গত দেড়দশক ধরে ইন্দ্রাণী দত্তের ছোটগল্প প্রবুদ্ধজনের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। তাঁর কাহিনীর বুনোট, গল্প বলার ধরণ, দৈনন্দিন জীবনের কাঁকর-বালি বেছে স্বর্ণরেণু আহরণের ক্ষমতা পাঠককে আবিষ্ট করে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে উনি বাংলাভাষার অগুনতি লেখকদের ভীড়ে হারিয়ে যান না। যে ক’জন সমসাময়িক ছোটগল্প লেখককে সিদ্ধিপ্রাপ্ত বলে আঙুলে কর গুনে চিহ্নিত করা যায়—নিঃসন্দেহে উনি তার অন্যতম।
প্রথম গল্পসংগ্রহ ‘পাড়াতুতো চাঁদ’ গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনই ছেপে বের করেছিল। এটি সে’ হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ। যথারীতি, চটিবই সিরিজের, এবং ১২৮ পাতার বইটির দাম মাত্র ১৩০ টাকা। এটি বেরিয়েছিল করোনাকালে, ২০২০ সালের বইমেলায়।
উনি লেখেন কম। সুদূর প্রবাসে জীবিকার এবং সংসারের দায় মিটিয়ে ফাঁকে ফোকরে চলতে থাকে তাঁর অধ্যয়ন এবং লেখাপত্তর। না, আমার ওপরের দুটো অবজার্ভেশন পরস্পরবিরোধী নয়। উনি যখন পাবলিক ফোরামে কোন লেখা পেশ করেন সেটা একবার পড়লেই বোঝা যায়—বড় যত্নে লেখা। ফরমাইশি লেখা নয়, ধর-তক্তা-মার-পেরেক গোছের তাড়াহুড়ো লেখা নয়।
বোঝাই যায় এ লেখা অনেকদিন ধরে মনে মনে কম্পোজ হচ্ছে , কাটছাঁট হয়েছে। একটি শব্দ বা লাইনও অনাবশ্যক নয়।
এমন লেখকের বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জানানোর অনুরোধ আসায় সোৎসাহে রাজি হলাম। কিন্তু পড়তে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট,-- বইটিতে গল্প-সংকলনের দীর্ঘ পাঠ-প্রতিক্রিয়া তো রয়েছে, লিখেছেন বিশিষ্ট লেখক অমর মিত্র মশায়। তাহলে আমি কেন আর একটা প্রতিক্রিয়া দেব? ওঁর অমন গভীর এবং ওজনদার লেখার পরে?
দু’গ্লাস জল খেয়ে রাগ-বিরক্তি সব গিলে ফেলে গল্পগুলো আবার পড়তে শুরু করলাম। শেষে এই বোধ এল যে আমি কোন সাহিত্য-সমালোচক নই তো কী হয়েছে? একজন মনোযোগী পাঠক তো বটি! লিখব আমার ভাল লাগার কথা, আমার মুগ্ধতার কথা, আমার মত করে।
কবিতার মত রূপকল্প
অমর মিত্র মশাই বলেছেন—এই গল্পকারের মায়াময় ভাষা, আশ্চর্য কাহিনি বয়ন নিয়ে উড়ান দেয়ার কথা; যথার্থ।
দেখুন, ক্যামেরার চোখ দিয়ে ডিটেইলস্ এর কাজ ও চিত্রকল্পঃ
“ফর্সা গেঞ্জির কাঁধের ওপর তখনও একফালি রোদ, জলের ছড়ার পাশে পিঁপড়েরা ঘুর ঘুর করছে’। (সূর্যমুখীর এরোপ্লেন)
“রাত নামছিল কোথাও। অথবা বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। কোথাও সকাল হচ্ছিল। সুখী যুগলের তৃপ্ত মুহূর্ত মধ্যে বেড়ালের থাবার আঁচড় পড়ছিল। কবি কলম বন্ধ করে উঠে যাচ্ছিলেন লেখার টেবিল ছেড়ে। অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছিল কেউ। অসুখ-বেলুন ভেসে আসছিল। খেলা চলছিল। অথবা প্রস্তুতি”।(প্রস্তুতি পর্ব)
