৪
- মা লাবণ্যর সিনেমা প্রীতির কথা তো বুঝলাম, তোমার এত সিনেমার নেশা হল কীকরে সেইটা বল দেখি।
- শুধু সিনেমা কেন, সবরকম কলার মধ্যে অভিনয় বিদ্যাটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আর প্রিয় হবার কারণ সেই এক, বাড়ির পরিবেশ। আমাদের ছোটবেলায় এক হল অভিনয় আর দুই হল খেলা - এই নিয়েই বড় হলাম।
- তোমার ছোটবেলার সিনেমার গল্প বল।
- আরে তখন যুগটাই ছিল, যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন- বন্ধু বান্ধব মিলে সিনেমা দেখতে যাবার যুগ। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকে অসিত বরণ, উত্তম কুমারের সিনেমা দিয়ে হাতেখড়ি। মামার বিয়ে হল - নতুন বৌকে নিয়ে মায়ার সংসার। রবিবার এলো তো বাবা মার হাত ধরে সব্যসাচী। মাসিমণির বিয়ের কথা চলছে, নতুন পাত্রকে নিয়ে চিরন্তন। কালে কালে বাবার হাত ধরে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী, এন্টার দ্য ড্রাগন, গ্রেট এসকেপ, গানস অফ নাভারোন। অবশ্য হিন্দি সিনেমায় বাধানিষেধ ছিল। স্কুল পাশ করে কলেজ পর্যন্ত শুধু সফেদ হাতি আর পার। কলেজে উঠে ও ব্যথাও মিটে গেল। নুন শোয়ে ফুল অর কাঁটে, প্রতিবন্ধ, লমহে - আহা কীসব দিন।
- দাঁড়াও, কলেজে উঠি, তারপর আমিও যাব।
- যাবি।
- সিনেমা দেখে দেখে সিনেমা প্রীতি?
- না না তা কেন? আসল হল, চরিত্র চিত্রণ, কোন সিন কীভাবে তোলা হচ্ছে, এসবের চুলচেরা আলোচনা।
- কীরকম?
- কীরকম শুনবি? শোন তবে। ১৯৮৬ সালে মারাদোনার স্বপ্ন মাখা বিশ্বকাপ শুরুর আগে আমার বাবা কিনে আনল একটা বারো ইঞ্চি ফিলিপস টিভি। আর মামা তার কিছুদিন আগে কিনল একটা চারটে পায়াওলা দরজা খোলা টিভি টেলেরামা সুপ্রিম। ঐ দুটো টিভি ছিল আমার শিক্ষার মাধ্যম। আজকে এই কোভিড অতিমারীতে তোরা কেমন টিভিতে, ফোনে, কম্পিউটারে ক্লাস করছিস - চার দশক আগেই টিভি থেকে আমার শিক্ষা শুরু হয়েছে। যখন হাঁ করে নায়ক নায়িকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, মামা বলে দিত, পাশে সহ অভিনেতার অভিব্যক্তি দেখ।
- কেন?
- কে কেমন ভাবে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিতে পারে, সেটাই হল মুন্সিয়ানা।
- আচ্ছা তারপর?
- সাথীহারা সিনেমা হচ্ছে, নায়িকা মালা সিনহা বেদেনীর ভূমিকায় বাঁদরের খেলা দেখাচ্ছে, এদিকে মামা বলছে, এই দেখ এখন শুধু মালা সিনহার মুখে ক্যামেরা। স্টুডিওতে রাস্তা সাজিয়ে গান গাওয়ার দৃশ্য তোলা হয়েছে। আসল রাস্তায় বাঁদর খেলা যেখানে হচ্ছে, সেখানে নায়িকা নেই, নিপুণ ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
- অ্যাঁ!!
