মেঘের সারি আসছে তেড়ে,
সাগর ডাকে কণ্ঠ ছেড়ে।
জল চলে জোর ঘরটি ঘিরে,
আয় নিয়ে সই ধনে জিরে।
ঝড়ে যাক সব উড়ে পুড়ে,
মাছে মাছ খাই পাতটি জুড়ে।
এক দুর্গাপুজোয় এক ঘটনা ঘটল। বাড়িতে গোপীনাথের মন্দির। দুর্গাপুজোয় নিরামিষ হয়। কিন্তু বিসর্জন হয়ে গেলে তো আর আমিষ খেতে বাধা নেই। দশমীর বিকেলে মেজদি খিড়কি পুকুরে ছিপ ফেলে পুঁটি মাছ, চারা পোনা এসব ধরছিল। তাই দেখে আমার কর্তা উত্তেজিত হয়ে হুইল ছিপ বার করে একটা বড়সড় রুই মাছ ধরে ফেললেন। সেই মাছ সারা পুকুরে ছুটে বেড়াচ্ছিল, আর কায়দা করে ছিপে সুতো ছেড়ে মাছ খেলিয়ে তোলা হচ্ছিল। সবাই ভিড় করে দেখছিল। ভিড়ের মধ্যে আমিও ছিলাম। হৈচৈয়ের মধ্যেও কোথায় যেন একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছিল। যখন সচেতন হয়ে শোনার চেষ্টা করছি, তখন মনে হচ্ছে – না, কিছু তো নেই। কিন্তু আনমনা হলেই আবার। একটা ঝিনঝিনে নাকি গুমগুমে রিদমিক আওয়াজ। কেমন যেন একটাই শব্দ বারবার রিপিট হচ্ছে। শেষকালে বলেই ফেললাম, তোমরা কেউ কিছু শুনতে পাচ্ছ? সবাই পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সমুদ্র ডাকছে। সমুদ্র? এখান থেকে কোদিন তো এভাবে শুনিনি। শোনা তো যায় না। শাশুড়ি মা বললেন, হ্যাঁ দীঘা মোহনা ডাকছে। বড় কিছু ঘটবে। বলেই একটা ছড়া কাটলেন –
দীঘা মোহনা, মন্দারমণি মানে মন্দার খালের মোহনা, সুবর্ণরেখার মোহনা আর রসুলপুরের মোহনা ডাকলে কী কী হয়। অনেকটা খনার বচনের মত, পূর্বাভাস। খুব কষ্ট হচ্ছে, ছড়াটা লিখে রাখিনি। অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি পরে, কিন্তু ওসব পুরোনো ছড়ার কথা কেউ বলতে পারে না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে দাঁড়িয়ে বুঝলে কী করে – কোন মোহনা ডাকছে? উনি বলেছিলেন শব্দের দিক থেকে। শুনশান নিস্তব্ধতায় যারা বাঁচে, তারা অনেক মৃদু শব্দ ভাল করে বুঝতে পারে। আমি শহরের মানুষ। উঁচু তারের শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে, শ্রুতির মিহি তারগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। তার সাড়া পাওয়া যায় না। আমার কর্তাকেও দেখি, কটকটে রোদের মধ্যে হঠাৎ বলে, একটু পরে বৃষ্টি হবে। আমি বলি, ধ্যাৎ। ও বলে, দেখবে তুমি, চ্যালেঞ্জ। আর আমাকে অবাক করে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামে। আমি বলি, বোঝো কী করে? ও বলে, তুমি বুঝবে না। হাওয়ার স্পর্শ বদলে যায়। সেদিন রোদ কিংবা বাতাস, কোথাও কোনো ইঙ্গিত ছিল না প্রলয়ের, শুধু ঐ ঝিনঝিনে শব্দ ছাড়া।
