অনেকের ধারণা, যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি মানে জেল থেকে ১৪ বছর পরে ছাড়া পাওয়া। কিন্তু এটা ভুল। সুপ্রিম কোর্ট বারবার বিভিন্ন রায়ে বলেছে যে যাবজ্জীবন মানে ‘যাবজ্জীবন’, অর্থাৎ অপরাধীর মৃত্যু পর্যন্ত। তবে অন্তত ১৪ বছর কারাবাস পূর্ণ হলে তাদের রেমিশন বা শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার আবেদন সরকার বিবেচনা করতে পারে।
কিন্তু যে কেউ ১৪ বছর পেরিয়ে গেলে রেমিশন পেতে পারে কি?
সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় রেমিশনের যোগ্যতা বিচারে পাঁচটি লক্ষণ দেখার কথা বলেছে:[1]
রেমিশনের জন্যে কারা বিবেচনার যোগ্য কারা নয়, এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত গাইডলাইন রয়েছে। সেগুলো সময় সময় বদলেও যায়।
তিনটি প্রাসঙ্গিক গাইডলাইন
গুজরাত সরকার ১৯৯২ সালে একটি গাইডলাইন বানায়, তাতে অপরাধের গুরুত্ব, বয়স, জেলে আচার আচরণ ইত্যাদি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন অগ্রাহ্য করা উচিত – এ নিয়ে কোন কথা বলা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট ওই গাইডলাইন ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়। কেন্দ্র সরকার সেই নির্দেশ সব রাজ্য সরকারকে দিয়ে তাদের নতুন করে সামঞ্জস্যপূর্ণ পলিসি বানাতে বলে।
গুজরাত সরকার সে’ অনুযায়ী ২০১৪ সালে নতুন গাইড লাইন বানায়। তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়, যে তিনটি ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন বিবেচনা করা হবে না:
এক, যে অপরাধের তদন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা (সি বি আই) করেছে,
দুই, ধর্ষণ করে হত্যা, এবং
তিন, গণধর্ষণ করে হত্যা।
এ বছর স্বাধীনতার ৭৬ বছর উদযাপন উপলক্ষে ভারত সরকারও তিন বিন্দু নির্দেশিকা জারি করেছে:
এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আগেও স্পষ্ট করেছে যে ‘ডিউ প্রসেস অফ ল’ মেনে নির্ণয় নিতে হবে। অর্থাৎ একটি অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করে তার রায় নিতে হবে এবং যে আদালত শাস্তি দিয়েছিল, সেই আদালতের মতামত শুনতে হবে। আর যদি রেমিশনের সিদ্ধান্তটি যুক্তিযুক্ত না মনে হয়, তবে তার জুডিসিয়াল রিভিউ হতেই পারে।
তাহলে তো প্রথমে মনে হবে অপরাধীরা প্রচলিত নিয়ম এবং পলিসি অনুযায়ী কখনোই ছাড়া পেতে পারে না।
কিন্তু হল কী করে?
মুম্বাইয়ের স্পেশাল সিবিআই আদালত অভিযুক্তদের ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০২, ৩৭৬(২)(ই)(জি) এবং সহপঠিত ধারা ১৪৯ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে ১ জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে রায় দেয়।
মে এবং জুলাই ২০১৭ সালে অভিযুক্তদের আপিল, যথাক্রমে মুম্বাই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে শাস্তি বহাল রাখে।
রাধেশ্যাম শাহ ১৪ বছরের উপর জেলে রয়েছে যুক্তিতে, ধারা ৪৩২ এবং ৪৩৩ অনুযায়ী রেমিশনের আবেদন পেশ করে। গুজরাত হাইকোর্ট আবেদন খারিজ করে বলে, ‘৪৩২(৭) অনুযায়ী appropriate government’ হল মহারাষ্ট্র রাজ্য, সেখানে যাও’। কিন্তু মুম্বাই হাইকোর্ট আবেদন শুনতে রাজি না হয়ে বলে, ‘মহারাষ্ট্র নয়, গুজরাত সরকার। অপরাধ ওখানেই হয়েছে’।
তখন রাধেশ্যাম শাহ সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ে।
আশ্চর্যের বিষয়, সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস অজয় রাস্তোগী এবং জাস্টিস বিক্রম নাথের ডিভিশন বেঞ্চ গুজরাত হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বলে, যে গুজরাত সরকারই হল appropriate government, কারণ অপরাধ তো ওই রাজ্যেই হয়েছে এবং রেমিশনের বিচার গুজরাত রাজ্য সরকার ওদের ওখানে প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী দু’মাসের মধ্যে সম্পন্ন করুক।
গুজরাত সরকার ওদের ৯ জুলাই ১৯৯২ সালের রেমিশন পলিসির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিল, কারণ ২০০২ সালে অপরাধ ঘটিত হবার সময় এবং রায় যখন বেরোয়, জানুয়ারি ২০০৮, ওই পলিসিই বলবৎ ছিল। সেই পলিসিতে কী ধরনের অপরাধে ওই পলিসি প্রযুক্ত হবে, কীসে হবে না – সে নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না।[2]
কিন্তু ওই পলিসি সুপ্রিম কোর্ট ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়।
যদিও জানুয়ারি ২০১৪ সালে গুজরাত সরকার যে নতুন গাইডলাইন জারি করে, তাতে এই ছাড়া পাওয়া মুশকিল ছিল। সেটা অনুযায়ী, যে অপরাধের তদন্ত সিবিআই করেছে বা ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করে হত্যার দোষীরা এই পলিসিতে ছাড়া পাবে না।[3]
তাহলে মুখ্য ইস্যু হল দুটো:
এক, রেমিশন নিয়ে বিচার করার ‘appropriate government’ কে? গুজরাত না মহারাষ্ট্র?
দুই, রেমিশনের সিদ্ধান্ত কোন গাইডলাইন মেনে হবে? বাতিল করা গুজরাত ১৯৯২-এর পলিসি, নাকি ২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন মেনে তৈরি পলিসি?
উপরের দুটো বিন্দুতে যদি কোনো একটায় পরের বিকল্পটি মেনে নেওয়া হয়, যেমন গুজরাতের বদলে মহারাষ্ট্রের পলিসি অথবা গুজরাতের ১৯৯২-এর বদলে ২০১৪ সালের পলিসি, তাহলেই অপরাধীরা ছাড়া পায় না।
এই অপরাধীদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি আইন মেনে হয়েছে?
এটা প্রসিডিওরাল বা পদ্ধতিগত প্রশ্ন; বুঝতে আমাদের আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
এক, ধারা ৪৩২(৭) অনুযায়ী ‘appropriate government’ কে? গুজরাত সরকার নাকি মহারাষ্ট্র?
দুই, মকুবের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত নেওয়া কি জরুরি ছিল?
তিন, শাস্তি ঘোষণার আদালতের মতামত নেওয়া কি জরুরি?
চার, সুপ্রিম কোর্টের আগের রায়গুলোর সঙ্গে এই রেমিসনের সিদ্ধান্ত কি সংগতিপূর্ণ?
এক এক করে দেখা যাক।
উল্লেখযোগ্য যে ৬০০০ নাগরিক, মানবাধিকার কার্যকর্তা সুপ্রিম কোর্টে [8] সংযুক্ত আবেদন পাঠিয়েছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস রমন্না তাঁর অবসর গ্রহণের শেষ কার্যদিবসে বিলকিস বানো কেসে গুজরাত সরকারের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরীক্ষা করার রিট আবেদন বিবেচনার জন্য স্বীকার করে গুজরাত সরকারকে এবং ১১ জন ছাড়া পাওয়া অপরাধীকে নোটিশ জারি করেছেন।
যদি গুজরাত সরকারের সিদ্ধান্তটি ভুল প্রতিপন্ন হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় গৃহরাজ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত টেনির সন্তান আশিস মিশ্রের মতন এই ১১ জনকেও আবার জেলের গরাদের পেছনে দেখা যেতে পারে।
[1] লক্ষ্মণ নস্কর বনাম ভারত সরকার (২০০০) এবং স্টেট অফ হরিয়ানা বনাম জগদীশ।
[2] দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।
[3] সি এন বি সি টিভি ১৮ ডট কম, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।
[4] ভারত সরকার বনাম ভি শ্রীহরন (২০১৫)।
[5] লাইভ ল, ২২অগাস্ট, ২০২২।
[6] রামচন্দর বনাম ছত্তিশগড় রাজ্য, ২২ এপ্রিল, ২০২২।
[7] স্ক্রল ডট ইন, ১৮ আগস্ট, ২০২২।
[8] হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯ অগাস্ট, ২০২২।