৪
“মনেরে তাই কহ যে
ভাল মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।”
গতকাল থেকেই মনস্থির করেছি,আজ দোতলাটা পুরো ঝাঁট মোছ করে তকতকে করব। তাই সকাল থেকে কাজে লেগে পড়েছি। নিচের উঠোনে রাঁধুনি বৌদের ছোট বাচ্চাগুলো দৌড়োদৌড়ি করে খেলাধুলো করছিল। হঠাৎ একটু অন্যরকম কিচিরমিচির শুনে বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাচ্চারা বাবা গো মা গো করে ঘরের দিকে দৌড়ে আসছে। হলোটা কী? ভাবতে ভাবতেই গাঁ-আ-ক করে একটা গম্ভীর গর্জন শুনলাম। অ, এই ব্যাপার! আজ ভোলা এল তবে। ভোলা আমাদের ঘরেরই এঁড়ে বাছুর। মানে এককালে তাই ছিল। এখন বিশাল চেহারা নিয়ে দীঘা উপকূল শাসন করে বেড়ায়। গাঁয়ের লোক অনেকবার ওকে চন্দনেশ্বরে পর্যন্ত দেখেছে। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। খায়দায়। কিছুদিন থেকে এলাকায় ঘুরে ঘারে চলে যায়। ও দুলকি চালে চলে, তবে চলার গতি অনুযায়ী সেটাকে পুরোপুরি হাঁটা নয়, মন্থর দৌড় বলা যেতে পারে। এক একবার খেপে গিয়ে উসেইন বোল্ট হয়েছিল, সে নজিরও অবিশ্যি আছে। ভোলার শালপ্রাংশু চেহারাটা গোয়ালের ধারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্রুত পায়ে আসছে। উঠোনের মাঝখানে এসে ঘাঁক ঘাঁক করে দুবার ডেকে, খিড়কি পুকুরের দিকে চলে গেল। ওখানে এবার দুপাক খাবে। ততক্ষণে ঝুড়িতে ওর সিধে রেডি করে ফেলতে হবে। গপগপিয়ে খাবে। তারপর বসবে না ঘুরবে, কবে যাবে সেটা ওর মর্জি। রুণাদা ঝুড়ি সাজিয়ে পুকুর ঘাটে দিয়ে এল। খাবার সময়ে হাটের মাঝে বসলে হয়না। সবারই একটা প্রাইভেসি লাগে। খাওয়ার পরে ঘাঁক ঘাঁক করতে করতে ভোলা কোথাও বেরিয়ে গেল। খিদে পেলে হয়তো আসবে আবার পরে। মেয়েরা যখন আরও ছোট, তখন একবার ভোলার তাড়া খেয়েছিলাম। বাপরে বাপ। সেবার আমার ছোট জা এসেছিল ছুটি নিয়ে। আমরা দুই মা, মেয়ে নিয়ে জমির ধার ধরে সরু বেলে রাস্তায় ঘুরছিলাম। নিস্তব্ধ দুপুরের বাতাসে হঠাৎ ঘাঁক ঘাঁক ফোঁস ফোঁস তরঙ্গ উঠল। ছোট জা মাথা উঁচু করে দেখল দৈত্যাকার শিবের বাহন আসছে কুঁজ ঘাড় শিঙ কাঁপিয়ে। বনবাদাড়ের ভিতর দিয়ে ঐ সরু পথে পাশে সরে দাঁড়াবার উপায় নেই। অনিবার্য কলিশন এড়াতে আমরা বাড়ির দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে শুরু করলাম। কিন্তু দৌড়নোয় দীর্ঘ অনভ্যাস। শিকড়ে পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ডাকতেও পারলাম না, আমার সামনে দিয়ে বাকি তিনজন পগার পার হল। যা গেছে তা যাক। আমার জীবনের বিনিময়ে ওরা বেঁচে থাক। আমার প্রাণ পাখিটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে আমাকে টা টা করার জন্য অপেক্ষা করছিল, আমি দেখছিলাম। হঠাৎ এক ঝলক ভেজা বাতাসে ভর করে একটা ছোট্ট রঞ্জা পরী এল, আর প্রাণপাখিটাকে চাপড় মেরে আমার ভিতরে ঢুকিয়ে হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। এবারে উঠতে না পারলে পরীরও জীবন সংশয় হবে। তাই শিবের নামে উঠে দাঁড়িয়ে ববম ব্যোম করে দৌড় লাগালাম। বাড়ির পিছন দিকে আমাদের বালিয়াড়িতে ওঠার একটা রাস্তা ছিল। নানা গাছের শিকড় ছড়িয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ির মতো হয়ে আছে। ওদিক দিয়ে সচরাচর যাতায়াত হয়না। কাঁটা ডাল লেগে জামাকাপড় ছেঁড়ে, রক্তারক্তি হয়, তাই। কাঁটা কুটো উপেক্ষা করে সেই পথেই আমরা রাস্তা থেকে অদৃশ্য হলাম। পরে বাড়ির লোক বর্ণনা শুনে বলল, ও হল ভোলা। আসলে ভোলা গৃহত্যাগ করেছে আমার বিয়ের আগে, তাই চিনতাম না। সেই প্রথম পরিচয়।
খানিক পরে নিচে আবার হৈ চৈ – আবার কী হল দেখি। মেয়ে দৌড়ে দৌড়ে ওপরে উঠে এল।
– মা, ও মা!
– কী?
– ফণী জেঠু এসেছে।
– তাই নাকি? প্রণাম করেছিস? ওপরে নিয়ে আয়।
বলতে না বলতে সিঁড়িতে ফণীদার দীর্ঘ অবয়ব দেখা যায়। পেটানো চেহারায় সময়ের আঁকিবুকি। সময় মতো তেল জল আরাম বিশ্রাম পেলে বয়সকালে শ্যামলা হৃতিক রোশন বলা যেতে পারত।
– বৌ-মা!
– আসুন ফণীদা। বাড়িতে সবাই ভালতো?
– হ্যাঁ, বৌমা সব কুশল মঙ্গল। কৌটোগুলো ধরো, তোমার বৌদি পাঠিয়েছে। এটা চালভাজা, বাপুভাই (আমার কর্তা) ভালবাসে। আর এই তোমার তেঁতুলের আচার। সব কলকাতা নিয়ে যাবে। নিচে রান্নাঘরে একদম দেবেনা, সব কমিয়ে দেবে। আমি ওদের কাউকে না বলে সব ওপরে নিয়ে চলে এলাম। সাবধানে রাখো। মেয়েদের চিকেনটা রান্নাঘরে দিয়েছি।
– এই এতো কিছু আপনি সেই বালিসাই থেকে সাইকেলে বয়ে আনলেন? খুব কষ্ট হল তো।
– কষ্ট বললে হয় বৌমা? বাপু, তুমি, মেয়েরা বাড়ি এসেছ। কতটুকু দিতে পারি, এটুকু আনবোনা?