সন্ধেবেলা সে এক কাণ্ড। দেখি, এক একটা দেওয়াল জুড়ে লাল পিঁপড়ের ঢল নেমেছে। একফোঁটা জায়গা খালি থাকছে না। তারপর খাটেও লাল পিঁপড়ে। শেষে এমন অবস্থা – হারিকেন থেকে কেরোসিন ঢেলে খাট, জানলা, টেবিল চেয়ার মুছতে হল। দেওয়াল থেকে খাট টেনে আনতে হল মাঝখানে। সবাই বলল পিঁপড়ে উথলি হয়েছে। বাড়িতে সাজো সাজো রব পড়ল। ধানের গোলা থেকে বেশ কয়েক বস্তা চাল এনে বাড়িতে রাখা হল। বারান্দা ভারি প্লাস্টিক শিট দিয়ে বেঁধে ঢাকা হতে লাগল। শাশুড়ি মা রান্নাঘরে আনাজ, মশলা কতদিন চলতে পারে সেটা হিসেব করতে লাগলেন। লোকজন ডেকে কর্তা আর দেওর গেল পুকুর বাঁচাতে। আমি তো এসব প্রস্তুতি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। কোনো যুদ্ধ হবে মনে হচ্ছে। শ্বশুরমশাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, পুকুর বাঁচানো মানে কী? উনি বুঝিয়ে বলেন, প্রতি পুকুরের একদিকে ঢাল থাকে। বন্যা হলে পুকুরের জল উপচে সেই দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাই সেদিকে বাঁধ দিতে হয়, যাতে মাছ না বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে তো বন্যা হলে। এখনও তো বৃষ্টি নামেনি। খটখটে শুকনো। তারপর রাত তিনটে থেকে শুরু হল প্রলয়। কানে তালা ধরা বৃষ্টির আওয়াজ। হাওয়ার ধাক্কায় বাড়িটা কাঁপছিল। ও বৃষ্টির আওয়াজ যে শোনে, তার মৃত্যুভয় চলে আসে। তারপর দিন সাতেক জলবন্দী জীবন। আসলে আমাদের বাড়িটা তো বালিয়াড়ির ওপরে। আশপাশের বাড়িগুলোও তাই। রাস্তাগুলো আসলে ঐ বালির টিলার মাঝখানের উপত্যকা। ওগুলো দিয়ে বালিয়াড়ির জল যায়। কাজেই, বেলে রাস্তা বছরের আট মাসই ভেজা ভেজা থাকে। ঐ রাস্তাগুলো দিয়ে খরস্রোতে বৃষ্টি আর জোয়ারের জল চলল খলবলিয়ে। চারিদিকে নদী আর মাঝখানে বাড়িগুলো যেন দ্বীপ। এমন জিনিস তো দেখিনি বাপের জন্মে। ল্যান্ডফোন বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। কেবল উপকূলের মানুষের অভিজ্ঞতার জোরে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম সকলে। বৃষ্টি একটু কমতে, রাস্তার ধারে গিয়ে দেখি চুনো মাছের স্রোত চলেছে রাস্তা দিয়ে। সবাই জলের স্রোতে ঝুড়ি আড় করে দাঁড়িয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। কয়েক মিনিট পরে পরে তুলে নিলে আধঝুড়ি করে মাছ উঠছে। আমিও ঝুড়ি পাতলাম। হঠাৎ দেখি সবাই চেঁচিয়ে কী একটা ইশারা করছে আমাকে। তাকিয়ে দেখি আমার খুব কাছে কিছু একটা গোল্লা পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি কি আর জানি ছাই যে ওটা চিংড়ি মাছের ঝাঁক। যাই হোক শেষ মূহূর্তে বুঝে ঝুড়ি দিয়ে গোল্লাটা আটকে দিলাম। আর আমার ঝুড়িতে চিংড়ির ঝাঁক কিলবিল করতে লাগল। বাড়িতে অত লোক, আনাজপাতি যা ছিল, দু’দিনে ফুরিয়ে গেল। তখন খাওয়া বলতে শুধু ভাত আর মাছ। মানে মাছ আর মাছ। পাঁচমিশালি নানা রঙের, নানা স্বাদের বিনা পয়সার মাছ খেয়ে বেঁচে রইলাম সবাই। সবাই মানে, পাড়া-প্রতিবেশী সবারই এক দশা। কয়েকটি বাড়ি অবশ্য চাল বাড়ন্ত