শ্বশুর-শাশুড়ি যখন আসতেন, তখন অনেক মজার মজার কাণ্ড ঘটত। শ্বশুরবাড়ির সব পুরুষমানুষ – বর, দেওর, শ্বশুর – সকলেই প্রচণ্ড ঘুমোতে পারে। বিছানায় পিঠ দিলেই ঘুম। রবিবার দুপুরে কর্তারা ঘুমোলে, আমি আর শাশুড়ি-মা দুই সইয়ের মত মনের কথা কইতে বসতাম। অনেক সময়েই সেই পিএনপিসি মানে পরনিন্দা-পরচর্চা – পতিনিন্দার দিকে গড়াত।
- ... তখন বাপু কী বলল জানো? ...
- ঐ তো, ঠিক বাপের স্বভাব পেয়েছে। ঐ নিয়ে তো সারাজীবন জ্বলছি।
- ... তারপর এই শুনে বাপু কী অশান্তি করল।
- বলতে গেছ কেন? সংসারে সব কথা পুরুষমানুষকে বলতে নেই।
কর্তারা ঘুম থেকে উঠলে দেখা যেত, মা ছেলের আর বৌমা শ্বশুরের অনেক গোপন খবর জেনে ফেলেছে। তারপর বিকেলের মুড়িমাখার সময়ে সব ফাঁস করা হত। বরেদের বিব্রত করে দুই সখী অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতাম। আর যখন ননদেরা আসত, তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিত – দু’জনে বসে কী কী পতিনিন্দা করেছি – আর অট্টহাসির রোল উঠত বাড়িতে। বিয়ের আগে যে তেল-আমের আচার এসেছিল, বড় বয়ামে সেই আচারই আসত গ্রামের বাড়ি থেকে। ঐ তেলে মুড়ি মাখত মিনি।
শাশুড়ি-মা আমার সঙ্গে শাড়ি অদলবদল করতে পছন্দ করতেন। পুজোর সময়ে পাওয়া একটু দামি অমরশীর তাঁত, ঢাকাই – না পরে নিয়ে আসতেন। বলতেন, এগুলো তুমি ভাঙবে। পরে কলেজে যাবে। পরেরবার এলে নিয়ে যাব। ততদিনে মাড় ধুয়ে কাপড় নরম হয়ে যাবে। তার বদলে আমার আলমারি থেকে সাদা বা চন্দন বেসের বাটিক, কলমকারি নিয়ে যেতেন। পরেরবার আবার ফেরত দিয়ে নিজেরগুলো নিয়ে যেতেন। ছেলে টক ছাড়া ভাত খেতে পারে না, তাই ধৈর্য ধরে আমাকে টক রান্নার কৌশল শেখাতেন। কয়েকটা এখানে বলছি।
১) কাঁচা মৌরলা মাছের অম্বল:
কাঁচা মাছে রান্না হবে যখন, মাছটা টাটকা হতে হবে। প্রথমে মাছগুলো পরিষ্কার করে আঁশ ছাড়িয়ে ধুয়ে নুন আর হলুদ মেখে ঘণ্টাখানেক ঢেকে রেখে দিতে হবে। পুরোনো তেঁতুল হলে স্বাদটা ভাল হবে। এবার কড়ায় তেল দিয়ে পাঁচ-ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা দিয়েই কড়ার উপর একটি মাপমত ঢাকনা চাপা দিতে হবে, যাতে ফোড়নের গন্ধ উড়ে না যায়। এবার কড়ায় তেঁতুল-গোলা জল দিয়ে একইরকম ভাবে চাপা দিয়ে ফোটাতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ ফোটার পরে ওই ফুটন্ত তেঁতুলজলে মাছগুলো ছেড়ে দিতে হবে। এবার মাছ সেদ্ধ হয়ে গেলে, পরিমাণ মতো নুন আর চিনি দিয়ে নামাতে হবে। এই পদটা স্বাদে একটু টক-মিষ্টি হয়। একইরকম ভাবে এই টক লেবু, কাঁচা আম বা আমসি দিয়ে বানানো যায়; শুধু লেবু, কাঁচা আম বা আমসির ক্ষেত্রে মিষ্টি দেওয়া হয় না আর টকে লেবু দেওয়ার নিয়ম হল – ঝোল একেবারে তৈরি হয়ে গেলে লেবু দিয়েই আঁচ থেকে নামাতে হবে – অর্থাৎ, লেবু দিয়ে আর ফোটানো যাবে না।
