আমাদের এলাকায় গাজনে ডাব কাড়াকাড়ির খেলায় মেতে উঠতেন কেন মানুষ?
কারণ কারও মুখে শোনা হয়নি। তবে আমার প্রাথমিক অনুমান, আমাদের দেশ এঁটেল মাটির জমির দেশ। এখানে ধান হয় ভালো।
লোকশ্রুতি ছিল, এটা তো ধানের দেশ, এঁটেল মাটির জমি। এখানে লিচু নারকেল ডালিম এইসব হবে না।
নারকেল গাছ দু একজন লাগাতেন। তবে নারকেল দূরে থাক, ভালো ডাব হতেও দেখিনি। আমার নানার বাড়িতে নারকেল গাছ ছিল। তার তলায় বস্তা ভর্তি নুন দিতে দেখেছি।
আমাদের বাড়িতেও একবার লাগানো হল। কিন্তু দাদি কাটিয়ে দিলেন।
আমার বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান অকালে মারা যান। বড় সুন্দর দেখতে ছিল। সে নাকি নারকেল গাছ লাগানোর পরে পরেই হয়েছিল। তাই নারকেল গাছ লাগানো নিষিদ্ধ ছিল। তবু কেউ একজন পরে লাগান। দাদিই উদ্যোগ নিয়ে কাটান।
আগেই বলেছি, আমাদের এলাকায় সুগন্ধি চাল খাস চাল তথা কলকাত্তাইয়া গোবিন্দভোগ চালের ফলন ছিল এবং আছে অসাধারণ।
এত ভালো খাস চাল আর কোথাও পাবেন না।
খাস চালের দেশের লোকের খাস লড়াই ছিল দুটো।
এক আগরাপুরার মাঠে গোরুর গাড়ির লড়াই আর দুই ডাব কাড়াকাড়ি।
পরে আগরাপুরার মাঠ বিখ্যাত হল, ফুটবলের জন্য।
এখন সেটা মূলত ঈদগাহ তলা হিসেবেই বিখ্যাত। ইদের নামাজ আগেও হতো। বছরে তো মাত্র দুদিন। বাকি দিনগুলো ফুটবলের। এখন ফুটবল প্রায় উধাও।
গ্রামের আদিবাসী ছেলেরা মাঝে মাঝে খেলতে যায়। বাকি সময় ফাঁকা। ইদগাহ আগে ছিল ফাঁকা। এখন ইটের পাঁচিল উঠেছে।
গ্রামে আগে মনে মনে পাঁচিল ওঠেনি।
ফলে হিন্দু মুসলমান দুলে বাগ্দি মুচি সবাই মিলে মিশে ডাব কাড়াকাড়ির খেলায় অংশ নিত।
বেশিরভাগ সময় দেখা যেত, মুসলিম প্রাধান্যের দলই ডাব কাড়াকাড়ির খেলায় বেশি ডাব জিতেছে।
এবং জেতার পর গ্রামে তাঁদের বিশেষ করে মেয়েমহলে সম্মান বেড়ে যেত।
মরদ বটে!
এই গাজন ছিল সবার। বোধহয় বৌদ্ধ ধর্মরাজ তথা বুদ্ধ উপাসনা বদলে যায় শিবের পূজায়।
গাজনের সিধে ঘিরেই গ্রামে প্রথম ফাটল ধরল।
তার আগে অবশ্যই আরেকটি ঘটনা আছে। সাম্প্রদায়িক সলতে পাকানোর সেই শুরু।
১৯৯৯-এ রামমন্দির গড়ার জন্য ইট পূজার ডাক দিলেন তখন বিজেপির প্রধান মুখ লালকৃষ্ণ আদবানি।
আমাদের মত শান্তির গ্রামেও সেই ইটপূজা হল।
এই ঘটনা হতবাক করে দিল গ্রামকে।
ইটপূজা হল গাজন তলা তথা ওলাইচণ্ডী পূজার বারোয়ারি তলায়।
বারোয়ারি তলায় বর্ষার পর একটা বাঁশের মাচা করা হতো আড্ডার জন্য। দুগোদার মুদি দোকান বড়দের দখলে থাকতো বেশিরভাগ সময়। ১৫-২৫ ভিড় করতো বাঁশের মাচায়।
হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই আড্ডা।
বন্ধুদের আবার হিন্দু মুসলমান কী?
কিন্তু সেই বন্ধুদের কেউ কেউ ইটপূজার উদ্যোক্তা। কদিন আগেই একসঙ্গে কার্তিক ঠাকুর ফেলেছে নতুন বিয়েওলা বাড়িতে। তাঁদের কেউ কেউ পূজা না করে ঠাকুর ফেলে দেওয়ায় একসঙ্গে সেই ঠাকুর তুলে এনে খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে।
আর তাদের কেউ কেউ বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার জন্য ইট পাঠাচ্ছে গ্রাম থেকে!