বলে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গেল। সেই সময়ে আমাদের পাকশালার হেড ম্যানেজার ছিল জানকী। সবাই ডাকতো জান্-কি। ফর্সা রোগাভোগা মেয়ে একটা। তার সঙ্গে ফুটফুটে একটা বাচ্চা আসত, জানকীর ছেলে। নাম – নাঃ, আসল নামটা থাক। একটা কাছাকাছি নাম দিই বরং। ধরে নিলাম বাচ্চাটার নাম সূরজ সিং। জানকীকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না, কারণ রান্নাঘরে তার একটু হাতটান ছিল। কিন্তু শাশুড়ি মা সব জেনেশুনেও তাকে ভালবাসতেন। জানকীর নামটা বলে দিলাম, কারণ সে যে আর বেঁচে নেই গো। পরে ননদের কাছে শুনেছিলাম ছোট বয়সে মোটা কন্যাপণ দিয়ে ওকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল এক প্রতিবেশী রাজ্যের ছোকরা। দেহাতে সেই শ্বশুরঘরে মহিলা নেই। বরেরা – না, না – বর নয়, স্বামীরা সাত ভাই। জানকী তাকে স্বেচ্ছায় কি বরণ করেছিল নাকি, যে সে ছোকরা বর হবে? স্বামী বা মালিকেরা ছিল সাতভাই। সোজা কথা, জানকীকে তার বাবা মা একরকম বিক্রিই করে দিয়েছিল বলা যায়। যা হোক, সেই শ্বশুর ঘরে, দেওর ভাসুরের পল্টন আর শ্বশুর সবার বৌ হয়ে কাটাতে হত একরত্তি মেয়েটাকে। উপরি পুরষ্কার ছিল অনাহার, স্বল্পাহার আর মার। তারপর একদিন পেটে বাচ্চা নিয়ে জানকী পালাল। কী করে সে যে বাপের ঘরে পৌঁছল, সেটা আমি আর বিশদে জিজ্ঞেস করিনি, প্রবৃত্তি হয়নি। জনক দুহিতা জানকীর অপহরণ, বনবাস, তপোবনে ত্যাগ যাই হয়ে যাক না কেন, তার বাপের ঘর মিথিলা কোনোদিন ফিরে তাকায়নি। তবে এই জানকীর কপালটা খুব চওড়া, তাই বাপের ঘরে আবার জায়গা পেল, ছেলে হল। বাপের বাড়ি অনেক ভাই, কাজকর্ম তেমন করে না। জানকীর বাপ দুর্গাঠাকুরের অস্ত্র বানাত। সে কাজ তো আর সারা বছর থাকে না। যেদিন তার কোনো ভাই এবাড়িতে কাজে লাগত, সেদিন তার পাত পড়ত এখানে। কিন্তু বাকিরা? গরীবের ঘরে সংস্থান থাক আর না থাক, সবাই বিয়েটা আগেভাগে করে নেয়, আর মা ষষ্ঠীও হাত ভরে কেবল আশীর্বাদ দিয়েই যান। জানকী তাই আড়ালে আবডালে রান্নাঘর থেকে কিছুমিছু প্রায়ই নিত। ওর এই গল্প শোনার পর, আমি নিজের চোখের সামনে একটা চিকের পর্দা টেনে নিয়েছিলাম। সব কিছু দেখতে পেতাম না। বেছে বেছে দেখতাম।
সেবার পুজোর আগে ছোট ননদ তার ছেলেদের অনেকগুলো ছোট হয়ে যাওয়া জামা-প্যান্ট দিয়ে গিয়েছিল, প্রায় নতুন নতুন। শাশুড়ি মা, যার বাড়ির ছেলেমেয়েদের ফিট করবে, সব ডেকে ডেকে বিলিয়ে দিলেন। কোন বাড়িতে কোন ছেলেমেয়ে কত বড় হল – সব তাঁর নখদর্পণে থাকত। ওঁর কাছ থেকে ছেলেপুলের বাপ মায়েরা জন্মদিন জেনে যেত। শুধু ছোটরা নয়, আমাদের বয়সী বড়দেরও ঠিকুজি কুষ্ঠি তিনি জানতেন। অথচ কিছু লেখা থাকত না। তিনি ছিলেন এলাকাবাসীর জন্মনথির জীবন্ত ডাইরেক্টরি। সে যা হোক, দু’খানা হাফপ্যান্ট সূরজ সিংয়ের মাপমত বুঝে তিনি ও’দুটো