৪
এবারে লকডাউনে পুজোর নতুন জামা হল না। রঞ্জাবতীর মনটা খারাপ। জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছোটবেলার কথা মনে আসে। অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা ছিট কাপড় কিনে আনত। আমার ধারণা ছিল, বাবা সব কিছু অফিস থেকেই আনে। যা হোক, পুজোর আগে কোনো এক রবিবার আমাদের দুই বোনকে নিয়ে দর্জির দোকানে অভিযানে যেত বাবা। মায়ের কড়া নির্দেশ থাকত, জামার ঝুল যেন হাঁটুর নিচে থাকে আর গলায় যেন চওড়া কুঁচি থাকে। একটা চোরা টেনশন কাজ করত – জামা তৈরি হবার পরে ডিজাইন মায়ের পছন্দ হবে কিনা। তারপর পুজোর দিনে দুই বোন একরকম ছিটের জামা পরে বাবা মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। জামাগুলো নকশাতেও এক, কেবল মাপে আলাদা। আর জামার সঙ্গে ছিল বাটার ব্যালেরিনা জুতো। ইস্কুল যতদিন, সেই এক কালো বকলস দেওয়া জুতোও ততদিন। শুধু একটাই আনন্দ ছিল—জুতো কিনলেই সঙ্গে প্লাস্টিকের লাট্টু আর বেলুন দিত। লাট্টুটা সোজা, উল্টো দুদিকেই ঘোরানো যেত। ঐটা ছিল বিরাট আকর্ষণ। এখন আমার কন্যেরা সেসব দিন কল্পনাতেও আনতে পারবে না। ইস্কুলের জুতো আর বিয়েবাড়িতে পরার জুতো যে এক হতে পারে, পুজোয় দুটো জামা আর চৈত্র সেলে একটা জামা—তিনটে জামায় যে সারাবছর চালানো যায়, এসব কথা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। অদ্ভুত লাগে—সেই সব দিনে আমাদের কোনো অভাব বোধও ছিল না। তবে আইবুড়ো কাল আর বৌ-কাল—ব্যাপারটাই আলাদা। তেমন কোনো মিল থাকে না।
বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ষষ্ঠীর দিনটা খুব একটা কিছু তাড়াহুড়ো না থাকলেও, সপ্তমীর দিন থেকে বেশ সাজো সাজো রব পড়ে যায়। প্রতিবছরই আমি নতুন জামার সঙ্গে মেয়ের পুরোনো সুন্দর দেখতে জামাগুলো বাক্স ভর্তি করে নিয়ে যাই। কারণ পুজোবাড়ির রান্নাঘরের কাজে যে বৌরা আসে, তাদের নাতি নাতনির সংখ্যা তো কম নয়। কোনো না কোনো মেয়েকে ওই জামা ফিট করে যায় আর আমারও বোঝা হালকা হয়। কেবল ঐ সব মেয়েরা আমার মেয়ের জামা পরে যখন উঠোনে ছুটোছুটি করে খেলা করে, তখন দোতলার বারান্দা থেকে দেখলে কোনটা যে আমার মেয়ে—সেটা গুলিয়ে যায়। ঐ জামা পরে ওদের কত আনন্দ, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। সারাদিন রাত এক জামা পরে থাকে, খায় দায়। তবে দু’দিনের মধ্যেই ধুলো কাদা মেখে জামাগুলোকে আর চেনা যায় না। ওই বাচ্চারাও পুজোবাড়িতে এক একটা চরিত্র। মায়ের সঙ্গে আসত এমন একটি শিশুর কথা মনে পড়ে, নাম প্যাঁটরা। বছর ছয়েক বয়স হবে, তবে মাথায় খাটো ছিল বলে আরও কম বয়স লাগত দেখতে। কথাবার্তায় টরটরি। কিন্তু আসল দেখার জিনিস ছিল তার গুছিয়ে ভাত খাওয়া। বড় মানুষের