১৬
এসে গেল শীতকালের দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাকসিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে শিগগির। আনলক চতুর্থ পর্ব চলছে। যেহেতু কলেজ এখনও খোলেনি, তাই আমার লকডাউন বহমান, থামার জো টি নেই। লকডাউনের অবসরে কর্তামশাই আমার এই একচিলতে বাসার জানলাগুলো বাগান করে ভরিয়ে দিয়েছেন। জানলা থেকে পুঁইশাক কেটে খাওয়া চলল নানারকম, কখনো শাক, কখনও শুধু ডাঁটা অথবা পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি। বিলোনোও হল কিছু নিকট আত্মীয় আর প্রতিবেশীকে। এখন ঐ জানালার একফালি রোদে তার বীজ শুকনো হচ্ছে আবার নতুন করে বোনার জন্য। বারান্দাকে তো একটু বড়সড় জানলা হিসেবে ভাবাই যায়, সেখানে তিনি ফলিয়েছেন ছোটো ছোটো বেগুন, দুরকম - সাদা আর বেগুনি। এখন শীতকালে দক্ষিণের জানলায় রোদ আসে বেশ। ছোটোবেলার স্মৃতি আর ইউ টিউবের পড়া মিশিয়ে, রান্নার মেয়েটির সঙ্গে যুক্তি করে থালায় থালায় দিলাম বড়ি। শুকোতে দিলাম সেই জানলায়।
ঠাকুর ঘরের জানলার নিচে দোতলার এজমালি একটু চাতাল। ওখানে সেদিন ম্যাও ম্যাও শুনে দেখি পাড়ার ভুলো বেড়াল দুটো ফারের বল নিয়ে শুয়ে আছে। গরমকালে ওর তিনটে ছানাকে ডেকে নিয়ে গেছে আম্ফান ঝড়ে। সেই থেকে ভুলোর দেমাক নেই, মনমরা হয়ে ঘোরে। আজ ওর পাশে দুটো তুলোর পুঁটুলি দেখে ভারি ভালো লাগে। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছেঁড়া গামছা পাট করে পেতে দিই। মনটা উশখুশ করে, ঠান্ডাটা খুব জোর। রেশন দোকান থেকে চেয়ে চিন্তে একটা চট যোগাড় করে জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে পেতে দিই। বান্ধবীদের উৎসাহে ওপাশের জানলায় টুটিফ্রুটি শুকোতে দিয়েছি লাল আর সাদা। এবারে বড় দিনে কেক বানাবো। কোন কৃত্রিম রঙ নয়, চিনি আর বীটের রসে ফুটিয়ে ছোট ছোট পেঁপের টুকরোগুলো লাল করে রোদে শুকিয়েছি, বীটের রঙ না দেওয়াগুলো সাদা। বাবা মাকে কেক বানিয়ে খাওয়াবো। হার্ড লকডাউনে যাওয়া আসা করা যায়নি, শুধু ফোনে ফোনে লেকটাউনের ড্যাফোডিল নার্সিং হোমের অ্যামবুলেন্স বুক করে, ওখানেই বাবা মায়ের চেক আপ করাতে হয়েছে। এখন তো একটু যাতায়াত করা যাচ্ছে, অসুবিধে হবেনা। আর এই ভুলোর ছানাগুলো একটু বড় হলে ওদেরও দেব। ২৫ শে ডিসেম্বর আসতে আর বেশি দেরি নেই। ইউ টিউবের জানলায় মুখ বাড়িয়ে পছন্দসই কেকের রেসিপি খুঁজি। এর মধ্যে পনের আর ষোল তারিখ দুদিন আনন্দবাজারে আমার লেখা আর্টিকল প্রকাশিত হয়, মাকে আমি এসে বলি, কাগজ খুলে দেখাই, মা ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বুঝেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু অসুখের জন্য মুখের পেশী নড়েনা। বাবা বসে অনেক মতামত দেয়।
