ব্লেদ
নভেম্বর ১৯৯৪
-সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের পর্দা টেনে সরিয়ে বাইরে যখন তাকাই, আমি নিজেকে বলি, স্টিভ, এটা মস্কো। ম্যানহাটান নয়। আজ যেখানে আমাদের ব্যবসা বিস্তার করতে এসেছি, সেসব দেশের ব্যাঙ্কিং গত পঞ্চাশ বছর অন্য মডেলে চলেছে। তাহলে কি আমরা বলব পুরোনো টেক্সট বুক ছুঁড়ে ফেলে দাও, আমরা নতুন বই নিয়ে এসেছি? এখন থেকে এইভাবে কাজ হবে? আমাদের যে সংবিধান, সেটা কি এখানে চলবে? টাকার অনেক নাম আছে, তার কাজ একটাই। ব্যাঙ্কিং কি শেষ অবধি তাই? কে কাকে মানিয়ে নেবে?
সিটি ব্যাঙ্ক মস্কোর ক্রেডিট গুরু স্টিভেন আমাদের কনফারেন্সে উদ্বোধনী সম্ভাষণ দিচ্ছিলেন। স্টিভ শিকাগোর লোক, আজীবন সিটি ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন। মাথা ভর্তি চুল, সাদা হয়ে এসেছে। চিরুনির পরিবর্তে ডান হাতের আঙুল দিয়ে তাকে বশে রাখার চেষ্টা করেন। এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের দেখলে মনে হয় এই পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা তাঁদেরই ঘাড়ে। স্টিভ এই দলে পড়েন।
ঠিক দু-বছর আগে পূর্ব ইউরোপে সিটি ব্যাঙ্কের প্রথম পদক্ষেপের দিনে, এক নভেম্বর মাসে পোল্যান্ডের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যাঙ্কিং বিদ্যাচর্চার পালায় শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। তারপরে আমাদের নীল ঝান্ডা উড়েছে প্রাগ, ব্রাতিস্লাভা, বুখারেসট, মস্কো, আলমা আতি, বুদাপেস্ত (১৯৮৬) – চার দশকের সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থার পতন এবং আমেরিকান পুঁজিবাদী ব্যাঙ্কিং প্রথার অভ্যুদয়। দিন বদলেছে, এবার আমাদের ঝটিকাবাহিনী এসে পড়েছে! আমার চোখের সামনে যুগান্তর দেখছি!
স্টিভের সতর্কতাবাণীর অর্থ আমি সেদিন বুঝিনি। দুয়োর খোলা পেয়েই গ্রামের গৃহবাসীর উঠোনে ‘চিরুনি নেবে গো’ বলে যেমন ঢুকে পড়ে ফিরিওলা, নতুন বাজারের সন্ধানে সেই ভাবেই পূর্ব ইউরোপে ‘এসেছি, আজি এসেছি’ রব তুলে হাজির হয়েছি সেদিন। এক হাতে ১৮১২ সালে নিউ ইয়র্কে লেখা ব্যাঙ্কিং সংবিধান, অন্য হাতে আই বি এম কম্পিউটার নিয়ে বিজয় যাত্রা। প্রফেটিক কথাটার কোনো সঠিক বাংলা পাইনি। তবে পরের পঁচিশ বছরে পূর্ব ইউরোপে সিটি এবং আরও অনেক পশ্চিমি ব্যাঙ্কের রোলার কোস্টার রাইড দেখে স্টিভকে মনে মনে প্রণাম করেছি। দিব্যদ্রষ্টা।
অকুস্থল ব্লেদ। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটি হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সেই শহর। দু-কিলোমিটার লম্বা এক কিলোমিটার চওড়া এই হ্রদের জল নেমে এসেছে জুলিয়ান আল্পসের গ্লাসিয়ার থেকে। তার জল বড়োই নীল বলে শোনা যায়, তবে এই নভেম্বরের শীতে সেই বর্ণ পরিচয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনুমান করে নেওয়া যায় শুধু হ্রদের মাঝে একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপে গির্জের চুড়ো দেখা যায়। আমরা উঠেছি গ্র্যান্ড হোটেল টপলিচেতে। সিটি ব্যাঙ্কের এই দলে আমাকে একমাত্র অশ্বেতবর্ণ বিদেশি দেখে বর্ষীয়ান কনসিয়ারজ জানতে চাইলেন, আমি কোন দেশের লোক। ভারতীয় শুনে আমাকে বললেন, এই হোটেলে মার্শাল টিটো একদা মিস্টার নেহরুর আপ্যায়ন করেছিলেন। তিনি যোগ করলেন, ব্লেদের বাহার দেখতে হলে গ্রীষ্মকালে আসুন।
কী ভাগ্যে একবার আসা হলো, আবার কি কখনও হবে?