ভেবেই থ।
বারোয়ারিতলার আড্ডায় আর মুসলমান ছেলেরা গেল না।
কোন প্রতিবাদ কেউ মুখে করল না। কিছু বললও না।
এরপর ওলাইচণ্ডী পূজা হল, যাত্রাও হল। মুসলমানদের আত্মীয় কুটুম যথারীতি ঝেঁটিয়ে এল। মুসলমানদের ৯৫% ভাগ মানুষ যাত্রাও করল কিন্তু সুর একটু কাটা কাটা।
পূজা কমিটি যতটা টাকা দেওয়ার কথা সে-নিয়ে গড়িমসি করছে বলে মনে খেদ জন্মাল। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলল না। এটা ছেলেছোকরাদের ব্যাপার।
গাজনের সময় পড়ল প্রভাব। বড়দের মনে।
গাজনের সময় হিন্দু মুসলমান সব বাড়ি থেকেই সিধা সংগ্রহের রীতি ছিল। আমাদের বাড়ি থেকেই সিধা সংগ্রহ শুরু করতেন শিবের পূজারী গন্তা বেনে।
আমার বাবাকে তিনি বলতেন, জ্যান্ত শিব।
ভালো মানুষকে শিব বলার রীতি ছিল হিন্দু মুসলমান সবপক্ষেই।
দুই শিক্ষক আপত্তি করলেন।
একজন জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ। আরেকজন জন্মসূত্রে মুসলিম।
ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ছিলেন রসায়নের শিক্ষক। তিনি বললেন, শিবের পূজায় মুসলমানদের চাল টাকা নেওয়া হবে কেন?
আর মুসলিম ভদ্রলোকও উচ্চশিক্ষিত। তবলিগ জামাতের সদস্য। তিনি প্রশ্ন তুললেন, মুসলিমরা পূজায় চাল টাকা দেবে কেন?
আগেও বলতেন দুজনে।
কেউ পাত্তা দিত না।
এবার সিধা আদায় বন্ধ হয়ে গেল।
ওদিকে দুর্গাপূজার ঘটা বেড়েছে। বারোয়ারি তলায় ঘরের লোহার গেট হল। আর এদিকে মসজিদের সীমানা ঘিরে দেওয়াল উঠল।
যৌথ আড্ডা হতো আগে মসজিদের রকে। রকই থাকল না। তো আড্ডা। সেখানে সীমান্ত।
এতসব সত্ত্বেও আমাদের গ্রামে এখনও হিন্দু মুসলমান একতা খুব। ওলাইচণ্ডী পূজা আজও ধুমধাম করে হয়। মেলা বসে। একদিনের জায়গায় এখন তিন চারদিন। মেলার সীমানা মসজিদ ছাড়িয়ে মুসলিম পাড়ায় ঢুকে গেছে। এবার তো আমাদের খামারে মেলারুদের গাড়ি ভর্তি।
এই মেলায় ঝেঁটিয়ে কুটুম আসে হিন্দু মুসলমান সবার ঘরে। মুসলমানদের ঘরেই বেশি। তাদের উদ্যোগে একদিন অ্যামেচার যাত্রা হয়।
সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। এর পাশাপাশি 'ববি'-র মতো সিনেমা বা 'বারবধূ' বা ''সম্রাট ও সুন্দরী'-র মতো যৌন প্রণোদনার নাটক হয়েছে। সে নিয়ে কিছু কথা তবু শুনি।
কিন্তু হিন্দু মুসলমান দু'পক্ষের মধ্যেই ধর্মীয় চর্চা বেড়ে যাওয়ার শুরুও সত্তর দশকেই।
লৌকিক দেবদেবী যথা ওলাইচণ্ডী ( কলেরার দেবী), শীতলা ( বসন্ত রোগের দেবী), মনসা ( সাপের দেবী)-- এই সব দেবীরা ছিলেন হিন্দু মুসলমান সবার পূজ্য।
মেলা হতো। উৎসব হতো এদের ঘিরে।
পীরের দরগায় ভিড় করতেন হিন্দুরাও।
পীরের উরস বা মেলায় হিন্দুদের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
সুন্দরবন এলাকায় বনবিবি, দখিনা রায়, গাজী বাবা, বামুনগাজী সবার। কোন নির্দিষ্ট ধর্মের নয়।
সত্যপীরের পূজা এবং সিরনি সবার।
সত্যপীরের নামে সাংস্কৃতিক পালা গান হতো, রামযাত্রা, কেষ্ট যাত্রার আসর বসতো।
হিন্দু মুসলমান সবাই শুনতেন, প্যালা দিতেন।
এই প্যালা দেওয়া নিয়ে ঘটতো খুব মজার মজার সব কান্ডকারখানা।