দেওয়াল ভাঙার প্রস্তুতি অনেক দিনের ।
আমার বন্ধু অরটউইন এককালের সুদেতেনলানড – বর্তমান চেকের মেলনিক শহরে কাকার বাড়ি গিয়েছিল। ভোরের দিকে কাকিমা তাকে ঘুম থেকে তুলে বলেন, রাশিয়ানরা ঢুকে পড়েছে। তুমি এখুনি গাড়ি নিয়ে পালাও ফ্রাঙ্কফুর্ট। আগস্ট মাস, আকাশে একটু আলো দেখা দিয়েছে। মেলনিক থেকে নুরেমবের্গের পথ তার চেনা। কিন্তু কে বা কারা যেন রাস্তার সাইনবোর্ডগুলোকে উলটো মুখে ঘুরিয়ে দিয়েছে ব্রুইন দেখাচ্ছে উত্তরে, প্রাগ দক্ষিণে! রাশিয়ান ট্যাঙ্ককে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য চেক প্রতিরোধের কাজ ছিল সেটি। মেলনিক থেকে কার্লসবাদ হয়ে চেবের জার্মান সীমান্ত পৌঁছুতে ঘণ্টাদেড়েক – অরটউইন হলফ করে বলে সেদিন চেক সীমান্তে কোনো প্রহরী ছিল না।
প্রাগে রাশিয়ান বাহিনীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে শীতের অন্ধকার নেমে এল, কেবল প্রাগ নয়, সারা পূর্ব ইউরোপে।
প্রাগের বসন্তের (প্রাগার ফ্রুইলিং) দিন ফুরোলো। আগস্ট ১৯৬৮।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপকে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিন মহামতি; তারপর থেকে পুব আর পশ্চিমের মুখ দেখাদেখি বন্ধ রইল পুরো চার দশক। এই লৌহ-যবনিকা উত্তোলনের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল – হাঙ্গেরি ১৯৫৬, চেক ১৯৬৮। আরও শক্ত লোহায় তৈরি রাশিয়ান ট্যাঙ্ক এসে তার মোকাবিলা করে। আটের দশকে পোল্যান্ডে মানুষেরা রাস্তায় নামলেন – তাঁরা এই লৌহ-যবনিকায় যে হাতুড়ির আঘাত হেনেছিলেন, তার আওয়াজ থামাতে শ্রমিক-কৃষকের স্বর্গরাজ্য থেকে কোনো সাঁজোয়া গাড়ি ওয়ারশ-র পথে দেখা দেয়নি।
গোটা ১৯৮৯ সাল জুড়ে পূর্ব ইউরোপে, বিশেষ করে পূর্ব জার্মানির পথে পথে বিক্ষুদ্ধ জনতা – তাদের প্রাথমিক দাবি যাতায়াতের স্বাধীনতা। হাঙ্গেরি এবং চেকোস্লোভাকিয়া যেতে কোনো বাধা নেই – সাম্যবাদের লড়াকু সেপাই তারা। জুন মাস নাগাদ হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ার মাঝের কাঁটাতার নির্মূল হলে’পর মুক্ত পৃথিবীতে যাওয়ার আশায় হাজার হাজার পূর্ব জার্মান ভিড় করেছেন প্রাগ ও বুদাপেস্টের পশ্চিম জার্মান এমব্যাসিতে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তা মিকাহিল গর্বাচেভ পেরেস্ত্রইকার মাদুলি পরে গ্লাসনস্তের মালা ঘুরোচ্ছেন।
রাশিয়ান ট্যাঙ্কের দেখা নেই।
অদম্য ইহুদি কৌতুক তার ব্যাখ্যা দিয়েছিল।
মাংসের দোকানে কিছুই না পেয়ে নাথান চেঁচামেচি করেছে। তৎক্ষণাৎ কেজিবি-র লোক তাকে বেঁধে নিয়ে গেল মস্কোর লুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারের অফিসে।
অফিসার গ্রোনেনকো: কমরেড নাথান অলেগোভিচ! কমরেড স্টালিনের আমলে এ ধরনের মন্তব্য করলে গুলি খেতেন। আমরা অতটা নিষ্ঠুর নই। তবে সাবধান করে দিচ্ছি – মনের কথা মনেই রাখুন। চেঁচামেচি করে পাড়া মাত করবেন না।
নাথানের ধরা পড়ার খবর শুনে উদ্বিগ্ন পড়শি নাফতালি খবর নিতে এসেছে।
