বনেদী পরিবারের গুহ্য শৈলী
এবারে মায়ের একটা স্পেশাল আইটেমের কথা বলি। আমার মা একরকম দইমাছ বানাত, সেটা অন্যান্য পরিবারের দইমাছের সঙ্গে মিলত না। অন্য বাড়িতে দইমাছের রং হত সাদাটে, কিন্তু মায়ের দইমাছ ছিল টকটকে লাল। ঐ দইমাছ আমার কর্তা আর কন্যারও ভীষণ পছন্দ। পদ্ধতিটা বলি তাহলে। বড় পাকা রুই মাছ লাগবে। মাছটা যদি আকারে ছোট হত, তাহলে মা ভীষণ রেগে যেত। বলত, এটাতে কোনো কম্প্রোমাইজ চলবে না। এই রান্না মা শিখেছিল মায়ের মা লাবণ্যপ্রভার কাছ থেকে। লাবণ্য ছিলেন খানাকুলের ঘোষ বংশের মেয়ে। তিনি শিখেছিলেন তাঁর মা যূথিকারানীর কাছে। যূথিকারানী বেতড়ের কর বাড়ির মেয়ে, চিকিৎসক আর. জি. করের ভাইঝি। এই দইমাছ যদি করবাড়ির রেসিপি হয়, তবে তা খানাকুলের ঘোষ, বসিরহাটের মণ্ডল হয়ে এখন রামনগরের দাসমহাপাত্র পরিবারে চলে এসেছে। মাছে শুধু নুন মাখিয়ে রাখতে হবে, হলুদ পড়বে না। মাছ ভাজা হবে না, কাঁচা থাকবে। কড়াতে সর্ষের তেল আর ঘি সমপরিমাণে নিতে হবে। গরম হলে তাতে গরমমশলা আর চিনি দিতে হবে। গরমমশলা ভাজার গন্ধ উঠবে, চিনি গলে যাবে, তারপর মিহি পেঁয়াজবাটা দিয়ে কষতে হবে। ভালো করে কষা হলে, এবারে নুন আর শুকনো লঙ্কাবাটা দিতে হবে। কষতে কষতে তেল ছেড়ে যাবে। এবারে অল্প জল দিতে হবে। জল দিলে কড়ার উষ্ণতা কমে যাবে। এবারে মিষ্টি দই ফেটিয়ে কড়ায় ঢেলে দিতে হবে। ফেটানোর সময়ে একচিলতে ময়দা মিশিয়ে ফেটালে ভালো। কড়ায় কম উষ্ণতা আর দইয়ে একচিলতে ময়দা থাকলে দই ফেটে যাবার সম্ভাবনা আর থাকে না। এই গ্রেভিতে এবারে নুন মাখানো কাঁচা মাছগুলো ফুটবে। মাছ ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে, ঝোলের নুন-মিষ্টি দেখে রান্না নামাতে হবে।
বোসবাড়িতে একরকম মাছের ঝাল রান্না হত, তাতে কোনোরকম ফোড়ন পড়ত না। এই রান্নাটা একদম ঠিকঠাক করতে পারতেন আমার এক মামীমা। সম্পর্কে তিনি আমার দাদু বিকাশ বোসের বড়দা সতীশ বোসের বড়বৌমা। তাঁর এখন চুরানব্বই বছর বয়স। আমার মা কিন্তু এটা ঠিকভাবে রপ্ত করতে পারেনি। সর্ষের তেল আর ঘি মিশিয়ে, তাতে শুকনো লঙ্কা আর হলুদ বাটা দিয়ে কষতে হত। তেল ছেড়ে গেলে, তাতে অল্প জল, নুন দিয়ে পাকা রুই মাছের টুকরো ফেলে ফোটাতে হয়। এখানেও মাছটা ভাজা হয় না।
মা গল্প করত, যে মায়েদের ছোটবেলায় পোস্ত রান্না হত একেবারে ঝুরঝুরে, বাদামি রঙের। প্রথমে পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, মুচমুচে আলু ভেজে, তাতে পোস্তবাটা দেওয়া হত। আর কষে কষে সেই পোস্ত বাদামি রং হয়ে তেল ছেড়ে যেত। আমার দাদুভাই নাকি এই মুচমুচে, ঝুরঝুরে পোস্ত ছাড়া মুখে তুলত না। একবার রাঁচিতে শ্বশুরবাড়ির এক জ্ঞাতির বাড়িতে নরম আলুপোস্ত খেয়ে তাঁর মন ঘুরে যায়। তেল জবজবে ঝুরো আলুপোস্ত বন্ধ হয়। এখন দাদুর শ্বশুরবাড়ির তরফে, মানে লাবণ্যর বাপের বাড়িতে যদি এই ঝুরো পোস্ত না হয়, সেক্ষেত্রে আমার ধারণা, এই রেসিপি শোভাবাজার রাজবাড়ির। দাদুভাইয়ের ছেলেবেলা ওখানেই কেটেছে, কারণ আমার দাদুভাই বিকাশচন্দ্র বোসের ঠাকুরদা মহেশচন্দ্র বোস ছিলেন রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের ঘরজামাই। তাই দাদুভাই মনে হয় অমন খেতে শিখেছিল।
মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনী বসুর হাতের আনারসের সরবতের কথা শুনেছি। কুমুদিনীর মা লীলাবতী মিত্র ছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। লীলাবতীর মা ছিলেন হাটখোলা দত্ত বাড়ির মেয়ে। আর কুমুদিনীর বাবা হলেন ব্রাহ্ম নেতা কৃষ্ণকুমার মিত্র, যিনি প্রথম স্বদেশী ও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের ময়মনসিংহ। বসু, দত্ত নাকি মিত্র কোন বাড়ি থেকে কুমুদিনী এই সরবৎ শিখেছিলেন, সে তো আজ আর জানার উপায় নেই। তখনকার দিনে তো মিক্সার গ্রাইন্ডার ছিল না, হাতেই খুব ঝিরিঝিরি করে আনারস কাটা হত। এবারে বেশ কয়েকঘণ্টা ঐ আনারস মিষ্টি বাতাবি বা মুসম্বির রসে জারিয়ে রাখা হত। আর ঐ সময়ে জলে চিনি দিয়ে ফুটিয়ে আলাদা করে রস বানিয়ে ঠান্ডা করে রাখা হত। এবারে ডালের কাঁটা দিয়ে আনারস ভালো ভাবে মেড়ে, তাতে নুন বা বিটনুন, গোল মরিচের গুঁড়ো, চিনির রস আর পরিমাণমত জল দিয়ে ঐ সরবৎ বানানো হত। পরিবেশনের আগে ছাঁকনি বা পরিষ্কার কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হত, যাতে মুখে কোনো শাঁস, শোঁয়া বা লেবুর বিচি না পড়ে। সে যুগে তো ঘরে ঘরে বরফ সুলভ ছিল না। তাই পাথরের পাত্রে বাড়ির কোনো ছায়াঘেরা ঠান্ডা জায়গায় রাখা হত। পরিবেশনও করা হত পাথরের গেলাসে। মায়ের কাছে সেই পুরোনো দিনের একটা রয়্যাল সাইজের শ্বেত পাথরের গেলাস ছিল। তার মাপমত একটা পাথরের ঢাকাও ছিল। কুমুদিনীর হাতের ঐ সরবৎ কেউ একবার খেলে নাকি ভুলত না।
আর মা বলত, মায়েদের বাড়িতে নানারকম নিমকি, এলোঝেলো, জিরে চিঁড়ে, ক্ষীর কমলা এইসব নাকি সবসময়ে বানানো হত। আমার বোন শ্যামবাজারের এক রান্না শেখার ইস্কুলে এলোঝেলো বানাতে শিখেছিল। পরিমাণমত ময়ান, নুন আর কালোজিরে দিয়ে ঠেসে ময়দা মাখতে হবে। এবারে লম্বাটে লুচির মত বেলে তার সেন্ট্রাল পজিশনে খুন্তি দিয়ে তিনটে সমান্তরাল ভাবে জানলা করে দিতে হবে, মানে কেটে দিতে হবে। লুচিতে ফুটো হয়ে গেলে ভাজলে সে আর ফুলবে না, কিন্তু মচমচে নিমকির মত হবে। ঐ জানলাওলা লুচিটা দু'পাশে ধরে টফির কাগজের মত পেঁচিয়ে দিতে হবে। মাঝখানটা কাটা থাকার জন্য ফিতে পেঁচানোর মত দেখতে লাগবে। এটাই এলোঝেলো। এটাকে এবার ছাঁকা তেলে বা ঘিয়ে মচমচে করে ভাজতে হবে। তারপর এলোঝেলোগুলো জাল দেওয়া চিনির রসে ফেলে দিতে হবে। চিনিটা গায়ে গায়ে লেগে শুকোবে। চিনির রস জ্বাল দেবার সময়ে যদি মনে করে লবঙ্গ ফেলে দেওয়া হয় তো কেল্লা ফতে।
