এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ভেজা মাটি..... সোঁদা গন্ধ......উদাসীনতার কথা

    শ্রাবণী
    অন্যান্য | ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ | ১৪২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৯628564
  • খিড়কীর খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোনের ঠিক মাঝখানটাতে এসে দাঁড়ালো কালীতারা। বাবা রান্নাঘরের দুয়ারে খুঁটির ধারে ধারিতে বসে ছিল, উঠোনে পা ঝুলিয়ে, পাশে কানাই জেঠু, চাষী। বসে বসে জেঠুর কথা শুনছে বাবা, ধান চালের হিসেব, গ্রামের খবর। মাটিতে খালি চায়ের কাপ, প্লেটে চলকে পড়া লালচে অবশেষে কালো ডেঁয়ো পিঁপড়ে খুঁজে বেড়ায় সার।
    প্রায়ান্ধকার ঘরের ভেতরে পড়ার টেবিলে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে উঠোনের গাছপালা আকাশ ইত্যাদি দেখছিল কাজল এতক্ষণ, আমগাছের পাতায় রোদ পড়ে মাকড়সার জাল চকচক করছে। বাড়িতে বাইরের কেউ ঢুকেছে টের পেয়ে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এল দৃষ্টি। বুঝল কী করে, কেউ এসেছে?
    চারিদিকের অগোছালো আওয়াজ যত কেমন যেন থমকে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। কলতলায় বাঁটুলদির সকালের চায়ের বাসন ধোয়ার টুংটাং শব্দ বন্ধ। বাবা আর কানাই জেঠু চুপ, বোনটার এখনো সকালে পড়ার বালাই শুরু হয়নি, সে বারান্দার খুঁটি ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, থেমে গেল।

    সাদা ঈষৎ ময়লা থান, মাথায় হেলাফেলার আধঘোমটা, কপালে তিলক, গলায় কন্ঠি,লম্বা চওড়া চেহারা, ফর্সা রঙ, টানটান, কোথাও কোনো জড়তা নেই। কপালের তিলকটার দিকে তাকালে গা কেমন শিরশির করে ওঠে। চেহারায়, সাজপোশাকে, আশেপাশে দেখা মা জেঠিমা ঠাকুমাদের মত মহিলাদের সঙ্গে কোনো মিল পায়না বলেই বোধায় কালীতারাকে দেখলে অস্বস্তি হয় কাজলের । তাকে কেউ পিসী মাসী জেঠি ইত্যাদি কিছু বলে ডাকেনা। কী বলে সম্বোধন করতে হবে কখনো শেখায়নি কেউ। অথচ মা প্রায় সবাইকেই কিছু না কিছু বলে ডাকতে শিখিয়েছে। কাজের মেয়েকে দিদি, চাষীকে জেঠু, নাপিতানীকে আলতাপিসী, দুধওয়ালিকে দুধমাসি। কালীতারার সঙ্গে বা তাকে নিয়ে কেউ কথা বলতে চায়না, এটা বুঝতে ছোটদেরও বিশেষ অসুবিধে হয় না। এপাড়ায় তার আনাগোনা কম, এলেও বাগান বা খামারে। বাইরে থেকেই ব্যাটাছেলেদের সাথে কাজের কথা বলে চলে যায়। কোনো বাড়ির ভেতরে ঢুকে মেয়েদের আসরে গল্পগাল করতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কালেভদ্রে যখন কোথাও তাকে দেখা যায়, আজকের মতই চারিপাশের অন্য সব উচ্চগ্রামের আওয়াজ থেমে গিয়ে চাপাস্বরের ফিসফিস গুজগুজ শোনা যায় শুধু ।
    মাঠের ওপারে চাষীপাড়া অর্থাৎ কানাইজেঠুদের পাড়াতে কালীতারাদের বাস। একটু একানে একটা চালা ঘরে মেয়েকে নিয়ে থাকে। কানাই জেঠুর বাড়ি যাবার পথে দেখেছে কাজল। এক ছেলেও আছে শুনেছে, কোন বাবুর বাড়ি, না কারখানা, কোথায় জানি কাজ করে, দুর্গাপুরে না কলকাতায়।
    গেলবার বারোয়ারী কালী পুজোয়, একটা খুব ফর্সা মত ছেলে, ওর থেকে বেশ বড়, বড়জেঠুর ছোট ছেলে মন্টুদার মত হবে, বলির কাটা মহিষের মুন্ডুটা নিয়ে রক্তে মাখামাখি হয়ে নাচছিল। তাকে দেখে মেয়েদের দল খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মা জেঠিমা কাকীমারা বলির সময় যায়না, অল্পবয়সী মেয়ে বউরা যায়। বাঁটুলদি কাজলকে আর বোনকে নিয়ে গিয়েছিল পুজো দেখতে। দাসেদের দুয়ারের যেদিকটায় এপাড়ার মেয়েরা দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়ে বলি দেখার চেষ্টা করছিল ও, যদিও অত ঠাসা ভিড়ে কিছুই তেমন চোখে পড়ছিল না।
    বোন বাঁটুলদির কোলে, কাজল চেয়েছিল বাবার সাথে মন্দিরের একেবারে সামনে যেতে, কিন্তু বাবা নিয়ে যায়নি, হয়ত কিছুটা ইচ্ছে করেই। বারোয়ারী পুজোয় পাঁঠাবলি হয় শয়ে শয়ে, এত রক্তারক্তি কান্ড ছোটরা দেখুক, বাবা বোধহয় চায়না। তাছাড়া মায়ের পুজোয় কারণবারির সমুদ্র বয়ে যায়, বেশীরভাগ লোক ওদিন ঠিক নিজের বশে থাকেনা, তাই তো ভদ্রবাড়ির মহিলারা পুজোর ঐ সময়টা ওদিকে ঘেঁষে না।

    ছেলেটাকে মুন্ডু নিয়ে ওরকম বীভৎসভাবে নাচতে নাচতে দাসেদের দুয়ারের দিকে আসতে দেখে, হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল,মেয়েরা সব দৌড় দিয়েছিল দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। কাজল ভয় পায়নি, সেরকম খারাপও লাগেনি, বরং আরো ভালো করে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাঁটুলদি দেখতে দেয়নি, তার হাতটা ধরে টানতে টানতে মোয়ানের রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছিল দ্রুতপায়ে।
    পরে শুনেছিল, ছেলেটা নাকি কালীতারার সেই কলকাতা না দুর্গাপুরবাসী ছেলে। সবাই খুব নাক মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, "হবেনা? কেমন মায়ের ছেলে দেখতে হবে তো! বাপের ঠিক নেই"। ঠিকমত বোঝেনি ব্যাপারটা, তবে একটা কথা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল, কালীতারা আর তার ছেলে দুজনকেই এ গ্রামে কেউ পছন্দ করেনা সেরকম।

    মা রান্নাঘরের ভেতরে ছিল, টের পায়নি বাইরে কে এসেছে, খুন্তির ক্যাঁচকোঁচ আর লক্ষ্মীপিসীর শিলে বাটনা বাটার আওয়াজ তাই বন্ধ হয়না। সকালের জলখাবার হচ্ছে, বাবা বাড়ি আছে মানে সকালে পরোটা আর আলুচচ্চড়ি। লঙ্কা, পাঁচফোড়নের ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে বেড়ায় বাতাসে।
    কালীতারা বাবার পায়ে হাত না দিয়ে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে,
    -"ছোটকত্তা, বড় বিপদে পড়েছি। কিছু টাকা চাই, এখনি।"
    কানাইজেঠুর মুখটা বেঁকে যায়, জানলার গরাদের মধ্যে দিয়েও কষ্টিপাথরের মত কালো কপালের কোঁচকানো রেখাগুলো স্পষ্ট দেখা গেল। দম বন্ধ করে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে কাজল। কেমন যেন মনে হয় এ একটা খুব নাটকীয় মুহূর্ত।
    -"টাকা? দেবার মত টাকা আমার হাতে কোথায়?"
    কালীতারার গলায় মিনতি ঝরে পড়ে,
    -"তুমি ছাড়া আর কে দিবে, কার কাছে যাই আমি? তুমি শহরের বড় সরকারী চাকুরে।"

    মা বাবার আলোচনায় এ কথা সে অনেকবার শুনেছে। বাবার সরকারী অফিসে ভালো চাকরি, তাই গ্রামের লোকে তাদের বড়লোক ভাবে, কিন্তু আসলে তারা বড়লোক নয়, জমিজমা তাদের নেই তেমন। বাবা যখন কাজলের চেয়েও ছোট, ঠাকুরদা মরে যায়।বাবা ছোটতে খুব ভুগত, সবাই বলত বাঁচবেনা। নির্বংশ হবে সেই ভয়ে নাকি দাদু মরার আগে সব জমি বিক্রি করে, দান করে দিয়ে গেছে, যদি পুণ্যে ছেলে বাঁচে। কিছুদিন আগে অবধি একটা পুকুর পর্যন্ত ছিলনা। বাড়িও ছোট ছিল, এখন বাবা পুরনো বাড়ির লাগোয়া ওপর নীচে দুটো ঘর তুলেছে, খিড়কি দিকের ছোটপুকুরটা কিনে নিয়েছে।
    বাবা কি বিরক্ত? রান্নাঘরের ভেতরের আওয়াজও এবার বন্ধ, তবে কেউ বাইরে আসে না। না দেখেও কাজল বলতে পারে মায়ের কান এদিকে খাড়া, তারই মত। তারও কি পড়ায় মন আছে নাকি, যদিও সামনে বইয়ের পাতা খোলা ।

    -"ওসব সরকারী চাকরি শুনতেই গালভরা, মাইনে সামান্য। শহরে ঘরভাড়া দিয়ে, দু জায়গায় সংসার চালিয়ে কতটুকু আর থাকে? তায় নতুন বাড়ি করেছি, মাথার ওপর এখনো দেনার বোঝা। আমি কোত্থেকে টাকা দেব?"
    -"টাকা না থাক গোলায় ধান আছে তোমার। ধান বিক্রি করে টাকা দাও। আমার খুব দরকার।"

    মুখটা উল্টোদিকে ঘোরানো,ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা তবে গলার স্বরে মনে হল এমন একটা কথা কেউ বলতে পারে তা বাবার কল্পনার বাইরে।
    -"ধান বিক্রি করে টাকা দেব? আমার যা ধান তা আমার সংসারের সম্বচ্ছরের খাবার ধান। সেসব দিলে আমার চলবে কী করে?
    কালী কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওদিক থেকে কানাই জেঠু বলে ওঠে,
    -"বেশী থাকলেই বা ধান বিলোতে হবে কেন! কিনতে আসিসনি তো আর, সে মুরোদ থাকলে তো বড় বাড়িতে যেতিস, এখানে আসতিস নি। কত্তা কি খয়রাতি করতে বসে আছে নাকি, ভেবেছিস কী?"

