৫
- মা, আমাদের ক্লাসে জোয়ানা বলছিল ফ্রেঞ্চ শেখার ক্লাসে ভর্তি হবে অনলাইনে।
- ভালো তো।
- তুমি কখনও বিদেশী ভাষা শিখেছ?
- সুযোগ হয়নি। তবে ইচ্ছে ছিল খুব। তখন যদি অনলাইন ক্লাস থাকত!
- কোন ভাষা শিখবে ভেবেছিলে?
- রাশিয়ান।
- তাই নাকি? হঠাৎ ওটা কেন?
- বই পড়ে পড়ে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। বাড়িতে সোভিয়েত নারী পত্রিকা আসত, মোম মোম পাতা, পাতায় পাতায় উজ্জ্বল রঙিন ছবি। সেখানে এক ধারাবাহিক পড়তে পড়তে মাকে বলে দিলাম, ‘মা! আজ থেকে তুমি ইভদোকিয়া আর আমি নাতালিয়া।’ মা মেনে নিল। তারপর একদিন ইস্কুলের লাইব্রেরিতে পেলাম ম্যাক্সিম গোর্কির "মা", সহজ বাংলা অনুবাদ। তারপরই নতুন ঘোষণা করে দিলাম,
- ‘মা! এবার থেকে মা নয়, তোমাকে নেনকো বলে ডাকব।
- আবার বই পড়ে ডাক বদলাচ্ছিস?
- ডা, মানে হ্যাঁ।’
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে?
- বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল -
- ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’
- মানে! লাবণ্য ইংরেজি শিখতে চেয়েছিল?
- হ্যাঁ।
- একটু খোলসা করে বল দেখি!
- প্রথম যেদিন কথাটা জানলাম, এই একই প্রশ্ন আমি আমার মাকেও করেছিলাম। কিন্তু মা তার ছোটবেলার কথা খুব বিশদে বলতে চাইতনা, ছলছুতোয় এড়িয়ে যেত। আমিও নাছোড়বান্দা, কোন কিছু পুরোটা না জানলে পোষায় না।
- আচ্ছা, এরকম কেন? শেষ পর্যন্ত জানতে পেরেছিলে?
- হ্যাঁ।
- তাহলে বল।
মেয়েকে বলতে গিয়ে সেদিনের কথা চোখে ভাসে। দিনগুলো বড্ড জলজ্যান্ত হয়ে মনের ভেতরে বসে আছে।
“- এই হল রে! আমার এখন অনেক খাতা দেখা বাকি পড়ে রয়েছে।
- না মা, এরকম আধখানা কথা বললে হয়না। সবসময় পরে পরে করলে, আমার তো জানা হচ্ছেনা। বলো শিগগির। প্রথমে বলো, দিদা কেন ইংরেজি শিখতে চাইতো। কারণটা কি?
- তুই কেন রাশিয়ান শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস?
- সিম্পল। কিছু শিখলে ভালো লাগে।
- আমার মায়ের ও তাই। সবসময়ে প্রয়োজন থাকবে সেটা কেন?
- আচ্ছা, মানলাম। বাকিটা বলো।
- ছোটবেলায় বড়দা, ছোড়দা ইস্কুলে যেত। আমাকে কেউ ভর্তি করতনা। একদিন সেন বাড়িতে খেলছিলাম। দাঁতিদার বৌ ফুল বৌদি বললেন, সবসময় খেলা! বাবাকে বলে দেব, এবারে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই ধমক খেয়ে বাবা আমায় নিবেদিতা ইস্কুলে ভর্তি করে দিল। কিন্তু ছোট ছিলাম, কেউ কিছু বলতোও না। বছরের শেষে অঙ্ক পরীক্ষায় দেখলাম, প্রশ্নে কত কিছু লেখা। কে করে ওসব! যা খুশি অঙ্ক বসিয়ে দিলাম। যোগ বিয়োগ কিছুই করলাম না। ব্যাস ক্লাস ওয়ানে ফ-এ ফেল। বাবা গেল বলতে, যাতে ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ইন্দিরাদি খাতা দেখিয়ে বললেন, দেখুন লিখতে দিয়েছি ডুমুর, লিখেছে গুমুর। একটাও অঙ্ক করেনি। বড় গীতাদি মানে তোদের ত্যাগপ্রাণাজী বললেন, থাক একবছর। ওর ভালোই হবে। তখন উনি ব্রহ্মচারিণী ছিলেন, সন্ন্যাসিনী হননি।
আমি হা হা করে হাসি।
- মা, তোমার এত প্রাইজ। ক্লাস ওয়ানে ফেল? ওটা ফেল করার মতো কোন ক্লাস হল?