আর জিরেচিঁড়েতে চিঁড়ে থাকে না। নারকেলকে চিঁড়ের মত ঝিরিঝিরি করে কাটা হয়। মায়ের কাছে শুনে যা বুঝেছি, তা হল জিরে চিঁড়ে বাংলার ট্র্যাডিশনাল নারকেলের টুটিফ্রুটি। সাদা চিঁড়ের মত ফাইন স্লাইস করা নারকেল আর প্রায় সমপরিমাণ সাদা চিনি ঠান্ডা কড়ায় ঢেলে নিয়ে, তারপর ঢিমে আঁচে বসাতে হবে। খুন্তি নাড়া ছাড়া যাবে না, অন্য কাজে মন দেওয়া যাবে না। ধৈর্য হারিয়ে আঁচ বাড়ানো যাবে না। ধীরে ধীরে নারকেলের তেল ছাড়বে, চিনি গলবে, কিন্তু লাল হবে না। চিনির চিটচিটে ভাব চলে গিয়ে নারকেলের গায়ে শুকিয়ে যখন আটকে যাবে, তৈরি জিরেচিঁড়ে। ঠান্ডা করে কৌটোয় ভরে রাখতে হবে, অনেক দিন থাকবে। এত সময় নিয়ে আমি যদি এটা সত্যি সত্যি বানাতে পারতাম, আমার মেয়ে ভাত বাদ দিয়ে এটাই সারা দিনে খেয়ে শেষ করে দিত, বেশি দিন রাখার অবকাশ থাকত না।
ক্ষীর কমলা, আতার পায়েস এসব আমি নিজে করেছি। মূল ব্যপারটা হল, চিনি, এলাচ, জাফরান, এসব দিয়ে ক্ষীর যেমন বানায়, তেমন হবে। এবারে ঠান্ডা করার পর, ফলের শাঁস – সে কমলালেবু হোক বা অন্য কিছু – সেটা মেশাতে হবে। আঁচে থাকাকালীন মেশালে ছানা কেটে যাবে। এখন ফ্রিজ আছে, ঠান্ডা করা কোনো ব্যাপার নয়। মা বলত, আগের দিনে যেকোনো ঠান্ডা খাবার শ্বেত পাথরের বাসনে রাখা হত, আর পাথরের বাসনেই খেতে দেওয়া হত। মায়ের ভাগে বংশের যেসব বাসন পড়েছিল, সেসব এখন আমার কাছে আছে।
এবারে শেষপাতের চাটনির কথা কি না বললে চলে? মায়ের চাটনি করার বেশ স্টাইল ছিল। আমার শ্বশুরবাড়িতে টমেটোর চাটনিতে জল পড়ে না। ভুরি পরিমাণ ফোড়ন, মশলা, লঙ্কা দিয়ে ঘন বড়ের আঠা চাটনি করে রাঁধুনিরা। কিন্তু মা কখনও পাঁচফোড়ন, কখনও সর্ষে ফোড়ন দিয়ে টমেটোর পাতলা চাটনি করত। পেঁপের চাটনির নানান রকমফের ছিল। সর্ষে ফোড়ন দিয়ে পেঁপে হাল্কা তেলে নেড়ে আমাদাবাটা দিয়ে চাটনি যেমন হত, আবার পেঁপে কুরে লেবু-চিনির রসে ফেলা চাটনিও হত। আর একরকম ছিল, যেখানে পেঁপে এত পাতলা করে স্লাইস করা হত, যে রান্নার পরে স্বচ্ছ হয়ে যেত। আমরা বলতাম প্লাস্টিকের চাটনি। সেকালে বিয়েবাড়িতে প্রায়শই এই প্লাস্টিকের চাটনি হত। এখন ক্যাটারিংয়ের বিস্বাদ ফ্রুট চাটনির ঠেলায় এসব তরিবত উঠে গেছে। আমড়া আর জলপাই দিয়েও মা পাতলা চাটনি করত। আমার শ্বশুরবাড়িতে পাকা তেঁতুলের চাটনি বা সরবৎ খুব চলে। কিন্তু মা করত আমাদা দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের চাটনি। খুব ভালো লাগত। বিয়ের পর এক ভাইফোঁটায় আমার মামাতো ভাই অতিথি ছিল। আমি তো সাধ্যমত টমেটোর চাটনি করেছি। ওকে খেতে দিয়েছি, জিজ্ঞেস করছি – কেমন হয়েছে। ভাই হেসে ঘাড় নাড়ছে। পরে আমি খেতে গিয়ে দেখি, চাটনি কি কিড়কিড়ে মিষ্টিরে বাবা, টকের ট নেই। আমি নিজেই মুখে তুলতে পারছি না। তারপর ল্যান্ডফোনে মায়ের কাছে অনুযোগ জানালাম, এমন কেন হল। মা বলল, টমেটো নিশ্চয়ই দিশি ছিল না, মিষ্টি হাইব্রিড টমেটো ছিল। চেখে দেখা উচিত ছিল আমার। সবকিছু ওভাবে শেখানো যায় না। পরিস্থিতি বুঝে নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয়। এরকম ক্ষেত্রে পাতিলেবুর রস বা পাকা তেঁতুল মিশিয়ে দিলে এমন ম্যাসাকার হত না। আজকাল ক্যাডবেরির একটা বিজ্ঞাপন দেখায়, দিদি ভুল করে চিনির বদলে নুন দিয়ে পায়েস করে ফেলেছে, আর ভাই, কেউ যাতে না বুঝতে পারে, বলছে পুরোটা আমি খাব। ওটা দেখলে আমার নিজের সেই চাটনির কথা মনে পড়ে যায়। তবে নতুন গিন্নিদের বোধ করি সকলেরই এমন কিছু না কিছু ঘটে। আমার এক পিসতুতো বোন নুনের বদলে সোডা দিয়ে ডাল করে ফেলেছিল। যাক এসব দুঃখের কথা, মিষ্টি মিষ্টি চাটনির কথায় ফিরে আসি।
কাঁচা আম দিয়ে মা নানারকম চাটনি করত। পাঁচফোড়ন, গোটা শুকনো লঙ্কা দিয়ে আমের টুকরো ভেজে, ওপরে ভাজা মশলা দিয়ে চাটনি করত। তবে আমি ভালোবাসতাম গোটা সর্ষে ফোড়ন দিয়ে আমের একেবারে পাতলা চাটনি। মা বলত আমের ঝোল। আর বাবা পোনা মাছের ডিম দিয়ে আমের চাটনি খেতে ভীষণ ভালোবাসত। মাঝেমধ্যে আম থেঁতো করা হত। থেঁতোতে নুন, মিষ্টি, এক ফোঁটা সর্ষের তেল আর ভাজা মশলা দিয়ে মাখা হত। আম ছাড়া আর একটা দারুণ জিনিস ছিল - কয়েৎবেল মাখা। কয়েৎবেল ভেঙে ভিতরটা যদি কালো পাওয়া যায়, মানে রসস্থ পাকা ফল, তাহলে তো কেল্লা ফতে। সর্ষের তেল, নুন, চিনি, ঝিরিঝিরি কাঁচা লঙ্কা কুচি দিয়ে খুব ভালো ভাবে মাখতে হত, যাতে চিনি গলে যায়। এখন সুগার ফ্রি মিশিয়ে সেই স্বাদ জমে না। হা-হুতাশ করতে হয়।
মা রকমারি সরবৎ বানাতে পারত। দেশি লেমোনেড – লেবু চিনির সরবৎ তো ছিলই, এছাড়া কাঁচা আমপোড়া সরবৎ, পাকা আমের ভাজা মশলা দেওয়া সরবৎ, রোজ সিরাপ মিশিয়ে তরমুজের সরবৎ, মিষ্টি দইয়ের ঘোল, টক দই আর পুদিনার সরবৎ - এইসব। হাতিবাগানে সিনেমা দেখতে গেলে, বাবা একটা দোকানে গুঁড়ো বরফ দেওয়া আম আর দইয়ের সরবৎ খাওয়াত। আর ধর্মতলায় গেলে প্যারামাউন্টের সরবতের ভাণ্ডার তো ছিলই। সর্দি-কাশি হলে মা মিছরি, গোলমরিচ, তেজপাতা আর আদা ফুটিয়ে, গরম সরবৎ বানিয়ে, কাপে করে নিয়ে এসে বলত, খেয়ে নে। গলায় খুব আরাম হত।
ছোটবেলায় সবারই মাঝে মাঝে জ্বর হয়, আমাদেরও হত। জ্বর হলে খুব বিধিনিষেধ মেনে চলতে হত। চান করা যাবে না। ঈষদুষ্ণ জলে গা মুছতে হবে। জ্বর বাড়লে মা মাথা ধুইয়ে দিত। দুধে ফুটিয়ে দু’বেলা রবিনসন বার্লি গিলতে হত। ভাতের জন্য প্রাণ আকুলি বিকুলি করলেও, ভাত পাওয়া যাবে না। জ্বরে নাকি রুটি খেতে হয়। বয়স বাড়তে জানলাম, এগুলো ওভাবে অত না মানলেও চলত। আর একটা নিয়ম ছিল, জ্বর যেদিন ছাড়বে, মানে যেদিন চান করে প্রথম ভাত খাবো, সেদিন দুপুরে