৬
"জেনে কি বা প্রয়োজন
অনেক দূরে বন
রাঙা হ'ল কুসুমে, না,
বহ্নিতাপে?"
- আজ লাবণ্যর লড়াইটা পুরো শুনে তবেই উঠবো মা।
- একটু গুছিয়ে নিই তবে। এ বড় কঠিন কাজ রে বাবু, তোকে নিরপেক্ষ বয়ান দেওয়া - যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বেদনা।
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি?
- সব গেছে, দেবে কী করে?
- গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল,
- আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’
- যাঃ জানা হলনা তবে?
- জেনেছি, কিছুদিন পরে। ক্লাস টেনে আমি সংস্কৃত ঐচ্ছিক নিলাম। আসলে এমনিতেই আমাদের ইস্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে সংস্কৃত পড়ানো হত। শ্লোকের ছন্দ খুব ভালো লেগে গেল। মা ইস্কুলে বাংলা পড়াত। সংস্কৃতেও অনায়াস দখল ছিল। মায়ের কাছে বাংলা, ইংরেজি আর সংস্কৃত তিনটে ভাষাই পড়তাম।
- তার মানে কোন বিদেশি ভাষা নয়, কৃষ্ণার প্যাশন ছিল সংস্কৃত?
- হ্যাঁ, তা বলতে পারিস। মায়ের লেখার হাত যেমন চমৎকার ছিল, তেমন সুন্দর উচ্চারণে আবৃত্তি করতে পারত। যখন আমি কলেজে পড়াতে শুরু করেছি, তখনও আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোন প্রোগ্রাম হলে মা স্ক্রিপ্ট লিখে দিত।
- মানে তুমি ঘাড়ে চাপিয়ে জোর করে লেখাতে।
- অনেকটা সেরকম, আমি একটা লেখার চেষ্টা করতাম। সেই কাঠামোটা বুঝে নিয়ে, মা সহজ অথচ মধুর ভাষায় লিখে দিত।
- আমি দিদাকে এইভাবে পেলাম না মা, খুব আফশোস হচ্ছে। তারপর বল।
- আমাদের ইস্কুলে প্রতি বছর আন্তঃশ্রেণী প্রতিযোগিতা হত।
- কীসের?
- গান, আঁকা, আবৃত্তি সবকিছু।
- আচ্ছা!
- ক্লাস টেনে, আমাদের সংস্কৃত ঐচ্ছিক গ্রুপের জন্য দীপ্তিদি সংস্কৃত রামায়ণের একটা অধ্যায়ের অংশবিশেষ আবৃত্তির জন্য দিলেন। রাবণকে হারিয়ে দিয়েছেন রামচন্দ্র। সীতাকে অশোকবন থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু রাম সীতার সতীত্বের পরীক্ষা নেবেন। অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। কুন্ডে আগুনের লেলিহান শিখার সামনে সীতা একের পর এক প্রশ্নে ফালাফালা করে দিচ্ছেন পিতৃতন্ত্রকে। মা আমাকে স্বরের ওঠানামা করে বলতে শিখিয়ে দিয়েছিল। ঐ অংশটা আবৃত্তি অভ্যাস করতে করতে শিরায় আগুন ধরে যেত আমার।
- আমাকে পড়াবে মা ঐ অংশটা? আমিও বলব ওভাবে।
- খুঁজে দেখতে হবে, ইন্টারনেটে যদি পাই, নিশ্চয়ই পড়াব। তাছাড়া দীপ্তিদি এখনও বেঁচে আছেন। উনি মায়েরও টিচার। দীপ্তিদির মেয়ে সুদক্ষিণাদিও আমাদের পড়িয়েছেন ইস্কুলে, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ওঁদের কাছেও পাব।
- আচ্ছা, তুমিও তো নিবেদিতা ইস্কুলে একসময় পড়িয়েছ মা। ওখানে বুঝি বংশ পরম্পরায় পড়ানো হয়?
- মিশনারি স্কুল তো, কোন দরকার পড়লেই প্রাক্তনীরা কিছুদিন সার্ভিস দিয়ে দেয়।
- আমি মজা করছিলাম, যা হোক, তারপর?
- মাধ্যমিকের আগে একদিন পড়তে ভালো লাগছিল না। গল্পের বইগুলো আলমারি থেকে নামিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। হঠাৎ মায়ের নবম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার প্রাইজের বইটা বেরিয়ে পড়ে। সালের দিকে নজর পড়ল, ১৯৬৩ সাল। মাকে ডেকে বললাম
- 'মা - আ! তুমি ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছিলে?