- বেশি জানার অসুবিধেও তো কম নয়। মায়ামৃগ ছবিতে বিশ্বজিত আর সন্ধ্যা রায় গাড়ি নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর বিশ্বজিত গেয়ে ওঠে মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য, আমি তো পুরো ফিদা। এদিকে মামা বলে কিনা স্টুডিওর অচল গাড়িতে বসে ওরা অভিনয় করছে, পিছন থেকে স্টুডিও কর্মীরা হেঁইও হেঁইও করে গাড়িটাকে দোলাচ্ছে, আর পাশ থেকে রাস্তার দৃশ্য সরিয়ে সরিয়ে গাড়িটা চলমান দেখানো হচ্ছে। সেদিনই ভালোলাগার দফারফা।
- হা হা হা হা, তারপর? আমি তো কস্মিনকালেও ভাবিনি এমন হতে পারে।
- তখন টিভিতে প্রতি শনিবার সন্ধেয় একটা করে বাংলা ছবি, রবিবার দুপুরে ইউ জি সি র ওপেন ক্লাসের পর আঞ্চলিক ছবি, আর রবিবার সন্ধেয় হিন্দি ছবির সম্প্রচার হত। ইউ জি সির ক্লাসগুলো খুব ভালো লাগত আমার। ওর দর্শক অবশ্য বাড়িতে আমি একাই ছিলাম। দুপুরে বেশ কিছু অসামান্য আঞ্চলিক ছবি দেখেছি। কৃষ্ণের বেশে এন টি রামা রাওয়ের ভ্রূভঙ্গি দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একমাত্র ক্লাসিকাল নৃত্যশিল্পীরাই অমন পারেন। শনিবারের বাংলা ছবি শুরু হওয়ার আগে পরিবারের সকলে মিলে গুছিয়ে বসা হত। প্রায় প্রতিটা সিনেমার আগে বড়রা একটা ইনট্রোডাকশন দিয়ে দিত যে ছবিটাতে কী কী খেয়াল করতে হবে।
- মানে?
- যেমন ধর, সিনেমা হবে সুচিত্রা সেনের শ্রাবণসন্ধ্যা। মা পাখি পড়া করিয়ে দিয়েছিল, ঐ ছবির প্রথমদিকে দেখবি সুচিত্রা সেন রোগা, খুব অল্প বয়স, শুধু বড় বড় করে তাকাচ্ছে। আর পরিবর্তনটা বুঝতে হবে, সিনেমার মাঝামাঝি সময়ে, যখন সাদা (হালকা রঙের) শাড়ি পরা রোগা সুচিত্রা সেন দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবে আর ঘরে ঢুকবে কালো (গাঢ় রঙের) শাড়ি পরা পরিণত দোহারা সুচিত্রা সেন। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সুচিত্রা যখন কাঁদবে, তখন আগের অপরিণত অভিব্যক্তি আর কান্নার পরিণত অভিব্যক্তির তফাৎ বুঝতে হবে।
- ওরেব্বাবা, এমনও হয়?
- আরও আছে, আবার শেষে শমিত ভঞ্জ যখন দিদি দিদি করে সংলাপ বলছে, ওপাশে সুচিত্রা সেন নেই, ডেট পাওয়া যায়নি। ও ছবি কুড়ি বছর আগে শুরু হয়েছিল, আর রিলিজ করেছে অনেক পরে। তাই সব আগের শিল্পীর বয়স বেড়ে গেছে। চেহারা পাল্টে গেছে। যে শাড়ি পরে সিঁড়ি দিয়ে সুচিত্রা উঠেছে, সেটা হারিয়ে গেছে। কুড়িবছর পরে আর পাওয়া যায়নি।
- ভাবা যায়! তারপর?
- বড়দের কড়া নির্দেশ থাকত, মেন পয়েন্টগুলো খেয়াল করার সময়ে গল্প করা যাবেনা, বাথরুমেও যাওয়া যাবেনা। শ্রাবণ সন্ধ্যার গল্পের নির্যাসটা ভুলে গেছি। কিন্তু যা যা খেয়াল করানো হয়েছিল, সেগুলো দিব্যি পষ্টো দেখতে পাচ্ছি। আজ এত বছর পরে আন্তর্জাল খুলে দেখলাম, ১৯৫২ সালে শুটিং শুরু হয়েছিল শেষ কোথায় ছায়াছবির। তখন মুক্তি পায়নি। সেই ছবি কেটে জুড়ে ১৯৭৪ সালে মানে বাইশ বছর পরে শ্রাবণসন্ধ্যা নাম নিয়ে মুক্তি পায়।
- ইন্টারেস্টিং, তারপর?