“কোথায় যেন একটা কুকুর কঁকিয়ে উঠল, তারপর আর যেন কোন শব্দ নেই, সব অন্ধকার—যেন রাত নেমে এল ভর বিকেলেই। পরক্ষণেই আলো ফিরে এল আবার, গাড়ির হর্ন, মানুষজনের চিৎকার—অনেক ওপর থেকে সবকিছু দেখছি, এরকম মনে হচ্ছিল। হয়তো পালক হয়ে গেছি, কিংবা তুলোর আঁশ, অথবা বেলুন—ভেসে ভেসে ওপরে উঠছি মনে হল”।
আবার দেখুন ভাষা ও চিত্রকল্পের মন্তাজঃ
“সেই সময়ে, একদিন বেণু এসেছিল দোকানে। বেণুর সঙ্গে পাড়া উপচে গলি উপচে বেলফুলের গন্ধ এসেছিল রেলব্রিজের দিক থেকে, তারপর বেলফুল আর বকুলগন্ধ মেশামেশি করে রেললাইন পেরিয়েছিল; শেষ অবধি, বাজার উপচে গিয়ে বেল বকুল আর কদম্ব থেমেছিল প্রফুল্লর দোকানের সামনে। প্রফুল্ল আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল”।
“আচমকা মনে হল, কলেজ স্ট্রিট ট্রামলাইনের তলায় গরম কফি জমছিল অনেকদিন, আজ যেন মাটি খুলে গেছে; ঠনঠনের দিক থেকে কফির ঢেউ ছুটে আসছে। উত্তাল”। (অরফ্যানগঞ্জ)
সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় মফঃস্বলী মেয়ে রিংকু। গলায় সুর আছে, ভেবেছিল সেই সম্পদে ভর করে ওপরে উঠবে। কিন্তু এই বাজারে লোকে ওর উঠতি বয়েসের শরীরকেই বেশি দাম দিতে চায়। ওর দিনচর্যায় আজকের ভারতের ইনফর্মাল সেক্টরের খেটে খাওয়া জীবনের নিখুঁত ছবি।
ওর দরকার ম্যাজিক। তাই ওর সঙ্গী হয়ে ঘরে এক মায়াবী হরিণ টিংকু। ওর অল্টার-ইগো। হতাশার পাঁকে ডুবতে গিয়ে ওর মুক্তি ঘটে টিংকুর চাঁদ খাওয়ায়।
“—মাঝখানের ফাঁকটুকু দিয়ে সাঁৎ করে চাঁদ ঢুকল স্টেশনে, আর যেন পায়ের তলা থেকে জ্যোৎস্না উঠে এল সটান—বিশাল এক চাদর পাতল প্ল্যাটফর্ম জুড়ে। সিনেমার পর্দার মতো”।
“ তারপর রুটি দিয়ে বাঁধাকপি গেলার মত খাবলা খাবলা জ্যোৎস্না ঠুসতে লাগল নিজের মুখে। এঁকেবেঁকে পালাতে চাইছিল বাকি আলোটুকু—টিংকু এবার সটান কামড় দিল চাঁদে—টপটপ করে ঝরে পড়ল রস—রেললাইন আর প্ল্যাটফর্মে”। (বৌঠানের ছাদ)
ইন্দ্রাণী এক কথক ঠাকুর। ওঁর লেখার মধ্যে গুঁজে দেন রূপকথা, পরীকথা, আদিম জনজাতির স্মৃতি।
বুড়ো জন গল্প বলে—
‘আকাশ ছিল না। উপুড় করা চ্যাপটা বাটি পৃথিবীর ওপর। যা আকাশ নয়। অথচ পাখি ছিল, ডানা ছিল। একঝাঁক পাখি ক্লান্ত, অধৈর্য ডানা মেলার খোঁজে একদিন ধাক্কা দিতে শুরু করল সেই উপুড় অর্ধগোলকে। আকাশ ভাসে না তবুও”। (যাপনকাল)
ইন্দ্রাণী আমার কিশোর বয়সে দেখা ম্যাজিক লণ্ঠনের আলোয় ছবি দেখিয়ে গল্প বলেন।
মানুষ, মেঘমানুষ-- মেঘমানুষের গল্প।
পাগল জেঠু বলে দেশের গল্প। “পড়ে শোনায় গল্পগুচ্ছ আর ভাঙা আয়নায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে সুর করে বলে—এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে না”।
এবার নামগল্পের শেষের ক’টি লাইন দেখুন, কাঁচের প্লেটে মোটা ব্রাশের টানে আঁকা-- ঝড় আসছে। আমরাও কুটোর মতন উড়ে যাচ্ছি। ক্রমশঃ উড়ান যেন মহাজাগতিক হয়ে উঠল--