- না। আমাদের মাধ্যমিক নয় হায়ার সেকেন্ডারি। একেবারে ইস্কুলেই ইলেভেন অবধি পড়ে, তারপর কলেজ।
- ও তার মানে ১৯৬৫ সাল।
- না রে আমি পাশ করেছি ১৯৬৭ সালে। তুই ৮৭ তে পরীক্ষা দিবি। আমি ঠিক কুড়ি বছর আগে পরীক্ষা দিয়েছি।
- মাথাটা গেছে তোমার মা। নবম শ্রেণীতে এই তো লেবেলে লেখা আছে ১৯৬৩।
মায়ের হাসিটা খুব করুণ দেখায়।
- দুবছর পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার।
- এ্যাঁ, ওহ্ তোমরা যখন গরীব হয়ে গিয়েছিলে, তখন? পরে বলব করে করে তো ক্লাস টেনে উঠে গেলাম। কি হয়েছিল খুলে বলবে এবার? একটু শুনি।
- শুনবো বললেই তো শোনা যায়না মা। তার জন্য মন প্রস্তুত করতে হয়।
- আমি বড় হয়ে গেছি মা। কি বুকে চেপে রেখেছ, নিঃসঙ্কোচে বলো। আমি শুনতে প্রস্তুত।'
- তারপর?
- তারপর মা বলল, - 'জানিস তো তোর দিদা হল দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ভারতী তোর বড়মামার জন্মের একবছরের মাথায় মারা যায়। ছোট বাচ্ছা দেখবে কে? দাঁতিদা তখন আমার মায়ের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বাবার আবার বিয়ে দেয়। তার পরে মা বাবার একে একে এগারোটি সন্তান হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সন্তান শিশু বয়সে মারা যায়। ছোড়দা, আমি আর তোর দুই মাসি - এই চারজনই বেঁচে রইলাম। আর বড়দা ছিল, আমাদের সৎ দাদা। মা শোকে তাপে পাথর হয়ে গিয়েছিল। গান, হাতের কাজ, পড়াশোনা এগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিল। সংসারে থেকেও অন্যরকম মানুষ ছিল। আমরা বড় হচ্ছিলাম। বড়দার বিয়ে হল। তারপর বাবার যে কি হল। কান পাতলা লোক ছিল। কেউ কানে ফুসমন্তর দিয়েছিল হয়তো। বাবার হঠাৎ ধারণা হল, সৎ ছেলে বলে মা বড়দার দেখাশোনা করছেনা। কিন্তু মা অমন মানুষ ছিলনা। চিরকাল মুখ বুজে বাবার সব তান্ডব সয়ে এসেছে। এবারে মা প্রতিবাদ করল। কিন্তু ফল হল সাংঘাতিক। বাবা মায়ের হাত থেকে ভাঁড়ারের চাবি কেড়ে নিল। চাল, ডাল সব একটা ভাঁড়ারের আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা চাবি দিল। আমরা না খেয়ে রইলাম।
- সে কী! এমন ও হয়?
- হয়। আমাদের জীবনে হয়েছিল। তোর মাসিরা তখন ছোট। খিদেতে কান্নাকাটি করত। ছোড়দা পাশ দিয়েছে। আর আমি নাইনে পড়ি। রোজ অফিস যাবার আগে, আমরা চার ভাইবোন আর মা বাদে, যতজন ছিল, তাদের মতো চাল বার করে দিয়ে, চাবি নিয়ে বাবা অফিস চলে যেত। কয়েকদিন পরিচারিকারা বাড়ি থেকে কিছু খাবার এনে খাইয়েছিল।
- দাদুভাই কী চাইছিল? অপবাদ স্বীকার করে নিয়ে আত্মসমর্পণ?
- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাই। ভুল স্বীকার করলে নিজে হেরে যাবে। বাবা হার স্বীকার করতে জানতোনা।
- পাশে তো সেনবাড়ি ছিল, তাঁরা কিছু বলেননি?
- সেনবাড়ি জানতে পারেনি। মায়ের মনে অভিমানের পাহাড় জমেছিল। তাই মনে হয়, কিছু বলেনি। তবে আমার এখন মনে হয় বললে ভালো হত। ওবাড়িতে গুরুজনেরা ছিলেন। বাবাকে শাসন করতে পারতেন। তবে ঐ সময়ে সেনবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা একটু টাল খেয়ে গিয়েছিল।
- কেন?