- জীবনতৃষ্ণা ছায়াছবিতে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে একটি আবহসঙ্গীত ছিল - বিখ্যাত গান, সাগরসঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত। ঐ গানটা দ্বিতীয় বার আছে যেখানে উত্তম কুমার ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছে আর গুনগুনিয়ে ঐ গানটাই গাইছে। ছবি দেখতে বসার আগেই মামা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল, দেখবি উত্তম কুমারের লিপে ভূপেন হাজারিকার গানটা কি অড।
- কেন, ভূপেন হাজারিকার গান ভালো লাগেনি?
- না না ভূপেন হাজারিকার ওপরে কারোর বিরূপ ভাব ছিলনা, বরং শ্রদ্ধা ছিল। আসলে উত্তম-হেমন্ত, উত্তম-শ্যামল, উত্তম-মান্না, পরের দিকে উত্তম-কিশোরকুমার শোনা আমার মামার বাড়ির কানগুলো উত্তম-ভূপেন হাজারিকা যুগলবন্দীটা মেনে নিতে পারেনি।
- আচ্ছা, বলে যাও।
- সবার উপরে সিনেমার একটা সিন দেখছি মন দিয়ে - সুচিত্রা একটা টানা রিকশোয় চড়ে উত্তম কে পথে পথে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর মা পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বলছে, 'যা তা, সব ইনডোর শুটিং', আমি তো অবাক, রাস্তার সিন ইনডোর? মা বলল, 'দেখতে পাচ্ছিসনা মাপ করা খোপ খোপ দোকান? ওটা স্টুডিও, আসল রাস্তা না।' যা হোক, এইসব শিক্ষা পেতে পেতে, একবার শুধু একটি বছর দেখতে বসেছি সকলে মিলে। অমন শেখানোর গুণে আমার চোখে একটা জিনিস ধরা পড়ে গেল।
- কী?
- উত্তম কুমার পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। পাশের সিন অনুযায়ী গাড়ি হেয়ার পিন বাঁক ঘুরছে, অথচ স্টিয়ারিং সে অনুপাতে ঘুরছেনা, মোটামুটি সোজা রাস্তার মতন।
- এ বাবা! কিন্তু উত্তম কুমারের এমন ভুল।
- ভুল উত্তমের না। মামা বলল এডিটিং এর ভুল। উত্তম স্টুডিওতে বসে স্টিয়ারিং এ হাত রেখে এক্সপ্রেশন দিয়েছে। সে জানেনা পাশে কী সিন যাবে।
- আচ্ছা, তাজ্জব ব্যাপার।
- যে রবিবারে ছোটি সি মুলাকাত দেখানো হল, সেদিন বাড়িতে তুমুল আলোচনা শুরু হল, বম্বেতে মানে তখনও মিডিয়া বলিউড শব্দটা তৈরি করেনি, উত্তম কুমারকে লস খাওয়ানোর জন্য কে কীভাবে অসহযোগিতা করেছিল। এই নিয়ে কিছুদিন চলল। আমি ও পরিষ্কার দেখলাম উত্তম কুমার বৈজয়ন্তীমালার পাশে নাচে ফেল। আর সেটা ঢাকতে নাচের সময়ে উত্তমের মুখের উপর ক্যামেরা, তবে সেই ভুবন ভোলানো হাসিও আড়ষ্ট।
- গল্পটা কী?
- গল্পটা একটা বাংলা উপন্যাস -অগ্নিপরীক্ষা, আশাপূর্ণা দেবীর। খুব ছোটবেলায় সুচিত্রার চরিত্রের বিয়ে দিয়েছিলেন তার ঠাকুমা। কিন্তু মা বাবা মেনে নেয়নি। সেই ছেলে বড় হয়ে উত্তমকুমার হয়। তারপর অনেক বিধির বিধান পেরিয়ে মিল হয়। বাংলাতেও ঐ গল্পে সিনেমা হয়েছে - হিট সিনেমা।
- তুমি দেখেছ?