“পাক খেতে খেতে ঢুকে যাচ্ছিল শাশুড়ির ব্যাদান মুখে—বিশাল হাঁ করে ঝড় খাচ্ছেন সূর্যমুখী”।
মৃত্যুর ‘ইমেজ’
খুঁজছিলাম কী সেই অদৃশ্য সুতো যা ইন্দ্রাণীর নির্বাচিত গল্পগুলোকে গেঁথে রেখেছে। মনে হয় পেয়ে গেছি, আর আন্দাজ করতে পারছি তাঁর টুলকিট, রূপকথার ভাসিলিসার জাদুদণ্ড।
এক ডজন গল্পের এই সংকলনে আনখশির ছড়িয়ে আছে মৃত্যুর গন্ধ, মৃত্যুর বর্ণনা, মরে যাওয়ার অনুভূতি। কোথাও মৃত্যু আসে জানলার পর্দা সরিয়ে ঝোড়ো জলের ঝাপটার মত, কোথাও মৃত্যুর বর্ণনা যেন সাংবাদিকের রিপোর্তাজ, কোথাও মৃত্যুর গন্ধ ক্লোরোফর্মের মত আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে।
“পাঁজর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম—বাসের চাকা আমাকে চ্যাপ্টা করে রাস্তায় মিশিয়ে দিচ্ছিল—লাল, ঘন লাল হয়ে যাচ্ছিল অ্যাসফল্ট” (সূর্যমুখীর এরোপ্লেন)।
নিও-লিবার্যাল ইকনমি ও বিশ্বায়নের যুগে কোম্পানির প্রতি নিষ্ঠা এবং প্রযুক্তির আবিষ্কার তার গুণগত মানের মর্যাদা পায় না। সেখানে ব্যক্তিমানুষ অসহায়। তার ভবিতব্য কি আত্মহনন?
“সে আসে। ভস্মরাশি মাড়িয়ে। ফেন্স টপকায়। তারপর ঝাঁপ দেয়। নুড়িপাথর ভস্মরাশি গড়িয়ে নামে তার পাশে পাশে। পাথরে ঠোক্কর খায় পাথর, দেহ, রক্ত, ঘিলু মজ্জা। ভল্লবিদ্ধ শিকার যেমন। শব্দ ওঠে। গহ্বর তা শুষে খায়।
দেহটি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। চাঁদের আলোয়”। (যাপনকাল)।
আর নারী? এই মৃত্যুতে একলা হয়ে যাওয়া নারী? যে ধারণ করেছে মৃত পুরুষের বীজ ও স্বপ্ন? তার ট্র্যাজেডি ইন্দ্রাণী এঁকেছেন এভাবেঃ
“ওর জগতে অভিষেক ছিল না। পাখি ছিল, জল ছিল আর ওর অজাত সন্তান। --- সিপিয়া আকাশ থেকে পাখি ঝরে পড়ছে। মরা পাখি”। (যাপনকাল)।
কিন্তু কোথাও কোথাও মৃত্যু তার কাব্যিক ইমেজ নির্মাণের ফলে তাৎক্ষণিকতা ও তুচ্ছতার উর্দ্ধে উঠে এক মহাজাগতিক উপলব্ধি আনে। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
গল্পটির নাম ‘পদ্মের দল’।
পরিতোষ আপনার আমার মতন এক ছাপোষা মানুষ। পরিতোষ মৃত্যু নিয়ে ভাবে। রিটায়ারমেন্ট একরকম মৃত্যুই, অন্য জীবনে প্রবেশের দরজা। পরিতোষ থাকে মৃত্যু বা কালীদার আগমনের প্রতীক্ষায়, তাকে অভ্যর্থনার জন্যে তৈরি হতে থাকে। ও বলবে- কালীদা চা খান।
কিন্তু এই মৃত্যুচিন্তা নিয়ে আসে অবসাদ। ওর স্ত্রী মালিনী স্বামীর অবসাদ কাটাতে নিয়ে যায় কোন অভয়ারণ্যে। কিন্তু দলবেঁধে ঘোরার সময় একটি পাথুরে নালার পাশে আচমকা বাঘের দেখা পেয়ে উত্তেজিত মালিনী সবার নিষেধ অমান্য করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে সেদিকে দৌড়ে যায়। সামনে কমলা ডোরাকাটা মহাকালকে দেখে মালিনী নির্বিকার অনাসক্ত ভাবে তাকে বরণ করে।
আটপৌরে জীবন থেকে ছিটকে বেরনো এই মুহুর্তকে ইন্দ্রাণী কীভাবে ধারণ করেছেন তাঁর কলমে?