    বড়বাড়ি মানে কাজলদের পাড়ার সবথেকে বড় পাকা বাড়ি, ভবতোষ জেঠুদের বাড়ি। সে বাড়িতে অনেক লোক, ঠাকুরের সম্পত্তির বড় অংশীদার ওরা, জমিজমা সম্পত্তি তে ওদের ভাগ অনেক বেশী বেশী, দাপটও তেমনি।
    কানাইজেঠু চাষীপাড়ার অর্থাৎ কালীতারাদের পাড়ার মাতব্বর, তবু তাকে উপেক্ষা করে কালী সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে কথা বলে। শুধু এখন আর মিনতির ভাবটা নেই, কঠিন গলার স্বর ।

    -"খয়রাতি নয় কত্তা, পরে কিছু কিছু করে শোধ দিয়ে দিব। না হলে গতরে খেটে দেব তোমার ঘরে।"
    অচ্ছেদ্দার সে সুরে কানাই যেন আরো তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে,
    -"হুঁ, শোধ দিয়ে দেবে। গতর আছে অন্য জায়গায় যা, এখানে তোর ওসব খাটনি কাজে লাগবেনি।"

    কাজল মন্ত্রমুগ্ধের মত থানে জড়ানো ঐ মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, সে মুখ যেন গনগনে আঁচ,আর কিছু বলার আগে বাবা কানাই আর কালীতারা দুজনকেই থামিয়ে দেয়।

    -"এত কথায় দরকার নেই। আমার ঘরে এ নিয়ে অযথা চেঁচামেচি কোরোনা তোমরা, ছোট ছেলেমেয়ে আছে। কালী, তুই অন্য কোথাও দ্যাখ, আমি অপারগ। হাতে তেমন কিছু নেই আর ধান বিক্রি করে টাকা দিলে খেতে পাবনা।"
    কালীতারা আর দাঁড়ায় না, হনহন করে খিড়কি দরজার দিকে যেতে যেতে একবার এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বোনটার দিকে তাকায়, পরক্ষণেই দৃষ্টি ঘরের ভেতরে। কাজল জানে দিনেরবেলায় আলোভরা উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর ঠিক দেখা যায়না, অন্ধকার লাগে। তবু কেমন সিঁটিয়ে যায় সে, ভয়ে অস্বস্তিতে মাথা নীচু হয়ে আসে আপনা আপনি।

    -"তোমার ছেলেমেয়েদের দিব্যি ছোটকত্তা, এর ফল তুমি পাবে। আমি বড় আশা নিয়ে তোমার সাহায্যি চাইতে এসছিলুম, তুমি ফিরিয়ে দিলে। ভালো হলনা।"
    বাবা কিছু বলেনা, কানাই জেঠু খিড়কি দরজার কাছে গিয়ে লম্ফঝ্‌ম্প জুড়ে দেয়,
    -"অসব্য মেয়েমানুষ কোথাকার, আবার শাসিয়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও রবীন, ওকে আমি দিয়ে আসি আচ্ছা করে। এত দুঃসাহস হয় কী করে ওর, পাড়ার বাস উঠিয়ে দেবনি। ছেনাল মাগী, তার আবার দিব্যি"।
    মা বেরিয়ে এসেছে রান্নাঘর থেকে, সেদিকে তাকিয়ে বাবা কানাই জেঠুকে থামায়,
    -"আঃ, কানাইদা, এসব কী ভাষা বলছ তুমি। চুপ কর, কিচ্ছু করতে হবে না। ওসব দিব্যিটিব্যিতে কিস্যু হয়না। এ বাড়িতে রাধাগোবিন্দ আছেন, আমাদের কোনো ক্ষতি হবেনা।'

    মুখে কিছু না বললেও মায়ের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। বাবা সবাইকে চুপ করাতে চাইলে কী হবে, ওদিকে লক্ষ্মীপিসী আর বাঁটুলদি সমস্বরে হায় হায় বিলাপ জুড়েছে। তাদের চিৎকারে বিরক্ত হয়ে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে খামারের দিকে যায়, পেছন পেছন কানাইজেঠু।
    ****************************************
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১২:১৫628572
  • ************************************
    ইচ্ছে হোক আর না হোক সকাল সন্ধ্যে একই সময়ে রোজ নিয়ম করে পড়তে বসতে হয়। মা শুনলে বলে
    “ছোটছেলের পড়াশোনার আবার ইচ্ছেঅনিচ্ছে কী,সেরকম হলে তো তোমার কোনোসময়েই পড়তে ইচ্ছে করবেনা। পড়তে বসতে হবে, বসলেই পড়া হবে।“
    হয়না, ভালো না লাগলে পড়া মাথায় ঢোকেনা ওর । তখন বসে বসে স্লেটে ছবি আঁকে, অথবা কাগজ ভাঁজ করে নৌকো,পাখি বানায়। মায়ের যাতে সন্দেহ না হয় তাই মাঝেমাঝে ইতিহাস বা ভুগোল যে কোনো একটা বই খুলে চিৎকার করে রিডিং পড়তে থাকে।
    এও মায়ের এক বাতিক, "জোরে পড়, যেন শুনতে পাই, এবয়সে আবার মনে মনে পড়া কী"। চেঁচানি বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল হলে ওদিক থেকে মা চিৎকার করে, "কিরে, এত শীগগির পড়া হয়ে গেল? গলা পাচ্ছিনা কেন?" তখন হয় আবার গলা তোলে নয় তো উত্তর দেয়, "অংক করছি এখন"।
    সকালের দিকে মা এত কাজে ব্যস্ত থাকে যে সেসবের থেকে বেরিয়ে ও পড়ছে কী অন্য কিছু করছে তা দেখার ফুরসত থাকেনা, তাই যা বলে মেনে নিতে হয়। তবে মা জানে তার ছেলে ফাঁকিবাজ, ইস্কুলের মাস্টাররাও তাই বলে, মাথা খুব, তবে মনোযোগ নেই। সেজন্যে সন্ধ্যেবেলা তাকে বড়জেঠুর কাছে পড়তে যেতে হয়।

    সন্ধ্যের অন্ধকার নামলে চেনা জায়গা কেমন অচেনা লাগে। বড় বড় গাছের,চারপাশের বাড়িগুলোর, লম্বা কালো কালো ছায়া সারা পাড়াটাকে বেড় দিয়ে জড়িয়ে রাখে। টর্চের বা হেরিকেনের আলোয়ও সে কালো ঘোচেনা। তখন আর একা একা বাড়ির বাইরে যেতে পারেনা, গা ছমছম করে। সবাই হাসে, এত বড় ছেলের ভয় দেখলে, বিশেষ করে মা, তবু সাহস হয়না।
    দিনদুপুরে স্কুল না থাকলে একা একা মাঠে ঘাটে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, একা ঘুরতেই তার বেশী ভালো লাগে। পাড়ায় খেলার সঙ্গী সমবয়সী কোনো ছেলে নেই। মাঝে মাঝে ডাকলে মেয়েদের পুতুল বা খেলনাবাড়ি খেলায় ঢোকে বটে তবে বেশীক্ষণ তা ভালো লাগেনা।
    একা একা বাগানে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, বাগানের গাছপালা, সেখানে বসবাসকারী কাঠবেড়ালী ইঁদুর গোসাপ সব তার বড় প্রিয়।
    মন্দিরের আরতি শেষ হলে পড়তে যায়, ছোট মাঠটার এককোণে তাদের বাড়ি, কোণাকুণি উল্টো দিকে বড়জেঠুদের বাড়ি।
    এবাড়ির সদরে একজন দাঁড়ায় আলো নিয়ে, ওবাড়ির সিঁড়িতেও আলো রাখা থাকে। "জেঠাইমা" বলে একটা জোরে ডাক দিয়েই একছুটে মাঠ পেরিয়ে ওবাড়ির চৌকাঠে। ফেরার সময়ও একই নিয়ম, "মা" বলে জোরে হেঁকে আবার সেই এক ছুট।

    বাবা যখন থাকে তখন তাদের বাড়িটা গমগম করে। সন্ধ্যেবেলা কেউ না কেউ আসে, কাজে বা এমনিই গল্প করতে। কখনো এপাড়া ওপাড়া থেকে বাবার বন্ধুরা, দীনুকাকা, কমলদাদা এরা সব এসে অনেক রাত অবধি তাসের আড্ডা বসে। সেসব দিনে ওর ভয় কম লাগে, সন্ধ্যেটা তত আর খারাপ লাগেনা। দুবেলা রান্না হয়, চা জলখাবার হয়ে অনেকখন ধরে রান্নাঘরের পাট চলে।
    যেদিন তেমন কেউ আসেনা, আসর বসেনা, সেদিন জেঠুর ওখেন থেকে ফিরলে বাবা বসে পড়া নিয়ে।
    তখন অবশ্য ব্যাপারটা খুব সুখের হয়না, বাবার ধৈর্য্য কম, একটু কিছু ভুল করলেই শুরু হয় মার। এসময় মা এসে বাঁচায়, এমনিতে মা সব সময়ে বাবার কাছে কাজলের বিরূদ্ধে নালিশ করে, কথা শোনেনা, পড়েনা, তবু বাবা মারলে মা উল্টে বাবার ওপরেই রাগ করে।
    “এই পাড়াগাঁয়ে থাকলে এরকমই হবে, ছেলেমেয়ে মানুষ হবেনা, আদাড়েবাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, ইস্কুলও সব তেমনি।“
    ব্যস, এরপর মা বাবার ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। মা কলকাতার মেয়ে, এখানে গ্রামে থাকতে মায়ের একেবারে ভালো লাগেনা, বাবা আবার গ্রাম ছাড়বেনা। মুখে বাবা বলে যে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে সংসার চালাতে অনেক খরচ, অত পারবেনা। কিন্তু কাজলের কেমন মনে হয় বাবা আসলে গ্রাম খুব ভালোবাসে। একবার তারা কলকাতায় চলে গেলে তো আর এভাবে হপ্তা মাসে বাড়ি আসা হবেনা। তখন হয়ত পাশের বাড়ির ভানুদাদাদের মত বছরে একবার, খালি পুজোর সময় আসবে ওরা, সেছাড়া সারাবছর বাড়িটা পোড়ো হয়ে পড়ে থাকবে।

    এপাড়ায় ওদের দুপাশে ছোটজেঠু আর ভানুদাদের বাড়ি, দুটোই প্রায় সারাবছর বন্ধ থাকে। ছোটজেঠু থাকে খড়গপুরে আর ভানুদারা কলকাতায়। ভানুদাদের বাড়ি মাটির দোতলা, সেখানে যত রাজ্যের পায়রার বাস। সেই পায়রা শিকার করতে নাকি ভাম আসে। প্রায়ই একটা দুটো মরা আধখাওয়া পায়রা পড়ে থাকে ওদের বাইরের দুয়ারে, সবাই বলে ভামের কীর্তি।
    কানাই জেঠু ভানু দাদাদেরও চাষী। পুজোর কিছুদিন আগে থেকে মজুর লাগিয়ে উঠোন ঘরদোর সব সাফ করায়। তখন পাড়ার সব ছোটরা, ঢোকে ওবাড়িতে, দুয়ারে খুঁটি ধরাধরি খেলে, উঠোনে কুমীরডাঙা। সারাবছর বন্ধ থাকে বলে, কৌতুহল প্রচুর সবার মনে ঐ বাড়িটাকে ঘিরে। সেসময় কাজল দেখেছে দোতলার ঘরগুলোতে বিকট গন্ধ, কালো কালো গু পড়ে থাকে, জেঠু বলে ওগুলো ভামের গু। লক্ষ্মীপিসী কিন্তু বলে আসলে ওগুলো ভাম নয়, ভুত। ভুতেরা তো নানা বেশ ধরতে পারে তো, তাই ওরা ভামের বেশ ধরে ভানুদাদের বাড়ি আসে।
    ও কখনো সচক্ষে ভাম দেখেনি, পাড়ায় কেন জানি একমাত্র ঐ বাড়িতেই ভাম আছে বা আসে। কেউ যদি কখনো ভাঙা জানালা দিয়ে বা টিনের চালে অন্ধকারে ভাম দেখে ফেলে তাহলে সেটা নিয়ে সাতদিন নানা আলোচনা গল্প চলে পাড়ায়।