নাথান: ভাবিস না। দোকানে মাংস নেই, কিন্তু কেজিবি-র বন্দুকের গুলিও শেষ।
বার্লিন দেওয়াল তখনও আপন মহিমায় বিরাজিত। পূর্ব জার্মানির দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রনেতা এরিখ হোনেকারকে সরিয়ে দিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে। নতুন প্রভু এগোন ক্রেন্তস ধরে নিলেন পুব-পশ্চিমে আসা যাওয়ার ব্যাপারটা সহজ করে দিলেই জনরোষ কমবে, তারপরে দেখা যাবে।
নভেম্বরের আট তারিখে পলিটব্যুরোর মিটিঙে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। দশ নভেম্বর থেকে দরখাস্ত করলেই পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার অনুমতি মিলবে, কোনো বিশেষ কারণ দেখানোর প্রয়োজন নেই। ক্রেন্তস এই মর্মে হাতে লেখা একটা নোট গুঁজে দিলেন পার্টির বিশ্বস্ত সদস্য এবং বেসরকারি মুখপাত্র গুইন্টার জাবোসকির পকেটে। একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জাবোসকি সেই ঘোষণা করবেন।
জনা কুড়ি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে লাইভ টেলিভিশনে জাবোসকি জানালেন, প্রাগ বা বুদাপেস্ত দিয়ে কেন, পূর্ব জার্মানির মানুষ সরাসরি পশ্চিমে যেতে পারবেন তাঁদের আপন ইচ্ছা ও প্রয়োজনমত। পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে পঠিত খবরের কাগজ বিলডের পিটার ব্রিঙ্কমান জানতে চাইলেন ভ্রমণের ব্যাপারে এই শিথিলতা কবে থেকে চালু হবে। জাবোসকি একটু বিভ্রান্ত হয়ে এগোন ক্রেন্তসের নোট উলটে-পালটে দেখে বললেন, “আমার মতে, এই মুহূর্তে, অবিলম্বে (জোফোরট, উনফেরতসুগলিখ)”। বার্লিন দেওয়াল সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না, কারণ সেটা সামগ্রিক নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত।
বার্লিনে সন্ধ্যে ৬.৫৩ – মস্কোয় ৭.৫৩ – ওয়াশিংটনে দুপুর ১২.৫৩।
সোয়া সাতটায় পশ্চিম জার্মান টেলিভিশন যা জানাল, তার সারাংশ – খুল গয়া! খবর চাউর হয়ে গেলে, পূর্ব বার্লিনের হাজার হাজার মানুষ ছেনি, হাতুড়ি, শাবল – যা পেলেন, তাই নিয়ে বার্লিনের বিভাজক দেওয়ালটিকে ভাঙার কাজে লেগে গেলেন। জনতার রক্ষী (ফোলকসপোলিতসাই) অদৃশ্য।
প্রাচীরের পতন আসন্ন ছিল, তবে জাবোসকির অসতর্ক মন্তব্যে ইতিহাসের পাতা উলটে গেল তাড়াতাড়ি। আজ আমরা সেদিনটিকে লৌহকপাট ভেঙে ফেলার দিন বলে স্মরণ করে থাকি।
স্বর্গীয় শান্তির দ্বারে (তিয়ানানমেন স্কোয়ারে) অবশ্য ততদিনে চিনা ট্যাঙ্ক মুক্তির মন্দির সোপানতলে অনেক প্রাণ বলি দিয়ে স্বাধীনতার শখকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
লাল ফৌজের ছাউনি আছে পূর্ব বার্লিনে। দুশ’ কিলোমিটার দূরে ড্রেসডেনের কেজিবি অফিসে মস্কোর হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছেন ৩৭ বছরের ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। মিখাইল গর্বাচেভ রাশিয়ান সৈন্য পাঠালেন না, ওয়ারশ চুক্তির মিত্রদের ডাকলেন না।
কেজিবি-র বন্দুকের গুলিও শেষ।
তিন সপ্তাহ বাদে মাল্টায় গর্বাচেভ এবং বুশ দুনিয়াকে জানালেন ঠান্ডা লড়াই শেষ। লৌহ যবনিকার বিনাশ।