“শুয়ে পড়ল মালিনী।–পিঠের তলায় কনকনে জল আর মসৃণ নুড়ি পাথর টের পাচ্ছিল সে”। “আইস্ক্রিমটা গলে যেতে যেতে ফেটে গেল এবারে—কমলা রঙের আগুন ছিটকে বেরোল। মালিনী চিনতে পারল—কালিদা।“ (পদ্মের দল)
ভাবতে থাকি—ইন্দ্রাণী কি কখনও কোথাও বেড়াতে গিয়ে সাক্ষাৎ শমনকে সামনে দেখে অমন লাফ দিয়ে জীবনের বৃত্ত থেকে ছিটকে বেরোতে চেয়েছিলেন? আর আমরা?
আবার মধ্যবিত্ত জীবনের একাকীত্ব, ক্রমশঃ একে অপরকে চিনতে না পেরে দূরে সরে যাওয়া –এও তো একরকম মৃত্যুই।
কে কাকে চেনে? সুদীপ-স্বাতী, পুর্ণেন্দু-কস্তুরী?
“পূর্ণেন্দু পাজামা নামিয়ে দু ঊরুর মাঝে হাত ঢুকিয়ে গোঙাচ্ছে । কস্তুরী লুকিয়ে ফিরে আসে। বালিশে মুখ ঢুকিয়ে হাহা কাঁদে। মৃত্যু কামনা করে। পূর্ণেন্দুর। অথবা নিজের”। (উইদাউট আ প্রিফেস)
“তখন মধ্যরাত। কস্তুরীর সেলফোনে স্বাতীর মেসেজ আসে—“ও চলে গেল এইমাত্র। ম্যাসিভ অ্যাটাক। কিচ্ছু করতে পারলাম না”। (উইদাউট আ প্রিফেস)।
পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আদ্দেক জীবন পেরিয়ে এসেও কি ঠিকমত চিনতে পেরেছি আমার সঙ্গীকে? নাকি রোজ পিংপং খেলছি? ইন্দ্রাণী আমাকেও আত্মবীক্ষণে বাধ্য করেন।
কিন্তু আমরা যে একে অপরকে চিনতে চাই, অনেক না-বলা কথা বলতে চাই। একজনের মৃত্যু এসে অপরজনকে সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। তাই গল্পে আসে একটি আশ্চর্য প্রাচীন বই।
“ঠিক সেই সময়ে আটলান্টিকের ওপারে প্রাচীন বইটি খুলছে স্বাতী। বাতাস বইছিল না। নিস্পত্র বৃক্ষরাজি, জনবিহীন সাইডওয়াক, একলা স্ট্রিটলাইট যেন কিছুর প্রতীক্ষায় ছিল” (ঐ)।
এই ব্যাপারটা ইন্দ্রাণীর টুলকিট। এ নিয়ে পরে আরও কথা হবে। আর বলতে চাই অল্প কথায় এঁকে ফেলা মৃত্যুর মন্তাজ নিয়ে ।
“ক্রমে বাড়ি ফেরার সময় আলাদা হয়ে গেল দুজনের। তারপর একদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরে বেণূকে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে দেখল প্রফুল্ল। পায়ের কাছে উলটানো টুল”।(অরফ্যানগঞ্জ)
এবারে কথা বলি অন্য স্বাদের এই গল্পটির অন্য এক মাত্রা নিয়ে, ব্যষ্টির মৃত্যু থেকে সমষ্টিতে পৌঁছে যাওয়ার বর্ণনা।
এখানেও জাদু এবং জাদুকর। বেণুর হত্যার মিথ্যে অপরাধে জেল খেটে বেরিয়ে আসা প্রফুল্ল জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না। কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
এমন সময় ওর হাতে আসে জাদুকরের দিয়ে যাওয়া লাঠি। সেটা হাতে নিলেই ওর পায়ের তলায় মাটি কাঁপে। তারপর ভানুমতীর খেল শুরু।
