ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্ব থেকে শুরু হলো অভিযান শেষ করে ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
ষোড়শ অধ্যায়
ঘরে ফেরার পথে
উন্যানিয়েম্বে জায়গাটা এখন আমার কাছে মাটির পৃথিবীতে স্বর্গের মতন। লিভিংস্টোনও কম খুশি নন; তিনি একটা আরামদায়ক ঘরে ছিলেন, উজিজিতে তাঁর কুঁড়েঘরের তুলনায় সেটা একটা রাজপ্রাসাদ। আমাদের ভান্ডারের জিনিসপত্র এসেছে বাগামোয়ো থেকে, দেড়শও বেশি কুলির মাথায় চেপে। কাপড়, পুঁতি, তার ও হাজার-একটা ভ্রমণ সংক্রান্ত লটবহর তো আছেই। এছাড়াও অজস্র ঐহিক বিলাসদ্রব্যে ভরা সে ঘরগুলো। আমারই পঁচাত্তর বস্তা হরেক রকম জিনিস আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী এখন লিভিংস্টোনের হাতে তুলে দেওয়া হবে, নীল নদের উৎসের দিকে তাঁর অভিযানের জন্য।
যেদিন ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে ডাক্তারের বাক্সগুলো খুলতে বসলাম, সেই দিনটা ভারি সুন্দর ছিল। আগেরসব নির্জন জায়গায় জোয়ার- ভুট্টা ছাড়া গতি ছিল না, সেই অখাদ্যের দুঃস্বপ্ন-জাল কেটে বেরিয়ে, বিভিন্ন স্বপ্নের খাবার মুখে দেওয়ার আশায় প্রাণ হাঁকপাক করছে। ভেবেছিলাম যে কৌটোয়-পোরা হ্যাম, ক্র্যাকার আর জেলি খেতে পেলেই আমি তালাসের মতো অদম্য হয়ে উঠব। তারপর একটা শক্তপোক্ত ডাণ্ডা হাতে পেলেই হল, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে চোখের পলক ফেললেও ওয়াগোগোকে সিধে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়াটা কোন ব্যাপারই না।
প্রথমেই যে বাক্সটা খোলা হল, তাতে ছিল তিনটে বিস্কুটের টিন। আর ছয় টিন কৌটোর হ্যাম - ছোট্ট কৌটো, একটা অঙ্গুলিত্রাণের চেয়ে বড় নয়। খুলে দেখা গেল, এক টেবিল-চামচ প্রচণ্ড ঝাল মাংসের কিমা ছাড়া আর কিছুই নেই: ডাক্তারের রসদভান্ডার সম্বন্ধে আমার ধারণার পারদ শূন্যের পাঁচশ ডিগ্রি নিচে চলে গেল। এরপর বেরোল পাঁচ পাত্র জ্যাম। একটা খোলা হল, এও খুব হতাশাজনক। পাথরের কৌটোগুলোর ওজন এক পাউন্ড মত হবে - তার প্রতিটাতে এক চা-চামচের অল্প বেশি জ্যাম পাওয়া গেল। ভাবতে শুরু করলাম যে আমাদের প্রত্যাশাগুলো বড্ড উঁচু তারে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বেরোল কারির তিনটে বোতল। কে চেয়েছে কারি! আরেকটা বাক্স খোলা হল আর বেরিয়ে এল একটা মোটা ভেজামতন ডাচ চিজ - পুরো ইটের মতন শক্ত, তবে ঠিকই আছে, নষ্ট হয়নি; যদিও উন্যমওয়েজিতে পেটের পক্ষে এটা ভাল না। তারপরে আরও একটা চিজের টুকরো দেখা গেল, সেটা পুরো খেয়ে নেওয়া— একেবারে ফাঁপা, পুরোটাই জলে। তৃতীয় বাক্সে দুটো মিস্টি রুটি ছাড়া কিছু নেই; আর চার নম্বরটাতে মোমবাতি; পঞ্চম বাক্সে নুন, হার্ভে, ওর্সেস্টার ও রিডিং সসের বোতল, অ্যাঞ্চোভি, মরিচ আর সরিষার নির্যাস। হায় ভগবান! এসব কী! আমার মতন মৃতপ্রায় মানুষকে ফের বাঁচিয়ে তুলবে এগুলো? ষষ্ঠ বাক্সে রয়েছে চারটে শার্ট, দু জোড়া শক্ত জুতা, কিছু স্টকিংস আর জুতোর ফিতে; ডাক্তার এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, "রিচার্ড এখনও আগের মতোই রয়ে গেল!"। "সেই লোকটিই" আমি বলেছিলাম, "সে তিনি যেই হ’ন না কেন, আপনার সত্যিকারের বন্ধু।"। "হ্যাঁ, এ হল আমার বন্ধু, ওয়ালার।"
