সতীমায়ের পুজো
আমার পরিবারের গ্রামের বাড়িতে বছরে একদিন ঘট প্রতিষ্ঠা করে সতীমায়ের পুজো হত। আবার আমার মামার বাড়িতে সতীমায়ের ঘট বংশপরম্পরায় নিত্যপূজা হত। কিন্তু দুই পূজার রীতিনীতি ছিল একদম আলাদা। শুধু মিল বলতে – দুই বাড়িতেই দোলযাত্রার দিনটা সতীমায়ের দিন ভেবে ভক্তিভরে পালন করা হত। বড় হয়ে জানতে পারলাম, বৈষ্ণব ধর্মের এক শাখা, কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধক আউলচাঁদের কথা। তাঁর স্ত্রী হলেন সাধিকা সতীমা। নদীয়ার ঘোষপাড়ায় এই সম্প্রদায়ের মূল আশ্রম। শুনেছি অন্য অনেক বিষয়ে খামখেয়ালি হলেও, আমার দাদু বিকাশচন্দ্র বোস গৃহদেবতার পুজো করতেন নিয়মিত ও খুব নিষ্ঠাভরে। মাতামহের বংশের সেই ঠাকুর এখনও আমার মামা সুজিতচন্দ্রের পুত্র মনোজিতের কাছেই আছে। একটি শ্বেত পাথরের শিবলিঙ্গ আছে – আজকাল যেমন দেখা যায়, তেমন নয়। বেশ বড়, ডিম্বাকৃতি। তেপায়া স্ট্যান্ডের ওপরে থাকে। ওটি যে শ্বেত পাথরের, তা আমরা জানতাম না। কারণ দেবতার রং ছিল গাঢ় বেগুনি। মামার বিয়ের পরে, মামীমা সরস্বতী, ঐ শিবলিঙ্গ ধুয়ে মাজতে গিয়ে অবাক হয়ে যান। পরে দোকানে দিয়ে মাজিয়ে ভিতরের শ্বেত পাথর বেরিয়ে পড়ে। একশ’ – বা হতে পারে দুশ’ – বছরের রক্তচন্দনের প্রলেপ পড়ে শিবঠাকুর অমন রূপ নিয়েছিলেন। এটি আবিষ্কার হতে মামীমা শখ করে ঐ শিবলিঙ্গের গায়ে রুপোর চোখ নাক বসিয়ে দেন। এখনো তেমনি আছে। এগুলো ১৯৭৭ এর ঘটনা।
শিবলিঙ্গের পাশেই আছে সতীমার ঘট। প্রায় দশ ইঞ্চি উঁচু, ভারি একটি পেতলের ঘট। ঘটটি ছোটবেলা থেকে আমাকে খুব আকর্ষণ করত। কারণ ঐ ঘট, বংশের অদ্ভুত নিয়মের জন্য, আমি কোনোদিন স্পর্শ করতে পারিনি। পুরুষ সদস্য ছাড়া, নারী সদস্যদের ঐ ঘট ছোঁওয়ার অধিকার নেই। তাছাড়া, ঐ ঘটের জল পুরো ফেলে কোনোদিন জলশূন্য করতে নেই। আর ঘট সবসময়ে সিঁদুর লেপে রাখতে হয়। তাই পেতলের ঘট বলে চেনা যায় না। একটা কালো পাথরের বাটি দিয়ে সেই ঘটের জল চাপা দেওয়া থাকে। দোলের দিন বড় করে সতীমার ঘটপুজো হয়। দাদু ঐ দিন নিজে হাতে দধিকর্মা মাখতেন। মামা সুজিতচন্দ্র যতদিন বেঁচে ছিলেন, মানে ২০১৮ পর্যন্ত, এই বিশেষ পুজো করেছেন। মামার হাতের দধিকর্মা খাব বলে আমরা দোলের দিন হাপিত্যেস করে বসে থাকতাম, কখন মামা আসবে। বিকাশ চন্দ্রের বড় মেয়ে কৃষ্ণা (আমার মা) ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আমার বাবা আড়বালিয়ার বাসিন্দা সমীর কুমার মণ্ডলকে। আড়বালিয়া আর লাগোয়া ধান্যকুড়িয়া হল বসিরহাটের ট্যুরিস্ট প্লেস – অসংখ্য জমিদার বাড়ি আর প্রাসাদ দিয়ে সাজানো। এ অঞ্চলের ইতিহাসও অতি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বসু, নাগ চৌধুরী, সাউ, গাইন এইসব