টেলিভিশনে ব্রায়ান হ্যানরাহান যখন এই যুগান্তকারী ঘটনাবলির বর্ণনা দিচ্ছেন, আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছি বারো বছর আগের সেই দিনটার কথা – যেদিন আমি পশ্চিম বার্লিনের পতসডামার প্লাতসে একটা কাঠের পাটাতনের ওপরে উঠে প্রথম পূর্ব বার্লিন দেখি। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ধূসর মাটি, ভাঙাচোরা চ্যান্সেলরির বাড়ি – যার নীচে ছিল হিটলারের বাঙ্কার, গোয়েরিঙের হাওয়া অফিস। সে মাত্র বত্রিশ বছর আগের কথা। লোকে কেতাবে পড়ে – আমি চোখের সামনে ইতিহাস দেখছি।
ঠিক এই সময়ে জার্মানি ফিরব? কাজে? কোইন্সিডেনসের বাংলা কী? সমাপতন কি একেই বলে?
১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে মিশরের লুক্সরে কাগজপত্রে সই করে নতুন চাকরিতে যোগ দিলাম। আমার দেখা সিটি একটা অখণ্ড প্রতিষ্ঠান ছিল না – ছিল অজস্র কুটিরশিল্পের সমবায়। একটা দফতর ঠিক কী যে করে – অন্য দফতর সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকেছে। ফলে একই খদ্দেরকে নিয়ে দুইপ্রান্তে টানাটানি হতে দেখেছি। লয়েডস ব্যাঙ্কের সাইমন পেনিসটন একবার বলেছিলেন, যখনই সিটি ব্যাঙ্কের কর্তারা মনে করেন কর্মীগণ ব্যাঙ্কের সংবিধান ও কর্মপদ্ধতি বুঝে ফেলেছে, তখনই তাঁরা সেটিকে বদলে দিয়ে নতুন ধন্দের সৃষ্টি করেন! আমি যে বিভাগে যোগ দিলাম, তার নাম গ্লোবাল পেমেন্ট প্রোডাক্ট সার্ভিস। তাঁরা খুব গর্বের সঙ্গে বলেন, বাকি ব্যাঙ্কের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই!
এবার শুরু হল জার্মানভাষী ইউরোপে আমার নিত্য আসা-যাওয়া, প্রায় প্রতি সপ্তাহে। যদিও ব্যাঙ্ক দিয়েছে আমার নিজস্ব অফিস, গাড়ি রাখার ব্যবস্থা – কিন্তু লন্ডনে কদাচিৎ থাকি। দু’ বছরের ছেলে ইন্দ্রনীল মনে করত আমি হিথরোতে কাজ করি। আমাদের খদ্দেরের তালিকা আলাদা – মার্কেট সার্ভে করে নিজেরাই ঠিক করি বলির পাঁঠা কোথায় ধরব। মিউনিক, ব্রেমেন, হামবুর্গ, কলোন – যেখানেই হোক না কেন, প্লেন থেকে নেমে গাড়ি ভাড়া করি আর খদ্দেরের অফিসে হানা দিই। সম্পূর্ণ স্বাধীন। নিজেই নিজের প্ল্যান ঠিক করি। কোথায় কখন যাব। কোথায় থাকব। মোবাইল ফোন আসেনি। কাজেই আমার টিকিটি ধরার উপায় নেই কারো। কোথায় আছি বা না আছি – আমার কর্তার জানবার উপায় নেই। এই কাজের দৌলতে দেড় বছরে জার্মানি দেশটা দেখলাম। আট বছর জার্মানিতে থেকে কিছুই দেখিনি।
হাইকে থাকে স্টাডরোডাতে। বাড়ির ফোন, যাকে আমরা আজকাল ল্যান্ডলাইন বলে জানি, তখন দুর্লভ। একবার লিখেছিল, স্টাডরোডায় ফোন থাকে পুলিশের আর দমকলের অফিসে। আমি লিখেছিলাম, তাদের না হয় আছে, কিন্তু যার বাড়িতে আগুন লাগল সে কীভাবে জানাবে? হাইকেকে জানালাম – দু’দেশের মাঝখানের বেড়া ভেঙে গেছে। তুমি তো নবজাত পুত্র টরস্টেনকে নিয়ে বাড়িতেই থাক। যে কোনোদিন হাজির হব।
সুযোগ জুটল। সে সপ্তাহে আমার কাজ পড়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট অঞ্চলে। রাইন মাইন ফ্লুগ হাফেনে নেমেই গাড়ি নিয়েছি। ঠিক করলাম স্টাডরোডা যাব। কাজে একদিন ফাঁকি দিলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অচল হবে না।