    অন্ধকারে জেঠুর বাড়ি থেকে ফেরার ঐটুকু সময়ে ভুলেও ডানদিকে বা বাঁদিকে খালিবাড়ি গুলোর দিকে তাকায় না। ভানুদাদের বাড়ির ওদিকের কোণে দত্তজেঠিমার বাড়ি। দত্তরা এ পাড়ার দৌহিত্তির। সবাই দৌহিত্তির বললেও আসল কথাটা দৌহিত্র, জেঠু মানে বুঝিয়ে দিয়েছে। পাড়ায় এরকম আরো তিনঘর দৌহিত্র আছে, তাদের পদবী ওদের সবার পদবী থেকে আলাদা, তাই দিয়ে বোঝা যে ওরা দৌহিত্তির।
    প্রতিবছর দূর্গা পুজোর পরে একাদশীর দিন মিটিংয়ের নামে আটচালায় বড়দের যে চেঁচামেচি হইহই হয় খাতাপত্র নিয়ে বসে, তা নাকি আসলে সারাবছরের হিসেবপত্র বোঝার পালা।
    সেখানে বসে রাধাগোবিন্দের এস্টেটের সেক্রেটারী, ক্যাশিয়ার নিয়োগ করা হয় সবার মত নিয়ে, এছাড়াও পাড়ার নানা সমস্যা, সারাবছরের জমি পুকুর নিয়ে বিবাদ ইত্যাদি থাকলে তার মীমাংসা, এসব হয়। ছোটরা অনেকে একটু দুরে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে মিটিং শোনে, বড়দের ঝগড়া দেখাটা কম মজার নাকি!
    কাজলের বারন আছে, বড়দের আসরের ধারেকাছে দেখলে বাবা রেগে যাবে বলে ইচ্ছে থাকলেও ওদিক ঘেঁসে না।
    তবে পরদিন থেকে কিছুকাল অবধি হাটে মাঠে সর্বত্র মিটিংয়ে কী কী কথা হয়েছে সেসব নিয়ে গালগল্প চলে পাড়ায়, তাই কারোর কিছু জানতে শুনতে বাকী থাকেনা। মিটিংয়ে প্রতিবছরই দুই সরকার বাড়ির ছেলেরা এসে খুব রাগ রাগ করে বলে তারা দৌহিত্তির বলে পুজোয় তাদের নামে সংকল্প হয় না, বাড়ির এই নিয়ম বদলাতে হবে, নাহলে পরের বছর থেকে তারা আর পুজোতে থাকবেনা।
    প্রত্যেক বার দুই দল হয়ে যায় এই নিয়ে, পক্ষে বিপক্ষে। তবে মীমাংসা আজ অবধি মুলতুবি আছে। অনেকে বলে, সরকারদের বয়স্করাই নাকি এতে মত দেয়না। রায়েদের মন্দিরে অন্যের নামে সংকল্প আজ অবধি কখনো হয়নি, হলে কী হবে কেউ জানেনা, অনর্থও হতে পারে। ভয়ে দৌহিত্ররা নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত।

    দত্ত জেঠিমার ছেলে হারুদা শহরে চাকরি করে, সম্পর্কে বাবার ভাইপো হলেও আসলে বাবার থেকে বয়সে বড়। হারুদার মেয়ে কাজলের থেকে অনেক বড়, কিন্তু তার ভাইঝি হয়। অত বড় মেয়েকে কি নাম ধরে ডাকবে?
    মা এরকম ক্ষেত্রে সম্পর্কটা উল্টে নিয়ে ডাকতে শিখিয়েছে। কৃষ্ণাপিসী কলেজে পড়ত, ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝেমাঝে তাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসে, তখন কতদুর পড়েছে জিজ্ঞেস করলে বলে বিএ ফেল। কাজল ভেবে পায়না কীকরে ওরকম সবার সামনে ফেল করার কথা বলে। মজাও বেশ, ফেল করেছে তবু কেউ কিছু বলেনা!
    দত্ত জেঠিমা তো খুব বুড়ি হয়ে গেছে, বাড়ি থাকলে সবসময় ছেলের বৌ আর নাতনীর সঙ্গে ঝগড়া হয় তার। বেশীরভাগ সময় তাই একটা খুঁতো পা কে টেনে টেনে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায়। জেঠিমা বলে এপাড়ায় নাকি অনেক ভুত আছে। মাকে এসে প্রায়ই বলে, “তোর শাশুড়ীকে দেখলাম পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছিল। রবীনকে বল গয়ায় যাক, একবার পিন্ডিটা দিয়ে আসুক।“ মা শুনে যায়, বাবাকে কিছু বলেনা, শুধু তাকে একদিন বলে দিয়েছিল যে এসব গল্পে যেন কান না দেয়, ভুত বলে আসলে কিছু নেই।

    কাজল শুনতে চায়না তবু কানে এসে যায়। সে তার ঠাকুমা দাদু কাউকে দেখেনি। বন্ধুদের অনেকের ঠাকুমা দাদু আছে, জেঠা কাকা পিসী অনেকে আছে বাড়িতে। তাদের বাড়িতে কেউ নেই। পাড়ায় অনেক লোক আছে, কিন্তু সব জ্ঞাতি, বাবার দুর সম্পর্কের, নিজের নয়। বড়জেঠু ছোটজেঠুরা অবশ্য একদম নিজেদের মত, সবাই তাদের ভালোবাসে, তবু কেউ বাড়িতে তো আর থাকেনা।
    বড়জেঠুর বাড়িতে কত লোক, রোজ দুবেলা দুটো দুয়ার ভরে লম্বা শতরঞ্চি পেতে খাবার জায়গা হয়, নেমন্তন্ন বাড়ির মত। কাজলদের বাড়িতে বাবা না থাকলে ভালো আসনও পাতা হয় না। সকালে ভাত খাওয়ার সময় লক্ষ্মীপিসী ওকে একটা খেজুর চাটাইয়ের আসন পেতে দেয়। সকড়ি করে ফেলে বলে রোজ ধুতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। খুব সাবধানে খেলেও কেমন করে একটা ভাত বা একটু কিছু আসনে লাগবেই।
    রাতেরবেলা রুটি আর নিরিমিষ তরকারী বলে সেটুকুও নেই। বাবা না থাকলে, পড়ে বাড়ি ফিরলে মা ওদের খাবার আর কোলের ছোট ভাইয়ের দুধ নিয়ে সন্ধ্যে থেকেই নতুন বাড়ির ওপরে উঠে যায় চারিদিক বন্ধ করে। ওপরের বারান্দায় একদিকটা ঘিরে একটু জায়গা করা আছে, রাতে বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে সেখানেই যায়, বারান্দা পুরো গ্রীল দিয়ে ঘেরা।
    ঘরে একটা ছোট স্টোভ রাখা আছে, তরকারী বা ভাইয়ের দুধ গরম করার জন্যে। রেডিও চলে, মা ওদের একটু পড়ায়, বিশেষ করে বোনকে, সে সামনের বছর ইস্কুলে যাবে।
    সবাই বলে মায়ের খুব সাহস, একা একেটেরে বাড়িতে তিনটে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে থাকে। মাকে কেউ বললে মা অবশ্য সাহসের কথা স্বীকার করেনা, বলে উপায় নেই তাই। নিজের অদৃষ্টকে দোষ দেয়, কোথাকার মেয়ে কোথায় এসে আছে। ঝগড়ার সময় বা খুব রাগ হলে মা মামাবাড়ির দাদুর কথা বলে কাঁদে, পণ দিতে হবেনা বলে এরকম একটা গ্রামে, কেউ কোথাও নেই পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে।

    ওপরের ঘরে দুটো জানলা, একটা ভেতরে উঠোনের দিকে আর অন্যটা বাইরে মাঠের দিকে।শুতে যাবার আগে মা ভালো করে দুটো জানালা দিয়ে ঘর বার দেখে তারপর বন্ধ করে। গরমের দিনে ভয় বিশেষ নেই, তখন চারিদিকে সবার জানালা খোলা,অনেক বাড়ির ছেলেরা গরমের চোটে বাইরে দুয়ারে মাদুর পেতে শোয়, ডাকলেই সাড়া পাওয়া যায়। ভয়, মা বলে বর্ষায় আর শীতে বেশী।
    *****************************
  • kumu | 133.63.***.*** | ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:০১628573
  • কদ্দিন পর সোনারোদে পিঠ দিয়ে শ্রাবণীর লেখা।
    বেঁচে থাকার জন্য আর কিছু লাগে না
  • nina | 78.37.***.*** | ২০ জানুয়ারি ২০১৪ ০৪:১৮628574
  • আহা সত্যি কুমু হক কথা কইলে গো!
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:৩৪628575
  • ************************************************
    ধান উঠেছে, গাদা করে রাখা আছে খামারে। বাবা ছুটি নিয়ে এসেছে ধান ঝাড়াইয়ের জন্যে, ধান ঝাড়িয়ে তবে ফিরবে। তাদের গাদা বেশী নয়, ছোট খামারেই ধরে যায়। জেঠুদের অনেকগুলো ধানের গাদা, বাড়ির পেছনের খামারে ধরেনা বলে সামনের মাঠের অর্ধেকটায় রাখা থাকে। খেলার জায়গা অনেক কমে যায় তাই এই শীতকালে।
    কাজলের ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু সঙ্গী নেই। ইস্কুলে টিফিনে যখনি সুযোগ পায় বল পেটায়। পাড়ায় সঙ্গী কেউ নেই, ছেলেরা হয় সব ক্ষুদে, নয় মন্টুদাদের মত বড়। বড়রা কেউ পাড়ায় খেলেনা, বিকেলে প্রাইমারী ইস্কুলের মাঠে খেলা হয়, সেখানে যায়। কাজলকে সেখানে খেলতে নেয় না, ছোট বলে।
    ছোট যারা, তারা সব নিজের নিজের পাড়ায় খেলে। ওর সঙ্গে পড়ে মাইতিপাড়ার দেবু, অনেকবার ডেকেছে খেলতে তাদের পাড়ায়, কিন্তু মা যেতে দেয়না একা একা। মাইতিপাড়া যেতে গেলে পদ্মপুকুরেরে পাড় দিয়ে যেতে হয়, তাই মায়ের ভয়। পদ্মপুকুর খুব বড় আর গভীর, বছরে একবার কেউ না কেউ ডুবে যায় তাতে। তখন খুব হইহই হয়, সবাই ডোবা তোলা দেখতে দৌড়য়।
    দেবুদের আবার বল নেই, তাই ওরা কাগজ আর টুন দড়ি দিয়ে বল বানায়,সে বল বেশীক্ষণ পেটানো যায়না, একদিনেই তার দফা গয়া হয়ে যায়। বাতাবির দিনে বাতাবি দিয়ে খেলে। কাজলের বল আছে, বাবা এনে দিয়েছে কলকাতা থেকে। তাই ওকে খেলতে ডাকায় দেবুর আগ্রহ বেশী।
    মাঝে মাঝে ভাবে মাকে লুকিয়ে চলে যাবে, কিন্তু গাঁঘরের ব্যাপার, কেউ না কেউ ঠিক দেখতে পেয়ে বলে দেবে।