- হ্যাঁ, বাংলা অগ্নি পরীক্ষা দেখেছি আবার ইস্কুলের লাইব্রেরিতে আসল বইটাও পড়েছিলাম। বয়ঃসন্ধিতে সেই বই, প্রেমের উপাখ্যান মনে ঝড় তুলেছিল।
- আমার ও একটু একটু অমন হয়েছিল মা বাগি দেখে।
- বাগি?
- মার্শাল আর্ট, টাইগার শ্রফ মা, আর শ্রদ্ধা কাপুর।
- আর লোক পেলিনা?
- চুপ, অমন বলবে না, তুমি তোমারটা বল।
- তাই বলি। বাংলা ছবিটা ঐ উপন্যাসের পুরোটা না হলেও পাশে রাখা যায়, তবে ঐ গল্পে ছোটি সি মুলাকাত পাতে দেবার যোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু জানিস, আজ এই বয়সে যখন ঐ ছবি দেখতে বসি, চল্লিশের উত্তমকে দেখে ছোটবেলার সমালোচক মন পিছিয়ে যায়। পঞ্চাশ পেরিয়ে আমার বড্ড মায়া লাগে। ঐ মুখের ওপরে মামার বাড়ির ছায়া ভাসে। মনে মনে লাবণ্য, কৃষ্ণা, শারদা, মানে দিদা, মা আর আমি এক দোলনায় দুলি।
- হুঁ, জাস্টিফায়েড।
- জানিস, আমার মাসিরা সবসময়ে উত্তম কুমারের শুটিং দেখতে যেতে চাইতো। কিন্তু মামা বারণ করত। বলত যে সাদা কালো ছবির মেকআপ বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে অবাস্তব মনে হয়। কাজল পরা, ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া উত্তম কুমারকে সামনে থেকে দেখলে স্বপ্ন ভঙ্গ নিশ্চিত। ওসব করা হয় সাদা কালো পর্দায় স্পষ্ট দেখানোর জন্য।
- এ বাবা! মামা দাদু যদি আজ থাকত আরও কত গল্প শুনতে পেতাম।
- সে তো বটেই, আর শুধু কি বাংলা সিনেমা! মামা ইংরেজি সিনেমার এমন ফ্রেম বাই ফ্রেম গল্প বলত, যে সিনেমাগুলো যে দেখিনি শুধু শুনেছি, সেটা মনে থাকতনা, যেন দেখেছি মনে হত।
- কোন সিনেমা?
- এরল ফ্লিনের রবিন হুড, গ্রেটা গার্বোর মাতাহারি, গ্রেগরি পেকের রোমান হলিডে।
- এগুলো এখন দেখতে পাওয়া যায়?
- কেন যাবেনা? ইন্টারনেটে সব আছে। কিন্তু তখন তো আর ইন্টারনেট ছিলনা। তাছাড়া শুধু তো সিনেমা নয়, যাত্রা থিয়েটারের গল্পও মামার কাছে কম ছিলনা।
- বল বল।
- মামার দল ছিল অনামী যাত্রা ইউনিট। বিশ্বরূপা থিয়েটার হলে মামার যাত্রাপালা দেখেছি হ্যানিম্যান। সারকারিনায় দেখেছি কালকেউটের বিষ। এছাড়া খুব জনপ্রিয় হয়েছিল লালকুঠি। হ্যানিম্যান পালা হোমিওপ্যাথির জনকের জীবনী নিয়ে তৈরি। সেখানে হ্যানিম্যানের মেয়ে এমিলির চরিত্রে অভিনয় করতো দুটি মেয়ে। একজন বড় বয়সের, একজন ছোটো বয়সের। ছোটো এমিলি করতো নীলোৎপল দের মেয়ে। উনি এখনও অভিনয় করেন। টেলিভিশনের সিরিয়ালে।
- নীলোৎপল দে কে?