মত বাবু হয়ে বসে কলাপাতায় চূড়ো ভাত নিমেষে উড়িয়ে দিত। কোনো পছন্দ, বাছ বিচার কিচ্ছু নেই। পাতে যাই পড়ুক নির্বিবাদে খেয়ে নেবে। আমার কর্তা তাকে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াত। কারণ কাজের মেয়েদের নিজেদের মধ্যে অনেক সময় হিংসা-হিংসি থাকে। নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য বেশি করে সরিয়ে রাখার প্রবণতা থাকে। যারা সারাবছর কাজ করে, তারা পুজোর সময়ে আসা লোকেদের গুরুত্ব পাওয়া পছন্দ করে না। কর্তা বলে ওর ছোটবেলায় খুব খেতে পারে এমন একটা বাচ্চা থাকত তার মায়ের সঙ্গে—নাম ছিল বদনি। আমার শাশুড়ি মা সচরাচর সবার পরেই খেতে বসতেন। কখনও ক্বচিৎ আগে বসে পড়লে, সেই বদনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্না শুরু করে দিত – “ও মা রে, ছুটি কি আয় রে, বক্সি ঘরোর বৌ তো সবু খাই লেলা রে।” তার কান্না দেখে সকলে হাসত। খেতে ভালবাসা তো দোষের কিছু নয়। তবে গ্রাম দেশের এই সব মেয়ে বড় হয়ে খাওয়ার স্বাধীনতা পায় না। মেয়েমানুষ খেতে চায়, এমন আশ্চর্য ব্যাপার কেই বা কবে দেখেছে। সমাজ মেনে নেয় না, তাই আরও বেশি করে আঘাত করে। বদনির কপালও এমনি হয়েছিল। সেই কথা মনে করেই সম্ভবত কর্তা দাঁড়িয়ে থেকে প্যাঁটরার খাওয়ার তদারক করত। কর্তার কাছে অনেক পুরোনো দিনের গল্প শুনেছি। ওদের ছোটবেলায় গ্রামের সাধারণ মানুষের দারিদ্র অনেক বেশি ছিল। দুপুরে গোপীনাথের অন্নভোগ প্রসাদ পাবার জন্য নিরন্ন মানুষের ঢল নামত। ভাত তরকারি মেখে সকলকে এক আঁজলা দিতে দিতে অনেক সময়ে প্রসাদ ফুরিয়ে যেত। তখন বাড়ির লোকের খাবারে টান পড়ত। আমার দাদাশ্বশুরমশাই একবার বাড়িতে কেউ এসে পড়লে তাকে অভুক্ত ফিরতে দিতেন না। এরকম বেশির ভাগ দিনেই শাশুড়ি মাকে মুড়ি খেয়ে থাকতে হত। কারণ তিনি শেষে খান বলে, তাঁর ভাগটা পড়ে থাকত, বাকিরা—মানে বাচ্চারা আর পুরুষেরা—আগে খেয়ে নিত। কোনো কোনো দিন এমনও গেছে, এত লোক এসেছে, মুড়ির টিনও বুভুক্ষু মানুষের পাতে ঢেলে দিয়ে তিনি জল খেয়ে থেকেছেন। যা হোক, এখন দিনকালের পরিবর্তন হয়েছে। ঐ মাত্রার দারিদ্র এসব অঞ্চলে অনেকটাই কমে গেছে। এখনও রঞ্জা বা কর্ণা খেতে বসে কোনো খাবার পাতে ফেলে রাখলে ওদের বাবারা খুব রাগ করে। ছোটবেলায় মন্দিরে বুভুক্ষু মানুষের সারি – ভাতের জন্য অপেক্ষার ঐ স্মৃতি ওদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