অন্য পাঁচটি বাক্সে মাংস ও স্যুপের কৌটো রয়েছে; তবে দ্বাদশ বাক্সটি যাতে এক ডজন বোতল ঔষধি ব্র্যান্ডি ছিল সেটা আর নেই। লিভিংস্টনের কাফেলার সর্দার আসমানিকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল যে, কেবল ব্র্যান্ডিই উধাও হয়নি, দুই গাঁটরি কাপড় ও চার ব্যাগ পুঁতিও উধাও। যে সে পুঁতি নয়, আফ্রিকার সবচেয়ে মূল্যবান পুঁতি, স্থানীয়দের কাছে যা কিনা সোনার মতো, সামি-সামি।
ভাণ্ডারের অবস্থা দেখে মারাত্মক হতাশ হলাম; আমার জন্ডিস রোগাক্রান্ত চোখে সবটাই রামঠকানো বলে মনে হল।
বিস্কুটের টিনগুলো যখন খোলা হল, দেখা গেল একটাই কেবল আস্ত বাক্স আছে; আর তার পুরোটা দিয়েও এক বেলার পুরো খাবার হবে না। গুচ্ছের স্যুপ রয়েছে - আফ্রিকায় বসে মাংসের স্যুপ কে পোঁছে? এখানে কি ষাঁড়, ভেড়া বা ছাগল নেই, যা দিয়ে ওই কৌটোর স্যুপের থেকে অনেকগুণ ভাল স্যুপ বানানো যায়? মটরশুঁটি, বা অন্য কোনও ধরণের উদ্ভিজ্জ স্যুপ পেলেও নাহয় সেটা একটা বিলাসিতা হিসেবে ধরতাম; তা না! মুরগী আর অন্য প্রাণীর স্যুপ! - যত্ত সব ভুলভাল জিনিস।
তারপর আমার নিজের রসদভান্ডার উল্টেপাল্টে দেখলাম। কিছু ভাল, পুরোনো ব্র্যান্ডি আর এক বোতল শ্যাম্পেনের এখনও পড়ে আছে; অবশ্য কাপড়ের গাঁটরির দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে যে এখানেও অসততা থাবা মেরেছে। কয়েকজন দোষী হিসেবে আসমানির কথাই বলল। আসমানি হল সেই সর্দার যাকে ডাঃ কার্ক লিভিংস্টোনের জিনিসপত্রের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তার নিজের বাক্সপ্যাঁটরা হাঁটকে আট-দশটি রঙিন কাপড় মিলল, সেগুলোর উপর আমার নিজের এজেন্টের চিহ্ন রয়েছে। কীভাবে তার বাক্সে কাপড়গুলো এল সে কথা সে স্পষ্ট করে বলতে পারল না। তাই সেসব একেবারে বাজেয়াপ্ত করা হল আর ডাক্তারের লোকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উপযুক্ত, তাদের মধ্যে বিতরণ করা হল। কয়েকজন প্রহরী এও অভিযোগ করল যে সে নাকি আমার স্টোর-রুমে ঢুকেছিল আর আমার লটবহর থেকে দু'তিন গোরাহ জিনিস লোপাট করেছিল, আর তার কিছু দিন পরে আমার দলের একজনের হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে দিয়েছে, যাতে অন্য কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে আর তার অপরাধের প্রমাণও খুঁজে পাওয়া না যায়। বোঝা গেল, আসমানী "নৈতিক দিক দিয়ে গাধা"। লিভিংস্টোন তাকে তক্ষুনি তাড়িয়ে দিলেন। আমরা যদি এত তাড়াতাড়ি উন্যানিয়েম্বে না পৌঁছাতাম, তাহলে হয়ত জাঞ্জিবার থেকে পাঠানো সব মালপত্রই সেই ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে যেত।