- নীলোৎপল দে ঐ দলে যাত্রা করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে পুলিশ অফিসার, ওনার ডাকনাম ছিল সাহেব। ওনাকে সুপ্রিয়া চৌধুরীর সিস্টার সিনেমায় পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় দেখেছি। ওটা ছাড়াও উনি বহু বাংলা ছবিতে পুলিশ সেজেছেন। এমনকি সত্যজিতের একমাত্র ব্যোমকেশ - ছবি চিড়িয়াখানায় সেজেছিলেন ইনস্পেক্টর বরাট।
- তারপর?
- মামা আমাকে ছোটবেলায় বলেছিল আমাকে দিয়ে ছোট এমিলির চরিত্র করাবে। সে অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি। তবে আমার আক্ষেপ থেকে গেছে। কালকেউটের বিষে মামা একাই তিনটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিল।
- বা-বা!
- প্রথম জন অ্যাটাচি নিয়ে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, একটা সংলাপ মনে পড়ে, "শুধু নুন জলেই যদি হত গলা পরিষ্কার, ট্যাবলেট, সিরাপ, ডিসপিরিনের হতো না আবিষ্কার" - আসলে যাত্রার আগে মামা বাড়িতে এইসব সংলাপ মহড়া দিত। আর আমার মুখস্থ হয়ে যেত। আমি ও নিজের ঘরে, নিজের মতো যাত্রা করতাম।
- হে হে, ভাল তো, ওই জন্যেই তুমি নকল করা শিখেছ।
- দ্বিতীয় চরিত্র মনে হয় সার্কাসের জোকার আর তৃতীয় জন চানাচুর ওয়ালা যে নেচে গেয়ে চানাচুর বিক্রি করে।
- মামা দাদু স্টেজে নাচতো?
- হ্যাঁ, ঐ যাত্রায় মামাকে নাচতে দেখেছি। মামা পুজোতে যাত্রা পালার দল নিয়ে কয়েকবার বম্বে গিয়েছিল। প্রথমবার গিয়ে বম্বে থেকে মামা সকলের জন্য কিছু না কিছু এনেছিল। আমার জন্য এনেছিল আপেল বীজের লম্বা মালা। ওটা ছিল আমার কাছে মুক্তোমালার সমান।
- সে তো হবেই, আদরের ভাগ্নি।
- তখনকার দিনে আকাশ বাণী কলকাতা ক-এ সন্ধ্যে ছটা আটত্রিশ মিনিটে যাত্রা সম্প্রচার হতো। বেশ কয়েকবার মামার অভিনীত যাত্রাপালা সম্প্রচারিত হয়েছিল।
- দারুণ ব্যাপার! কিন্তু একটা কথা বল, যে যাত্রা করে, সে কীকরে সিনেমার খুঁটিনাটি জানল?
- জানল, কারণ, কাজ করে শিখেছে। মামা তো ষাটের দশকে টালিগঞ্জের ফিল্ম স্টুডিওতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের কাজ করত। ১৯৬৭ তে মুক্তিপ্রাপ্ত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিস প্রিয়ংবদাতে শেষ কাজ করেছিল। তারপরে কাশীপুর গান সেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়ে যায়।
- ফিল্ম স্টু-ডি-ওতে চাকরি পেল কীকরে?
- আত্মীয় স্বজনের সূত্রে। আসলে আমার মায়ের মেজ পিসির বিয়ে হয়েছিল হাটখোলা দত্তদের এক শরীক শোভারাম দত্তের ছেলের সঙ্গে। শোভারাম দত্তও বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ওনারা হলেন বিডন স্ট্রিটের দত্ত। ওনাদের বাড়ি ছিল এখন যেটা রবীন্দ্র কানন বা বিডন স্কোয়ার, ঠিক তার উল্টো দিকের বাড়িটা। এখনো কলকাতার ইহুদি মার্কেট মানে কলেজ স্ট্রিট এর বড়ো বাটার পিছনে যে দোকান গুলো রয়েছে সেগুলোর মালিকানা ওনাদের। এখনও ঐ মার্কেট এর দোকান গুলোর অ্যাকাউন্ট্স দেখেন আমাদের এক জামাই বাবু। তাছাড়া কলেজ স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণীর মার্কেটের ভিতর কিছু দোকান, বাড়ি মালিকানাও আছে। কলকাতায় ওনাদের বেশ কিছু বাড়িতে অনেক অফিস ভাড়ায় আছে। ছোটপিসি দিদার একটি মাত্র ছেলে। তার নাম প্রতুলচন্দ্র দত্ত। ঐ বাড়িরই ছেলে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সলিল দত্ত। সেই সূত্রেই মামা ফিল্মে কাজ পেয়েছিল।
- তুমি কখনও স্টেজে অভিনয় করেছ মা?