পুজো এলেই দুই বোন কেউ হাতে খাবে না। প্রাতরাশ থেকে রাতের আহার সব খাইয়ে দিতে হবে—এমন বায়না। দুই মেয়েকে খাওয়ানো আর এক ঝকমারি। কর্ণা তাড়াতাড়ি গিলে নেয়, কিন্তু হাঁ ছোট করে রাখে, একসঙ্গে বড় গাল মুখে নেবে না। আবার রঞ্জা মুখে বড় গাল নেবে, তারপর গাল টোপলা করে বসে থাকবে গিলবে না – এত দুষ্টু। পরের গাল দিতে গেলে হাঁ করে দেখাবে মুখ ভর্তি – ধৈর্য রাখা যায় না। তারপর আবার দু’মেয়ের কাজের ধুম পড়বে। আমি যখন ঠাকুরের সামনে আলপনা দেব, তখন ওরা দু’জনও নিজের মত আঁকতে চলে আসবে। সঙ্গে থাকে আমার ধনুর্ধর দেওর। বছরের পর বছর তিনজনের হাতের যাদুতে আতপ চালের বাটা আর খড়িমাটির মিশেলে আল্পনার চারপাশে ফুটে উঠত নানা আজব বস্তু – যেমন টেলিনর টিভি কোম্পানির তিন পাপড়ি ফুল, গাছ, মেঘ, ঘোড়া, মায় কুকুর, বিড়াল, গরু যা প্রাণে চায় তাই। এই লকডাউনে ঘরে বসে বসে এসব কথা মনে পড়াতে বেশ আনন্দ হয়। তাল কাটে মেয়ের ডাকে।
- মা, আজ পুজোর দিন, বাড়িতে নাড়ু করবে?
- হ্যাঁ তা করা যায়।
- মা আজ সবরকম প্রসাদ হচ্ছে পুজো বাড়িতে, তাই না?
- হুম।
- কোন দিন কী কী হয়, একটু বল তো। মনে মনে ভাবি, যেতে তো পারলাম না।
- সপ্তমীর দিন ভোগে সাতরকম ভাজা হয়। সঙ্গে ডাল, শুক্তো, আলুপটলের ডালনা, নটেশাকের ঘন্ট, চালতার চাটনি, সিমাইয়ের পায়েস, লুচি, সুজি, চিনি আর গুড়ের নাড়ু, সন্দেশ আর ফলপ্রসাদ।
- সাতরকম ভাজা কী কী?
- যেদিন যেমন বাজারে ওঠে—চাকা চাকা গোল আলু ভাজা, লম্বা লম্বা পটল ভাজা, পাতলা করে কাটা কুমড়ো ভাজা, বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, চাকা করে কাঁচকলা ভাজা—এগুলো রোজই হবে, যতদিন পুজো চলবে। তার সঙ্গে ধর ডুমো করে ঢ্যাঁড়শ ভাজা বা ফুলকপি ভাজা হল – সব মিলে সাতরকম। অষ্টমীর দিন আর একটা বাড়বে—ধর কলমি শাক ভাজা হল, নবমীর দিন ধর এগুলোর সঙ্গে নারকেল ভাজা হল—এইরকম। সবসময়ে যে এই যা বললাম, সেগুলোই হবে, তা নাও হতে পারে। উচ্ছে ভাজা, গাজর, শিম বা কুঁদরি ভাজা—কতরকম হতে পারে। ভাজার কি আর শেষ আছে? বাড়িতে এতগুলো কলা গাছ, থোড় ভাজা হতেও বাধা নেই।
দুর্গাপুজো শেষ হতে হতে সন্ধে হয়ে যায়। তাই ঠাকুরের রান্নাঘরে যা রান্না হচ্ছে, তার থেকে কিছুটা সরিয়ে রেখে গোপীনাথের মন্দিরে অন্নভোগ দেওয়া হবে। সেটা দিয়েই দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। আর দুর্গাদেবীর প্রসাদ তো জানিস - খাওয়া হবে রাতে।
- হুম অষ্টমীতে তো খিচুড়ি,
- খিচুড়িটা গোপীনাথের ভোগ। অষ্টমীতে দুর্গাদেবীর কাছে লুচি, আট রকম ভাজা, কুমড়ো ঘন্ট, টমেটো খেজুর, কাজুবাদামের চাটনি, সুজি, সিমাইয়ের পায়েস, কলার বড়া, খই, মুড়কি, দুরকম নারকেল নাড়ু - এই হল ভোগ।
সন্ধ্যারতির সময়ে আলাদা করে কলাপাতায় জলখাবারের নৈবেদ্যতে খই, মুড়কি আর বাতাসা দেওয়া হবে। ওদিন পুজোপাঠ ঠাকুর মশাই খুব সকাল সকাল সেরে ফেলেন। আমরাও স্নান সেরে রেডি থাকি।
- হুঁ, অষ্টমীতে ছোট ঠাকুর আসে, ঢাক বাজায়। ছোট ঠাকুর কোথা থেকে আসে গো মা?