কৌটো সামলে রাখতে রাখতে সুখ দুঃখের গল্প জমে। ফণীদা আর তাঁর দাদা মণিদা হলেন আমার শাশুড়ির ধর্ম ছেলে, সে যুগে এমন চল ছিল। ওঁদের মা দুই ছেলেকে শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে ফণীদা মণিদা হলেন আমার ভাশুর। আমার কর্তারা যখন ছোট ছিল, এবাড়ির জন্য ওঁরা অনেক করেছেন। ফণীদার একটা ছোট দোকান আছে, কষ্টেসৃষ্টে চলে। বুড়ো মা, চলচ্ছক্তিহীন। এক পাগল বোন। বৌ আর এক ছেলে এক মেয়ে, এই হল ফণীদার সংসার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে জয়েন্ট পাশ করে শিবপুরে পড়ে। সে ছেলের ক্যানসার। বাবা মার অমূল্য ধন, তার কেমোর টাকা জোগাড় করতে করতে নাভিশ্বাস ওঠে। সে লড়াইয়ে আমরাও সামিল। সেই কৃতজ্ঞতা বোধে ফণীদা ছুটে ছুটে কত কী নিয়ে আসে। খুব খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। কিন্তু মানুষটা আমাদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। যা আনে খুব কষ্ট করেই আনে, তবু কিছু বলা যায়না। ঐ ছোট্ট দোকানের কতটুকু আয়। বৌদি শাশুড়ি, ননদকে দেখে। একা হাতে সব সংসার সামলায়, আর কিছুটা সুরাহার জন্যে ছাগল, মুরগি এইসব পোষে। সেই দিশি মুরগির একটাই আজ ফণীদা কেটে নিয়ে চলে এসেছে মেয়েদের জন্য। ওটা বিক্রি করতে পারলে কিছু তো রোজগার হত। ফণীদার দোকানের বড় বড় বয়ামে ভরা চালভাজা গুলো দেখি, ফণীদা বলে চলে,
– এটা রাখুকে (মেজ ননদকে) পাঠাবে বৌমা। এইটা মালুর (বড় ননদের), ওরা ঝাল খায়, তাই ঝাল দেওয়া। তোমাদের এইটে – বাপু (কর্তা) যেমন ভালবাসে, আর এটা তপুকে (দেওরকে) দেবে। তেঁতুলের আচার শুধু তোমার। বাকিদের না। চিনি দেওয়া নেই বৌমা, চিন্তা কোরোনা একটু গুড় আছে। সে তুমি যদি অন্যদের দিতে চাও আলাদা কথা, কিন্তু বৌদি বলছিল ওদের জন্য আমের আচার পাঠাবে খন। এটা শারদার ইস্পেশাল...
ফণীদা বলেই চলে, অনাবিল হাসে। আমার কানে কথাগুলি কুয়াশার মতো ভাসে, ওড়ে, পাক খায়। কটা দুখী মানুষ এত সুখী হাসি হাসতে পারে। প্রেগন্যান্সির সময়ে আমার জেস্টেশনাল ব্লাড সুগার ধরা পড়ে। মিষ্টি খেতে পারবোনা, এদিকে শরীর অস্থির, মুখে স্বাদ নেই। সেই থেকে আমার জন্য ফণীদার বাড়ি থেকে আমের নয় এই তেঁতুলের আচার বরাদ্দ।
– বড় সাইজ দেখে কেটেছি বৌমা। ভাল জাতের দিশি মোরগ। খুব স্বাদ হবে দেখো। মেয়েদুটো যেন ভাল করে খায়। রুণাকে বলো রান্না করতে, ও পারবে ভাল। তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে।
– চিন্তা করবেন না ফণীদা, আমি সব সামলে দেব। আপনি পাখার তলায় সুস্থির হয়ে বসুন তো। আমি নিচে গিয়ে আপনার চা জলখাবার পাঠাচ্ছি।
নিচে গিয়ে কাজে লেগে পড়ি।
– জেঠিমা, ও জেঠিমা!
– কী?
– ফণীজেঠু যে ঠাকুমার ধর্ম ছেলে, এখন তো এমন কিছু হয়না।
– হয় তো।
– কোথায় হয়? উদাহরণ দাও দেখি।
– উদাহরণ? চোখের সামনেই আছে। ঠুলি পরে আছিস নাকি?
– মানে? কোথায়?
– নিজের দিকে তাকা। তুই – ই তো আমার ধর্ম মেয়ে।
– হ্যাঁ তো, ঠিক বলেছ তো। আমার মাথাতেই আসেনি। এ্যাই বোনু, শোন, আমি জেঠিমার ধর্ম মেয়ে।
কর্ণাবতী উঠোনের দিকে হাঁটা লাগায়। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। যুতসই উত্তর না হলে, কাজকর্ম মাথায় তুলে এখন আমায় বকিয়ে মারতো। রান্নাবান্না, যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু কী মুশকিল, মিনিট পনেরো পরেই দুই মূর্তি আবার হাজির।
– একটা কোশ্চেন আছে।
– এখন হবে না।
– আর্জেন্ট। আনসার পেলে চলে যাব।
– বলে ফেলো।
– রাঁচীর দেহাতি চিকেন রান্নাটা কি ফণীজেঠুর আনা চিকেন দিয়ে করা সম্ভব? যদি হ্যাঁ হয় তা'লে কোন কথা নেই। যদি না হয়, তবে কেন সম্ভব নয়? দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেনের তফাৎ কী?
– তিনটে প্রশ্ন তো করার কথা ছিলনা।
– তিনটে নয়, ওটা এক্সটেনশন। তাড়াতাড়ি উত্তরটা দিয়ে দাও, নইলে তোমার সময়ের ক্ষতি।
– দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেন – ব্যাপারটা একই। ওটা ভাষার তফাৎ। পোল্ট্রির বাইরে যেসব মুরগি বাড়িতে পোষা হয়, স্বাভাবিক খাদ্য খেয়ে বাঁচে, ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে মাংস বাড়ানো হয়না, তেমন চিকেন। তবে হ্যাঁ, বাংলায় যে জাতের মুরগি পোষা হয়, আর ঝাড়খন্ডী আদিবাসীরা যেমন পোষে, তাদের মধ্যে কিছু আলাদা থাকতে পারে। দিশি মোরগের জাতিভেদ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
– ঠিক আছে, এখন আমাদের প্রস্তাব হইল, সুযোগ যখন বাড়ি বয়ে এসে গেছে, তখন এই চিকেন রাঁচীর রেসিপিতেই রান্না হউক। আমরা স্বাদের পরীক্ষা করিব।
– আর্জি মঞ্জুর। তাহাই হইবেক। এখন পাকশালা হইতে প্রস্থান করিতে আজ্ঞা হউক।
– ও মা! রুণা জেঠুকে বলোনা।
– কী বলবো?
– বাঁশ কেটে দিতে।
– বাঁশ দিয়ে কী হবে?
– বাঁশের আচারটাও হয়ে যেত তাহলে।
– ভ্যাট। এই বাঁশ কেটে আচার হয়না। কচি বাঁশের কোঁড় মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ব্যাম্বু শুট, তাই দিয়ে আচার হয়। রাঁচীতে আদিবাসী মেয়েরা ঝিরিঝিরি কাটা নরম বাঁশ প্যাকেটে করে বিক্রি করে। ওরা কোনভাবে বাঁশগুলো একটু গেঁজিয়ে রাখে। টক টক খেতে লাগে। সেই বাঁশ ধুয়ে, জল শুকিয়ে, আচারের গুঁড়ো মশলা, অনেকটা সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে জরিয়ে কেউ রোদে দেয়, কেউ আবার উনুনে কড়া বসিয়ে ঐ শুকনো ঝিরিঝিরি কাটা বাঁশ ভেজে নরম করে চটজলদি বানিয়ে নেয়। বুঝেছিস? এবার পালা এখান থেকে।
– একটা কথা বলে যাই, ছোটবেলার দেহাতি চিকেন রেসিপিটা মনে আছে তো?
– তোরা যাবি?