- ইস্কুলে করেছি। আমার প্রথম মঞ্চাভিনয় বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুলে কিন্ডারগার্টেনে বার্ষিক অনুষ্ঠানে সমাজবন্ধু নাটকে। ওখানে আমি আর ক্লাসমেট সৈকত হয়েছিলাম ছুতোর মিস্ত্রি। রিহার্সাল অনেক হয়েছে, কিন্তু স্টেজে একটা মুশকিল হয়ে গেল। আমি মঞ্চে প্রথম ঢুকেছি, পিছনে সৈকত। বেরোনোর সময়ে ও আগে বেরোবে, পিছনে আমি। গান হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সৈকত বেরোয়না। শেষে আমি এক হাতে নেচে নেচে অন্যহাতে সৈকতকে ধরে বার করলাম। অভিভাবকে পূর্ণ রঙ্গনা হল তো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। মায়ের কাছে সেই গল্প শুনে মামা আমাকে কোলে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করল, আর বলছিল, দেখ খুকু, তোর মেয়ে কেমন স্টেজ ফ্রি। কোন মামার ভাগ্নি দেখতে হবে তো। আর আমাকে বলছিল, ওরে তোর আগের চার পুরুষ অভিনয় করেছে, তুই তো পারবি। তোর মধ্যে রক্ত কথা বলছে।
- হুম ম।
- মামা আমাকে অভিনয় ও শিখিয়েছে। ক্লাস ওয়ানে আমি নিবেদিতা ইস্কুলে ভর্তি হই। মা তখন ওখানেই প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষিকা। প্রতি বছরেই কোন না কোন নাটক হত।
- তুমি কী কী করেছ মা?
এই প্রশ্নের সরাসরি আর উত্তর দিতে পারিনা। মনটা উথাল পাথাল করে। আমি হাসি, বলব কী, সব কথা কী বলা যায়, কিছু অনুভূতি থাকে কেবল নিজের একান্ত। অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল, সব বাচ্চাদের যেমন হয়। অরুণ বরুণ কিরণমালাতে সোনার পাখি, ডাকঘরে গ্রামের ছেলে, হ য ব র ল তে দুষ্টু বেড়ালটা, তোতা-কাহিনীতে লিপিকর। ক্লাস টেনে বার্ষিক অনুষ্ঠানে স্কুলে গৈরিক পতাকা নাটকে আমি হলাম শিবাজীর গুরু সন্ন্যাসী রামদাস স্বামী। সেখানে স্কুলের দিদি ভজনের সময়ে আমাকে লিপ দেওয়ার যে ডিরেকশন দিয়েছিলেন, মামার সেটা পছন্দ হয়নি। শুধরে দিয়ে কী করতে হবে শিখিয়ে দিয়েছিল। আমি চুপচাপ ড্রেস রিহার্সালের দিন সেটাই করলাম। মানে ঐ নতুন অভিব্যক্তিটা দেখালাম। সবাই তো আপ্লুত। তাছাড়া ড্রেস রিহার্সালের দিন আমাকে বাঙালিদের মতো করে গেরুয়া ধুতি পরানো হয়েছিল। মামা জেনে বলল যে মারাঠি সাধু ওভাবে ধুতি পরবেনা। ধুতি দুভাঁজ করে সামনে বড় কুঁচি দিয়ে লুঙ্গির মতো করে পরতে হবে। ফাইনাল স্টেজের দিন আমি কারোর কাছে না গিয়ে ওভাবেই ধুতি পরেছিলাম। যাই হোক নাটক ভালো ভাবেই উৎরে গিয়েছিল। প্রাইজও পেয়েছিলাম। আজ মাও নেই, মামাও নেই। শুধু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে এমন গ্রুমিংয়ের জন্য আমি বিভিন্ন লোককে নকল করতে পারতাম। তবে বন্ধুরা সবচেয়ে পছন্দ করতো যখন আমি সুচিত্রা সেনের নকল করতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল উত্তর ফাল্গুনীর সংলাপ - মনীশ আমার ঘর চাই, তোমাকে চাই, আমার সুপর্ণাকে বুকের পাশটিতে চাই। আমার এম এস সির এক বন্ধু অশোক বলতো, কেন ভূগোল নিয়ে সায়েন্স কলেজের দেওয়ালে মাথা কুটছিস। তোর জায়গা মঞ্চে। ওখানে যা। বুড়ো বয়সে একবার কন্যাকে নিয়ে সায়েন্স কলেজে রি ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। বন্ধুদের নজর আমার ওপর পড়তেই তারা হৈ হৈ করে উঠল - 'ওরে বাবা আমাদের ছুছিত্রা সেন এসে গেছে রে। নে কোনো কথা নয় শুরু কর, মনীশ - শুরু কর, শুরু কর, জলদি।' মেয়ে চুপ করে শুনছিল। বাড়িতে এসে ফেটে পড়ল, মা! তুমি তোমার বন্ধুদের সুচিত্রা সেন? আর আমাকে কোনদিন বলোনি? আমি হাসি, বলবো কাকে? শুনতে চেয়েছে কেউ? যে অভিনয় এত ভালোবাসি, সেটাই তো আর এগোলনা এ জীবনে।
- ও মা! কী ভাবছ? এত যে সিনেমা থিয়েটারে যেতে খ্যাঁটন কিছু হতনা?
- হত বৈকি। তবে কী জানিস সিনেমা দেখে ফেরার পথে খুব একটা বাইরে খাওয়া হতনা। টুকটাক হত। হলের মধ্যে রাস্তার তুলনায় তিনগুণ দামে প্যাকেটে পপ কর্ন পাওয়া যেত। খুব বায়না করলে কখনও কিনে দিত বাবা।
- এখনকার পি ভি আর, আইনক্সে যেমন হয়।
- না না, ঐসব খাবার নয়, সাধারণ হকারেরাই ফিরি করত, ছোলা মটর, চিপস, পপ কর্ন। ফেরার পথে ফুটপাতের দোকান থেকে সরবত বা কোকোকোলা।
- ব্যাস!
- হুম, ভালো একটু খাওয়া দাওয়া হত থিয়েটার দেখে ফেরার পথে। কাঁটা চামচ দিয়ে ফিশ ফ্রাই, মোগলাই পরোটা। নিদেনপক্ষে ডালপুরি, হিঙের কচুরি বা ধোঁকা।
- সিনেমা দেখে এসব খাওয়া হতনা কেন?
- আসলে মনে হয়, সিনেমা দেখতে অনেক বড় দল মানে অনেকে মিলে যাওয়া হত তো, অতজন দোকানে খেতে মনে হয় কর্তাদের বাজেটে কুলোতনা। থিয়েটার মা বাবা আমরা দুবোন যেতাম। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা
- হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই হবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র বলতে?
- মানে খুব জনপ্রিয় কোন প্রোডাকশন। তখন সবাই যাওয়া হত - মামা, মাসি, প্রতিবেশী।
- জনপ্রিয় কোনটা?
- যেমন ধর নহবত, অঘটন, অমর কণ্টক। তবে আমার চোখে ভাসে থিয়েটার হলেই দেখা নটী বিনোদিনী আর মা মাটি মানুষ নামের দুটো যাত্রা। আর আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি ছিল কী জানিস?
- কী?
