- মা কী বলবে বলেছিলে মনে আছে?
- কী রে?
- দাদুরা আড়বালিয়ার বাড়ি ছেড়ে শহরে কেন গিয়েছিল?
- ইচ্ছে হয়েছিল তাই গিয়েছিল।
- না, বল ঠিক করে, বলতেই হবে। তোমার মামার বাড়ির কথা তো অনেক শুনলাম। আমার মামার বাড়ির কথা জানবোনা বুঝি? আড়বালিয়ার অমন প্রাচীন ইতিহাস নেই?
- সে তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কিনা রাজা মহারাজাদের সাত পুরুষ, দশ পুরুষ সব নাম নথি পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের সেসব লেখা থাকেনা, তাই হারিয়ে যায়। আমাকে নিয়ে কেবল চার পুরুষের কথাই জানি।
- সেটাই বল, আমাকে তো জানতে হবে।
- জানতে হবে? সংক্ষেপে জানবি নাকি বিশদে?
- ওসব জানিনা, তুমি যা জানো আমাকে বলতে হবে।
- তাহলে তোকে কিন্তু ধৈর্য ধরে অন্তত সোয়াশো বছর আগের আড়বালিয়ায় যেতে হবে। পারবি?
- তাই নাকি! চল, চল, শিগগির।
- চল তবে। শোন, আড়বালিয়া গ্রামটা হল বসিরহাট মহকুমার মধ্যে। পরিবেশে বাংলার সবুজ মখমলে মোড়া গ্রাম হলেও সেটা আসলে বাদুড়িয়া পৌরসভার অংশ। ও তল্লাটে ইংরেজ আমলে কু ঝিকঝিক মার্টিনের রেল চলত। ইছামতী নদীর বেশ কিছু খালও আছে চারিপাশে।
- এবার আমি যোগ করছি মা, আমার মামার বাড়ির পাড়ায় আছে এক বিশাল ঝুপসি বটতলা, তার বয়স অনেক। কত হতে পারে?
- তা দেড় দু শতক হবেও বা। আমার বাবা বলেছিল, ঐ বট যে কত পুরোনো তা কেউ জানেনা। বাবার বাবাও নাকি জানতেননা।
- আর ঝুপসি বটের ধারে এক বিশাল পুকুর। সেখানে সব নাইতে আসে। ঐ জলে গাছের ছায়া আর আকাশের ছায়ারা খেলা করে, আমি যখনই যাই, কেবলই দেখি।
- তাই বুঝি? বটের ঝুরি আর জেগে ওঠা শিকড় ধরে জলে আনকোরারাও দিব্যি চান করে। আমিও করেছি অনেকবার। বটতলার ঝুরি নেমে নেমে আজ অনেক গুলো গুঁড়ি। বড় দুটো প্রধান গুঁড়ির মধ্যে দিয়ে চলার রাস্তা। ও গাছে লাখ লাখ পাখি আর লক্ষ কোটি বাদুড়ের আস্তানা। দিনের বেলা বাদুড়গুলো লম্বা হয়ে ঝোলে। আর বিকেল হলে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়। গেলবারের উম্পুন ঝড়ের মাথা যখন ঝুঁটি নাড়া দিল, বুড়ো বট টাল খেয়েও সামলে নিল। কিন্তু যখন ঝড়ের লেজ আছড়ালো তখন আর পারলেনা। পুকুর পাড়ের গুঁড়িটা গেল উল্টে। সে কি দৃশ্য, শিকড়ের বিরাট দেয়াল, যেন তিনতলা বাড়ি। পাখি, বাদুড় কত যে মরল, তার ঠিকানা নেই। এখনো ওভাবেই আছে।
- ঠিক ঠিক। খুব দুঃখ লাগে ঐ উলটনো গুঁড়িটা দেখলে।
- এর পর চল হেঁটে যাই বটতলার পাশ দিয়ে। কলেজ স্ট্রিটের মর্ডান বুক যাদের, তাদের ভিটে ছিল পথের ডানদিকে। একটা ঠাকুর দালান ছিল। কালীপুজো হত। এখন আর হয়না। এবার একটা মাঠ। রাস্তা গেছে বেঁকে, ডানদিকে গেলে সিংহদুয়ার আর বাঁদিকে শুকপুকুরের রাস্তা।
- একদম ঠিক, ডানদিকে একটু এগোলে পথের ওপর আছে এক বিরাট সিংহওলা গেট। গেটের মাথায় সিংহের চারপাশে পাহারায় আছে চার সেপাই। ঐ দরজায় ওপরদিকে খোদাই করে লেখা আছে এক টাকা।
- হুম, আমার বাবা বলতো, একমণ চালের দাম যখন এক টাকা ছিল, তখন ঐ গেট তৈরি হয়েছিল। গেট দিয়ে ঢুকলে পথের দুপাশে আমবাগান। পথ শেষ হয় এক বিশাল পুষ্করিণীতে। সেখানে ছেলেদের আর মেয়েদের স্নানের ঘাট আলাদা। আর আছে একটা বিশাল সুড়ঙ্গ। জমিদারির সময়ে কী কাজে লাগতো কি জানি।
- আর ঐ সিংহওলা গেটের উল্টোদিকে আছে তিনশিবের মন্দির। মন্দিরের চাতালের পাশে আছে একরাত্তিরের বাড়ি। একরাতে তৈরি বাড়ি ছাদ ঢালাইয়ের আগে সুয্যি উঠে গেল। আর ছাদ হলনা। তাই না মা! ওভাবেই রয়ে গেল।
- হুঁ, পিছনে নাগচৌধুরীদের বাড়ি। আর একটু এগোলে বাজার। ডানদিকে হাঁস ঠাকুরের বাড়ি আর ঠাকুর দালান। এটা কী জানিস যে ঐ হাঁস ঠাকুরের বাড়ি হল অগ্নি যুগের বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মামার বাড়ি। ও বাড়িতে এখনও তাঁর আঁতুড় ঘরের চিহ্ন রেখে দেওয়া আছে!
- তাই নাকি? আমি তো হাঁস ঠাকুরের বাড়ি এলেই পাশের সেই প্রাচীন মিষ্টির দোকানটার কথা ভাবি। কী দারুণ রসগোল্লা আর কাঁচাগোল্লা।
- অ্যাই! ওখানে কেউ কাঁচাগোল্লা বলেনা, বলে মাখা সন্দেশ।
- হ্যাঁ ঐ মাখা সন্দেশ। মুখে দিলে গলে যায় উফফ। ঐ দোকানের রসগোল্লায় কী জাদু আছে গো মা, এত ভাল্লাগে, একটু বলনা কারণটা কী?