- তার পর সংসারে কাজের ফাঁকে ফাঁকে, মা আমার পড়া দেখাশোনা করা শুরু করল। আমিও টকটক করে ক্লাসে উঠতে লাগলাম। কিন্তু যখনই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত, দেখতাম, ছোটো একটা আলো জ্বালিয়ে মা আমার ইস্কুলের ইংরেজি বই পড়ছে আর ট্রান্সলেশন করছে। যখন আটকে যেত, তখন খুকু খুকু করে ডেকে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত। কোনো শব্দের মানে জিজ্ঞেস করতো।
- তুমি কি করতে?
- ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বলে দিতাম।
- কিন্তু তুমি তো তখন ছোটো মা। সবকিছু ঠিকঠাক বলতে পারতে?
- না, সব তো পারতাম না। তাই মা সেগুলো নিজের মতো করে লিখত, তারপর সংশোধনের জন্য ইনল্যান্ড লেটারে ছোট্ট ছোট্ট হাতের লেখায় সব ধরিয়ে রাঁচিতে আমার বড়মামার কাছে পাঠিয়ে দিত। বড়মামা আবার ইংরেজি শুধরে, ব্যাখ্যা লিখে পাঠিয়ে দিত।
- কি বলছ মা! রাঁচি থেকে চিঠি যাওয়া আসা - সে তো অনেক সময়ের ব্যাপার। বাড়িতে কেউ ছিলনা, যে একটু বলে দিতে পারে?
- কেউ জানতো নাকি? বাড়ির বৌ, কেউ যদি ছোটো বড় কথা বলে দেয়। মানে লাগবে। খুব অভিমানী ছিল তো।”
এই অবধি বলে একটু দম নিই। দেখি মেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
- কী বলছ গো মা? লাবণ্যর এত টেনাসিটি? এ তো ইংরেজি শেখার অদম্য ইচ্ছে। এর মানে হল এটাই যে বেশি লেখাপড়া শেখা হয়নি বলে আক্ষেপ ছিল লাবণ্যর।
- সে তো বটেই। বাড়ির লোকে সাহেব সুবোর সঙ্গে ওঠাবসা করছে। স্বামী সাহেবী কোম্পানিতে চাকরি করছে, এই জন্য হয়ত হীনমন্যতায় ভুগত। পাশে সেনবাড়ির খোলামেলা পরিবেশ, মেয়েদের সম্মানজনক অবস্থান দেখত চোখের সামনে। তাছাড়া বাড়িতে নিজের শাশুড়ি কুমুদিনীর স্বাধীন জীবন দেখেছিল। তার স্বাধীন কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছিল। এসবের পাশে নিজের জীবনটা হয়ত খুব খেলো লাগত তার।
- ঠিক, সেইজন্যই বাড়ির লোক, স্বামীকে গোপন করে, বড় মেয়ে, আর প্রবাসী ভাইয়ের সাহায্যে লেখাপড়া শেখার এই প্রাণান্তকর চেষ্টা। কিন্তু মা, তোমার দাদু জানতে পারলে কি সত্যি সত্যিই পড়া বন্ধ হয়ে যেত? এমনও তো হতে পারে যে লাবণ্যর এই ইচ্ছের কথা জানতে পারলে অফিস বা বাইরের জগতের কাছে বৌকে মানানসই করার জন্য বিকাশ চন্দ্র হয়ত মত দিত। কুমুদিনীর জন্য শরৎ চন্দ্র যেমন মেম শিক্ষিকার বন্দোবস্ত করেছিলেন, তেমন কিছুও তো হতে পারত।
- কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস? কুমুদিনীর স্বামী শরৎ আর লাবণ্যর স্বামী বিকাশের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। মা বলেছিল,
- “আমার বাবা ছিল খুব কান পাতলা লোক। মা মানে কুমুদিনী ঘর দুয়ার দেখতে পারেনা, সব ঠাকুর চাকরের ওপর নির্ভর। তাই আমার বাবার তার মায়ের ওপরে খুব রাগ ছিল। আত্মীয় স্বজন হয়তো কিছু বুঝিয়ে ছিল। মায়ের ওপর রাগ করে, মানে আসলে লেখাপড়ার ওপরে রাগ করে বাবা ম্যাট্রিক পরীক্ষাটাও দেয়নি।
- ওরে বাবা, তাহলে চাকরি পেল কীকরে?