জানকীকে দিলেন। আর আমার বরকে নির্দেশ দিলেন, সূরজকে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দমত দু’টি জামা কিনে দিতে। হুকুম পালন হল। কিছুক্ষণ পরে দূরে রাস্তায় আমার কর্তার অবয়ব দেখা গেল। আর সঙ্গে দেখলাম একটা ছোট মূর্তি লাফাতে লাফাতে আসছে। ঠিক লাফাচ্ছে না, ড্যাডাং ড্যাং ঢাকের তালে লাফালে যেমন হয়, তেমন। ঢাক বাজছে না, যদিও সূরজ সিং ওভাবে নাচতে নাচতে আসছে। একটু আড়াল থেকে ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম। কাছে এলে বুঝলাম, ঢাক ছাড়াও সে পায়ের তালটা বজায় রাখছে কীভাবে। সে আসলে ছন্দোময় কিছু বলতে বলতে আসছে। জানকী তখন পুকুরঘাটে বাসন ধুচ্ছিল। আমি একটু কাছাকাছি গিয়ে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। সূরজ সিং বাড়ির উঠোনে এসেই মায়ের দিকে ঐভাবে নেচে নেচে ছুটল। তার কথাগুলো এবার স্পষ্ট শুনলাম –
- এ জামাটো আমোর পছন্দ হই আলা।
আমো লে-ই চলি আলা।
মাকে জামা দেখানোর পর সে আমার কাছে ছুটে এল, বলল
- বা-পু মামা জামা দ্যালা, পেন দ্যালানি।
দেখো কাণ্ড। পেন যে দুটো তার মায়ের কাছে জমা আছে, এ খবর তার কাছে নেই। তবে নালিশ ঠোকার ভঙ্গি শুনে আশপাশের সকলে হেসে উঠল। পুজোয় এ বাড়িতে যারা ঘরে বা মন্দিরে কাজ করে, অথবা যারা অনেক বছর করেছে, এখন আর পারে না, সকলেই নতুন পোষাক পায়। দায়রা আদালতে সাহস করে এগিয়ে এসে নালিশ ঠোকার জন্য কর্তামশাইয়ের সাজা হল। খর রোদে তিনি আবার সেই বক্সীবাজারে হেঁটে গিয়ে দুটো নতুন ‘পেন’ আনলেন। পরে শুনলাম সে আর্জি নিয়ে দেওরের কাছেও গিয়েছিল। বলেছে – তপু মামা, বাপু মামা তো জামা পেন দ্যালা। তুমো কি দৌউচে? দেওর নাকি বলেছে – তুমোর লোভো কি বাড়ুচি? মুখে বললেও তপু মামা একজোড়া জুতো এনে দিল। জানকী হাসে। বলে, ‘আমোর কোটি স্যায়না ছুয়া। মামা ঘরর নেবে না তো কি?’ এখানে কোটিয়া ছুয়া মানে ছোট ছেলে। আর ‘র’ হল অব্যয়, মানে থেকে। এইভাবে হেসে খেলেই কাটছিল। হঠাৎ এসে গেল বন্যার দিন।
কথা হচ্ছিল, যে আমরা সবাই জলবন্দী ছিলাম আর মাছ, কেবলি মাছ – খাচ্ছিলাম। মাছের পয়সা লাগছিল না। যাদের পুকুর ভেসেছে, তাদের বুকে শেল বিঁধছিল। সে তো আমাদেরও আটখানা পুকুর ভেসেছিল। তখন তো কিছু করারও ছিল না। জানকীর বাবা ঐ দুর্যোগের মধ্যে আমাদের দুপুরে খাওয়ার নেমন্তন্ন করল। কারণ আমরা যেমন রাস্তায় চুনোমাছ ধরেছিলাম, জানকীর ভাইয়েরা মাঠে জাল ফেলে বড় বড় রুই কাতলা ধরেছে। ছাতা মাথায় গেলাম সেই নদীপথ ধরে পা ডুবিয়ে, খালি পায়ে। জানকীদের মাটির ঘর, ঝকঝকে পরিষ্কার। চৌকিটাকে টেবিলের মত করে ওরা আমাদের খেতে দিল যত্ন করে। একটা জিনিস দেখলাম, ওদের বাড়িতে আগে ডাল আর নটে শাক পরিবেশন করল, তারপরে উচ্ছের চচ্চড়ি। এটা কিন্তু আমি এ অঞ্চলের অনেক বাড়িতেই দেখেছি। পাঁচমিশালি