ঠান্ডা আরো ঘন হয়ে আসে। টুটিফ্রুটি পড়ে থাকে বোতলবন্দী। কেক বানানো হয়না। বরং বড়দিনের দিন নিমতলা ঘাটের গ্রিলের জানলা দিয়ে দেখি মা চলেছে আগুনের সিঁড়ি বেয়ে পরমাত্মার দিকে। নিমতলা ঘাটে গঙ্গায় মায়াবী আলো ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যায়। মুখাগ্নি করে গঙ্গায় আমি মায়ের অস্থি বিসর্জন করি। এর আগে আমি কখনও শ্মশানে যাইনি। ছোট থেকে সকলে বলতো, মেয়েরা শ্মশানে যায়না। আজ প্রথমবার গেলাম তো গেলাম একেবারে প্রধান ভূমিকায়। ঘরে ফিরে জানলা দিয়ে দেখি ভুলু তার ছানা দুটোকে মুখে মুখ, গালে গাল দিয়ে গলাগলি করে। পিছন থেকে কন্যা এসে জড়িয়ে ধরে। বলে, মা আমার দিকে দেখো, তোমার মা মরেনি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি, আর নতুন উৎসাহে কাজে লেগে পড়ি। কম্পিউটারের জানলায় কতোনা দায়িত্ব এসে জমে। দুঃখের মাঝে মুঠোফোনে দু দুটো ভালো খবর চলে আসে। বম্বে আই আই টি থেকে ভারতে ফ্রী এন্ড ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের প্রচার ও প্রশিক্ষণ চলে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে লকডাউনে এই সফটওয়্যারের প্রসারে অংশ নেওয়ার জন্য আমাকে ওরা অ্যাপ্রিসিয়েশন লেটার দিয়ে সম্মানিত করেছে। প্রতিবছর সারা দেশে নাকি মাত্র একশ শিক্ষক এই সম্মান পান। আর আমার লেখা শালিক পাখির কাহিনীটা বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকায় ২০২০ তে অমলেশ চন্দ্র তালুকদার স্মৃতি পুরষ্কার ও রৌপ্য ফলকের জন্য মনোনীত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠান।
বাবাকে বলি বাবা আর দুটো মাস, নতুন বাড়িতে নিয়ে যাব তোমায়। তুমি সব চিকিৎসার অভিজ্ঞতা বলবে, আমি অনুলিখন করে বই ছাপাবো তোমার নামে। বাবা অল্প হেসে দুদিকে মাথা নাড়ে। সে হাসিতে কী ছিল সেদিন বুঝিনি। জানুয়ারি যায়, ফেব্রুয়ারির এক তারিখ আসে। বাড়িতে ঢুকে ডাকাডাকি করি বাবা বাবা। ঘোলা চোখের দৃষ্টি খোঁজে আমাকে, সে চোখে আলোর তারা নেই। বাবা হাত তোলে। হাত ধরে মাথায় হাত বোলাই। বাবা ঘুমোয়। আগামীকাল ভগিনী প্রতিম সহকর্মিনীর বিয়ে। তার উপহারটা প্লাস্টিক না দিয়ে জাপানি ফুরোসিকি প্রথায় কাপড়ের মোড়ক করে রাংতা বসিয়ে দিই। পরদিন নিমতলার আগুনের সুড়ঙ্গ বেয়ে বাবা, মার কাছে পাড়ি দেয়। আমার অনুলিখন বাকিই রয়ে যায়। আজ নিমতলার চাতালে সারি দেওয়া শবের মাঝে বাবাও একজন। আবার সেই একইরকম ক্রিয়াকলাপ সাধন করি নির্বিকার মুখে। ঠিক