- হি হি, ওটা রসগোল্লার জাদু নয়, পরিবেশের জাদু। ঘিঞ্জি শহরে গাড়িঘোড়ার মধ্যে থাকিস তো। কাচের বাক্সে সাজানো রসগোল্লা দেখিস। আর ওখানে গাছপালার মধ্যে মাটির মেঝেতে উনুন পেতে গরম চিনির রসে রসগোল্লা ফুটছে। টালির চালের তলায় ভাঙা বেঞ্চিতে বসে মিষ্টি চাইলেই শালপাতা মুড়ে তাতে টপাং করে গরম রসগোল্লা দিচ্ছে। খেতে গিয়ে চটচটে রসে হাত মাখামাখি, আঙুল চুষেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। মেকি ভদ্রতার বালাই নেই। সব মিলিয়ে অন্যরকম লাগে।
- সেটা ঠিক, ওখানে হাওয়া দিলেও অন্যরকম শব্দ হয় মা, গাছের পাতার আলাদা আলাদা শব্দ। কিন্তু টেস্ট, টেস্টের ব্যাপার আছে। শুধু পরিবেশ নয়। টেস্ট আলাদা।
- আলাদা তো, শুধু স্বাদে কেন, অনেক কিছুতে আলাদা। আড়বেলের রসগোল্লাগুলো ভারি, রসটা অনেক গাঢ়। স্বাদে মিষ্টি বেশি। ছোটবেলা থেকে কলকাতার হালকা ফুলকা স্পঞ্জ রসগোল্লা খেয়েছিস তো, তাই ঐ ভারি রসগোল্লা ভালোলাগে তোর।
- গ্রামে শহরে রসগোল্লারও রকমফের আছে বুঝি?
- আছে। কিন্তু প্রশ্নটা গ্রাম, শহরের নয়। পুঁজির। বড় ব্যবসায়ীরা ছানা কাটিয়ে মেশিনে মাড়াই করে গরম অবস্থায় গোল্লা পাকিয়ে হালকা মিষ্টি রসে ফোটায়। আর সেই ফোটানো খোলা কড়ায় না করে স্টিম বয়লারে করা হয়, যাতে চিনির ঘনত্ব আর তাপমাত্রা একই রকম থাকে, কমা বাড়া হয়না। তাই ওগুলো হয় তুলতুলে স্পঞ্জ রসগোল্লা। আর তোর যেটা ভালো লাগছে, ওটা হল সলিড রসগোল্লা। ছানা হাতে বেটে, দলাইমলাই করতে করতে ঠান্ডা হয়ে যায়। সেই ঠান্ডা ছানার মোটা মোটা বল ঘন চিনির শিরায় কড়ায় ফুটে ফুলে ওঠে।
- ওহ, বুঝলাম এবার। আর মাখা সন্দেশ? ওটা কি শুধু দুধ ঘন করে ক্ষীরের মতো করে?
- শুধু দুধ নয়, ঘন দুধের ছানা আর মিষ্টি কড়ায় নেড়ে নেড়ে বানায়। যখন নতুন নলেন গুড় তৈরি করত সাহেব চাচারা, তখন শিবু জেঠু সেই গুড়ের রসে কাঠের ইয়াব্বড় খুন্তি দিয়ে ছানা নেড়ে নেড়ে মাখা সন্দেশ বানাতো। আর আমরা সেই গন্ধে নালে ঝোলে হয়ে চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। শুধু আমরা কেন, বাবারাও তাই। খালি খবর নিত, আর ফরমায়েশ করত, 'শিবুদা সন্দেশ তৈরি হলে এক কেজি বাড়ি দিওখন।' শিবু জেঠুও হেসে হেসে বলত, 'দোবানি, বাবু দোবানি। আর একটুখানি রোসো।'
- ঐ দোকানের পাশেই তো পাঠশালা। ওখানে দাদু পড়ত, তাই না মা! দাদু আমাকে বলেছিল, চটের টুকরোর মধ্যে বই খাতা বেঁধে মাথায় করে নিয়ে কীভাবে পাঠশালায় যেত, আর জানো মা, বাঁধন খুলে ঐ চট পেতেই ক্লাসে বসতে হত, বেঞ্চি ছিলনা। ওখান থেকে পাশ করে বড় রাস্তার ধারে বড় ইস্কুলে পড়তে গিয়েছিল।
- হুঁ, ঐ ইস্কুলে এককালে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বাবাও পড়িয়েছেন।
- এত পুরোনো ইস্কুল? তোমাদের নিবেদিতা ইস্কুলের থেকেও বেশি পুরোনো!
- অনেক পুরোনো, ১৮৮৫ সালে ইস্কুল তৈরি হয়েছে, আর এম. এন. রায় জন্মেছেন ১৮৮৭ সালে। আড়বালিয়ার মাটি অনেক বিপ্লব আর স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড়ঘর। হাঁস ঠাকুরের বাড়িতে আলিপুর বোমার মামলার এক আসামী অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্যও জন্মেছেন - এম. এন. রায়ের জন্মের ঠিক পাঁচ বছর আগে। পাঠশালা ছাড়িয়ে ডানদিকের পথ ধরলে বণিক পাড়ার বড় বাজার। আর বাঁদিক ধরে এগিয়ে গেলে আদি বসুবাড়ির প্রাচীন প্রাসাদ। ওবাড়ির ছেলে কৌশিক অর্থনীতিতে বিশ্বজয় করেছে। আর এক ছেলে বিশ্বনাথ আজ বাংলার আমজনতার মন চুরি করেছে। কাছেই আর এক শরীক মাঠের-বসুবাড়ির অট্টালিকা ও ঠাকুর দালান। আরো এগোলে চার শিবের মন্দির।
- আমি বলছি মা, ছোটো বর্গাকার ক্ষেত্রের দুই বাহুতে পাশাপাশি দুটো করে মোট চারটে ইট রঙা মন্দির। মাঝখানে চাতাল। চাতাল নেমে গেছে এক গভীর পুকুরে। মন্দিরের উঁচু ভিতে পা ঝুলিয়ে বসলে ভেজা বাতাসে কেমন যেন ঝিম ধরে। ও পুকুরের জল বড়ো স্থির। আমি ভাবি তল কোথায়, থৈ কই?
- থৈ নেই। শহুরে মত্ত পিকনিক পার্টির অনেককে শাস্তি দিয়েছে ঐ জল। দুই বসু আর হাঁস ঠাকুরের বাড়িতে দুর্গা পুজো হয় দালানে আর বণিক পাড়ায় বারোয়ারী। আরো সাত গাঁয়ের ঠাকুর এসে তিনশিবের মন্দিরের মাঠে বিজয়াদশমীর মেলা হয়। ও মন্দিরগুলো এক সারিতে পাশাপাশি, সাদা কালো পাথরে বাঁধানো চকমকে।
- এত ঘুরতে ঘুরতে যে বেলা হল মা, দাদুর আর কথা কই?