- কোথা থেকে আসে মানে? ও তো স্বপন ঠাকুরের নাতি। প্রচুর লোক সমাগম হয় তো অঞ্জলি দেবার জন্য। আজকাল স্বপন ঠাকুরের বয়স হয়ে যাচ্ছে তো, একা সব সামলাতে পারেনা, তাই নাতিকে নিয়ে আসে।
- ওখানে থাকলে তোমার শাড়ি পরতাম, এবার কিছুই হল না। সারাদিন বেশ প্রসাদ দিতে কেটে যেত। মনটা খুব খারাপ লাগছে।
- রাইকে ফোন কর, এবারে ব্রতীদের জন্য কী প্রসাদ হচ্ছে জিজ্ঞেস কর।
- করেছিলাম, এবারে লুচি, আলুর দম, মিহিদানা আর রসগোল্লা হচ্ছে। মা, অসুখটা কবে যাবে গো? আমার কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছে। ও মা, এবাড়িতে এখন মিষ্টি আনা যাবে?
- বাবাকে বল, এখন তো হোয়াটসঅ্যাপে অর্ডার দিলে মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে যায়।
- দুর্গাপুজোয় বাড়িতে কত মিষ্টি হয়!
- মিষ্টান্ন ভোগ বেশি থাকে নবমীতে, তাই ঐ দিন পুজোর ভোগ নিবেদনে একটু দেরি হয়। সব বানাতে করতে অনেক সময় লাগে। ঘরে পাতা দই, ক্ষীর, ছানা, পালো, সুজি, সিমাইয়ের পায়েস, কলার বড়া, মুড়কি, দুরকম নারকেল নাড়ু, চাটনি—মোট এগারো রকম মিষ্টান্ন। চাটনি বাদে বাকিগুলোকে বলা হয় জলসেবা ভোগ। দুর্গাদেবীর মূল ভোগে থাকে—লুচি, শুক্তো, ছোলার ডাল, ছোলা সেদ্ধ, নরকম ভাজা, নটেশাকের ঘন্ট, আলু পটলের তরকারি, আর সঙ্গে চাটনি।
- মা দুর্গাকে এইভাবেই মিষ্টি দিতে হয় বুঝি!
- যা বললাম, সেগুলো হচ্ছে তোদের বাড়ির নিয়ম। অন্য জায়গায় অন্য রীতি চলে। যে যেমন ভাবে মাকে সেবা করতে পারে তেমন করে।
- যেমন একটু উদাহরণ দাও শুনি।
- অন্য সব বাড়ির হাঁড়ির খবর তো বিশদে জানিনা। ছোটবেলায় মামার বাড়িতে শোভাবাজারের গল্প শুনেছি—সেসব অনেক এলাহি ব্যাপার।
- বল, আমি শুনব।
- মামারা বলত, ওখানে বিরাট ভিয়েন বসতো পুজোর সময়ে। গজা হত চার রকমের – দু’রকম ডুমো গজা, দুরকম জিবে গজা। দুরকম মানে ডুমো গজার মধ্যে কিছু থাকত খুব হালকা মিষ্টি। আর বাকিগুলো কড়া মিষ্টি। জিবে গজাতেও তাই।
- তারপর?