তিন বছর আগে ইয়ুগোস্লাভিয়ার বর্ম ছিঁড়ে স্লোভেনিয়া স্বাধীন দেশ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্য রিপাবলিক ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছে দু-বছর যাবত, সারায়েভো অবরুদ্ধ, কসভোয় অশান্তি। কিন্তু স্লোভেনিয়াতে তার কোনো ছায়া নেই- আল্পসের কোলে নীল হ্রদের ধারে শান্তিময় অপরূপ ব্লেদ শহর। এই সুন্দর শহরে আমাদের সম্মিলনীর উদ্দেশ্য নবীন অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন শাখায় নবনিযুক্ত কর্মীবৃন্দ এবং প্রাচীন অর্থাৎ আমাদের মতন জুতোর সুকতলা খইয়ে দেওয়া পুরোনো সিটি ব্যাঙ্কারদের আপোষে আলাপ পরিচয় করানো এবং সিটি ব্যাঙ্কে নামক সুপার মার্কেটের সেলস ক্যাটালগ পেশ করা – আমরা কী কী সেবা নিয়ে এখানে হাজির হতে পারি—তার ফিরিস্তি। সিটি ব্যাঙ্ক কেবলমাত্র সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতা খোলার জন্য আসেনি বন্ধুগণ, ক্রেডিট কার্ড, বন্ড, মর্টগেজ, প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ, আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহ – আমাদের ভাণ্ডারে আছে বিবিধ রতন! আমেরিকান ভাষায় যাকে বলে নেট ওয়ার্কিং আর সেলস পিচ!
কেন ব্লেদ? স্লোভেনিয়ার মতন ছোটো দেশে সিটি ব্যাঙ্কের শাখা খোলার কোনো প্রসঙ্গ নেই, থাকতে পারে না। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন সিটি ব্যাঙ্কের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অফিস। তাঁরা ব্যাঙ্কের খরচায় নতুন নতুন কনফারেন্স ভেনুর খোঁজে বহু দেশে ঘোরাঘুরি করেন, সবচেয়ে দামি হোটেলে বাস করে সেখানকার খাবার দাবার, জিমের সৌষ্ঠব, বিছানার গদির দৃঢ়তার পরীক্ষানিরীক্ষা-পূর্বক সেরা স্থান নির্বাচিত করেন। বলা বাহুল্য, এই সরেজমিন তদন্ত চলতে থাকে মাস দুয়েক। সেটাই তো তাদের কাজ! তবে মানতে হল—জায়গাটা বেছেছেন খাসা।
পোল্যান্ডে ব্যাঙ্কের ও আমার পূর্ব ইউরোপ পরিচিতির প্রারম্ভ * । বিগত দু-বছরে আমরা দেশে দেশে স্থানীয় ব্যাঙ্কারদের কাজে বহাল করে আমাদের ধান্দার কায়দাকানুন বোঝানো শুরু করেছি, সিটি ব্যাঙ্কের অজস্র জারগন, সেলস টেকনিক শেখানোর প্রচেষ্টাও সম্যক বহাল। ব্লেদ সমাবেশে তাদের আরও অন্তরঙ্গভাবে জানা হবে—আজকে যাকে বলে ইন্টার অ্যাকশন—তারপর উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা মস্কো থেকে ব্রাতিস্লাভা অবধি আমাদের পতাকা তুলে বেওসা বাড়াবেন, তনখার সঙ্গে এতাবৎ অচেনা বোনাস বস্তুটির পিছনে ধাওয়া করবেন।
উপস্থিতদের মধ্যে পোল্যান্ডের ঝাকশেভোতে চেনা ভিটেক জেলিন্সকি, এ ছাড়া হাঙ্গেরির আগি কুমের, টোনি (আন্তন) ফেকেতে, বুখারেস্তের রাদু সরবান, ব্রাতিস্লাভার ইগর থাম এবং আরও অনেকে। সিটি এবং আমেরিকান ওয়ে অফ ডুইং বিজনেস তাঁদের কাছে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু খুব শিগগির বুঝলাম, এঁরা একে অপরকেও তেমন চেনেন না! পূর্ব ইউরোপ বলতে আমরা জানতাম ওয়ারশ প্যাক্ট, ককমিকন, সাম্যবাদী ভাইচারা, সমস্বরে ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া। শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছুই নেই—এই মন্ত্রে বিশ্বাসী আটটি দেশের মানুষ একত্র ওঠাবসা করেন, গান গেয়ে ছুটি কাটান এমন ধারণাও আমার ছিল — জান পহচান জরুর হ্যায়!
