ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষা
রাতের অন্ধকারে উড়তে গিয়ে একটি হেলিকপ্টার সোজা আঘাত করেছে ‘দৈনিক গ্রহ’ পত্রিকার আকাশচুম্বী অট্টালিকার একশো এক তলার দেওয়ালে। এই সংঘর্ষের ফলে লোয়েস নাম্নী সাংবাদিক হেলিকপ্টার থেকে ছিটকে পড়ে কোনোমতে তার একটি জানালা ধরে ঝুলছেন। রাস্তায় বহু আতঙ্কিত মানুষ ঊর্ধ্বপানে চেয়ে আছেন – তুমুল কলরব, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি হাজির। পতন ও মৃত্যু আসন্ন জেনে লোয়েস প্রভুর নাম জপ আরম্ভ করেছেন। হেনকালে আকাশ ফুঁড়ে নীল বস্ত্রধারী এক বলশালী পুরুষের আবির্ভাব হল। এক লহমায় লোয়েসকে বগলদাবা করে সেই পুরুষ বললেন, “ভদ্রে, আপনার শঙ্কার কোনো কারণ নাই। আমি আপনাকে আলিঙ্গনে ধরিয়া রাখিয়াছি।”
পায়ের অনেক নিচে নিউ ইয়র্কের পথঘাট গাড়িগুলোকে খেলনার মত দেখাচ্ছে। লোয়েস খুব একটা আশ্বস্ত হলেন না, একবার সেই বলশালী পুরুষকে আরেকবার অনেক নিচের শহরকে দেখে নিয়ে সন্দেহের সুরে বললেন, “হে বীর, আপনি আমাকে ধরিয়া রাখিয়াছেন, কিন্তু আপনাকে ধরিয়া রাখিয়াছে কে?”
তিন ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়ে সুপারম্যান ছবিটি কয়েকবার দেখে বুঝেছি লোয়েসের এই পতন এবং রক্ষার ভেতরে ব্যাঙ্কিঙের একটি গভীর তাৎপর্য নিহিত আছে।
আপনারা ব্যাঙ্কে এসে আমাদের টাকা ধার দিয়ে থাকেন। আপনারা টাকা জমা রাখেন না, আপনারা ধার দেন – সুদের হার এবং মেয়াদের কাল ব্যতিরেকে কোনো প্রশ্ন করেন না – আমাদের ব্যাল্যান্স শিট, সিইও-র মাইনে, স্টেটমেন্ট পাঠানোর গাফিলতি কেন হয়—কিছুই জানতে চান না। আপনার কষ্টার্জিত সেই ধন নিয়ে ব্যাঙ্ক কী করে, কাকে, কেন ধার দেয়—এ বিষয়ে আপনাদের মনে কোনো দ্বিধা, সন্দেহ নেই। পাঠক, আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন, হয়তো নিয়মিত আস্থা চ্যানেল দেখেন। আপনারা অকপট, প্রকৃত সরল মানুষ। সেই আস্থার মর্যাদা রক্ষার বাসনায় আমরা আপনার ধার দেওয়া টাকা ‘উড়ো খই গোবিন্দাঐ নমঃ’ বলে বিলিয়ে দিই না। মাঝে মধ্যে অবিশ্যি ভুলচুক হয়ে যায়: এই ধরুন, নীরবে কোনো মোদি হীরে জহরতের ব্যবসা করবেন বলে টাকা নিয়ে অদৃশ্য হলেন অথবা কোনো বীর মল্য এসে অর্থ বিজয় করে দূরদেশে বাসা বাঁধালেন, কেউ আমদানির আশ্বাস দিয়ে ধনী হলেন। নিউ ইয়র্কে সিটি ব্যাঙ্ক জুয়োর আখড়া খুলল, ফরাসি ব্যাঙ্ক হলিউডে নেমে পড়ল, বিলিতি ব্যাঙ্ক রাশিয়ান রুলে খেলল – তবে তা ব্যতিক্রম বই তো নয়, সেটাও আপনারা ক্ষমাঘেন্না করে থাকেন। প্রভূত দুষ্কর্মের পরেও ইউরোপ আমেরিকার ব্যাঙ্কের সামনে প্রতিবাদী জুলুস দেখিনি, কোনো ব্যাঙ্কার জেলে যাননি।
