১৯
ঊষা মেয়েটা মানুষ ভাল, বৌমাকে খুব ভালবাসে। বলে - “আমার ছেলি ভালা না, বৌমা ভালা। ডাক্তার বাবু বলিসে ছেলি ন্যাশা না ছাড়লি বৌয়ের বাস্সা হবেনি বলো। কিন্তু ছেলি শোনেনা। তাই নিয়ে অশান্তি। দিদি আমার ছেলি গাড়ি চালায় ভালা। কলকাতায় একটা কাস দেখি দোবা দিদি?” আমি তো সঙ্কটে পড়ে যাই। জেনেশুনে গাঁজায় দম ছেলেকে কোথায় সুপারিশ করব? আমি কথা ঘোরাই,বলি, “আমরা যতদিন থাকব, তুমি এবাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করবে”। ঊষা রাজি হয়, কিন্তু কিছুতেই এই বাড়িতে বসে খায়না। সব গুছিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খায়। আমি ব্যাপার বুঝি। তাই একটু বেশি বেশি করে দিয়ে দিই। হায়রে বঙ্গ নারী - যে পুরুষদের জন্য জীবন জ্বলে পুড়ে যায়, ভালোমন্দ গুছিয়ে নিয়ে তাদেরই মুখে তোলে।
আমাদের আড়বালিয়ায় থাকার দিন শেষ হয়ে এল। শ্বশুরবাড়িতে যেমন রুনাদা, এখানেও আমাদের একজন আছে - অনাথদা। সেই কোন ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়ির ফাইফরমাসে সদা উপস্থিত, ভারি ব্যস্ত। অনাথদার তিন চাকার ট্রলি ভ্যান হল আমাদের পারিবারিক প্রাইভেট কার। ছোটবেলা থেকে শুনছি,
- 'ধান্যকুড়িয়া যেতে হবে, অনাথ দশটায় চলে আসবি, সবাই যাবে।'
- 'ওরে অনাথ, বেনেপাড়া যা, মেজকার কাছ থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে চট করে চলে আয় দিকিনি।'
- 'অ-না-থ! থাকিস কোথায়? সেজকার গাছ থেকে ডাব নামাতে হবে।'
এখনও অবধি অশীতিপর ডাকাবুকো মেজজ্যাঠাইমা যখন একা একা এসে আড়বালিয়ায় থাকে, অনাথদা নিজের ঘর ছেড়ে রাতে মেজজ্যাঠাইমার ঘরের বাইরে বিছানা পেতে ঘুমোয়। বয়স হয়ে গেছে, রাতে তাকে একা অনাথদা ছাড়বেনা।
আগে বাবা সন্ধেবেলা বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখত। বড়জেঠু আসত চা খেতে। দাদা-বৌদিরাও আসত, কখনও বা বাবার মামাতো ভাইয়েরাও থাকত আড্ডায়। রান্নাঘরে মায়ের চা করার টুংটাং, মুড়িমাখার রিনঝিন শব্দ ভেসে আসত। চা, মুড়ি খেতে খেতে সাত গাঁয়ের খবরাখবর চালাচালি হত। ভবিষ্যৎ দিশা ঠিক হত। আর আসত অনাথদা। ও বছরের বৃষ্টি, তাপ, হাওয়া অনুযায়ী কোন ফলন বেশি কি কম হল, কী গাছ এবারে লাগাতে হবে। কোন বাড়িতে কোন গাছ লাগিয়ে লাভ হয়েছে, এসব খবর তার নখদর্পণে। এবারেও অনুষ্ঠান মিটলে সন্ধেবেলায় পায়ে পায়ে আমাদের বৈঠকখানায় এসে দাঁড়ায় অনাথদা। এত বছরের অভ্যেস কি বদলানো সম্ভব! বাবার মতো একইভাবে আমি ডাকি তাকে, বসতে বলি, কর্তা টিভিটা চালিয়ে দেয়। এবাড়িতে কথাবার্তা শুনে একে একে দাদারা, বৌদিরা, ভাইপোরা আসে। আমি চা করি, ঊষা মুড়ি মাখে - জগৎটা একইরকম চলতে থাকে, আগে যেমন ছিল।
অনাথদার সঙ্গে কর্তার কথাবার্তা যেটুকু কানে আসে আমার তা অনেকটা এইরকম:
- কাল আসবে কখন? কাজ আছে।
- সেই দুক্কুরের দিকে আসবো।
- এত দেরি কেন?