    সেবারে বাচ্চুদের সাথে সাতগাছির রায়বাড়ীর চব্বিশপহরে চলে গিয়েছিল মাকে না বলে। খাবার ইচ্ছে ছিলনা কিন্তু বাচ্চু বলল যে ওখানের বীচেকলার তরকারীটা নাকি দারুন খেতে হয়। ও কোনোদিন খায়নি বীচেকলার তরকারি, বাচ্চু যেখানেই চব্বিশ পহর হয় যায়, তাই অভিজ্ঞতা অনেক, বলছে যখন সত্যিই হবে।
    পংক্তিতে বসেছে, এমন সময় রায়বাড়ীর কে চিনতে পেরে যায় বাবার ছেলে বলে। ওরা যে কাজলদের এই রায়বাড়ির কিসব সম্পর্কে আত্মীয় হয়, তা আর কে জানত! তারপরে সে কী কান্ড, হাঁকডাক করে কে যেন ওকে বাচ্চুদের ওখান থেকে তুলে দিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসলো, সেখানে মহিলারা খুব যত্ন করে থালায় খাবার বেড়ে দিল। ওর ভালো লাগেনি, কোথায় বাচ্চুদের সঙ্গে হইহই মজা করে খেতে বসার আনন্দ আর কোথায় একলা অচেনা ঘরে অচেনা দৃষ্টির সম্মুখে একরাশ অস্বস্তির মাঝে। অনেক কিছু ছিল, কোনটা বীচেকলার তরকারি বুঝতে পারেনি, জিজ্ঞেস করতেও পারেনি। খিদে ছিলনা, তাই অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়ে। এরপর ওরা একজনকে সঙ্গে দিয়ে প্রসাদ মিষ্টি সহ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
    লোকটি এসে মাকে কী বলে, মা প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। হপ্তান্তে বাবা এসে সব শুনে খুব রেগে যায়, মাকে না জানিয়ে বাচ্চুদের সাথে গেছে বলে, মারও পড়ে, তবে সেসময় জেঠু ছিল বলে অল্পের ওপর দিয়ে যায়। মা তার পরেও অনেকদিন গজগজ করত এ নিয়ে, এতবড় ছেলের এতটুকু বুদ্ধি নেই, ভদ্দরবাড়ির ছেলে হয়ে কাঙালীভোজনে গিয়ে বসে গেছে।
    মানে জানে তবুও সন্ধ্যেয় জেঠুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কাঙালী মানে কী। বাচ্চুরা তার মানে কি গরীব? ওরা তো চব্বিশপহরে গিয়ে ওরকম সবার সাথে বসে খেয়ে আসে নিয়মিত!

    কাঙালী মানে গরীব হলেও, সব কাঙাল কিন্তু মোটেই গরীব নয়। ময়রাপাড়ার কাঙালজেঠুই তো বরং তাদের থেকেও বড়লোক, দুখানা মিষ্টির দোকান। মাঝে মাঝে বাবার কাছে আসে জেঠু। বাড়িতে কেউ এলে, বাজারপাড়ার দোকানে রসগোল্লা কিনতে গেলে, জেঠু দোকানে থাকলে কাজলকে দুটো চিনির শুঁটি খেতে দেয়, ফাউ। কাজলের অবশ্য চিনির শুঁটি তত ভালো লাগেনা, গুড়ের শুঁটিভাজা বেশী ভালো লাগে। মা এমনিতে তাকে শুঁটিভাজা খেতে পয়সা দেয়না, কিছু খেতেই দেয়না। ছোট ছেলেদের হাতে নাকি পয়সা দিতে নেই। কলকাতা থেকে মামাবাড়ির কেউ এলে তখন গুড়ের শুঁটি আনানো হয়, কলকাতায় এ জিনিস পাওয়া যায়না। মামাবাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে শুঁটিভাজা, ওরা বলে কাঠিভাজা। তখন মায়ের দরাজ মেজাজ, কত কী রান্না হয় বাড়িতে, মিষ্টি আসে রোজ, চপ ফুলুরি!

    শীতের দুপুর কাটতে না কাটতেই গাঁয়ে সন্ধ্যে নেমে যায়, ঝুপ করে। যতক্ষন রোদ থাকে ততক্ষন কেমন খুশী খুশী চারধার, সকাল থেকে দুপুর, রোদে বাইরে বাইরে কাটে, সবার সব কাজকর্ম ছোট মাঠটাতে। ধানের গাদা বাদ দিয়ে যতখানি জায়গা পড়ে থাকে, সেখানে যেন মেলা বসে যায়, উৎসব উৎসব লাগে।
    পাতা চাটাই মাদুরের ওপর পড়ার বই খাতা, একটু বেলা হলে তার ওপরেই খুলে রাখা চাদর সোয়েটারের স্তুপ, রোদে ভাজা হয়, বেলা পড়লে সেখান থেকেই তুলে নিয়ে আবার গায়ে তোলা। বড়ি আচার ডাল শুকোচ্ছে, কোনদিন বড়ির বিয়ের প্রসাদও জুটে যায় কচিকাঁচাদের, কপাল ভালো থাকলে।
    কিন্তু অন্ধকার হলেই কেমন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, দরজা জানালা আঁটা সব ঘরের, সাড়া শব্দ পাওয়া যায়না, সবাইকে সাথে নিয়ে কেমন যেন এক একজনের একা হয়ে যাওয়া।

    গরমের দিনে আবার ঠিক উল্টো, দিনের বেলায় রোদের তাতে সব ঘরে ঢুকে বসে থাকে, সন্ধ্যে রাত্তিরে বাইরে হাওয়ায়, খোলা মাঠে লোকের ভিড়, রাত দুপুর অবধি। কেউ কেউ রাতভর শুয়ে থাকে বাইরে দালানে, মাঠে।
    এই শীতে খাওয়াদাওয়ার পরে মায়েদের তাসের আসর বসে ভানুদাদের দুয়ারে, মহিলারা এসে জোটে সব। খেলুড়ে চারজন, হাতে উলবোনা বা আসনের চটে ফোঁড় ওঠাতে ওঠাতে বাকীরা গল্পে মশগুল। মোটকথা এসময় দুপুরে কেউই ঘুমোয় না, খুব বয়স্ক বা কোলের ছেলে অথবা অসুস্থরা ছাড়া। খেলতে খেলতেই মার নজর তীক্ষ্ণ, ছেলে গাদায় উঠছে কিনা বা মাঠ ছেড়ে পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছে কিনা।
    বোন মায়ের চর, ছোট বলে লুকোচুরি খেলাতে নেওয়া হয় না। দলে কাজলই এই সবে বছর দুয়েক হল ঢুকেছে, তার আগে অবধি দুধেভাতে ছিল। তাদের পাড়াতে মেয়ে বেশী, দিদিরা সব দলের পান্ডা, দাপট খুব, নিয়মের খুব কড়াকড়ি।
    বোন পুতুলকে শাড়ি পরাতে পরাতে মাঝে মাঝে মার পাশে গিয়ে বসে আবার কখনো মাঠে নেমে গুটিগুটি কাজল কোথায় যাচ্ছে দেখে আসে।

    ধান ঝাড়া শেষ হয়ে বাবা চলে গেছে আজ দুদিন হল। শীতটা এখন আর তেমন গায়ে লাগেনা, পড়তির দিকে। ধানের গাদা উঠে গিয়ে বাগানে মাঠে শুধু খড়ের গাদা। কদিন পাড়াটা খুব সরগরম ছিল, খালি বাড়ি গুলোয় ধান ঝাড়াতে লোক এসেছিল, ভানুদাদারা, ছোটজেঠুরা। ভানুদার বড় ছেলে বিলু ওর থেকে এক বছরের ছোট, এখানে এলে কাজলের সঙ্গী হয়। বিলু একটু রুগ্ন ধরণের, ফুটবল খেলেনা, দৌড়ঝাঁপ করে কোনো খেলাই পছন্দ করেনা। লুডো, চাইনিজ চেকার, ক্যারম খেলা হয়। বিলু তাসের অনেক খেলা জানে, সেসব খেলতে মন চায় কিন্তু মা ছোটদের তাস খেলা পছন্দ করেনা, লুকিয়ে খেললে কী করে যেন ধরা পড়েই যায়, তখন বকুনি জোটে।
    তাই বিলু জোর করলেও তাস খেলেনা কখনো। মকর, পৌষ সংক্রান্তি,সব হই হই করে কাটল, বাবা একটানা অনেকদিন ছিল এবারে। এরকম আবার হয় পুজোর সময়, কিন্তু সেতো এখনো বেশ দেরী আছে, কত পরীক্ষার সমুদ্দুর পেরিয়ে তবে সেই আনন্দ সাগর আসবে!

    পাড়া ফাঁকা, আর কদিন বাদেই ইস্কুল খুলে যাবে, পড়াশোনার পালা শুরু, মন ভালো নেই। ক্লাস থ্রি হল, নিজেকে বেশ বড় বড় লাগছে, সামনের বছর বৃত্তি। কী করে যেন রেজাল্ট এবার খুব ভালো হয়েছে, সেকেন্ড। ফার্স্ট এবারেও পালেদের মধু হয়েছে, তবু অঙ্কে সেই একমাত্র একশতে একশ।
    বাবার সঙ্গে হাটে হেডমাস্টারমশাইয়ের দেখা হয়েছিল, বাবা মাকে বলছিল রাতে। ও ঘুমের ভান করে পড়েছিল, শুনেছে। মাস্টারমশাই বাবাকে বলেছে, আর একটু মন দিলে ওই ফার্স্ট হত, আপনার ছেলের মাথা খুব ভালো, তবে ছটফটে। ভালো করে প্রশ্ন পড়ে উত্তর করেনা, প্রশ্ন ছেড়ে আসে।
    বাবাকে খুশী মনে হলেও মার মনের ভাব ঠিক বোঝা যায়না। গুম হয়ে সেই এক কথা বলে যায়, এখানে থাকলে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে ছেলে মানুষ হবেনা। এখন ছোট ক্লাস ঠিক আছে, এরপরে পড়ার চাপ আরো বাড়লে এ ছেলেকে নিয়ে ভোগান্তি আছে।
    বাবা তাই মাস্টারের কথাটা একটু আমতা আমতা করেই জানায়। উনি বলেছেন, কাজল অনায়াসে বৃত্তি পাবার মত ছেলে, গাঁয়ের ইস্কুল থেকে কেউ কখনো বৃত্তি পায়নি, তাই এবার মাস্টাররা মিলে যেসব ছেলে ভালো, তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখবে ঠিক করেছে। বাবাকে অনুরোধ করেছে অন্তত ক্লাস ফোর অবধি যেন কাজলকে গাঁয়ে রাখে, শহরে নিয়ে না যায়। মা একথার উত্তরে কী বলেছিল শোনার আগেই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
    কদিন ডামাডোলে পড়া বন্ধ ছিল, এখন আবার মা সন্ধ্যেয় জেঠুর কাছে পাঠাচ্ছে। বুকলিস্ট দেয়নি এখনো, মনিদির বই চেয়ে নিয়ে এসে সেগুলো থেকে পড়ছে। মা জোর করে বলে বই আনতেই হয়, নাহলে সেরকম কোনো তাড়া ছিলনা। অবশ্য পড়া তেমন হয় না, জেঠুও এখন জোর করেনা, সরস্বতী পুজো অবধি এমনিই চলবে। অঙ্ক জেঠু খুব ভালো করায়, দু চারটে অঙ্ক করিয়ে, গল্প বলে, রামায়ণ মহাভারতের। ব্লক অফিসের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে আজকাল জেঠু সারাদিন চাষবাস আর বই নিয়ে থাকে।
    বাড়িতেও তেমন চাপ নেই এখন, সকালে পড়তে বসতে হয় নিয়ম ধরে, তবে মা অত খেয়াল করেনা। একবার নম নম করে বই ছুঁয়ে নিলেই হয়ে যায়। এবারে আবার বোন ইস্কুলে ভর্তি হবে, তার সঙ্গেই, প্রাইমারী ইস্কুলের ক্লাস ওয়ানে যাবে। ইস্কুল খুললে জেঠু নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে। মা তাই বোনকে নিয়ে ব্যস্ত, মৌখিক পরীক্ষা হবে। যদিও ইস্কুলে সবাইকে পাস করিয়ে দেয় তবু একটা সম্মানের ব্যাপার আছে, ফেল করলে সবাই কথা বলে যদি!