“নেতাজির মূর্তি খুলে আনল প্যাঁচ ঘুরিয়ে। প্রথমে একটা রক্তমাখা হাত বেরিয়ে এসেছিল।“ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ছোটখাটো বুড়ো মানুষ—পাকা চুল দাড়ি—বুকে, মাথায় রক্তের ছোপ; বেরিয়ে এসে ধুলোটুলো ঝাড়ল জামা থেকে।---- প্রফুল্লকে জড়িয়ে ধরল বুড়ো তারপর নাম বলেছিল; একটু থেমে নিবাস—“মহম্মদ আখলাক সইফি, দাদরি, উত্তরপ্রদেশ, ভারত”।
“মাটির গভীর থেকে হাত বের করে বুড়ো বুড়ি কারও গলায় আঙুলের দাগ, কালশিটে, বুকে পেটে মাথায় গভীর ক্ষত, কারও হাত নেই, পা নেই, চোখ খুবলানো, বর্শায় এফোঁড় হয়ে গিয়েছে কেউ, হয়তো মুখের সামনেটাই নেই; অস্পষ্ট মুখ, ছায়াময় অবয়ব”। নিঠারির নিহত শিশু। (অরফ্যানগঞ্জ)
আমরা চমকে উঠি। টের পাই ইন্দ্রাণী নেমে এসেছেন আজকের ভারতে, তার মাটিতে। বুঝি—এসবই ঘটমান বর্তমান ।
আর তার পরেই চোখ যায় শেষের গল্পটিতে—‘মুকুলের বাড়ি”। এটি আমার কাছে সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্প। ইন্দ্রাণীর শিল্পসৃষ্টি এই গল্পের বয়নে অন্য মাত্রা এনেছে। প্যান্ডেমিকের সময়ে লেখা গল্পটি সেই লকডাউনের দিনগুলোকে ধরেছে খুব মিতভাষণে। আর সব ছাপিয়ে জেগে ওঠে বাঁচা-মরার এক আশ্চর্য কল্পনা যেখানে মৃত্যুও নান্দনিক হয়ে ওঠে।
আপাত উদাসীন বাবা-মা’র সম্পর্ক অনেক দিন তেতো। গলির সাত নম্বর এবং তেকোনা বাড়িটির মেয়েটি ভাবে—“ বাবা, মা, আমি কেউই কারোর দিকে তাকিয়ে নেই বরং তিন দিকে মুখ করে বসে আছি। যেন—অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। অদ্ভূত। খুবই অদ্ভুত”।
বাবার মাথায় এক নেশা চেপেছে—একটা নৌকো বানাতে হবে, নোয়ার আর্কের মত, শুধু পরিবারের তিনজনের জন্যে। নৌকো বানিয়ে নাম লিখে দেওয়া হল—ল্যাজারাস।
কিন্তু ‘মা বড়ো উদাসীন। অপরিষ্কার শাড়ি, চুল উশকোখুশকো, নখের কোণে ময়লা—ভুলে যেত ঠিকই, রান্না করতে ভুলে যেত, আমাকে খেতে দেওয়ার কথা মনে থাকত না”।
তারপর এল এক অদ্ভুত মহামারী।
“বাতাসে বাতাসে এক মারাত্মক জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে—বাড়ির বাইরে বেরোলেই মানুষ ইনফেক্টেড হবে—আর ঘন্টাখানেকের বেশি বাইরে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য”। কিন্তু ওষুধ বেরিয়ে গেছে—এলিক্সির ওয়ান। বাইরে বেরোলে অন্তত এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে ওটা খেয়ে নিতে হবে। ওষূধটি বাড়ির বাইরে কাজ করে না।
শহরের দৈনন্দিন জীবন থমকে গেছে।
“বাইরে কুকুর ডাকে না, রিকশা চলে না, অটো নেই, রাস্তাঘাট ধূ -ধূ করে—মাঝে মাঝে হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স। একদিন ড্রোন এসে সপ্তাহের সাপ্লাই দিয়ে যায়”।
চেনা ছবি?