চচ্চড়িতে একটা সবজি হিসেবে করলা দিয়েছে। প্রথমে ডাল আর কলমি শাক ভাজা দিয়ে শুরু হল। তারপর তেতো স্বাদের চচ্চড়ি দিচ্ছে। সব পরিবার অবশ্য এমন নয়। এমন হতে পারে – যে কিছু একটা খেলেই হল, তেতো আগে – এমন ব্যাপার নেই। কাতলা মাছ, আলু ছাড়া পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে রান্না করেছিল, তবে ঝোলে নারকেলের দুধ দিয়েছিল। আর খাইয়েছিল পোনা মাছের টক। যা হোক, তখন আমরা বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। জল বের করার জন্য সব রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছিল। যোগাযোগ বলতে শুধু ব্যাটারিতে চলা রেডিও ছিল। তার মধ্যেই একটা নেমন্তন্ন খাওয়া হয়ে গেল।
ঐ বন্যার সময়ে একটা নতুন জিনিস খেলাম। সেটা হচ্ছে কুমড়ো বিচির চাটনি। এসব তো কিছু বাপের বাড়িতে খাইনি। কুমড়ো বিচি জিনিসটা এ অঞ্চলে খুব ব্যবহার হয়। বিচিগুলো বার করে সারা বছর ব্যবহারের জন্য শুকিয়ে রাখা হয়। ঐ শুকনো বিচিগুলোর ওপরের ছালটা ছাড়িয়ে ফেলতে হয়। ভিতরের নরম বীজটা বেটে বাদাম বাটার মত চাটনি হয়। কুমড়ো বিচি ছাড়া চালকুমড়ো বিচি এখানে বড়িতে ব্যবহার হয়। আমাদের আড়বেলের বড়ি থেকে এখানকার বড়ি সম্পূর্ণ আলাদা। অনেক রকম বড়ি দেখলাম, যেগুলো মনে পড়ছে, বলি – বাতাসা বড়ি, গয়না বড়ি, জিলিপি বড়ি আর তরকারি বড়ি। এর মধ্যে গয়না বড়িটা চিনতাম। কলকাতায় মেলায় বিক্রি হয়, বড়ির তলায় পোস্ত ছড়ানো থাকে। গয়নার নকশা বদল করে জিলিপির প্যাঁচ দিলে ওটাই হয়ে যায় জিলিপি বড়ি। এতে চালকুমড়ো কোরা মেশানো হয়, অন্য কিছু না। গয়না বড়ি আর জিলিপি বড়ির নকশাটা খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে করতে হয়। ভাজা খেতে ভাল লাগে। অন্য বড়িগুলোয় লঙ্কাগুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, পাঁচ ফোড়ন গুঁড়ো, আদাবাটা, তেজপাতা গুঁড়ো এইসব মেশানো হয়। এই বড়ি নিয়ে কর্তা আর আমার সঙ্গে প্রেস্টিজ ফাইট শুরু হয়েছিল বিয়ের প্রথম থেকেই। সেই ফাইট এখনও চলছে। কর্তার মনে হত আড়বেলের বড়ি স্বাদহীন ঘাস বড়ি। আমি মেদিনীপুরের ঐ মশলাবড়ি মুখে তুলতে পারতাম না। লঙ্কা গুঁড়ো ঠাসা, কী ঝাল বাপরে বাপ, কোনোটা আবার নিমপাতা দেওয়া কুটকুটে তেতো বড়ি। কর্তার যুক্তি ছিল, তেতো বড়ি সবজির মধ্যে ফেলে দিলেই নাকি শুক্তো হয়ে যায়। আদাবাটা আর লঙ্কা গুঁড়ো ঠাসা বড়ি ফেলে দিলেই নাকি তরকারিতে আর মশলা দেবার দরকার পড়ে না। শেষে দু’জনে ঘাট মেনে সন্ধি করেছি যে, তোমার বড়ি তুমি খাও, আমার বড়ি আমি। জেলার প্রেস্টিজ যেখানে জুড়ে রয়েছে, সেখানে পিছু হটা যাবে না, কভি নেহি। অবশ্য সময় সব যুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে দেয়। কর্তা এখন বড়ি সেদ্ধ, নিরামিষ বড়ির ঝাল সব খেয়ে নেয়, আগের মত অসুবিধে নেই। আমিও তরকারিতে মশলা বড়ি খাই, তবে পুরোপুরি যে অ্যাকসেপ্ট করেছি বা আপন করেছি তা নয় – একথা দু’জনের ক্ষেত্রেই সত্যি। আর একটা খাবার আছে, যেটা কর্তা খুব পছন্দ করেন, অথচ আমার একদম ভাল লাগেনি। সেই খাবারটা হল মুড়ির ছাতু। ঐজন্য কর্তামশাই আমাকে আরও দেখিয়ে দেখিয়ে জামবাটিতে বাড়ির গরুর দুধ নিয়ে, তাতে গুড়, বাতাসা আর মুড়ির ছাতু গুলে খান। তা খাক, যার যা ভাল লাগে, খেলে আপত্তি তো কিছু নেই।
বেলা তুমি ধন্যা
আছে ঘরকন্না।
তার মাঝে রেখে
গেছ একটুকু ফাঁক।
সেথা হতে আসে
কত মেয়েদের ডাক।
শ্বশুরমশাই কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে গেলেন হৃদরোগে। কোনো সুযোগ দিলেন না চিকিৎসার। তার অল্প কিছুদিন পরেই শাশুড়ি মায়েরও স্ট্রোক হল। একসঙ্গে তেষট্টিটা বসন্ত পার করেছিলেন দু’জনে। বিরহ সহ্য হয়নি। শেষ দু’বছর আমার কাছেই শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরে সম্বৎসরের ব্যস্ততা ফুরোল শুধু পুজোর সময়টুকু ছাড়া। তাই জানকীর মত মেয়েদের কাজ ফুরোল আমাদের বাড়িতে। বছর দুই পরে তার খবর নিতে গিয়ে শুনি জানকী মরেছে। কী করে মরল – কারণটা তার বাড়ির লোকও বলতে পারে না। বাপের ঘরে জায়গা তো সে পেয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসার খরচ বুঝি মুখ ফুটে চাইতে পারেনি। তাই কী হয়েছে নির্ণয় হবার আগেই তার আয়ু ফুরোল। ভালই হয়েছে, জানকীর মরাটা শাশুড়ি মাকে দেখে যেতে হয়নি। যতদিন তাঁর জ্ঞান ছিল, তিনি খুঁজে গেছেন এমন কোনো পথ, যেখানে মেয়ের টাকা কেউ কেড়ে নিতে পারে না, এমন কোনো সুযোগ বা পরিষেবা, যেখানে পুরুষের খুঁটো বাঁধা থাকে মেয়েদের হাতে।
শারদার হল শুরু
আর শাশুড়ির হল সারা
দুশ’ বছরের হেঁশেল
আজও বয়ে চলে তার ধারা।
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে একদিন মেনু ঠিক করলাম বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত। কিন্তু রান্না এমন হল, যেন পোস্ত দর্শন করানো আলুচচ্চড়ি। ভাবি বসে, এটা কেন হল? ব্যাপারখানা কী? কর্তা বলেন, গরীব মানুষ যা খায় না, তা রাঁধা শিখবে কী করে? হক কথা। এভাবে তো ভাবিনি আগে। এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল, এক সেমিনারে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রের বক্তৃতার কথা। তিনি বলেছিলেন ঠাকুমার কাছে সবসময়ে ছোটবেলা থেকে ঢাকার পাতক্ষীরের গল্প শুনতেন। যেদিন সত্যি সত্যিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন কাজে, সেদিন ওখানকার এক অধ্যাপককে বললেন, পাতক্ষীর খাওয়াতেই হবে। এদিকে ঐ অধ্যাপক জানেন না, সেটা কী জিনিস। দু’জনেই তাজ্জব। তারপর গৌতম স্যারের ঠাকুমার কথা শুনে, ঐ অধ্যাপক বলেছিলেন, তোমার ঠাকুরদাদা