এই যাত্রাটি অবিস্মরণীয়। অনেক কারণে। এত বছরের চেনা দেশের চেনা সীমানা বিলুপ্ত। সরকারীভাবে দুই দেশ তখনো আলাদা, কিন্তু সীমান্ত অরক্ষিত। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, লোহার দেওয়াল – মানুষকে, গাড়িকে আটকানোর আরও কত রকমের যে কলকব্জা পড়ে আছে – সেগুলো দেখলে জানা যায় ধনতন্ত্র কোথায় শেষ আর সাম্যবাদ শুরু। সশস্ত্র প্রহরীবৃন্দ অদৃশ্য। গাড়ি চালাচ্ছি সেই অটোবানে, যেটিকে ত্যাগ করে বিপথে যাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল! পথে অনেক ত্রাবান্ত, ওয়ারটবুর্গ – তাদের নিতান্ত খেলনা গাড়ি মনে হয়। অটোবানের মাঝে কোনো রেলিং নেই। এবার একটু অন্য রাস্তা নিলাম। ম্যাপে দেখেছি ইয়েনা (যেটাকে আমরা জেনা বলে চিনি) হয়ে স্টাডরোডা যাওয়া যায়। নতুন ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নেয়া যাক তবে!
১৮০৬ সালে ইয়েনাতে প্রাশিয়ানদের বেধড়ক পিটিয়ে নাপোলেওঁ তাদের রাজত্বকে অর্ধেক করে দিলেন। শেষ পুণ্য রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রান্তস পোপকে চিঠি লিখে পদত্যাগ করে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়ার রাজত্ব সামলালেন। জার্মানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে ফরাসীদের এই শেষ বিজয়ের স্মারক – সেইন নদীর ওপরে একটি সেতু : তার নাম পঁ দে ইয়েনা (ইয়েনা সেতু)। পরের বার আইফেল টাওয়ার থেকে ট্রকাদেরো যাবার সময়ে লক্ষ করবেন সেটি।
ইয়েনাতে অটোবান ছেড়ে স্টাডরোডা যাব। রাস্তার অবস্থা সঙ্গিন, বহুদিন মেরামত হয়নি। এবার পড়ল একটি লেভেল ক্রসিং (এখন তার ওপরে ফ্লাই বনে গেছে)। গেট বন্ধ। রেডিওতে হেসেন দ্রাই শুনছি আনমনে। জুন মাসের দুপুর, কেউ কোথাও নেই, ট্রেন কখন আসবে কে জানে। ইতিউতি দেখছি।
দুটো দৃশ্য মনে গেঁথে আছে আজও।
পেছন দিকে ইয়েনা শহর। সেদিকে তাকালে দেখি – একটু উঁচুতে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দশতলা ফ্ল্যাট বাড়ি। আকাশের পটভূমিকায় মনে হয় যেন সারি সারি দৈত্য চেয়ে আছে আমার দিকে। যতদূর দেখা যায় ততগুলো দৈত্য। তিন বছর পরে রাশিয়ার মুরমান্সক দেখে এই একই অনুভূতি হয়েছিল।
এক সময় ট্রেন এল। প্রথমে মালগাড়ি। তারপরে এল দেশে দেখা কু-ঝিক-ঝিক যাত্রীবাহী ট্রেন। দুটোরই চেহারা জীর্ণ। জানলা-দরজা খসে পড়তে পারে যে কোনো সময়ে। আমাদের দেশের ট্রেন এর চেয়ে স্বাস্থ্যবান। ভাবছিলাম, রাজনৈতিক পুনর্মিলন তো না হয় হল। অর্থনৈতিক পুনর্জীবন হবে কবে? আদৌ হবে কি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে লুডভিগ এরহার্ড এনেছিলেন অর্থনৈতিক অলৌকিক পুনর্জীবন (ভিরটশাফটসউনডার)। এবারে যে আরেকটি উনডার প্রয়োজন! বার্লিন দেওয়ালের পতনের পরে আঙ্গেলা মেরকেল বলেছিলেন, আশা করি এবার কাঁচের জানলাগুলো পোক্ত হবে, ঠান্ডা হাওয়া ঢুকবে না হু হু করে!
