এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চুমু, মুহাম্মদ ফজলুল হক 

    Fazlul Huque লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ অক্টোবর ২০২৫ | ৪২ বার পঠিত
  • চুমু
    মুহাম্মদ ফজলুল হক

    সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার ফুট উপরে বিমানের দুলুনিতে সচেতন হয় মেঘলা। পাশ ফিরে অর্ণবকে দেখে। শিশুর মত ঘুমিয়ে আছে। ডানহাত রেখেছে মেঘলার পায়ের উপর। যেন কখনো হাতছাড়া করবে না তাকে। ভালোবাসায় ভরে উঠে মেঘলার মন। অর্ণবের হাত তুলে চুমু দেয়।

    "আমরা অল্প সময়ের মধ্যে আইসল্যান্ডে বিশ্বের সবচেয়ে উত্তর প্রান্তের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রেইকিয়াভিক কেফ্লাভিক বিমানবন্দর আবতরণ করব। অনুগ্রহ করে আপনার সিট বেল্ট বেঁধে ফেলুন।"

    ক্যাপ্টেনের ভেসে আসা কন্ঠে অর্ণবের হাতে হাত রেখে কেবিন উইন্ডোর পাশ দিয়ে বাইরে তাকালো মেঘল। নীচে সমুদ্রের কালো নীল ঢেউ। ফাঁকে ফাঁকে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো কালো ভূমি। কোথাও সাদা বরফের দাগ। আকাশ যেন ধোয়া তোলা নীল কিন্তু মাটির রঙ রহস্যময় কালো-ধূসর। প্রথমবার যে কোনো যাত্রী এখানকার দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন বৈপরীত্য নেই। মেঘলার মুগ্ধতা কাটছে না।

    বিমান নিচে নামছে ধীরে ধীরে। চারপাশে কুয়াশা বা হালকা মেঘ ঝুলে আছে। মেঘনার মনে হয়, পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে এসেছে সে। জেগে উঠে অর্ণব। চেপে ধরে মেঘলার হাত। গালে আলতো চুমো দেয়।

    বিমান রানওয়ে ছুঁল। চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা। বড় শহরের মত উঁচু দালান নেই। কেবল বিস্তৃত সমতল ভূমি। দূরে সমুদ্র আর কালো পাথরের পাহাড়। শীতল হাওয়াকে যেন বিমানবন্দর কাঁচের জানালা দিয়েই ডেকে আনছে।

    মেঘলা ও অর্ণব সারিবদ্ধভাবে যাত্রীদের সাথে নেমে আসছে। তাদের চোখে মুগ্ধতা। কেউ ছবি তুলছে। কেউ কাঁপছে ঠান্ডায়। বিমানের ভেতরের গরম আর বাইরের ঠান্ডা। হঠাৎ পরিবর্তন শরীরকে চমকে দেয়।

    টার্মিনালের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আধুনিক সাজসজ্জা চোখে পড়ে। আধুনিকতার মধ্যেও সরলতা বিদ্যমান। বিশাল বড় না হলেও  আরামদায়ক। দেয়ালে দেয়ালে আইসল্যান্ডের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ছবি।

    বিমানবন্দরের বাইরে বের হতেই প্রথমে আঘাত করে বাতাস। হিমেল, শীতল, কানে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে প্রবলভাবে বয়ে যায়। নাকে ভেসে আসে সমুদ্রের নোনাধরা গন্ধ। সাথে আগ্নেয় পাথরের কাঁচা গন্ধও যেন মিশে আছে। শহরের কোলাহল নেই। নীরবতা, খোলা আকাশ ও অসীম প্রকৃতি।
    রাস্তার দুই পাশে গাঢ় কালো লাভার মাঠ। দূরে ধোঁয়া উঠছে গরম পানির ঝরনা হট স্পিংস থেকে। বাতাসে মেঘনার চুল এলোমেলো হয়ে যায়। সে জড়িয়ে ধরে অর্ণবকে। কিছু বলে না অর্ণব। মেঘনার মুখ থেকে চুল সরিয়ে লম্বা চুমু দেয় তার ঠোঁটে।
     
    গেট দিয়ে বের হয়ে আসার সময় তাদের ভেতরে এক ধরনের বিস্ময় কাজ করে। সত্যিই কি পৃথিবীর অদ্ভুত প্রান্তে এসে পৌঁছেছি? মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববৈচিত্র্যে উচ্চাতর পড়ারশোনার শুরুতে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের পরবর্তী ভ্যাকেশন ট্যুর হবে আগুন ও বরফের দেশ খ্যাত পুরোপুরি সমুদ্র বেষ্টিত আইসল্যান্ড। সিদ্ধান্তে পুলকিত হয়ে তাদের চুমো খাওয়া আরো বেড়ে গিয়েছিল। এখানে আসতে পেরে সত্যি তারা সজীবতা অনুভব করছে।