জমিদারের ব্যাটা, পাতক্ষীরে তাঁর পাত পড়ত। আর আমার ঠাকুরদাদা চাষার পোলা। আমি কী করে জানব এসব খাবারের কথা। পরে গোলপার্কের এক মিষ্টির দোকানে দেখেছিলেন পাশে লেখা আছে, এখানে ঢাকার পাতক্ষীর পাওয়া যায়। যা হোক, শ্বশুরবাড়িতে ফিরি। কর্তা বললেন, এই এলাকায় পোস্তর বদলে ভাঙা কাজুবাটা দিয়ে লোকে রান্না করে। কিন্তু ভাঙা কাজু জিনিসটা কী? কর্তা বুঝিয়ে বলেন যে, এই এলাকায় প্রচুর কাজুর কারখানা। সেখানে কাজু প্রসেস করার সময়ে কিছু কাজু ভেঙে যায়, সেগুলো জড়ো করে ভাঙা কাজু প্যাকেট করা হয়। এগুলো বড় টুকরো নয়, একেবারে গুঁড়িয়ে যাওয়ার আগের পর্যায়। সমপরিমাণ পোস্তর প্যাকেটের তুলনায় এর দাম কিছুটা হলেও কম।
একদিন সকালের জলখাবারে ঘুগনি করতে বলেও ঠকে গেলাম। দেখি রুটির সঙ্গে বাটিতে যেটা এসেছে, সেটা দেখে মনে হচ্ছে কাঁচা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে করা আলু মটরের তরকারি। বুঝলাম এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে থেকে রান্না করাতে হবে। চার পুরুষ আগের শারদা, তারপরের প্রজন্মের বৌরা – মোক্ষদা, বেলারানী – সকলেই মেদিনীপুরের মেয়ে। তার মানে গত একশ’ বছরে এই প্রথম আমি হলাম জেলার বাইরের বৌ যে এই রান্নাঘরে ঢুকেছে। তেলে-জলে মিশ খেতে গেলে একটু সমস্যা তো হবেই।
আমার ছোটজায়ের রান্নাঘরে এক সহকারিণী ছিল – বয়সে তরুণী – ধরে নিলাম, তার নাম মায়ারানী। খুব হাসিখুশি, চটপটে, চোখেমুখে কথা। আমরা ওকে ভালবাসতাম। আমার জায়ের মেয়ের কথা ফোটার পর তাকে সে প্রায় একশ’ ছড়া শিখিয়েছিল। গল্প একই প্রায়, শুধু শেষটায় একটু তফাৎ আছে। মায়ারানীর বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য ওকে নাকি মারধোর করত শ্বশুরবাড়ির লোক। বাপের বাড়ি চিরাচরিত মানিয়ে নেবার গান গাইত। একদিন শ্বশুরবাড়ির পাড়ার কোনো ভালমানুষ এলে ছুটতে ছুটতে। খবর পেয়ে বাপ দাদা পাগলের মত ছোটে। গিয়ে দেখে মায়ারানী পড়ে আছে মেঝেয়। আর হাট্টাকাট্টা স্বামীটা দাঁড়িয়ে আছে তার বুকের ওপরে, পাঁজরের খাঁচাটা পিষছে পায়ের তলায় যাতে প্রাণপাখিটা বেরোতে পারে। তারপর আর কী, লাঠিসোঁটা, থানা-পুলিশ, জেল-জরিমানা – অনেক কিছু হল। মায়ারাণীর প্রাণপাখিটা এখনও তার বুকের খাঁচার ভিতর আছে। যখন থানা পুলিশ হল, পেটে বাচ্চা ছিল তার। মায়া এখন তার সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে। বাপের ঘর বা শ্বশুর ঘর কারোর তোয়াক্কা রাখে না। যুঝছে দু’জন জীবন যুদ্ধে। এইসব মেয়েদের ঘামে আর চোখের জলে ভিজে যায় রান্নাঘরের মেঝে, ওদের দীর্ঘশ্বাসে ঝাপসা হয়ে যায় আমার কলমের কালি।
শাশুড়ি যখন শহরে আমাদের বাড়িতে আসতেন, তখন ওঁর সঙ্গে একটা তালিকা থাকত। তাতে লেখা থাকত
রথের ঘরের মেয়ের জামা
পন্ডা বৌয়ের লাল আয়না ...