- ওপাড়ায় নারকেল গাছ চোদ্দটা ছাড়াতি হবে। দোমালা গুলো রাখতি হবে, পুজোর সময়ে লাগবানি।
- এবারে বর্ষায় কী গাছ লাগাবো বলতো। আমার সফেদা লাগানোর ইচ্ছে।
- (প্রবল মাথা নেড়ে) না না। হনুমান খাতি আসবানি। এটা ভাঙবানি, ওটা ভাঙবানি। সুপুরি লাগাও দাদাবাবু।
- তাহলে সুপুরি আর কাঁঠাল লাগাই, কী বল। কাঁঠাল ও ব্যাটা হনু খেতে পারবেনা।
- উঁ হুঁ হুঁ, কাঁঠালও খায়।
- এ্যাঁ, ব্যাটা এখানে কাঁঠালও খায়? হনুমানের জাত ধর্ম আর কিস্যু রইলনা। আমাদের গ্রামের পাশে একটা পাকা রাস্তার ধারে পাঁচ ছটা হনুমান বসে ভিক্ষে করে। ফলের গাছ কমে যাচ্ছে। ব্যাটাগুলো ভিখিরি হয়ে গেছে।
- হেঁ হেঁ মেজকাকিমার ঘরে জানলা খুললেই হনুমান আসে। বিস্কুট নে যায়। আর ছোটকা বাড়ি এলি রাজ্যের কুকুর এসি জোটে।
(কথাটা ঠিক। আসলে মেজজেঠু হনুমানদের দলকে খেতে দিত। আর বাবা এলে আলাদা আলাদা কলাপাতায় ভাত, মাছ, বা মাংসের হাড়, ঝোল মেখে কুকুরদের পাত পেড়ে খাওয়াত।)
- হা হা, হনুমান কি সোজা লোক? আমার বড়দির সম্বন্ধীর একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল একজন ফল ওয়ালা। ঘর তালা দেওয়া, জানলা বন্ধ। এদিকে রোজ ফল চুরি যায়। শেষে তক্কে তক্কে থেকে দেখা গেল, হনুমানের দল আসে। পালের গোদা চালের টালি সরিয়ে লাফিয়ে মেঝেতে নামে। তার ঘাড়ে একজন, তার ওপর একজন এমন পরপর হনুমানের সিঁড়ি বানিয়ে গোদাটা হাতে হাতে ওপরে ফল পাচার করে।
- হি হি হি হি।
- ভালো চারা কোথায় পাবো বলতো?
- রথ না এলি চারা আসবেনি। নারকেল লাগাবা?
- ওরে বাবা, সে গাছের ফল তো আর দেখে যেতে পারবোনা। নারকেল তো যে সে গাছ নয়। আমার বাবার কালে একটা নারকেল গাছ নিয়ে বারো বছর মামলা চলেছিল - তার নামই হয়ে গেল মোকদ্দমা গাছ। আর এই আড়বালিয়ার একটা নারকেল থেকে চারা করে আমাদের খিড়কি পুকুরে আমার বাবা লাগিয়েছিল। টুম্পার বাবার নামে ঐ গাছটার নাম বাবা দিয়েছিল সমীর স্মৃতি।
আড্ডায় বসলে নানা কথা উঠে পড়ে। মেজবৌদি বলে তার ছোট ছেলে মানে আমার ছোট ভাইপোর জন্য পাত্রী খোঁজাখুঁজি চলছে। কেমন মেয়ে হলে ভালো, কোথায় কোথায় সম্বন্ধ এসেছে, এসব আলোচনার ফাঁকে হঠাৎ ঊষা এসে মাথা গলায়। বলে,
- তোমরা যে আমাদের দিকের মেয়ি নেবেনা, নইলে আমি খুব ভালা ভালা মেয়ির খপর দিতি পারি।
বৌদি একথা শুনে উদাস দৃষ্টি দূরে ভাসায়। ভাবখানা এমন যেন শোনেনি কথাটা। কিন্তু আমি ওর মুখের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারি। সেখানে লেখা আছে -
'এদিকে কন্যা কি কম পড়িয়াছে?'
আমার চোখে ধরা পড়ে, একদিকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য ভয় মেশানো জেদ, আর ওদিকে মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার অদম্য আকুতি। বিষয়টা এতই সংবেদনশীল, কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। বাকি শ্রোতারাও চুপ। কথায় কথায় রাত বাড়ে। অনাথদা পায়ে পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। পরের দিন আমরা শহরে ফিরব। দুপুরে গাড়ি যখন ছাড়বে বলে প্রস্তুত, অনাথদা ছুটে এসে নিজের গাছের লাল পুঁইমিটুলি এক তাড়া, গাড়ির মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়, বলে
- নে যাও গো, দ্যাশের জিনিস, রান্না করি খাবানি। টুম্পা ভালাবাসে।
গাড়ি ছোটে আড়বালিয়া ছেড়ে, টাকি রোড ধরে। ও রাস্তার দুপাশে ছিল ঝুপসি পুরোন সব গাছ। কয়েকশো বছর বয়স তাদের, লক্ষ পাখি, পিঁপড়ে, কাঠবিড়ালি আরও কত প্রাণীর আশ্রয়। দুপাশের পাতার ছাতার তলা দিয়ে এক সবুজ সুড়ঙ্গ ধরে গাড়িগুলো যেত। ভীষণ ভালো লাগতো। কে জানে কী হল, এখন গাছগুলো কারা কেটে দিয়েছে। এতো শুধু গাছ নয়, ছোটবেলার শিকড়। জোর করে উপড়ে দিলে ব্যথা লাগে। জীবনের এক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাজের পরিসরে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ভিতরে। শালিক পাখির গল্প লেখার জন্য আমার নামে পুরষ্কার উঠেছে। আজই অনুষ্ঠান। হাসিমুখে দাঁড়াই মঞ্চে, মাইক ধরে দু চার কথা বলি নিপুণ পেশাদারিত্বে। আজ এই দৃশ্য দেখে যারা সবচেয়ে খুশি হত, তারাই আজ নেই। এ যে কী শূন্যতা বলে বোঝানো যায় না। আত্মীয় স্বজনের গুঞ্জন কানে ভাসে, 'তোমার খুব মনের জোর।' 'তুমি তো একটা ছেলের কাজ করছ'। এদের কাছে অন্তর ঢেকে রাখি সঙ্গোপনে। অসুস্থ বোনটা বাবা মায়ের কাছেই থাকত। এখন তাকে নিয়ে এসেছি সব পাট চুকিয়ে। আর আমার দুটো মেয়ে নয়, তিনটে। মনে ভাবি সামলাতে পারব তো সব দায়িত্ব! একশো বছর আগে কুমুদিনীর লেখা পংক্তিগুলির মর্ম আবার নতুন করে অনুভব করি,
"সান্ত্বনা পাবার আশে
চেয়েদেখি চারিপাশে
ভুলেও প্রবোধ দিয়া
কেহ তো না যায়।
আমার মরম ব্যথা
কে বুঝিবে হায়।"
মনে মনে পংক্তিগুলিকে নিজের মত সাজাই -
সান্ত্বনা দিবার আশে
কত লোক চারিপাশে
তবুও হাটের মাঝেতে দুখ
বিকোনো না যায়।
আমার গোপন ব্যথা
কে বুঝিবে হায়।
বিজ্ঞান পরিষদের বাইরের রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ, নিয়নের আলো। যেদিন বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম, সেদিনের মতোই, তফাৎ কিছু নেই। শুধু বদলে গেছে বাতাসের ভাষা, হাওয়ার রং। সেদিন হাওয়ায় মিশে ছিল সোনার গুঁড়ো, সেই স্বর্ণ চূর্ণ এক অদৃশ্য ঢাকে কেবল বোল তুলত, ড্যাড্যাং ড্যাং, ডুডুং ডুং। খুব ছোটবেলার কথা মনে আসে। বাবা আর মায়ের হাত ধরে ঝুলে ঝুলে যেতাম, আর চেঁচাতাম - চ্যাংড়া ব্যাঙা, চ্যাংড়া ব্যাঙা। ব্যাস্ত রাস্তায় পাশের কোন পথিক মুখ টিপে হেসে আবার ভিড়ে হারিয়ে যেত। কখনও আবদার জুড়তাম আমায় পিঠে ঠেস কুমড়ো করো না বাবা। বাবা হেসে ঠেস কুমড়ো না করে আমায় কাঁধে বসিয়ে নিত। বাবার কাঁধে দু পা ঝুলিয়ে সবার উঁচুতে মাথা তুলে এই কলকাতাটাকেই কিনে নিতে পারত বাবার রাজকন্যা। কিন্তু আজ এই রুপোর পদকের উদ্ভাস বাতাসকে এতটুকুও রঙিন করতে পারছেনা কেন? ঢাকের বদলে ও বেহালা বাজাচ্ছে কেন? বাবা তুমি বাতাসকে বকে দিচ্ছ না কেন?
ফিরতি পথে আমাদের গাড়িটা ধীরে ধীরে গঙ্গা পেরোয়। এতদিন মা গঙ্গা কে দেখলে, গোমুখ, গঙ্গোত্রী, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ, ভাঙন, কোথায় ফিল্ডে যাব - এসব কত কীই না ভাবতাম। আজ হঠাৎ ঐ জল দেখে মনে হল বাবা মাকে ওখানে ভাসিয়েছি আমি। লাবণ্য, কুমুদিনী আর যত পূর্বপুরুষ সবাই ওখানেই আছেন। আমাদের কলেজের ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক ঘোর কমিউনিস্ট স্নেহাদ্রিদা গঙ্গা পেরোলেই চোখ বুজে হাত তুলে গঙ্গাকে প্রণাম করতেন আর আমরা ছোকরা ছুকরি অর্বাচীন অধ্যাপকেরা হাসতাম, বলতাম লেনিন রেগে যাবে স্নেহাদ্রিদা। একদিন উনি বলেছিলেন, 'আমি আমার বাবাকে প্রণাম করি।' কত যুগ পরে কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। কলেজেও তো পুরোন সকলে অবসর নিয়েছেন। বুঝতে পারি ঘরে বাইরে আহ্লাদ পাওয়ার দিন আর আমার নেই, এসে গেছে আহ্লাদ বিতরণের দিন।
জীবনদেবতাকে স্মরণ করে মনে মনে কটা নতুন পংক্তি বলি -
কর্তব্য শিকল পাশে
যদি বা শ্রান্তি আসে,
বুঝিও মনের কোনে
ভরা আছে মায়া।
আমি যেন হতে পারি
ভরসার ছায়া।