রান্নাঘরের বৌদের নানারকম নির্দেশ দিয়ে দিই। আমার ছোটবেলার রেসিপি কি ছোটবেলায় বসে আছে নাকি? আমি তো প্রায়শই রাঁচীতে ভিডিও কল করি। ছুকুমামাকে বলি ফোন নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঘোরো। আমাকে রাঁচীর বাড়িটা দেখাও। বারান্দায় যাও। রাঁচীর রাস্তা দেখাও। সব একরকমই আছে, যেমন ছেড়ে এসেছিলাম শেষবার। দেখতে খুব ভাল লাগে। ছোটবেলাকে ছুঁতে পারি। মাইমাকে বলি, "কী রান্না করছ মাইমা?" মাইমাও বড়দিদার মতো রন্ধন পটিয়সী। ফোন দিয়ে দেখি রাঁচীর গেরস্থালি। বড়দিদা দেহাতি চিকেনে কোনো মশলা মাখাতো না। শুধু আধঘন্টা নুন লেবু আর গোলমরিচে ভিজিয়ে রাখতো। নুনটা বেশি নয়, অল্প। কাঁচা মাংসে বেশি নুন দিলে প্রথমেই জল বেরিয়ে মাংস ছিবড়ে হয়ে যায়। এবারে সর্ষের তেলে গোটা গরম মশলা ফোড়ন, আর একটু চিনি দিয়ে গলিয়ে ক্যারামেল করে নিত। তার ওপরে কুচো পেঁয়াজ আর পেঁয়াজ বাটা দিয়ে দিত। বাটা যদি তিনের চারভাগ হয়, তো কুচোনো থাকবে একের চার। ভাল করে পেঁয়াজ ভাজার পর একে একে আদা রসুন বাটা, টমেটো বাটা, হলুদ, ধনে, জিরে আর কাশ্মিরী লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষতে হবে। আঁচ থাকবে মাঝারি। মশলা অর্ধেক কষা হলে, এবারে মাংস দিয়ে দেওয়া হবে। ঢাকা দিয়ে দিয়ে রান্না হবে। মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে, যাতে তলা না ধরে যায়। মাংস কষা খানিকটা হয়ে এলে পড়বে কাঁচা লঙ্কা বাটা। বেশ ভাল করে তেল ছেড়ে গেলে একটু গরমজল দিয়ে ফোটানো যায়। শেষে ধনেপাতা কুচো আর গোলমরিচ, গরম মশলা গুঁড়ো দিতে হবে। মাংস সুসিদ্ধ হওয়া চাই। কষা মাংসের মতো অল্প গ্রেভি থাকবে। ব্যস, হয়ে গেল দেহাতি থুড়ি দেশি চিকেন।
ফণীদার আনা চিকেন খেয়ে মেয়েরা খুব খুশি। তাই ফণীদার কত আনন্দ। এই স্থিতধী প্রশান্ত মুখ দেখে, আমার বড়দাদুর কথা মনে আসে। আজ কতদিন পরে বড়দাদুর শান্ত, হাসিমুখ, সেই তিনতলা বাড়ি, লাল সিমেন্টের মেঝেয় ছোটাছুটি, হাসি খেলা যেন গতজন্মের স্মৃতির মতো ভেসে আসে। বিকেল হলে সরল মুখের আদিবাসী মেয়েরা ঝাঁকা নিয়ে আসতো, বাদাম, কাঠের হাতা খুন্তি, লোহার খেলনাপাতি নিয়ে। বড়দাদু আমায় লোহার একসেট রান্নাবাটি কিনে দিয়েছিল। খুব শক্ত পোক্ত আর বড়সড়। সেখানে উনুন, বঁটি থেকে শুরু করে রান্নাঘরের খুঁটিনাটি সবরকম বাসন ছিল। কলকাতায় ফিরে, মায়ের কাছ থেকে রোজ আলু, পটল, কাঁচকলার – যেদিন যেমন হয়, সব খোসা নিয়ে সেই বঁটিতে কুটনো কেটে মিছিমিছি রান্না করতাম। রাঁচী পাহাড়ের ভোরের লাল সূর্য, আর রাতের সেই বন্য জোছনা পরিবার থেকে মুছে দিয়েছিল ছোটকর্তার স্মৃতি।