এমন টুকিটাকি পনেরো-ষোলোজনের জন্য কিছুমিছু জিনিস। ছেলেকে দেখাতেন না। তখন আমাদের মাইনে তো বেশি ছিল না। ঘরভাড়া দিয়ে থাকতে হত। একটু টানাটানি তো ছিলই। ঐ বড় লিস্ট দেখলে ছেলে চেঁচাত,
- মা, তোমার শ্বশুর শেষ জমিদার ছিল, আমি না।
শাশুড়ি করুণ মুখে বোঝানোর চেষ্টা করতেন,
- বাপু শোন, একটা মেয়ে আমার সামনে দিয়ে পড়তে যাচ্ছে, জামা ছেঁড়া। আমি কি চুপ করে থাকব? ছোট ছিল সব, বড় হয়ে যাচ্ছে, চিনতে পারি না। আজকাল ঘরে থাকি। বেশি যাতায়াত করতে পারি না। ডেকে কোন বাড়ির মেয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমি ওকে বলেছি, আমি বাপুর বাড়ি যাব, ওখান থেকে তোমার জামা নিয়ে আসব।
- লাল আয়নাটা কী ব্যাপার?
- মেলা থেকে গতবার বৌরানী আমাকে যে আয়নাটা এনে দিয়েছিল, ওটা তো জানলায় বসিয়ে আমি সিঁদূর পরি। পন্ডা বৌ বলে কিনা, জেঠিমা আমায় আয়নাটা দাও। আমি বললাম ‘না বাবা! এটা আমায় বৌরানী কিনে দিয়েছে, এটা আমি দিতে পারব না। আমি বাপুর বাড়ি যাচ্ছি। ওখান থেকে তোমায় একটা এনে দেব’।
এইরকম ষোলোটা গল্প পরপর শুনতে হত। মায়ের যত বয়স বাড়ছিল, অবিরাম কথা বলাও বাড়ছিল। আমার বড় ননদ বুদ্ধি দিত, ‘শোন, মা যখন বেশি কথা বলে, আমি কায়দা করে ঘুমিয়ে যাই, আর মাঝে মাঝে হুঁ দিয়ে যাই। তুইও হুঁ দিতে দিতে নিজের কাজ সেরে নিবি।’ কিন্তু এই বুদ্ধি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। কারণ মা পড়া ধরা শুরু করল, কী বললাম বল তো। ঐ পদ্ধতিটি ছাড়তে হল। কলেজ থেকে ফিরে, মায়ের তালিকা নিয়ে, মাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতাম। তখন মা টুকিটাকি নিজের জিনিসও কিনে নিত – একটা রুমাল, একটা মিকি মাউস ছাপ দেওয়া প্লাস্টিকের ব্যাগ। চোদ্দ বছর বয়েসে শ্বশুরবাড়ি ঢুকেছে, হেঁশেল ঠেলতে গিয়ে হাজারো নিয়মকানুনের অত্যাচার সয়েছে। কনকনে শীতে বা খর গ্রীষ্মে দিন নেই, রাত নেই, আমিষ, নিরামিষের বিচার, বারবার পুকুরে ডোবা, বাড়িতে অতিথির ঢল, পেটে বাচ্চা নিয়েও কোনো কাজ থেকে ছাড় নেই – মায়ের,এসব গল্প শুনে বুক কেঁপে যেত আমার। শখ আহ্লাদ কিছুই করতে পারেনি জীবনে। আজ যদি এইটুকু শখ তার হয়ে থাকে, তাকে কী ফেরানো যায়? ছেলে সামনে চেঁচালেও পরে জিজ্ঞেস করত, মার লিস্টের সব কেনা হল, নাকি কিছু বাকি আছে?