ঘুমনো যাবে না। অথচ, সেদিন মাথায় তেল-জল আর পেটে ভাত পড়ে দুপুরে পাগলপারা ঘুম পেত। পাশে সব নাক ডাকাচ্ছে, আর জ্বর থেকে ভালো হওয়া রুগি ড্যাবডেবিয়ে বসে আছে - উফফ, কী অত্যাচার! ভাবলে এখনও গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তবে জ্বর থেকে ওঠার পর মা পাতলা মাছের ঝোলভাত দিত, খুব ভালো লাগত। বড় হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী যাদু করতে বলো তো মা? মা হেসে বলেছিল, ঝোলে তখন ঘি আর গোটা গোলমরিচ ফোড়ন দিতাম। ওতে অরুচি কাটে। আর বাড়িতে কারোর অরুচি হলে, মেথি শাক রান্না করবি, দেখবি ভালো হয়ে যাবে। একবার বাবা ওরকম জ্বর থেকে উঠেছিল। আমি সাধ্যমত গুছিয়ে খেতে বেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু জ্বোরো রুগির মুখ তো – বাবা তেমন কিছু খেতে পারেনি। মা বুঝিয়ে বলেছিল, এটা আমার খেতে দেওয়ার ভুল। রুগিকে স্বাভাবিক পরিমাণে খেতে দিতে নেই। থালায় অল্প করে বাড়তে হয়। তাতে পুরোটা খেতে পারলে, সে খুশি হবে। আর থালার খাবার পড়ে থাকলে, সে একই পরিমাণ খেয়ে ভাববে, কিছুই খেতে পারলাম না। যে রান্না করে আর খেতে দেয়, তাকে শুধু রান্না জানলে চলে না, যে খায়, তার মন বুঝতে হয়। আর রুগিকে এমনভাবে কৌশলে খেতে দিতে হয়, যাতে তার মনোবল বাড়ে।
মা খুব সুন্দর সুর করে আদ্যাস্তোত্র পাঠ করত। স্নান করে, কোঁকড়া চুলে গামছা জড়িয়ে স্তোত্র পাঠ করতে করতে মা রোজকার পুজোর যোগাড় করত। শিবরাত্রি আর ফলহারিণী কালীপুজোয় মা উপোস করত। কিন্তু নির্জলা উপোস পারত না। ফল, মিষ্টি আর পুজোর পরে উপোস ভাঙলে খেত সাবুর খিচুড়ি বা সাবু মাখা। কখনো বা সাবু সেদ্ধ। আমরাও তার ভাগ পেতাম। ছোটদানা সাবু ভিজিয়ে তাতে পরিমাণ মত দুধ, আম, কলা, বেদানা এবং অন্যান্য ফলের টুকরো একটু মিষ্টি দিয়ে মিশিয়ে খেতে খুব ভালো লাগত। আর সাবু সেদ্ধ হলেও পছন্দ করতাম। বড়দানা সাবু একটা মাঝারি পাত্রে জল দিয়ে ফোটাতে হবে আর সমানে নাড়তে হবে। নুন মিষ্টি দিতে হবে। সেদ্ধ হয়ে গেলে ঢেকে রেখে ঠান্ডা করতে হবে। সাবু ঠান্ডা হলে ঘন হয়ে স্বচ্ছ জেলির মত পাত্রের মধ্যে বসে যাবে। তখন চামচে কেটে কেটে খেতে হবে। আমার এই খাবারটার ওপরে বাড়তি আগ্রহ ছিল, কারণ মা আমার বাটিতে এই সাবুর জেলির ওপরে বড় বড় দু'চামচ চিনি দিয়ে দিত। ঐ চিনির লোভে সাবু সেদ্ধ আরও স্বাদু হয়ে উঠত। আর সাবুর খিচুড়ি হলে, কড়ায় থাকা অবস্থাতেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, মা কখন বেড়ে দেবে। ছোটোদানা সাবু আগে ভিজিয়ে রাখা হত। বড় টুকরো আলু, গাজর, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, বরবটি, বিন - হাতের কাছে যা থাকে - তেমন আনাজ নিয়ে তেলে নেড়ে হাল্কা ভাপিয়ে রাখতে হবে। এবারে মুগের ডাল ভেজে আনাজ সমেত সেদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর কড়ায় জিরে, লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আদাবাটা, টমেটো কুচি, হলুদ, ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, নুন, মিষ্টি দিয়ে মশলা কষতে হবে। কষা হয়ে গেলে কড়ায় ডাল ঢেলে দিতে হবে আর ভেজানো সাবুটাও ঢেলে দিতে হবে। নাড়তে হবে, সাবু যাতে বসে না যায়, আর সাবু ঘন হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে বলে, জলের পরিমাণটা নজরে রাখতে হবে। জল কম হলে চলবে না।
সরস্বতী পুজোর সময়ে অনেক বাড়িতেই গোটা সেদ্ধ হত। প্রতিবেশীরা দিত অনেক সময়ে। মা গোটা সেদ্ধ খেতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু নিজে কখনও করত না। মাকে করতে বললে বলত, আমাদের গোটার নিয়ম নেই। যে বছর কেউ দিত না, সে বছর খুব হা-হুতাশ করত। মাকে বোঝাতাম, নিয়মের কি আছে? ভালো লাগলে করতে ক্ষতি কি? আজ আমি ছোটো বেগুন, শিম, রাঙাআলু, কড়াইশুঁটি, টক পালং আর গোটা মুগ দিয়ে গোটা সেদ্ধ বানাতে শিখেছি। কিন্তু সেটা চেখে দেখার জন্য মা আজ আর বেঁচে নেই।
ইস্কুলের দিন সকালে জলখাবার ছিল পাঁউরুটি টোস্ট আর আলু-চচ্চড়ি। টিফিনেও তাই নিতাম। সঙ্গে আমার আর বোনের জন্য ভাগ করে একটা ডিমসেদ্ধ হাফ হাফ। আর কোনোদিন পাঁউরুটির কাগজে মুড়ে একটা রসগোল্লা। সকালে মা খুব তাড়াহুড়ো করে রান্না সারত। বাবা টিফিন গুছিয়ে দিত। পাঁউরুটি ছাড়া অন্য কিছু করে দেওয়ার উপায় বা সময় কোনোটাই ছিল না। বছরের পর বছর পাঁউরুটি খেয়ে আমি ঠিক করেছিলাম, পৃথিবী থেকে পাঁউরুটি ধ্বংস করব। কিন্তু তা আর হল কই। কিছুদিন আগে, বুড়ো বয়সে, ইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে শুনি, যে রোজ রুটি আর ঢেঁড়স ভাজা আনত, সে বলে, তুই কি সুন্দর পাঁউরুটি আনতিস। একজন বলে, আমার ঠাকুমা বই খাতার সঙ্গে ডিম নিতে দিত না, আর তুই রোজ হাফ ডিম আনতিস, আমার খুব রাগ হত। পাকা চুলে কলপ করা বুড়িরা হেসে কুটিপাটি হই। ইস্কুল শেষ হবার তিরিশ বছর পরে সকলে জানতে পারলাম, টিফিন নিয়ে যার যার নিজের কষ্ট ছিল। যাই হোক, ছুটির দিন রুটি, লুচি, পরোটা সব কিছুই হত। আর মাঝে মাঝে গোলা রুটি হত। আলুভাজা, মোটা লম্বা, ঝিরিঝিরি, কাঠি কাঠি, ডুমো ডুমো, গোল গোল সবরকম হত। পটলভাজা, গোল গোল বেগুন ভাজা, ঝিরিঝিরি ঢেঁড়স ভাজা, কপিভাজাও হত। মাঝে মাঝে মোটা করে খোসা ছাড়িয়ে আলুর খোসা ভাজা হত। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল, যখন মা ডুমো আলু অল্প ভাপিয়ে সাদা তেলে নুন মরিচ দিয়ে কষে দিত। শীতকালে এতে ফুলকপির টুকরো আর কড়াইশুঁটি পড়ত। এই রান্নাটার নাম আলু-মরিচ। তবে মা যতই করুক, আমার দেখা জলখাবারের রানী ছিল আমার একমাত্র পিসিমণি।
আমরা যেমন পাতিপুকুরে থাকতাম, আমার একমাত্র পিসি থাকত দত্তবাগানে। সে বাড়িতে চন্দনা ছিল। আমি আর বোন পিসির কাছ থেকে ধানের শিষ নিয়ে তাকে খাওয়াতাম। পিসি লক্ষ্মী ঘিয়ে লুচি ভাজত। সেই লুচি ভাজার গন্ধ ছিল পিসির বাড়ির গন্ধ। আর বড়দের মত আমাদেরও একইরকম ভাবে বাটি বাটি করে তরকারি, বোঁটা সমেত বেগুনভাজা, মিষ্টি সাজিয়ে দিত। বড় ছোট আলাদা করত না। এটা ছিল একটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার। বাড়িতে বাবা মাকে ভয় করতাম। কিন্তু পিসির সামনে বাবা মা জবুথবু। যতই দৌরাত্ম্য করি, কেউ কিছু বলতে পারত না। বকার চেষ্টা করলেই পিসি কড়া ধমক দিত বাবা মাকে। এই ব্যাপারটা দারুণ লাগত, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম। শীতের শুরুতে মাঝে মাঝে ঐ আবাসনে নীচ থেকে হাঁক শোনা যেত – টু-ম্পা, ঝু-ম্পা! আর জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালেই মনটা নেচে উঠত। দেখতাম অনেক ব্যাগ নিয়ে, দশাসই পিসিমণি সাইকেল রিক্সায় বসে আছে। আমরা তিনতলার কোয়ার্টার থেকে ছুট্টে নিচে গিয়ে ব্যাগগুলো ধরলে পিসি রিক্সা থেকে নামত। ঘরে এসে সেই ব্যাগ থেকে থরে থরে বেরোত – তুলতুলে দুধপুলি, নারকেল, গুড়ের পাক ভরা সেদ্ধ পুলি, সরুচাকলি, পাটিসাপটা দু’রকম – একটা চিকণ, অন্যটা ক্ষীরের মধ্যে ভাসমান। সেদ্ধ পুলিটা ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য আড়বেলে স্পেশাল মৌঝোলা গুড়। বাবা পাটিসাপটা খেতে ভালোবাসত, আমার আর মায়ের প্রিয় ছিল রসবড়া। চিনির রসে টোপা টোপা দেবভোগ্য রসবড়া ভাসত। পড়তে পেত না, সব খেয়ে ফেলতাম। আর তারপরে দু’তিন দিন প্রাতরাশ হত পুলি দিয়ে। পিসি চলে যাওয়ার পর পিঠে-পুলিও গল্প হয়ে গেল। পিসির মুখে হিমালয় কোম্পানির স্নো, তার সঙ্গে পাউডার আর ঘামের গন্ধ মিশে একটা ছোটবেলার গন্ধ ছিল। ঐ গন্ধটা আজকাল মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসে।
বারাসাতে তখন সদ্য পৌর-জনবসতির সলতে পাকানো চলছে। পিসিমনাই ছিল করিতকর্মা মানুষ। বারাসাতে ধীরে ধীরে পিসিমনাই একটা বড় বাড়ি করল। সে বাড়িতে বাগান ছিল, বাঁধানো ঘাটওলা পুকুর ছিল। পুকুরের ঘাটের দু’পাশে লাল সিমেন্টের বসার জায়গা করা ছিল। চারিদিকে ফাঁকা মাঠ। দূরে ধানজমি আর হু হু হাওয়া। চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে পিসি পুজো করত, আমরা চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। আমাদের সব জায়গায় ছিল অবাধ গতিবিধি। চানঘরে বড় চৌবাচ্চা ছিল। আমরা দু’ বোন পুকুরের মত চৌবাচ্চায় একসঙ্গে নামতাম স্নান করতে। দু’জন দু’জনকে জল ছুঁড়তাম, ভীষণ মজা হত। আড়বেলেতেও মেজজেঠুদের চৌবাচ্চা ছিল। কিন্তু সেটায় একজন করে নামা যেত। পিসির বাড়িতে যখন থাকতাম, বাবা ওখান থেকে অফিস করত। ফিরতে অনেক রাত হত। একবার মাথায় রোখ চাপল, পিসির বাগানে গাছ লাগাব। বাবাকে বলে দিলাম, বাবা অফিস থেকে গাছ আনবে, আমি পুঁতব। রাত অবধি চোখ-ভরা ঘুম তাড়িয়ে বসে ছিলাম – বাবা কখন আসবে। বাবা ফিরলে দেখলাম গাছ আনেনি। ব্যস, শুরু হল কান্না। হঠাৎ দেখি, হারিকেন আর খুরপি হাতে পিসি আসছে, বাগান থেকে। হাতে দু’টো গাছের চারা। নিজের বাগানের দু’টো গাছ কুপিয়ে তুলে ফেলেছে, আমরা লাগাব বলে। বাবার বিরক্তি, বকুনিকে দশ গোল দিয়ে, দু’টো গাছ আমরা পুঁতে দিলাম। মানে আমরা ছুঁয়েছিলাম, পিসি পুঁতে দিল। আর গাছদু’টোর নামকরণও হয়ে গেল – টুম্পার গাছ আর ঝুমুর গাছ। আমার গাছটা ছিল মৌরি গাছ। সে গাছ বড় হয়ে ফল ধরেছিল। মিষ্টি মিষ্টি কচি সবুজ মৌরি তুলে খেয়েছিলাম। আজ স্বপ্নের মধ্যে সেই মৌরির স্বাদ ফিরে আসে। ছুটির দিন দুপুর বেলা সেই পুকুর ঘাটে বাবা ডলে ডলে সর্ষের তেল মাখাত, মাথায় এক আঁজলা নারকেল তেল দিয়ে দিত, খেতে বসার সময়ে রগ দিয়ে তেল গড়াত। বড় বাড়ি ধুয়ে মুছে রান্না বসাতে পিসির দেরি হয়ে যেত। মাংস সেদ্ধ হয়নি, এদিকে আমাদের খিদে পেয়ে গেছে। পিছনের টানা দালানে আসন পেতে বসে পড়তাম, পিসিমনাই বলে দিত, খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বল, আমাদের ভাত দাও, মাংস দাও। আমরাও যথাসাধ্য নির্দেশ পালন করতাম। তার পরেই ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা আর অন্য থালায় অনেক বাটি সাজিয়ে পিসির প্রবেশ ঘটত। আর বড়দের যতগুলো বাটি, আমাদের দু’বোনকেও ততগুলো বাটি সাজিয়ে দিত। পিসি কোনদিন কোলে নিয়ে সোনামনা বলে আদর করেনি। বাবা মাকে কড়া শাসনে রেখে, আমাদের সর্ববিধ প্রশ্রয় দেওয়াটাই ছিল পিসির আদর। সে আদর শেষ হল, ক্লাস এইটে। আমরা স্কুল থেকে মায়ের সঙ্গে আর. জি. কর হাসপাতালে গিয়ে দেখি দাপুটে পিসি শুয়ে আছে নিশ্চুপ। এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তবু একবারও ডাকেনা – টুম্পা ঝুম্পা এলি! নাকে নিশ্বাস পড়ে না। আরও কিছুদিন থেকে গেলে কি এমন ক্ষতি ছিল? যেবার টুসি সিনেমা এসেছিল হলে, সে বছর পিসি আমাকে আর বোনকে টুসি জামা কিনে দিয়েছিল, লেসের ফ্রিল দেওয়া। আমার হলুদ আর বোনের নীল। পুজোয় গান বাজছিল, তোমার নীল দোপাটি চোখ আর শ্বেত দোপাটি হাসি। পিসি গম্ভীর ছিল, বড় একটা হাসত না। আড়বালিয়ায় পুজো হলে, পিসি সব প্রসাদ ভাগ করত। দিদির ওপরে বাবা, বা জেঠুদের কোনো কথাই চলত না। আমি একবার দাদাদের সঙ্গে ভিড়ে, শয়তানি করে ফাঁকা মিষ্টির বাক্স ঢিল পাটকেল পুরে, গার্ডার লাগিয়ে সুন্দর করে পিসিকে দিলাম – যেন মিষ্টিটা একপাশে পড়ে আছে, কেউ দেখেনি। পিসি নির্বিকার বাক্সটা নিল, আর আমাদের সামনেই ফেলে দিয়ে মুচকি হাসল। আমরা হাসি দেখব কী, তখন সব একছুটে পগার পার। আমার মা বলত, দিদির যা বুদ্ধি আর স্মরণশক্তি, লেখাপড়া করার সুযোগ পেলে জজ ব্যারিস্টার হত।