- আর ঘুরবিনা? তাহলে ফিরে চল আবার বটতলায়। নাকবরাবর পুকুর ধারে শুরুতে ডানদিকে মণ্ডলদের ভিটে আর একটু এগিয়ে বাঁদিকে মিত্তিরদের। আরও আরও অনেকটা এগিয়ে গেলে বড়পোল, ইছামতীর খাল, চারিপাশে জলকড়, মানে মাছের ভেড়ি। আরও এগোলে ধান্যকুড়িয়া, নেহালপুর। ধান্যকুড়িয়ার গাইন, সাউ, সমাদ্দারদের প্রাসাদ, মন্দির, রাসমঞ্চ।
- হুঁ।
- এইবারে তুই যা জানতে চাইছিস, সেই গল্পটা শোন। আঠেরো শতকের শেষ দিকে আড়বালিয়া গ্রামের জনৈক লক্ষ্মণচন্দ্র মণ্ডল ছিলেন নাগচৌধুরী জমিদারির গোমস্তা। জাতিতে সৎচাষী হলেও তাঁর পেটে কিছু বিদ্যে ছিল। ভিটে আর চাষজমি মিলিয়ে তাঁর কয়েক বিঘা জমিজিরেতও ছিল। সেযুগে পাকা সড়ক গল্প কথা। খাজনা আদায়ে জলকাদার পথ গোমস্তা মশাই পাল্কি চড়েই যেতেন। অবসর সময়ে তাঁর পাল্কিটা মাটির ঘরের একপাশে রাখা থাকত।
- লক্ষ্মণচন্দ্র কে? তোমার ঠাকুর্দা?
- উঁ হু, ঠাকুর্দার বাবা।
- মামার বাড়িতে পালকি ছিল, তুমি দেখেছ?
- না রে বাবু, শুধু শুনেছি। যা হোক, সাত গাঁয়ের মানুষ চিনলেও লক্ষ্মণ বাবুর মনে সোয়াস্তি নেই। তাঁর মনের মধ্যে সূঁচ বেঁধায় এক গোপন ইচ্ছে। জমিদার বাড়ির মতো, অন্য বামুন কায়েতের ঘরের মতো তাঁর ছেলেমেয়েদের অনেক লেখাপড়া শেখাবেন।
- আচ্ছা, সে তো ভাল কথা।
- কিন্তু বিধি যে বাম। বেলা যায়, এখনও ছেলেপুলের মুখ দেখতে পেলেননা।
- তাই নাকি? কিন্তু তখন তো পরিবারে অনেক ছেলেমেয়ে থাকত, এই আমার মত কাউকে একলা থাকতে হতনা।
- হুম, কিন্তু আমাদের লক্ষ্মণচন্দ্রের স্ত্রী যে গৃহে থেকেও সাধিকার মত জীবন কাটান। সম্ভবত সেই কারণেই সন্তান ছিলনা।
- সাধিকার মত কেন? কীসের সাধনা!
- বিশদে জানিনা। পরিবারে শুনেছি তিনি সতীমার বংশের মেয়ে, সাধন ভজন করে দিন কাটাতেন। জড়িবুটি, ওষধি - এইসবের চর্চা করতেন। চারপাশের গ্রামের মানুষ ছোটখাটো চিকিৎসার জন্য তাঁর ওপরে নির্ভরশীল ছিল।
- আশ্চর্য, তার মানে কর্তা গিন্নি দুজনেই দুরকমভাবে প্রভাবশালী ছিলেন!
- হুম, বলতে পারিস, তাই।
- সতীমার বংশ কী?
- বৈষ্ণবদের সুফী প্রভাবিত এক উপধারা আছে,নাম কর্তাভজা। এই মত শুরু করেছিলেন আউলচাঁদ নামে এক সাধু।
- দুটো নামই অদ্ভুত।
- এই মতের ভক্তরা ঐ সাধুকে শ্রীচৈতন্যের অবতার হিসেবে মানেন। ধর্মের ব্যাপার তো, অনেক মিথও আছে। গল্পটা হচ্ছে - সতের শতকের শেষ দিকে নদীয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে ঊলা গ্রামে মহাদেব নামে একজন লোক দেখলেন পানের বরোজে এক ফুটফুটে শিশুপুত্র শুয়ে আছে, আশেপাশে কেউ নেই।
- তারপর?
- সাধারণ মানুষের পক্ষে যা স্বাভাবিক মহাদেব তাই করলেন। তাকে কোলে তুলে নিয়ে বড় করলেন।
- বেশ।
- মহাদেবের কুড়িয়ে পাওয়া সেই ছেলে একদিন নানা ধর্মশাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু বিধির বিধানে গৃহী না হয়ে কৃষ্ণ নামে মজে হলেন বৈষ্ণব সাধু - বাবা নাম রেখেছিলেন পূর্ণচন্দ্র আর সাধু হবার পর লোকে তাঁর নাম দিল আউলচাঁদ।
- তারপর?
- এবার সাধু হয়ে পথে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি এসে পড়লেন নদীয়ার ঘোষপাড়ায়। সেখানকার এক বাসিন্দা রামশরণ পালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সরস্বতী তখন দুরারোগ্য রোগে মরণাপন্ন। আউলচাঁদ নাকি তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন। এই সরস্বতীই পরবর্তীকালে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সঙ্ঘজননী হয়ে ওঠেন এবং "সতী মা" নামে পরিচিত হলেন। এবারে সতীমার বংশ মানে, তাঁর সরাসরি বাপের বাড়ি নাকি শ্বশুরবাড়ি নাকি কোন ঘনিষ্ঠ ভক্ত বাড়ি - কোন বাড়ির মেয়ে আমার বুড়ো ঠাকুমা তা আমার জানা নেই - কেউ বলতেও পারেনি। তিনি নাকি সেযুগের নিরিখে বেশ সক্ষম ভাবে দীর্ঘজীবী ছিলেন এবং গ্রামের সকলে তাঁকে বুড়ো দি বলে ডাকতো।
- বুঝলাম। কিন্তু লক্ষ্মণচন্দ্রের আশা পূরণ - সেটার কী হবে?
- লক্ষ্মণচন্দ্র দুঁদে লোক, গাঁয়ের সব পরিবারকেই তিনি অস্থি মজ্জায় চেনেন। তাই আকাশ পাতাল অনেক ভেবে বুঝে শুনে এক পাল্টিঘরের দরিদ্র প্রতিবেশীর কাছ থেকে তার বড় ছেলেটিকে চেয়ে নিলেন মানুষ করবেন বলে। কৃষ্ণভক্ত লক্ষ্মণ সে ছেলের নতুন নাম দিলেন রাধারমণ।
- রাধারমণ তার মানে …..
- আমার ঠাকুর্দা।
- ওহ, তিনি দত্তক সন্তান!
- হ্যাঁ।
- তারপর?
- দিনে দিনে রাধারমণ উজ্জ্বল, বুদ্ধিমান, ঝকঝকে হয়ে বেড়ে উঠছিল। লম্বা ফর্সা চেহারা, পড়াশোনায় ভালো রাধারমণকে চোখে পড়ে গেল শুকপুকুরিয়ার সম্পন্ন গৃহস্থ গোষ্ঠগোপাল কাবাসীর। নিজের বড়মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেন লক্ষ্মণ বাবুর ঘরে। এবাড়িতে অমত হলনা। লোকতো বেশি নেই। ঘরে বৌ এলে তো ভালোই। তখন লোকে ভাবত, ছোটোবয়সে এলে শউরঘরে মিলমিশ ভালো হয়।
- কোন সালের ঘটনা এটা আন্দাজ আছে?
- আছে, সনটা ১৯০৬। চারপাশ অশান্ত।
- ১-৯-০-৬! মানে সবে ব-ঙ্গ---
- ভঙ্গ হয়েছে। বাদুড়িয়া আর আড়বালিয়ায় তখন স্বদেশী আর বয়কট চলছে পুরোদমে। কখন কী হয় কে জানে। তাই শুভস্য শীঘ্রম। পাঁজিতে দিন দেখে সানাই, উলু, শাঁখ বাজিয়ে পাঁচ বছরের হেমনলিনী আর বারো বছরের রাধারমণের বিয়ে হয়ে যায়।
- এ বাবা! এতো ছোট বাচ্চা!
- যে কালে যে নিয়ম চলে। ছেলের তখনও লেখাপড়া চলছে। পরীক্ষায় ভালো ফল, ভালো ঘরে বিয়ে! শুদ্দুরের পো বাবার স্বপ্ন সফল করতে ইস্কুল পাশ দিয়ে আরও পড়তে চায়। যুগটায় তখন ভারি জাতের বিচার। এ অনাচার কি ধম্মে সয়? ধর্ম বাঁচাতে গিয়ে আড়বালিয়ার বামুন কায়েতের কিছু দুষ্ট ছেলেপুলে শলা করে একদিন রাধাকে বিষ খাইয়ে দেয়......
- সে কী? একী কথা বলছ?
- যা ঘটেছিল তাই বলছি। লক্ষ্মণচন্দ্রের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাঁর বংশে কাকা জ্যাঠা জ্ঞাতিতো কেউ নেই। তিনি তাঁর বাবার এক সন্তান। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে প্রতিবেশীদের শত্রুতা সামলাবেন কি করে?
- সেই তো!
- হেমনলিনীর বাপের ঘরে খবর যায়। সে বাড়ি বিশাল যৌথ পরিবার। হেমের বাবা কাকারা ঝাঁপিয়ে পড়েন রাধাকে বাঁচাতে। হেমের দুই দাদাও তখন বড় হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির তাগদ, মায়ের চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান আর হেমের সিঁদুরের জোর - রাধারমণ সে যাত্রা বেঁচে গেল, আর জেদের বশে হিংসুকের মাথায় তবলা বাজিয়ে হয়ে উঠল ও তল্লাটের প্রথম প্রশিক্ষিত ডাক্তার।
- আহ, এইটাই ঠিক হয়েছে।
- ঐ নাগচৌধুরীরাই তাঁকে গৃহচিকিৎসক নিয়োগ করল। সাত গাঁয়ের লোক দেখাতে আসত। এক রাত্তিরের বাড়ির পাশেই ডাক্তারখানা। ডাক্তার বাবুর বাড়ি যাব বললেই নাকি গরুর গাড়ি বাড়িতে নিয়ে চলে আসত আত্মীয় স্বজনকে, আর কোন ঠিকানা বলতে হতনা।
- তারপর?
- তুলসী তলায় পিদিম দিয়ে, হেম আর রাধার ঘরে প্রথম সন্তান এল কন্যা সতীরানী।
- জাঁদরেল পিসি দিদা?
- হুঁ, তারপর একে একে আমোদ, রণজিত, নীরোদ, সমীর। কয়েক বছরের বড় ছোট সব।
- এতক্ষণে দাদু এল। স-মী-র, সবচেয়ে ছোট ছেলে।
- হুঁ, রাধারমণ অনেক রোগী দেখলেও গাঁয়ের লোকের তেমন পারিশ্রমিক দেবার ক্ষমতা নেই। আর ডাক্তার বাবু মানুষের কষ্ট বোঝেন। প্রায়ই পয়সা মাপ হয়। এদিকে লক্ষণ চন্দ্র বিদায় নিয়েছেন। রাধার মা রয়েছেন এখনো। এতগুলো ছেলেমেয়ে। অনেকগুলো পেট চালাতে কষ্ট। টেনেটুনে চলে। ছোটোছেলেটা জন্মানোর আগেই ডাক্তার বাবুর নামযশে বড় মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসে ধান্যকুড়িয়ার বিখ্যাত জমিদার গাইন বাড়ি থেকে। মামারবাড়ির সাহায্যে বিয়েও হয়ে যায় ধুমধাম করে। দিদির বিয়ের পর ছোটোছেলেটা জন্মায়। মেলানো ডাকনাম। বেণু, রেণু, ধেণু, ভানু। সব ঠিকঠাকই চলছিল। ভানুর যখন আড়াই বছর বয়স, হেমের বয়স দুকুড়ি পাঁচ।
- মানে পঁয়তাল্লিশ?
- হ্যাঁ, রাধা ডাক্তার হলেও যুগটা বড় বালাই। মেয়েদের গর্ভ ফাঁকা যায়না। হেমও রেহাই পেলোনা। এবার কন্যা বিয়োতে গিয়ে হেম সংসার থেকে একেবারে ছুটি নিল। মা - খাকি ঐ মেয়েটা বেঁচে রইল। দাদারা মায়ের স্মৃতিতে একরত্তি বোনটার নাম রাখল স্মৃতি। ভানু আর স্মৃতিকে দেখাশোনার জন্য এবার মণ্ডল পরিবারে পা রাখল হেমের আদুরী পিসি। সে যুগে প্রায় ঘরেই বালবিধবা, নিঃসন্তান, ফাইফরমাসখাটা নারীরা থাকতেন। আত্মীয় স্বজনের যার যেমন দরকার পড়ত, পেটভাতায় সেখানে খাটুনি খেটে তাঁদের দিন যেত। এই আদুরীও তেমন। যে কোনদিন আদর পায়না সেই আদুরী।
- ইশ-শ। দাদুর আড়াই বছরে মা মারা গেল? মুখটাও মনে রইলনা? তাহলে এই আদুরী দিদা আমার দাদুকে মানুষ করল?
- হুঁ, এই আদুরীকে আমি খুব ছোটবেলায় দেখেছি জানিস। মায়েরা ডাকত আদুরী দিদমা। এদিকে বিধাতা দেখলেন একরত্তিটা আগের জন্মে অনেক পুণ্যি করেছে। মা-খাকি, অপয়া এসব শোনার দুঃখু দেওয়া একে উচিত হবেনা। তাই জ্ঞান হবার আগেই, বছর খানেকের মধ্যে তাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলেন গলায় দুধ আটকানোর ছুতো করে। স্মৃতির স্মৃতি বাড়িতে মুছে গেল।
- এ মা! মরে গেল বাচ্চাটা?
- হ্যাঁ, তখন শিশু মৃত্যুর হার শহরেই বেশি ছিল, তো গ্রামে! তবে ভানুটা রোগাসোগা হলেও, আদুরী তাকে বাঁচিয়ে দিল। দেশ যখন স্বাধীন হল, ভানুর বয়স চার। ছোট ছেলে তো - সবাই আদর করে ডাকত খোকা।
- খোকা? দাদুর নাম খোকা আর দিদার ডাকনাম তো খুকু? এ কীকরে হল - হি হি হি।
- ভবিতব্য, আর কী?
- যাকগে তারপর?
- মা-হারা ভায়েদের জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। তাদের ডাক্তার বাবা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে কোনো আপস করতে চাননা। কিন্তু এতগুলো ছেলেকে পড়ানোর সামর্থ্য কোথায়?
- কেন, জমিজিরেত ছিল যে বললে।
- হ্যাঁ তা ছিল বটে। বাবাদের ছোটবেলায় ধানের সঙ্গে নাকি প্রচুর আখ চাষ হত। সারি সারি কলসি করে আখের গুড় বানানো হত। সবজিও ফলানো হত কম বেশি। তবে চাষবাসে সব বছর তো সমান যায়না। আর এইরকম পরিবারে, যখন ফসল ওঠে, তখন হাতে টাকা থাকে। অন্য সময়ে সেই টানাটানি, অর্থকষ্ট থেকেই যায়।
- তাহলে এত লেখাপড়া কীভাবে হল?
- রাধারমণের শ্বশুরমশাই গোষ্ঠগোপাল ততদিনে গত হয়েছেন। তবে দুই শ্যালক ততদিনে সাব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বড় গুরুদাস বাদুড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান আবার জাতীয় কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা। পারিবারিক জমিজিরেতের সঙ্গে ছিল বাদুড়িয়ার সিনেমা হলের মালিকানা। ছোটো রবীন্দ্রনাথ চাষবাস দেখতেন, রেশনের দোকান ছিল, আর তাঁর নেশা ছিল আবার রান্না করা।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ রে, এলাকায় কোনো বড় অনুষ্ঠান হলে খাওয়াদাওয়ার তদারকিতে তিনি - তা সে অষ্টম প্রহর কীর্তন হোক, বা কংগ্রেসের সভা। ছোট মামাদাদুর ছেলেরা বাবার এই শখ ধরে রেখেছিল, জানিস?
- ছোটমামাদাদুর ছেলেরা কারা?
- আমার মামাতো কাকারা। সুজয় কাকু নিজে দাঁড়িয়ে তোর এক বছরের জন্মদিনের সব রান্না করেছিল - এই আড়বেলের বাড়িতে।
- তাই নাকি?
- অ্যালবামে ছবি আছে, খুলে দেখবি। যাই হোক, বাবার মামার বাড়িতে লোকবল আর অর্থবল দুইই ছিল। তাই প্রথমদিকে মামারা ভাগ্নেদের পড়াশোনার খরচ যোগাতেন সাধ্যমতো।
- আচ্ছা।
- বড় হলে ভাগ্নেরা নিজেরা টিউশনি করে পড়ার খরচ জোটানো শুরু করে। বড় আমোদ কুমার কলকাতায় ট্রাম কোম্পানির চাকরি পায় আর শ্যামবাজারে মেসবাড়িতে আস্তানা খুঁজে নেয়।
- আমোদ কুমার মানে?
- বড়জেঠু।
- বুঝলাম।
- মেজ রণজিত কিছুদিন আড়বেলেতে মর্ডান বুক এজেন্সির মালিক পরিবারে গৃহশিক্ষক হয়ে থাকে। তার কাজ হল সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানো আর অন্য সময়ে বাজার করা, টুকিটাকি সাহায্য করে দেওয়া। এ ব্যবস্থায় খাওয়ার খরচটা বেঁচে যায় আর সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের পড়াটা চালানো যায় কোনোক্রমে।।
- এ যে শরৎবাবুর বলা জীবন গো মা! লোকের বাড়িতে থেকে, ছেলে পড়িয়ে, ফাইফরমাশ খেটে নিজের পড়া চালানো? এতো ভাবতেই পারিনা, তারপর?
- শেষ পর্যন্ত রণজিতের লড়াই সাফল্যের মুখ দেখে। সে ভালো ভাবে এম. কম পাশ করে, কলকাতায় পেটেন্ট অফিসে একটা চাকরি পায়। হেমনলিনীর বোনের ছেলে তারাপদও জীবিকার টানে কলকাতায় গিয়ে ওঠে। সে কাজ পায় টেলিফোন অফিসে। দুই মাসতুতো ভাই বাড়িভাড়া নেয় কলকাতার লকগেট রোডে।
- এই সেই লকগেট রোড! তারপর? দাদু ওখানে কবে গেল?
- উতলা হচ্ছিস কেন? শোন আগে। মামারা এবার বড় আর মেজ দুই ভাগ্নের পাত্রীর খোঁজ শুরু করেন।
- হুঁ হুঁ সে তো হবেই, চাকরি পেয়ে গেছে না!