টোনি তার ইংরেজি শেখার গল্প করছিল। হাঙ্গেরিয়ান স্কুলে ইংরেজি টেক্সট বইয়ের সংলাপ –
সুজান: এই গ্রীষ্মের ছুটিতে তুমি কোথায় যাচ্ছ?
জন: আমি এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে ব্রাইটনে গিয়ে যৌথ খামারে চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে আলু তুলব। তুমি?
সুজান: আমি ওয়েলসে যাচ্ছি। টেনবির খেতে আপেল আর পিচ ফলের প্যাকিং করতে।
আমি জানি আমার স্ত্রী তাঁর স্কুলের ছুটিতে স্থানীয় পার্টির মর্জি মাফিক ভুট্টা বা আপেলের বাগানে বেগার খেটেছেন, কিন্তু সেটার বর্ণনা রোমানিয়াতে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ছিল না!
ব্লেদের দিনগুলিতে জানলাম পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের অপরিচিতি শুধু নয়, তাঁরা প্রতিবেশীকে, পরস্পরকেও খুব কম চেনেন। সোভিয়েত দেশের পত্রিকায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারার পতাকার নিচে মানুষের মহামিলনের যে ছবি আকছার দেখেছি, সেটা নিতান্তই রাশিয়ান রাস উৎসব। বাকি পূর্ব ইউরোপ কমিউনিস্ট, কিন্তু তারা ঠিক একজাতি, একপ্রাণ, এক ভাষার প্রতীক ছিল না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি সক্ষম পোলিশ বুলগারিয়ার কৃষ্ণ সাগর উপকূলে ছুটি কাটিয়েছে, যদিও সেটা প্রায় ব্যতিক্রম। রোমানিয়ানদের দৌড়ও ছিল ঐ পাশের দেশ বুলগারিয়া অবধি। সবাই নিজেদের দেশে থেকেছে, কদাচ সীমানা পেরিয়েছে। আন্তর্জাতিক মেলামেশার যে ছবি আমরা দেখেছি সেটা সরকারি, মুখ্যত পার্টি লেভেলে।
রাশিয়ার ব্যাপারটা আলাদা – তারা বড়ো ভাই। উচ্চশিক্ষার জন্যে অনেকে সে দেশে গেছে, স্কুলে রাশিয়ান শেখা বাধ্যতামূলক, অতএব সেটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। দেশটা অনেক বড়ো — শোনা যায় আশি শতাংশ আমেরিকানের পাসপোর্ট নেই (আমার বেয়াই সদ্য রিটায়ার করেছেন, কখনও পাসপোর্ট ছিল না)। তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ আপন দেশেই ছুটি কাটিয়েছেন। পার্টি বসেরা রিগার ইউরমালার সমুদ্রতীরে ছুটিতে অবশ্যই গেছেন (ক্রুশভ নিয়মিত যেতেন)। তবে সেটা ঐ সাম্যবাদী সমাজের ওপরতলার লোকের জন্য। কিন্তু দু-জন পোলিশ বা চেক মানুষের কাছে ক্রোয়েশিয়া বা লিথুয়ানিয়া বহু দূরের কোনো নক্ষত্র মাত্র। ভাষার