- আমরা তো দাঁতিদার বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, বাবা অত টাকা ওড়াতো, কিন্তু বাড়ি ভাড়া দিতনা। শেষে যখন অনেক টাকা বাকি পড়ল, তখন মায়ের হাতের ভারি ভারি চুড়িগুলো বেচে বাড়িভাড়া দিয়ে দিল। মা তাতে খুবই দুঃখ পেয়েছিল। গয়না যে শুধু সম্পদ তা তো নয়। অনেক স্মৃতি থাকে। হয়তো মায়ের মায়ের, বা দিদার, ঠাকুমার বা অন্য কারোর স্মৃতি ছিল। আর কি একটা ছুতোয় বাবা দাঁতিদার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে দিল। ও বাড়ি ডাকসাইটে জজ, ব্যারিস্টার, অ্যাটর্নিদের বাড়ি। সবসময়ে আমাদের উপকার করেছে। আত্মীয়দের মধ্যে ছুটকো কারণে এই মামলা করাতে সেনবাড়ির লোকেরা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল। আর অন্দরে মেয়েতে মেয়েতে তো সম্পর্ক থাকে। বাবার এই মামলা করার জন্য মা সেনবাড়িতে মরমে মরে গিয়েছিল।
- দাদুভাই কি পাগল ছিল? এমন কেউ করে? ছি ছি।
- হ্যাঁ তা ছিটগ্রস্ত তো ছিল, একথা হলপ করে বলা যায়।
- তারপর?
- দাঁতিদার বাড়ি ছেড়ে বাবা আমাদের নিয়ে কাশীপুর লকগেট রোডে ভাড়াবাড়িতে উঠে আসে। ঐ বাড়িতেই এই ঘটনা ঘটে।
- ওহ, বাড়ি বদল হয়েছিল, তাই সেনবাড়ির লোক সামনাসামনি ঘটনাটা দেখতে পায়নি। তারপর?
- তারপর মা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আসলে মা তখন সহ্যের শেষ সীমায় চলে গিয়েছিল।
- কি সে সিদ্ধান্ত?
- আমাদের বাড়ির এক রাঁধুনির কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে, মা আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে, কাশীপুর থেকে অনেক দূরে অশোকনগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে চলে যায়। পড়ে রইল মায়ের গেরস্থালি, আর সেই শ্বেত পাথরের টেবিল, বিয়ের যৌতুকে পাওয়া।
- কিন্তু সংসার চলল কীকরে? আর দাদুভাই খোঁজ করেনি?
- যেদিন আমরা বাড়ি থেকে চলে যাই, সেদিন অফিস থেকে ফিরে, নাকি কাউকে দেখতে না পেয়ে আমাদের নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি করেছিল। পরে শুনেছি।
- আচ্ছা, সংসার খরচটা?
- তখনই আমার মেজপিসির বাড়ির ছেলে চিত্র পরিচালক সলিল দত্তকে ধরে ছোড়দা টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় সহকারী পরিচালকের কাজ জুটিয়ে নেয়। কোনো মাস মাইনে ছিলনা। যেদিন কাজ, সেদিন পয়সা। কতদিন হয়েছে, সারাদিন হাঁড়ি চড়েনি। ছোড়দা রাতে চাল কিনে এনেছে, তখন সবাই খেয়েছি। এইসময়েই আমাদের তিন বোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
- আবার শুরু হল কী করে?
- ইস্কুলে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী খোঁজ করছিলেন, আমরা তিনবোন গেলাম কোথায়। বছর দুয়েক বাদে খোঁজ পেয়ে তিনি বাড়িতে লোক পাঠান। ট্রেনে করে অনেক দূরের পথ। কিন্তু তিনি বাধ্য করেন আবার পড়াশোনা শুরু করতে। ভোরে বেরোতে হত। ইস্কুলে হোস্টেলে ভাত খেতাম। লক্ষ্মীদি মানে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রোজ রোজ খেতে লজ্জা করত। মাঝে মাঝে বলে দিতাম খেয়ে এসেছি। সেদিন সারাটা দিন উপোস।
- বুঝলাম, এইজন্য তোমাদের সব বোনেদের, মামার গ্যাস্ট্রিক আলসার ধরেছে। তারপর?