    মেঘলা ও অর্ণব  দুজন একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরল। বাইরে তাকিয়ে মেঘলা হেসে বলল,
    অর্ণব, দেখ! যেন অন্য কোনো গ্রহের দৃশ্য। কালো পাথর, সাদা বরফ ও নীল সমুদ্র। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।
    অর্ণব মৃদু চুমু খেল মেঘলার গালে।
    তোমার চোখের ভেতরেও তো এমন হাজারো গ্রহ আছে, মেঘ। আমি প্রতিদিন সেগুলো ঘুরে দেখি আর অবাক হই।
    মেঘলা লাজুক ভঙ্গিতে তার হাতটা আরও শক্ত করে ধরল। তাদের ভেতরের উত্তেজনা, রোমাঞ্চ ও ভালোবাসার উষ্ণতা নতুন পরিবেশকে আরও উজ্জ্বল করে তুলল।

    মেঘলা শীতের ঝাঁকুনি খেয়ে কেঁপে উঠল।
    অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল তাকে।
    শীতকে ভয় পেয়ো না।
    মেঘলা খিলখিল করে হেসে উঠল।
    শীতকে ভয় পাইনি, তোমার বুকে লেগে থাকতে ইচ্ছে হলো।
    একটু থেমে মেঘলা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, অর্ণব, দেখছো তো? যেন স্বপ্নপুরী।
    অর্ণব তার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,আমার স্বপ্নপুরী তুমি। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত।
    মেঘলা হেসে বলল, তুমি কথার জাদুকর!
    না, ভালোবাসার জাদুকর। বলে আবার চুমু খেল মেঘলার ঠোঁটে।

    বাইরে বের হতেই ঠান্ডা বাতাস শরীরে আঘাত করল। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বইছে। মেঘলা ঠোঁট কামড়ে বলল, আহা, কী তীব্র ঠান্ডা! আমি জমে যাচ্ছি।
    অর্ণব তার জ্যাকেট খুলে মেঘলার কাঁধে জড়িয়ে দিয়ে বলল, ভয় নেই। তুমি বরফ হলে আমি তোমাকে আদর করে আবার স্বাভাবিক করে দিব।
    না হেসে পারল না মেঘলা। অর্ণবের ভালোবাসা এমনই সারাক্ষণ তাকে ভাসিয়ে দেয়। হেসে বলল,
    তাহলে স্বাভাবিক করো।
    অর্ণব তাকে জড়িয়ে ধরে ঠান্ডা হাওয়ায় উষ্ণ চুমু খেল। চারপাশের যাত্রী তাদের দিকে হাসিমুখে তাকাল। তারুণ্যের আবেগ নিজেদের মধ্যে অনুভব করল।

    ট্যাক্সিতে চলতেই দেখা গেল কালো লাভার মাঠ দূরে সাদা বরফ। আকাশে ঝুলে থাকা হালকা মেঘ। মেঘলা বলল, এখানে সবকিছু এত নির্জন,  ভিন্ন। মনে হয় সত্যিই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসেছি।
    অর্ণব তার হাত ধরে ঝাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, শেষ প্রান্তে এসেছি।
    মেঘলা চোখ মিটিমিটি করে তাকাল,
    তাহলে শুরুটা কেমন হবে?
    অর্ণব তার কানে ফিসফিস করে বলল,
    একটা লম্বা চুমু দিয়ে।
    ওরা আবার চুমু খেল। তাদের চুমুর খেলায়  ট্যাক্সির কাঁচের বাইরে জমে থাকা বরফ যেন উষ্ণ হয়ে গলতে শুরু করল।

    শহরে ঢুকে রঙিন ঘরবাড়ি দেখল। ছোট ছোট কাঠে তৈরি ঘরের ছাদে তুষার জমে আছে।
    মেঘলা বলল, এমন সুন্দর শহর আমি কোনো সিনেমাতেও দেখিনি।
    অর্ণব তার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
    আমরা যদি এখানে থেকে যাই, তুমি রাজি?
    মেঘলা অবাক হয়ে বলল, না। নিশ্চয়ই আমি একদিন দেশে ফিরব।
    অর্ণব হাসে, দেশ থাকবে হৃদয়ে। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, তুমি পাশে থাকলেই আমার দেশ, আমার ঘর পূর্ণ হবে।
    মেঘলার চোখ ভিজে উঠে। সত্যি। তুমি ছাড়াও আমার ঘর অপূর্ণ।