    লক্ষীপিসী দুয়ারে থামে হেলান দিয়ে বসে ঢুলছিল, কাজলকে ঘরে ঢুকিয়ে হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে মা ডাকে,
    “এই লক্ষীদি, ওঠ, বাড়ি যা।“ধরমর করে উঠে বসে পিসী, “কী হল কী হল” । মা খিড়কি দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,
    “কিছু হয়নি, কাজলা এসে গেছে। তুই সব গুছিয়ে নে, আর রাত করিসনি।“
    গুছিয়ে নেওয়া মানে পিসীর রাতের খাবার, রুটি তরকারী। মা ঘুরছে চারদিকে, পিসী থাকতে থাকতে সব ভালো করে দেখে নিচ্ছে, বাথরুম, হামারের পিছন, কোথাও কেউ ঢুকে বসে আছে কিনা, রোজই দেখে। এরপর পিসী গেলে সদর দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে, খাবার আর কাজলকে নিয়ে ওপরে উঠে যাবে সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে। ভাই আর বোনকে আগেই ওপরে রেখে এসেছে।
    লক্ষীপিসীর বাড়ি দুলে পাড়ায়, এখন মাঠে ধান নেই, মাঠের রাস্তা দিয়ে যাবে, কাছে হয়। অন্যসময় বাজারপাড়া দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। কাজল পিসীর পিছন পিছন রান্নাঘরে গেল, পিসী রুটি তরকারী গুছোচ্ছে, তাদের টা একদিকে, নিজেরটা আরেকদিকে।
    “পিসী, তুমি ওই টা কী নিলে, আমাদের দিলেনা?”
    মা এসে পড়েছে, পিসী আর মা দুজনেই হাসে।
    -“ও তুই খেতে পারবিনি গোপাল, আলুর খোসা ভাজা।“

    পিসী, কানাইজেঠু, বাঁটুলদি, এরা সবাই ওকে গোপাল বলে ডাকে। খুব বিচ্ছিরি লাগে, কিন্তু মা বলে কিছু বলতে নেই, আদরের ডাক। এমনি কাজল নামটাও ভালো লাগেনা, বোস বাড়িতে একজন কাজল দিদি আছে, হাইস্কুলে পড়ে। সকালে ভানুদাদাদের সদরে বিল্টুকাকা নাইন টেনের ছাত্র ছাত্রী দের অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ায়, কাকার খুব নাম। সারা গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে কাকার কাছে, কাজল দিদিও আসে। ওকে দেখলেই কাজল দিদি আর তার বন্ধুরা “এই তো আর এক কাজল এসে গেছে” বলে গাল টিপে দেয় আর হাসে।
    ইস্কুলেও অনেকে বলে নামটা নাকি মেয়েদের নাম, তবে বিলু বলেছে, কাজল ছেলেদেরও নাম হয়, কলকাতায়। বিলু এখানকার সবার থেকে অনেক বেশী জানে, কলকাতার ইস্কুলের গল্প শুনলে কেমন স্বপ্নের মত লাগে। এমনিতে ওর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে নেই। মামাবাড়িতে গেলে কেমন হারিয়ে যায় মনে হয়। বড় বড় বাড়ি, রাস্তা, এত লোকজন, খেই পায়না, বিশেষ করে রাস্তা পেরোতে খুব ভয় লাগে, বাসে উঠতেও। তবু বিলুর গল্প শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় ওরকম একটা ইস্কুলে পড়লে মন্দ হত না, বড় খেলার মাঠ, কত খেলার সরঞ্জাম।

    খোসা ভাজা পিসী মাঝে মাঝেই করে নিয়ে যায়, লঙ্কা বাটা দিয়ে পোস্ত ছড়িয়ে, করকরে করে ভাজা। লাউ , কুমড়ো, দেখে দারুন লাগে। আজ ওর খেতে ইচ্ছে করল, বায়না করল।
    “একটু দাওনা, খেয়ে দেখি” । পিসী দিতে চাইছিল, মা চোখ দিয়ে না করল, পিসী হাত গুটিয়ে নেয়।
    “ছিঃ, ওরকম চায় না। পিসী ঝাল দিয়েছে খুব, তুমি খেতে পারবেনা, নিয়ে নষ্ট করবে।“
    এটা অবশ্য মা ভুল বলেনি, পিসী খুব ঝাল খায়। রোজ তাদের তরকারী তুলে রেখে নিজেরটাতে লঙ্কা ঢেলে দেয়। মুড়ি খায় গাছের ঝাল লঙ্কা কামড়ে।
    তুলসী মঞ্চে বেদীর ওপরে পিসীর লন্ঠনটা রাখা ছিল, শিস বাড়িয়ে এক হাতে ঝুলিয়ে অন্য হাতে খাবারের পুঁটলি নিয়ে পিসী দরজার দিকে এগোয়, সঙ্গে মা হেরিকেন হাতে, পেছনে সে। পিসী বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এদিক থেকে মার তালা দেওয়া শেষ হলে, একবার আওয়াজ দিয়ে যায়। সেই আওয়াজে ওদিক থেকে জেঠুর বাড়ি, দত্ত জেঠিমারা, বাঁ কোনে বিল্টু কাকীমারাও বুঝতে পারে লক্ষীপিসী চলল। কখনো তারাও কেউ পাল্টা আওয়াজ দেয়,
    “হয়ে গেল, লক্ষী?” জেঠুদের চাষী সত্য দোলুইয়ের বাড়িও পিসীদের পাড়ায়। কোনদিন সন্ধ্যেয় জেঠুর কাছে কোনো কাজে এলে, পিসিকে হাঁক দেয়,
    “দিদি, যাবে নাকি গো? হয়ে গেলে বোলো।“
    মা তখন তাড়াহুড়ো করে পিসিকে আগে আগে পাঠিয়ে দেয় সত্যকাকার সাথে। একা একা অন্ধকারে বাড়ি যায় পিসী, মায়ের খুব খারাপ লাগে। কিন্তু পিসী কিছুতেই রাতে থাকবেনা, ঘরে ছেলে নাতি আছে, সারাদিনে তাদের দেখেনা। তাই মাও আর জোর করেনা।
  • Sibu | 84.125.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৩৯628576
  • চব্বিশপহর কি? তিনদিন ধরে নামসংকীর্তন?
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:৫২628577
  • শিবুদা, হ্যাঁ, প্রতিদিন অষ্টপ্রহর, তিনদিন!
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:০০628578
  • ভাই এখন অল্প অল্প হামাগুড়ি দিচ্ছে। মা হেরিকেনকে টেবিলের ওপর তুলে রেখেছে, বারান্দার দরজা বন্ধ। বোনটা এমনিতে শান্ত, ভাই বরং দস্যি। ও আর মা যখন ওপরে পৌঁছল, তখন ভাইকে সামলাতে গিয়ে বোন কাঁদকাঁদ। ভাই তার বই খাচ্ছে, বাঁধা চুল খুলে দিয়েছে। মা বোনকে নিয়ে আবার নীচে গেল বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। কাজল বিছানায় উঠে গেল, মেঝেয় মাদুরে বসলে ভাই বিরক্ত করবে। ওকে দেখলে ভাই আরো উৎসাহী হয়ে পড়ে।
    মা এসে বারান্দা দেখে নিয়ে সব বন্ধঝ্ন্দ করে বোনকে পড়াতে বসল, ভাইকে কায়দা করে কোলে চেপে ধরেছে, তার প্রিয় খেলনা বুড়ো দিয়ে। কাজল একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে, দেশবিদেশের রুপকথা , বাবা এনে দিয়েছে এবার। এই কদিন, দুপুর রাতে একটু গল্পের বই পড়া যায়, মা বারন করেনা। এমনিতে মায়ের সব ঘড়ি ধরা, নড়চড় হবার জো নেই। আটটা অবধি পড়িয়ে ওদের খেতে দেবে আর নিজে রেডিও তে নাটক শুনবে। শুনতে শুনতে ভাইকে দুধ খাওয়াবে। নাটক শেষ হলে ভাইকে ঘুম পাড়াবে, ভাই ঘুমোলেই বিছানা ঝেড়ে, মশারি টাঙিয়ে তাদেরও তুলে দেয়। নিজে তার পরেও মাদুরে বসে হয় গল্পের বই পড়ে নয় চিঠি লেখে, রেডিওটাকে কানের কাছে নিয়ে।

    কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানেনা, ভাঙল মায়ের ডাকে। ডাকটাও কেমন অদ্ভুত, ক্ষীন একটা আওয়াজ, যেন দূর কোথা থেকে ভেসে আসছে, “কাজল, বাবুসোনা”।
    ও তখন একটা ম্যাজিক কার্পেটে বসে মামাবাড়ির ছাদে নামছে, সানুমামা, ঝন্টু মিমিরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, সেইসময় মায়ের ডাক শুনতে পেল। প্রথমে চোখ খোলেনা, আওয়াজ একটু জোরে হওয়ার সাথে কপালে মায়ের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ, ধরপড় করে উঠে বসে, “মা আ আ”।
    -“চুপ, চুপ, একদম আওয়াজ করবিনা।“ কপালের হাত এবার মুখ চেপে ধরে।
    কিছু বুঝতে পারেনা, ও রোজ খুব স্বপ্ন দেখে, ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষন সেসব মনে রয়ে যায়। ইস্কুলে মিত্তিরদের তাতুন ওর পাশে বসে, পিরিয়ডের ফাঁকে ফাঁকে তাতুনকে সেসব গল্প শোনায়। তাতুন একটু ভীতু ছেলে, মাথাও তেমন পরিস্কার নয়, তাই রফিক মাস্টার তাতুনকে ওর পাশে বসিয়েছে।
    ওদের ক্লাসে এরকম নিয়ম, পড়াশোনায় যারা ভালো তাদের পাশে যারা দুর্বল তাদের বসানো, দুষ্টুদের পাশে শান্তদের বসানো। স্বপ্নের গল্প, তাতুন হাঁ করে শোনে, যেদিন গল্প থাকেনা, সেদিন খুব হতাশ হয়।
    প্রথমে ভাবল এও বুঝি স্বপ্ন, খাটের ধারে দেওয়াল ঘেঁসে ভাইয়ের বিছানা, পাশে মা, বোন, একেবারে ধারে ও। বাবা থাকলে মেঝেতে বিছানা হয়ে বাবা আর কাজল মেঝেতে শোয়। মা মশারি গুঁজে দুটো মোটা পাশবালিশ দিয়ে রাখে ধারে, যাতে ও পড়ে না যায়। বোন আর ভাই ঘুমিয়ে আছে, মা বিছানায় উঠে বসে আছে।