- তারপর আর কি, ইস্কুলের দিদিদের একটা আশা ছিল যে, আমি স্কুলের শেষ পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হব। কিন্তু হতে পারলাম না। যা হোক একটা ফল হল।
জানিস পাশ করার পর বাবার অফিসে ফোন করেছিলাম স্টেশন থেকে। বাবা একটা কথা বলল, ফার্স্ট হয়েছ? আমি যেই বললাম না, অমনি ফোন কেটে দিল। হ্যাঁ রে, ফার্স্ট হতে গেলে বাড়িতেও একটা পরিবেশ দিতে হয়, বাবা কি জানতোনা?'
মায়ের গলা বুজে আসে, মায়ের মাথায় হাত বোলাই। বলি,
- 'যা গেছে তা গেছে মা, ক্ষমা করে দাও।'
মা চোখ মোছে। বলে,
- 'ক্ষমা করে দিয়েছি রে মা। বাবা স্যাক্সবি থেকে অবসর নেবার পর, কপর্দক শূন্য হয়ে তো আমাদের কাছেই চলে এসেছিল। সঞ্চয় তো করেনি কোনদিন। বলতো, টাকা যে কোনদিন না থাকতে পারে, একদিন যে রিটায়ার করতে হবে, এমন কথা কখনো মাথায় আসেনি। বড়দা তখন ফায়ার ব্রিগেডের চাকরি নিয়ে উত্তর বঙ্গে। দেখারও কেউ ছিলনা। শেষ বয়সে রাতে গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, ছোড়দা কখন ফিরবে। কিন্তু ছেলের মন তখন বাবার থেকে একসমুদ্র দূরে।'
- আশ্চর্য, এ তো উপন্যাসের মত কাহিনী মা। সেই শ্বেত পাথরের টেবিলের কী হল?
- সে সব দাদুই বেচেবুচে কিছুদিন নিজেরটা চালিয়েছিল। তারপর বৌ আর ছেলেমেয়ের ভরসা।
- তারপর?
- দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে আসে, কিন্তু হঠাৎ মিরিকে প্রশ্ন লুঠ হয়ে মার্চ থেকে আমাদের পরীক্ষা পিছিয়ে যায় মে মাসে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ তাই প্রথমে একটু থমকে গেলেও আমার মাধ্যমিকের প্রস্তুতি চলে জোর কদমে। পড়তে পড়তে একটু তন্দ্রা মতো চলে এসেছিল একদিন। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। অগ্নিকুন্ডে ধু ধু আগুন জ্বলছে। শিখা উঠেছে লকলকিয়ে। একপাশে রামচন্দ্র নয়, আমার দাদু বিকাশচন্দ্র, আর অন্যপাশে মুখোমুখি সীতা নয় লাবণ্য। বিকাশচন্দ্রের গমগমে গলা শুনতে পাই,
- 'এই শেষ সুযোগ। দোষ স্বীকার করো, সৎ ছেলেকে দেখোনি। স্বীকার করে করুণা ভিক্ষা করো, তবেই প্রাণভিক্ষা দিতে পারি আমি।'
লাবণ্যর মনের কথা শুনতে পাই আমি। দুধের শিশুকে দেখাশোনার জন্য ঘরে এনেছিলে, বুকে করে মানুষ করেছি। কিন্তু আশ্চর্য, মুখে লাবণ্য একথা বলেনা। নতমুখ তুলে বিকাশের চোখে চোখ রাখে। এতকাল গোপনে ইংরেজি চর্চা করা লাবণ্য আজ প্রকাশ্যে শুধু বলে
- 'আই কুইট। গুড বাই।'
তারপর দুজোড়া লবকুশকে নিয়ে সীতা নয় লাবণ্য এগিয়ে যায় অশোক বন নয় তপোবন মানে অশোকনগরের দিকে।
পায়ে পায়ে চলতে চলতে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল আমার - ১৯৮৭ সাল। ফলও বেরোল। মাধ্যমিকে যে ইস্কুল থেকে ফার্স্ট হয়, সে একটা চ্যালেঞ্জ কাপ পায়। কুড়ি বছর আগে ওটা মঞ্চে উঠে মায়ের নেওয়ার কথা ছিল। বিধির বিধানে হয়নি। কুড়ি বছর পরে কাপটা আমি পেলাম। নিবেদিতা ইস্কুলের যেসব দিদিরা মাকে আর আমাকে, দুজনকেই পড়িয়েছেন, তাঁরা আমাকে উপলক্ষ করে ওটা মাকেই দিলেন। অন্তত তাঁদের শরীরী ভাষায় সে কথাটা প্রকাশ পাচ্ছিল।
- এও তো একটা সিনেমা মা, জীবনের সিনেমা। দুটো প্রশ্ন আছে, প্রথম হল, অশোকনগরের উদ্বাস্তু কলোনি কী? সেটা কোথায়?