বড় বড় জমিদারের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জন্মও আড়বালিয়াতে। সে যাই হোক, আমার ঠাকুর্দা জমিদার ছিলেন না। তিনি ছিলেন নাগচৌধুরীদের পারিবারিক চিকিৎসক। আমার বাবা কলকাতা বন্দরের হেড অফিসে ক্লার্ক ছিলেন এবং হোমিওপ্যাথি পাশ করেছিলেন। অবসরের পরে পাইকপাড়ায় চুটিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। অনেক সময়ে এমন হত, রোগীরা ঐ সামান্য ভিজিট দিতে না পারলে ডাক্তার বাবু নিজের খরচে চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। ২০২১ এর ২রা ফেব্রুয়ারি বাবা মারা যাবার পরে, চল্লিশ বছরের ভাড়ার চেম্বারটি যখন আমার স্বামী ছাড়তে গেলেন, তখন লকডাউনের ভিতরেও এলাকার লোক ভিড় করে এসেছিল। বাড়িওলা আর এলাকাবাসীর কান্না দেখে আমার স্বামীও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
যাকগে, কথা হচ্ছিল সতীমার ঘট নিয়ে। বলছি, আমাদের আড়বেলের বাড়িতে কিন্তু সতীমার পুজো এমন নয় মোটেই। নদীয়ার ঘোষপাড়ায় সতীমার যে মন্দির ও আশ্রম আছে, সেখানেও দোলের দিন উৎসব হয়। বাড়িতে একটা ছবি আছে সতীমার। ঘোষপাড়া থেকে কেনা। বহুদিন আগের, ভিতরে পোকায় কেটেছে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বছরের যে কোনো একদিন সকলের সুবিধামত সতীমার পুজো হত। আমরা বলি সতীমার কাজ। বড়জেঠু, মেজজেঠু, সেজজেঠু আর আমার বাবা, চারভাই আর আমার পিসি – এই পাঁচটি পরিবার এক হতাম। ঠাকুমার বাপের বাড়ি ও বিরাট যৌথ পরিবার। সেখান থেকে কাকা-পিসিরা আসতেন। কিন্তু সেখানে পুরোহিত ডেকে পুজো হত না। মেজ জ্যাঠাইমা ঘট প্রতিষ্ঠা করতেন। বড় জ্যাঠাইমা আলপনা দিতেন। মা আর সেজ জ্যাঠাইমা হাতে হাতে এগিয়ে দিতেন। আমরা চার বোন ফুল তুলতাম, মালা গাঁথতাম, চন্দন পাটায় চন্দন বাটতাম; সতীমার ছবি, আর ঠাকুমা-ঠাকুরদার ছবিতে চন্দন পরিয়ে মালা দিয়ে সাজাতাম। ঝুরি-নামা তেঁতুল গাছের তলায় বেদী ছিল। বড় জ্যাঠাইমার আলমারিতে বোনা আসন থাকত। সেগুলো পাতা হত। এবারে দাদাদের যোগাড় করা ইট পিছনে দিয়ে আসনে ছবি বসানো হত। পুরো বেদী আমরা ফুল দিয়ে সাজাতাম। পুরোহিত ডাকা, যাগযজ্ঞ, অংবং মন্ত্রোচ্চারণ – কিছুই হত না। সতীমাকে সামনে রেখে এ যেন পরিবারের এক মিলনোৎসব, সেই সঙ্গে পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্মরণ।
সেদিন বাড়িতে ফল কাটা আর রান্নার বিরাট পর্ব চলত। সারা সকাল-বিকেল চলত ফল কাটা আর কুটনো কোটা। বড় বড় কাঁসার বগি থালায় পাঁচ রকম বা সাত রকম ফল কাটা হত। শসা, কলা, আখ, বাতাবি লেবু, খেজুর, আম, লিচু – যখন যেমন পাওয়া যেত। বাড়িতে কোটা লাল চিঁড়ে আর আখের গুড় মিশিয়ে একরকম শুকনো শুকনো মিষ্টি চিঁড়ে বানানো হত। আর দু’ রকমের নারকেল নাড়ু হত। গুড়ের আর চিনির দু’ রকম নাড়ুই