- সে কি আর আজকের যুগ! চেনা পরিচয়, নিজের বাবা শরতের গুড উইল - সব মিলিয়ে চাকরি যোগাড় করা খুব কঠিন কিছু ছিলনা। বিকাশ বিলিতি স্যাক্সবি কোম্পানিতে চাকরি পায়। অনেক টাকা রোজগার করত। আর পুরোটাই ওড়াত। ঠকেও যেত। বেলা করে বাজারে গিয়ে, শুকনো শাক, বরফের মাছ কাঁড়ি দাম দিয়ে, টাটকা বলে কিনে আনত। লাবণ্য আবার লুকিয়ে, পরিচারক কাউকে বাজারে পাঠাত। যাই হোক। সবার কাছেই যে বিকাশ মানুষ হিসেবে খুব খারাপ ছিল, তা কিন্তু নয়। কোনো ম - কারের নেশা ছিলনা। হাসলে বাড়ি কাঁপিয়ে হা হা করে হাসত। কিন্তু, ভীষণ বদরাগী। চণ্ডাল রাগ। একবার মায়ের এক দাদাকে দোতলার বারান্দা দিয়ে ফেলে দিতে গিয়েছিল। অন্য লোকে কোনোক্রমে বাঁচায়। লাবণ্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ঐ দাদার হার্টে ফুটো ছিল। তখন তো তেমন চিকিৎসা ছিলনা, যত্নে রাখতে হত। কিন্তু রাগলে বিকাশের জ্ঞান থাকতো না। পরে ঐ দাদা মারা যায়। যদি কোনো বিষয়ে বিকাশ জেদ ধরে বসত, তবে কোনো উপায়েই তাকে ফেরানো যেতনা। কারোর কথা শুনতোনা। যদি একবার পড়তে বারণ করে দেয়, আর পড়া হবেনা। তাই লাবণ্য ভয় পেয়েছিল। লুকিয়ে পড়াশোনা করত।”
- নিকুচি করেছে বিকাশ চন্দ্রের রাগের। লাবণ্য রাগ করতোনা?
- মা বলত, লাবণ্য ছিল খুব ঠান্ডা ধৈর্যশীল মানুষ। সবদিক সামাল দেবার চেষ্টা করত। এক দুবার হয়ত রেগে যেত।
- কিন্তু মা এযে ভয়ে ভয়ে বাঁচা। ভারি জ্বালা! কিন্তু কুমুদিনীর খুব তেজ ছিল, তাই না?
- হ্যাঁ। লাবণ্যরও ছিল। কিন্তু অন্যরকম। একটা শান্ত গাম্ভীর্য। সেও তো কম বড়বাড়ির মেয়ে ছিলনা। আর জি করের ছোটো ভায়ের নাতনি, খানাকুলের ঘোষবংশের মেয়ে। খুব মানী ছিল। মায়ের কাছে, মামার কাছে এত শুনেছি, মনে হয় যেন ওকে খুব ভাল করে চিনি।
- মা, তুমি কি একটা জিনিস জানো?
- কী জানব?
- উরি ওম্মা সংসেননিম ইয়া। ওম্মা সারাংহেঅ।
- মানে?
- মানে আমার মা টিচার। মা, আই লাভিউ।
- কোন ভাষা রে?
- হে হে কোরিয়ান। কে ড্রামা দেখে দেখে শিখে ফেলেছি।
- ইয়া তো রিচেবে লুব্লু। জানিনা ঠিক বললাম কিনা।
- তুমি কী বললে?
- বললাম, আই লাভিউ টু।
- ভারি আশ্চর্য না মা? লাবণ্য ইংরেজি শিখতে চেয়েছিল। তুমি রাশিয়ান শিখতে চেয়েছিলে আর আমি কোরিয়ান শিখতে চাইছি!
- যে যুগে যে ভাষা টানে।
- তুমি রাশিয়ান ভাষা শিখবে মা? আমি তাহলে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখব কী উপায় আছে।
- সব আশা কী পূরণ হয় এক জীবনে?
- হয়না নাকি? আমার মনের মধ্যে যে অনেকগুলো বড় বড় আশা পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় বসে আছে।
- অ্যাঁ, বলিস কীরে, তা তোর নবীন বয়স, পুচ্ছ এখন উচ্চে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
- তোমার প্রবীণ বয়স, তাই আশা নেই?
- তা কেন? আমারও একটা বিশেষ আশা মগডালে বসে পা দোলাচ্ছে।
- সে কী! শুনি শুনি।
- সে বলা যাবেনা।
- মা, পনের বর্ষে পুত্রী মিত্রি, বলে ফেলো, নইলে ঠাকুর ভীষণ পাপ দেবে।
- হা হা হা হা, ডায়োসেশনের ছানা হয়ে সংস্কৃতের হদ্দমুদ্দ করছিস! জানিস আমার মা বাংলার টিচার হলেও, সংস্কৃতে একটা অনায়াস দখল ছিল, মায়ের শেখানোর গুণে মাধ্যমিকের সময়ে আমি সংস্কৃতে কথা বলতে পারতাম, এখন চর্চার অভাবে অনেক ভুলে গেছি।
- কথা ঘুরিয়োনা মা, তোমার মগডালে বসা আশাটা কী সেটা বল।
- কীভাবে বলি, বড্ড মুশকিলে ফেলে দিলি। আসলে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ২০০০ সাল নাগাদ, আমরা কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হলদিয়ার পাশে একটা গ্রামে গিয়েছিলাম সার্ভে করতে। ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করছিল, আর আমরা দুজন শিক্ষিকা - আমি আর বল্লরীদি, একটা প্রাইমারী ইস্কুলের পাঁচিলে বসেছিলাম। হঠাৎ একদল মেয়ে এসে আমাদের ডাকল। একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চৌকিতে বসতে দিল, লেবু চিনির শরবৎ দিল।
- মেয়ে মানে, তারা কারা?
- ঐ গ্রামের সব অল্পবয়সী বৌরা। আমাদের কলেজের ছেলেমেয়েদের মতই, কিন্তু ঐ বয়সেই সব কোলে, কাঁখে বাচ্চা। তাদের ভীষণ কৌতূহল আমাদের সম্পর্কে। আমরা তাদের সার্ভে করব কী? তারাই আমাদের প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করছে।
- কীরকম?
- এই ধর আমরা বিয়ে করেছি কিনা, পুরুষের সঙ্গে চাকরি কীভাবে করছি? বাড়িতে কিছু বলেনা?
- আচ্ছা! এত পিছিয়ে?
- হুম, সব জেনে তারপরে বলল, দেখো না আমাদের রেডিও শুনতে দেয়না। তোমরা গান জানো? একটা গান করত।
- আশ্চর্য, তখন মোবাইল ছিলনা না?
- নাঃ, মোবাইল তখন ভবিষ্যতের গর্ভে।
- বল্লরীদি শান্তিনিকেতনের মেয়ে, দারুণ গান করে, ও বলল, ‘তোমরা আগে কর, তারপরে আমরা করব।’ এই শুনে একটি মেয়ে তার দশ - বারো বছরের কন্যাকে বলল, ‘আমিনা তুই ধর ঐ গানটা’। আমিনা গেয়ে উঠল - যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে। কী মিষ্টি সুরেলা গলা, অথচ দৃপ্ত। গান শুনে আমরা মুগ্ধ। বললাম, শিখলে কোথায় এত সুন্দর গান? মেয়ের হয়ে উত্তর দিল তার মা - ইস্কুলে গো। আমরা বললাম, ইস্কুলের নাম কী, কত দূরে? এই গ্রামেই? এবারে আমিনা বলল, ‘আমি আর ইস্কুলে পড়িনা।’
- সে কী কেন? পড়েনা কেন?
- পড়েনা, কারণ হিসেবে তার মা বললে, যে - ‘কত করে বারণ করলাম গো, ইস্কুল ছাড়িয়োনা, মেয়েটা পড়ালেখায় ভালো ছিল গো, তাও জোর করে ছাড়িয়ে দিলে গো। দিদিমণিরা, মাস্টারেরা কতবার এলো, আমিনার বাপ শুনলেনা।
- তারপর? এ কথা শুনে তোমরা কী করলে?
- কিচ্ছু করতে পারিনি রে বাবু, অতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছি, ভিন গাঁয়ে বিবাদ করব কেমন করে? তখন তো আর সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা।
- ইশ শ, তুমি কলেজে পড়াও, কত জানা চেনা, কিচ্ছু করতে পারলেনা মা?
- তখন আমারও যে অল্প বয়স বাবু, সবে কিছুদিন চাকরিতে ঢুকেছি, জানা চেনা অতশত কিছু ছিলনা। কিচ্ছু করতে না পারাটা কুরে কুরে খায়।
- তা এখন তোমার আশাটা কী?
- আশাটা একরকম দিবাস্বপ্ন বলতে পারিস। আমিনা নিশ্চয়ই তার মেয়েকে ইস্কুল ছাড়াতে দেয়নি, যদি সে বেঁচে বর্তে থাকে। ২০০০ সালের পর কালের ঘড়ি খুব দ্রুত ঘুরেছে। যদি ২০০৫ থেকে ১০ এর মধ্যে আমিনার মেয়ে জন্মায়, তবে…
- তবে?
- তবে ২০২৩ থেকে ২৮ এর মধ্যে সেই মেয়ে আঠেরো বছর হবে।
- হবে, তো?
- তাকে আমার ক্লাসে পাব। তখনও আমার চাকরি থাকবে।
- এ আবার কী ধরণের আশা! আমিনার মেয়ে এতদূরে তোমার কলেজে আসবেই এমন কোন কথা নেই।
- তা নেই, তবে রেলপথটাতো এক। আসতেও পারে।
- এলেও তাকে চিনবে কী করে?
- যদি আসে, ঠিক চিনতে পারব। বিধাতা চিনিয়ে দেবেন।
- ধর এলো, তুমি চিনতেও পারলে, কী করবে তখন?
- শোন, ও মেয়ে ওর মায়ের আফসোসের মশাল মনের মধ্যে নিয়েই আসবে। আমি সেই আগুনের শিখাটাকে যত্ন করে আকাশে তুলব।
- এমন হয় মানে হবে?
- অবশ্যই হবে, এইভাবেই হয়। লাবণ্যের আফসোসের মশালের আগুন আমার মাকে গ্র্যাজুয়েট আর আমাকে এম এস সি, এম ফিল, পি এইচ ডি করেছে। যখনই নানা সমস্যায় পড়ি, মনে হয় আর পারছিনা, তখনই চোখের সামনে দেখতে পাই, কুমুদিনীর দিদি শাশুড়িকে সকলে মিলে বাগবাজারের কোন ঘাটে সতী বলে পুড়িয়ে মারছে। লেখালেখি, স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে থাকার জন্য, বিধবা কুমুদিনীকে শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে, আর লাবণ্য তো জনম দুখিনী। এইগুলো মনে পড়ে গেলেই, আবার ঘুরে দাঁড়াই, রুখে দাঁড়াই। কলকাতা আর হলদিয়ার পাশে ঐ গ্রামের - ভৌগোলিক দূরত্ব তো খুব বেশি নয়, আসলে দুটো জায়গার মধ্যে একটা টাইম গ্যাপ রয়েছে, দুই প্রজন্মের পার্থক্য।
- মা, আমার হাতটা দেখো, কেমন কাঁটা দিচ্ছে। আমিও আশা করছি মা, আমিনার মেয়ে গানের গলা পেয়েছে মায়ের মতোন, আর খুব বড় নাম করা আর্টিস্ট হয়েছে। লাবণ্যও তো গাইত মা। না না, গান থেমে গিয়েছিল। ওর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল। লাবণ্যর হারমোনিয়ামটার খোঁজ পাওনি মা?
- পেয়েছি আবার পাইওনি।
- ও আবার কী হেঁয়ালি, হারমোনিয়ামের কথাটা শেষ কর দেখি, খুব টেনশন হয়ে যাচ্ছে।
- টেনশন হয়ে যাচ্ছে? টেনশনের কিছু নেই, ওসব কথা অনেক যুগ আগেই শেষ হয়ে গেছে।
- কিচ্ছু শেষ হয়নি, লাবণ্যর হারমোনিয়ামটা কোথায় গেল?
- কী আর করি, শোন তবে। আগেই বলেছি তখন যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন মিলে সিনেমা দেখতে যাবার চল ছিল। আমরা একবার দেখতে গিয়েছিলাম তপন সিংহের হারমোনিয়াম। একটা হারমোনিয়াম হাত ফেরতা হয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, আর গল্পও বদলে বদলে যাচ্ছে। ছবি দেখে মা আর ছোটোমামা, দুজনের চোখে জল। হল থেকে বেরিয়ে মামাকে ধরি,
- 'ও মামা, কাঁদছিলে কেন গো? কত হাসির সিন ছিল।
- ও কিছু না। আমাদেরও হারমোনিয়াম ছিল। হারিয়ে গেল। আবার যদি পেতাম।
- যা গেছে, তা গেছে। আবার কিনতে পারতে।
- বাবা আর কিনলোনা। খামখেয়াল। মা গুমরে মরতো। আমার গান শেখা হলনা। তোর মায়েরও হলনা। খুব দামী বিলিতি কোম্পানির অর্গ্যান রিডের হারমোনিয়াম।
- ঐ হারমোনিয়ামটা কে কিনেছিল?
- বিয়ের পরে, মায়ের গানের শখ দেখে বাবা কিনেছিল, মানে ঠাকুমা তখন বেঁচে ছিল তো। খুব তেজীয়ান মহিলা। মায়ের জন্য হারমোনিয়াম কিনিয়েছিল ছেলেকে দিয়ে।
(মস্তিষ্কের অদৃশ্য ডায়েরিতে নোট করি নতুন তথ্য। কুমুদিনী পুত্রবধূ লাবণ্যর জন্য দামী হারমোনিয়াম কিনিয়েছিলেন।)
- তারপর?
- ঐ হারমোনিয়াম মায়ের শান্তির জায়গা ছিল। কাজ শেষ করে নিয়ে বসত। রবিঠাকুরের গান গাইত।
- হারাল কি করে?
- বাবা অভিনয় করতো। সেন বাড়িতে হৈ হৈ ক্লাব ছিল। এন্টালিতে থ্যাটাব্যাটা ক্লাব ছিল। দিনরাত নাটক, থিয়েটারের মহলা চলত। ঐসব করতে গিয়েই বাবা কাউকে দিয়েছিল, কাকে আমরা জানিনা। আর ফেরত পাওয়া গেলনা। তারপর সব গোলমাল হয়ে গেল। আমরা খুব গরীব হয়ে গেলাম। ভাত জোটানোর লড়াই করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলাম। মা চলে গেল। হারমোনিয়াম মরীচিকা হয়ে গেল।'
এটুকু আলোচনা হচ্ছিল হাতিবাগানের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে। তারপর বাস এসে গেল। যে যার বাড়ি চলে গেলাম। হারমোনিয়াম রহস্যটা উদ্ঘাটন হল বটে, কিন্তু নতুন জট পড়ল। মায়েরা গরীব হয়ে গেল কি করে? লাবণ্যর হারমোনিয়াম নিয়েও একটা ছায়াছবি হতে পারত মনে হয়।
- সত্যিই তো মা, তুমি একদিকে বলছ, তোমার নিজের দাদু আর গোঁফ দাদু মিলে কমপিটিশন করে টাকা ওড়াত, এদিকে আবার বলছ গরীব। কীকরে হয়?
- টাকা না রেখে উড়িয়ে দিলে তো গরীবই হবে।
- ঠিক আছে, কিন্তু কবে থেকে গরীব হল?
- সে সব অনেক কথা, ছাড় এখন।
- ছাড়লে হবে কীকরে মা? যারা এবেলার লুচি ওবেলা ফেলে দিত তারা কীভাবে মানিয়ে নিল?
- না পেলে মানুষ যেভাবে মানিয়ে নেয়। শুধু তো খাবার নয়, জীবনধারণের জন্য যা যা লাগে সবই অপ্রতুল হল। আগের নিয়ম কানুন চললো না।
- নিয়ম কানুন বলতে?
- নিয়ম কানুন মানে রান্নার ব্যাকরণ। আর পাঁচটা ঘটি বাড়ির মতো ওবাড়িতেও রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার চল ছিল। ঘি, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি বেশি বেশি করে ব্যবহার হত। রোজ বেশ অনেক পদ রান্না হত। তোকে আগেই বলেছি আমার মা সপ্তাহে সাতদিন সাতরকম ডাল করত। রিপিট হতনা। সব লাবণ্যর কাছে শিখেছিল। রকম রকম শুক্তোও হত। কিন্তু রোজকার রান্নায় মানে ডাল, মাছের ঝোল বা ঝাল, কোন ডালনা - এগুলো তে পেঁয়াজ রসুন ছিল ব্রাত্য। মাছের কালিয়া, মাংস বা কাঁকড়া - এইধরনের রান্না হলে তবেই পেঁয়াজ রসুন ব্যবহার হত। আর ছিল নানারকম অম্বল আর তাতে ফোড়নের কারসাজি।
- অম্বল বলতে?
- অম্বল মানে তেঁতুল, আমসি, কাঁচা আম বা টোপা কুল এইসব টক উপকরণ দিয়ে চাটনি। টক যেটা থাকবে সেটার ক্বাথ, হলুদ আর সর্ষে বাটা ছাঁকা জল বেশ করে ফুটবে, এবারে তার মধ্যে দিতে হবে অন্য উপকরণ সঙ্গে নুন মিষ্টি। শেষে ফোড়ন দিতে হবে। আমসি বা চালতা জাতীয় ফলের নোনতা অম্বল হলে মিষ্টি পড়েনা। তবে মামার বাড়ির সকলে ছিল মিষ্টি খাওয়ার পোকা, তাই নোনতা অম্বলের চল খুব একটা ছিলনা।
- পরে নিয়মকানুন আলাদা কী হল?
- ঘি, গরম মশলা, দামী উপকরণগুলো কমে গেল। যেমন ধর মা বলত, ছোটবেলায় কমলালেবুর অম্বল খেয়েছে, পাতিলেবুর গন্ধওলা রসগোল্লার অম্বল খেয়েছে, কাঁচা তেঁতুল আর পোস্তর অম্বল খেয়েছে। কিন্তু পরে সেসব জুটতনা। তখন লাবণ্য রাঁধত তেঁতুল দিয়ে লাল শাকের অম্বল, মুসুর ডাল, আমড়া আর পাকা পটলের বীজের অম্বল। আমার মা বলত, লাবণ্য যাই রান্না করত, এক তরকারি ভাত হলেও যেন অমৃত। আমি ভাবি জানিস, কর বাড়ির প্রভাবে লাবণ্য তো খুব অল্প তেল মশলায় রান্না করতে জানত। আর মায়ের মুখে শুনেছি মায়েদের একজন পারিবারিক ধন্বন্তরি ডাক্তারবাবু ছিলেন জ্যোতিষবাবু। লাবণ্য তাঁর পরামর্শে রান্নার পদ্ধতিতে অনেক বদল এনেছিল। রান্নায় অতিরিক্ত ঘি আর মিষ্টি দেওয়া লাবণ্যর প্রভাবেই কমে আসে। পরিবারে কড়া ভাজা তরকারির বদলে সাদা ধরণের সেদ্ধ স্টু এর প্রচলনও তার হাত ধরে। সেই কারণেই চরম আর্থিক দুর্দশাতেও মানিয়ে নিতে পেরেছিল।
- রাইট, কৃষ্ণা মানে আমার দিদার হাতের ভেজিটেবল স্টুয়ের স্বাদ আমার মুখে এখনও লেগে আছে। কীকরে যে ঐ স্বাদ বানাত! তাছাড়া কম তেল মশলায় কেবল ফোড়নের জাদুতে অমৃত করত, তাই না মা? তুমি জান কীভাবে ফোড়ন দিত লাবণ্য?