    ওরা হোটেলে পৌঁছে। । জানালার বাইরে সমুদ্র দেখা যায়। দূরে বরফাচ্ছন্ন পাহাড়। মেঘলা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, অর্ণব। দেখ, সমুদ্র যেন গান গাইছে।
    অর্ণব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে।
    হ্যা, শুনছি আমি। আমাদের ভালোবাসার গান।
    মেঘলা বলল, তুমি যদি কবি হতে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক কবিতা লিখতে।
    অর্ণব ফিসফিস করে বলল,
    আমিতো কবিই। আমার কবিতা, তুমি।

    হোটেল থেকে তাদের স্বাগত লাঞ্চ দেওয়া হয়। ভেড়ার মাংসের স্যুপ, সালমন ও হ্যাডক মাছ। আলু ও পেয়াজ দিয়ে তৈরি প্লক-ফিস্কুর। দইয়ের মত দুধ জাতীয় খাবার স্কির এবং আগ্নেয়গিরির তাপে তৈরি গাঢ় রংয়ের রুটি। সবশেষে ভাজা মিষ্টি ক্লাই-নর খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

    সন্ধ্যায় দুজন হাত ধরে বের হল। ঠান্ডা বাতাস কেটে হেঁটে যাচ্ছে রঙিন রাস্তা দিয়ে।
    মেঘলা বলল, আমার হাতটা জোড় করে ধরো।
    অর্ণব হাসল, ওর আঙুল মুঠো করে ধরল।
    আরো উষ্ণতা চাই।
    অর্ণব সাথে সাথে তার ঠোঁট মেঘলার ঠোঁটে  মেশাল। হালকা তুষারপাতে চুমুর উষ্ণতায় মনে হচ্ছিল তারা যেন গ্রীষ্মের রোদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
    মেঘলা মিষ্টি গলায় বলল, তুমি আছো বলেই শীতও রোমান্টিক মনে হচ্ছে।
    অর্ণব হেসে উত্তর দিল, তুমি পাশাপাশি আছো বলেই এই শীতেও আমি উষ্ণতা অনুভব করছি।

    রাতের আকাশে হঠাৎ সবুজ আলোর নাচ শুরু হলো। আকাশজুড়ে সবুজ, বেগুনি, নীল আলো। স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা। নর্দান লাইটস এর প্রাকৃতিক আলোয় ভরপুর আকাশ। মেঘলা বিস্ময়ে বলল, এ তো আকাশের প্রেমপত্র।
    অর্ণব ফিসফিস করে বলল,
    হ্যাঁ, আমাদের জন্যই আকাশে প্রেমের রঙ্গিন আলো খেলা করেছে।
    আলোর খেলা দেখে নেচে উঠল তারা। নর্দান লাইটসয়ের নিচে একে অপরকে জড়িয়ে শব্দ করে চুমু খেল।
    রাতের আকাশে আবার তারা নর্দান লাইটস দেখল। আকাশের ওপরে সবুজ আলো দুলছে। মেঘলা অবাক হয়ে বলল  এ যেন স্বপ্ন! আকাশের পর্দা নাচছে।
    অর্ণব তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আকাশ নাচছে তবে তোমার চোখ আরও চমৎকার করে নাচছে! যেন জাদু আছে।
    মেঘলা মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই আমাকে এত ভালোবাসো?
    অর্ণব তার কাঁধ জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
    তুমি যদি বরফ হও, আমি তোমাকে গলাবো।
    তুমি যদি আগুন হও, আমি তাতে পুড়ে যাবো। তুমি যদি আকাশ হও, আমি তোমার নিচে দাঁড়িয়ে যাবো।
    মেঘ, তুমি ছাড়া আমি কিছুই নই।
    মেঘলা কোনো কথা বলল না। শুধু ওর ঠোঁট অর্ণবের ঠোঁটে মিশিয়ে দিল। নর্দান লাইটসের সবুজ আলো যেন ওদের ভালোবাসার আশীর্বাদ হয়ে নেমে এলো।

