বুদাপেস্ত থেকে ব্রাতিস্লাভা যাবো। দানিউবের পাশে সিংহ সেতুর কোনায় ইন্টার কনটিনেনটাল হোটেলের বয়স্ক কন্সিয়ার্জের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল একাধিকবার সাক্ষাতের কারণে। তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ইংরেজি, জার্মান এবং কিমাশ্চর্যম, রোমানিয়ান অবধি বলেন। হাঙ্গেরি ও বুদা এবং পেস্ট সম্বন্ধে তাঁর কাছে অনেক তথ্য আহরণ করি যা উইকিপিদিয়াতে মেলে না।
গাড়িতে উঠতে দেখে টিবর এগিয়ে এলেন।
- ভিয়েনা ফিরছেন?
- না, ঠিক সিধে নয়। ব্রাতিস্লাভায় কাজ আছে। আচ্ছা যেভাবে এসেছি সেই পথেই তাতাবানিয়া হয়ে এম ওয়ান ধরে যাবো? একটু ঘুর হয়ে যাবে না?
- তা হবে, কিন্তু আরেকটা রাস্তাও নিতে পারেন। এম ওয়ান ধরুন, যেমন এসেছেন, খানিক গিয়েই পাবেন চেম, সেখানে ডাইনে ঘুরে দানিউব নদী পার হয়ে কমারোম নেমেসোচা দিওসফরগেপাতোনি পেরিয়ে পঝনি পৌঁছে যাবেন; মানে এসেছিলেন দানিউবের ডানদিক ধরে, ফিরবেন বাঁ দিক ধরে!
গুগলের আবির্ভাবের দশ বছর আগে থেকেই ম্যাপ দেখে ইউরোপে গাড়ি চালাচ্ছি। হল্যান্ডের মাসট্রিখটে প্লেন থেকে নেমেছি, যাবো বেলজিয়ামের লিয়েজ হয়ে জার্মানির আখেন কিন্তু মোটরওয়ের বোর্ডে সে নাম নেই-আছে Luik, Lüttich, Aken Aix-la-Chapelle–বুঝ গুণী যে জানো সন্ধান! টিবরের মুখে শোনা নামগুলো সেই রকম অচেনা ঠেকল!
আমি কিছু বলার আগেই টিবর একটু বিব্রত মুখে বললেন, দুঃখিত, কিছু না ভেবেই আপনাকে রাস্তার শহর গ্রামের হাঙ্গেরিয়ান নামগুলো বলে ফেলেছি; এদের আজকের পরিচয় স্লোভাক নামে, সেটা আপনি গুগলে অবশ্য ঠিক পেয়ে যাবেন : যেমন নেমেসোচা হল জেমিয়ান্সকা অলচা!
আমি বললাম, হল্যান্ড, চেক, পোল্যান্ড বা রোমানিয়াতে তাদের ভাষার পাশাপাশি হাজার হাজার জার্মান নামের সঙ্গেও আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় আছে–হাঙ্গেরিয়ানটা নতুন যোগ হলো।
দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপে গিয়ে আমার ইউরোপীয় ইতিহাস ও ভূগোলের জ্ঞানের খামতিটা ক্রমশ বুঝেছি।
একদা ইউরোপের মাঝখানে কোথাও বসবাস করতেন স্লাভ জাতি। কালে খাদ্যের অকুলান হলো, নিয়মিত তুরকিক অভিযানে জীবন বিপর্যস্ত–দেড় হাজার বছর আগে ভাগ্য সন্ধানে তাঁরা ইউরোপের তিন দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পোল্যান্ডের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তিন স্লাভিক ভাই, লেখ চেখ রুশ গেলেন তিন দিকে–উত্তর দিকে লেখ, পুবে রুশ দক্ষিণে চেখ। লেখ বাসা বাঁধলেন আজকের পোল্যান্ডে (লেখ নামক বিয়ার তাঁর নামকে অমর করে রেখেছে) বেলারুশ; রুশ যেখানে থামলেন সেটি আজকের রাশিয়া, ইউক্রেন (আক্ষরিক অর্থে সীমানা), চেখ ভাই গেলেন দক্ষিণে, আজকের বলকান অবধি। কালক্রমে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন সকলে। পশ্চিমে কেন যান নি তার কোন ব্যাখ্যা পাই নি। হয়তো বর্বর গথ ভিসিগথ জাতির নৃশংস আচরণের কাহিনী শুনেছিলেন অথবা এই তিন অঞ্চলে তাঁরা পেলেন বাসযোগ্য ভূমি; লোভ বাড়ান নি। ইতিহাসের কি বিচিত্র পরিহাস-স্লাভ হারাবে তাদের আপন রাজ্য ; হাবসবুরগ, হোহেনজোলারন/প্রাশিয়ান রাজারা শাসন করবেন সকল স্লাভ জাতিকে*, দক্ষিণে এলো অটোমান। এরই মাঝে হাবসবুরগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাঙ্গেরিয়ানরা দখল করলো আধখানা বলকান, আজকের স্লোভাকিয়া। একমাত্র ব্যতিক্রম স্লাভিক রুশ যারা অন্য স্লাভেদের ওপরে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করবে।
একদিন পশ্চিমের সেই গথ ভিসিগথ ফ্রাংক উপজাতি, আজকের জার্মানি সরব হবে আপন স্বার্থে স্লাভ বাসভূমি দখলের দাবিতে-নাৎসি অভ্যুদয়ের বহু আগেই জার্মান মনিষীরা বললেন ইংরেজ, ফরাসি, স্প্যানিশ বা ডাচের কলোনি আছে নানান মহাদেশে। আমরা ইউরোপে খুঁজে নেবো আমাদের বাসভূমি (লেবেনসরাউম)-সে জমি আছে পুবে। পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ইউরোপের ইতিহাস নির্মম স্লাভ দমনের কাহিনী–পুবের পানে ধাও (দ্রাং নাখ অস্টেন)।
১৯১৪ সালে সারায়েভোতে ল্যাটিন ব্রিজের পাশে অস্ট্রিয়ান রাজকুমারের ওপরে যে গুলি বর্ষিত হয় সেটি ছিল স্লাভিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবির বজ্র নির্ঘোষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে পোল্যান্ড নামক দেশটির পুনরাবির্ভাব হল, ক্রোয়াট ও স্লোভেনদের আপন দেশ (পরবর্তী কালে ইউগোস্লাভিয়া– দক্ষিণ স্লাভ), চেক এবং স্লোভাকদের দেশ-চেকোস্লোভাকিয়া। যিশুর ভজনা সকলেই করেন, তবে কেউ ক্যাথলিক, কেউ প্রটেস্টান্ট বাকিরা অর্থোডক্স, বসনিয়াতে