একমাস আগে যেমনটা হয়েছিল। আগুন কাঠি নিয়ে আমি বাবাকে প্রদক্ষিণ করি, বাকি শ্মশানযাত্রীরা আমার দিকে চেয়ে থাকে চিত্রার্পিতের মত। একবিংশ শতকেও কন্যাকে পিতার অন্ত্যেষ্টি কর্তা দেখে লোকে অবাক হয়। আমার কাঁধে আরও দায়িত্ব এসে চাপে। মা চলে যাবার আগের তিন বছর পার্কিন্সনে শয্যাশায়ী ছিলেন। শেষটায় কথাও আর বলতে পারতেন না। কিন্তু একমাসের মধ্যে আমার পক্ষে - আমি কন্যা সন্তান - বাবা চলে যাবার ধাক্কাটা সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। শহুরে বনেদী বসু আর গ্রামের চাষির ছেলে, তায় কায়স্থ নয়, মণ্ডল - সমাজের লাল চোখ পেরিয়ে সংসার, পড়াশোনার সূত্রে আলাপ, প্রেম, আর বইয়ের সমুদ্রে দুজনের মুক্তি - তাই বুঝি বিচ্ছেদ বাবার সহ্য হলনা।
কর্তা মশাই বলেন মায়ের কাজ লকডাউন বলে পাতিপুকুরের বলরাম মন্দিরে সারা হয়েছিল, কিন্তু বাবার কাজ আড়বালিয়ায় না হলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবেনা। আর করোনার প্রথম ঢেউ থিতিয়ে এসেছে। হয়তো ইস্কুল কলেজও খুলে যাবে এবার। গ্রামে তেমন ছড়ায়নি অসুখটা, গ্রামের রাস্তায় ঢোকার মুখের ব্যারিকেডগুলোও খুলে দিয়েছে লোকে। তাই এই মুহূর্তে ওখানে বাবার কাজ করলে অসুবিধে হবেনা। আম্ফানের তাণ্ডবের পরে এই সুযোগে ঘরবাড়িটাও দেখাশোনা করা যাবে। যুক্তিগুলো ঠিক, তাই মেনে নিই এই কথা। বাবা চিরকাল লাজুক, মুখচোরা, বিতর্কহীন, শান্ত এক মানুষ ছিলেন। আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী সকলেই তাঁকে ভালবাসতো। বাবা আড়বালিয়ার বাড়িতে গেলেই সকাল নেই, দুপুর নেই, রাত্তির নেই বাড়িতে রোগীদের ঢল নামতো। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বাবা কখনও দক্ষিণা নিতেননা। আর আমার ভাইপো, ভাইঝি, বোনপো, বোনঝি - ছোটবেলা থেকেই বাবার আন্ডারে ছিল। বাচ্চাদের রোগ ভালো করার ব্যাপারে বাবার একটা ম্যাজিকাল ক্ষমতা ছিল। বেনারস বেড়াতে যাবার সময়ে নিছক খেয়ালে নিয়ে এসেছিলাম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেতলের কলস। আজ তারই একটায় বাবার অস্থি ভরে আড়বালিয়ার ভিটেয় বাবার লাগানো গাছের গোড়ায় রেখে দিই চিরদিনের মত।
এদিকে এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমেস্টার শেষের অনলাইন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারী হয়েছে। একই সঙ্গে জীবনের দুরকম হিসেব নিয়ে বসি। আট তিনে বিজোড় সন্মাষ পরীক্ষা হলে সিলেবাসের ধার বাকি কত আনা, সেই সঙ্গে কত লোকের জন্য কী কী আয়োজন হলে, লাগবে কত নয়া। কি নাম দেব এই হিসেবের? ত্রৈরাশিক নাকি ভগ্নাংশ!