উন্যানিয়েম্বে ফল, শস্য ও গবাদি পশু সমৃদ্ধ, আমরা ঠিক করলাম আবার জমিয়ে ক্রিসমাস ডিনার খাব। সৌভাগ্যক্রমে এই সময় বেশ ভাল থাকায়, এবার এর প্রস্তুতি পর্বটি ভাল করে দেখাশোনা করতে পারলাম। উন্যামওয়েজির গ্রামের ঘরে কখনও এরকম উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি, কখনও এ ধরণের খাবারও পরিবেশিত হয়নি।
আমরা যখন পৌঁছেছিলাম তখন উন্যানিয়েম্বেতে আরবের সংখ্যা খুব কম, তারা সব মিরাম্বোর দুর্গের ঘাঁটি শক্ত করছিল। আমাদের ফিরে আসার প্রায় এক সপ্তাহ পরে, "দ্য লিটল ম্যানিকিন," শেখ সৈয়দ বিন সেলিম এল ওয়ালি- যে কিনা তাদের সেনাবাহিনীর নেতা ছিল, সে যুদ্ধক্ষেত্রের থেকে কুইহারায় এল। তবে যে মানুষটার সঙ্গে এত রকমের অন্যায় করা হয়েছে, ছোট্ট শেখটি কিন্তু তাকে স্বাগত জানাতে খুব ব্যস্ত ছিল না। লিভিংস্টোন মিকিন্ডনি বে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেই তার অনেক জিনিসপত্র ওয়ালির কাছে যত্নে রাখার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার আসার কথা শুনেই আমরা সেসব জিনিসপত্রের জন্য লোক পাঠালাম। প্রথমবার লোক পাঠানোর পরে শুনলাম কর্তা এইসব কাজ করার মত সুস্থ নয়, তবে দ্বিতীয় দিন তারা আত্মসমর্পণ করল, সেই সঙ্গে অনুরোধ করল যে ডাক্তার যেন মালপত্রের অবস্থার জন্য খুব বেশি রাগ না করেন, কারণ উই লেগে সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই লোকটার কাছে উন্যানিয়েম্বেতে রেখে যাওয়া রসদের খুবই দুঃখজনক দশা। সেগুলো উজিজিতে পাঠানোর খরচও আগেই দিয়ে রাখা ছিল। কিন্তু সেই ১৮৬৭ সাল থেকে সৈয়দ বিন সালিম সব মালপত্র এখানেই আটকে রেখেছিল যাতে সে নিজের মদের তৃষ্ণা মেটাতে পারে, আর সে জানত মালের সঙ্গে দুটো মূল্যবান বন্দুক আছে। হয়ত ভেবেছিল এই ফাঁকে যদি সেগুলোর মালিক হয়ে যাওয়া যায়। উইপোকা শুধু বন্দুকের বাক্স গুলোই ধ্বংস করেনি, তারা বন্দুকের শরীরেও আক্রমণ করেছিল। ব্যারেলগুলি ক্ষতবিক্ষত, লকগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। সব থেকে আশ্চর্যের কথা ব্র্যান্ডির বোতলগুলোও এই সর্বভুক অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসকারী উইপোকার হাত থেকে রেহাই পায়নি। কোন এক ব্যাখ্যাতীত উপায়ে অতি কড়া হেনেসিও হজম করে নিয়েছিল আর বোতলের কর্কগুলোকে ভুট্টা দিয়ে বদলে দিয়েছিল। ওষুধপত্রও সব হাওয়া। আর যে দস্তার পাত্রে তাদের ভালভাবে পুরে রাখা ছিল, সেটাও ক্ষয়ে গেছে। সেই পূর্ণ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শুধুমাত্র দুটো ব্র্যান্ডির বোতল আর ওষুধের একটা ছোট দস্তার পাত্র বেঁচে আছে।
(ক্রমশ…)