হত বেশ বড় বড়। কিন্তু গুড়ের বা চিনির পাক চিটচিটে হত না, বেশ শুকনো। দাঁতে আটকাত না। বসিরহাটের বিখ্যাত মাখা সন্দেশ দেওয়া হত। আর অতিথি অভ্যাগতরা যদি কোনো মিষ্টি নিয়ে আসতেন, তো সেগুলোও ভোগে সাজিয়ে দেওয়া হত। মটর, পাঁচ কড়াই, গোটা মুগ ভেজানো থাকত। সন্ধের মুখে, বড় বড় কাঁসার বাসনে এই শীতল ভোগ সতীমায়ের থানে নিবেদন করা হত। সঙ্গে চারটে কাঁসার গেলাসে জল দেওয়া হত। মা আর সেজজ্যাঠাইমা মাথায় ঘোমটা দিয়ে, ডানহাতের পাতা কাঁধের কাছে তুলে, বড় পাথরের থালার তলায় দিয়ে, আর বাঁ-হাতে থালাটাকে ধরে ঠাকুরের কাছে নিয়ে আসছে – এই ছবিটা চোখে ভাসে। এই পুরো নিবেদনটিকে বলা হত জলসেবা।
কর্তারা বাজার করতেন, বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ করতেন। পিসি সবার বড়, সব ফল-প্রসাদ আর ভোগের বিলি-ব্যবস্থার তদারকি করতেন। তাঁর নজর এড়িয়ে কুটো নড়ার উপায় থাকত না। দাদারা, বড়দের কিছু দরকার হলে, দোকান ছুটত। আর আমাদের টুকিটাকি প্রয়োজনে আগানে-বাগানে দৌড়াদৌড়ি করত। সন্ধে হলে হ্যাজাক জ্বালত। প্রসাদ খাওয়ার কলাপাতা কাটত মাপ করে। ফল খাওয়ার জন্য ছোট-ছোট। আর ভাত খাওয়ার জন্য বড়। সবার কাজের আলাদা ভাগ ছিল। উঠোনে সতরঞ্চি পাতা হত। ঠাকুরদার পুরোনো বাড়ির লম্বা টানা দাওয়ায় আমরা অতিথিদের নিয়ে মাদুর পেতে বসতাম। সন্ধের মুখে কীর্তনের দল আসত হারমোনিয়াম নিয়ে। মা যখন বৌ হয়ে এ বাড়িতে আসে, তখন শুনেছি সরাসরি ঘোষপাড়া থেকেই প্রায় পঞ্চাশজন গায়ক এবং বাজনদার আসতেন। একদল শেষ করে যখন চায়ের বিরতি নিতেন, তখন অন্যদল গেয়ে যেত। গান থামত না। সঙ্গে তবলা আর খঞ্জনিও থাকত। প্রায় সারারাত সতীমার কীর্তন গান হত। একদিকে বারবাড়িতে কীর্তন চলত, আর অন্দরে জোরকদমে চলত অন্নভোগ তৈরি। এই ভোগ কিন্তু নিরামিষ ছিল না, আমিষ। শুক্তো প্রথম পাতে, তারপর মুড়োর ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, ছ্যাঁচড়া, আলুপটল বা আলু ফুলকপির তরকারি, পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি, মিষ্টি, দই। এই অন্নভোগ নিবেদনের জন্য বড় বড় পাথরের থালা ছিল। সেগুলোকে বলা হত ভোগের পাথর। রান্না শেষ হলে, রাতের বেলা, মা-জ্যাঠাইমারা সেই ভারি ভারি থালা বয়ে এনে, সতীমায়ের থানে এনে রাখত। এই প্রক্রিয়ার নাম ছিল অন্নসেবা। একটা পাত্রে ভোগের সবরকম তরকারি একটু একটু নিয়ে তার সঙ্গে অন্ন মেখে রাখা হত, আর পরিবেশনের সময়ে সকলের হাতে একহাতা করে দেওয়া হত, পাতে নয়। একে বলা হত ভোগের “পারস”।