কতদিন আমি শহরে দু কামরার ঘুপচি বাড়িতে বন্দী ছিলাম। আড়বালিয়ার রোদের মধ্যে নিজেকে যেন একটা পাখির মত স্বাধীন মনে হয়। এতদিন লকডাউনের ফলে জমি সব জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে। কোথায় পুজো, কোথায় কুলপুরোহিত, কোথায় মণ্ডপ, কোথায় ক্যাটারার, কোথায় ফুল - এসব কি করেছি আমি কোনদিন? জ্যেঠতুতো দাদাদের বলেছি যেভাবে যা করা যায়, সব তোদের হাতে ছেড়ে দিলাম। আমাকে শুধু বলবি কী লাগবে। জঙ্গল কাটাতে পাড়ার বিশু কাকাকে খবর দেওয়া হয়েছে। সকাল সকাল বিশু কাকা এসে জানায় যে কত তার রোজ লাগবে। আমার কর্তা সবসময়ে বলেন যে আমি খরুচে, বাস্তব বুদ্ধি নেই। সেই ভেবে বললাম, ‘আচ্ছা তোমার জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসছি।’ বিশু কাকা অমনি আমাকে দাবড়ে বলে ওঠে, ‘সেই কবে থেকে এই জমি পরিষ্কার করি আমি। আগে বাবু ছিল, বাবুর সঙ্গে কথা ছিল। এখন তুই আছিস। তোর সঙ্গে কথা, তুই বল। জামাইরে আমি চিনিনা, জামাই কেডা?’ তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলি আমি। কিন্তু এই নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়, বুকের ভেতরে এক তপ্ত মরুভূমির বাতাস হু হু করে ঘুরপাক খায়। বাবা একবার জোর করে আমাকে সপরিবার আড়বালিয়া পাঠিয়েছিল, কিন্তু নিজেরা আসেনি। পরখ করতে চেয়েছিল বাবা মাকে ছাড়া আমরা আড়বালিয়াতে সব কিছু সামলাতে পারি কিনা। রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাবার জল, পাম্প, জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার, টিভির কেবল লাইন, সব তালা খোলা বন্ধ নিজেরা চালু করতে পারি কিনা, আবার বেরিয়ে আসার সময়ে সব কিছু গুছিয়ে বন্ধ করতে পারি কিনা। আর আমাদের সুবিধের জন্য, প্রতিটা চাবি আলাদা আলাদা প্যাকেটে লেবেল করে দিয়েছিল, সঙ্গে একটা নোটবুকে কোথায় কী আছে, দরকারি লোকেদের ফোন নম্বর সব লিখে দিয়েছিল। আজ সেই ট্রেনিংটা সবচেয়ে বেশি কাজে লেগে যায়। কাজের বাড়িতে সকলে ডাকাডাকি করে, ‘টুম্পা এটা কোথায়?’ ‘টুম্পা ওটা বার করে দে।’ আমি সেই নোটবুক আর চাবির ডালা নিয়ে বাবা হয়ে ঘুরি।
ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়, এখনও নীলচে কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে রয়েছে বটতলার পুকুর। ছোটবেলায় এমনি ভোরে বাবা লেপের মধ্যে ঘুম ভাঙ্গিয়ে হাতে দিত কনকনে ঠান্ডা খেজুরের রসের গ্লাস। মধুর চেয়েও মিষ্টি। এমন ঋতুতে বাবা যখন বাজারে যেত, তখন শীতের কুয়াশা মেখে আমিও বাবার সঙ্গ নিতাম। শিশিরে ভেজা টাটকা সজনে ফুল, মোটা মোটা ফুলেশ্বরী ডাঁটা, কোনদিন বা ওলের ডাঁটা আর পাকা পাকা হলুদ পটল কিনে আনতাম। ডুমো আলু দিয়ে সজনে ফুলের চচ্চড়ি হত। ওলের ডাঁটার ছেঁচকি হত - আমিষ বা নিরামিষ। ডাঁটাটা ছোট ছোট টুকরো করে অল্প ভাপিয়ে নিত মা। বেশি