    হোটেলে ফেরার পথে মেঘলা বলল, আজকের প্রতিটি মুহূর্ত যেন উৎসব। আমরা কতটা সাহসী, তাই না? এতো দূরে এসেছি, নতুন দেশে, নতুন আকাশের নিচে।
    অর্ণব হেসে উত্তর দিল, হ্যাঁ, নতুনকে আলিঙ্গন করা। ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করা আর ভালোবাসাকে জয় করা।
    মেঘলা বলল, তাহলে আজকের দিনে একটা প্রতিজ্ঞা করি ?
    অর্ণব, কী?
    মেঘলা, আমরা ভালোবাসাকে প্রতিদিন নতুন করে উদযাপন করব।
    অর্ণব তার ঠোঁটে হালকা চুমু দিয়ে বলল, রাজী।

    রাতে তারা হোটেলের জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। বাইরে বরফ পড়ছিল। ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল তাদের ভালোবাসা। মেঘলা বলল, মনে হচ্ছে আইসল্যান্ড আমাদের জন্য শুভবারতা নিয়ে আসছে। এখানে আসাতে  আমাদের ভালোবাসা আরো গভীর ও মধুময় হয়েছে।
    অর্ণব ফিসফিস করে উত্তর দিল। না, মেঘ। আইসল্যান্ড না আসলেও হতো। তুমি পাশে থাকলে পৃথিবীর যে কোন জায়গা আমার জন্য হয়ে অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসাময়
    হয়ে উঠে।
    মেঘলা জড়িয়ে ধরে অর্ণবকে। তারুণ্যের দীপ্তি ও অভিরাম প্রেমের উষ্ণতা নিয়ে সেই রাতে তারা পরস্পরকে জয় করল।

    পরের দিন গেল বিখ্যাত গিজার বা ফুটন্ত জলস্রোত দেখতে। হঠাৎ করে গরম পানির ফোয়ারা আকাশ ছুঁয়ে উঠল। মেঘলা হাততালি দিয়ে বলল, ওফ! দেখো তো, যেন পৃথিবীর হৃদস্পন্দন।
    অর্ণব হাসল, তুমি হাসলে আমার হৃদয়ের ভেতরেও এমন ফোয়ারা ওঠে।

    তারপর গেল গালফস জলপ্রপাতে। সাদা বরফ ভেঙে ঝরে পড়ছে বিশাল জলধারা। মেঘলা মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, প্রকৃতি যেন ভালোবাসার সিম্ফনি বাজাচ্ছে।
    অর্ণব তার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গাড়ে চুমু দিয়ে বলল,
    আমাদের ভালোবাসাও এমন প্রচণ্ড অথচ সুন্দর।
    তারা গালফস জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়াল।

    গালফস তথা সোনালী জলপ্রপাত। দুই ধাপে প্রায় বত্রিশ মিটার উপর থেকে পানি নেমে আসে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পানির ধোঁয়ায় রংধনু দেখা যায়। বিশশতকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে এই প্রপাত ধ্বংসের মুখে পড়লে স্থানীয় নারী সিগ্রিদুর টমাসডত্তিরের সাহসিকতার কারণে রক্ষা পায়। সিগ্রিদুর একশত বিশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে রেইকিয়াভিক শহরে গিয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যদি গালফস ধ্বংস করা হয় তাহলে প্রপাতে ঝাঁপ দিয়ে তিনি নিজকে ধ্বংস করবেন। তাঁর সংগ্রামের কারণে গালফস সংরক্ষিত হয়। আজও আইসল্যান্ডবাসী তাকে গালফসের রক্ষক হিসেবে স্মরণ করে। জলপ্রপাতের কাছে স্থাপন করা স্মৃতিফলকের সামনে নতসিরে দাড়িয়ে নিরবতা পালন করে মেঘলা ও অর্ণব।

    গর্জে পড়া জলধারার শব্দে পৃথিবী যেন কেঁপে উঠছে। মেঘলা অর্ণবের কানে চিৎকার করে বলল, বলতো প্রপাতের জলধারা বিকট আওযাজ করে কি বলছে?
    অর্ণব মেঘলাকে চেপে ধরে বলল, আমাদের ভালোবাসার কথা বলছে।
    মেঘলা জোড়ে বলল, ভালোবাসি তোমাকে!
    অর্ণবও তাই করল।
    তাদের কথা প্রতিধ্বণি হয়ে ফিরে আসছে তাদের কাছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠে দুজন। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে আমাদের ভালোবাসা জলপ্রপাতের মতো চিরকাল বয়ে চলবে।

    ব্লু লেগুন গিয়ে বিস্ময় কাটছে না। ভূগর্ভস্থ উষ্ণ পানি দিয়ে তৈরি কৃত্রিম লেগুন। লেগুনের উষ্ণ নীলাভ পানি থেকে উঠা ধোঁয়া রহস্যময় দৃশ্যের অবতারণা করছে। ঠান্ডা বাতাসে উষ্ণ নীল পানিতে নামতেই মেঘলা চিৎকার করে উঠল, আহা, এ যে স্বর্গ!
    অর্ণব তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, আমার কাছে তুমিও স্বর্গ। ওরা পানির ভেতরে আলিঙ্গনে ডুবে রইল। কুয়াশার আবছায়ায় চুমু খেতে খেতে মনে হচ্ছিল তারা পৃথিবীর বাইরে চলে গেছে।

    থিঙ্গভেলি পার্কে এলো। বিশ্বের প্রথম সংসদ ঘরে উঠে এখানে। ইউরোশিয়ান ও নর্থ আমেরিকান টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থল হিসেবেও পরিচিত। থিঙ্গভেলিতে দুটি টেকটোনিক প্লেট আলাদা হওয়ায় মাটিতে ফাটল ও খাত তৈরি হয়েছে। মেঘলা অবাক হয়ে বলল, পৃথিবী এখানে সত্যিই দু’ভাগ হয়ে গেছে। অর্ণব হেসে বলল, যেমন আমি আর তুমি আলাদা হয়ে জন্মেছি। প্রেম আমাদের এক করেছে। সে মেঘলার ঠোঁটে আলতো চুমু খেল। প্রকৃতির ফাঁকে সেই চুমু যেন দুই মহাদেশকে আবার এক করে দিল।

    সেলজাল্যান্ডসফস দক্ষিণ আইসল্যান্ডে। পর্যটক জলপ্রপাতের পিছনে গুহার মতো ফাঁকা জায়গায় হাঁটলে জলের নিচে হাঁটার অনুভুতি উপলব্ধি করে। সূর্যাস্তের সময় একে রূপকথার দেশের মতো লাগে। সেলজাল্যান্ডসফস জলপ্রপাতের নিচে দাড়িয়ে দুজন। মনে হয় পানির পর্দার আড়াল দিয়ে হাঁটছে তারা। মেঘলা জলের ফোঁটা ঝরে পড়া দেখতে দেখতে বলল, আমরা যেন জলের গোপন ঘরে আছি। অর্ণব তার চোখ ও মুখের জল চুমু দিয়ে মুছে বলল, জলের আড়াল করা গোপন ঘরে শুধু তোমাকেই চাই।

    কালো বালুর সৈকতে ঢেউ গর্জে উঠছিল। সমুদ্র যেন ভয় দেখাচ্ছিল। মেঘলা বলল, এ জায়গা একটু ভয়ের মতো।
    অর্ণব তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, ভয় পেও অর্ণব উপস্থিত।
    ওরা বালুর ওপর বসে একে অপরকে চুমু খেল। তাদের প্রেমের আভাসে ঢেউয়ের গর্জন প্রেমের সঙ্গীত হয়ে উঠল।

    ভাসমান বরফখণ্ডে ভরা লেগুনে দাঁড়িয়ে ভাসছিল তারা। সূর্যের আলোয় বরফ ঝলমল করছে। মেঘলা উচ্ছ্বাসে বলল, যেন হাজার হাজার হীরা ভাসছে।
    অর্ণব ফিসফিস করে বলল, হীরা আমার চাই না। আমার কাছে তুমি আছো।
    মেঘলা হেসে বলল, তাহলে আমিই তোমার হীরা।
    অর্ণব জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি হীরার চেয়েও দামী।

    ভ্রমনের প্রতিটি জায়গায় তারা নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করল। প্রকৃতি তাদের প্রেমের সাক্ষী হলো রইল৷ কোথাও জলপ্রপাতের গর্জন। কোথাও বরফের নীরবতা। কোথাও আগুন আর চুমুর উষ্ণতা।

    " ইন্টারকম সিস্টেমে বিমানের ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ শোনা গেলো, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে রেইকিয়াভিক কেফ্লাভিক বিমানবন্দর থেকে মিনিয়াপলিস এর উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন শুরু করব। অনুগ্রহ করে সিটবেল্ট বেঁধে নিন।"

    ঘোষণা শুনে পরস্পরকে চুমু খেল। কেবিনের সিটে একই সিটবেল্ট বেঁধে পরপস্পরকে জড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। তাদের নিয়ে সেকেন্ডে পনর কিলোমিটার গতিতে মিনেসোটার দিকে এগিয়ে চলছে বিমান।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন