‘ছেঁড়া মেঘের আলো পড়ে
দেউল চূড়ার ত্রিশূলে।’
রান্নাঘরের মেয়েগুলো
রেঁধেছে ‘পাঁচমিশুলে’।
আমাদের মিনি ভাল চালতা কাটতে পারত। আমিও শিখেছিলাম, তবে খুব একটা হাত লাগাতাম না। ভয় লাগত। মিনি পড়তে শিখে গিয়েছিল। ওরা, মানে ঐ এলাকার মানুষ ‘ড়’ উচ্চারণ করতে পারে না। ‘ডয়ে শূন্য অড়’ বলে। তখন আমাদের শহরের বাড়িতে ল্যান্ডফোন ছিল না। শাশুড়ি মা প্রতিমাসে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতেন। সেই চিঠিতে খবর পেলাম, জাপানিকে তার বাবা আর নতুন মা এসে নিয়ে গেছে। জাপানি যেতে চায়নি। কিন্তু বাপ-মা এসে শ্বশুরমশায়ের হাতে পায়ে ধরেছে। খুব ভাল সম্বন্ধ পাওয়া গেছে। ছেলে বাইরের নয়, এক জেলায় বাড়ি। জমিজমা আছে, পাকা বাড়ি। বছরখানেক পরে কর্তার অফিসে ফোন এল, মিনিকে বাড়ি পাঠাতে হবে, জরুরি দরকার। ওকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা হল। তিন-চারদিন পরে মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। জাপানি মারা গেছে। অন্তসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক অবস্থা জটিল হয়ে গিয়েছিল। শীর্ণ শরীর, বোধহয় খাওয়া জুটত না ঠিকঠাক। বাপ মা খবর রাখেনি। শেষ অবস্থায় বাপের ছিটে বেড়ার ঘরে রেখে গিয়েছিল। হাসপাতালে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মা সন্তান কেউই বাঁচেনি। বরও খবর নিতে আসেনি। বর নাকি গাল তোবড়া আধবুড়ো। মিনির ফোঁপানির আওয়াজ শুনি, আর মনে মনে ফুঁসি। করবটা কী? কর্তা, গিন্নি, দেওর, ননদ মিলে শলা করে খবরটা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে গোপন রাখি। আমার ছোট জা সরকারি সিনিয়র নার্স। বদলির চাকরিতে গাঁয়েগঞ্জে বহু জায়গায় পোস্টিং পেয়েছে। মেয়েদের বহু ঘটনার সাক্ষী। খবর শুনে বলল, কী করবে শারদাদি? এর তো আঠেরো হয়েছিল, একটা বিয়ে হয়েছিল। জগৎটাই এমন। যেখানেই পোস্টিং পাই, কিছুদিন অন্তর অন্তর ছোট ছোট বালিকা, কিশোরী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হয়। অসুখ সব এক – পেটে টিউমার। আসলে টিউমার নয়। পাশবিকতার শিকার হয়ে পিরিয়ড বন্ধ। গর্ভপাত করাতে আসে। কাকা, মামা, দাদা খুব আদর করে মা, মা ডেকে ভর্তি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই কালপ্রিট। শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকি।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে মিনির প্রবল জ্বর আসে। শরীরের সব গ্ল্যান্ড ফুলে ওঠে। ওর বয়স তখন ষোলো-সতেরো হবে। কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করি। জ্বর বাগে আসতে চায় না। পিজি হাসপাতাল ওর ঐ অসহ্য জ্বর বাগে আনতে আট আটজন ডাক্তারের বোর্ড বসিয়ে দেয়। পোড়া দেশের গরীব মেয়ে এত সম্মানও পায়! ডাক্তারবাবুদের হাতযশে, নাকি জীবনে আরও যন্ত্রণা ভোগ আছে বলে – মিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি এল। কিন্তু তার বাপ-মা বললে তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। পরের মেয়ে। জোর কী করে করি? বছরখানেক পরে তার বাবা এলে আমাদের কাছে। বক্তব্য, কিছু অর্থসাহায্য দরকার। মিনির বিয়ের ঠিক হয়েছে। শুনেই জ্বলে উঠি, আবার জাপানির মতো এটিরও বলি চড়বে? মিনির বাপ নানাভাবে আশ্বস্ত করতে চায় আমাদের। ততদিনে ফোন এসেছে বাড়িতে। মিনি ফোন করে বলে, ‘চিন্তা নেই গো বো-দি। ছেলে দেখেছি আমি। পছন্দ হয়েছে।’ কানের দুল আর কিছু নগদ নিয়ে মিনির বাপ বাড়ি ফেরে। সেই শেষ। মিনির খবর আর পাইনি। লোক পাঠিয়েছিলাম কয়েকবার। সেই জানা ঠিকানায় ওর বাপ-মাও থাকে না আর। গাঁয়ের মানুষও খোঁজ দিতে পারেনি। ও চলে গেছে, তা কুড়ি বছর তো হবে। জানি না কেমন আছে বা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। মিনির বিয়ের আলোচনায় মূহূর্তের অসতর্কতায় জাপানির মরার খবর ফাঁস হয়ে যায় শাশুড়িমায়ের সামনে। তিনি শয্যা নেন। কেঁদে কেঁদে হাহুতাশ করেন, ‘বৌরানি, তোমরা তো কত লেখাপড়া করেছ, এমনকি কোনো ব্যবস্থা হয় না গো, নিজের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে মেয়েদের হাতে একটা টাকা আসে। সামান্য হলেও হবে। তবু যেন সেটা মেয়ের টাকা হয়, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না এমন টাকা। এমন কি কিছু হয় না, যেখানে মেয়ে থাকবে প্রধান হয়ে, বাড়ির লোকগুলো দরকারি কিছু পাবার জন্য ঐ মেয়ের খুঁটোয় বাঁধা থাকবে। মেয়েগুলোর কি কেউ দাম দেবে না গো।’ শাশুড়ি মায়ের বিলাপ শুনি। কিন্তু উনি যা চান, সেরকম কোনো ব্যবস্থা যে জানা নেই আমার। একটু সামলে নিয়ে তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘চোদ্দ বছর বয়সে এ সংসারে এসেছি। তারপর চারপাশে কত মেয়ের যে না খেয়ে, মার খেয়ে মৃত্যু দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। যখন যেভাবে পারি, যতটা পারি এদের বাঁচানোর চেষ্টা করি, তবু অনেক লড়াই হেরে যেতে হয়। এইসব মেয়েগুলো যে বাড়ির লোকের কাছে মর্যাদা পায় না, তাদেরই কিছু সুরাহা করার জন্য রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে যায়। সবসময় চাইতে হয়তো মানে লাগে। তাই এদের কিছু বলতে পারি না। আজ দশটাকার জিরেগুঁড়ো নিয়ে যাকে বকব, কাল পরশু হয়তো সে কাঁচা বয়সের কাজল চোখে চিতেয় উঠবে। এমন আগে ঘটেছে, তাই কিছু বলতে পারি না। ওসব সংসারের খরচ হিসেবে ধরে নিই।’ শাশুড়ি-মার কথাগুলি মর্ম ভেদ করে আমার। স্তব্ধ হয়ে থাকি। পুঁথির পাতায় এই মরা মেয়েগুলোর গালভারি নাম আছে একটা, এই বাংলারই সেন মশাইয়ের দেওয়া – মিসিং উওম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েছিলাম এসব, তখন নিজে তো কাউকে হঠাৎ মিসিং হতে দেখিনি। আজ বুঝছি। হারিয়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে যারা চিনত, তাদের বড্ড কষ্ট। বুকে পাথর চেপে রাখতে হয়।
শ্বশুর-শাশুড়ি যখন আসতেন শহরে, পোঁটলা বেঁধে অনেক কিছু আনতেন। আর পোঁটলার মধ্যে থাকত নানারকম শাক – হিঞ্চে, গিমে, মেথি শাক, ছোলা শাক, রসুন শাক এইসব। আর একটা শাক থাকত, বাপের বাড়িতে তার নাম শুনিনি কোনোদিন – পিড়িং শাক। অনেকটা মেথি শাকের মতো দেখতে। তবে মেথি শাকের থেকে তিতকুটে ভাব কম। দুটো শাক একরকমভাবেই রান্না হয়। আর দুটো শাকই আমার ভাল লাগে। তেলে পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা দিয়ে ছোট ছোট টুকরো আলু ভেজে নিতে হবে। তারপর হলুদ, জিরেগুঁড়ো দিয়ে কষে শাকটা দিতে হবে। শাক নেড়েচেড়ে মশলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে, তারপর ঢাকা দিতে হবে। মেথি বা পিড়িং – যা-ই রান্না হোক, এই শাকদুটো একটু শুকনো শুকনো ভাজা ভাজা হলে ভাল খেতে লাগে। মেথি শাকটা বেছেবুছে ডাঁটি ছাড়িয়ে শুধু পাতাটুকুই রাখতে হবে। তারপর পাতাগুলো সামান্য নুন দিয়ে কিছুক্ষণ মজিয়ে রেখে দিয়ে জল নিংড়ে নিলে তেতো ভাবটা কমে যায়। আলু না দিয়ে বেগুন ছোট ছোট করে দিয়েও রান্নাটা করা যায়। তবে আমার আর কর্তার দু’জনেরই শিম আর কড়াইশুঁটি দিয়ে মেথি শাকভাজা ভাল লাগে।
শাশুড়ি মা আর একটা খাবার বানাতেন, তেঁতুল দিয়ে চিনেবাদাম বাটা। বাদামগুলো কিন্তু কাঁচা হলে হবে না, ভাজা হতে হবে। স্বাদমত নুন-মিষ্টি মিশিয়ে নিতে হবে। কচি আম হলে তার আমসি দিয়েও ভাজা বাদামের বাটা খেতে ভাল লাগে। আর একটা হত বাদামের চাটনি। সর্ষের তেলে গোটা সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে আমসি আর বাদামগোলা জল দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হয়। আর গরমকাল হলে আমসির বদলে কাঁচা আমের ফালি ভেজে নিয়েও চাটনিটা করা যায়। কাঁচা আম দিয়ে শোল মাছের টক কর্তা খেতে খুব ভালবাসেন। তবে আমার ফেভারিট হয়ে গেছে শোল মাছের ধো়ঁকা। এই রান্নাটা আমার মেজ ননদ খুব ভাল করে। এই রান্না করার জন্য শোলমাছটা কিন্তু বোনলেস কিউব করে কাটতে হবে। তারপর যেমন নুন হলুদ মেখে মাছ ভাজা হয়, তেমনি হবে। রান্না হবে পুরো কষা মাংসের মত, একটু ঝোল ঝোল। শুধু মাংসের বদলে থাকবে শোল মাছ।
শ্বশুরবাড়ির খিড়কি পুকুরটায় খুব কই মাছ হয়। মেজদি এলেই আমার কর্তা গামছা পরে পুকুরে নেমে পড়ে। হাতে আর একটা গামছা থাকে। তারপর পাড়ের কাছে কাদায় চেপে চেপে হাতে কইমাছ ধরে ধরে পাড়ের দিকে ছোঁড়ে। মেজদি একটা হাঁড়ি নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘোরে। মাছ যেখানে পড়ে, সেখান থেকে কুড়িয়ে নেয়। আমিও ঘুরি সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু কাঁটার ভয়ে হাত লাগাতে পারি না। আমার দেওর কই মাছের হরগৌরি রান্না করে। একপিঠ সর্ষে দিয়ে ঝালঝাল কাই মাখানো, আর এক পিঠ ডোবানো থাকে ঘন তেঁতুলের টকে। কিন্তু পুকুরের শেওলা ধরা রয়্যাল সাইজের দিশি কই না হলে হরগৌরি খেয়ে শান্তি নেই। শহরে তাই আমি পমফ্রেট মাছের হরগৌরি করি। পমফ্রেটের বড় আকার আর প্রশস্ত পিঠ হরগৌরি করার জন্য আদর্শ। তবে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পমফ্রেটের চেয়েও বাউল মাছ বেশি পছন্দ করে। ওদিকে রাঁধুনিরা পমফ্রেটকে পমফ্লেট বলে ডাকে। বাউল মাছ সুস্বাদু। এ মাছের ঝোল, ঝাল, টক – সবই হয়। তবে টাটকা বাউল এলে কাঁটা ছাড়িয়ে, ফিলে কেটে সন্ধেবেলা ফিশ ফিঙ্গার ভাজা হয়। এক প্লেট করে ফিশ ফিঙ্গার সহযোগে মুড়িমাখা নিয়ে আড্ডা বসে।