জীবন বৈপরীত্যময়।
গ্রামীণ জীবনে এই বৈপরীত্য আশির দশক পর্যন্ত খুব স্পষ্ট এবং চেনা ছি। টিভির অনুপ্রবেশ এবং সবকিছুতেই পার্টি-- হাঁস মুরগির ঝগড়া থেকে স্বামী স্ত্রীর কোন্দল বা জমি জমা নিয়ে বচসা-- পার্টির অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি।
এর ভালো মন্দ দুইই ছিল।
মামলা মোকদ্দমা কম হতো।
আবার ন্যায়বিচারের বদলে পার্টিপন্থাও ছিল। নয়ের দশকে বাড়ল। নতুন শতাব্দীতে বেপরোয়া হয়ে গেল। কারণ এলাকায় এলাকায় পার্টি যাঁরা গড়েছিলেন তাঁরা অনেকেই বসে গেলেন অথবা তাঁদের তরুণ ছাত্র নেতারা পার্টি নেতা হয়ে কৃষক নেতাদের জায়গা নিয়ে নিলেন। শিল্পাঞ্চলেও ছাত্রনেতারা শ্রমিক নেতা এবং পার্টি নেতা দুইই বাড়ল। কমিউনিস্ট পার্টিসহ যেকোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে উপদল বা গোষ্ঠী কোন্দল একটা অতি পরিচিত ঘটনা। ছাত্র নেতাদের তেজ বেশি, গ্রুপ এবং গলার জোর দুটোই বেশি। তাঁরা কর্তৃত্ব করতে লাগলেন। এব তাঁরা নিজেদের ইয়েসম্যানদের বসাতে লাগলেন। পুরনো স্বাভাবিক নেতাদের দাপট কমল। গায়ের জোরে ছাত্র সংসদ দখল করা নেতারা বুকনি ও গ্রুপের জোরে নেতৃত্বে আসতে লাগলেন।
যে কথা শুরু করেছিলাম, গ্রামে আশির দশক পর্যন্ত স্পষ্ট দুটি ভাগ ছিল। এক, নিঃসংশয়ে মানা। দুই, সবকিছুতেই সন্দেহ।
আর এই সন্দেহের মূল চাবিটি, নারী নয়, টাকা দিল কে?
কার টাকা ও বুদ্ধি আছে বলদিনি!
ওভারল্যান্ড কাগজের কথা তো জানাই ছিল। এবার এল সাপ্তাহিক কলকাতা থেকে গ্রাম পত্রিকা। পত্রিকার লোকজন গ্রামে গ্রামে বৈঠক করতে লাগলেন। গ্রামের খবর হবে। গ্রামের লোক হবে সাংবাদিক।
হইহই পড়ে গেল। ৩৬ পাতার নিউজপ্রিন্টে ছাপা ট্যাবলয়েড কাগজ। আগে গ্রামে চারটে কাগজ আসতো। যুগান্তর দুটো। আনন্দবাজার একটা। সত্যযুগ একটা। সান্ধ্য গণশক্তি আসতো গোপীনাথপুরে বাদশা চাচার বাড়ি হয়ে আমাদের বাড়ি। আর চলতো পাঁচটি সাপ্তাহিক দেশহিতৈষী কাগজ। এই কাগজ আমার খুব উপকার করে। সারা সপ্তাহের খবর এক জায়গায় থাকতো। দেশ রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক একটা আলাদা পাতা। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী সুধাংশু দাশগুপ্ত ছিলেন সম্পাদক। ১৯৮৯ থেকে আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। অল্প বয়সেই আমাকে দিয়ে বেশ কিছু লেখা তিনি ও হাওড়ার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়েছেন। আগে সব মিলিয়ে দশ। ওভারল্যান্ড একাই হলো এবার ১০টা। যে বাড়িতে কোনওদিন কাগজ ঢুকতো না, সেখানে পড়ার পাতার জন্য কাগজ ঢুকে গেল। মাসে নয় টাকা। এজেন্ট এসে কাগজ দিতেন পয়সাও নিতেন।
কলকাতা থেকে গ্রাম কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ঝাউতলা থেকে বের হতো বোধহয়। সাংবাদিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য বহু কাগজে অল্পবিস্তর কাগজ করেছেন। লিখেছেন। তিনি জানালেন, সম্পাদকের নাম বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। স্ত্রী মিলি গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশক। এই পত্রিকার গ্রাহক হলো প্রায় ত্রিশটা। প্রথম খণ্ডে বলেছি, আমাদের গ্রামে ১৯৮০ তেই ১৭ জন কবি। যাত্রাপালাকার আরও দুয়েকজন। এবার এল সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ। ফলে ত্রিশটা গ্রাহক হয়ে গেল। যদিও সংবাদ কিছু বের হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
তবে এটা মনে আছে, মনস্ক মহলে জোর শোরগোল, ৩৬ পাতার কাগজ! পয়সা দিচ্ছে কে?
বেশিরভাগের মত হল, রাশিয়া। কারণ কাগজ ছিল বামঘেঁষা।
সিআইএ র কথাও ওঠেনি তা নয়। তবে বড়রা বললেন, ওদের তো বড় কাগজ আছেই। ছোট কাগজে টাকা ঢালবে কেন?
১৯৮০ তে আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে। স্কাইল্যাব ভেঙে পড়বে বলে জোর রটে।
পৃথিবী নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে!