সালটা ১৯৯৬। অফিসের কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে দুর্গাপুজো এসে গেল। ষষ্ঠীর দিন অফিস হয়ে ছুটি পড়বে। আমরা ঠিক করলাম, বসকে বলে হাফ-ডে করে দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়ব। তারপর বাইরে খেয়ে, যে যার রাস্তা ধরব। পার্ক সার্কাসের কাছে একটা রেস্তোরাঁ সদ্য নতুন খুলেছে, ওখানে যাওয়াই স্থির হল। চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন চাঁপ খেয়ে বিকেল চারটে নাগাদ যখন বেরোচ্ছি, ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,
- এখন কি সোজা বাড়ি যাবি?
- না, কুমোরটুলি, বাগবাজার সর্বজনীন দেখে যাব।
- ওখানে কেন?
- ছোটবেলার অভ্যেস। বাবা মায়ের সঙ্গে যেতাম। ওখানে না গেলে আমার চলবে না।
- আমার আবার উত্তর কলকাতাটা একেবারেই চেনা হয়নি, যাওয়া হয় না তো। চল, তাহলে তোর সঙ্গে আমিও যাই।
সেই পুরোনো পথ, কুমোরটুলির গলিতে ঢোকার মুখে ছোট্ট পেতলের দুর্গা, তারপর ঠাকুর, গোকুল মিত্রের বাড়ি, মদনমোহন, চিলড্রেন্স পার্ক, গিরিশ ঘোষের বাড়ি, তারপর বাগবাজার সর্বজনীন। মেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে, দু’জনে ফুটপাতের স্টলে বেঞ্চিতে বসে কচুরি তরকারি খেলাম। ছেলেটি আগামীকাল “ভোর” চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে। ওর বাড়িতে নাকি ‘দুর্গো’ পুজো হয়। শুনেছিলাম দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দুর্গা। তবে এমন সরাসরি দুর্গোপুজো করতে কাউকে দেখিনি। ওর কথাবার্তায় বাংলাটা অন্যরকম। ও ভোরে বেরোয় না, ভোর ভোর বেরোয় না, ‘ভোর’ বেরোয়। কচুরির দোকান থেকে খায় না। কচুরি দোকান, মিষ্টি দোকান, পান দোকান, মুদি দোকান থেকে জিনিস কেনে, ষষ্ঠী বিভক্তির অস্তিত্ব ওর বাংলায় নেই। ল্যাবে আড়ালে সবাই মজা করে। সে অবশ্য, জগাদার কথাও এরকম। ‘চলে গেলাম’ – বোঝাতে বলে, ‘পালিয়ে গেলাম’। চলে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া আমাদের কাছে আলাদা, ওদের কাছে এক। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে দু’জনের দু’টি পথ আলাদা হল। আমি চললাম পাতিপুকুরের সরকারি আবাসনে’ আর অন্যজন চলল বেহালা রবীন্দ্রনগরের ভাড়াবাড়িতে।
দুর্গাপুজো চলল পুজোর মত। এখন তো আর ইস্কুল কলেজের মত ভাইফোঁটা পর্যন্ত লম্বা ছুটির ব্যাপার নেই। একাদশীর পরে খুলে গেল অফিস। আমরা আবার কাজে মন দিলাম। লক্ষ্মীপুজোর পরে ছেলেটি এসে হঠাৎ আমার হাতে একটা কাচের শিশি ধরিয়ে দিল।
- এটা কী?
- আমার মা পাঠিয়েছে, তেল-আমের আচার।
- তাই! বাকিদের বল।
- কেন? এটা তোর জন্য।
- আমার এ-কা-র?
- হ্যাঁ
- কেন?
- আমি মাকে বলে দিয়েছি।
- কী?
- ঐ, মাকে বলে দিলাম, আমি তোকেই বিয়ে করব। মা তোর নাম জিজ্ঞেস করল। কালো না ফর্সা জিজ্ঞেস করল। ফেরার সময়ে এই আচারটা দিয়ে বলল, শারদাকে দিস। সামনের রবিবার দুপুরে তুই আমার বেহালার বাড়িতে যাবি, ওখানেই খাবি। আমার বাবা-মা আসছে, ডাক্তার দেখাতে। সোমবার উডল্যান্ডসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। অফিসে আসব না। রবিবার আমার বাবা-মা তোকে দেখবে।
আমি তো ওর কথা শুনে তাজ্জব। কী সাহস রে বাবা! কিছু তেড়েমেড়ে বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনের ভেতরে দেখলাম, প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে না। আচারটা অ্যাকসেপ্ট করে নিলাম। এরকম বাবা-মা, ডাক্তার-বদ্যি-হাসপাতাল সব টেনে, আচার দিয়ে কেউ প্রোপোজ করে? কস্মিনকালেও কেউ শুনেছে? ধ্যাৎ।
রবিবার চললাম বেহালা। বাড়িতে বললাম, বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন। অফিসে আমার ল্যাবের সহকর্মীদের বাড়িতে সকলেই চিনত। আর আমি সব কথা খুলে বলে দিয়েছিলাম। কারণ জীবনে আমি কিছু নীতি নিয়ে চলি। আমি যা করি, সেটা ঠিক বলে মনে করি বলেই করি। আমার চোখে কোনো কাজ যদি ঠিকই হয়, তবে তা গোপন করার কিছু নেই। আর যেখানে সিদ্ধান্ত আমার, সেখানে দায়িত্বও আমার। রবিবার প্রথমে বেলগাছিয়া থেকে মেট্রো ধরে হাজরা। ওখান থেকে অটোরিকশো করে বেহালা। তারপর সাইকেলরিকশো ধরে বাড়ি। হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হল। তাঁরা আমাকে হাসিমুখেই অভ্যর্থনা করলেন। তারপর এটা-ওটা গল্প চলতে লাগল।
খেতে বসার সময় কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। করলা মোটা মোটা করে কেটে নরম ভাজা হয়েছে। আমাদের যেমন তেতো কমানোর জন্য পাতলা স্লাইস কেটে মড়মড়ে করে ভাজা হয়, তেমন নয়। থালার পাশে একটা বাটিতে অনেক কাঁচালঙ্কা রাখা আছে। আমি বাদে বাকি সবাই ভাত খেতে খেতে কুটকুট করে লঙ্কা খাচ্ছে। আর পোনা মাছের টক বানানো হয়েছে। আমাকে আগে অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মাছের টক খাই কিনা। আমি বলেছি, না। কারণ আমি কখনও টক খাইনি। তাই আমার জন্যে ডিমের কারি বানানো হয়েছে আলু ছাড়া। ডিমটা খুব ভালো করে ভাজা। আর তরকারিটা মশলাদার, কিন্তু মিষ্টি দেওয়া নেই। ডাল জিরে-ফোড়ন দিয়ে করা, কিন্তু ওটাতেও মিষ্টি দেওয়া নেই। বাঁধাকপিটাও ঝাল-ঝাল, কিন্তু পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে করা। আমাদের বাড়িতে জিরে, শুকনো লঙ্কা, গরম-মশলা ফোড়ন দিয়ে বাঁধাকপি রান্না হত। তাই এরকম কখনোই খাইনি। আমার মনে হল, এই পরিবার তেতো, ঝাল, টক সবগুলো স্বাদই উগ্র পছন্দ করে। আর রান্নার ব্যাকরণটা আমার এতদিনের জানা ব্যাকরণ থেকে একেবারেই আলাদা। এতদিন জানতাম, রান্নার ব্যাকরণ ঘটি আর বাঙাল বাড়িতে আলাদা হয়। এখানে দেখছি ঘটি হলেও আলাদা হচ্ছে। কারণটা মনে হয় ভৌগোলিক। আমরা কলকাতা এবং উত্তর চব্বিশ পরগণায় ম্যাচিওরড ডেল্টা, মানে পরিণত ব-দ্বীপে থাকি। আমরা পলিমাটির ওপরে থাকা মানুষ। এরা উপকূলের মানুষ। কিন্তু ব-দ্বীপীয় উপকূল নয়, গঙ্গার ও’পাশের, দীঘা উপকূলের মানুষ। মৈতনা গ্রামটা শুনেছি বালিয়াড়ির ওপরে। এরা বালি আর নোনা হাওয়ার দেশের মানুষ। তাই মুখের স্বাদ আলাদা। অবশ্য ঘটি-বাঙালের যে পার্থক্য, তার শিকড়েও তো ভৌগোলিক কারণই লুকিয়ে আছে। বাড়ি ফেরার সময় হবু শাশুড়ি একটা রূপোর চেন পরিয়ে দিলেন গলায়। তারপর একদিন দুই বাড়ি শলা করে আমাদের চার হাত এক করে দিল। ততদিনে আমরা দু’জনেই চাকরি বদলেছি। তবে ষষ্ঠীর দিন, মদনমোহন আর বাগবাজার সর্বজনীনের মা দুর্গা, জীবনের বড় একটা ধাপের সাক্ষী রইলেন।