কারণে হাঙ্গেরি একেবারে আলাদা, যেমন রোমানিয়াও – চতুর্দিকে স্লাভিক প্রতিবেশী কিন্তু তাদের আপন ভাষা ল্যাটিন ভিত্তিক। আলাপের একেবারে গোড়ার দিকে কিছুই না জেনে রোমানিয়ান বিদেশি মুদ্রার কারবারি বাঙ্করেক্স এর ভ্লাদ সোয়ারেকে (সোয়ারে অর্থ সূর্য!) রোমানিয়াকে স্লাভিক দেশ বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
নভেম্বরের কুয়াশায় পাহাড় অদৃশ্য, লেকের জল স্থির। ভিটেক আর আমি তার পাশে চক্কর দিচ্ছি। ছোটো স্টল খুলে একজন পিকচার পোস্টকার্ড বিক্রি করছে দেখে ভিটেক বললে কার্ড কিনব। কিন্তু এর সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলি? তাকে বললাম, ভিটেক, নির্ভেজাল পোলিশে বলো তুমি একটা কার্ড কিনতে চাও! দেখ সে বোঝে কিনা। ভিটেক খানিকটা দ্বিধা গ্রস্ত ভাবে দোকানিকে পোলিশে তার অভিলাষ অভিব্যক্ত করলেই তিনি সেটি বুঝলেন। কেনাবেচা, ডিল সম্পূর্ণ হলো! ভিটেক এবারে আমাকে জিজ্ঞেস করল, জানি তুমি একটু আধটু পোলিশ বোঝো, আমিই তোমাকে ঝাকশেভোতে হাতেখড়ি দিয়েছি। পরে তোমার পোলিশ বান্ধবীরা তাকে ঘষে মেজে দিয়েছে। কিন্তু স্লোভেনিয়ান শিখলে কবে?
অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী—এই আপ্তবাক্যকে অবহেলা করে বাহাদুরি দেখাবার চিরাচরিত বাঙালি অভ্যাস কখনও ত্যাগ করিনি। লিলিয়ানার কাছে শোনা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার এই সুযোগ। বললাম, ভিটেক, যতটুকু জানি – পোলিশ, চেক, স্লোভেনিয়ান একই স্লাভিক ভাষা পরিবারের সদস্য। তফাৎ আছে ব্যাকরণে, বাক্য বিন্যাসে, কিন্তু নিত্যদিনের ব্যবহারের শব্দ প্রায় এক। পোলিশে তোমরা গোনো ইয়েদনা দ্ভা ত্রি, স্লোভেনিয়ানরা গোনে এনা দ্বা ত্রি; পোলিশে কেনা হলো কুপিচ, এরা বলে কুপিতি। কার্ড কেনা নিয়ে কথা। তুমি তো আর দোকানদারের সঙ্গে ব্লেদ শহরের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা বিষয়ে কোনো আলোচনায় বসছ না!
বছর দশেক বাদে ভিটেকের সঙ্গে সিটি ব্যাঙ্ক বুখারেস্টে দেখা—ইতিমধ্যে সে ইউক্রেনের (সিটির শততম বিদেশি শাখা) সি ই ও পদ অলঙ্কৃত করে এসেছে। ব্লেদের গল্পটা তার মনে ছিল। দেখা হতেই সে বললে, কিভে গিয়ে দেখি একই ব্যাপার! একপক্ষ ইউক্রেনিয়ান এবং অপর পক্ষ পোলিশ বললেও বুঝতে কারো কোনো অসুবিধে হয় না!
সুধী, আমার নিজের ফান্ডা দেখিয়ে হাততালি কুড়নোর জন্যে এ গপ্পো নয়। আমি কোথাকার সিঁথি বরানগরের মানুষ, কেবল ঘটনাচক্রে এখানে এসে পড়েছি। জানি পোলিশ বা স্লোভেনিয়ান নিয়ে একটু গভীরে ঢুকলেই তলিয়ে যাব। বাবা বলতেন, তুমি পল্লবগ্রাহী, পাতায় পাতায় ঘোরো, গাছ চেনার মুরোদ নেই। এই কাহিনি বিস্তারিত বলার একমাত্র উদ্দেশ্য এই, যে ‘পূর্ব ইউরোপ’ কোনো একক যূথবদ্ধ জনসমষ্টির নাম নয়। সিটি ব্যাঙ্কে আমার প্রভুদের সঙ্গে আলোচনায়, কনফারেন্সে অনেকবার বলেছি ইস্টার্ন ইউরোপ নামে কোনো দেশ নেই। কাজটা অবিশ্যি শক্ত—আফ্রিকা যে একটা দেশ নয়, ‘আফ্রিকানস’ এক ভাষার নাম বটে, কিন্তু ৯৯% আফ্রিকান এ ভাষা চেনে না বা বলে না—এমন তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে হার মেনেছি।
আইদার কালিয়েভ এসেছিল সিটি ব্যাঙ্ক কাজাখস্তানের আলমা আতি থেকে। একদিন আমাদের রজার বললে তুমি আইদারের ইংরেজি শুনেছো? আমি ইস্ট লন্ডনের ককনিতে আটকে আছি, ওর ইংরেজি শুনলে চমকে যাবে! একদিন তার সঙ্গে বসে গেলাম পাবে। কথায় কথায় বললাম দেশ ছেড়েছি বিশ বছর আগে এখনও আমার ভারতীয় অ্যাকসেন্ট গেল না। কিন্তু তুমি এমন মোক্ষম ইংরেজি কোথায় শিখলে বাপু? ইউরোপে আমেরিকান ইংরেজি চালু কিন্তু তুমি ইংরেজের ইংরেজি বল? শিখলে কোথায়? বিলেতে ছিলে?
তারিফ শুনে খুব খুশি হয়ে আইদার বললে, তুমি বিশ্বাস করবে কি—আমি পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে এই প্রথম কোথাও এসেছি?
রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। তবে কী? ইংরেজ বান্ধবী? আইদার বললে তাও নয় – বি বি সি!
—মানে?
—আলমা আতিতে ছাত্রাবস্থায় অত্যন্ত মন দিয়ে বি বি সি শুনতাম, সরকারি নিষেধ না মেনে, লুকিয়ে। বি বি সির খবর, সংবাদ সমীক্ষা, স্পোর্টস রাউন্ডআপ শুনে শুনে বাবার একটা পুরোনো টেপ রেকর্ডারে নিজের উচ্চারণ রেকর্ড করেছি কয়েক বছর। প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্র্যাকটিস!
লজ্জা হল। এত বছর ইংল্যান্ডে থেকেও আমার উচ্চারণ শোধরাল না। এই আইদার কোন দূর দেশে বসে সেটি আয়ত্ত করেছে। অবাক হওয়া তখনও বাকি ছিল। এই সেমিনারে নানান আলোচনা, ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ ইত্যাদি শুনে একদিন আইদার বললে, যা শুনছি তাতে মনে হয় আমরা সঠিক দিকেই যাচ্ছি। তবে কথার সঙ্গে কাজ আর কাজের সঙ্গে কথাটা যেন মেলে (সুট দি অ্যাকশন টু দি ওয়ার্ড, দি ওয়ার্ড টু দি অ্যাকশন)। চমকে গেলাম, আগে কোথাও যেন শুনেছি। জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাতেই আইদার একটু বিব্রত মুখে বললে, হ্যামলেট ** !
