লক্ষ্মী পুজো
মা বৃহস্পতিবার করে লক্ষ্মীপুজো করত বটে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোনোদিন কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়নি। মা বলত, ও পুজো ঘটি-বাড়ির নয়, বাঙাল-বাড়িতে হয়। আমাদের বছরে চারবার লক্ষ্মীপুজো – ভাদ্রলক্ষ্মী, দীপান্বিতা, পৌষলক্ষ্মী আর চৈত্রলক্ষ্মী। তার মধ্যে আড়বালিয়ায় কালীপুজোয়, মানে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোটাই খুব জোরদার হত। মায়ের ঠাকুর-ঘর চিলেকোঠায়। সদর থেকে ঠাকুরের আসন পর্যন্ত দু’ বোন আলপনা দিতাম – লক্ষ্মীঠাকুরের ডান পা, বাঁ পা, পাশে পাশে ধানের ছড়া। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে মা দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন, তাই জোড়া পা পাশাপাশি। দুয়ারে বড় করে লতাপাতা আর কল্কা দিয়ে আলপনা। ওটা হল অভ্যর্থনা। ওখানকার মানুষের কথায় অদ্ভুত টান আছে। আমাদের ঐ বাড়ি জুড়ে আলপনা দেখে আশপাশের জেঠিমা, কাকিমারা এসে বলতেন, “সেই তো, বাড়ি বন্ধ থাকে, মেয়িরা বাড়ি না এলি অয়?” বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, অতি উৎসাহে আবার আমরা যেন, ঠাকুরের জলচৌকির নীচের আলপনা দিয়ে না বসি। ও আলপনা শুধু বড়জ্যাঠাইমা দেবে, আর কেউ নয়।
বড়জ্যাঠাইমা হাজার কাজের ফাঁকে চালবাটায় কাপড়মোড়া আঙুল চুবিয়ে কি নিখুঁত আলপনা দিত জলচৌকির তলায়। যেন সরু তুলির টান। কোথাও এতটুকু চওড়ার ফারাক নেই, হাত কাঁপা নেই। প্রথমে মাঝখানে একটা ঘূর্ণি, তারপর ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে কাল্পনিক বৃত্তে পরপর সাজানো শঙ্খ, গদা, পদ্ম, প্যাঁচা। পজিশন অনুযায়ী প্যাঁচা পড়ত জলচৌকির সামনের দিকে বাঁদিকে। সামনে ডানদিকে শঙ্খ দিয়ে শুরু হত। ঘূর্ণির বৃত্তগুলোর মাঝখানে ফোঁটা ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে দিত বড়জ্যাঠাইমা। ওটা হল চক্র। শঙ্খ, গদা, পদ্ম, প্যাঁচার বৃত্তের বাইরের দিকে আর একটা কাল্পনিক বৃত্তে থাকত আয়না, চিরুনি, বালাজোড়া, দুলজোড়া। আজ যখন আমি নিজের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করি, তখন মার্বেলের মেঝেতে আলপনা ভালো ফোটে না। জলচৌকির নিচে আলপনা দিতে ভয় ভয় করে। আমার তো দেওয়ার কথা নয়, বাবা বারণ করেছে। বড়জ্যাঠাইমা কোথায়? যা-ই আঁকি না কেন, বড়জ্যাঠাইমার মত হয় না। ধ্যাবড়া হয়ে যায়, আর বারবার মুছে দিই। হাতে ধরে তো শিখিনি, খালি দেখেছি। যখন দেখেছি, তখন বড়রা যে থাকবে না – সেটা মাথায় আসেনি। নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হয়। কান্না পেয়ে যায়। মন পোড়ে, সব কান্না দেখানো যায় না।
আড়বালিয়ায় খিচুড়ি, লাবড়া, পাঁচরকম ভাজা, আলু পটলের তরকারি আর টমেটোর চাটনি হত লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হিসেবে। চারবাড়ি মিলে লোক তো কম নয়, তাই হাঁড়িতে আগে গোবিন্দভোগ চাল আর ভাজা মুগডাল মিশিয়ে ফুটিয়ে রাখা হত। আর আলু, ফুলকপি আগে নুন-হলুদ মাখিয়ে ভেজে রাখা হত। এরপর কড়ায় সর্ষের তেলে জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আদাবাটা, টমেটো বাটা, হলুদ, নুন, অল্প মিষ্টি দিয়ে কষে হাঁড়িতে ঢেলে দেওয়া হত। এইসময়েই ভাজা আলু আর ফুলকপিগুলোও হাঁড়িতে দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেওয়া হত। জলের পরিমাণটা দেখে নিয়ে ঘি, গরমমশলা আর ভাজা জিরে গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নেওয়া হত।
লাবড়াতে আমাদের বাড়িতে তেলে পাঁচফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হত। তারপর ডুমো করে কেটে রাখা আলু, বেগুন, কুমড়ো, রাঙাআলু, কাঁচকলা কড়ায় দেওয়া হত ভাজার জন্যে। কখনও বা ডয়রা কলা, থোড় কুচিও পড়ত। নুন দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলে সবজিগুলো মজে যায়। এবারে হলুদ, জিরে, ধনে গুঁড়ো, একটু মিষ্টি আর জলের ছিটে দিয়ে ভাপিয়ে নেওয়া হত। নামানোর আগে ঘি, আর ভাজা মশলা মিশিয়ে নামানো হত। বাড়িতেই খাওয়া তো, ভোগের খিচুড়ি হলেও খুব মাখামাখা করা হত না। একটু পাতলার দিকেই রাখা হত।
ফলপ্রসাদের সঙ্গে সুজি, পায়েস, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়কি, খই, মুড়ির মোয়া, চিঁড়ের মোয়া আর ক্ষীর দেওয়া হত। বাবা মোটা লাল রঙের মোমবাতি আনত। সেটা সারারাত জ্বলত। লক্ষ্মীপুজোর আগে, ভূতচতুর্দশীর দিন – বাড়ির বাইরে বড় বড় প্যাকাটির গোছা দু’ হাতে দুটো ধরিয়ে দিত বাবা। তার একদিকে আগুন ধরিয়ে ফুলঝুরির মতো ঘোরাতাম বাবা, আমি আর বোন। বাবা ছড়া কাটতো:
আলো পাকাটি দিয়ে
লক্ষ্মীর পোর বিয়ে।
আলক্ষ্মী বিদায় হয়।
ঘরের লক্ষ্মী ঘরে আয়।
আমরাও বাবার শুনে শুনে খুব জোরে জোরে চেঁচিয়ে আলক্ষ্মী বিদায় করে দিতুম। তারপর বাবা তালপাতার পাখা আর বেতের কুলো নামিয়ে আনত। এগুলো ঠাকুরের জায়গায় তোলা থাকত। তিনজন মিলে সেগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে ছড়া কেটে বাতাস দিয়ে দিয়ে রাস্তায় গিয়ে অলক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দিতুম। কুলোর বাতাস আর পাখার বাতাস দিতে আমাদের দু’ বোনের এত উৎসাহ আর তিড়িং বিড়িং লাফালাফি দেখে বাবা হা হা করে হাসত। বাবা খুব শান্ত, চুপচাপ মানুষ ছিল। কিন্তু ঐ লক্ষ্মীপুজোর দিন বাবা যেন আমাদের সমবয়সী ছেলেমানুষ হয়ে যেত। এখন বুঝি, ঐ সব রীতি বাবার ছোটবেলার স্মৃতিতে মিশে ছিল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাবা নিজের ছোটবেলায় ফিরে যেত।
সকালে ভাত তরকারির সঙ্গে চোদ্দ শাকের ভাজা খাওয়া হত। একটা তিতকুটে স্বাদ থাকত বলে খেতে চাইতাম না। কিন্তু রাঁধুনি দিদি বলত খেয়ে নাও, খেতে হয়, নইলে ভূতে ধরবে। খাওয়া একটা আনন্দের ব্যাপার। তার সঙ্গে ভূত? কিন্তু মা বলত এখানে ভূত হল অসুখ। মা খুব ভালো লিখতে পারত। নিজে ছড়া বানিয়েছিল:
লাউ কলমি
হিঞ্চে গিমে
সর্ষে নটে শাক।
পাট কুমড়ো
মেথি ধনে
রসুন দিয়ে পাক।
সুষনি মুলো
পলতা ঘেঁটু
অসুখ দূরে যাক।
মা বলত, ছড়া বলে, চোদ্দ শাক দলা করে মুখে পুরে দাও। মা বলছে, অগত্যা তাই করতাম।
এইবার শুরু হত ভূতপোড়ানো।
সারা সকাল ধরে দাদারা খড় বিচালি, শুকনো কলাপাতা দিয়ে উঠোনের সামনে ফাঁকা জায়গায় বড় একটা ভূত তৈরি করে রাখত। সেটা ঘিরে লড়াই শুরু হত। দাদারা, দিদিরা, আমি, বোন ভূত বাঁচানোর দলে। আর বাবার নেতৃত্বে জেঠুরা ভূত পোড়ানোর দলে। বাবার হাতে অব্যর্থ টিপ। বাবা দূর থেকে রকেটের মতো এমন রংমশাল ছুঁড়ল, ভূতের বুক জ্বলে উঠল। আমাদের অবস্থা দেখে বড়জেঠু দল ভেঙে বিভীষণ হয়ে, একটা বড় পাতা সমেত আমগাছের ডাল পিটিয়ে পিটিয়ে সে আগুন নেভালো। কিছুক্ষণ আরো লড়াই চলার পরে ভুস ভুস করে ভূত পুড়ে গেল। রান্নাঘরে তখন, নাড়ু, মোয়া এসব তৈরি করার জন্য দক্ষ যজ্ঞ চলছে।
বাবা জানলায় জানলায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে দিত। সেদিন মায়েরা খুব ব্যস্ত, পরের দিনই কালীপুজোয় লক্ষ্মীপুজো। তাই জলখাবারে মুড়ি খেয়েই পেটপুজো করতে হত।
সরস্বতী পুজো
আড়বালিয়ায় সরস্বতী পুজো ছিল একটা মেগা ইভেন্ট। অথচ আমাদের বাড়িতে পুজো হত না। আসলে পাড়ার ক্লাবের পুজোটা বাড়ির সামনে হত। বাড়িতে আমরা দশটা ভাইবোন। কাজেই ঐ পুজো অনেকটাই আমাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকত। ফল কাটা, প্রসাদ, উপচার সব মেজজ্যাঠাইমার বারান্দায় হত। কাগজের শিকল তৈরি করে আমরা প্যান্ডেল সাজাতাম। পিসি আসত রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে। সেই লং প্লেয়িং রেকর্ডে সারা দিন নবদ্বীপ হালদার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিক বাজানো হত। রানীমা ঘটক এয়েছেন, ফটক খুলে দাও, অথবা রসগোল্লায় ইঁদুর, কিংবা নব রামায়ণ। প্যান্ডেলের পাশে ছোট্ট তেরপল-ঢাকা ঘরে মাদুর পেতে এইসব কীর্তি করা হত। দাদারা ঠাকুরের হাতের সন্দেশটা খেয়ে নেবার প্ল্যান করত। লক্ষ্মীপুজোর মতোই খিচুড়ি হত। লাবড়াও প্রায় এক, তবে তফাৎটা হচ্ছে, এই লাবড়ায় বাকি সবজির, মানে আলু, বেগুন ও অন্যান্যর সঙ্গে নটেশাক, গাজর, কড়াইশুঁটি পড়ত। আর চাটনিটা হত কুলের চাটনি। কালো সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পাকা পাকা টোপা কুল ভাজা হত। নুন দিয়ে ঢাকা দিয়ে কড়ায় ভাপিয়ে নেওয়া হত। তার পর জল, এক টিপ হলুদ, আর পরিমাণ মতো চিনি দিয়ে ফোটানো হত। এসময়ে কুলগুলো ফাটিয়ে দিলে সেগুলোর মধ্যে মিষ্টি রসটা ভালো করে ঢুকে যায়। ঝোলটা এমন পিচ্ছিল হয়, যে গলা দিয়ে বেশ গ্লাইড করে নেমে যায়। এখন অবশ্য আমার বাড়িতে সরস্বতী পুজোয়, আমি পালংশাকের লাবড়া করি। লাবড়া রান্নায় কাজুবাটা, আমুল দুধ, ঘি দিলে স্বাদ খোলে। এই টুইস্টটাই হল রোজকার ঘন্ট আর বচ্ছরকার লাবড়ার তফাৎ।
অন্য ঠাকুরের, মানে সচরাচর দুর্গা-অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে দেরি হলে, অনেক সময় কিছু খেয়ে নিতাম। মা বলত আত্মাকে কষ্ট দিতে নেই। কিন্তু আজ অবধি এই একজন ঠাকুরের অঞ্জলি উপোস করেই দিয়েছি। খেয়ে নেবার সাহস হয়নি। বিসর্জনের আগে, মায়েরা আর পাড়ার কাকিমা, জেঠিমারা মিলে ঠাকুর বরণ করত। দু’ হাতে পানপাতা নিয়ে, ঠাকুরের পায়ের দিক থেকে দুই হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুকে ঠেকানো, তারপরে কপালে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রদীপ আর ধূপ ঘুরিয়ে আরতি করা, গালে পানপাতা দিয়ে মাকে আদর করা। মুখে জল, মিষ্টি আর কপালে সিঁদুর ছুঁয়ে দেওয়া আর সব শেষে ডানহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে কানে কানে বলা, আবার এসো - বরণের ঘটা চলত দীর্ঘক্ষণ। হাঁসকেও একইভাবে বরণ করা হত। তারপর বাড়ির পাশে বটতলার পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন হত, আর খুব কান্না পেয়ে যেত।