    নিজেকে একটা রাম চিমটি কেটে নিজেই উহু উহু করে উঠে বসল। ওকে বসতে দেখে, মা পায়ের দিক দিয়ে সবাইকে ডিঙিয়ে মশারি তুলে নামতে নামতে বলল,
    -“চুপ করে থাক, মনে হচ্ছে বাড়িতে চোর ঢুকেছে।“
    শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, “চোর”! চোর মানে সেই লোকটা যে একবার রাত্তিরে মনিদিদের বাড়ি ঢুকে উঠোনে রাখা বাসনগুলো নিয়ে সব বস্তায় পুরে বেরোবার মুখে ধরা পড়ে গেসল ভুলোর চ্যাঁচানিতে লোক উঠে পড়ায়?
    ভুলো কুকুর সেদিন মনিদিদের বাড়ির ক্যাঁদালে শুয়ে ছিল। ভুলো পাড়ার পোষা নেড়ি, অবশ্য দিদিরা মজা করে বলে আসলে ভুলোরই পোষা এই পাড়া। এক এক দিন এক এক বাড়িতে খায় চক্রাকারে, এবং সেদিন সেই বাড়ির আশেপাশে পাহারা দেয়। অদ্ভুত ভাবে কখনো পর পর একই বাড়িতে খায় না, ডাকলেও না, এক চক্করে সব বাড়ির পালা হয়ে গেলে আবার প্রথম থেকে শুরু করে।
    বিল্টুকাকা বলে ভুলোর এত বুদ্ধি যে মানুষ হলে নির্ঘাত ক্লাসে ফার্স্ট হত, রোজ সকালে কাকা যখন ব্যাচ পড়ায় তখন ভুলো দরজায় বসে সবার জুতো পাহারা দেয়। দু চারটে বেপাড়ার কুকুর মাঝে মাঝে এপাড়ায় ঢোকে, তাদের কারুর আবার জুতো চেবানোর বাই আছে। ভুলো এমনি কুকুররা এলে আপত্তি করেনা, তাদের সঙ্গে দলে মিশে গাল গল্প, ঘোরাফেরা, ঝগড়া সবই করে কিন্তু তারা কারোর ঘরে ঢুকতে গেলে ভুলো ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যায়, ভাব টাব ভুলে।

    চোরটাকে মনিদিদের রাখাল ধরেছিল প্রথমে। কাঠের ঘরে শুয়েছিল, ভুলোর ডাক শুনে ঘুম ভাঙে তারই প্রথম। চোরটা খিড়কি দিকের দেওয়ালে সিঁদ কেটে ঢুকেছিল। বেরোবার সময় বোধায় সিঁদ ছোট বলে বস্তা ভর্তি বাসন নিয়ে খিড়কি দরজা খুলে বেরোতে গেছে, সেখানে ভুলো ছিল। ভুলো চেঁচাতেই চোর দৌড় দিয়েছিল কিন্ত কাঁধে ভারী কাঁসা পেতলের বাসন ভরা থলে, জোরে দৌড়তে পারেনি। সদর পুকুর অবধি যেতে না যেতে লোকেরা পিছু নিয়ে ধরে ফেলেছিল।

    সকালে উঠে কাজল বাঁটুলদির সঙ্গে চোর দেখতে গিয়েছিল। একদম রোগাভোগা, আটচালায় খুঁটিতে বাঁধা ছিল, লম্বা চওড়া, ইয়া বড় গালপাট্টা, যেমন বইয়েতে লেখা থাকে, সেরকম একদমই নয়। কাজল দেখেনি তবে সবাই বলছিল পাড়ার ষন্ডাগুন্ডা যত আছে, হোঁদলদা, বিশুদা, পল্টনকাকা, সবাই চোরটাকে মেরে হাতের সুখ করেছে।
    ও যখন দেখতে গেসল তখন সেসব মিটে গিয়ে চোরটাকে চা মুড়ি দেওয়া হয়েছে।
    সবাই জটলা করছিল, পুলিশ আসবে, চোর নিয়ে যাবে, অপেক্ষায় সব। কাজলের খুব দারোগা পুলিশ দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু লক্ষীপিসী এসে ডেকে নিয়ে গেল, মা ডাকছে, ইস্কুল যেতে হবে। মনিদিদের বাড়ির কেউ সেদিন ইস্কুল যায়নি, বাড়িতে চুরি হয়েছে বলে কথা। কাজলের খুব দুঃখ হয়েছিল, চুরিটা ওদের বাড়ি কেন যে হলনা, তাহলে ওকেও ইস্কুল যেতে হতনা।
    তবে তখন কাজল ছোট ছিল তাই এমনটা ভেবেছিল, এখন মনে হয় চুরি হয়নি ভালোই হয়েছে। চোর ধরা না পড়লে কত লোকসান হত। আসলে ধরা পড়লেও বোধহয় ভালো লাগতনা, সেদিন আটচালায় বাঁধা চোর দেখে একটুও ভালো লাগেনি, কেমন গোবেচারা অসহায় লাগছিল, চুপ করে বসেছিল মাটির দিকে তাকিয়ে, চা মুড়ি রাখা সামনে, কিন্তু খাচ্ছিল না!

    -“মা, সেই চোরটা আবার এসেছে? মনিদিদের বাড়ির চোরটা? পুলিশ ওকে জেলে দেয়নি, ছেড়ে দিয়েছে?”
    ফিসফিস করে জানতে চায়। মা তখন উঠোনের দিকের জানালার পাল্লাটা অল্প করে খুলে কী দেখছে। কথার উত্তর না দিয়ে ঠোঁটের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে ওকে চুপ করতে বলে।
    জানালাটা ভেজিয়ে এবার মশারি তুলে ওকে বাইরে আসতে বলে,
    -“মা সেই চোরটা?”
    -“জানিনা কোন চোর। আমি কোত্থেকে চোরেদের খবর জানব? ভালো করে ঠাহর হচ্ছেনা, তবু এখন কুয়াশা নেই তেমন তাই রক্ষে। খুব আস্তে, তবু আমি চলাফেরা টের পাচ্ছি বেশ কিছুক্ষন হল, একজন নয় , দু তিন জন আছে। কিন্তু এতক্ষন ধরে কী করছে চোরেরা!
    বাবু শোন, মাঠের দিকের জানালাটা খুলে আমি মন্টুর নাম করে চেঁচাব, তুই আমার সাথে গলা মিলিয়ে যত জোরে পারিস, তোর জেঠুকে, মন্টুকে ডাকবি।
    কপাল আমার, এই শীতের রাতে সব জানালা বন্ধ করে শুয়েছে, আমাদের ডাকে শুনতে পাবে কিনা কে জানে। এমন ফেলে রেখে গেছে তোর বাবা, দুদিকে খালি বাড়ি, মাঝে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে একা মেয়েমানুষ আমি, এতটুকু ভাবনা আছে! “
    কাজল প্রমাদ গনে, মায়ের এই নিয়ে বিলাপ শুরু হলে থামেনা, ওদিকে চোর পালিয়ে যাবে যে।
    -“মা, চল, চেঁচাবে না?”
    -“হ্যাঁ চল।“
    মা ভাই আর বোনের চাপাচুপি ঠিক করে টেনে দিয়ে পাড়ার ভেতর দিকের জানালা খুলে কাঠের গরাদের মধ্যে দিয়ে মুখটা যতসম্ভব বাড়িয়ে চিৎকার শুরু করে। কাজলও প্রানপনে গলার শিরা ফুলিয়ে ডাকে,
    -“চোর, চোর। জেঠু, মন্টু দা, চোর চোর।“ প্রায় মিনিট খানেক চেঁচাতে, কে একটা দরজা খোলে বোধহয় বিল্টুকাকাদের বাড়ির কেউ, পল্টুকাকা।
    -“বৌদি, কাজল, তোমরা ঘরে থাকো, বেরিও না কেউ। চোর চোর, কাজলদের বাড়ি চোর ঢুকেছে।“

    ব্যস, পাড়ার লোক জেগে গেছে। মা কাজলকে চুপ করতে ইশারা করে, অন্ধকারে দেখতে পায়না তবে মনে হয় মাও ওর মত ঘেমে নেয়ে গেছে, এই ঠান্ডাতেও ।
    মা এবার আবার উঠোনের দিকের জানালাটা খোলে, তখন নীচের পায়ের আওয়াজ জোরে জোরে শোনা যায়,
    -“পালাচ্ছে, চোরগুলো পালাচ্ছে। সব ফেলে পালাচ্ছে না নিয়ে যাচ্ছে, কে জানে!” আবার মা মাঠের দিকের জানালায় যায়।
    -“ঠাকুরপো, দক্ষিনমাঠের দিকে যাও তোমরা, লোকগুলো ওই দিক দিয়ে পালাতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।“

    মা জানালায় দাঁড়িয়ে, একটু উঠোনের দিকের জানালা দিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল, যদি চোর দেখা যায়, মাকে সরতে বলার সাহস হল না। ভাই বোন ঘুমিয়ে আছে, ওরা কিছু টেরও পেল না। কাল সকালে বোনটা আসবে,
    “দাভাই, চোরের গল্প বল”।
    ইস্কুলে বন্ধুরা, পাড়ার সবাই ওকে জিজ্ঞেস করবে, খুঁটিয়ে সব জানতে চাইবে, কাজলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, চনমনে লাগছে। এমনি করে কতক্ষন মা আর ও ছিল কে জানে, বেশ অনেকটা সময় কাটলে নীচে থেকে আওয়াজ এল,
    -“বৌদি, নেমে এস। আমরা।“
    পল্টুকাকার গলা, আরো অনেক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে, মা ঘরের দরজা খুলে নামতে শুরু করেছে, জানালায় গিয়ে দেখল অনেকগুলো টর্চের আলো উঠোনে। ছুটে মায়ের পিছু পিছু নামে, মা নীচের সিঁড়ির দরজার তালা খুলছে, জেঠুর গলা পেল,
    -“বৌমা, মা তোমরা ঠিক আছ তো? কাজল।“
    দরজা খুলে সামনে জেঠুকে দেখে মা কেঁদে ফেলল। এতক্ষণের ভয় উত্তেজনা সব গলে গলে নামছিল দু চোখ বেয়ে।
    কাজলেরও খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল মাকে কাঁদতে দেখে।
    -“চুপ কর মা , ভয় কী, সবাই এসে গেছি তো”। জেঠু এগিয়ে এসে তাকে ধরেছে জড়িয়ে, মাথাটা জেঠুর পেটের ওপর। কাঁদলে চোখের জলে জেঠুর গেঞ্জি, গরম চাদর ভিজে যাবে, সবাই হাসবে, এত বড় ছেলে, দুটো ভাইবোনের দাদা, মা কী বলবে!
    কাজল আর কাঁদতে পারেনা, তবে এমনিতে জড়ানো মড়ানো তার একেবারে নাপসন্দ হলেও, এখন একটুও খারাপ লাগছে না, বরং শান্তি লাগছে, কী আরাম, আহ!
  • নেতাই | 132.177.***.*** | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:২৬628579
  • চলুক চলুক
  • kumu | 133.63.***.*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:২৯628565
  • অ শ্রাবণী শীত চলে গেল তো।লেখো না।
  • শ্রাবণী | 127.239.***.*** | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:২৯628566
  • কুমুদি, তাড়া দিও না প্লিজ, আশাও কোরোনা, হয়ত কিছু দাঁড়াবেই না।
    লিখে রাখিনা, লেখার অভ্যেস ইচ্ছে সব চলে যাচ্ছে বলে আগেকার মত টই খুলে যা খুশী লিখতে চেষ্টা করছি, প্রো তো আর নই, যে তরতর করে কপি পেস্ট করবো।:)
  • nina | 78.37.***.*** | ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ০৪:৫৬628567
  • প্রো ভাগ্যিস নস শ্রাবনী--
    তরতর করে প্রো রা যা সব লিখে রাখে পড়তে শুরু করলে তিন চার লাইন পড়েই হাই ওঠে---তারপর মনেও থাকেনা কি পড়লাম---
    আর এই লেখা যতবার পড়ি ততবার মনে হয় --আরও আরও আরও চাইইইইইই-------
  • Tripti | 138.2.***.*** | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ০২:০২628568
  • ভিজে মাটি সোঁদা গন্ধ শ্বাস ভরে নিলাম। ফেলে আসা গ্রাম জীবন।
    অনবদ্য।
    লেখাটা শেষ হলে একটা প্রশ্ন কবব।
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৬:৩৪628569
  • মায়ের কান্না থামলে সবাই মাকে বলে ভালো করে দেখতে, কী কী গেছে। কত লোক, সদর দিয়ে এক এক করে আসতেই থাকে , এত লোক আছে পাড়ায়? জেঠিমা উমিপিসীকে বলল হ্যারিকেন লম্ফর ওখানে গিয়ে আলো জ্বালাতে। মা উঠোনে নামল, রাতের রান্নার বাসন সব উঠোনেই রাখা ছিল, বেশী না।
    -“মুড়ি খাওয়ার কাঁসি ছিল দুটো, নেই। কাঁসার ঘটি, গেলাস, পিতলের হাতাও নেই। স্টীল আর এলুমিনিয়ামের বাসন পড়ে আছে।“
    কে একজন টর্চের আলো ফেলে ফেলে ওদিকের পুরনো ঘরের দরজা, নীচের ঘরের দরজা দেখছিল।
    -“সব দরজা তো বন্ধ, তালা দেওয়া। কোনো ঘরে ঢোকেনি।“
    -“ওসব ঘরে তো কিছু রাখা নেই, ভাঁড়ার ঘরে কলসী পানের ডাবর, আরো কিছু বাসন আছে। টর্চ ঘুরতে ঘুরতে হামারের ছোট দরজায় পড়ল।
    -“কাকীমা, হামার খোলা।“
    জেঠু কাজলকে ছেড়ে এবার উঠোনে নামে। হামারের একদম ওপরের দিকে ছোট একটা জানালার মত খুপরি প্রবেশ পথ।

    -“মই কোথায়, মই নিয়ে আয়। বুড়ো, ওঠ হামারে, ধান ঠিক আছে কিনা দ্যাখ।“ জেঠুর গলায় উদ্বেগ।
    মায়ের নির্দেশে কয়লার জায়গা থেকে মই নিয়ে আসে কে যেন, টর্চ নিয়ে হামারে ওঠে।

    কানাই জেঠুরা যখন বস্তা ভরে ভরে ধান এনে হামারে রাখছিল, কাজল বায়না করায় ওকে তুলে নামিয়ে দিয়েছিল হামারের ভেতরে। কিছুই না, দিনেও জমাট অন্ধকারময় গোলার ভেতর, সারি সারি বস্তা বসানো। গোবর মাটি দিয়ে সদ্য নিকোনো মেঝের গন্ধে, নতুন ধানের গন্ধ মিশেছে।
    চাল ফুরিয়ে এলে মা কানাই জেঠুকে বলে আর জেঠু হামারের চাবি খুলে একটা বস্তা বার করে নিয়ে যায়। নিজের বাড়িতে ধান সেদ্ধ করে চাল বানিয়ে মাকে দিয়ে যায়। শহরের মেয়ে মা, ধান সেদ্ধ, মুড়িভাজা এসব পারেনা। নাহলে পাড়ার অন্যান্য বাড়িতে মেয়েরা নিজেরাই ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে দেয়, ছেলেরা বাজারপাড়ায় নিমাই মালের ধানকলে ভাঙিয়ে চাল করে নিয়ে আসে।

    বুড়োদা উঠেছিল হামারে, এক সেকেন্ড দেখে নিয়েই বলল,
    -“জ্যাঠা, ধান নেই। একটাও বস্তা নেই।“
    সবাই স্তম্ভিত। মা বসে পড়েছে মাটিতে, কপালে হাত। জেঠুও দুয়ারে রাখা টিনের চেয়ারে বসে পড়ে। কাজল ওপরে ওঠার সিঁড়িতে গিয়ে বসেছিল। অন্ধকার আবছা হয়ে আলো ছাড়াই সবার মুখ দেখা যাচ্ছে অল্প অল্প।
    জেঠু র দিকে এগিয়ে এসেছে হারুদা, বিল্টু কাকারা।
    -“কেউ গিয়ে কানাইকে খবর দে। আর একজন যা, দক্ষিনমাঠের দিকে পল্টুরা গেছে, দৌড়ে গিয়ে ধরে বল, ধান চুরি গেছে, ধানের বস্তা খুঁজতে। কানাই মাতব্বর, পাড়ার সবাইকে বার করুক, সব চোরেদের ঘরে লোক পাঠা, নতুন ধানের এতগুলো বস্তা যেখানে পাবে, তাকে মারতে মারতে নিয়ে আসবে। এত সাহস হয়েছে, এই সবে সংক্রান্তি পুরল আর আমার ঘর থেকে মা লক্ষীকে চুরি করে নিয়ে যায়।“

    -“গোপাল, ও গোপাল, উঠে পড় বাবা, ওঠ ওঠ, দ্যাখ কখন সকাল হয়ে গেছে।“
    লক্ষীপিসীর ডাকে চোখ খোলে ওর। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে তড়াক করে উঠে বসে।
    -“পিসী জানো , কাল না স্বপ্নে দেখলাম আমাদের ঘরে চোর এসেছে, হামারের সব ধান নিয়ে গেছে।”
    পিসীর মশারির খুঁট খোলা হয়ে গেছে, মশারি তুলে একপাশে ঠেলে জড়ো করে, ওর গায়ে সোয়েটার পরাতে পরাতে বলে,
    -“হা পোড়াকপাল, সপন হতে যাবে কেন সোনা, মুখপোড়ারা যে সত্যি কাল রাতে এসে সব ধান নিয়ে গেছে।”
    স্বপ্ন না সত্যি? সব সত্যি? বোন ঘুমিয়ে আছে, পিসী এবার বোনকে নাড়া দেয়, কাজল এক লাফে খাট থেকে নেমে দুরদাড় সিঁড়ি ভাঙে। উঠোনে আবছা রোদে টিনের চেয়ারে জেঠু, বড়বাড়ির ভব জেঠু আর আশুকাকা, তাদের ঘিরে আরও কিছু লোক, ধারিতে কানাই জেঠু। মা ভাঁড়ার ঘরের মধ্যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, দুয়ারে জেঠিমা, রানীদিদি মিটসেফের সামনে, স্টোভে চা বসিয়েছে।
    অন্যদিন মা চা করে, জেঠিমা অবশ্য রোজ সকালে আসে মায়ের হাতের চা খেতে। ভাই তার কাঠের দোলনায় শুয়ে আছে নতুন বাড়ির দুয়ারে।
    ওকে নামতে দেখে মা ইশারা করে দাঁত মাজার জন্যে। মায়ের কাছে গেলে মা ব্রাশে মাজন লাগিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়।
    ইচ্ছে নেই তবু গুটি গুটি পায়ে খিড়কি দিকে যায়, দাঁত মেজে পুকুরে মুখ ধুয়ে নেবে। ঘাটে বাঁটুলদি, ওইদিকের ঘাটের কার সাথে গল্প করছে চিৎকার করে, বাসন মাজতে মাজতে। মুখ ধুয়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখে আরো কেউ কেউ এসেছে, তার মধ্যেও মায়ের তার দিকে নজর। কাছে যেতে হাতে দুধের গেলাস আর বিস্কুট ধরিয়ে দেয়। আজ ভেবেছিল দুধের থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, মা ভুলে যাবে। একবুক আশঙ্কা নিয়ে উঠোনে পেঁপেতলার দিকে রোদ এসেছে, সেদিকে যায়। মায়ের লক্ষণ ভালো নয়, আজও কি পড়াতে বসাবে নাকি?

    বড়দের কথা এক আধটু যা বোঝা যাচ্ছে তা হল, পোস্টাপিস খুললে বাবার কলকাতা অফিসে ট্রাঙ্ককল করা হবে, মা নম্বর টম্বর খুঁজে দেখছে। সকালে বেরোলে বিকেল নাগাদ বাবা এসে পড়বে। থানায় ডায়েরী করতে সকালেই বুড়োদারা চলে গেছে, তাদের ফেরার অপেক্ষায় সবাই। কাজল হতাশ, যা বোঝা যাচ্ছে, উত্তেজনা থিতিয়ে আসছে, চোর ধরা না পড়লে আর নতুন কিছু হবার নয়।
    মা ঘরের মধ্যে ব্যস্ত, লক্ষ্মী পিসী বোনকে বাথরুমে নিয়ে গেছে। কোনরকমে চোঁচাঁ দুধ শেষ করেই সদর দিকে হাঁটা দেয়।
    মাঠে রোদে তখন পাড়ার বাকী লোকেদের আড্ডা বসেছে। সবাই ওকে দেখে ঘিরে ধরল,
    “চোর দেখলি, দেখতে পেয়েছিলি?” – বৌদি কাকীমা দাদাদিদিরা। ও প্রশ্নের টুকটাক উত্তর দিতে থাকে, জানা অজানা সব। সবাই আরো জানতে চায়, অনেক মতামত আছে সবার - “এই করলনা কেন, ওদিকে গেল না কেন”।
    ফিক করে হেসে ফেলল ও, মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে”। মা কথায় কথায় খুব শোলোক বলে, ছড়া কাটে। ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করল না ওর হাসিমুখ, নাহলে কিছু মনে করতে পারত।

    এইসব হট্টগোলের মাঝে দেখল বাবার বন্ধু চাটুজ্জ্যেদের দীনুকাকা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে বাজারপাড়ার দিক দিয়ে, মুখ আষাঢ়ের মেঘের মত গম্ভীর। মাঠের জমায়েতটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে, মুখে কিছু না বলে বাড়ি ঢুকে গেল। নিশ্চয়ই চুরি সংক্রান্ত কোনো খবর এনেছে। কাজল সবার হাত ছাড়িয়ে ঘরের দিকে যায়। ঢোকার মুখে জেঠুর গলা শুনতে পেল
    “সর্বনাশ, একী বলছিস তুই দীনু”?
    যারা বসেছিল সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে, জেঠাইমার কপালে হাত। কাজল দৌড়ে ভেতরে যায়, হাতদুটো ভাঁড়ারের দরজার পাল্লায় শক্ত করে ধরে মা, ওকে দেখেও দেখেনা, মুখটা কঠিন, দৃষ্টি কেমন দূরপানে। ওর খুব খুব ভয় লাগে, কেমন দুঃখ হয়, কান্না পায়। এত লোকের উপস্থিতি খেয়াল করে না কাজল, লজ্জা ভুলে মাকে জড়িয়ে ধরে।
    ও জড়িয়ে ধরতেই মা যেন সম্বিত ফিরে পায়, জেঠাইমার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
    -“মানুষটা যে শেষ হয়ে যাবে দিদি। কত কষ্ট করে ছেলেমেয়ে সংসার থেকে দুরে থেকে, তিল তিল করে এক একটা কড়ি জমিয়ে যেটুকু করেছিল সব এমন করে চলে গেল, একদিনে। আমার ছেলেমেয়ের দিব্যি, কোনো অন্যায় আমরা করিনি, কার পাপে আমাদের এ শাস্তি?”
    -“চুপ কর চুপ কর। পাপ হতে যাবে কেন, এসব তার পরীক্ষা, ভালো মানুষদের তিনি পরীক্ষা নেন। মাথা ঠান্ডা কর ছোট, সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে তোদের, ঠাকুরপো বিদ্বান বুদ্ধিমান, সব আবার হবে, দশ গুণ হবে।“
    জেঠাইমা, রানীদি, আরও কারা সব মাকে ঘিরে ধরে। দীনুকাকাকে ঢুকতে দেখে ও যেমন বাড়ি এল তেমনি ওর পেছনে আরও মাঠের জমায়েত থেকে কেউ কেউ এসেছিল। জেঠুর কথায় তাদের একজন ওকে ধরে উঠোনে জেঠুর কোলে বসিয়ে দিল।
    কাজলের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল দীনুকাকা কী খবর নিয়ে এসেছে, কী কারণে মা হঠাৎ এত ভেঙে পড়েছে, এতক্ষন শক্ত থাকার পরেও, কিন্তু কে বলে দেবে, কাকে জিজ্ঞেস করবে!
  • শ্রাবণী | 69.94.***.*** | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৬:৪৫628570
  • *********************************************************
    নতুন বাড়ির নীচের ঘর ওর পড়ার ঘর। এখন অবশ্য আর ওর একার নয়, টেবিলে একদিকে বোনের সহজ পাঠ জায়গা করে নিয়েছে, ওর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও। এই ঘরটা এতদিন একার দখলে ছিল বাবার অনুপস্থিতিতে। বাবা বাড়ি এলে অবশ্য তখন বাবার আড্ডা এখানেই বসত তবে সে আর হপ্তায় কদিন। কিন্তু এখন বোন ছাড়াও ঘরটার এক তৃতীয় দাবীদার এসেছে অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্য।
    চুরির পর থেকে, ডাকুদা রোজ রাতে শুতে আসে, এই ঘরেই শোয়। তার বই খাতা ও ছুটছাট কিছু জিনিস থাকে খাটের মাথার দিকে জানালার তাকে, রাতে শোয়ার আগে লেখাপড়া করে কখনো কখনো।
    মাঝে মাঝে খেলা থাকলে ডাকুদা মায়ের কাছে রেডিও চেয়ে নেয়, কমেন্ট্রি শুনবে। এই ক্রিকেট ব্যাপারটা কাজল আগে বুঝত না। ডাকুদার সাথে তার তেমন ভাব ছিল না, অনেক বড় তার থেকে, কলেজে পড়ে, মনিদির দাদা। মাঝে মাঝে হাইস্কুলের মাঠে বড় ছেলেদের ক্রিকেট প্রতিযোগীতা হয়। মন্টুদার কাছে শুনেছে ডাকুদা এ গ্রামের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়। দুঃখের বিষয় তেমন ভালো আর দ্বিতীয় কেউ না থাকার জন্যে ওদের ক্লাব তরুণ সঙ্ঘ কোনো খেলায় জিততে পারেনা।
    তবে ডাকুদা তার কলেজের হয়ে অনেক জায়গায় খেলতে যায়, কাপ পায়। মনি দিদের বাড়ির আলমারীতে সেসব কাপ রাখা আছে।

    প্রথম দিন কমেন্ট্রি শোনার সময় ডাকুদা ওকে ডেকে নিয়েছিল। এখন শীত কমে গেছে, উঠোনে ধারিতে বসে চাঁদের আলোয় ওরা খেলা শুনছিল। একা একা খেলা শুনতে নাকি ভালো লাগেনা, তাই মাকে বলে ডাকুদা ওকেও বসিয়ে রেখেছিল। মা আপত্তি করেনি, ভাই বোনকে নিয়ে ওপরে উঠে যাবার আগে বলেছিল, ঘুম পেলে ওপরে ওঠার আগে যেন তাকে ডাকে, সিঁড়ির দরজা ঠিক করে বন্ধ করতে হবে।
    ও ক্রিকেট কিছুই বোঝেনা শুনে ডাকুদা যুগপৎ অবাক ও উত্তেজিত। খেলা শুনতে শুনতেই বোঝাতে থাকে, ব্যাটসম্যান, বোলার, ফিল্ডার, রান, উইকেট।
    দেবু ওকে দু একবার স্কুল মাঠে নিয়ে গিয়েছিল, হাইস্কুলের ছেলেদের খেলা দেখতে, ভাল্লাগেনি। ঠুকঠাক, হেঁটেই প্রায় এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, পুরো খেলাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ফুটবলের দৌড়, গতি, রক্ত গরম করা উত্তেজনা, সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। সেসব কথা ডাকুদাকে বলেনা, খুব মন দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা, তাদের দেশে, তাও দাদা বলল বলে জানল, নাহলে এত রাতে অন্ধকারে কী করে খেলা হচ্ছে তাই ভেবে প্রথমে কূল পাচ্ছিলনা।
    এরকম রাতে সময় ধরে খেয়ে শুয়ে না পড়ে একজন বড় দাদার সঙ্গে বসে খেলা শোনা, এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, সেই রোমাঞ্চে চার ছয় হলে না কী উইকেট পড়লে মানে যাতেই দাদা লাফিয়ে ওঠে, সেও হাততালি দিয়ে ওঠে। আর একটা নতুন কথা শেখে “ইন্ডিয়া”। যদিও এর মানে জানা তবু পড়ার বইয়ের বাইরে এর ব্যবহার ও জানত না এতদিন!

    বাবা এখন প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসে। মায়ের সঙ্গে নানা আলোচনায় আজকাল বারবার কলকাতা চলে যাওয়ার কথা শোনা যায়, মিশ্র অনুভূতি। বড় স্কুল, খেলার মাঠ এসবের কথা ভেবে একটা আকর্ষন আবার এখানকার মাঠ ঘাট ইস্কুল বন্ধুদের কথা মনে হলে ঠান্ডা এক বিষাদ জুড়ে বসে সারা শরীরময়। ডাকুদার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে, সেও এক নতুন জিনিস। কত গল্প শোনে, দেশ বিদেশের খেলোয়াড়দের। নিজে ক্রিকেটভক্ত হলেও কাজলের ফুটবল প্রেমের কথা শুনে ফুটবলের কত অজানা গল্প শোনায় তাকে। রাতে ডাকুদা এলে খাওয়াদাওয়ার পরে খানিক গল্প, এও আজকাল রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা ডাকুদাকে বলেছিল রোজ রাতে কাজলকে একটু ভূগোল আর ইতিহাস পড়িয়ে দিতে, গল্পের ফাঁকে, কিন্তু দাদা রাজী হয়নি, সে নিয়ম ধরে পড়াবে না বলেছে, কোথাও আটকে গেলে দেখিয়ে দেবে। মাঝে মাঝে খেলার গল্প করতে করতেই ওর ম্যাপবই নিয়ে বসে, ওকে বিদেশের খেলোয়াড়দের নাম বলে তার দেশ খোঁজে ওরা ম্যাপে, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড!
    ময়দান, ফুটবল, ইডেন গার্ডেন্স, ক্রিকেট, এসব জাদুনাম ওর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ডাকুদা। কলকাতা গেলে এখন হয়ত আর সেরকম অচেনা লাগবেনা, আজব দেশে অমলার মত লাগবেনা!

    বাবা এলে দীনু কাকাও রোজ সন্ধ্যেবেলায় এসে একধারে বসে থাকে, রোজ নিয়মিত। তবে আগের সে হইচই মজা আর নেই, তাস খেলাও এখন কালে ভদ্রে হয় যদিও আসে অনেকেই, শুধু একজোটে নয়, আলাদা আলাদা। কাজলের আগে জানা ছিলনা যে বাজারপাড়ায় দীনু কাকার ওষুধের দোকান আসলে কাকার একার নয়, বাবারও তাতে অর্ধেক ভাগ ছিল। সেদিন রাতে যখন বাড়িতে ধানের বস্তা চুরি হচ্ছিল ওদিকে দোকানেরও তালা ভেঙে চুরি হয়েছিল।

    বাড়ির চুরির রিপোর্ট করতে থানায় গিয়ে বুড়োদারা দেখেছিল পুলিশ দোকানের চুরির খবর আগে পেয়ে, দারোগা সেখানে চলে গেছে তদন্তে। দারোগাকে খুঁজতে সবাই তখন দোকানে যায় কিন্তু তার আগেই পুলিশ ও গ্রামের আরো লোকজন একদল বদ্যিপুরের নদীর ঘাটে গেছে, আরেকদল রথতলা বাসস্ট্যান্ডে, নৌকোয় বা বাসে মাল পাচার হতে পারে সন্দেহে।
    ওদিকে কানাইজেঠুর লোকেরা গ্রামে তন্ন তন্ন করে খুঁজে, একজন কালীতারার ঘরের সামনে নাকি ধানের কুটো পায়। শুধু তাই নয়, দুলে পাড়ার রতন দুলে ঘরের সামনে বসেছিল, তার মাথা দেখেও নাকি সন্দেহ হয়, ধানের বস্তা বওয়া মাথা বলে।
    সে যখন কানাইকে খবর দিতে আসে তখন কানাইয়ের দল দোকান চুরির খবর পেয়ে সেদিকে দৌড়েছে। পরে যখন এই চুরির হদিশ না পেয়ে কানাই জেঠু পুলিশ আর গাঁয়ের লোকজন নিয়ে কালীতারার ঘরে গেছে ধান খুঁজতে, তখন কিছুই পাওয়া যায়নি। সবাই মনে করেছিল যে সময় পেয়েছিল দোকান চুরির জন্যে তাতে ধান ওরা পাচার করে দিয়েছিল গাঁয়ের বাইরে।
    কানা ভিখারী রোজ রাতে দোকানের দাওয়ায় শুয়ে থাকত, তাকেও সেদিন দেখা যায়নি। পুরো দুদিন সে গাঁয়ে ঢোকেনি। পরে জিগ্যেস করলে বলেছিল শ্বশুর বাড়ি গেসল। এর আগে কানাকে কেউ কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে কোন বাড়িই যেতে দেখেনি, তার যে তিনকুলে কেউ আছে তাই এদের জানা ছিলনা। পুলিশ কিছুদিন কালীতারা, রতন দুলে আর সুবল বাগদির সাথে কানা ভিখারীকেও ধরে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখিয়ে ফাটকে পুরে অল্পবিস্তর মারধরও করল কিন্তু কারুর মুখ দিয়ে একটি কথাও বার করতে পারল না, প্রমাণের অভাবে শেষে ছেড়ে দিতে হল সবাইকে। কানাই জেঠু কালীতারাকে পাড়ায় একঘরে করে রাখল, তাতেও কিছুই হয়না। ওরা এমনিতেই পাড়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতনা।
  • দেব | 111.218.***.*** | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৯:৪৬628571
  • তারপর?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন