১০
বিজয়া দশমীর বিকেল হয়ে এল। ঘরের ভেতর এই বন্দী জীবন বুকে যেন পাথর হয়ে বসে থাকে। ঠাকুর বরণের প্রদীপের আগুনটা ধূ ধূ করে বুকের মধ্যে জ্বলে। মেয়েদের যতই বড় বড় বাক্যি দিয়ে বোঝাই, নিজের মন মানেনা। ছোটবেলায় দশমী কাটাতাম আড়বালিয়ায়। তিন শিবের মন্দিরের মাঠে মেলা বসত। চারপাশের সব গ্রামের দুর্গা প্রতিমা মেলায় আসতো বরণের জন্য। তারপরে সংলগ্ন বিশাল পুকুরে নৌকোর জোড় ভেঙে যেত, মা দুর্গা জলে পড়ে যেতেন, দু'চোখ জলে ভরে যেত। বাড়ি ফিরে বেল পাতায় "শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়" লিখে বাড়ি বাড়ি বিজয়া সারা হতো, আর মিষ্টির সঙ্গে ঝুলিতে যে পার্বণী জমা পড়ত তাও কম ছিলনা। এই পর্ব শেষ হলে কলকাতায় ফেরা অ্যানুয়াল পরীক্ষার প্রস্তুতি। তাই মন চাইতনা দশমী আসুক। তখন বিজয়া মানে ছিল জেঠু, জ্যাঠাইমা, আর দাদা দিদিদের সঙ্গে বিচ্ছেদের কষ্ট। তারপর এমন বাড়িতে বিয়ে হল, যে পুজোয় বাপের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি - আড়বালিয়া, কলকাতার ঠাকুর দেখা সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল। প্রথম প্রথম খুবই কষ্টে কাটতো পুজোগুলো। তারপর উপায় নেই - নিজের মত করে মানিয়ে নিলাম। অনেক স্মৃতি ভেসে আসে। বিয়ের পরে নতুন বউ, শ্বশুর বাড়িতে দুর্গাপুজো, শাশুড়ি বরণ শেখাচ্ছেন, সিঁদুর খেলা, বরের ক্যামেরায় সিঁদুর মাখা মুখের ছবি, মত্ত হয়ে ছিলাম। বাড়িসুদ্ধ সবাই মাতোয়ারা। হঠাৎ চোখে পড়লো, সবার প্রিয় বড়দি, আমার বড় ননদ ঘরে মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে। বিধবা বলে এই আনন্দে তার অধিকার নেই, নিজের বাড়িতেও। সেদিন বিজয়ার আর একটা নির্মম মানে বুঝলাম - সধবার স্বীকৃতি আর আনন্দের তলায় বিধবার দুঃখ। সধবার অধিকারের উলটো দিকে রয়েছে বিধবার নিঃসঙ্গতা - একরকম সামাজিক বহিষ্কার। এ চাবুক চোখে দেখা যায়না, তাই আসল চাবুকের চেয়ে অনেক কঠিন আর ধারালো, চামড়া কেটে গভীরে বসে যায়। ঐ দৃশ্য দেখার আগে বিজয়া দশমী যে কিছু মেয়ের জন্য এতটা অপমানের তা বুঝতে পারিনি। এখন দশমীর বরণে পারুল কে ডাকি। অল্প বয়সে পারুলের বর সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডসে মারা যায়। তিনটি শিশু সন্তানসহ একঘরে পারুলকে শাশুড়ি আশ্রয় দেন। পারুল বলে, "হ গো বৌদি, মো কি ঘরো পূজা করিনা? শুধু সিন্দুর দিবানি, প্রদীপ, ধূ্প, মিষ্টি, জড়ো, পানো সবু দিবা"। প্রথাগত শিক্ষার নাগালের বাইরে থাকা আত্মবিশ্বাসী নারীকে বড় ভালো লাগে। আর আছেন সেই ঋজু নবতিপর বৃদ্ধা, অন্নদা দিদি, একা থাকেন, পুজোয় একাই আসেন। অন্নদা দিদিকে ডাকি, "আসুন, বরণ করবেন।" বৃদ্ধার চোখে বিস্ময় আর অবিশ্বাস চিকমিক করে, "মো বরণ করিবি বউমা?" কন্যেদেরও ডাকি - বরণের নিয়ম কানুন, পর পর ধাপগুলি শেখাই। পারুলের আত্মবিশ্বাসে, অন্নদা দিদির আনন্দে, কন্যাদের তেজে আমার বিজয়া সম্পন্ন হয়। এবছর ঘরে বসে দূর থেকে কল্পনা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, কী আর করা যাবে?
শুধু সাত রাজ্যের ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না! বিকেলের জলখাবার, রাতের খাবার - এসবের তোড়জোড় আছে। বাজারের মাছের দোকানি ছেলেটা হঠাৎ দিশি ট্যাংরা আর ভেটকির ফিলে দিয়ে গেল কিছুটা। এনেছিল বিক্রি করার জন্য, কিন্তু লকডাউনে পুরোটা বিক্রি হয়নি। এখন এমন হয়েছে। দোকানিরা অল্প করে জিনিস আনে, পুরোটা বিক্রি না হলে চেনা বাড়িগুলোয় ঘোরে, যদি কেউ কিনে নেয়। পাঁচ-ছদিন বাদে বাদে কাঁকড়াওলাও আসে এভাবে। বিল্ডিঙের পিছনের চাতালে রেখে কেটেকুটে রেডি করে দিয়ে যায়। ভেটকির ফিলেগুলো সাইজে বেশ বড়। ফিশফ্রাই বানাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু উপায় নেই। অনেক উপকরণ লাগবে, যেগুলো এখন বাড়িতে নেই, আর যোগাড় করার উপায়ও নেই। বাজার খোলার সময় সকালে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। এখন সব বন্ধ। তাছাড়া বাড়ি থেকে বেরোনোর অনেক হ্যাঙ্গাম। তিনপরত মাস্ক তো মাস্ট, সঙ্গে হাত আধঘণ্টা অন্তর স্যানিটাইজ কর রে, ফিরে বাজারের ব্যাগ ধোওরে, জামাকাপড় কাচোরে, নিজে চান কররে। সবসময় অত পোষায় না। তার চেয়ে বরং ফিলেটা ছোট টুকরো করে হালকা মশলা দিয়ে পাতুরি বানিয়ে ফেলি। কর্তা বারান্দায় লাউ শাক চাষ করেছেন। ঐ লাউ পাতাতে মুড়ে হয়ে যাবে। আর বিকেলে জলখাবারে মুড়ি মাখা - ব্যাস, ঝামেলা খতম। কর্তা আর মেয়ে দুজনেই দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কেবল ঘুরে ঘুরে খুটুর খাটুর করে মরি। গৃহিণীদের এই এক সমস্যা। একটা কাজ শেষ হয় তো পাঁচটা না হওয়া কাজ চোখের সামনে নাচে। সেগুলো শেষ হল বা তাড়িয়ে দিলাম, তো আবার দুটো শখ মাথায় চাগিয়ে ওঠে। জোর করে বালিশে যদি একবার মাথা দিয়েছি, তো তখনই ঝনঝন করে ফোন বেজে ওঠে। কর্তা শুয়ে শুয়ে মশকরা করেন, বিশ্রাম আমার কপালে বিধাতা লিখতে ভুলে গেছেন, তাই আমার নাকি বিধির বিধান অনুযায়ী চলা উচিত। বিকেলে মুড়ি মাখতে গেলে ফ্রিজ থেকে শসা, টমেটো এখনই বার করে রাখি, যাতে মাখার সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে আসে। মুড়িটা মাইক্রোওয়েভে মিনিট খানেক রেখে মচমচে করব। নুন, সর্ষের তেলের সঙ্গে পাতিলেবুর রস মেশাব। শেষে সেরামিকের গ্লাসের ভেতর দুটো করে পাঁপড় রেখে এক মিনিটে মাইক্রোওয়েভে সেঁকে নেব। তারপর ভেঙে মুড়িতে মিশিয়ে দেব। সব হাতের কাছে গুছিয়ে নিলাম। এবারে লাউপাতা কাটব। সেই ছোটবেলায় বাবা শিখিয়ে দিয়েছে সূর্য ডুবে গেলে গাছ ঘুমিয়ে পড়ে, তখন নাড়াচাড়া দিতে নেই, পাতা ছিঁড়তে নেই। তাই আলো থাকতে থাকতেই করব। কাটার পর নুন মাখিয়ে পাতাটা মজিয়ে নিতে হবে, তবেই পাতুরির সময় মোড়া যাবে, ছিঁড়বেনা, ভাঙবেনা। বারান্দায় পাতা কাটছি, হঠাৎ মেয়ে এসে পিছন থেকে চোখ টিপে ধরে।
— আরে ছাড় ছাড়।
— ও মা, দুটো প্রশ্ন। বলাই বাবুর কী হল? আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে পুলিশ তো বলাইবাবুকে পেলনা। উনি গেলেন কোথায়? আর দ্বিতীয় হচ্ছে ঐ ইস্কুল আর হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারটা কী?