ইয়েনা থেকে স্টাডরোডা মেরে কেটে বিশ কিলোমিটার। পথে দুটো গ্রাম পড়ল – ৎসলনিতস আর লাসডরফ। এ পথে যারা বার বার যান, তাঁদের গাড়ির সাসপেনশন কতদিন টেকে? বাড়ির চেহারা প্রায় সবার একইরকম। ধূসর বা বিবর্ণ। বহু বছর রঙ হয়নি। শ্যাওলা লেগে আছে দেওয়ালে। জানলা-দরজা অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরনো। হাওয়াতে একটা কটু গন্ধ। পরে জেনেছিলাম, সেটি ওই ত্রাবান্ত ওয়ারটবুর্গ গাড়িগুলির দ্বারা উৎপাদিত দূষণ। সে গাড়ির এঞ্জিন হল টু স্ট্রোক। তাই দূষণ ক্ষমতা অতি উচ্চস্তরের। ছোটখাটো দোকান চোখে পড়ল। আমাদের রাস্তার ধারের পান দোকান বা মুদির দোকানের মত।
স্টাডরোডার রাস্তা পাথরে বাঁধানো। এককালে ঘোড়া এবং ঘোড়ার গাড়ি, পরে মোটরগাড়ি চলে সে পথ পালিশ হয়ে গেছে। বৃষ্টির দিনে হাঁটলে পা সিলিপ করার চান্স। গল্প অনুযায়ী গোয়েথের ফাউসট এখানে জন্মেছিলেন। ঘোড়া এবং তাদের টানা গাড়ির পক্ষে পাথুরে রাস্তা খুব মানানসই। গাড়ি ভেঙে যাবে, কিন্তু পথ অবিনশ্বর। সে সব গাড়ির ঝাঁকুনি আরোহীরা অবলীলাক্রমে হজম করতেন। আজকের স্বতশ্চলশকট আরোহী সেটা মোটে পছন্দ করেন না। কিন্তু এই পাথুরে রাস্তায় হাল ফ্যাশনের মোটর গাড়ির যাত্রীর কপালে সেই ঝাঁকুনি জোটে। কাগজে লেখ নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে। পাথুরে রাস্তা চিরদিন রয়ে যাবে।
এটি গ্রাম নয়, শহর – হাজার পাঁচেক লোকের বাস। এককালের ধনী ব্যক্তিদের আবাসন চোখে পড়ে, যার মেরামত আজই শুরু করা উচিত। বিবর্ণ দেওয়াল। চালের টালি কিছু আছে, কিছু নেই। ত্রেপল চোখে পড়ে কোনো কোনো চালে। রাস্তার নাম প্রায় কোথাও লেখা নেই। আমি উত্তর কলকাতায় বড় হয়েছি। রাস্তার নাম জানতাম। লেখা আছে কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত হইনি। পাইকপাড়া বরানগরে ক’জন বিদেশি নিত্য মুখুজ্জে লেন খুঁজবেন? কিন্তু ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে – সেটা ভাবা যায় না। কোন ঠিকানায় যাব জানি। পাঁচ বছর চিঠি লিখি। মাকস শিফারডেকার স্ত্রাসে ১৩। রাস্তায় অনেক লোক। কেউ গল্প করছে কারো বাড়ির রেলিঙ ধরে। রাস্তায় বয়স্ক মানুষ বসেছেন টুল পেতে। ধূমায়িত মুখ। পথ চলতি মানুষ থেমে দুটো কথা বলে আবার চলেছেন। কোথাও কারো ব্যস্ততা নেই।
গাড়ি থামিয়ে একজনকে জিগ্যেস করলে তিনজন জানলার সামনে হাজির হলেন। সবার হাতে অনন্ত সময়।
