১৪
দুর্গাপুজো মিটতে মিটতে লক্ষ্মীপুজোও এসে গেল হুট করে। আজ বাদ কাল পুজো। দেওরের সঙ্গে আজ দুপুরে অনেকক্ষণ কনফারেন্স কলে কথা হল। সেই আলাপ থেকেই কয়েকটা অদ্ভুত খবর ভেসে এল আমাদের মুঠোফোনে। এই লকডাউনের মধ্যেই নাকি পুজোর মৌতাতে কাঁথি এগরা মিলিয়ে বেশ কিছু কিশোরী বাড়ি থেকে পালিয়েছে। পুলিশ হন্যে। মেয়েগুলি নাবালিকা এবং তাদের সংখ্যা কুড়ির ওপরে। দেওরের মুখে শুনলাম এটাই হালের ট্রেন্ড। পুজো পার্বণের হিড়িকে, ঠাকুর দেখা, বন্ধুর বাড়ি যাওয়া এমন নানা অজুহাতে আইবুড়ো মেয়েরা ঘর ছাড়ে। এ বয়সে প্রেমের টান বেশি, আর পণের সমস্যা থেকে পরিবারকে মুক্তি দেওয়াও হয়তো একটা উদ্দেশ্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল, আবার কতজন এই লকডাউনের ভিতরেও আড়কাঠির হাতে পড়ল কে জানে!
দ্বিতীয় খবরটাও ভালো নয়। রথের সময়ে আমাদের খরখরি পুতুল পিসির হবু বৌমা সেই যে পাত্রী দিদিকে দেখেছিলাম, সে বাড়ি ছেড়ে পরিচিতদের সাহায্য নিয়ে এখন একটা অন্য জায়গায় আছে। কিন্তু হঠাৎ হল কী? দেওরের কাছে যা শুনলাম, তাতে চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। আমাদের এলাকায় নাকি বিবাহযোগ্য পাত্রী অমিল, তাই হবু কনেদের বিরাট চাহিদা। সেই সুযোগে গ্রামে লকডাউনের আগে থেকেই বিয়ে দেওয়ার উটকো কোম্পানি এসে বসেছে। পাত্রী পিছু হাজার টাকা গুণে দিলে একটি করে মেয়ে দেখানো হয়। আমাদের বাড়িতে পুজোয় কাজ করে পারিয়া। তার বড় ছেলে বলুর জন্যেও নাকি কষ্টে সৃষ্টে হাজার টাকা জমা দিয়েছিল। কোম্পানি বলুর মায়ের বয়সী এক পাত্রী দেখিয়েছে। বিয়ে হয়ে গেলে আরও পঁচিশ হাজার জমা দিতে হবে পাত্রপক্ষকে। পারিয়ার রক্ত জল করা খাটুনির পয়সা এইভাবে উড়ো কোম্পানি আত্মসাৎ করবে! এসব খবর শুনে আমি আর কর্তা দুজনেই থ। কিন্তু তাতে পাত্রীদিদির সমস্যা হবার কথা নয়। তার বন্ধন তো পাকা। কিন্তু ও বাবা! এক দোজবরে প্রৌঢ় তাঁর দুই সন্তানের মা হিসেবে পাত্রীদিদিকে মনে মনে নির্বাচন করে বসে আছেন এবং তার বাবাকে মানানোর জন্য লকডাউনের ভিতরেই নোটের গোছা দিয়ে গেছেন। জানতে পেরে মেয়েটি বাড়ি ছেড়েছে। হায় রে কপাল, যুগ যুগ ধরে মেয়েদের মনের খবর উপেক্ষা করে, সম্পদই জিতে এসেছে। এবারটায় চাকা উলটো দিকে ঘুরবে কিনা তা বলবে ভবিষ্যৎ।
পরের খবরটা আবার ভয়ানক রকম চমকপ্রদ। লকডাউনে গ্রামে নাকি চারিদিকে গজাড় জঙ্গল ডালপালা মেলেছে। আর সেই সুযোগে হানা দিয়েছে বুনো শুয়োরের দল। কয়েকজনকে জখমও করেছে। একথা সত্যি যে আমাদের বাড়ির পিছনের জমিও পরিষ্কার হয়নি আজ দুবছর। দেওরের কথায় জায়গাটা আর কিছুদিন গেলেই অন্তত কঙ্গোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। সেখানেও কাচ্ছা বাচ্ছা নিয়ে থানা গেড়েছে বন্যবরাহেরা। প্রমাণ হিসেবে রাতের আঁধারে দেবরের চলন্ত বাইক থেকে তোলা একটি ফটোগ্রাফও দেখলাম। ছবিটা আবছা মত হলেও সেখানে বরাহ বাছাদের নিয়ে বাবা মায়ের দলকে বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার আর বড়দের বাঁকানো দুটি করে দাঁতও বড় স্পষ্ট। ছবি দেখে আমার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। আমরা না হয় সারাবছর বাড়ি থাকিনা, এলাকার মানুষ তো তা নয়। গ্রামে অসুখ এখনও তেমন ছড়ায়নি। সকলে বাড়ি বসে আছে। নিজেদের জমিগুলো পরিষ্কার করেনা কেন? দেওরের বক্তব্য বিনা পয়সায় চাল গম পেয়ে গাঁয়ের মানুষকে কুঁড়েমিতে ধরেছে। পরিশ্রম না করে জুটে যাচ্ছে যখন, খাটাখাটনি পোষাচ্ছেনা। যা হোক, বনদপ্তরকে খবর দেওয়া হয়েছে, তারা চেষ্টাও করছে বিস্তর। কিন্তু বরাহের দল বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দেবেনা পণ করে, গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। খবর শুনে আমার তো আজ রান্না করা মাথায় উঠল। রুনাদা আছে। বয়েস হচ্ছে। রাতবিরেতে অকুতোভয় বেরিয়ে পড়াটাই ওর অভ্যেস। রাতে মাছ ধরা জাল পাতে। জমি টহল দেয়। কী হবে রুনাদার? এই করোনার জন্য আজকাল একটুতেই ভীষণ উদ্বেগ হয় আমার। উদ্বেগ ভোলার জন্য ওম মন্ত্র মনে মনে বলতে বলতে হাতে কাজ করে যাই। মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করি। বাজারের মাসি আজ দুধমানের পাতা দিয়ে গেছে বাড়িতে। হাওড়ায় আমার সহকর্মীরা এই দুধমান পাতা খুব খায়। এই পাতায় মুড়ে ওরা চিংড়ি ভাপা করে। পাতা সমেত খায়। এর ব্যবহার আমার বাপের বাড়িতে কখনোই হতনা। কিন্তু এখন শুনে শুনে আমারও ইচ্ছে হয়েছে রান্না করার। হাওড়ার শিবপুরে পুরোন বাজারগুলোতে অনেককিছুই পাওয়া যায়, আমরা সবসময়ে খেয়াল করিনা। এই যেমন গেঁড়ি গুগলির পাশেই ঝিনুকের মাংসও বিক্রি হয়। আমি ওটাও খেতে জানতাম না। কিন্তু এখন শিখে গেছি। ঝিনুকের মাংস প্রথমে ভাপিয়ে নিয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হয়। তারপর কড়ায় মশলা কষে তেল ছেড়ে গেলে ঝিনুক দিয়ে দিতে হয়। বেশ মাখামাখা গরগরে পাঁঠার মাংসের কিমার মতোই দেখতে লাগে, খেতেও সুস্বাদু।
দুপুরে খেতে খেতে কর্তার সঙ্গে তুমুল আলোচনা চলতে লাগল। বঙ্গদেশে পাত্রী তো প্রচুর, কিন্তু তাদের উপযুক্ত পাত্র অমিল হয় - চিরকাল এটাই শুনে এসেছি। এখন হঠাৎ এই উল্টো পুরান কীভাবে হল! কর্তার কথাটাও ফেলে দেবার মত নয়। তার বক্তব্য,
- পাত্রী অমিল, মেয়ে অমিল তো বলেনি। গ্রাম দেশে বেশিরভাগ সব ষোল থেকে কুড়ির মধ্যে পাত্রী খোঁজে। মধ্যবিত্ত বা শিক্ষা সচেতন নিম্নবিত্তের ঘরে ঐ বয়সের মেয়েরা আর বিয়ের পিঁড়িতে বসছেনা। নানান স্কলারশিপের বাঁধনে বন্দী হয়ে তারা পড়াশোনা করছে।
- সে তো খুব ভালো কথা। জন্ম জন্ম যেন এই বয়সী মেয়েদের হবু বরেরা আইবুড়ো নাম ঘোচাতে না পারে।
- তা সে তোমার দেওয়া এই অভিশাপ ফলে যেতেও পারে। আমাদের ছোট বয়সে দেখেছি, সম্পন্ন ঘরে ছেলে ইস্কুলে ভর্তি হলে, বাবা, কাকা, দাদু সব আদিখ্যেতা করে তাদের ইস্কুলে দিতে আবার নিতে আসত। মেয়েদের কেউ তেমন পুঁছতনা। কিন্তু এখন দিন বদলাচ্ছে। মৈতনা গার্লস স্কুলের সামনে শহরের মত মায়েরা বসে থাকে। মেয়েদের সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যায়।
একথা শুনে চট করে মনটা ভালো হয়ে যায়। আজ ইস্কুল বন্ধ তো কী? একদিন লকডাউন কাটবে, ইস্কুল ও খুলবে। দৃষ্টিভঙ্গি এমন হলে স্কুলছুট কমবে। কিন্তু মুদ্রার অন্যপিঠটা! বিপুল সংখ্যক মেয়ে যে প্রেমিকের হাত ধরে, বিয়ের ফাঁদে ঘর ছাড়ছে, ওদের কী হবে? এমন ধারা ঘটনা তো কম দেখলাম না বিয়ের পর। আচ্ছা, এই পুজোয় যে মেয়েগুলো পালালো, তাদের সঙ্গী ছেলেগুলো কি স্থানীয় নাকি অন্য জায়গা থেকে মেয়ে পটাতে আসা দুষ্টু লোক, যারা মেয়েগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে? মনের মধ্যে কাঁটা খচখচ করে। বিকেলে আবার দেওরকে ফোনে ধরি।
- হ্যাঁ রে তপু, বিয়ের পাত্রী কম নাকি মেয়ে কম, কোনটা একটু খোলসা করে বল দেখি।
- দুটোই। পঞ্চায়েত থেকে নানান প্রকল্পে কাজ করতে করতে এলাকার লোক যা গোনা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে একশোর মধ্যে যদি একান্নটা ছেলে হয় তো ঊনপঞ্চাশটা মেয়ে। কিন্তু এতকাল তো মেয়েই একটা দুটো বেশি থাকত - তাই আমরা অবাক হয়ে গেছি।
ভারি আশ্চর্য। এখানকার কোন মেয়ে বসে থাকেনা। ঘরের কাজের সঙ্গে মাঠে কাজ করে, কাজু বাদামের বিচি থেকে শাঁস ছাড়ায়, বিড়ি বাঁধে। সরকারি ভাতাও পাচ্ছে। একটু সম্পন্ন ঘরে পরিচারিকা বা রান্নার কাজও করছে। আবার শ্বশুরবাড়িতে বরের মার খাচ্ছে, অভিভাবকদের বকুনি খাচ্ছে - এমন অল ইন ওয়ান উপযোগী প্রাণী যার ঘরে থাকবে তার লাভ। মেয়ে কমার তো কথা নয়। পড়াশোনা জানা ঘরে মেয়েরা কেউ কেউ শিক্ষিকা হয়, কিন্তু বেশিরভাগ নার্সিং পড়ে। বোধ করি সারা দেশে এখানকার নার্স আছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে টপ করে একটা চিন্তা আসে। মেয়ে কমেছে না কি ছেলে বেড়েছে? যেসব পুরুষ পাকাপাকি ভাবে ভিনরাজ্যে বসতি করেছিল, সেই পরবাসীরা এই লকডাউনে তো অনেকেই ফিরে এসেছে। এখানেই কাজের চেষ্টা করছে। কিন্তু সিস্টারদের বিরাট চাহিদা। ভিনরাজ্যে আছে এমন মেয়েগুলি তো ফেরেনি। এমন হলে তো চিন্তার কিছু নেই। কর্তার কানে তুললাম কথাটা। সে মানতে চাইলনা। উল্টে আমাকে বলল,
- সকলকে নিজের মত ভেবো না। নিজে তো মেয়ে মেয়ে করে মশগুল হয়ে আছ। গ্রামে সবাই ছেলে চায়। আমার বন্ধুদের সব সাত আটটা করে দিদি। ছেলের আশায় পরপর মেয়ে জন্মে গেছে। এখন তো আর সেদিন নেই। সব এক সন্তান। তাই বাবা মায়েরা ভাবতে পারে এক সন্তান, ছেলে সন্তান হবে।
- ভাবলেই তো আর হবেনা, এতো লটারি।
- সব জেনে শুনে ন্যাকা হয়োনা। চারিদিকে গর্ভপাতের ক্লিনিক।
মেয়ের বাবার কথা শুনে চমকে উঠি। এসব গ্রামে অবৈধ সম্পর্ক আর গর্ভপাত যে জলভাত সে তো জানি। কিন্তু এখানে তার মানে বৈধ দম্পতিরা …..। কী জানি কেন হু হু করে কান্না এসে যায় আমার। কিন্তু বাড়িতে কিছু ঘটেনি, হঠাৎ কাঁদতে বসলে বাড়ির লোক ভাববে কী? তাড়াতাড়ি কলঘরে গিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি। এত মুড সুয়িং হচ্ছে আমার, খুব মুশকিলে পড়ে যাচ্ছি। বয়সটা অর্ধ শতকের কোঠায়। দ্বিতীয় কৈশোরে প্রবেশটা এবার ভালোই মালুম দিচ্ছে। নাকি লকডাউনে ঘরে বসে বসে অবসাদ গ্রাস করছে আমাকে। প্রাণপণে লক্ষ্মীপুজোর মনোরম স্মৃতিগুলি হাতড়াতে থাকি। মন্দ কথাগুলিকে চাপা দিয়ে মনের মধ্যে যেন একটা সিনেমা চলতে থাকে।
দুর্গা পুজোয় শ্বশুরবাড়ি গেলে আমরা সচরাচর লক্ষ্মী পুজো করে তার পরে শহর ঘরে ফিরি। আমাদের দুর্গাদালানে দুর্গাপুজো হয়, তবে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয় লাগোয়া গোপীনাথের মন্দিরে। কোনো মূর্তি থাকেনা। কারণ সিংহাসনে বেতের চুবড়ি, কড়ি, ঘট, পেতলের ডাব লক্ষীদেবীর প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে। বাপের বাড়িতে জানতাম ঘটি বাড়িতে কোজাগরী পুজো হয়না, ওটা পূর্ববঙ্গীয়দের পুজো। আর শ্বশুরবাড়িতে দেখলাম বাপের বাড়ির মতো বছরে চারবার লক্ষ্মীপুজো তো হয়ই, তবে কোজাগরী পুজোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাপের বাড়ি আড়বালিয়ায় সেই কালীপুজোয় লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে এই পুজোর তফাত আছে। ওখানে আমি ছিলাম আহ্লাদী মেয়ে, যার প্রধান কাজ ছিল প্রসাদ খাওয়া আর আবার খাওয়ার জন্য ছুঁক ছুঁক করা। কিন্তু এখানে আমি গিন্নি বান্নি - তাই কী আর করা - পেটে খিদে মুখে লাজ করে চলা ছাড়া উপায়ই বা কী!
আমাদের পুরোনো মন্দির তো, তাই অনেক প্রাচীন প্রথা আছে। এলাকায় যত বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়, সেই বাড়ির সদস্যরা আমাদের সদর পুকুরে ঘট তুলে, ঢাক কাঁসর বাজাতে বাজাতে গোপীনাথের মন্দিরে আসেন। আর পান সুপুরি দিয়ে গোপীনাথকে তাঁদের পুজোতে নিমন্ত্রণ করে যান। এই এলাকায় পান আর কাজু চাষ অর্থনৈতিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে পান খাওয়ার নেশাও প্রবল। এ অঞ্চলে যত কাজু কারখানা আছে, সেখান থেকে প্রসেসিংয়ের সময়ে যে ভাঙা কাজু বেরোয়, সেটার বাটা পোস্ত বাটার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়। দামের দিক থেকে পোস্তর তুলনায় এই ভাঙ্গা কাজু, কিছুটা হলেও সস্তা পড়ে। তবে আমার মনে হয়, পড়শি জেলার লোকেরা তো ভাঙা কাজুর এমন ব্যবহার জানেনা, তাই চাহিদা সীমিত থাকে। অন্যেরা জানতে পারলে এই সুবিধাটুকু ঘুচবে। এখানে দৈনন্দিন খাবারে ভাজা কাজুর ব্যবহার আবার কাঁচা কাজু দিয়ে শাকভাজা, চাটনি এগুলো খুব প্রচলিত। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই শাশুড়ি শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে সব রকম সব্জি আর শাক দিয়ে করা নিরামিষ ঘন্ট, কাজুবাটা, কীভাবে ঘন দুধ আর ঘি পড়লে, ভোগের লাবড়া হয়ে যায়। শাশুড়ি মা আজ না থাকলে কী হবে, লক্ষ্মীপুজোর ভোগ রান্নায় সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। আর নাড়ু, মুড়কি, বাতাসা, সন্দেশ আর ফল প্রসাদের সঙ্গে একটি খাবার দিতেই হবে - সেটা হল তালের ফোঁপল। এদিক থেকে বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির মিল। দুপুরের খাওয়ায় লাবড়ার সঙ্গে খিচুড়ি আর পায়েস হয়। আমার ইচ্ছে কোন কোন বার নিরামিষ পোলাও হোক। এদিকে ঠাকুর ঘরের রান্নার বৌ কজনের পোলাও রান্নায় হাত পাকেনি। তাই ওরা সাহস পায়না। আর পুজোর দিনে রুনাদার দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দেখি লকডাউনটা যাক, এবারে আমিই একবার চেষ্টা করব। আসলে এতজনের রান্না একাহাতে করিনা তো, ভয় লাগে। রাতের প্রসাদ লুচি আলুরদম। এই আলুরদম প্রসঙ্গে একটা কথা বলার আছে আমার। আমি বাগবাজারের গলিতে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি থেকে শালপাতায় লাল লাল আলুর দম খাওয়া মেয়ে। এখানকার নারকেলের দুধ আর নারকেল বাটা দিয়ে সাদাটে মিষ্টি মিষ্টি আলুরদম খেতে ভালো লাগেনা। আমি ছোট আলুর দম খুব পছন্দ করি, ঠিক যেমন ছোট বেলায় কাঠি ফুটিয়ে খেতাম, সেই রকম। প্রথমে খুব অল্প সর্ষের তেলে গোটা জিরে, গোল মরিচ, গোটা গরম মশলা, কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা আর আদার টুকরো ভেজে নিই, এরপর তাতে নাড়াচাড়া করি লাল টমেটো। এবারে সব ভাজা মশলা একসঙ্গে মিক্সিতে বেটে নিই। টমেটো থাকার জন্য মিক্সিতে আলাদা করে খুব একটা জল দিতে হয়না। অল্প একটু জলের ছিটে দিলেই চলে। মশলা তৈরি। এবারে আলু ভাজার পালা। এমনিতে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে, তবে শীতকালের নতুন আলুতে খোসা ছাড়াইনা। খোসা সমেতই ভেজে ফেলি। কড়ায় আলু ভাজার ওপরেই হলুদ আর কাশ্মিরী লংকার গুঁড়ো দিয়ে দিলে লালচে রংটা খোলতাই হবে। তারপরে মশলাটা ঢেলে দিয়ে কষতে হবে, যাতে তেল ছেড়ে দেয়। কড়া খুব গরম হয়ে পুড়ে না যায়, তার জন্য মাঝে মাঝে একটু করে জল দিতে হবে। এই সময়ে খানিকটা ধনে গুঁড়োও দিয়ে দিই। সবার শেষে জিরে মরিচ আর ধনে ভাজার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া যায়। না দিলেও ক্ষতি নেই। শীতকাল হলে ধনে পাতা আর পুদিনা পাতা বাটা দেওয়া যায়। মানে এখন সব কালেই দেওয়া যায়, তবে গরম কালে সার দেওয়া বড় বড় পাতাগুলোর না থাকে স্বাদ না গন্ধ। তবে দুটো পাতার অনুপাত ঠিক রাখতে হবে, ধনে পাতা চার হলে পুদিনা পাতা এক, এইরকম মাপ হবে। ইচ্ছে হলে কসৌরি মেথিও দেওয়া যায়, তবে এটা দিলে ধনে পাতা, পুদিনা পাতা দেওয়া যাবেনা। শেষে কিছুটা চাট মশলা আর আমচুর পাউডার মিশিয়ে দিই মাঝে মাঝে। স্বাদটা আরও খোলতাই হয়।