- খুব অল্পই জানি। লাবণ্যর সঙ্গে পরিচয় করার সুযোগ তো হলনা। মায়ের কাছ থেকে যেটুকু শিখেছি।
- আমাকে একটু বল।
- যেমন ধর, আমার বাবা মায়ের হাতে কাঁচা পেঁপের অম্বল খেতে ভালোবাসত। তাতে মা কাঁচা তেঁতুল আর আমাদা মেশাত। ফোড়ন দিত চার ছ দানা মেথি। মেথি ভাজা হয়ে গেলে সর্ষের তেলে একটা বেশ অন্যরকম সুগন্ধ হয়, তখন আঁচ কমিয়ে মেথিগুলো তুলে ফেলে দিয়ে, সেই তেলে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিত। বাকি নিয়ম আগের মতন। অবাক হলাম কিসে জানিস, সুন্দরীদির বইতে এই উপায়ে অম্বলের কথা লেখা আছে। বাড়তি যেটা জানলাম, সেটা হল এইভাবে লাউ, শসা আর নারকেলের অম্বলও হয়। নারকেলের ক্ষেত্রে অবশ্য সর্ষের বদলে তিলবাটা লাগবে। কোন অম্বলে আবার সর্ষে ফোড়ন পড়ে। কখনও পাঁচ ফোড়ন, তো কখনও তিন ফোড়ন - ফোড়নটা বদলে দিলেই অম্বলের স্বাদ আলাদা হয়ে যাবে।
- পাঁচ ফোড়ন শুনেছি, তিন ফোড়ন তো শুনিনি। দোকানে পাওয়া যায়?
- না, বানিয়ে নিতে হয়। পাঁচ ফোড়নে থাকে মৌরি, মেথি, ধনে, কালোজিরে, রাঁধুনি। আর তিন ফোড়নে শুধু মেথি, মৌরি আর কালোজিরে। দরকার হলে হিং, সর্ষে আর জিরে আলাদা ফোড়ন দিতে হয়।
- বাঃ, আমি এভাবে একবার রান্না করার চেষ্টা করব মা।
- বেশ তো! করবি এখন। সেসময়ে মামার সেই ফিল্ম স্টুডিওতে কাজ করার রোজগারে সংসার চলত। মামা সাত সকালে বেরিয়ে যেত, গভীর রাতে বাজার করে ফিরত, তখন লাবণ্য রান্না বসাত। মায়েরা অপেক্ষায় থাকত ছোড়দা বাড়ি ফিরলে খাওয়া হবে।
- মানে বাড়িতে রান্নার কিছু থাকতনা?
- না, মাস মাইনে তো ছিলনা তখন, দিনেরটা দিনে।
- যদি কোনদিন না যেতে পারে?
- হুঁ, হত তো, ট্রেন বন্ধ বা শরীর খারাপ। সেদিন অনাহার।
- ইশ শ। কিন্তু ট্রেন বন্ধ মানে? স্টুডিও তো টালিগঞ্জে আর লাবণ্যরা থাকত বাগবাজারে। আর বিকাশ চন্দ্র?
- অত্যাচার চরমে উঠলে লাবণ্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিকাশ চন্দ্রকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। আর মামা পড়াশোনা ছেড়ে মা আর বোনেদের বাঁচাতে কাঁধে সংসারের জোয়াল তুলে নিয়েছিল।
- কী বললে? লাবণ্য শেষ পর্যন্ত পেরেছিল মা?
- পেরেছিল।
- স্যালুট। পুরো কাহিনীটা বল। আমি সবটা শুনতে চাই।
- তিক্ত কাহিনী, হয়তো শুনতে তোর ভালো লাগবেনা। মাও আমাকে বলতে চাইতোনা। তবু যা কিছু সত্য তা তো সত্যই। আমাদের নিবেদিতা ইস্কুলে শিখেছিলাম, সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়ে সত্যকে ত্যাগ করা যায়না।
- আমি তো ত্যাগ করিনি, তাই সত্যটা পুরো জানতে চাই।
'দিনগুলি কুড়োতে
কত কি যে হারাল
ব্যথা কই সে ফলা-র
বিঁধেছে যা ধারালো'
'কার চুল এলোমেলো
কিবা তাতে এলো গেল!
কার চোখে কত জল
কেবা তা মাপে?'