ওয়েলেসলির গলিতে কলিম খানের আস্তানা খুঁজে পেয়েছি। মাকস শিফারডেকার স্ত্রাসের ১৩ নম্বর চাক্ষুষ করা শক্ত হল না। আঠারো বছরের যে হাইকেকে দেখেছিলাম, সে এখন প্রায় তিরিশ। একটি পুত্র সন্তানের জননী, গৃহিণী।
বাড়ির অবস্থান খুব সুন্দর। দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ উঠতে হয়। উথমানস্ত্রাসের বাড়ি ছিল একেবারে রাস্তার ওপরে। ফুটপাথ বরাবর। এ বাড়িটি শ্যেনে আউসসিখট বা সুন্দর দৃশ্য নামক আরেকটি রাস্তার কোণায়। একটু উঁচুতে বলে তাদের বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়, সবুজে ঢাকা। বেলা তিনটে বাজে। গ্রীষ্মের আলোয় ভরে আছে দিগন্ত। মাথার চুল কমে গেলেও হাইকের মা এরিকা আমাকে চিনলেন।
রান্নাঘর আজ আর পারিবারিক সম্মিলনী মঞ্চ নয়। নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। সেখানে সোফা আছে, কফি টেবিল আছে। সাধারণ সামগ্রী সুন্দরভাবে সাজানো। ফ্রাঙ্কফুর্টের ডিএম নামক দোকান থেকে যা যা কিনেছিলাম, হাইকের হাতে তুলে দিলাম। আমি আর কী জানি? দোকানের মহিলাকে বলেছিলাম, এক বছরের ছেলের জন্যে যা যা নিতে পারি দিয়ে দিন। এই ডিএম দোকানে সকল প্রকার কসমেটিক বস্তু মেলে অতীব সুলভে। এ সবের উপযোগ হাইকে নিশ্চয় খুঁজে পাবে! পশ্চিমের যে কোনো জিনিস এখনো বিস্ময়বহ। দুয়ার খুলেছে বটে, তবু সব এখানে পাওয়া যায় না। দাম বেশি। হাইকের বর ফ্রাংক ফিরল কাজ থেকে। সে আমার কথা শুনেছে। বললে, চাক্ষুষ করার বাসনা পূর্ণ হল এতদিনে।
এগারো বছর আগের সেই দিনের মতন পাশের বাড়ির ও তার পাশের বাড়ির কিছু পড়শি হাজির হলেন। হ্যারমেসডর্ফের তুলনায় সংখ্যায় কম। এখন ফোপো বা ফোলকসপোলিতসাই কোথাও ওঁত পেতে নেই। স্টাজি হয়তো আছে কোথাও। তবে এখন সবই বদলাচ্ছে। তারাও বদলাবে।
মহিলাদের কাছে আমি আরেক কৌতূহলের উপাদান। ভারতীয় বা বাদামী রঙের মানুষ দেখেননি। আমার হাতের কাছে নিজের হাত নিয়ে এসে রঙটা দেখে নিলেন – এটা আমার আদত গাত্রবর্ণ কিনা – হ্যারমেসডরফের এসব প্রশ্ন পাইনি – ভীতি বাধা ছিল অনেক। এমন একজন মানুষ হাইকের বন্ধু হল কেমন করে? মা এরিকা আমাদের আকস্মিক আগমনের সেই গল্প একবার করলেন, তিনবার করলেন, অনেকবার করলেন। সাখসেনের জার্মান উচ্চারণ, তাদের ডায়ালেক্ট আমার কানে বড় মিষ্টি শোনায়, একটা অন্তরের টান আসে সামান্য সৌজন্যের প্রকাশে। সে যে কত কথা কত গল্প। কথায় কথায় সন্ধে। আমার কোনো চিন্তা নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট বড়জোর দু’ঘণ্টার ড্রাইভ। সীমানা পেরুনোর ঝক্কি নেই। আকাশের আলো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবে আমার জন্য।
