৪
সাগরের উথাল পাতাল
বুকেও এই নৌকা চলে।
কত ঝড় বিবাদ সামাল,
দিতে খেলাই কথা বলে।
-আজ রঞ্জার জন্য বিকেলটা দারুণ কাটল কিন্তু জেঠিমা।
-কিন্তু এই দারুণ কাটানোর জন্য দুপুরে রান্নার পিসিরা কেউ বিশ্রাম পায়নি। রাতে সব এক তরকারি ভাত খেতে হবে।
-রাতে রুটি হবে না?
-না। আজ দুপুরে কেউ শুতে পারেনি। তাই রুটির ঝামেলা করতে পারবে না। সবাই একসঙ্গে তো খেতে আসে না। খেপে খেপে আসে। ওদের বসে থাকতে হয়।
-সে ঠিক আছে। অসুবিধে নেই। কিন্তু তরকারিটা কী?
-এ বেলা পনির করতে বলে দিয়েছি।
-শাহী পনির? দারুণ লাগে।
-না রে বাবা। শাহী পনিরের অনেক ঝামেলা। রাতে অত করা যাবে না।
-তাহলে?
-মেথি শাক দিয়ে হবে। রুনাজেঠু আজ টাটকা মেথিশাক তুলেছে।
-অ্যাঁ-অ্যাঁ-না- তিতকুটে।
-তেতো হবে না রে, খেয়ে দেখবি। এটা একটা কাশ্মিরী রান্না – পনির মেথি চমন।
-ও বাবা। সেটা আবার কী করে করে?
-বেশি কিছু নয়। রুনাদা ম্যাজিক মশলা করে রাখে না, তাই দিয়ে হয়ে যাবে। প্রথমে পনিরের টুকরোগুলো বেশ বাদামী করে ভেজে দুধে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
-নতুন রকম, তারপর?
-মেথিশাকটা তেলে হিং ফোড়ন দিয়ে ভাজতে হবে। এবারে নুন হলুদ, গরম মশলা গুঁড়ো, আর ম্যাজিক মশলা দিয়ে কষে নিতে হবে। মেথিশাক নরম হয়ে গেলে পনির দিয়ে নাড়তে হবে। তারপর দুধটা ঢেলে ফোটাতে হবে। ঘন হয়ে এলে নামাতে হবে। এ বাড়িতে তো আমন্ড নেই। নামাবার আগে কিশমিশ ছড়িয়ে দেব।
-শুনে তো ভালই মনে হচ্ছে। খেয়ে দেখব।
-ও মা, একটা তরকারি যখন, একটু রায়তা করবে দই শসা দিয়ে। আর বাটিতে ঘি গলিয়ে রাখবে। প্রথমে ঘি দিয়ে গরম ভাত খাব। শেষে রায়তা। তিনরকম হয়ে যাবে।
-বোনুর জিভের তার দেখেছ, জেঠিমা?
-তুই দেখ। ছোটবেলায় তুই আলুভাতে দিয়ে ভাত খেতিস, আর রঞ্জার মুখে দিলে জিভ বার করে ঠেলত। মুখে নিত না। ওর জন্যে রুনাদা আলুভাজা করে আনলে তবে মুখে নিত।
-বোনুটা খুব খাদ্যরসিক। এবারে গল্পটা আবার শুরু কর জেঠিমা। সেই যে কুমোরটুলি ক্লাব, টাউন ক্লাব আর ন্যাশনাল ক্লাব, জুবিলি ক্লাব – এক এক করে সব হল, তারপর মোহনবাগান কবে হল?
-মোহনবাগান তৈরি হল জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার চার বছর পর – ১৮৮৯ সালে, মানে জুবিলি ক্লাব বা মহমেডান স্পোর্টিং তৈরি হওয়ার দু’বছর পর। ভূপেন বসুর বাড়িতে যখন মোহনবাগানের জন্মমূহূর্তের সভা বসে, ভূপেন্দ্রনাথ তখন তিরিশ বছরের যুবক। বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে দু’বছরের আর স্বামী বিবেকানন্দের থেকে চার বছরের বড়। কলকাতা হাইকোর্টের নথি বলছে, বছরখানেক বিবেকানন্দ মানে নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ভূপেন্দ্রনাথ বসু দু’জনে নিমাইচরণ বসুর এজলাসে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। সময়টা সম্ভবত ১৮৮১। নিমাইচরণ বসু সে যুগের একজন মহানুভব ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশপরিচয় ষষ্ঠ খণ্ডে তাঁর কথা পড়েছি।
-বিবেকানন্দ আইনের কাজ শিখতেন?
-তখন তো বিবেকানন্দ হননি, নরেন দত্ত। না শেখার কী আছে? নরেন্দ্রের বাবা বিশ্বনাথ দত্তও তো নামী অ্যাটর্নি ছিলেন। তবে নরেনের মন তখন অন্যদিকে টানছিল। ১৮৮০-তে নরেন্দ্রনাথ কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন এবং ধর্মালোচনা ও ব্রহ্মসঙ্গীতের সুবাদে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তবে ১৮৮১ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পরে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এজলাসে আইনের কাজ শেখাতেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে লেখাপড়া চলছিল, ১৮৮৪ সালে যে বছর তিনি বিএ পাশ করলেন, ঐ বছরই বাবা বিশ্বনাথ দত্তের তিরোধান হয়। তবে আজন্ম খেলাধূলা-প্রিয় বিবেকানন্দ যে ফুটবল ভোলেননি, তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সাধন জীবনের বিভিন্ন বক্তৃতায়।
-মোহনবাগান তৈরির সময়ে বিবেকানন্দ ছিলেন?
-না। ১৮৮৯-তে যখন মোহনবাগানের জন্ম হয়, বিবেকানন্দ তখন দেশকে চিনতে ভারত পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। তবে একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে, ১৮৯৭-তে কলকাতায় ফেরার পরে নিশ্চয়ই এই দলের কথা তাঁর গোচরে আসে। ১৮৯৩-এ বম্বে থেকেই তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় চলে যান এবং বিশ্বজয় করেন। ১৮৯৮ সালে বিনয়কৃষ্ণ দেবের সভাপতিত্বে শোভাবাজার রাজবাড়িতে তাঁকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেই বক্তৃতাতেও তিনি ফুটবলের উল্লেখ করেছিলেন।
আবার কেশব সেনের সঙ্গে যেমন বিবেকানন্দের যোগ আছে, তেমন তাঁর সঙ্গে মোহনবাগানও অদ্ভুত একটা সূত্রে জুড়ে আছে, পরে যথাসময়ে বলব। ১৮৯৮-এ বিবেকানন্দের সংবর্ধনার পরের বছরে, মানে ১৮৯৯ সালে কলকাতায় ভয়াবহ ভাবে বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে।
সে এক ভয়ানক দিন। কলকাতা কাঁপছে বিউবোনিক প্লেগের আতঙ্কে। দলে দলে মানুষ বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে কলকাতা ছাড়ছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইংরেজ সরকারের ব্যবস্থাপনার প্রতি অসন্তোষ এবং টীকার প্রতি সন্দেহ। প্লেগের টীকা দূরস্থান, বসন্ত রোগের টীকা দেয় এমন সরকারি কর্মচারীদেরও লোকে পথে মারতে তাড়া করছে। বাড়ির মেয়েদের টীকা বা চিকিৎসা করতে গেলে, অন্তঃপুরের আব্রু বা সম্ভ্রম যাবে, এই ভয়ে মানুষ কাঁটা হয়ে আছে। এইসময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা সেই প্লেগের বিরুদ্ধে জীবনপণ করে যুদ্ধে নামেন। আমার পারিবারিক শ্রুতি বলে, রামকৃষ্ণ মিশন ও ভগিনী নিবেদিতার সেই সেবা দলের সদস্য হয়ে প্লেগ নিবারণের মহৎ কার্যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন কুমুদিনী বসু, মায়ের ঠাকুমা। সেই সময়ে আরও একজন মানুষ নিজের আগ্রহে উত্তর কলকাতার প্লেগ আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করছিলেন। তিনি লাবণ্যর মায়ের জ্যাঠামশাই – ড. আর. জি. কর। এরপর স্বাভাবিক ভাবেই রাধাগোবিন্দ ও নিবেদিতা পরস্পরের সহযোগী হয়ে ওঠেন। কুমুদিনীর বয়স তখন আনুমানিক সাতাশ-আঠাশ। তিনি ভগিনী নিবেদিতার সহযোগী হয়ে বস্তিতে বস্তিতে পরিচ্ছন্নতা আর স্বাস্থ্যরক্ষার লড়াই শুরু করেন। আসলে একাজে বেশ কিছু আলোকপ্রাপ্ত মহিলা এগিয়ে এসেছিলেন, কারণ অন্দরমহলে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
-কেন মা?
-আরে সে যুগে অনেকটা পর্দা প্রথার মত ছিল রে। রানী রাসমণি সিরিয়ালে দেখিসনি, রানী চিকের আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
-তা বলে অসুখ হলে ডাক্তার দেখাবে না?
-না, মেয়েরা প্রায়শই বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। লোকেরা মনে করত, অন্দরে ঢুকে কেউ টীকা দিলে, অসুস্থ মেয়েদের চিকিৎসা করলে, পরিবারের আব্রু, সম্মান নষ্ট হবে। বিউবোনিক প্লেগে বগল, কুঁচকি – এইসব ঢাকা জায়গায় গ্ল্যান্ড ফুলে উঠত। তখনকার সমাজে মেয়েরা পোশাক সরিয়ে ডাক্তারকে শরীর পরীক্ষা করতে দেওয়া দূরের কথা, কল্পনাতেও আনতে পারত না। তাই তারা মরে যাবে, তাও স্বাস্থ্যকর্মী বা সমাজকর্মীদের ঢুকতে দেবে না। বস্তিগুলোর অবস্থা দাঁড়িয়েছিল ভয়াবহ। নর্দমাগুলো জঞ্জালে প্রায় বোজা। চারিদিকে নোংরা জল থৈথৈ। অপরিচ্ছন্নতা। তাই রোগও বাড়ছিল হু হু করে। নিবেদিতার নেতৃত্বে শিক্ষিত মেয়েরা প্লেগের লড়াইয়ে না নামলে পরিস্থিতি আরও বহুগুণ খারাপ হতে পারত। কিন্তু যাদের জন্য করা, তারা সহজে মেনে নেয়নি। আমার দাদুভাই গল্প করত, যে রাগের মাথায় লোকে মায়ের আর অন্য মহিলাদের মাথায় গায়ে ময়লা ঢেলে দিয়েছে এমনও হয়েছে।
-ইশশ! কী বেইমানি!
-সেই ময়লাই ঝুড়ি করে তাঁরা মাথায় তুলে নিয়ে, আবার জনসচেতনতার কাজে নেমেছেন। আমার মামাতো দিদি, মানে বাবলিদি বলে – আমার দাদু বিকাশ বোস খুব গর্বের সঙ্গে মায়ের এসব কাহিনী ওদের শোনাতেন। আমি তো দাদুকে দেখিনি। আমার জন্মের আগের বছর তিনি মারা যান। আন্তর্জালে বিবেকানন্দের প্লেগ ম্যানিফেস্টো পড়ে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেছি। এ’কথা এখানে উল্লেখ করলাম, তার কারণ, নিজের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে চোখের সামনে খুলে গেছে কলকাতার বা বাংলার অদেখা অধ্যায়। মহামারী অতীতে বারবার আক্রমণ করেছে, কখনো প্লেগ, তো কখনো ম্যালেরিয়া, কলেরা বা স্প্যানিশ ফ্লু – নানারূপে। কিন্তু জাতির জীবনসংগ্রাম থেমে থাকেনি।
-কলেরার মহামারী? আচ্ছা মা, তুমি যে ছোটবেলায় গল্প বলতে, জামাই এসেছে, শাশুড়ি খেতে দিচ্ছে। জামাই একটু লেবু চেয়েছে বলে শাশুড়ি জানলা দিয়ে লম্বা হাত বাড়িয়ে থালার সামনে বসে গাছে লেবু পাড়ছে। সব কলেরায় ভূত হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ, ঠিক মনে করেছিস। ও গল্পটার নাম গদখালির হাত। কলেরা মহামারীর গল্প।
-ও মা! আর একটা পড়ে শুনিয়েছিলে না, একজন লোক ভাবছে ম্যালেরিয়ার জ্বরে কাবু রামভরসা আসছে পিছন পিছন কম্বল মুড়ি দিয়ে, আসলে ভালুক আসছে শুঁটকি মাছ খেতে খেতে।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, নারায়ণ গাঙ্গুলির লেখা – টেনিদার কুট্টি মামা। ওটা ম্যালেরিয়ার গল্প বলা যেতে পারে।
-খুব বাজে জেঠিমা, তুমি বোনুকে সব বলে দিয়েছ, আমি শুনিনি।
-তাই তো! ভারি অন্যায় হয়ে গেছে আমার। ওটা না পড়লেও তুই তো বঙ্কিমের আনন্দমঠ পড়েছিস। সেখানেও তো মড়ক লাগার কথা আছে। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ততেও আছে। ঐ মড়ক লাগাই তো মহামারী। কিন্তু এগুলো এখন বলতে গেলে মোহনবাগানটা হবে না।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা আগে শেষ কর। জেঠিমা এরপরে যখন মোহনবাগান জিতবে, আমরা সেনবাড়ির মত মাটন রোস্ট খাব, কী বলিস রে বোনু?
-সে সম্ভব হবে না। সেই রোস্ট সেনবাড়ির পুরিয়া ঠাকুর বানাত। তার রেসিপি আমি জানি না।
-ইউটিউব দেখেও হবে না?
-তোরা শিখে করে খাওয়া তাহলেই হবে।
-অ্যাঁ!! আমরা করব? মাটন রোস্ট কেমন খেতে গো জেঠিমা, আমি কখনো খাইনি।
-মাংসটা খুব নরম আর রসালো হয়।
-ও, আমি ভাবছিলাম কাবাবের মত হয়।
-না, কাবাব হয় শুকনো শুকনো। এটা তা নয়। মাটন অল্প জলে আগে সেদ্ধ করে নিতে হয়। তারপর ঘি, কাঁচা লঙ্কা, গোলমরিচ, আদা, রসুন বাটা, মাটন স্টক – সব মিলিয়ে একটা স্বাদের তরঙ্গ তৈরি হয়, যেন সেতারের মীড় বা বীণার ঝঙ্কার।
-উফ-ফ! আমি খাব। কিন্তু রোস্টের সঙ্গে কী খাওয়া হবে? সাদা ভাত?
-দূর পাগল। বিরিয়ানি দিয়ে খেতে পারিস, তবে আমার পছন্দ হাল্কা করে একটু পোলাও।
-খেতেই হবে, এবার বাকিটা বল।
-হুঁ, যা বলছিলাম – আবার সে প্রসঙ্গে ফিরি। কলকাতার এই কুলীন পরিবারগুলির মধ্যে যেহেতু অন্দরে-বাইরে লেখাপড়ার চর্চা ছিল, কোনো না কোনো সদস্যের হাত ধরে ব্রাহ্ম এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কারক ভাবনাগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ভূপেন বসুর পুত্রবধূ, মানে গিরীন্দ্রনাথ বসুর স্ত্রী মলিনা দেবী ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী দ্বারকানাথ মিত্রের মেয়ে। এই দ্বারকানাথ আবার ছিলেন বিদ্যাসাগরের সহযোগী। এই গিরীন্দ্র-মলিনার পুত্র কমল বসু হয়েছিলেন কলকাতার মেয়র।
-আচ্ছা।
-শোভাবাজার রাজবাড়িতে আমার মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনী সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যসভা, সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকতেন। অন্দরমহলে তাঁর জীবন যেটুকু মায়ের কাছে শুনেছি সে সব কথা, শোভাবাজার রাজবাড়ির রক্ষণশীলতার যে সব কাহিনী সমাজে প্রচলিত, তার সঙ্গে ঠিক মেলে না। সমাজ রাধাকান্ত দেবের সতীদাহের পক্ষে আর বিধবাবিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই বেশি করে মনে রেখেছে। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম, স্কুল-কলেজ স্থাপনগুলি ততটা মনে রাখেনি। একথাও মনে রাখেনি, যে রামমোহনের পরিবারেও সতীদাহ হয়েছে, দেব পরিবারে একটিও হয়নি। অবশ্য এতে সমাজকে দোষ দেওয়া যায় না। রেঁনেশার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাধাকান্ত আজও ভিলেন। তবে একথা আমি মন থেকে মানি – ঐ বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল বলেই রামমোহনের আর বিদ্যাসাগরের জয় চিরস্থায়ী। যাকগে, ঐ রাজবাড়ির কথা এখানে উঠছে, কারণ ওখানে শোভাবাজার ফুটবল ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল এবং সাহেবদের বিরুদ্ধে খেলে নামডাকও হয়েছিল।
এবারে কেশব সেনের প্রসঙ্গে আসি। কেশব সেনের কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ দেবের। নৃপেন্দ্র নারায়ণ বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও প্রজাহিতৈষী এবং আধুনিক কোচবিহার শহরের রূপান্তর ও তাঁর হাতে হয়েছে। আবার এই বৃটিশ শিক্ষার হাত ধরেই কোচবিহারে আসে ফুটবল।
-এক মিনিট জেঠিমা। আমার একটা বন্ধু ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছে। তার মা কোচবিহারে বদলি হয়ে গেছে। সে এখন সুনীতি অ্যাকাডেমিতে পড়ে। ফোন করেছিল আমায়।
-আচ্ছা, এটা ঐ রানী সুনীতির নামেই ইস্কুল। রাজা-রানী মিলেই তৈরি করেছিলেন। এই নৃপেন্দ্র নারায়ণের ছেলে রাজা রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ মোহনবাগানের অন্যতম শুভানুধ্যায়ী হয়ে ওঠেন। তার মানে সম্পর্কে কেশব সেন হলেন রাজরাজেন্দ্রের দাদু। এই রাজরাজেন্দ্রের এক ভাইপো মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ফুটবল আর ক্রিকেট দুটো খেলাতেই পারদর্শী ছিলেন। বিংশ শতকের চারের দশকে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি ছিলেন বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক। এই জগদ্দীপেন্দ্রের বোন হলেন জয়পুরের মহারাণী গায়ত্রী দেবী। এসব কারণেই মনে হয় মোহনবাগান নিয়মিত কোচবিহার কাপ খেলতে যেত। যা হোক, সেযুগে এত রাজা রাজড়া, ব্যবসায়ীদের সমাবেশের জন্যই বোধ হয় আন্তর্জালে লেখা আছে, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ব্রিটিশ আমোদের অঙ্গ হিসেবে ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন।
-ও মা, ও মা, আমার একটা বন্ধু জোয়ানা কোচবিহারের কী একটা উৎসবে গিয়েছিল। ওখানে বোরোলি মাছ খেয়েছে। অনেক রকম – বোরোলি ভাজা, কালিয়া, টক এইসব। আবার নাকি শিশিতে পুরে বোরোলির আচার বিক্রি হচ্ছিল।
-তাই নাকি রে, জোয়ানা গিয়েছিল? ওই উৎসবে তো দই বোরোলি, বোরোলি পোস্ত, তেল বোরোলি – মানে বাংলার মাছ দিয়ে যতরকম রেসিপি হয়, সব বোরোলি দিয়ে রান্না করে বিক্রি হয়। ওটা কোচবিহারের বোরোলি উৎসব।
-বোরোলি কেমন খেতে গো জেঠিমা? দেখতে কেমন?
-আমি খেয়েছি। উত্তরবঙ্গে তো প্রায়শই আমাদের সার্ভে করতে যেতে হয়। দারুণ সুস্বাদু। রুপোলি মসৃণ ছোট, সরু, লম্বা। আমি জলদাপাড়ায় বা ঐ সাউথ খয়েরবাড়ি লেপার্ড রেসকিউ সেন্টারে নদীতেও বোরোলির ঝাঁক দেখেছি।
-আমিও তো খাইনি রে দিদি।
-তুই খেয়েছিস একবার, মনে করে দেখ। রাজ্য সরকারি দোকান থেকে প্যাকেটে একবার এনেছিলাম ফ্রোজেন বোরোলি।
-ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তবে টাটকা মাছের স্বাদ তো পাইনি।
- তোরা তবে বোরোলি নিয়ে গবেষণা কর, আমি চললাম, সময় বয়ে যায়। রাতের খাবারের তোড়জোড় আছে।
-না না না না। আড্ডা দিতে গেলে ওর’ম অনেক সাইড টক হয়ে যায়। যেকথা হচ্ছিল, রইস লোকেদের আমোদ-প্রমোদের ফল হিসেবে বঙ্গজীবনে ফুটবল এল।
-একথা অনেকে বলে। কিন্তু মোহনবাগানের জন্মটা আমোদপ্রমোদ থেকে হয়েছে এ কথাটা আমি মানি না।
-কেন?
-মানি না, কারণ ভূপেন বোস ও সেন পরিবারের উপস্থিতি। সেন পরিবার অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক এবং মানবিক। গত দেড়শ’ বছরে, কোনদিনই ঐ পরিবার বিরাট কোনো ব্যয়বাহুল্য করেনি, আবার ভয়ঙ্কর আর্থিক দুর্দশাতেও পড়েনি, যেটা কীর্তি মিত্রের পরিবারে হয়েছে।
-একটু বিশদে বল। ভাল করে বুঝতে হবে।