সেদ্ধ হয়ে গেলে কেমন একটা লালা বেরিয়ে যায়। নিরামিষ করলে মা ছেঁচকিতে কাঁঠাল বীচি কেটে দিত, এতে স্বাদ বাড়ে। মায়ের হাতে সর্ষের তেলে পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা ফোড়নের গন্ধ উঠত। তার মধ্যে পড়ত ডুমো আলু আর কাঁঠাল বীচি। ভাজা ভাজা হয়ে গেলে তার মধ্যে ভাপানো ডাঁটা দিয়ে নুন, মিষ্টি, হলুদ মিশিয়ে কষত মা। শেষে সর্ষে বাটা ধোয়া জল দিয়ে একটু ফুটিয়ে নামিয়ে নিত। আমিষ হলে নিয়মটা একটু আলাদা। সেখানে প্রথমে চিংড়ি ভেজে তুলে নিতে হবে। সেই তেলে গোটা কালো সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচো লাল করে ভেজে নিতে হয়। এবার এর মধ্যে ভাপানো ডাঁটা দিয়ে ভাল করে কষতে হবে। অল্প করে রসুন বাটাও দেওয়া যায়, ক্ষতি নেই। আগে থেকে সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা বেটে রাখতে হবে। শেষে একটু দিয়ে রান্নাটা নামাতে হবে। বাবা বেশ নানারকম খেতে পছন্দ করত। রোজ রকম রকম বাজার করত। মা রান্নাটাও করত ভালো। পাকা পটলের শাঁস আর বীচি বার করে নিয়ে, হলুদ, নুন, মিষ্টি আর পেঁয়াজ, আদা, রসুন বাটা দিয়ে কষে একেবারে চপের পুরের মত মাখা মাখা চচ্চড়ি বানাত মা। কোনদিন আবার চিংড়ি মাছ দিয়ে ডয়রা কলার চচ্চড়ি বানাতে বাবা নিজে মাঠে নামত।
বিকেলে কখনও কখনও বাবা বাজারে যেত খেজুর গুড়ের পাটালি কিনতে। বাবার পাঠশালার সহপাঠী, প্রাণের বন্ধু সাহেব চাচাকে অনেক কেজি পাটালির অর্ডার দেওয়া থাকতো। কারণ বাবার অফিসের কলিগ, কলকাতার প্রতিবেশী, মায়ের বন্ধুরা, অনেকেই আমরা কবে পাটালি আনব, সেই অপেক্ষায় থাকতেন। কাক ভোরে একের পরে এক খেজুর গাছে উঠে রসের হাড়ি নামাতো সাহেব চাচা। চাচী একটা চৌকোণা আয়তাকার চৌবাচ্চার মত উনুন বানাতো, তাতে মাটির প্রলেপ দেওয়া। ঠান্ডা কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে আকাশে সূর্যের লাল আভা উঁকি দিত আর সেই আয়ত উনুনে খেজুরের স্বচ্ছ রসে লালচে রঙ ধরত। কোন কোনদিন আমি আর বাবা দেখতাম দুজনে মিলে। বাবা আমাকে বলত 'দেখ বুড়ো, সুয্যিমামা কেমন খেজুর রসে রং ঢালছে'। ঐ রস ঘন করে জমিয়ে পাটালি কাটা হত বিকেলে। গোল সরা থেকে খুলে খুলে কাপড়ের ওপরে পাটালি সাজাত চাচা। বিয়ের পরে আমার কর্তা আবার রমেশ কাকুর ভক্ত হয়ে উঠল। বাবাই ওকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। কর্তা এলেই, রমেশ কাকু তার বৌকে কড়া নির্দেশ দিত, 'ছোড়দার জামাই এসেছে। ইস্পেশাল গুড় বানাবি, চিনি যেন না পড়ে'। আসলে দেশ গাঁয়ে আগের মত খেজুর গাছ তো নেই। কিন্তু গুড় খাবার লোক বেড়েছে অনেক। তাই এক কলসি রসকে চিনি মিশিয়ে তিন কলসি করে এই গুড়ের কারিগর মানে শিউলিরা। চিনি মেশানো পাটালি দেখলে আমরা চিনতে পারি। একটু কচকচ করে, কিছুদিন থাকলে গলে যায়, আর রংটা হালকা হয়। রমেশ কাকু আমবাগানের ইজারা