পশ্চিম এখানে অতটা অচেনা অজানা নয়। আসতে-যেতে কোনো বাধা নেই। গত ডিসেম্বর মাস থেকে সীমান্তে পুলিশ নেই। রাস্তাঘাটে কেউ চোখ রাঙায় না। মুদ্রা এখনো আলাদা, তবে জার্মান মার্ক সহজেই ব্যবহার করা যায়। হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হয় না আগের মত, এ টাকা কোথায় পেলে! বাজারে গুজব, শিগগির দু’দেশের টাকা এক হয়ে যাবে। জার্মান মার্ক গোটা দেশের জাতীয় মুদ্রা হবে (এক মাস বাদে তা-ই হয়)। সকলেই কাউকে না কাউকে চেনেন, যে অন্তত একবার হামবুর্গ, হানোভার ঘুরে এসেছে। কারো ছেলে বা মেয়ে মিউনিক, নুরেমবের্গ গেছে কাজ করতে। সেখানে সবাই জার্মান বলে, তবু সেটা বিদেশ! প্রথমেই চোখে পড়েছে ঝকঝকে রাস্তাঘাট, চকচকে গাড়ি, ঝলমলে পোশাক! সবকিছুর দাম বেশি। আগ্রহের ও প্রশ্নের অন্ত নেই। আমাদের গ্রামের মত মনে হল আবার। একজনের ঘরে অতিথি এসেছে – যেন গ্রামের সবার সে অতিথি! আমি তাদের গল্প শুনতে চাই। এই যে এত বড় একটা পরিবর্তন হল (জার্মানে ওয়েনডে): কী মনে হচ্ছে। ভালো হবে এ আশা করেন সবাই। বয়স্ক মানুষেরা ভয় পাচ্ছেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেই আলোকিত পৃথিবীর পথে প্রস্থান করবে। সুযোগ যখন আছে, কে থাকতে চাইবে এই পুরনো রঙ-ওঠা (ফারবেনলোস) স্টাডরোডা শহরে? না আছে কাজকর্ম, না আছে কোনো ভবিষ্যৎ। একজন সম্প্রতি লাইপতসিগ ঘুরে এসেছেন। পশ্চিমের প্রলোভনে তরুণ তরুণীরা সে শহর থেকে বিদায় নিচ্ছে দলে দলে। লাইপতসিগ শিগগির বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হবে।
এক বয়স্কা মহিলা আরেক কাহিনী শোনালেন। তিনি কাজ করেন একটি চিনেমাটির বাসনপত্র বানানোর কারখানায় (পরতসেলানফাব্রিক), স্টাডরোডার কাছেই। সম্প্রতি তাঁর ম্যানেজার তাঁকে ডেকে বলেছেন, কারখানায় নতুন মেশিন বসছে। হাতের কাজ করার লোকের প্রয়োজন কম। দু’মাসের মধ্যে তাঁর মাইনে চুকিয়ে ছুটি দেওয়া হবে। তিনি সবাইকে লক্ষ করে বললেন, তোমরা কেউ ভাবতে পার? সবে পঞ্চান্ন হল, অবসর নিতে পুরো দশ বছর বাকি। বলে আর কাজ থাকবে না? কাজ কখনো যায়? এমন কেউ কখনো শুনেছ?
সেই বেদনাময় মুহূর্তে বুঝলাম, এঁরা যে সমাজ ও অর্থনীতিক ব্যবস্থা দেখেছেন, সেখানে কারো চাকরি যেত না। প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ুক না বাড়ুক, একটা বেতন সবার প্রাপ্য। সরকারের এক দপ্তর উৎপাদন করে, দাম ঠিক করে। অন্য দফতর সেটা কেনে। মার্কেটিং নামক বিজ্ঞান এখানে অপ্রয়োজনীয়। সেই সন্ধেয় হয়তো বুঝেছিলাম কেন গর্বাচেভ পেরেস্ত্রয়কা এনে লাভ-লোকসানের মত মার্ক্স-বিরোধী প্রসঙ্গ তুলেছেন। গ্লাসনস্ত বা স্বচ্ছতার অভিযান কি এই কথাটাই বোঝাতে, যে এই ব্যবস্থা টিকবে না, টিকবার নয়? অঙ্কটা মিলছে না। মার্ক্সীয় সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বার কারণ কি অর্থনীতি? মাক্স শিফারডেকারস্ত্রাসের এই সন্ধ্যায় দ্বান্দিক বস্তুবাদ আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক আলোচনা একান্ত অর্থহীন।
কিছুদিন আগে বায়ারিশে লান্দেসব্যাঙ্কের স্টেফানের কাছে একটা গল্প শুনেছি। তাদের কোবুর্গ (সাক্সা-কোবুর্গ-গথা, প্রিন্স আলবার্টের রাজত্ব) ব্রাঞ্চের একতলায় একটা পার্টি চলছিল শুক্রবারে, কাজের শেষে। বড় বড় কাঁচের জানালা-দরোজা একেবারে রাস্তার লাগোয়া – কোনো পরদার আড়াল নেই, ফুটপাথ থেকে পরিষ্কার ভেতরটা দেখা যায়। স্টেফান লক্ষ করে রাস্তায় বেশ কিছু মানুষ প্রায় কাঁচের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে অবাক হয়ে এই সুবেশ নরনারীদের পান ভোজনের দৃশ্য দেখছে। সকলেই (তখনও) নিকটবর্তী পূর্ব জার্মানির লোক। স্টেফান বলেছিল, সেই মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল, দুই সমাজের ব্যবধান বিশাল – শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কি সম্ভব হবে? কতদিন লাগবে?
হেরো, ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে?
আমি যে হৃদয়হীন পশ্চিমে ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে কাজ করছি বছরের পর বছর, সিটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমার কর্মচুক্তি যে কোনো পক্ষের তিরিশ দিনের নোটিসে সমাপ্ত হতে পারে – সে কথা বলার সময় এটা নয়। আমি একটা জুতসই অর্থহীন জবাব খুঁজছি। পাচ্ছি না। সেই মহিলা অবশ্য পেনশন পাবেন। পূর্ব জার্মান মার্কে তার মূল্য যৎসামান্য। পরে রোমানিয়াতে আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখেছি এক নগণ্য ন্যূনতম পেনশন নিয়ে কর্মজীবনের ইতি করতে। দুই পৃথিবীর সংঘর্ষ আসন্ন।
ইতিহাসে দ্বিতীয়বার জার্মানি এক হতে যাচ্ছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী অক্টোবর মাসের তিন তারিখে।
হাইকে আর ফ্রাংকের সঙ্গে অনেক গল্প হল। তারা পশ্চিমপানে ধাওয়া করতে রাজি নয়। হাইকের মনে একটা অসম্ভব আস্থা দেখলাম। সে বললে, দেখ আমি রাজনীতি, অর্থনীতি কিছু বুঝি না। আমার মনে হয়, আমাদের দেশ যখন এক হয়েছে, সবার দশা একই রকম হবে! হয় সবাই গরিব, নয় সবাই বড়লোক! এখনো সাম্যবাদী চিন্তা!
আমরা হাসলাম।
প্রচুর খাওয়াদাওয়ার পরে বেরুতে প্রায় ন’টা বাজল। তখনো কত আলো। বাদ হের্সফেলডের পথে যাবার সময় মনে হল, এ দেশ গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বজোড়া মন্দা, তা থেকে মুক্তি দেখেছে, ইউরোপ শাসন করেছে, দেখেছে বিধ্বংসী যুদ্ধ, ভাঙাচোরা দেশে আবার সুদিন আসবে ভেবে চল্লিশ বছর একটা সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করেছে। আজ সে বিশ্বাস হারানোর দিন।
বিনিময়ে প্রাপ্তি কী?
জুন ১৯৯০