মুসলিম–ইহুদিদের সঙ্গে তেমন বিরোধ নেই। বুলগারিয়া, সার্বিয়া সিরিলিক অক্ষরে লেখে। ভাষার দিকে দিয়ে স্লাভ জাতি প্রায় অভিন্ন এবং ইন্দো ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সদস্য। শয়ে শয়ে শব্দ আছে যাদের আপনি আমি খুব চিনি–পোলিশে পিঞ্চ মানে পাঁচ, রাশিয়ানে নিঝনি মানে নিচু, নভ নব, নতুন, গরদ গড় : নিঝনি নভ গরদ, নিচু নতুন নগর। চেক ভাষায় দেন আমাদের দিন, সারবো ক্রোয়াটে চিচা মানে কাকা।
হাবসবুরগ রাজবংশের পতনের আগে অবধি দক্ষিণ ও পশ্চিম স্লাভিক দেশগুলি ছিল ভিয়েনার অধীনে। বিশাল সাম্রাজ্য হারিয়ে অস্ট্রিয়া আজ এক কোটিরও কম মানুষের ছোট্ট দেশ। তবে পুরনো সাম্রাজ্যের রেশ দেখা যায় সর্বত্র। ভিয়েনা শোয়েখাট বিমান বন্দরে প্লেন নামার ঠিক আগে জানলার বাইরে একটি আলোকিত শহর দেখছিলাম কৌতূহলের সঙ্গে-অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান বালিকা আমাকে বললেন, ওটা ভিয়েনার নয়, ব্রাতিস্লাভার আলো! এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ভিয়েনা মুখো অটোবানে গাড়ি চালালে পরের পর সাইনবোর্ড চোখে পড়ে-এই দিকে প্রাগ (চেক) ব্রাতিস্লাভা (স্লোভাকিয়া) ওই রাস্তায় বুদাপেস্ট (হাঙ্গেরি) লুবলিয়ানা (স্লোভেনিয়া), জাগ্রেব (ক্রোয়েশিয়া )। সাম্রাজ্যের স্মৃতি।
হাবসবুরগ রাজবংশের পতনের পরে এবং দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে আগে অবধি স্লাভিক দেশগুলির অবস্থান ছিল বারুদের গাদায়। জার্মানি দখল করল চেক, পোল্যান্ড। তারপর একদিন অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাল বৃহত্তম স্লাভিক দেশের পানে-সে ঘোড়া ফিরল মৃতপ্রায় হয়ে।
পাঁচ বছরের জন্যে নাৎসি প্ররোচনায় স্লোভাকিয়া নামের দেশটি দেখা দিয়েছিল (১৯৩৯-১৯৪৫), পরে সেটি চেকের সঙ্গে মিশে যায়। ব্রাতিস্লাভা (স্লোভাক প্রেশপরক, হাঙ্গেরিয়ান পঝনি, জার্মান প্রেসবুরগ) নামের শহর কোনদিন ছিলো না ইতিহাস বা ভূগোলে। নদীর আরেকটু উজানে বুদা শহর তুর্কি কামানের গোলা গুলির রেঞ্জে পড়ে; অটোমান আক্রমণ থেকে রাজন্যবর্গ ও পারিষদদের প্রাণ বাঁচাতে বুদা হতে রাজধানী এই পঝনি শহরে স্থানান্তরিত হয়, সেটি তখন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর। অন্তত এক ডজন হাঙ্গেরিয়ান রাজার করোনেশান হয়েছে এখানকার গির্জেয়, আপামর জনসাধারণ হাঙ্গেরিয়ান বলেন। ১৮৬৭ সালে অস্ট্রিয়ান হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্মিলনের (পারসোনাল ইউনিয়ন) পরে এই অঞ্চল সরাসরি ভিয়েনা থেকে শাসিত, দলে দলে জার্মান ভাষা-ভাষী ভিড় করলেন, অচিরেই তাঁদের সংখ্যা হাঙ্গেরিয়ানদের ছাড়িয়ে যায়; হাঙ্গেরিয়ান পজনি পরিচিত হলো জার্মান প্রেসবুরগ নামে: প্যারিসে আর্ক দে ত্রিউম্ফকে ঘিরে যে বৃত্তাকার পথ আছে তার উত্তর ভাগের নাম রু দে টিলসিট, দক্ষিণ অংশের নাম রু দে প্রেসবুরগ! প্লাস দে লা কনকর্ড হতে শঁজে লিজে যেতে বাঁ হাতে পড়ে ; গত সপ্তাহে সে পথে গাড়ি চালাতে গিয়ে আবার লক্ষ করেছি।