— আমাদের বাড়ি পোড়ানোর সময়ে বলাইবাবু আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিতাংশু শেখর নন্দের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন।
— তিনি আবার কে?
— কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর ভাইপো হলেন অধ্যাপক নরেশ নন্দ।
— কোথাকার অধ্যাপক?
— কলকাতার কলেজে পড়াতেন। পরে বেহালা ঠাকুরপুকুর কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। এঁর বাড়িও তোদের গ্রামে, সিতাংশু বাবুর পাশেই। পরে ইনি এইসব ঘটনা নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন - "জ্বেলে দিই জ্ঞানের আলো।" পুলিশের কাছেও তো খবর থাকে, তোদের বাড়ির পরে পুলিশ সিতাংশু নন্দের বাড়িও আক্রমণ করল।
— সে কী? তারপর?
— শুনেছি বলাইবাবু মহিলার পোষাকে পুলিশের সামনে দিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
— তাই নাকি?
— হ্যাঁ, ইংরেজ বলাইবাবুকে অগাস্ট আন্দোলনের সময়ে ধরতে পারেনি। আত্মীয় প্রতিবেশীরা আগলেছেন। ইংরেজকে খবর দেওয়া বিশ্বাসঘাতকেরা সুবিধে করতে পারেনি। ধরা পড়লেন ১৯৪৫শে। জেল হল। পরে স্বাধীন ভারতে তিনি বিধায়ক হয়েছিলেন।
— কংগ্রেসের?
— না, উনি সুভাষপন্থী হয়েছিলেন তো, সুভাষের অন্তর্ধানের পরে স্বাধীন ভারতে জয়প্রকাশ নারায়ণের অনুগামী হন। প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে দু'বার, আর জনতা পার্টি থেকে দু'বার, মোট চারবার বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি।
— আমি শুয়ে শুয়ে আর একটা কথা ভাবছিলাম জানো মা!
— কী কথা?
— এই যে তারিণীপ্রসাদের কত ভাগ্য, গান্ধিজীকে সামনে থেকে দেখতে পেলেন। জাতির জনক বলে কথা।
— শুধু তারিণীপ্রসাদ কেন? তোর ঠাকুরদা অমরেন্দ্রনাথও গান্ধিজীকে দেখেছেন।
— তাই নাকি! কবে, কোথায়?
— ১৯৪৬ সালের পয়লা জানুয়ারি, অমরেন্দ্রনাথ গান্ধিজীর পদযাত্রায় পা মিলিয়েছিলেন। গান্ধী সেসময়ে দিন তিনেক কাঁথিতে ছিলেন।
— আমার নিজের ঠাকুরদা গান্ধিজীর সঙ্গে এক পদযাত্রায় হেঁটেছেন! ভেবেই আমার গা শিরশির করছে মা।
— হুম, বাবা তারিণী হেঁটেছেন ১৯২৫ সালে, আর ছেলে অমর হেঁটেছেন কুড়ি বছর পরে ১৯৪৫ এ।
— অদ্ভুত না মা! একজন মানুষ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে হেঁটে চলেছেন সারা জীবন ধরে। তাঁর ডাকে পিছনে চলেছে অগণিত মানুষ, যে যতটুকু পারে।
— হুঁ, অদ্ভুত তো বটেই। যেন একটা ম্যাজিক। তুই কি জানিস যে তোর বুড়ো ঠাকুরদাও সারা দেশ ঘুরেছেন।
— তাই নাকি?
— তোর বাবা, কাকা, পিসিরাই বলে, তাই শুনেছি।
— কী শুনেছ?
— তারিণী তাঁর ১০৩ বছরের জীবদ্দশায় নাকি পঁচিশ বার দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থান, পঁচিশ বার উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান, একবার কাশ্মীর, একবার দার্জিলিং আর উঠতে বসতে অগুন্তিবার পুরীতে গিয়েছিলেন। তুলনায় তোর ঠাকুরদা অমর অনেক সাদাসিধে জীবন যাপন করেন।
— বাপরে!
— আসলে কী জানিস, আমার মামার বাড়িতে যেমন কুমুদিনীর দেশ সেবা আর সম্পত্তি ত্যাগের ফলে পরের প্রজন্ম দরিদ্র হয়ে গিয়েছিল, তারিণীও তাই। বাবার সম্পত্তি অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার দু'দশক পরে তোর বাবা আর কাকামণি যখন জন্মালো, তখন নাকি বুড়ো কর্তা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, নাতিদের জন্য কী রইল।
— হা হা হা। বাবা কী একটা সেবার বলছিলনা মা, এইরকম বেলি থালায় ঠাকুরদাকে খেতে দিতে হত।
— ওরে বাবা! শুনেছি সেসব। বুড়ো কর্তার খাওয়ার কঠিন নিয়ম ছিল, সময়ের নড়চড় হবে না। এমনি এমনি কী আর একশো তিন বছর বেঁচেছিলেন! অবশ্য তোর ঠাকুরদারও তাই। দেখেছি তো, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ভোর চারটেয় উঠে কাঠপুল বাজার অবধি হন্টন।
— কাঠপুল বাজার অবধি হেঁটে? আমরা তো গাড়ি করে যাই।
— ওঁরা পারতেন হাঁটতে। তোর ঠাকুমাও হামেশা কাঠপুল বাজার থেকে টুকিটাকি জিনিস কিনে আনতেন।
— বাপরে! মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে - তারপর বল।
— ফিরে এসে চা, মুড়ি। ঠিক সাড়ে এগারোটায় ভাত। তারপর ঘুমিয়ে উঠে বিকেল চারটেয় চা। তোর ঠাকুরদার ব্রিটিশ সময়ের সঙ্গে সকলের সময়ের ঘড়ি তো আর তাল মিলিয়ে চলছেনা। এই পুজোর সময়ে বাড়ির সবার খেয়ে উঠতে চারটে বাজত। যেই তারা হাত পা ছড়িয়েছে, অমনি "চা কই?" হাঁক শোনা যেত।
— আর রাত্তিরে?
— সন্ধে সাড়ে সাতটায় দুটো রুটি আর সব্জি। রাতের খাওয়া শেষ। ওষুধ খেয়ে ঘুম।
— আর তারিণীপ্রসাদ?
— ওঁকে চোখে তো দেখিনি, ১৯৭৮ এ তারিণী যখন মারা যান, আমি সবে ক্লাস টু। সেবছর ভয়ানক বন্যা হয়েছিল। পাতিপুকুরে আমরা জলবন্দী ছিলাম অনেকদিন। বিয়ের পরে সব শুনেছি।
— কী কী শুনেছ?
— তারিণী তাঁর বৌমার হাতের রান্না ছাড়া বাড়িতে অন্যের রান্না মুখে তুলতেন না।
— বৌমা মানে ঠাকুমা?
— হ্যাঁ।
— ঠাকুমা খুব ভালো রাঁধতে পারত।
— হ্যাঁ তা পারতেন। বাড়িতে আটখানা পুকুর, সামনে সমুদ্র, ভাব একবার - সারাবছর মৎস্য উৎসব চলছে। আমিষ, নিরামিষ আলাদা উনুন। ছোঁয়াছুঁয়ি চলবেনা। দুটো উনুনে একসঙ্গে রান্না চলবেনা। এক উনুন থেকে আর এক উনুনে রাঁধতে বসা মানেই মাঝখানে চান করতে হবে। বৌমাও তো কচি মেয়ে। সব সামলাতে সামলাতে তার অবস্থাটা বুঝতে পারছিস? আসলে দেশসেবা হোক বা সমাজসেবা - পুরুষ মানুষ যাই করে থাক, হেঁসেলে মেয়েদের অবস্থাটা প্রায়শ একরকমই থাকে। পুরুষ মানুষের মেন্টাল ম্যাপে এগুলো চট করে ধরা পড়েনা।
— হুম, ঠিকই। তারপর বল।
— বড় কাঁসার কানা উঁচু বগি থালায় তিনি খেতে বসতেন। এখানে ওরকম থালাকে বলে বেলি থালা।
— নাম আলাদা।
— হ্যাঁ, যেমন তরকারি রাখার পাত্র বা কাঁসিকে তোদের বাড়িতে বলে ব্যালা। যাই হোক, খেতে বসে ভাত তরকারি মেখে তিনি থালায় আলাদা আলাদা ভাগ সরিয়ে রাখতেন। এক ভাগ পুকুরের মাছের, এক ভাগ পোষা কুকুরের, এক ভাগ বিড়ালদের। পাখিদের আলাদা ব্যবস্থা ছিল।
— আরিব্বাস! আমাদের বাড়িতে পশুপাখির যত্ন আগে।
— পশুপাখিরাও তার মূল্য দেয়। মনে নেই সেবার রাত্তির বেলা কাকামণি ঘরের দাওয়ায় উঠছে, লালু কুকুরটা ঝাঁপিয়ে গরগর করে রাস্তা আটকে দিল।
— হুম, মনে নেই আবার! বড় একটা গোখরো ছিল। লালুর জন্যে কাকামণি বেঁচে গেল। মা, ঠাকুমার কথা বললে, আমার ঠাকুমার হাতের ট্যাংরা মাছের তেল ঝালের কথা মনে পড়ে গেল। তুমি ওরকম করতে পারোনা?
— হুম, পারি তো, শিখে নিয়েছি।
— কীভাবে হয় গো?
— পেঁয়াজ বাটা, আদা রসুন বাটা, কাঁচা লঙ্কা বাটা, টমেটো বাটা, আর ধনেপাতা বাটা - একটা কষা হলে আর একটা - পর পর কড়ায় এইভাবে নাড়তে হয়। সঙ্গে হলুদ, নুন, মিষ্টি, জল দিয়ে ফুটিয়ে সেই ঝোলে ভাজা ট্যাংরা মাছ ফোটাতে হবে। জলটা পরিমাণ মত বুঝে দিতে হবে। কারণ ট্যাংরা মাছ অন্য মাছের তুলনায় বেশি জাল খায়। ফুটতে ফুটতে জল মরবে। অল্প ঝোল রেখে নামাতে হয়। এটা একটু মশলাদার রান্না।
— এখন কোভিডের সময়ে হালকা খেতে হবে, তাই না মা? ট্যাংরা মাছের হালকা কিছু হয়না?
— কেন হবেনা? একদম প্লেন মাছের ঝাল হয়। তেলে পাঁচফোড়ন আর কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে একটু টমেটো কুচি আর হলুদ দিয়ে নেড়ে জল দিয়ে ফোটাতে হবে। শুধু নুন দেওয়া হবে। মিষ্টি পড়বে না। ঐ ঝোলে ভাজা মাছ দিয়ে ফোটানো হবে। কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামাতে হবে। ইচ্ছে হলে নামানোর আগে ধনেপাতা কুচি দেওয়া যায়। তবে আজ একটা অন্য রান্না করব।
— কী?
— আমার মা যেমন করত - মেটে আলু আর ছোট বেগুন দিয়ে ট্যাংরা মাছের রসা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা কিচ্ছু লাগে না। বেগুন গুলো লম্বা করে চিরে নিতে হয়। তেলে পাঁচফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, মেটে আলু আর বেগুন প্রথমে নেড়ে নিতে হয়। তারপর টমেটোকুচি, হলুদ আর জিরে - গোলমরিচ বাটা দিয়ে মা সব্জি অল্প কষত। বেশি কষার দরকার নেই। মেটে আলু খুব নরম, আর একটু লালা থাকে। তারপর জল দিয়ে নুন দিয়ে ফোটাতে হবে। ঝোলে ভাজা মাছ দিয়ে বেশি করে ফোটাতে হবে। গোটা ধনে শুকনো কড়ায় নেড়ে গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিলে ভালো লাগে।
— আচ্ছা।
— জিরে মরিচের ঝোল বেলে মাছেও ভালো হয়। এবারে দেখ, রান্না হল পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপার। জিরে মরিচ বাটা খেতে না চাইলে অল্প রাই সর্ষে বাটা ধোয়া জলও দিতে পারো। আবার এসব কিছু না দিয়ে ফোড়ন দেওয়ার সময়ে কসৌরি মেথি দিলেও বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল ভালো লাগে।
— ঠিক আছে, আজ রাতে দিদার মত জিরে মরিচের ঝোলই হোক। এবার তারিণীপ্রসাদের ইস্কুল, আর হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারটা বল।
— বলব, যদি আমার হাতে হাতে সাহায্য করিস।
— কী করতে হবে বল।
— পিলার দিচ্ছি, এই শসাগুলোর খোসা ছাড়া দেখি কেমন পারিস।
— আচ্ছা, দেখি চেষ্টা করে পারি কিনা।
"মধুর চেয়ে আছে মধুর
সে এই আমার দেশের মাটি
আমার দেশের পথের ধূলা
খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।
চন্দনেরি গন্ধভরা,
শীতল করা, ক্লান্তি—হরা
যেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটিতেই শীতল পাটি।"