালবাসার গল্প, আস্থা ও বিশ্বাসের গল্প। তত্ত্ব ও নীতি রয়েছে—যেমন রাতের সব তারারা থাকে দিনের গভীরে।
উৎসর্গ পত্রে রয়েছে লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর কাছে গল্প লেখার পাঠ নেওয়ার স্বীকৃতি। আমার মনে হয় শ্রীচক্রবর্তী চমৎকৃত হবেন শিষ্যের এমন অনায়াস সাফল্যে।
আশা করব, গুরুচণ্ডালী প্রকাশন ভবিষ্যতে এঁর আরও বই প্রকাশ করবেন।