- উত্তম কুমারের শ্যামলী আর কেয়া চক্রবর্তীর ভালো মানুষ। মা প্রায়ই ভালো মানুষের গান গাইত। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার।
"আমি যখন মেয়ে থাকি
তখন তাঁরা আসেন এবং
মুচকি মুচকি হাসেন এবং
খুকখুক করে কাশেন এবং
তোতলাতে তোতলাতে
বলেন ভালোবাসি।
আমি যখন ছেলে থাকি
তখন তাঁরা আসেন এবং
হাতজোড় করে বসেন এবং
সন্তর্পণে কাশেন এবং
কথা শেষ হবার আগে
বলেন এখন আসি।"
- হা হা হা হা, এ কেমন গান! দিদা এত ভালো বাসত, মানে কেয়া চক্রবর্তী দারুণ অভিনেত্রী ছিলেন - তাই না?
- সে তো নিশ্চয়ই। একটা মায়াও ছিল। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে, শুটিং করতে গিয়ে জলে পড়ে মারা গেলেন তিনি। সে মৃত্যুর কিনারা হয়নি।
- মানে?
- মানে এটা দুর্ঘটনা, নাকি আত্মহত্যা নাকি কেউ ঠেলে ফেলে মেরে ফেলেছে তার উত্তর এখনও সবাই খুঁজছে। আমার খুব মনে পড়ে জানিস, সবাই হতভম্ব, কাগজে দিনের পর দিন নানা রিপোর্ট বেরোচ্ছে, আর মার সেকি কান্না।
- সে কী? মা মানে?
- আমার মা। কেয়া চলে গেছেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, মানে মায়ের প্রায় সমবয়সী, একটু বড়। আর জানিস, কেয়ার মায়ের নামও লাবণ্য। এই লাবণ্যও স্বামীর অত্যাচারে সংসার করতে পারেননি। বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। বাগবাজারে থাকতেন।
- ইশশ, এত কষ্ট সয়েও সন্তানের মরামুখ দেখতে হল! ভগবানের কী বিচার।
- অনেকগুলো সন্তানের মরামুখ আমাদের লাবণ্যকেও দেখতে হয়েছে রে। মামা গল্প করত। একটা ছোট ভাই মরে গেল, মা পাগলের মত মরা ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবা এসে বলল, 'আর ন্যাকামি করতে হবেনা। ওঠো চা কর। সন্ধের টাইম, সবাই এসে যাবে।'
- কী বললে, বিকাশ চন্দ্র?
- হ্যাঁ, মা গল্প করত, লাবণ্য খুব নিষ্ঠাভরে পুজো করত সকালে। একদিন এলাচদানা, বাতাসা, গুঁজিয়া কিছুই নেই, তাই বাজার থেকে আনতে বলেছিল। সেই শুনে বিকাশ চন্দ্র ছোট একটি সন্তান, সবে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাকে বলেছে যা রাস্তার ময়লা তুলে ঠোঙায় ভরে মা পুজো করছে - হাতে দিয়ে আয়। শিশুটি তাই করেছে। লাবণ্যও কেঁদেছিল সেদিন।
- চুপ কর মা, আমি সহ্য করতে পারছিনা। এত অপমান!
- অপমান, নারীত্বের অবমাননা। রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন আছে জানিস - অন্যের হাতে অস্ত্র না থাকলে, নিজের অস্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। সেযুগের পুরুষগুলো বৌদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলত। অবশ্য সেযুগই বা বলি কেন, সব যুগেই একথা সত্যি।
- তাই নিজের হাতে অস্ত্র রাখতে হয়। কিন্তু কী অস্ত্র রাখব?
- প্রথমত পড়াশোনা, তারপর নিজের দক্ষতা চিনে তাকে ধারালো ইস্পাতের তলোয়ার তৈরি করতে হবে। ভালোমানুষের গানটা শিখিয়ে দেব তোকে।
"এই দুনিয়ায় কড়া হলে
তবু কিছু পাবেন এবং
কিছু করে খাবেন এবং
মাথা তুলে যাবেন এবং
সম্মান টম্মান পাবেন
কাঁড়িকাঁড়ি।
নরম হলে সবই যাবে
প্রাণও যাবে মানও যাবে
জানও যাবে কানও যাবে
কড়ালোকে বেশি খাবে
আপনার গলায় ঝুলিয়ে
দেবে হাঁড়ি।"