“এলিক্সির ওয়ান—বাড়ির যত লোক সবার জন্যে যেন দু-চামচ করে ওষুধ রাখা থাকে—কমে গেলে, ফুরিয়ে গেলে মেসেজ করে দিতে হয়’।
কিন্তু একদিন এল প্রচণ্ড ঝড় এবং ঝঞ্ঝাবাত। ‘শত হস্তীর বৃংহণ চতুষ্পার্শ্বে আর কামানের গোলার মত বাজ”।
এবার ইন্দ্রাণীর সেই টুলকিট— নিকষ আঁধারে “পাশের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাবা-“আমার নৌকা”?
“দড়ি খুলে উলটানো নৌকো হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে দৌড় শুরু করল খালি পায়ে। ঘাস জমি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায়।
--যেও না বাবা। কী করছ?
সহস্র অশ্বখুরে আমার কথা চাপা পড়ে গেল।“
বাবাকে ফিরিয়ে আনল মেয়ে ও মা। ততক্ষণে জামরুলের ডাল ভেঙে ঘরে ঢোকার পথ বন্ধ।
কিন্তু ওই জীবনদায়িনী ওষুধ ঘরের বাইরে কাজ করে না। একঘণ্টার মধ্যে ঘরে ঢুকে তিনজনকেই দু’চামচ খেয়ে নিতে হবে, নইলে মৃত্যু অনিবার্য। ইতিমধ্যে একঘণ্টা প্রায় পেরিয়ে গেছে। তিনজনেরই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। বাবা মাটিতে শুয়ে গোঙাচ্ছে। অন্ধকারে দৌড়ে ওষুধের শিশি আনতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ায় মায়ের হাত থেকে ছিপি খুলে মাটিতে গড়াল তরল ওষুধ।
পাঠকের দমবন্ধ হয়ে আসে।
“মা অন্ধকার হাতড়ে আঙুল দিয়ে কাচিয়ে তুলল ওষুধ, সেই আঙুল গুঁজে দিল বাবার মুখে”।
এবার? ইন্দ্রাণী কী করবেন? তিনজনকেই বাঁচিয়ে দিবেন কোন মন্ত্রবলে?
“মা একদম চুপ, শ্বাস নিচ্ছে বড়ো বড়ো আর মেঝে কাচিয়ে ওষুধের অবশিষ্টটুকু ঢুকিয়ে দিচ্ছে বাবার মুখে। তখনই বিদ্যুৎ-এর আলোয় দেখলাম সেই আশ্চর্য দৃশ্য। বাবা ওষুধ মাখা জিভ ঠোঁট দিয়ে ভয়ংকর চুমু খেল মাকে; দীর্ঘ দীর্ঘ সে চুম্বন—জিভ দিয়ে তরল স্পর্শ করাল মার আলজিভে।
আমি বেরিয়ে এলাম”। (মুকুলের বাড়ি)
জীবন-মৃত্যুর এমন পাঞ্জাকষার বর্ণনায় বেঁচে উঠল শিল্প।
শেষ পাতেঃ
সব মিলিয়ে কী পেলাম? ফিরে যেতে হবে ধ্রুবপদে, ফিরে আসি নাম-গল্পের শেষ প্যারাগ্রাফে। শেষ দুটো লাইন দেখুনঃ
‘লেটস্ টিম আপ। লেটস্ ডু ইট টুগেদার, ভাসিলিসা। উই নিড আ মির্যাকল”। (সূর্যমুখীর এরোপ্লেন)।
ইন্দ্রাণী নিজেই জাদুকরী ভাসিলিসা। তাঁর জাদুদণ্ড বা টুলকিট হল আটপৌরে জীবনের তুচ্ছতা থেকে লাফ মেরে মহাশূন্যে ভেসে যাওয়া। তাই গল্পের শেষ হয় অমন একটি জাদু-পংক্তিতেঃ
“আকাশ চৌচির করে উড়োজাহাজ নামছিল বড়ো রাস্তায়---“।
উনি এভাবেই ডাক দিচ্ছেন পাঠকদের একটি সুন্দর ভুবনের নির্মাণে, একসঙ্গে।
জাদুকরীর সামনে নতজানু হতেই হয়।
লেটস্ ডু ইট টুগেদার, ভাসিলিসা।