সন্ধেবেলায় গোপীনাথের সঙ্গেই লক্ষ্মীদেবীর আরতি ও পুষ্পাঞ্জলি হয়। সকাল থেকে মন্দির ধুয়ে মুছে আল্পনার তোড়জোড় শুরু হয়, কারণ উপকূল এলাকা তো, বাতাসে আর্দ্রতা, চাল-পিটুলির আলপনা শুকোতে খুব দেরী হয়। কাজে কর্মে সন্ধে নামে। গাই বাছুর গোয়ালে ফিরে হাঁক ডাক করে - অবলা প্রাণী হলে কী হবে, বাড়িতে কী হছে না হচ্ছে - সব খবরই ওরা রাখে। প্রসাদ খাবার তাড়া ওদেরও কিছু কম নয়। আকাশ জুড়ে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমলিয়ে ওঠে। আমরা গা ধুয়ে, লাল পাড়ওলা শাড়ি পরে উঠোনে নামতে নামতে চাঁদটা পুবের ডোবার পাড় থেকে বড় আর হলুদ হয়ে টুপ করে উঠে পড়ে আর উঠেই একেবারে রকেটের মত মাঝ আকাশের দিকে ছুট দেয়। এই দেখলাম ঝোপের মাথায় তো ঐ আবার কাঁঠাল গাছের পাতার আড়ালে, শেষে একেবারে দেবদারু গাছের মাথায় চড়ে চুপচাপ মজা দেখে।
পুজো সমাপন হলে কচি কলাপাতায় ফলমূল, ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলসী মঞ্চের গোড়ায় পেতে চাঁদকে ডাকা হয় খেয়ে যাবার জন্য। লক্ষ্মী পুজোয় চাঁদকে নৈবেদ্য দেওয়া এই প্রাচীন প্রথাটি চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। মনে করা হয় যে শরৎকালের পূর্ণিমায় চন্দ্রদেবতা ষোলো কলায় পূর্ণ হলে অমৃত বর্ষণ করেন। অনেক বাড়িতে পায়েস দেওয়া হয় চাঁদকে। তাছাড়া শাশুড়ি মা বলতেন লক্ষ্মীঠাকুর সারা রাত ঘুরবেন, চাঁদ যদি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে আলো না দেন, তবে তো খুব মুশকিল হয়ে যাবে। চাঁদকে নৈবেদ্য দেওয়ার সময়ে তুলসী গাছকেও পুজো করা হয়। তুলসী নারায়ণের প্রতীক হিসেবে পুজো পান। সব শেষে পাঁচালি পড়া হয়। আড়বালিয়ায় মা পড়ত একেবারে নিখুঁত সুর করে, নাটকের মত ঘটনাগুলো চোখে ভেসে আসত। কিন্তু এখানে মন ঠাকুর পাঁচালি পড়তেন মন্দিরের ভিতর একা, কেউ মন দিয়ে শুনতোনা। শাশুড়ি মা পাঁচ জায়গায় প্রসাদ বিতরণে ব্যাস্ত হয়ে পড়তেন। এখন শাশুড়ি মা নেই আর মন ঠাকুরও নেই। কিন্তু আমি নিজে সকলকে বসিয়ে রেখে পাঁচালি পড়ি,খুব ভালো লাগে, কী জানি, মায়ের মত হয় কিনা। মনোরম স্মৃতির মাঝে কর্তব্য মনে আসে। কাল লক্ষ্মীপুজো। লকডাউনের বাজারে গ্রামে তো আর যাওয়া হলনা। এখানেই অল্প করে নাড়ু করব ভেবেছি। নারকেল কুরতে হবে। কিন্তু কাজে হাত দিতে গিয়ে মনের ব্যথাটা টনটনিয়ে ওঠে। শ্বশুরবাড়ির গ্রামীণ এলাকায় কাজু হোক, পান হোক কি ধান - সব চাষেই নারীশ্রম লাগে। হায় গো মা লক্ষ্মী, পেটের ভেতর লক্ষ্মী মারার চল ওখানে ছিলনা। যদিও প্রমাণ ছাড়া নির্দিষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল, মেয়ে যখন কমেছে, তখন কারণটা আজ না হোক কাল বেরিয়ে পড়বেই।
আঁকিলাম নিয়া পিটুলি গোলা।
আমি যেন পাই সোনার বালা।
সোনার বালারা ছড়াবে জেল্লা।
রচিবে শতেক সোনার কেল্লা।
নিজগুণে নাশে বিঘ্ন কমলা -
মান যশ আদি না হবে চপলা।
পদতলে ঠেলি গরলের ছালা,
শিখরে উঠিও বাংলার বালা।