- তারপর জিলিপি, দরবেশ, মতিচুর, পান্তুয়া, নোড়া পান্তুয়া।
- দরবেশ, মতিচুর কী?
- অ্যাই তোকে শ্যামবাজারের দ্বারিকের দোকান থেকে অনেকবার দরবেশ এনে খাইয়েছি।
- কোনটা বল না।
- আরে বাবা লাল, হলুদ বোঁদে দিয়ে তৈরি লাড্ডু।
- আর মতিচুর?
- মতিচুর হল ছোট্ট ছোট্ট বেসনের বোঁদে দিয়ে তৈরি ঘিয়ের লাড্ডু। তাতে পেস্তা কুচি, কিশমিশ - এইসব থাকে। তবে এখন যেমন ছোট ছোট লাড্ডু দোকানে সাজানো দেখিস, রাজবাড়ির দরবেশ, মোতিচুর কিন্তু তেমন ছিল না। আকারে ছিল ফুটবলের মত।
- নোড়া পান্তুয়া?
- পান্তুয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। তবে নোড়া পান্তুয়া হল বর্ধমানের গৌরব। ছানা বেটে তার সঙ্গে ঘি, ময়দা, এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে হাতের চাপে বড় বড় নোড়ার মত আকার দেওয়া হয়। নোড়া গুলো ডোবা তেলে ভাজার পর ওপরের পরতটা বেশ শক্ত আর কালো হয়, কিন্তু ভেতরটা থাকে তুলতুলে। শেষে নোড়াগুলোকে রসের বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়।
- ব্যাস? রাজবাড়ির মিষ্টি শেষ?
- কে বলেছে শেষ? এরপরে আছে খাজা, ক্ষীর তক্তি, শোন পাপড়ি, লবঙ্গ লতিকা।
- ক্ষীর তক্তি! সেটা আবার কি গো মা! — কেমন খেতে ওটা?
- বাংলার প্রাচীন বনেদী মিষ্টি রে মা, আগে ঘরে ঘরে হত - দুধ ফুটিয়ে ঘন করে তাতে আতপ চাল বাটা, চিনি, এলাচ মিশিয়ে কেকের মত জমানো হয়। শক্ত হয়ে গেলে চৌকো করে কেটে নিলেই ক্ষীর তক্তি রেডি।
- বাবা, কতরকম কৌশল!
- এরপরে আরও আছে। সেসব মিষ্টির নাম শুনলে তুই ভির্মি খাবি।
- কেন কেন?
- পর পর বলছি শোন, ছোটবেলা থেকে মুখস্থ করতাম—বালুসাই, চাঁদসই, মগধ, মুটরি, সমেশা, খুরমা, সোহাগিনী, বিনোদিনী, পুরকান্তি। আর এর সঙ্গে ছিল পূর্ণচন্দ্রপুলি।
- পূর্ণচন্দ্রপুলি?
- হুম, বাগবাজারে চন্দ্রপুলি খাইয়েছিলাম, মনে করে দেখ, নারকেলের স্বাদ, আধখানা চাঁদের মত।
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
- সেই স্বাদের মিষ্টি, কিন্তু থালা ভরা গোল। তার মধ্যে কিশমিশ, পেস্তা নানা আকারে কেটে আল্পনার মত সাজানো। স্বাদে চন্দ্রপুলি, কিন্তু ছোট ছোট অর্ধ চন্দ্র নয়, থালাভরা পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র।
- কল্পনা করেই দারুণ লাগছে মা, স্বাদে না জানি কেমন হবে। বালুসাই নামটা চেনা চেনা লাগছে।
- ওটাও বাংলার এক সাবেকী মিষ্টি। ময়দা চেলে নিয়ে ঘি, টক দই, একটু খাবার সোডা দিয়ে মাখতে হয়। গোল গোল লেচি কেটে মাঝখানটা আঙ্গুলের চাপে গর্ত করে দিতে হয়। তারপর ডুবো তেলে ধীরে ধীরে কম আঁচে ভেজে নিয়ে রসে ফেলতে হয়।
- এই বালুসাইয়ের ভাই কী চাঁদসাই?