- আমাদের আড়বালিয়া যেমন বারাসাত থেকে টাকী রোড ধরে যেতে হয়, অশোকনগরের রাস্তাটা বারাসাত থেকে হাবড়ার দিকে।
- গ্রামে?
- এখন আর গ্রাম নেই, শহর হয়ে গেছে। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু ঘরভাঙা মানুষ এখানে কোনক্রমে বেঁচে ছিল। তাদের সেই ঘরবাড়ি মিলেই কলোনি। সেই ভাঙা দেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষেরা এই ছিন্নমূল ঘটি পরিবারটিকে পরম মমতায় আপন করে নেয়।
- সত্যি!
- হ্যাঁ, মায়ের মুখে একজনের গল্প খুব শুনেছি জানিস, নীলুদি। হাসিখুশি এক মেয়ে, সেই অভিভাবক হীন অসহায় দুঃখী পরিবারটির ফ্রেন্ড ফিলোসফার গাইড। সেই নাকি এসে এসে খবর রাখত, খাওয়া হয়েছে কিনা। আর মজার কথা কী জানিস, অশোকনগরবাসের পর মায়েদের রান্নার ব্যকরণ বদলে গিয়েছিল। রোজকার খাবারে পেঁয়াজ রসুনের প্রতি ছুৎমার্গ কমে এসেছিল। বাড়িতে চিনি না থাকলে ভেলিগুড় দিয়েও চা হয়, আর রান্না মিষ্টি করতে গেলে ঝোলে একটা আস্ত পেঁয়াজ ফেলে দিতে হয়, আর আনাজ না থাকলে রসুন তেল দিয়ে ভাত খাওয়া হয়, এসব শিক্ষা ওখান থেকেই পাওয়া। রেশনের মোটা চালের সঙ্গে খারকোল বাটা, খেসারির বড়া, শাপলা চচ্চড়ি, তেলাকুচোর ডাঁটা ছেঁচকি, ছাঁচি কুমড়োর খোসা ভাজা এসব খাবার ও প্রতিবেশীদের থেকে খেতে শিখেছিল।
- এ এক অদ্ভুত ইতিহাস মা!
- পরিবারে বা সমাজে যখনই কোন বড় বাঁক আসে, জানবি হেঁসেলে তার ছাপ পড়ে। মা বলত, ছেলেমেয়েদের জন্মদিন এলে লাবণ্য পায়েস করত। কিন্তু অশোকনগরে তো আর ভালো গোবিন্দভোগ চাল যোগাড় হতনা। তখন লাবণ্য চিঁড়ের পায়েস করত। ছানার অভাবে রাঙালুর পান্তুয়া করত।
- চিঁড়ের পায়েস! রাঙালুর পান্তুয়া? জীবনে শুনিনি।
- জীবন আর কতটুকু দেখলি বাবু?
- এগুলো কীভাবে করে?
- চিঁড়ের পায়েস কিছুই না, দুধ ঘন করে, মিষ্টি দিয়ে হাল্কা ভাজা চিঁড়ে দিয়ে ফোটানো। ঊপকরণ থাকলে এলাচ, কাজু, পেস্তা, কিশমিশ সব দেওয়া যায়, কিন্তু সেসব তো আর থাকতোনা। আর পান্তুয়া করতে গেলে, রাঙালুগুলো ভালো করে সেদ্ধ করে চটকে মেখে, তার সঙ্গে গুঁড়ো দুধ, আর ময়দা ঘি ময়ান দিয়ে মাখতে হবে। তারপর হাতে ঘি লাগিয়ে গোল গোল করে বল পাকিয়ে লাল করে ভেজে নিতে হবে। তারপর রসে ফেলতে হবে। মা বলত, লাবণ্যর পান্তুয়া খেয়ে কেউ নাকি ছানার পান্তুয়ার সঙ্গে তফাৎ করতে পারতোনা।
- শুধু গল্পই শুনি, আমার তো আর খাওয়া হলনা। এবারে দ্বিতীয় প্রশ্ন, শ্রদ্ধাপ্রাণাজী কে?
- ঘড়িতে কটা বাজল খেয়াল আছে? বাকী কথা আবার পরে হবে।
"তবুও সকল কাল শতাব্দীকে হিসেব নিকেশ ক’রে আজ
শুভ কাজ সূচনার আগে এই পৃথিবীর মানবহৃদয়
স্নিগ্ধ হয়— বীতশোক হয়?
মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো?
দীনতা: অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো।"