মায়ের কাছে জেনেছি, ঘণ্ট আর ছ্যাঁচড়ার মধ্যে তফাৎ হল, দুটোই শাক আর সবজির উপকরণ দিয়ে রান্না হয়, কিন্তু ঘণ্ট নিরামিষ, ছ্যাঁচড়া আমিষ। এতে মাছের মাথা আর মাছের তেল পড়ে। সবজি সব লম্বা করে কাটা হয়। মাছের মাথা আর তেল-নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখা হয়। একটু বেশি তেল লাগে। প্রথমে সর্ষের তেলে মাছের মাথাটা খুব কড়া করে ভাজা হত। কড়কড়ে হয়ে গেলে খুন্তি দিয়ে মাথাটা টুকরো করে ভেঙে দেওয়া হত। এবারে ঐ তেলেই শাক বাদে সব সবজি ভেজে তুলে নেওয়া হত। এবার কড়ায় আবার নতুন করে তেল দিয়ে, তাতে চিনি গলিয়ে ক্যারামেল করে নেওয়া হয়। চিটচিটে হবার আগে – চিনি তরল হলেই – পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা, রসুন কুচি ফোড়ন দিয়ে, পেঁয়াজ কুচো লাল করে ভেজে নেওয়া হত। এবারে কড়ায় নুন-হলুদ মাখানো মাছের তেল দিয়ে খুব ভালভাবে ভাজতে হবে। মাছের তেল গলতে শুরু করলে, তাতে রসুন বাটা, হলুদবাটা, জিরেবাটা, ধনেবাটা আর শুকনো লঙ্কা বাটা দিয়ে কষা হত। একটু একটু জলের ছিটে দিয়ে কষতে হবে, যাতে পুড়ে না যায়, বা কড়ায় লেগে না যায়। এখন অবশ্য এসব মশলা বাটার ব্যাপার নেই, সব গুঁড়ো ব্যবহার করি। এই সময়ে কেটে রাখা শাক মিশিয়ে দিতে হবে। পরিমাণমত নুন মিশিয়ে, নাড়াচাড়া করে, কয়েকটা আস্ত কাঁচালঙ্কা দিয়ে, আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে। শাক-সবজি সব সিদ্ধ হয়ে গিয়ে তেল ছেড়ে দিলে, ছ্যাঁচড়া তৈরি। আস্ত কাঁচালঙ্কায় ঝাল হবে না, কিন্তু একসঙ্গে ভাপানোর ফলে খুব সুন্দর কাঁচালঙ্কার একটা সুবাস হয়। আমি এখন মাঝে মাঝে ফোড়ন দেওয়ার সময়ে শুকনো লঙ্কা না দিয়ে, তিন চারটে কাঁচালঙ্কা, শিলে ছেঁচে, তেলে দিয়ে ভাজি। ঐ সুবাসটা আমার ভালো লাগে। আসলে মা শুকনো লঙ্কা খুব একটা পছন্দ করত না তো, সেই প্রভাবে কাঁচালঙ্কার প্রতি আমার একটু টান আছে। ছ্যাঁচড়ায় সবজির তালিকা তো বলিনি এখনও। আলু, বেগুন এই দুটো দিতেই হবে। আর বাকি সবজি, যে ঋতুতে যেমন পাওয়া যায় – কুমড়ো, ঝিঙে, বরবটি, বা শিম, মুলো – সবই দেওয়া যায়। শাক শীতকাল হলে পালং, নতুবা নটে।
আমরা রাত বাড়লেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেতাম। গভীর রাতে বাবা তুলে নিয়ে যেত কীর্তনের ভূমে প্রণাম করার জন্য। ততক্ষণে কীর্তন শেষ হয়েছে। এরপর বিজয়ার মত বাড়ির সব বড়কে প্রণাম করতে হত। তারপর মেজজেঠুদের পাকা ছাদে আসন পেতে সকলের খাবার জায়গা করা হত। আমাদের পরে মায়েদের খেয়ে উঠতে ভোর হয়ে যেত।
বড় হয়ে আমি মেজজ্যাঠাইমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাদের বাড়িতে এই সতীমায়ের পুজোর রীতি কিভাবে এল? উত্তরে যা শুনলাম, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেজজ্যাঠাইমা বলেছিল যে, আমার ঠাকুরদার মা সতীমায়ের বংশের মেয়ে ছিলেন। তিনি সাধিকার জীবন যাপন করতেন। তিনিই এই বাড়িতে সতীমায়ের বেদী প্রতিষ্ঠা