১৯১৮ সালের আগে স্লোভাকিয়া নামের কোন দেশ ছিল না। নিজ বাসভূমে পরবাসীর তুল্য স্লোভাকের সংখ্যা দশ শতাংশের কম। উত্তর অংশ হাঙ্গেরিয়ান, দক্ষিণ হাবসবুরগ/জার্মান; মাতৃ ভাষাটা বলেন সন্তর্পণে আপন গৃহকোণে, দুটি একটি ছোটো গির্জে বাদে রবিবারের ভজনা হয় জার্মান ও হাঙ্গেরিয়ানে, স্লোভাক ভাষায় পাঠাভ্যাস সীমিত।
তারপর একদিন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজপাটের পতন হলো; দেশের নাম হল স্লোভাকিয়া, শহরের নাম ব্রাতিস্লাভা (আক্ষরিক অর্থে ভ্রাতৃ গৌরব) - পাশা উলটে গেলে প্রেসবুরগের জার্মান জনতা পশ্চিমে ভিয়েনা মুখে পাড়ি দিলেন, পঝনির হাঙ্গেরিয়ান মানুষ পূব পানে বিশ কিলো মিটার হেঁটে হাঙ্গেরি পৌঁছুলেন প্রায় রাতারাতি। মধ্য ইউরোপে ছিন্নমূল জন যাত্রার ইতিহাস গাঢ় বেদনার, অতি দীর্ঘ।
চেক এবং স্লোভাক ভাষায় পার্থক্য যে কোথায় বোঝা শক্ত। কিছু শব্দ ও উচ্চারণের ব্যবধান বাদে প্রায় একই-ডাচ আর ফ্লেমিশ ভাষার মতো। অস্ট্রিয়ান, সুইস আর জার্মানির জার্মান ভাষার পার্থক্য তার চেয়ে অনেক বেশি: স্লোভাক বর্ণ মালায় অবশ্য ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্ষরের সম্ভার (৪৬)। ধর্ম এক-কাগজে কলমে ক্যাথলিক, যদিও তুলনামূলক ভাবে চেকের চেয়ে বেশি সংখ্যক স্লোভাক রবিবারে গির্জেয় হাজরে দেন। ব্রাতিস্লাভায় আজ নব্বুই শতাংশ স্লোভাক, পাঁচ শতাংশ হাঙ্গেরিয়ান, কিছু চেক এবং অনেক খুঁজলে হয়তো দশটা জার্মান ভাষী পরিবার পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুদ্ধ শেষে আবার চেকোস্লোভাকিয়া। তবে এবারে সোভিয়েত প্রভাবিত অঞ্চল, পতাকায় কাস্তে হাতুড়ি। বছর চল্লিশেক বাদে বার্লিন দেওয়াল পতনের পরে এলো ভেলভেট বিপ্লব-রাশিয়ানরা পশ্চাদপসরণ করলেন, পতাকার রঙ বদলাল, ভোটের কাগজে নানা দলের নাম দেখা গেল। কয়েক বছর না ঘুরতে চেক ও স্লোভাক কোন লড়াই ঝগড়া নয়, ভদ্রভাবে বার্তালাপ করে দেশের সীমানা আলাদা করে নিলেন (আশ্চর্যভাবে সেটা মিলে যায় ১৯৩৯ সালের সীমা রেখার সঙ্গে!) যা আজ মখমল বিচ্ছেদ (ভেলভেট ডিভোর্স) নামে পরিচিত।
উত্তর হাঙ্গেরি আর দক্ষিণের হাবসবুরগ জমিদারি মিলিয়ে নতুন দেশ স্লোভাকিয়া, রাজধানীর নতুন নাম ব্রাতিস্লাভা (আক্ষরিক অর্থে ভ্রাতৃ গৌরব)।
দানিউবের (জার্মান ডোনাউ, স্লোভাকে দুনাই, হাঙ্গেরিয়ানে দুনা) উজানে ডাইনে পুরনো শহর, বাঁয়ে সোভিয়েত স্থাপত্যের কংক্রিট স্মৃতি বিজড়িত আবাস। সেই সোভিয়েত অঞ্চলে দেশলাই বাকসোর মতন একটি বহুতল অট্টালিকার তিন তলায় সিটি ব্যাঙ্কের অফিস; লিফট এতো বাজে ও ঢিমে তালে চলে, আমরা হেঁটেই উঠতাম। এর চেয়ে সস্তার কিছু হয়তো আমাদের জোটে নি! অপরূপ পুরনো শহরে (স্তারে মেসতো) মিটিং সেরে অফিস ফেরার সময়ে সিটি ব্যাঙ্কের প্রপার্টি ম্যানেজারের শাপ শাপান্ত করেছি! আর কিছু পেলেন না?
ব্রাতিস্লাভা ইউনিভারসিটিতে বিজনেস এবং কমার্স পাঠ শেষে তরুণ মারেক পটোমা আমাদের ব্যাঙ্কে ট্রেড ফাইনান্স দফতরে যোগ দিয়েছে। স্কুলে পড়ার সময়ে কমিনিজমের সূর্যাস্ত তার দেখা। পশ্চিম থেকে আমরা যে কি মহতী বাণী বয়ে নিয়ে এলাম সেটা বোঝার চেষ্টা করে। মারেকের চোখে মুখে শিশু সুলভ কৌতূহল, ব্রাতিস্লাভা ক্লাসরুমের জানা ট্রেড ফাইনান্সের সঙ্গে ৩৯৯ পার্ক এভিনিউতে লেখা সিটি ব্যাঙ্কের সংবিধানের সঙ্গে কাজকর্ম মেলাতে হিমসিম খায়। তাই তার প্রশ্নের শেষ নেই – এটা এরকম ওটা আমরা করি কেন (এখনও আমার বাগাড়ম্বর মনে রেখেছে, সম্প্রতি ইমেল পেলাম তার)।
চমৎকার দিন। আমরা দুজন দানিউবের ব্রিজের ওপরে নানান গল্প করতে করতে দেশলাই বাকসোরূপ অফিসের পথে হাঁটছি, পায়ের তলায় নীল নদী–ব্লু দানিউব! আহা, এই তো সুদিন, এমনি দিন! পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে সিমেন্ট ও পাথরের এক নবীন অরণ্য তৈরির সোভিয়েত প্ল্যান থেকে কোনক্রমে রক্ষা পেয়ে আজও জেগে আছে ব্রাতিস্লাভার পুরনো শহর, স্তারে মেসতো। অন্যদিকে কমিউনিস্ট যুগের শিল্পকলা। দিন এবং দৃশ্যটা পরিষ্কার মনে পড়ে।
মারেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম আচ্ছা, তোমরা চেক থেকে আলাদা হলে কেন? মারেক বলেছিল বিভিন্ন লোককে প্রশ্ন করলে বিভিন্ন জবাব পাবে। তবে আমার কাছে একটা নিতান্ত সহজ ব্যাখ্যা আছে।
- সেটা কি?
- আইস হকি।
ভারতে ক্রিকেটকে ধর্ম এবং শ্রীমৎ তেন্দুলকারকে ঈশ্বর বলে দাবী করা হয় বলে শুনেছি–যেমন লিথুয়ানিয়াতে বাস্কেট বল। আইস হকির ষাট মিটার লম্বা তিরিশ মিটার চওড়া ছোট্ট ময়দানে নিয়মিত ভাগ দৌড় করে থাকে বহু দেশ, যাদের মধ্যে হয়তো সুইডেন বনাম ফিনল্যান্ড, ফিনল্যান্ড বনাম রাশিয়া, কানাডা বনাম আমেরিকার তীব্র রেষারেষির কথা সকলেই জানেন; সেই একই ধুন্দুমার কাণ্ড যে চেক এবং স্লোভাকিয়ার আইস হকির মাঠেও চলে সেটা আমার ঠিক জানা ছিল না। কিন্তু সেটা দেশ ভাগের কারণ কি করে হতে পারে?
মারেক বললে, তাহলে শোনো, চেকোস্লোভাক আইস হকি দলে একজনের বেশি স্লোভাক কখনো জায়গা পেতো না। চেকের জন সংখ্যা আমাদের ডবল, প্লেয়ারের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের খেলোয়াড়রা পয়লা সুযোগ পাবে-যত ভালোই খেলুক না কেন, স্লোভাকদের কপালে কষ্টে সৃষ্টে জুটবে একটা পজিশন। আমি স্কুলে, বিশ্ব বিদ্যালয়ে আইস হকি খেলেছি। ভেবেছি আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে আমাদের আইস হকি টিম হবে ছ জন স্লোভাককে নিয়ে!
যুক্তিটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না হয়তো। যে দেশে বাস করি, সেই যুক্তরাজ্যে খেলার মাঠ নিতান্ত বিযুক্ত-দেশের জাতীয় পতাকা এক হলেও ফুটবল খেলে চারটে আলাদা দেশ: ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড; ক্রিকেট খেলে তিনটে দেশ; একটি বিচিত্র কারণে রাগবি খেলার সময়ে দুই আয়ারল্যান্ড এক সঙ্গে মাঠে নামে, ব্রিটিশ লায়ন্স রাগবি টিম আবার এই চারটে দেশের সংমিশ্রণ! অ্যান্ডি মারে টেনিস ম্যাচে জিতলে তাকে ইংরেজ মাথায় তোলে, হেরে গেলে স্কটিশ বলে হেনস্থা করে। ভারতীয় ক্রিকেট দলে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রতিবাদী সুর শুনেছি আমাদের বাল্যকালে-পঙ্কজ রায় এবং সৌরভ গাঙ্গুলির মধ্যবর্তী কালে কোন বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটে স্থান পান নি (অম্বর রায় ও সুব্রত গুহের চারটি করে টেস্ট ম্যাচ খেলা বাদে) বলে আমরা ক্ষুদ্ধ হয়েছি। আমার চেনা ত্রিনিদাদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচিত জনেরা অভিযোগ করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল নির্বাচনে ত্রিনিদাদ টোবেগো নাকি মোটেও সুবিচার পায় না। শোনা যায় সেই আক্রোশে পোর্ট অফ স্পেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ভারতের টেস্ট ম্যাচে স্থানীয় জনতা ভারতীয় দলকে সমর্থন করে থাকে। ড্যারেন গঙ্গা, নিকলাস পুরাণ, সুনীল নারায়ণের নাম উল্লেখ করলে তারা বলে, হ্যাঁ, ওই কটাই! কতজন যে সুযোগ পায় নি।
কিন্তু তাই বলে দেশ ভাগ?
নতুন রাষ্ট্র গড়ার দশ বছরের মধ্যে বিশ্ব আইস হকি প্রতিযোগিতায় (২০০২) তৎকালে দুনিয়ার অন্যতম সেরা দুই টিম কানাডা ও সুইডেনকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় এবং সেখানে রাশিয়াকে হারিয়ে সোনা জেতে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের ছোট্ট দেশ স্লোভাকিয়া।
মারেক পটোমা এখন দুবাইতে সিটি ব্যাঙ্কের উচ্চপদে আসীন। তাকে সেদিন মনে করিয়ে দিলাম-স্লোভাকিয়া বিশ্ব আইস হকি কাপ জিতলে সে এক লাইনের ইমেল পাঠিয়েছিল।
এই কি স্বপ্নরাজ্য? (ইজ দিস ড্রিমল্যান্ড)
*আমাদের (প্রাশিয়ান) অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে পোলিশ জাতিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে – অটো ফন বিসমার্ক
Wenn wir bestehn wollen, nichts andres tun, als sie (Polen) ausrotten- Otto von Bismarck
ক্রমশ...