২) পোনা মাছের টক:
সাধারণত কাঁচা আম বা আমসি দিয়ে এই টক রান্না করা হয়। আমসি দিয়ে রান্না করতে গেলে আমসিটা আগে থেকে জলে ভিজিয়ে রাখলে ভাল হয়। রুই, কাতলা বা মৃগেল জাতীয় মাছের টক রান্না করা হয়। যত বড় বা পাকা মাছ হবে, তত ভাল টক রান্না হবে। যদি একেবারে টাটকা মাছ হয় তাহলে মাছের টুকরোগুলো খুব হালকা করে ভাজতে হবে – আবার অনেকে না ভেজেও করে। এই টক রান্নায় কাঁচা লঙ্কা আর সর্ষে একসঙ্গে বেটে নিয়ে ব্যবহার করতে হয়। প্রথমে তেলে শুকনো লঙ্কা, পাঁচ-ফোড়ন দিতে হবে। অবশ্য পাঁচ-ফোড়নের বদলে কালো গোটা সর্ষেও দেওয়া যায়। তারপরে কাঁচা আম বা আমসি দিয়ে একটু নেড়ে নিয়ে, পরিমাণ মত জল দিয়ে, তাতে সর্ষে, কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়ে ফোটাতে হয়, একটু পরে মাছ দিয়ে ভাল করে ফুটিয়ে নামিয়ে নিলেই মাছের টক রেডি।
৩) নানা সামুদ্রিক মাছের টক:
উপকূলবর্তী এলাকায় এবং যারা ট্রলারে করে দিনের পর দিন সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় তাদের মধ্যে এই পদগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। নানা প্রজাতির ফ্যাসা, ফিতে বা পাটিয়া, খাঁড়া বা সোর্ড ফিস, ভোলা, নানা প্রজাতির চিংড়ি থেকে পমফ্রেট বা মহার্ঘ ইলিশ – সব ধরনের মাছের টক রান্নার ব্যাকরণ মোটামুটি এক। তবে সমুদ্রের মাছ আগে ভাল করে ভেজে নিতে হবে আর সাধারণত এই মাছের টক তেঁতুল দিয়েই রান্না করা হয়। ফোড়ন হিসেবে সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে একটু বেশি সময় টকটা ফোটানো হয়। চিংড়ির টকটা একটু ঘন করা হয়, অনেকে আবার এই টকে একটু মিষ্টিও ব্যবহার করে। একমাত্র ইলিশের ক্ষেত্রে মাছটা কড়া ভাজা হবে না। হাল্কা ভাজা হবে।
মেজ নন্দাই যখন শ্বশুর বাড়িতে আসতেন, আমাকে বক্সীবাজারে নিয়ে যেতেন। কতরকম যে নোনামাছ বাজারে, তাদের চেহারা, আকৃতি সব কিছু অদ্ভুত। আমি অবাক হয়ে যেতাম। মাছগুলো বেশ স্বাদু, কিন্তু দামে কম। কম তো হবেই, স্থানীয় সমুদ্রের মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। শহরের মানুষ তো খেতে জানে না, তাই দামও ওঠে না। কিন্তু এই মাছগুলো এখানকার মানুষের শরীরে সস্তা প্রোটিনের যোগানদার। আর দীঘা-মোহনায় ইলিশ উঠলে, বাড়িতে ফোন চলে আসে। তখন বর, দেওর, আরো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কাকভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। কারখানা থেকে থার্মোকলের বাক্স কিনে রেখেছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে টাটকা ইলিশ ঠেসে বরফ দিয়ে চওড়া সেলোটেপ দিয়ে সিল করে নিয়ে আসে। শহরেও এভাবে ইলিশ নিয়ে আসি আমরা। প্রতিবেশী, নিকটজন ইলিশ উপহার পেলে খুবই খুশি হয়। হাওড়া স্টেশনের পাশে ইলিশের নিলাম হয়। সেখানেও যাওয়া হয় কখনো-সখনো।
৪) কাতলা বা ভেটকি মাছের মাখা ঝাল:
দু’-আড়াই কেজির উপরের কাতলা বা ভেটকি মাছে এই রান্নাটা খুব ভাল হয়। কাতলা মাছ দাগা-পেটি সহ কাটালে অর্থাৎ একটা রিং পিস-কে আড়াআড়ি ভাগ করে রান্না করলে সবচেয়ে ভাল হয়। মাছের টুকরোগুলো ভাল করে ধুয়ে ওতে নুন, হলুদ মাখাতে হবে। এরপর পেঁয়াজ, রসুন, সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা একসঙ্গে বেটে ওই মাছের টুকরোগুলোর সঙ্গে ভাল করে মাখাতে হবে, এবার মাছগুলোতে অল্প করে সর্ষের তেলও মাখাতে হবে। মাছগুলো এইভাবে ঘণ্টাখানেক রেখে দিতে হবে। এই রান্নায় ওই বাটার সঙ্গে যেটুকু জল আর মাছের গায়ে যেটুকু জল লেগে থাকবে, তার বাইরে একফোঁটাও জল ব্যবহার করা হয় না। এবার কড়ায় তেলে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে তাতে মেখে রাখা মাছ, মশলা-সুদ্ধ দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। আঁচ একেবারে ঢিমে থাকবে। কিছুক্ষণ পরে পরে ঢাকা খুলে খুব সাবধানে মশলা-সুদ্ধ মাছ উল্টে দিতে হবে। সাবধানে ওল্টাতে হবে, কারণ তা নইলে মাছের টুকরোগুলো ভেঙে যেতে পারে। এভাবে বারকতক ওল্টানোর পরে যখন তরকারি থেকে তেল ছেড়ে যাবে, তখন বোঝা যাবে রান্না হয়ে গেছে। এই মাখা ঝাল ভাতের সঙ্গে গরম গরম খেলে জিভের তারে ঝঙ্কার ওঠে নিশ্চিত, আমার উঠেছিল। আসলে আমার বাপের বাড়িতে মাছ রান্নার বেস মশলা – যেমন জিরে, ধনে, আদা – শ্বশুরবাড়িতে হল পেঁয়াজ, রসুন, সর্ষে। আবার বাপের বাড়িতে সর্ষেটা জল মিশিয়ে ঢেলে দেওয়া হয়। ঘন সর্ষেবাটা কখনও অন্য মশলার সঙ্গে কষতে দেখিনি। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে সেটাও দেখেছি। যদিও আমি এমন করি না। একটু-আধটু নিজের মত ইম্প্রোভাইজ করেছি।
শ্বশুরবাড়িতে রোজকার ঝোল, ডাল, সবজি – সবকিছুতেই পেঁয়াজ পড়ে। ওটা ছাড়া রান্নার ধারণা খুব কম মানুষের আছে। বাড়িতে মিনিকে ডাল রান্না শিখিয়ে দিতাম। আমার মা সপ্তাহে সাতদিন সাতরকম ডাল করত, আমারও তাই খাওয়া অভ্যেস ছিল। কিন্তু মিনি শুনত না। ও যা আগে থেকে জানত, সেটাই থোড় বড়ি খাড়া করে যেত। একদিন খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, তুই ডাল করতে পারিস না কেন রে? তোদের বাড়িতে তো ডাল খেয়েছিস। কথাটা বললাম, কারণ ছোটো থেকে শুনেছি, প্লেন লিভিং হাই থিঙ্কিং করতে হলে মোটা কাপড় আর ডালভাত হলেই চলে যায়। পুঁথিগত বিদ্যে থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, গরীব মানুষেরা, যারা বেশি উপকরণ জোটাতে পারে না, তারা ডালভাত খায়। কিন্তু আমার কথা শুনে মিনি হেসে উঠল। বললে,
- ডাল? আমাদের বাড়িতে ডাল? ডালের কত দাম তুমি জানো বো-দি?
- না, অনেক দাম?
সত্যিই আমি জানি না। আমি তো মাসকাবারি বাজার করি না। শখে এটা-ওটা কিনি, লাল হলুদ বেল পেপার, ব্রকোলি এইসব।
- শোনো বো-দি, আমাদের বাড়িতে একটাই তরকি হয়, বেশি করে কঁচা ঝাল্অ দিয়ে, যাতে একটুখানি তরকি দিয়ে বেশি ভাত খাওয়া যায়। অনেকে ভাতেও কঁচা ঝাল্অ চকটে দেয়।
অধোবদন হই, গরীব মানুষ ডাল দিয়ে নয় ঝাল দিয়ে ভাত খায়। ‘আমি ঝাল খেতে পারি না’ – এ ধরনের বাক্যবন্ধ যে বলতে পারে, সে আসলে খাদ্যের বিষয়ে সুরক্ষিত। রান্নাঘর যেন আমার গালে ঠাসিয়ে এক চড় মারে।
শ্বশুরবাড়ির দেশে নিরামিষ বা পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্নার চল একেবারে যে নেই, তা কিন্তু নয়। কিন্তু এর সঙ্গে একটা অনুষঙ্গ আছে। সেই অনুষঙ্গ হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। আমার কলেজের পাশে শাঁখরাইল থেকে সেই যে তিনি নৌকোয় উঠলেন শেষবারের মত ঊৎকল যাবার জন্য, সেই নৌকোতেই ডায়মন্ড হারবারের কাছে কোনো জায়গায় তিনি মেদিনীপুরের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর যাত্রাপথে আজও বেঁচে আছে বৈষ্ণব সংস্কৃতি। এ অঞ্চলে রথযাত্রা খুব বড় উৎসব, আর শ্বশুরবাড়ির পাশের গ্রাম ডেমুরিয়াতে আছে এক সুপ্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। এক ভক্ত পুরীর জগন্নাথ দর্শন করে এসে বর্ণনা করে করে শিল্পীকে দিয়ে বিগ্রহ নির্মাণ করিয়ে ছিলেন। তখন তো আর ছবি তোলা আবিষ্কার হয়নি। সেই বিগ্রহ আজও তেমনই আছেন, নবকলেবর হননি। বর্গি আক্রমণের সময়ে ইনি ভক্তগৃহে অন্তর্ধানও করেছিলেন। রথ উপলক্ষে তো বটেই, পারিবারিক যে কোনো ভাল-মন্দে, শোকে-আনন্দে মহোৎসবের আয়োজন করা এই এলাকার মানুষের সংস্কৃতি। এখানেই স্থানীয় মানুষের মুখে গল্প শুনেছি, চৈতন্য নয়, নিত্যানন্দ প্রথম চূড়া মহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। চূড়া মানে চিঁড়ে। উদ্দেশ্য ছিল জাতপাত নির্বিশেষে একসঙ্গে পংক্তিভোজন। সেই সংস্কৃতি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ভোগের জন্য যে তরকারি রান্না করা হয়, তার বিশেষ পদ্ধতি আছে। এখানে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে যে পদই রান্না হোক না কেন, তাতে কোনো তেল পড়ে না। সবটাই মূলত সেদ্ধ নির্ভর। সে শাক হোক বা আলুপটলের ডালনা বা এঁচোড়ের তরকারি। কোনো সবজিই কষা হয় না। আগে সেদ্ধ করে তাতে পদ অনুযায়ী নারকেলের দুধ, জিরে বা আদাবাটা মিশিয়ে আর ঘি ছড়িয়ে এই রান্না করা হয়। নানা পদের সঙ্গে একটি নিরামিষ টক রাখতেই হয়। এই বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা তরকারির স্বাদ হয় অপূর্ব। যে না খেয়েছে, সে বুঝবে না। যাঁরা এই ভোগ রান্না করেন, তাঁরা বহু প্রজন্ম ধরে এই পদ্ধতিতে রান্না করে আসছেন। এবং এই পদ্ধতির মধ্যে মন্ত্রগুপ্তি আছে যা ঐ পরিবারগুলির বাইরের মানুষেরা জানে না। ডেমুরিয়ার ঐ প্রাচীন মন্দিরে এইভাবেই নিত্য অন্নভোগ হয়। দীঘায় ঘুরতে আসা পর্যটকেরা বেশিরভাগই এই মন্দিরের কথা জানেন না। কিন্তু দীঘা থেকে ঘুরে আসা যায়। কারণ এটি ওখান থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কাছেই স্থানীয় পঞ্চায়েত একটি চমৎকার সাজানো ঝিল বানিয়েছে – নীলাচল। বিগ্রহের সঙ্গে ঝিলটাও ঘোরার মতোই জায়গা। পরবর্তীকালে ডেমুরিয়ার মন্দিরে যে সংস্কার কার্য হয়েছিল, তাতে আমাদের পরিবারের অবদান আছে। শ্বেতপাথরের ফলকগুলির প্রথম ফলকটিতেই সে কথা লেখা আছে।
মহোৎসবের রান্না ছাড়াও টুকিটাকি নিরামিষ হয়। যেমন রান্নার শেষে নিভন্ত উনুনে আলু ফেলে আলু পোড়ানো। আলু-ভাতের থেকে আলু-পোড়া অনেক বেশি স্বাদু। আঁচে চাটু রেখে টমেটোও পোড়ানো হয়। টমেটো-পোড়া দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে আমার কর্তা ভালবাসেন। এরকম আর একটা পদ হল মোচা-পোড়া।
এক্ষেত্রে পুরো মোচাটা কাঠ বা কয়লার আঁচে পোড়ানো হয়। উপরের খোলা পুড়ে গেলে আগুন থেকে বার করে মোচার খোলা খুলে খুলে ভেতরের অংশ বার করে তার সঙ্গে সর্ষে, কাঁচা লঙ্কা, ভাজা জিরে গুঁড়ো, পরিমাণমত নুন – ভাল করে মেখে, প্রয়োজনে শিল-নোড়ায় থেঁতো করে মেখে পরিবেশন করা হয়। গরম ভাতে খেতে খুব ভাল লাগে।
ভাতে খাওয়ার কথায় মনে পড়ল, এখানে এসে আর একটা জিনিস খেয়েছি, যেটা বাপের বাড়িতে কখনও খাইনি – চালতা ভাতে। বাড়ির পিছনে রাস্তার ধারে এক বিশাল চালতা গাছ আছে, প্রচুর ফলে ভরে থাকে। গ্রামের বহু বাড়িতে হঠাৎ অতিথি এসে গেলে, এ গাছ থেকে চালতা পেড়ে, অতিথি সৎকার করা হয়। আর একটা কথা, আমাদের বাড়ির জমি দেখিয়ে ঘটকেরা নাকি বহু ছেলের বিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ করেছে ছেলে বর্ধিষ্ণু ঘরের, মেয়ে দিতে পারেন। তারপর বিয়ের পর পর্দা ফাঁস। বৌগুলির তখন ঘটককে শাপশাপান্ত করা ছাড়া আর অন্য উপায় থাকে না। প্রথম প্রথম এসব শুনে অবাক হতাম, রাগ হত। কিন্তু এখন বুঝেছি, গরীব ঘরে বাপ মায়ের কাছেই মেয়েদের দাম নেই। কোনোক্রমে মেয়ে পার করতে পারলেই তারা নিশ্চিন্ত। তারপর যা খুশি হোক না। দায় মেয়েটির, বাপের নয়। কখনো-সখনো বিয়ের পরে আমাদের বাড়িতে মেয়ের বাড়ির লোক খোঁজ নিতে আসে। তখন এ বাড়ির লোক জানতে পারে। মেয়েদের জীবনে মিথ্যার চাষ বড় বেশি। হাজার লোক তাকে শুধু ঠকিয়েই যায়। যা হোক, চালতায় ফিরি। আমার বাপের বাড়িতে চালতার মিষ্টি চাটনি করত মা। কিন্তু এখানে মিষ্টি পড়ে না। চালতার নোনতা টক হয়। আর হিট আইটেম হল চালতা চিংড়ি। এখন আমার হট ফেভারিট। তবে হ্যাঁ, চালতা কাটা খুব শক্ত, বিশেষ পদ্ধতি আছে। আর ফলটা পিচ্ছিল। চাপ দিয়ে কাটতে হয়। একটু অসতর্ক হলেই চালতার বদলে চালতা কাটুনির হাত ফালাফালা হবার ঝুঁকি থাকে ষোলো আনা। তাই চালতা পাড়া হলে, সব চালতা একসঙ্গে কেটে সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। ইচ্ছেমত রান্না করা হয়। চালতা সেদ্ধ করে নিয়ে জল ফেলে না দিলে তরকারি কষা হয়ে যায়। রান্নার তাড়াহুড়োর সময়ে চালতা কাটা যায় না। তবে চালতা ভাতে হলে ঝুঁকি কম। কারণ বর্ষাকালে যখন নরম চালতা ওঠে, তখন আস্ত ফলটাই ভাতের মধ্যে ফেলে সেদ্ধ করে নেওয়া হয়। এবার সেদ্ধ চালতা সর্ষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা, নুন আর অল্প একটু সর্ষের তেল দিয়ে মেখে খাওয়া হয়। আর চালতা চিংড়ি করাও শক্ত কিছু নয়। চিংড়ি আগে ভেজে নিতে হবে। চিংড়িটার কিন্তু আকারের ব্যাপার আছে। বড় চিংড়িতে এই টকের স্বাদ খোলে না, ছোটো চিংড়ি চাই। আবার খোসা ছাড়ানো যাবে না – এতটা ছোট হলেও চলবে না। চালতা লম্বা করে কেটে আগেই সেদ্ধ করা আছে। এবারে তেলে গোটা কালো সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তার মধ্যে কিছুটা চালতা সেদ্ধ দিয়ে নেড়ে নিতে হবে। তারপর সর্ষেবাটা জলে গুলে একটু হলুদ, নুন দিয়ে ঢেলে দিতে হবে। তারপর ঝোল ফুটে গেলে ভাজা চিংড়ি দিয়ে আর একটু ফুটিয়ে নিতে হবে। চালতা চিংড়ির ঝোল পাতলা রাখা হয়। খুব ঘন, আর অতিরিক্ত টক হলে চালতা চিংড়ি খেতে ভাল লাগে না।