নিত। সেই আমগাছ থেকে পড়েই কাকা ছুটি নিয়েছে - তা হয়ে গেল আজ বছর ছয়েক তো বটেই। আচ্ছা সাহেব চাচা কোথায় গেল? বাবা চাচার কাছে না গিয়ে রমেশ কাকুর কাছে ওকে নিয়ে গেল কেন? চাচা কোথায় ছিল? বাবা যতদিন ছিল, এসব কথা মাথায় আসেনি। এখন বাবা নেই। সাহেব চাচা তুমি কোথায়? তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে। শুধু সাহেব চাচা তো নয়, আর একজন ছিল - আতিয়ার চাচা। দুজনে একসঙ্গে বাজারে যেত, আবার বাজার থেকে ফিরে আড্ডা দিত। বাবা খুব কম কথা বলত। শুধু হাতে গোনা এই কয়েকজন ছিল, যাদের সঙ্গে বাবা প্রাণ খুলে গল্প করত। আতি চাচাই বা কোথায় এখন? আমি দাদাদের দ্বারস্থ হই। আর্জি জানাই যে বাবার কাজে একবার কানে শুনেই এত মানুষ আসছে। দুই চাচাকে খুঁজে এনে দে। আমি অনেক ছোট ছিলাম। ওরা একটু বড় ছিল। এত বছর পরে যদি দেখা পায়, আমার চেয়ে চিনতে ওদেরই সুবিধে হবে। যা হোক, হঠাৎ একজন খবর আনল যে দুই গাঁ পরে একজন লম্বা, রোগা বয়স্ক আতিয়ার থাকে, তারা নাকি আগে এ গাঁয়েই থাকত। নদা ছুটল সাইকেল নিয়ে। দুপুর গড়ায়, বৌদি বসে আছে না খেয়ে। আমার একটু অপরাধবোধ হয়। এভাবে পাঠানো উচিত হয়নি। সদ্য মাতৃপিতৃহারা খুড়তুতো বোনের আবদার ফেলতে পারেনি। হয়তো বাবার এই আকস্মিক চলে যাওয়াটা মেনে নিতে সকলেরই কষ্ট হচ্ছে, বাবার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে সকলেই হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা হল। আমরা তো আর খোকাখুকু নেই। আবার মনে একটা আশাও আছে - যদি সেই হয়। বাবার বড় ভরসা ছিল এই দুই চাচা। দুপুর পেরিয়ে ঘেমে নেয়ে এসে নদা বলল, 'এ আতি, সে আতি নয় রে টুম্পা, ছোটকার বন্ধু নয়'। আশায় জল পড়ল। সাহেব চাচার খোঁজও পাওয়া গেলনা। গুড়ের কলসি কেনা হয়েছে। তার গন্ধে ছোটবেলায় চাচীর গুড় জাল দেওয়ার গন্ধ, বাবার গল্পগাছাগুলি ভেসে বেড়াতে থাকে। আচ্ছা, দুই চাচা কি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল? বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে? আকাশে কি খেজুর গাছ আছে? গাছের ঝাঁকড়া পাতার তলায় গুঁড়ির ওপরে পাতলা করে চেঁছে, ফুটো করে বাঁশের নল বসিয়ে চাচা হাঁড়ি বাঁধছে। আবার সড়সড়িয়ে গাছে উঠে হাঁড়ি নামাচ্ছে। রস জাল দিচ্ছে আর বাকি দুই বন্ধু হয়তো মাদুর পেতে বসেছে সামনে। খেজুর গাছকে তিনদিন করে বিশ্রাম দিয়ে জিরেন রস তো পাওয়াই দায় হত। এখন হয়তো সেই অমৃত রস মিলছে দেদার। পিঠে পুলির ভিয়েন বসিয়েছে তিন ইয়ার - এমন সব অবাস্তব কল্পনা করে মনে মনে হাসি।
খেজুর পাতায় হিম জমেছে,
বাবার কথা আসে।
খেজুর গুড়ের মিষ্টি বাসে
বাবার স্মৃতি ভাসে।
সবুজ পাতা ধূসর হল
লেপের ওমে ঝাঁজ,
পিঠে পুলির হাঁকে ডাকে
ব্যস্ত বাবা আজ।
খেজুর গাছে বাবুই বাসা
বাসায় মায়ার ছাঁচ,
মায়ায় মারে খেজুর কাঁটা
আমার মনে সাঁঝ।