- ১৯৪৫ এ সংসার ফেলে চলে গিয়েছিলেন হেমনলিনী। আবার ১৯৫৪ তে বাড়ির চৌহদ্দিতে নতুন বৌয়ের আলতা পরা পায়ের ছাপ পড়ে। হরিশপুরের গোলদার বাড়ির সুমিত্রাকে মামারা বড় বৌ করে নিয়ে আসেন। এর আবার দেড় বছর বাদে রঘুনাথপুরের খ্যাতনামা কবি বিজয়মাধব মণ্ডলের মেজ মেয়ে মঞ্জুলিকাকে পছন্দ করেন ছোটোমামা রবীন্দ্রনাথ, মেজ ভাগ্নে রণজিতের জন্য।
- মঞ্জুলিকা - বুঝেছি, আমসত্ত্ব দিদা, তাই না মা? ভালোই ব্যাপার স্যাপার। খোকা-খুকু জুটির আগে হল রঞ্জিত আর মঞ্জুলিকা? আমসত্ত্ব দিদা দারুণ লোক, আশি পেরিয়েও কেমন একা একা আড়বেলেতে থাকে, কোন ভয় ডর নেই। স্মৃতিশক্তিও কী ভাল জানো মা, কী বিশাল বিশাল কবিতা আবৃত্তি করে, আমি তো মনেই রাখতে পারিনা। এই দিদার গল্পটা বড় করে বল শুনি। দিদার বাবা কবি ছিলেন?
- হুঁ, কবি ছিলেন। তাছাড়া তাঁর আরও অনেক কর্মকাণ্ড আছে।
- আমি তো কিছু শুনিইনি আগে। বল বল।
- গল্পটা হল এইরকম - বিজয়মাধবেরা আট ভাই, তবে বিজয় ছিল কেমনধারা অন্যরকম। গদ্য পদ্য এসব লিখে খাতা ভরায়। ধান্যকুড়িয়ার যশোদা দুলাল মণ্ডল, গান লেখে, পত্রিকা চালায় - তার সাথে ভাব। যশোদা বিজয়ের কবিতা ছাপায়। বিজয় রঘুনাথপুরে ইস্কুল করেছে। নিজে আবার তার সেক্রেটারি। কী কাণ্ড সেখানে প্রাথমিকে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ে।
- ইন্টারেস্টিং! তারপর?
- বিজয়ের মেজ মেয়েটার খুব স্মৃতি শক্তি। বিজয় তাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। লুকিয়ে রবিঠাকুরের কবিতা শেখায়, নিজের লেখা কবিতাও শেখায়। কিন্তু বাকি ভাই ভাজেরা দুচক্ষে দেখতে পারেনা বিজয়ের এই অনাসৃষ্টি কাণ্ড। কিন্তু শত বোঝালেও সে বাগ মানেনা। মেয়েকে নিয়ে নিয়ে, এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে ঘোরে। যার বাড়িতে মেয়ে আছে, সেখানে নিজের মেয়েকে দেখিয়ে ধরাধরি করে। কবিতা বলায়। আরও কিছু প্রাথমিকে পাশ দেওয়া মেয়ে যোগাড় করে সে মেয়েদের সেকেন্ডারি ইস্কুল করতে চায়।
- তাই নাকি? আমি তো শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি! মেজ মেয়েই মঞ্জু - তাই তো?
- হুঁ, মঞ্জুটাও হয়েছে তেমনি। বাপে যা বলে তাই করে। আরে বাবা, মেয়ে নিজে যদি বাধা দিত, বাপে কি এত এগোয়? প্রথমটায় কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ও মা! পাঁচ পাঁচটা মেয়ে যোগাড় করে বিজয় একদিন সত্যি সত্যি মেয়েদের ক্লাস ফাইভ খুলে ফেলে। খোলাপোতা থেকে এক দিদিমণিও আসতে রাজি হয়ে যান। মঞ্জুও টকটক করে ক্লাস সেভেনে উঠে যায়। বাড়ির লোক প্রমাদ গোনে। পড়ার নেশা চড়ে গেলে, শেষে যে বে হবেনা। দেশ গাঁয়ের অরক্ষণীয়া মেয়ে ঘরে রাখা বড় বালাই। মঞ্জুকে লুকিয়ে শলা চলে। খবর আসে, তার ঠাকুমার জায়ের নাতনি সুমিত্রার বিয়ে হয়েছে আড়বেলের মণ্ডল বাড়িতে। সে বাড়িতে মেজ ছেলের জন্যে পাত্রী খুঁজছে। পাত্র কলকাতায় ভাড়া ঘরে থেকে চাকরি করে। খাওয়া পরা জুটে যাবে।
- মেজদাদুর সম্বন্ধ!
- হুঁ, সুমিত্রার মামাশ্বশুরদেরও কানে ওঠে কথাটা। ছোটোমামা পাত্রী দেখতে আসেন। রণজিতকুমারের গায়ের রং টুকটুকে ফর্সা, লম্বায় প্রায় ছফুট। সিনেমায় নামলে নায়ক হতে পারত। মঞ্জু লম্বা বটে, তবে ছেলের তুলনায় বেশ কালো। মামা ভাগ্নের মন জানেন। বাড়িতে পড়াশোনার চাষ আছে। মেয়েও মুখ্যু নয়। সব দেখে কালো মেয়েকেই তিনি পছন্দ করে যান।
- তারপর?
- বিজয়মাধবের প্রথম কবিতার বই বেরোয়। সে সাহিত্য সরস্বতী উপাধি পায়। কিন্তু তার নিয়ম-ছাড়া মেজ মেয়েটার ইস্কুল কামাই হয়। ইস্কুলের খাতার নাম খাতায় পড়ে থাকে। ভরা শ্রাবণে স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন তার পায় বেড়ি পড়ে। রণজিতের সঙ্গে মালাবদল করে সে নৌকা করে ইছামতীর খালপাড়ি দেয়। ইছামতীর হাওয়ায় তার বইয়ের পাতাগুলো ওড়ে। সেটা সন ১৯৫৬, দিনটা ১৫ই আগস্ট।
- পড়া হলনা তবে?
- নাঃ। মঞ্জুর নৌকো বড়পোলের ঘাটে ভেড়ে। সামনে পথ নেই, হাঁটু পেরিয়ে কাদা। সাবধানে বর বৌ গরুর গাড়িতে চলে। শ্রাবণ ধারায় খাল বিল পথ একাকার। সে জলে মঞ্জুর চোখেরও দুফোঁটা জল মিশে যায় আর সব মিলে গাড়ির গরুর পেটের তলায় ছলাৎ ছলাৎ করে। এ কি দেশ রে বাবা! কেবল ছোটোমামা ভরসা দেন, ‘সবুর কর, এখুনি বাড়ি এসে যাবে।’ একটু পরে উঁচু ভিটে দেখা যায়। দুই মামীমা নির্মলাবালা আর রেণুকাবালা দাঁড়িয়ে আছেন বরণডালা নিয়ে। পিছনে উঁকিঝুঁকি দেয় বড় বৌ সুমিত্রা।
মঞ্জুলিকার বয়স তখন
সদ্য ভরা ষোলো।
অষ্টাদশী সুমিত্রার
সঙ্গে দেখা হল।
তারপর সংসারের ফলা
দুরন্ত তার ধার,
একসঙ্গে করবে তারা
চারটি দশক পার।
- বাঃ, এই গল্প শুনে একসঙ্গে দুঃখ আনন্দ দুটোই হচ্ছে গো মা, তারপর?
- সুমিত্রা আর মঞ্জুলিকা কি তখন ভেবেছিল যে, দূরের ঐ কলকাতা শহরের সিমলে পাড়ায় রয়েছে এক বারো বছরের মেয়ে বিজলী। আর বাগবাজারের ৫০ নং রামকান্ত বোস স্ট্রিটের বাড়িতে বড় হচ্ছে আর এক মেয়ে কৃষ্ণা, যার ডাকনাম খুকু। বয়স এখন মোটে দশ। সে নিবেদিতা ইস্কুলে পড়ে আর ইস্কুলের শ্রদ্ধাপ্রাণাজী তার নাম দিয়েছেন কৃষ্ণকুমারী। এই দুজনেরও চাল দেওয়া আছে এই আড়বেলের হাঁড়িতে।
- সেই তো, তখন তো কেউ বুঝতেও পারেনি।
- বিধাতা হাসেন। যাদের হাত ধরে তারা আসবে, সেই সেজকুমার আর ছোটোকুমার যে এখনও ছোটো।
- কী মজা, কী করে তারা এখন?
- সেজকুমার তো বৌদিদের প্রায় পিঠোপিঠি, খেলার সাথী। আর ছোটোকুমার সবে ক্লাস সেভেন। মিহি স্বর, তখনও গলা ভাঙেনি। বৌদি বৌদি ডেকে দুই বৌয়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। রাধারমণের ডাক্তার খানা থেকে রুগী দেখে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। বাবা ঢুকতেই সেজ হাঁকডাক জোড়ে, ‘বাবা, দেখো বৌরা কী রান্না করেছে, গালে দেওয়া যায়না।’
- এ বাবা - বকা খাওয়ানোর তাল!
- বাবাও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাইরে থেকেই বলেন, ‘গালে না দিতে পারিস ভাতে জল ঢেলে নুন মেখে খা।’ বৌদিরা মুখ টিপে হাসে। আহা রে! চেষ্টাটা মাঠে মারা গেল। তবু সে কি বাগ মানে? আবার আসে, বলে - ‘মেজবৌদি! তুমি বেশি কালো না আমি, পরীক্ষা করে দেখি তো!’
- হা হা হা হা, সেজদাদুকে আমি দেখে তো অমন বুঝিনি, গম্ভীর মানুষ হিসেবেই দেখেছি। আর আমার দাদু?
- খোকার আবার খেলার নেশা। মাঠে মাঠে ঘুরে ফুটবল খেলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে করে ফেরে। বাবার আর দাদা বৌদির বকুনির চোটে পড়তে বসে। সকালে আবার ইস্কুলের আগে ব্যয়ামের আখড়ায় যায়। দেশ অল্পদিন হল স্বাধীন হয়েছে। সমাজে শরীর চর্চা আর ফুটবলের নেশা জোরদার। বড়বৌদি ঠান্ডা মানুষ, এদের সঙ্গে অত এঁটে উঠতে পারেনা। কিন্তু মেজবৌদি দেওরদের কড়া শাসনে রাখে।
- সে তো হবেই, কড়া ধাঁচের মানুষ না!
- তোর আমসত্ত্ব দিদার অনেক গুণের মধ্যে আরও একটা গুণ ছিল রান্নাবান্না নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা।
- কীরকম!
- একবার হঠাৎ করে মেজজেঠুর অফিসের কয়েকজন গ্রামের বাড়ি দেখতে চলে এসেছিলেন, আগে থাকতে কিছু না জানিয়ে। এদিকে বাড়িতে তখন রান্না করে খাওয়ানোর মত আনাজ নেই। তখন মেজজ্যাঠাইমা কী করেছে জানিস?
- কী করেছে?
- কচি ডাব পাড়িয়ে, ডাবের মাথা কেটে কচি সাদা অংশটা কুচি কুচি করে তাই দিয়ে ডালনা রেঁধেছে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ, রান্নাটা নাকি এত ভাল হয়েছিল, মেজজেঠুর অফিসের কলীগেরা খুব খুশি, বুঝতেও পারেনি কী খেয়েছে।
- দারুণ তো!
- আর একবার এইরকম একটা পরিস্থিতিতে, মেজজ্যাঠাইমা গাছ থেকে টোপা টোপা জামরুল পেড়ে তাই দিয়ে কালিয়া রেঁধে অতিথিকে খাইয়েছিল।
- বাপরে! রান্না যাই হোক, বিপদে পড়ে সাহস হারায়নি, লড়ে গেছে।
- হ্যাঁ, দুই বৌয়ের হাতযশে অনেকদিন পরে উৎসবে, আত্মীয়তায় বাড়ি আবার গমগমিয়ে ওঠে। মেজকুমার কিন্তু মঞ্জুকে বলে, ‘তুমি খোকার সঙ্গে আবার পড়া শুরু কর।’ তবে সংসারের ডামাডোলে সে আর হয়ে ওঠেনা।
- সত্যি, আমি দেখছি, জগতে সব কিছু চলে, শুধু মেয়েদের পড়াটা বন্ধ হয়ে যায় মা।
- হুঁ ঠিক বলেছিস। জীবনে সুখ দুঃখ পাশাপাশি চলে। একদিন ডাক্তার খানা থেকে ফিরে রাধারমণ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছেলেরা কলকাতা থেকে ডাক্তার আনায়। পরীক্ষায় জানা যায়, অসুখটা কঠিন - লিউকেমিয়া। সক্ষম মানুষটি হঠাৎই বিদায় নেন। এদিকে শুকপুকুরে হৃদরোগে বিদায় নেন ছোটমামা সকলকে হতবাক করে দিয়ে। দুটো ঝড় এসে সংসারটা ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে আবার কিছুটা টালমাটাল করে দেয়। খোকা আরও বেশি করে বৌদিদের আঁচল জড়িয়ে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে আবার সবাই শুরু করে নতুন পর্বের লড়াই।
- তারপর?
- সেজকুমারও পাশ দেবার পর কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট বাটায় চাকরি পেয়ে এবারে কলকাতাবাসী হয়। মেজকুমারের সংসারে রাজপুত্র আর রাজকন্যা আসে। সংসারের বাড়তি খরচ চালানোর জন্য সে ছাত্র পড়ানো শুরু করে। টালায় একবাড়িতে টিউশনি করতে গিয়ে শোনে গৃহকর্ত্রীর নাতনির জন্য পাত্রী দেখা চলছে। গৃহকর্ত্রী আবার তার একমাত্র দিদি সতীরানীর আত্মীয়। পরিবার জানাশোনা, তাই ঐ নাতনির সঙ্গে সেজভাইয়ের সম্বন্ধ করা হল। আর কি? - শহরের বিজলী বাতি আর গ্রামের জল ভরা নীরদের মিলন হল আড়বালিয়ার আকাশের নিচে।
- বাঃ, আর আমার দাদু?
- ছোটোকুমার ছিল পড়াশোনায় স্টার। ডবল প্রমোশন পেয়ে পেয়ে সে খুব অল্প বয়সে ইস্কুল পাশ করে কলকাতায় পড়তে আসে। ইচ্ছে ছিল বাবার মতো ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়া। কিন্তু একা একা অজানা শহরে ঠোক্কর খেতে খেতে হঠাৎ নতুন বন্ধুদের পরামর্শে পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। পাশ করে সে পোর্ট কমিশনের হেড অফিসে চাকরি পায়। আর লকগেট রোডের সেই বাসাবাড়িতে মাথা গোঁজে। তারপর পড়ার নেশায় বি এস সিও পাশ দিয়ে দেয়। এদিকে তো সেই বাগবাজারের কৃষ্ণা এখন লকগেট রোডে ভাড়া থাকে।
- তারপর তারপর?
- তারপর ঐ লকগেট রোডে আড়বেলের খোকা সমীর কুমার আর কলকাতার খুকু কৃষ্ণকুমারীর চার চোখ এক হল। গল্পের নটেগাছ কিন্তু মুড়োলোনা বরং দিন কে দিন আরো ডালপালা বিস্তার করল। এই অসবর্ণ বিয়ের সম্ভাবনায় দুই পরিবারেই ঝড় উঠল। কৃষ্ণার আত্মীয় স্বজন বেঁকে বসলেন। এখন হোকনা যতই অবস্থা পড়তি, তবু কুলীন কায়েত বোস বংশ বলে কথা, নামজাদা বনেদী পরিবারগুলির সঙ্গে আত্মীয়তা। হোকনা পাত্র সুদর্শন, মেধাবী, চাকরি ওলা। মণ্ডল আর বোসের বিয়ে হতে পারে কোনোদিন? তাছাড়া যে মেয়ে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি সে কিকরে ঐ অজ পাড়া গাঁয়ে সংসার করবে?
- আর আড়বালিয়ায়তে কী হল তখন?
- যা হবার তাই হল -
কৃষ্ণাতীরে সমীর বহে
মনে তাদের ফাগুন
আড়বালিয়ার সংসারে কি
জ্বলবে এবার আগুন?
মেনে নেওয়া কিকরে যায়?
যদিও ওরা ঘটি,
মাটির ঘরে মানিয়ে নেবে
কলকেতার ঐ বেটি?
সম্বন্ধ নয় ভালোবাসা -
ভে-ন্নজাতে বিয়ে!
সুমিত্রা আর মঞ্জুলিকা
উঠল ঘেমে নেয়ে।
- কিউট ডেসক্রিপশন - নেক্সট?
- কন্দর্পের বাণ যে কোনো বাধাই মানেনা। তাই কলকাতার খুকু একদিন শুভক্ষণে পায়ে আলতা পরে ঘোমটা মাথায় খোকার মতোই সুমিত্রা আর মঞ্জুলিকার আঁচলের তলায় ঢুকলো। সনটা ১৯৬৯। খোকার মাইনে তখন বেশি তো নয়। বড়দি সতীরানী ভাড়া থাকত পাইকপাড়ায়। সেই বাসায় বড়দির ঘরের পাশে ঢাকা বারান্দায় তাদের প্রথম সংসার। এরপর ওদের জন্য পাইকপাড়ায় একটা আলাদা বাসাবাড়ি নেওয়া হল। আর যুগটা হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিক্ষুব্ধ সত্তরের দশকে ঢুকে পড়ল।
- তারপর?
- তারপর -
উনিশশ ষাট পেরিয়ে
সত্তর যেই এল,
খোকা খুকুর ঘরে
একটা মেয়ের জন্ম হল।
এমন তো কতই হয়,
ঘটনার কি গুণ?
আরে এই মেয়েটাই,
এ গপ্পের - কথক ঠাকরুণ।
- ঠিক ঠিক, কিন্তু কথক ঠাক্রুণ - কৃষ্ণা তো বোস থেকে মণ্ডল হল, আধার কার্ডে তাই লেখা আছে, তুমি দাস মহাপাত্র হয়েও মণ্ডল রয়ে গেলে কেন? আমার সঙ্গে মেলালেনা।
- কারণ আছে।
মা যখন তার পার্কিন্সনে স্মৃতিটা হারাল,
ভাবলে মেয়ে এবার স্মৃতির প্রমাণ রাখা ভাল।
মায়ের দিকে কুলীন কায়েত জাতের ভারি বড়াই,
বাবার দিকে মাটি থেকে উঠে আসার লড়াই।
চাকরি করতে গিয়ে এল প্রেমের নাগপাশ,
বিয়ের পরে টুম্পা হল মহাপাত্র দাস।
পরিচয়ের বেলা তবু বাপের নামই বাছে,
ঐ নামের মধ্যে মেয়ের বাপের লড়াই বাঁচে।
- হুম, বুঝলাম, মেয়ে তো তাই বাপের দিকে ঢলে আছ। তা এই পাহাড় প্রমাণ স্মৃতির ভার নিয়ে যে পড়ে রইলাম আমি।
- আমার ভার আর কার ওপরে দিয়ে যাব তুইই বল? আমি দিয়ে দিলাম, তুই নিবি কীভাবে সেটা তোর ব্যাপার। মানুষ হয়ে পেট তো তোকে চালাতে হবে বাবু, তাই বুদ্ধি করে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ভারগুলো গুঁজে দিয়েছি। নিজে হাতে রান্না যদি নাও করিস, খেতে তো হবে। খাবার দেখলেই সব এক এক করে মনে পড়বে, ভুলতে পারবিনা।
- অ্যাঁ, এই বুদ্ধি করেছ তুমি? আর আমি না বুঝে শুধু গল্প শুনে গেছি।
- হুঁ হুঁ বাবা -
পাঁউরুটিতে মাখন মাখাই
পরোটা দিই ঘিয়ে,
পাঁচ দশকের জীবন লিখি
খুন্তি হাতা দিয়ে।
- সেটাই আগে বুঝিনি, ইন্টেলিজেন্ট। কিন্তু যদি কিছু ভুলে যাই, তবে?
- তবে -
আবার এসো পাকশালাতে
নিংড়ানো মন নিয়ে,
দলিলটি থাক তোর মনেতে
একশো বছর জীয়ে।