সামুরাই (Samurai), যাদের 'বুশি' নামেও ডাকা হয়, তারা ছিল জাপানের প্রাক-শিল্পাঞ্চল যুগের সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং এক কিংবদন্তিতুল্য যোদ্ধা শ্রেণি। জাপানি ক্রিয়াবাচক শব্দ 'সাবুরাই' থেকে 'সামুরাই' শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ হলো 'সেবা করা'। এই নামকরণের মধ্যেই তাদের প্রধান ভূমিকা নিহিত।
তারা সামন্ততান্ত্রিক জাপানে ধনী জমিদার বা 'দাইমিয়ো'দের ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে তাদের নিরাপত্তা ও ভূ-সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা সমাজে এক বিশেষ এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী যোদ্ধা শ্রেণিতে পরিণত হয়।
জাপানি ইতিহাসে সামুরাইরা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ১৮৬৮ সালের মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর ধরে জাপানের সরকার ও সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সময়কালে জাপানে শোগুনেট (সামরিক একনায়কতন্ত্র) প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে সামুরাইরাই ছিল ক্ষমতার মূল ভিত্তি।
বুশিদো: পথ ও নীতি
সামুরাইদের জীবন পরিচালিত হতো একটি কঠোর নৈতিক ও দার্শনিক বিধিমালা দ্বারা, যা 'বুশিদো' (Bushido) বা 'যোদ্ধার পথ' নামে পরিচিত। এই নীতিমালায় মূলত সাতটি প্রধান গুণের ওপর জোর দেওয়া হতো:
ন্যায়পরায়ণতা (Gi)
সাহস (Yū)
দয়া বা করুণা (Jin)
শ্রদ্ধা (Rei)
সততা (Makoto)
সম্মান (Meiyo)
আনুগত্য (Chūgi)
বুশিদোর মাধ্যমে একজন সামুরাই যোদ্ধা কেবল রণক্ষেত্রে তার দক্ষতা প্রমাণ করত না, বরং জীবন ও মৃত্যুর মাঝে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, নির্ভীকতা এবং চরম আনুগত্যের আদর্শ ধারণ করত। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া বা সম্মান হারানোর চেয়ে তারা সেপ্পুকু বা হারা-কিরি (আত্মসম্মান রক্ষার্থে আনুষ্ঠানিক আত্মহনন) বেছে নিতে দ্বিধা করত না।
সামুরাইদের অস্ত্র ও কৌশল
সামুরাইরা ছিল অত্যন্ত দক্ষ যোদ্ধা। তাদের প্রধান এবং সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্র ছিল কাতানা (Katana) নামক লম্বাটে তরবারি। তারা প্রায়শই দুটি তরবারি বহন করত - একটি লম্বা কাতানা এবং একটি ছোট তরবারি ওয়াকিজাশি (Wakizashi)। এই দুটি তরবারিকে সম্মিলিতভাবে ডাইশো (Daishō) বলা হতো।
সামুরাইরা বিশ্বাস করত যে তরবারির মধ্যে তাদের আত্মা বাস করে। এছাড়াও, তীর-ধনুক, বর্শা (ইয়ারি), এবং পরবর্তীতে আগ্নেয়াস্ত্রও তারা ব্যবহার করত। তারা যুদ্ধের সময় তাদের ঐতিহ্যবাহী বর্ম 'ও-য়োরোই' (Ō-yoroi) পরিধান করত, যা তাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত করত।
ঐতিহ্য ও বিলুপ্তি : ১৮৬৮ সালে মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর জাপানে আধুনিকীকরণ শুরু হয় এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। এর ফলস্বরূপ, সামুরাই শ্রেণি তাদের চিরায়ত বিশেষ অধিকার হারায় এবং সামুরাই শাসনের অবসান ঘটে। তবে তাদের সাহস, শৃঙ্খলা এবং বুশিদোর আদর্শ জাপানি সংস্কৃতিতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
আজকের দিনে সামুরাইরা জাপানের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় এবং সারা বিশ্বে বীরত্ব, মর্যাদা ও কঠোর শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।