আল্পস পেরিয়ে
আমেরিকার প্রাচীনতম ব্যাঙ্কের নবীনতম কর্মীদের সঙ্গে গল্পগুজব করে দিব্যি দুটো দিন কাটল। শুক্রবার দুপুরে সেই আড্ডা ভঙ্গ হবে। এমন সময় লন্ডন থেকে আমার সেক্রেটারি মারিয়া লালির ফোন — আমার বড়ো সায়েব খুব ঘ্যামা এক মক্কেলের সঙ্গে লাঞ্চ মিটিং স্থির করেছেন শুক্রবার দিন, তত্র আমার উপস্থিতি আকাঙ্ক্ষিত। ইতিমধ্যে আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট ওয়াগন লির সঙ্গে বার্তালাপ করে মারিয়া জেনেছে—সে মিটিঙে হাজিরা দিতে গেলে আমাকে লুবলিয়ানা থেকে বেস্পতিবার দুপুরের প্লেন ধরতে হবে। দিনে একবার মাত্র সে প্লেন লন্ডনের দিকে ওড়ে। অর্থাৎ প্রাতরাশের পরেই এই সুন্দর স্বর্ণালি ব্লেদ হতে বিদায়! আমি বললাম জিজ্ঞেস করো লুবলিয়ানা থেকে সরাসরি না হোক, ফ্রাঙ্কফুর্ট বা জুরিখ দিয়ে সেই সকালে লন্ডন পৌঁছুনো যায় কি? খুব ভোরে যদি প্লেন ধরি?
বেশ আড্ডা জমে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার ইচ্ছে একেবারেই নেই। কী এমন জরুরি মিটিং ছাই! এখানে ভবিষ্যতের বহু ডিলের অঙ্কুর দেখছি, তাদের পরিচর্যা করলে ফুলের বাহার লেগে যাবে। আমার বড়ো কর্তা অবিশ্যি ভাবেন স্লোভেনিয়ায় আমার এ শুধু ছুটির দিন, এ লগন লেকের ধারে বসে বিয়ার খাবার। চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে কতক্ষণ?
মারিয়া জানাল, আমার কল্পনা আকাশকুসুম—লুবলিয়ানা থেকে ভোরের প্লেন ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট বা জুরিখ হয়ে গেলেও বিকেলের আগে লন্ডন পৌঁছানো অসম্ভব। অতএব ফেরার টিকিট শুক্রবারের বদলে বেস্পতিবার করাটা বাঞ্ছনীয়। বললাম, হোল্ড অন। জরা বাঁধকে। একটু চিন্তা করে জানাচ্ছি।
বেজায় মন খারাপ করে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে আছি, চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙানো একটা বিশাল ম্যাপ। সেটা এমনি ইশকুলের ভূগোলের ম্যাপ নয়, তাতে পাহাড় পর্বতের রিলিফ বা আভাস দেওয়া আছে। খানিকটা অলস আগ্রহে দেখতে লাগলাম। আমাকে ম্যাপের সামনে নিবিষ্ট দেখে হিউ এসে বললে, অন্য কোথাও যাবার প্ল্যান আছে? ঘটনাটা জানিয়ে বললাম, না, লুবলিয়ানাকে এড়িয়ে লন্ডন যাওয়া যায় কিনা ভাবছি। গুড লাক বলে সে পানশালার দিকে এগুলো।
ব্লেদ তথা স্লোভেনিয়াকে উত্তর প্রান্তে ঘিরে রেখেছে ইয়ুলিখার আল্পেন বা জুলিয়ান আল্পস আর তার ওপারে আমার বহু চেনা অস্ট্রিয়া। মিউনিক থেকে একদা ট্রেনে চড়ে অস্ট্রিয়ার কুফস্টাইনে আসি – জার্মান প্রবাসে সেটাই আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা! ব্লেদ হতে ভিয়েনা যাওয়া যায় না? তারপর লন্ডন? এবে ভিয়েনা যাবো কীরূপে ? ম্যাপের ওপরে বুড়ো আঙুল দিয়ে মেপে দেখলাম সেটা অনেক দূরে। ইয়ুলিখার আল্পেন পেরুলে প্রথম অস্ট্রিয়ান শহর ক্লাগেনফুর্ট। সেখানে কোনো এয়ারপোর্ট আছে কি? যদি থাকে সেখানে হাওয়াই জাহাজ ধরে ভিয়েনায় প্লেন বদলানো যায় না? মারিয়াকে ফোন করলাম। সে জানাল, এয়ারপোর্ট আছে। সময়ের ব্যবধানের সৌজন্যে সকাল সাতটায় ক্লাগেনফুর্ট বিমান বন্দরে অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেন ধরলে, ভিয়েনায় কানেক্টিং প্লেন আমাকে সাড়ে দশটায় লন্ডন নিয়ে যেতে পারে। আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট বলেছে, এতে দুটো সমস্যা—ক্লাগেনফুর্ট তো অন্য দেশে, আর অত ভোরে হীরেন ব্লেদ থেকে কোন পথে সে শহরে পৌঁছুবে?
পাঠক, বিগত তিন দশকে ইংল্যান্ড বা জার্মানিতে ব্যাঙ্কের ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে নিজস্ব আন্তর্জাতিক ভ্রমণসূচি জানাতে গিয়ে বুঝেছি ভূগোলটা তারা একেবারেই পড়েনি। এরা যদি নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরে সমীরবাবুর ক্লাস করত!
বারমিংহামের মারিয়া লালির ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস জ্ঞানও সীমিত। তাই বলতে পারলাম না হানিবল যদি হাতি নিয়ে আল্পস পার হতে পারেন, বাঙালি সিংহরায়ও গাড়িতে এ পথ পার হতে পারে। একদিন আমার দেশের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা জয় করেননি? তার আগে আরেকটা কাজ বাকি – শেরপা না হোক, এক অ্যাডভেঞ্চারপিপাসু গাড়িওলা ধরতে হবে, যে নভেম্বর মাসের বরফ জমা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আমাকে ক্লাগেনফুর্ট পৌঁছে দেবে। আরেকটা ফ্যাকড়া থাকতে পারে – তার অস্ট্রিয়ান ভিসা থাকা প্রয়োজন (অস্ট্রিয়া ও স্লোভেনিয়া কেউ তখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য নয়)।
কোথাও পড়েছিলাম একটি নতুন চিন্তার উদ্ভাবন এবং সেটি যে কার্যত অচল তা বুঝে ওঠার মধ্যেকার সময়টুকুই দেয় এক তুরীয় আনন্দ (Ecstasy is the intervening period of time between hitting upon a novel idea and the realisation that it would not work in practice.)।
ইউরেকা মুহূর্তের সম্মুখীন আমি। ধোপে টিকবে সেটা? হোটেলের রিসেপশানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আগামীকাল ভোর চারটেয় ক্লাগেনফুর্ট যেতে হবে। সেটা কি সম্ভব? ট্যাক্সি পাওয়া যায়? আর একটা কথা, ড্রাইভার জার্মান জানলে আমার সুবিধে হয়। এমন অনুরোধ তাঁরা হয়তো সচরাচর শোনেননি। এক দাড়িওলা ভারতীয় স্লোভেনিয়া থেকে পাহাড় পেরিয়ে অস্ট্রিয়া যাবার জন্যে জার্মান জানা ড্রাইভার খুঁজছে? তার নিজের ভিসা আছে তো? চোখে সংশয় থাকলেও এমন কোনো প্রশ্ন তাঁরা করলেন না ভদ্রতাবশত। বললেন সেটা সম্ভব। একটু অপেক্ষা করুন একজনকে খবর দিচ্ছি। খানিকক্ষণ বাদে এক মাথা সাদা চুল এবং কালো লেদার জ্যাকেট পরা এমন একজনকে রিসেপশানে হাজির হতে দেখলাম যিনি সম্ভবত এই হোটেলের অস্থায়ী বাসিন্দা নন। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম, নাম আন্দ্রেই; আমার অভিসন্ধি জেনে ভুল ব্যাকরণ কিন্তু স্বচ্ছন্দ জার্মানে বললেন ব্লেদ থেকে ক্লাগেনফুর্ট যাওয়া যায়, প্রায় একশ কিলোমিটার। এমনিতে সোয়া ঘণ্টার পথ, তবে শীতের সকাল ও তাঁর গাড়ির বয়েসের কথা মনে রেখে একটু বেশি সময় হাতে রাখা ভালো। তিনি ভোর চারটের মধ্যে হাজির হবেন।
মারিয়াকে বললাম লুবলিয়ানা-লন্ডনের টিকিট বাতিল করে শুক্রবার সকালে ক্লাগেনফুর্ট-ভিয়েনা- লন্ডনের টিকিট কাটতে বলো ওয়াগন লি’-কে। ব্লেদ থেকে ক্লাগেনফুর্ট পৌঁছুনোর জিম্মেদারি আমার।
একদিন বার্লিন থেকে সম্পূর্ণ অচেনা পথে গাড়ি চালিয়ে সন্ধ্যের অন্ধকারে পোল্যান্ডের গ্রামে পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হয়েছিলাম। এবার না হয় কাক ভোরে স্লোভেনিয়ার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অস্ট্রিয়া পৌঁছুব।
পানশালায় ভিটেক, হিউ, আইদার, ডেভিডের সঙ্গে যোগ দিয়ে গল্পটা খুব বাড়িয়ে চড়িয়ে শোনালাম।
হিন্দুস্তানিকি আউকাদ ভি দেখ লিজিয়ে!
নভেম্বরের ভোর চারটেয় আমাদের রাত বারোটার মতন অন্ধকার। লেক ব্লেদ আবছা দেখা যায়। সারা রাত তুষার পড়েছে। তাজা বরফ গুঁড়িয়ে গাড়ি চললে এক বিরতি বিহীন মড়মড় শব্দ হতে থাকে, ক্রমশ চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। হ্রদকে পিছনে ফেলে প্রাথমিক যাত্রা দক্ষিণ পানে, আমাদের তো যেতে হবে উত্তরের পাহাড় পেরিয়ে! আন্দ্রেই বোঝালেন কারাভাঙ্কেন পর্বত পেরিয়ে উত্তরে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ লোইবল পাস, যা শুরু হয় স্লোভেনিয়ান গ্রাম ত্রশজিচ থেকে, গিয়ে পড়ে অস্ট্রিয়ার ফেরলাখ গ্রামে। মধ্যে দেড় কিলোমিটার লম্বা লোইবল টানেল *** সেটা তৈরি হয় সেই সময়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালকে ‘দামালস’ বা সেই সময় আখ্যা দেওয়ার ধারাটি এখানেও প্রচলিত আছে)। অস্ট্রিয়ার দু-হাজার মিটার উঁচু খাড়া পাহাড় হোখস্টুল—উঁচু চেয়ার—শীর্ষকে বাঁ পাশে রেখে এই লোইবল পাস আমাদের নিয়ে যাবে সমতল ভূমিতে। মনে মনে ভাবলাম হানিবলের হাতি কি এই পাহাড় পার হয়েছিল?
ছোটো খাটো লেক, জলধারা পার হয়ে অস্ট্রিয়ান চৌকিতে পৌঁছুনো গেল—সুরক্ষা প্রহরী আমার পাসপোর্টের পাতা উলটেই ফেরত দিলেন। আন্দ্রেইর পরিচিতি পত্র খুললেন না অবধি।
ক্লাগেনফুর্ট এয়ারপোর্ট এসে গেছি। হাতে একটা ব্যাগ ও এক ঘণ্টার বেশি সময়।
বিদায় নেওয়ার সময় আন্দ্রেই একটু হেসে বললেন, আপনি জানতে চেয়েছিলেন আমার অস্ট্রিয়ান ভিসা আছে কিনা! মাইন হ্যার, আমার বাবার বাল্যকালে এরা আমাদের রাজা ছিল—আমাদের সম্পর্ক বড়োই গভীর! অস্ট্রিয়ানরা যদি এক বছর আমাদের দেশে স্কি করতে না আসে, স্লোভেনিয়ার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হবে! আর জার্মান? সেটা দিয়ে স্লোভেনিয়াতে কাজ চালাতে পারেন। তবে আজকের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শেখে বেশি!
অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইনসের হাওয়াই জাহাজ যখন তুষারে ঢাকা আল্পসের ওপরে চক্কর দিয়ে ভিয়েনা মুখে রওনা দিল, জানতাম না—বিশ বছর বাদে এই ক্লাগেনফুর্ট হয়ে উঠবে আমার কাজের ঠিকানা। দু-মাস অন্তর এক অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর বেশে আসব নিয়মিত। আবার সেই পাহাড়ি পথে, লোইবল টানেল দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ব্লেদ, লুবলিয়ানা যাবো, কাজে এবং অকাজে।
চার নয়, আরও অনেক রঙ্গ আমার জন্যে সাজিয়ে রেখেছেন কেউ। *****