৯
— ও মা বল! বিপ্লবী কার্যকলাপ কী হচ্ছিল?
— বলছি বলছি, আমাকে ফ্যান গালার তোয়ালেটা এগিয়ে দে তো, ভাত হয়ে গেছে। দেখ, তারিণীপ্রসাদের সঙ্গে এবারে তোকে তাঁর ছেলে অমরেন্দ্রনাথের কথাও ভাবতে হবে।
— বল।
— তোর ঠাকুরদার জন্ম ১৯২৩ সালে। ঐ সময়ে বাংলার অবস্থাটা আগে মন দিয়ে বোঝ। অমর যখন সাত বছরের বালক, তখন ঘরের পাশে পিছাবনিতে হয় লবণ সত্যাগ্রহ।
— আরে পিছাবনি দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ঢোকে, তখন বাজারে ইস্কুলের কাছে একটা স্তম্ভ আছে, সেইটা? বাবা বারবার দেখায়?
— হাঁ সেইটাই ঐ সত্যাগ্রহের স্মারক স্তম্ভ। জেলাশাসক পেডির সামনে মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছিল, ‘আমরা পিছাবনি’।
— তারপর?
— লবণ আইন অমান্যের সময় জেলাশাসক জেমস পেডি দীঘা সমুদ্রতীরে সত্যাগ্রহীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিলেন। এর প্রতিশোধ নেন বিপ্লবীরা ১৯৩১ সালে পেডিকে হত্যা করে। ১৯৩২ এ নিহত হন ডগলাস, ১৯৩৩ এ বার্জ। অমরের যখন এগারো বছর বয়স, তখন মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি হয়। জালালাবাদের যুদ্ধের পরে যখন একের পর এক বিপ্লবী ধরা পড়ছিলেন, তখন বাংলার ছোট ছোট গ্রামগুলো প্রতিশোধের আগুনে ধক ধক করে জ্বলছিল। আসলে এই ঘটনা যখন ঘটে, মেদিনীপুরের মানুষের মনে বাঘা যতীনের বুড়িবালামের যুদ্ধের ক্ষত তখনও দগদগ করছে। বালেশ্বর জেলা তো তোদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। বাড়িতে, মাঠে ময়দানে তখন সর্বত্রই চুপি চুপি এইসব আলোচনা চলত।
— তারপর?
— ঐ সময়ে তোদের এলাকার নাম করা বিপ্লবী ছিলেন বলাইলাল দাস মহাপাত্র। ওঁর বাড়ি হচ্ছে রামনগরের লালপুর গ্রামে। উনি তারিণীপ্রসাদের একরকম আত্মীয়। এবারে ইংরেজ বিরোধী আগুনে পুড়তে পুড়তে এসে গেল অগাস্ট বিপ্লবের দিন। বিয়াল্লিশে অমর তখন উনিশ বছরের তরুণ। সকাল নেই, রাত নেই গ্রামে লালমুখো পুলিশ ঢুকে পড়ছে। নানা জনের বাড়ি দেখিয়ে দিতে বলছে। না দিলেই রাস্তায় ফেলে মার।
— কাদের বাড়ি দেখিয়ে দিতে বলছে?
— প্রথমত বলাইবাবুর বাড়ি আর তাঁর সঙ্গী-সাথীদের। আর পুলিশ ঢুকলেই যে প্রথম দেখবে সে শাঁখ বাজাবে। তারটা যে বা যারা শুনবে, তারা আবার বাজাবে। এই করে গ্রাম কে গ্রাম খবর হয়ে যেত। কাঁথি-দেপাল-দীঘা রাস্তার পাশে এক জায়গায় তোদের পাশের গ্রাম বেলবনিতে তৈরি হয়েছিল বেলবনি ভলান্টিয়ার্স ক্যাম্প। তোদের বাড়ির ঠিকানা মৈতনা হলেও, আসলে বাড়িটা বেলবনীর সীমান্তে।
— ক্যাম্পে কী হত?
— স্বদেশী নেতারা আসতেন। গোপন মিটিং হত। প্রকাশ্যে ব্যায়াম আর লাঠিখেলা শেখানো হত। কিন্তু আসলে রাসমঞ্চের আড়ালে বিদ্যুৎ বাহিনী তৈরি করে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ চলত। ঐ রাসমঞ্চ কাদের জানিস?
— কাদের?
— ফণীদাদের মানে তোর ফণীজেঠুর পরিবারের। ওঁরা এখন বালিসাইতে মামার বাড়ির জমি পেয়ে সেখানে থাকেন। ওঁদের আসল বাড়ি এই বেলবনিতে।
— কে ট্রেনিং দিত?
— ট্রেনিং দিতেন বলাইবাবু আর তাঁর ডানহাত - করঞ্জি গ্রামের সর্বেশ্বর পণ্ডা। এই সময় থেকে বাপ ছেলে - মানে তারিণী আর অমর সর্বতঃ ভাবে বলাইবাবু আর বিদ্যুৎ বাহিনীর পাশে দাঁড়ান। বাড়ির পিছন দিকে তখন বিস্তীর্ণ কাজু বাদামের জঙ্গল। ওখানেই বিপ্লবীরা অনেক সময়ে লুকিয়ে থাকতেন। এখন একটা কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস, তারিণী যেমন বড় হয়েছিলেন গান্ধীজির আদর্শ সামনে রেখে, অমরের বড় হবার প্রেক্ষাপট তার থেকে যুগের নিয়মে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। উনি মনে মনে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন।
— ঠিক, তারপর?
— এই বিপ্লবীদের খুঁজে বার করার জন্য পুলিশ শুরু করে বাড়ি পোড়ানো। গ্রামের আকাশ তখন এই বাড়ি পোড়ার ধোঁয়ায় কালো হয়ে থাকত। সেই সময়ে প্রথমবার তোদের বাড়ি পোড়ানো হয়।
— মা, ইংরেজদের যদি একবার হাতে পেতাম…
— এবারে গ্রামে একতা বাড়ানোর জন্য তারিণী শুরু করেন অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন। তখন নিচু জাতের মানুষ বাড়িতে পুজো করতে পারতনা।
— কেন?
— কোন ব্রাহ্মণ নিচু জাতের মানুষের বাড়িতে গিয়ে পুজো আচ্চা করতনা।
— সেকি? ঠাকুর কি শুধু ব্রাহ্মণদের নাকি?
— তাতো নয়, কিন্তু লোকে শুনলে তো। কোন ব্রাহ্মণ যদিও বা পুজো করত, তাকে বাকিরা সমাজে পতিত করে দিত।
— খুব খারাপ।
— টিভিতে রানী রাসমণি সিরিয়ালে এধরণের কাহিনী দেখানো হয়েছিল, মনে করে দেখ।
— হুম।
— তারিণী আশপাশের গ্রামে এই প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার ফলে ঐসব এলাকায় এই প্রথা ধীরে ধীরে লোপ পায়।
— মা, আমার গাটা দেখ, কেমন কাঁটা দিচ্ছে! তারপর বল।
— তারপর? ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবার এক মাসের মাথায় ২৪ শে সেপ্টেম্বর বেরোয় বিপ্লবী বুলেটিন। সেটা পাওয়ার পরে গ্রামের মানুষ প্রস্তুত হয়, সত্যিকারের করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। বেলবনীতে আপামর জনগণের এক বিশাল সভা হয়। ধনী গরিব, হিন্দু, মুসলমান কেউ বাকি ছিলনা। ঠিক হয় ২৮ তারিখে রাস্তা কেটে দেওয়া হবে যাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে না পারে। আর ২৯ তারিখে হবে থানা দখল। অ্যাই, কী ভাবছিস? ফ্রিজে আদাবাটা রেখে দিয়েছি, বার করে আমার হাতে দে তো বাবু।
— উফফ মা, এখন থেমো না, কন্টিনিউ।
— শুনতে শুনতে হাতে কাজ কর।
— এই নাও, এবারে বল।
— কোন বিশ্বাসঘাতকের কাছে খবর পেয়ে ২৭ তারিখে পুলিশ বেলবনী ক্যাম্পের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সন্দেহের বশে তারা ক্যাম্প আক্রমণ করে। এক লম্বা চওড়া লোক, তাঁর নাম হাওড়া - তিনি সেই ক্যাম্পের গেট পাহারা দিতেন। তাঁর কাছে প্রবল বাধা পেয়ে পুলিশ এমন মার মারে, বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়।
— ইশ শ
— ইতিহাস তো এঁদের কথা মনে রাখে না বাবু, পরবর্তী জীবনে তিনি ভিক্ষা চেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, শেষ জীবনে কুড়ি টাকা পেনশন পেতেন। অ্যাই শোন শোন, আমি তাড়াহুড়োতে খুন্তিটা খাবার টেবিলে রেখে চলে এসেছি, নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, শিগগির, আমার কড়া পুড়ে যাবে।
— এই নাও, ২৭ তারিখের বাকি কথাগুলো বল।
— তারপর পুলিশ ক্যাম্প পুড়িয়ে দিল। একটা লম্বা মাটির ঘর ছিল। ভেতরে টুপি, লাঠিসোঁটা সব রাখা থাকত। এইসব ঘটনা ঘটছে, আর এদিকে চারদিকের বাড়ি থেকে সকলে যত জোরে পারে শাঁখ বাজাচ্ছে। সেই শাঁখের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল বিস্তীর্ণ এলাকায়। আশপাশের গ্রামের মানুষ তো তেতেই ছিল। যার বাড়িতে লাঠি, বঁটি, কাটারি, দা, কাস্তে, শাবল যা ছিল তাই নিয়ে পিলপিল করে লোকে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সবাই মিলে পুলিশের দলকে ঘেরাও করে ফেলল। পুলিশ প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল, ওরা গ্রামবাসীদের সরিয়ে রামনগর ফিরে যেতে চাইছিল। কিন্তু উত্তেজনায় গ্রামের লোক রাজি নয়, তারা শেষ দেখে ছাড়বে। লড়াই শুরু হল। পুলিশ তখন বেগতিক দেখে গুলি চালাল। ছ'জন মারা গেলেন, আর অগণিত আহত। আহতদের মধ্যে আরও দু'জন মারা গেলেন কয়েকদিন পরে।
কড়ার ঢাকাটা দে। কোথায় গেলি?
আরে কাঁদছিস কেন?
— ইতিহাস বইয়ে এসব কথা তো লেখা নেই।
— বাংলার গ্রামে গ্রামে অগণিত লড়াই হয়েছে বাবু, সব কথা কি আর পড়ার বইতে ধরে? বেলবনী ক্যাম্প এখন বেলবনী শহীদ স্মৃতি তীর্থ। সেখানে শহীদ বেদীতে সেদিনকার নিহত মানুষদের নাম লেখা আছে। সব কিছু হারিয়ে যায়নি। তাঁদের বাড়ি ছিল বেলবনী, সোনাকনিয়া, লালপুর, কাদুয়া, মাধবপুর আর কলাপুঞ্জায়।
— সেখানেই কি সব ইতিহাস লেখা আছে।
— না এসব গল্প তোর ঠাকুরদার মুখে শুনেছি। তবে হ্যাঁ, লেখা আছে একটা জায়গায়।
— কোথায়?
— তোর শচীন দাদুর আত্মজীবনী। বইটা আছে বাড়িতে। পড়ে দেখতে তো পারিস।
— কোন বইটা?
— “দেশের সেই অস্থির সময় - আমার ছেলেবেলা।” লিখেছেন ডঃ শচীন্দ্রনাথ বড়পণ্ডা। ওঁর ভাইপো ড. দীপক কুমার বড়পণ্ডা এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামের কিউরেটর। তিনিই কাকার ডাইরি থেকে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে, সম্পাদনা করে বইটা ছাপিয়েছেন। যা হোক, এতো গেল ২৭শে সেপ্টেম্বরের কথা। ২৯ তারিখের ইতিহাস কিন্তু সোনার জলে লেখা আছে। সব্বাই জানে।
— কী ইতিহাস?
— ঐ যে বললাম, ২৯শে থানা দখল। সেদিন তমলুক আদালত চত্বরে শহিদ হলেন অগ্নিকন্যা মাতঙ্গিনী হাজরা, সঙ্গে আরও চুয়াল্লিশ জন।
— বইতে যখন পড়েছিলাম মা, এভাবে বুঝতে পারিনি।
— খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এতেও শেষ হল না। সেদিনের অত বড় ঘটনার পরেও পুলিশ কিন্তু বেলবনীর আসল নেতা বলাইলালকে ধরতে পারেনি।
— বেশ হয়েছে ধরতে পারেনি।
— হুঁ, সে তো ভাল হল। কিন্তু কোপ পড়ল তোদের বাড়ির ওপরে।
— মানে?
— পুলিশের মনে হল, বলাইলাল আর তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন তারিণীপ্রসাদ। এইবার দ্বিতীয়বারের জন্য তোদের বাড়ি, মন্দির লুঠ হল। সবজি বাগান, কলা বাগান সব তছনছ করে দিল। আর বাড়িটা আবার একবার পুড়িয়ে দিল। সেদিনের সেই ভয়াবহ লুঠের ফলে তোদের বাড়িতে কোন পুরোনো আমলের বাসন পর্যন্ত নেই। একতলার ডানদিকের পুরোনো কাঠের আলমারিতে একটা কোপের দাগ দেখেছিস?
— হ্যাঁ।
— সেদিনের স্মৃতি চিহ্ন।
— আমি আর সহ্য করতে পারছিনা মা।
— না তা বললে তো হবে না। শুনতে যখন বসেছ, তখন পুরোটা শুনতে হবে।
— আরও আছে?
— হ্যাঁ আছে। সেদিন তোর বুড়ো ঠাকুমা মোক্ষদা কুলোতে চাল বাচ্ছিলেন। এমন সময়ে পুলিশ পিছন থেকে এসে তাঁর হাতের কুলোয় লাথি মারে। তারিণীকে একবস্ত্রে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। তখন কিন্তু আগের শারদাও বেঁচে।
— তাই নাকি? তখন ওঁর বয়স কত?
— তা ধর তখন তাঁর একশো পেরিয়ে যাবার কথা। অন্নদাদি বলেন, উনি একশো কুড়ি বছর বেঁচে ছিলেন। উনিশশ সাতচল্লিশে অমর - বেলা মানে তোর ঠাকুরদা ঠাকুমার বিয়ে। শারদা মারা গেছেন তার পরে। দেশের স্বাধীনতা তিনি দেখে গেছেন। মজার কথা কী জানিস! দুঃসাহসী জমিদার তারিণীর ওপর তাঁর মায়ের কড়া শাসন ছিল। মায়ের জন্যেই পনের বছরের তারিণী জমিদারী হাতে পেয়ে বখে যেতে পারেননি। যা হোক তারিণী জেলে বন্দী হলেন। কিন্তু পুলিশ কিছুই প্রমাণ করতে পারল না, তারিণীকে দিয়ে কিছু বলাতেও পারেনি। উলটে সেখানে তিনি অনশন শুরু করেন। পুলিশ দেখে বেগতিক। এলাকায় তারিণীর প্রচণ্ড প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা। এতগুলো লোককে সদ্য মেরে ফেলা হয়েছে। পুরো এলাকা তখন আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে। অবস্থা বুঝে পুলিশ তারিণীকে ছেড়ে দেয়। আর একটা ভয়ঙ্কর কথা হল সেদিন মন্দির লুঠ করানোর জন্য বেছে বেছে মুসলমান পুলিশ কর্মী আনা হয়েছিল, যাতে দাঙ্গা বেঁধে যায়।
— তারপর?
— কিন্তু সে ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তারিণীপ্রসাদের চেষ্টা আর এলাকার মানুষের শুভবুদ্ধির ফলে দাঙ্গা হয়নি। এরপরেই বাড়িতে গোপীনাথের সামনে মহরমের অনুষ্ঠান চালু হয়।
— কীসব দিন মা, কীসব দিন। আমি তো কিছুই করতে পারলাম না। কোন কাজে লাগতে পারলাম না। যদি টাইম মেশিনে চলে যেতে পারতাম!
— কী করতিস?
— ইংরেজদের শেষ করে দিতাম।
— ইংরেজরা অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে বাবু। ওসব ভেবে লাভ নেই। এই মুহূর্তে যে লড়াই চলছে, সেইটা ভালো ভাবে কর।
— এখন কী? ইংরেজ তো আর নেই।
— ইংরেজ নেই, করোনা আছে। শোন বাবু তোর বুড়ো ঠাকুর্দা তো জেল খেটেছেন। কত বিপ্লবী জেলে বন্দী থেকে কত কষ্ট সহ্য করেছেন। তুই তো আর জেলে নেই, নিজের বাড়িতে আছিস। লকডাউনে এইটুকু ধৈর্য ধরতে পারবি না?
— পারব। আমি আগে বুঝতে পারিনি যে এটাও একটা যুদ্ধ।
— এখন বুঝেছিস তো? তাহলে দেখ, আমি যখন বললাম, এখন অসুখের সময়ে হাল্কা খেতে হবে। চিকেন স্টু করেছি, তখন তুই রুনাদার মত রিচ মাংস খাবার বায়না ধরলি।
— আর ধরব না।
— ভালো কথা। মনে থাকে যেন। এবারে তুই যে প্রশ্নটা করেছিলি যে আজ দশমীতে মাংস খাওয়ানোর প্রথাটা কতদিনের পুরোনো, তার উত্তর দিচ্ছি, মন দিয়ে শোন। অমরেন্দ্রনাথ বিপ্লবী সংস্পর্শে এসে মাংস খাওয়া রপ্ত করেছিলেন - আর সেটা অবশ্যই তারিণীপ্রসাদকে লুকিয়ে।
— পাঁঠার মাংস?
— হ্যাঁ রে বাবা। মুর্গি টুর্গি তখন খাওয়ার প্রচলন হয়নি। ১৯৭৮ এ ১০৩ বছর বয়সে তারিণীর মৃত্যু হয়। এরপরে অমরেন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে দুর্গাপুজোর শেষে বিসর্জনের পরে আত্মীয়দের ডেকে মাংস খাওয়ানো শুরু করেন। সেই খাওয়ানো এখন আলেডালে বেড়ে বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী মিলে তিনশো পার হয়ে যাচ্ছে। বুঝলি? আর হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির ধারাটা রয়েই গেছে, শুকোয়নি। দশমীর এই খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠানে বা অন্য কাজে অনেক মানুষই যোগ দেন, যাঁরা ধর্মে মুসলমান।
— বুঝলাম। সব ইতিহাস জমা থাকে রান্নাঘরে আর পেটের ভেতর।
— একদম! একেবারে সার কথা বুঝে গেছিস। এবারে হাত ধুয়ে খেতে বোস।
“এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার,
এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার।
এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়,
মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর,
প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস-
তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস;”