করেন। আমার ঠাকুমার বিয়ে হয়েছিল ১৯০৬-এ পাঁচ বছর বয়সে। ঠাকুরদা তখন বারো। তার মানে ঠাকুরদার মায়ের এই বেদী প্রতিষ্ঠার সময়টা উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকের শুরুতে ধরে নেওয়া যায়। তিনি দীর্ঘজীবী ছিলেন। ১৯৫৬-য়, কিশোরী বেলায়, মেজজ্যাঠাইমা যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে, তখন তাঁকে দেখেছিল। তিনি নানারকম গাছ গাছড়ার ওষধি-বিদ্যা জানতেন। সে সময়ে বয়সের কারণে গ্রামের লোক তাঁকে ভালোবেসে বুড়োদি বলে ডাকত। কিন্তু তাঁর আসল নাম কি, সেটা মেজজ্যাঠাইমা জানে না। ঐ বুড়োদির জন্য, গ্রামের লোক যখন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেত, তখন মন্দিরের মত কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করত। বুড়োদির ঐতিহ্য অনুসারে, আমার ঠাকুমা হেমনলিনী সতীমায়ের পুজো করেছেন, আবার হেমনলিনীর ধারা বজায় রাখার জন্য মা-জ্যাঠাইমারা করেছে। এটা এই পরিবারের শাশুড়ি-বৌমাদের পরম্পরা। এখানে বাড়ির পুরুষদের সরাসরি সম্পর্ক নেই। আমি আশ্চর্য হয়ে আমার প্রপিতামহী বুড়োদিকে মনে মনে প্রণাম জানাই। তবে একটা খটকা পরিষ্কার হল না। সাধক আউলচাঁদের ধারা যদি বৈষ্ণব ধারা হয়, অন্তত আন্তর্জালে তেমন লেখা আছে, তবে আমাদের সতীমা মাছে-ভাতে ভোগ গ্রহণ করেন কি করে? তবে আয়োজন, খরচখরচা ছাড়া, পুজোর সব কর্তৃত্বই কেন মেয়েদের হাতে ছিল এবং ছেলেরা কেন ছিল মেয়েদের হুকুমবরদার – সেটা একেবারে জলের মত পরিষ্কার।
নিজের বাড়িতে এমন দেখতাম, অথচ মামার বাড়িতে সতীমার ঘটে কেন মেয়েরা হাত দিতে পারে না, পুজো করতে পারে না, আর তাছাড়া পুজোর ঘট অত বড়ই বা কেন – এ সব প্রশ্ন মনে উঠত। কেন ওটা খুব একটা নাড়ানো হয় না, জল ফেলা হয় না, চকচকে করে মেজে স্বস্তিকা, আর সিঁদুর পুতুল আঁকা হয় না, সেটাও আশ্চর্য লাগত। মা বা দুই মামা এসব বিষয়ে কিছুই আমাকে বলে যাননি। আজ এতদিন পরে, যখন তিনজনেই নেই, জানতে পারলাম সেই ঘটের রহস্য, বাবলিদির কাছে। বাবলিদি হল আমার দাদু বিকাশ চন্দ্রের বড়দা সতীশ চন্দ্র বোসের নাতনি। শুনলাম, মামার বাড়ির সতীমার ঘট আর আমাদের বাড়ির সতীমা সম্পূর্ণ আলাদা। দুই ক্ষেত্রেই দোলের দিনে উৎসব হয় বটে, কিন্তু সেটা কাকতালীয়। মানে ঠিক কাকতালীয় নয়, আসলে কৃষ্ণ সম্পর্কিত। বুঝিয়ে বলতে হবে, এক কথায় হবে না। আমার মায়ের ঠাকুমা লেখিকা, স্বাধীনতা সংগ্রামী কুমুদিনী বসুর শাশুড়ি ছিলেন শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেবের সেজ মেয়ে। শ্বশুর হলেন মহেশচন্দ্র বসু। কিন্তু এই মহেশচন্দ্রের পরিচয় এখনও খোলসা হয়নি। কারণ বংশলতিকা হারিয়ে গেছে। তবে সেটা ছোটবেলায় আমি দেখেছি। মহেশচন্দ্র রামরাম বসুর প্রপৌত্র। বাবলিদির কাছে সতীমায়ের ঘটের রহস্য শুনে আমি কেঁপে উঠলাম। তবে বাবলিদির কাহিনী পারিবারিক শ্রুতি-নির্ভর। এর কোনো প্রামাণ্য নথি বা তথ্যপ্রমাণ নেই। মহেশচন্দ্ররা তিন ভাই। কাজের সূত্রে রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর এবং কর্মকুশলতার জন্য তিনি রাধাকান্তের স্নেহভাজন ছিলেন। মহেশচন্দ্রের অজান্তে তাঁর মা পিতার চিতায় সহমৃতা হন। মহেশচন্দ্র একথা জানতে পেরে, রাগে অভিমানে সতীর মৃত্যুর ঘট মাথায় নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। বৃদ্ধ রাধাকান্ত মহেশচন্দ্রকে ডেকে নেন, আশ্রয় দেন এবং নিজের সেজমেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই করে নেন। কুমুদিনীকে ধরে পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ আমি এবং মনোজিত। কুমুদিনীর শাশুড়ির মানে আমাকে ধরে ছয় পুরুষ আগের এক বধূর সতী হওয়ার বা জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুর ঘটের জল আর সিঁদুর আমার মামার বাড়িতে পুজো হত। দোলের দিন পুজো হওয়ার কারণ একটু অন্য। মামার বাড়ির গৃহদেবতা হলেন শ্রী রাধারমণ জীউ (আশ্চর্য, এখানেও কৃষ্ণ!)। যদিও গৃহদেবতা এখন আর বোসবাড়ির কাছে নেই। কুমুদিনী, স্বামী মারা যাবার পর, শোভাবাজার রাজবাড়ি ত্যাগ করেন। নাবালক পুত্রদের নিয়ে তৃতীয় পুত্র সুরেন্দ্র নাথের আশ্রয়ে চলে যান। এই সুরেন্দ্রনাথ, মানে আমার সেজদাদুকে বাল্যকালে দত্তক নিয়েছিলেন হাটখোলার দত্ত বাড়ির দয়াল দত্ত। কুমুদিনীর দাদু ঋষি রাজনারায়ণ বসু এবং দিদা আবার হাটখোলার দত্ত বাড়ির মেয়ে। হয়তো দয়াল দত্ত, সম্পর্কে কুমুদিনীর মামা অথবা ভাই – সেটা এখনও নিশ্চিত জানি না। সুরেন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন আন্দুল রাজবাড়ির মেয়ে। তিরিশ বছর বয়সে, কোনো কারণে এই আন্দুল রাজবাড়িতেই সুরেন্দ্রের অপঘাত মৃত্যু হয়। নানা পারিবারিক দুর্যোগে গৃহদেবতার নিত্যসেবায় বিঘ্ন উপস্থিত হওয়ায়, আমার দাদু কিশোর বয়সে সমস্ত অলঙ্কার সমেত রাধারমণ জীউয়ের বিগ্রহ দান করে দিতে বাধ্য হন। তথাপি সেই রাধারমণকে মনে রেখে দোলের দিন ছয় পুরুষ আগের মাকে স্মরণ করা হয়। এবং বিসর্জনের দধিকর্মা মাখা হয়।
মনে অনেক কথা ভিড় করে আসে। কুমুদিনী বসুর শতবর্ষ পরের নারী আমি, খুঁজে বেড়াচ্ছি পরিবারের ইতিহাস, তার রীতিনীতি। আমার নিজের বিবাহ হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের দাসমহাপাত্র ওরফে বক্সি পরিবারে। এবংশের পূর্ব পুরুষ কৃষ্ণনগরের রাজার দেওয়ান বা বক্সি ছিলেন। আমাদের বাড়িতে শ্রী গোপীনাথ জীউ আর রাধারানীর মন্দির আছে। মন্দিরের রান্নাঘরে নিত্য ভোগ বিতরণ আজও হয়। আমি যে ইতিহাস সন্ধান করছি, তা কি নিয়তির পূর্ব নির্ধারিত? জানি না মাতুল বংশের রাধারমণ কার কাছে পূজিত হন। রাধারমণকে হারিয়েছি বলেই কি, গোপীনাথ হয়ে তিনি আমার কাছে ফিরে এলেন? আর পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে, আমি চাকরিটাও এমন কলেজে পেলাম, যেটা আন্দুল রাজবাড়ির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যাক সে কথা – সতীমার ঘটে ফিরে আসি।
প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কলিকাতার ইতিবৃত্ত বইতে পড়লাম, কলকাতার বহু প্রাচীন পরিবারে এখনও সতীর সিঁদুর পুজো করা হয়। তার অর্থ, আমার মামার বাড়ির পরিবার, বইয়ে বর্ণিত তেমনই একটি পরিবার। জেনে-ইস্তক আমার শরীরের শিরা উপশিরা কাঁপছে। চোখে ভাসছে সেই দৃশ্য – বইতে যেমন পড়েছি, সালঙ্কৃতা, মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা, আলুলায়িত কেশ, খালি পা, বধূকে পথ দিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে নাপিতানীরা। সিদ্ধি জাতীয় কিছু খাইয়ে চেতনা কিছুটা বিস্রস্ত করে দেওয়া হয়েছে। পথে মাঝেমাঝেই লোকেরা এসে সতীর সিঁদুর নিয়ে যাচ্ছে। চিতার ওপরে মৃত স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে চিতায় বসেছেন বধূ, ডালপালা দিয়ে ঢাকা দেওয়া হল। অগ্নিসংযোগ করা হল, লোক ভেঙে পড়েছে, চারিদিকে ঢাক-ঢোল বাজছে, জয়ধ্বনি উঠেছে – লেলিহান আগুনের শিখায় জ্বলে যাচ্ছে বাংলার উজ্জ্বল ইতিহাস, চৈতন্যের ভক্তিবাদ, সন্ন্যাসীদের শিবজ্ঞানে জীবসেবা – কান মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। ছি ছি ছি! আর আমি ভাবতে পারছি না। ছয় প্রজন্ম আগে, কে মা তুমি প্রাণ দিয়েছ? তোমার মৃত্যু নয়, জীবন জানতে চাই আমি। তুমি কোন বাড়ির মেয়ে, কি তোমার নাম? কোনো সূত্র তো নেই। শুধু শুনেছি, তোমার পুত্র মহেশচন্দ্র মামার বাড়ির সূত্রে কৃষ্ণনগরের রাজার ভূসম্পত্তি পেয়েছিলেন।
তবে তোমার পরিচয়ের সূত্র কি কৃষ্ণনগরে লুকিয়ে আছে? মামাতো ভাই বেসরকারি চাকুরে। কাজের দিন, ছুটির দিন আলাদা করতে পারে না। দাদুর পরে, মামা আমৃত্যু দোলের দিন দধিকর্মা মাখতেন। কিন্তু মামাতো ভাইয়ের পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছে না, সে বিয়ে-থাও করেনি। আমি ভাইকে বলে দিয়েছি, দধিকর্মা মেখে সতীর পরের চারপ্রজন্ম – মহেশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিকাশচন্দ্র, সুজিৎচন্দ্র যদি প্রায়শ্চিত্ত করে থাকেন, তবে আমরাও করব। তুই তোর বাড়িতে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিস। আমি আমার বাড়িতে দধিকর্মা মাখব। নিয়ম বজায় থাকবে, চিন্তা করিস না। সরু চিঁড়ে, মিষ্টি দই, রাবড়ি, বাতাসা, গুঁজিয়া, পেঁড়া আর আঙুর – যেভাবে মাতুল বংশের রীতি, সেটাই বজায় রাখব আমি, নড়চড় করব না।