- হা হা হা, চাঁদসাই নয় রে, চাঁদসই। হ্যাঁ তা ভাই বলতে পারিস। বালুসাইয়ের বাবা হল গজা, আর চাঁদসইয়ের বাবা হল খাজা। খাজা গজা আবার দুই ভাই। তাই বালুসাই আর চাঁদসই হল সম্পর্কে জ্যেঠতুত খুড়তুতো ভাই। গোল চাঁদের সঙ্গে মানানসই খাজাই হল চাঁদসই।
- তারপর বল, সোহাগিনী, বিনোদিনী, কান্তিপুর।
- কান্তিপুর না, উলটে যাবে, পুরকান্তি। এগুলো হল পানিফলের আটার মিষ্টি।
- পানিফলের আটা? জন্মে শুনিনি।
- শুনিসনি, এখন শোন। আগেকার দিনে তো কর্ন ফ্লাওয়ার ছিলনা। তখন পানিফল শুকিয়ে গুঁড়িয়ে আটা করে খাবার বানানো হত। জিলিপিও অনেক সময়ে ময়দার বদলে পানিফলের আটায় হত।
- মিষ্টিগুলো হত কীকরে?
- কেন? ময়দা যেমন মাখে, তেমন করেই পানিফলের আটা ময়ান দিয়ে মেখে চাকি বেলনে বেলে নেওয়া হত। ছোট ছোট লুচির বা রুটির মত বেলে তার ভিতরে ক্ষীরের পুর দেওয়া হত। এবারে মোড়ার তফাৎ, নকশার তফাৎ - কোনটা প্লেন, কোনটা ধারে বিনুনি করা, কোনটা রসে ফেলা, কোনোটা শুকনো, নানারকম ফ্লেভারের তফাৎ - এসবের ওপরে নির্ভর করে নামও বদলে বদলে যেত।
- আর খুর্মা, মিষ্টির কোর্মা - ওটা বল।
- ধুর, মিষ্টির কোর্মা আবার কী? রথের মেলায় মিষ্টি মিষ্টি কটকটি গজা খাসনি মনে হচ্ছে কোনোদিন?
- উমম, খেয়েছি তো।
- ওটাই খুর্মা। আর সমেশা কী ঠিক বলতে পারবোনা। ধ্বনি সাদৃশ্যের দিক থেকে মনে হয়, সমেশা হল ক্ষীরের শিঙাড়া। আর মগধ - মুটরিটাও যে কী ঠিক জানিনা - মনে হয় নিমকি জাতীয় কিছু।
- রাজবাড়িতে তার মানে মা দুর্গা শুধু মিষ্টি খান।
- না না তা কেন? লুচি, কচুরি, রাধাবল্লভী, তরকারিপাতি সবই হয়।
- আচ্ছা মা তুমি ছোটবেলায় শোনা এত কথা মনে রাখ কীকরে বলতো?
- হুম, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় রে। ছোটবেলার স্মৃতির ওপরে ধুলোতো পড়বেই। বড়বেলায় রাজবাড়ি গিয়ে ছোটতরফের যিনি এখন সবচেয়ে বর্ষীয়ান, সেই অশীতিপর অলককৃষ্ণদেবের সঙ্গে গল্প করে আবার সব স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে ফেলেছি।
সপ্তমীতে চাঁদ উঠেছে
পড়ল মাথায় তারার জল,
ঐ চাঁদটাই গাঁয়ের বাড়ির
মাঝ পুকুরে টলোরমল।
রাত ফুরোলে মহাষ্টমী,
ফুলাঞ্জলির লাগবে ধূম -
দুই বালিকার বালিশ ভেজে
মহামারী - রাত নিঝুম।