ধার দেওয়ার সময় খুঁটিয়ে দেখি—টাকা যে নিচ্ছে, তার আয়-ব্যয় কত, শোধ দেওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা, বন্ধক নিই তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। যে বেওসা করতে চায়, তার হিসেব-নিকেশের চুলচেরা বিচার করি।। মনে কোনো সংশয় উদিত হলে তখন বলি, “আপনার ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি হোক, আপনি ধার যে শোধ দেবেন—তাতে অবিশ্বাস করি না। কিন্তু ধরুন, যদি কোনো কারণে আপনি আর্থিক সঙ্কটে পড়েন, মনে করুন তেলের দাম বেড়ে উৎপাদন ব্যয় আকাশ ছুঁয়ে ফেলল, তাতে আপনার বেওসায় ঘাটা হবে। তখন আমাদের ঋণের সুরক্ষা দরকার। আপনি একটা গ্যারান্টি দিতে পারেন? মানে আপনি শোধ দিতে না পারলে কোনো অর্থশালী পুরুষ আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাপ্য টাকা শোধ করার প্রতিজ্ঞা কাগজে লিখে সই করে দেবেন? অপরের টাকা নিয়ে কারবার করি, বুঝলেন তো – একটা জবাবদিহির ব্যাপার আছে”। আমাদের খদ্দের হয়তো মাথা চুলকে বললেন, “কাকে ধরি? আমার জামিন দাঁড়াবে কে? আমাদের পাড়ার বিশুবাবুকে বলতে পারি—তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি, কেউ চাইলেই তার জন্য ক্যারেকটার সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে থাকেন”। তখন জানাতে বাধ্য হই—প্রশ্নটা তাঁর চরিত্রের নয়, বিশুবাবুর আর্থিক সামর্থ্যের – আপনার ধারের ঝোলাটা তিনি কি নিজের ঘাড়ে তুলে নেবেন? পারবেন?
লোয়েস যখন সুপারম্যানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইউ গট মি, বাট হু গট ইউ’ — তিনি জামিনদারের এলেমটি জানতে চান।
স্টেট ব্যাঙ্কের প্রণম্য গুরুদের পদপ্রান্তে বসে যা শিখেছি—তাই ভাঙিয়ে জীবনটা কাটালাম। ব্যাঙ্কের আয়ের দুটি সূত্র। পরিষেবার জন্য দক্ষিণা বা ফি আর ধার দেওয়ার বিনিময়ে সুদ প্রাপ্তি। ধার দিতে গেলে সুরক্ষা খুঁজি। যেমন আপনার বাড়ি-ঘর-মেশিন-কারখানা যা-ই হোক না কেন, ধার শোধ না হলে সেটি কব্জা করব। অথবা খুঁজি একজন তাগড়া জামিনদার বা গ্যারান্টর; জামিনদারের পুণ্যে ঋণ গ্রহীতার পুণ্য। যার জামিনদার যত তাগড়া, তার সুদ তত কম – যেমন পূর্ব ইউরোপে আমাদের প্রথম দিকের ঋণ গ্রহীতা প্রায় সকলেই সরকারি প্রতিষ্ঠান। তখন দেনাদারের কথা ভেবে আপন নিদ্রা বিঘ্নিত করি না। তিনি শোধ দিতে না পারলে জামিনদারের ট্যাঁক ধরে দেব টান। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়ানোর সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধের জন্য সুপারম্যান ছবির গল্প ব্যবহার করি।
জামিন ব্যাপারটা বোঝা গেল। কিন্তু কীভাবে এটি পাওয়া যাবে, কেমন করে দেওয়া হবে—তার রকমফের আছে। ইউরোপে এসে দেখলাম, ওই জামিন বস্তুটি নানা রূপ ধরে। সবচেয়ে পোক্ত জামিন—একটি শক্ত কাগজে কোম্পানির নাম ঠিকানা এবং সিল মেরে জামিন দাতার সই—‘আমি এতদ্দ্বারা সকলকে অবগত করিতেছি, যদি কোনো কারণে ঋণগ্রহীতা সুদ সমেত অর্থ প্রত্যর্পণ করিতে অক্ষম বিবেচিত হয়, আপনাদের প্রথম এত্তেলা পাওয়া মাত্র (অন ইয়োর ফার্স্ট রিটন ডিমান্ড) আমি সেই প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ ঋণদাতাকে প্রদান করিতে বাধ্য থাকিব’। এটি সহজলভ্য নয়। জামিনদাতা নানান ছলে আপন দায়িত্বটি এড়ানোর প্রয়াস করেন—এই আপনার বীমা কোম্পানিকেই দেখুন। তারা আপনার প্রিমিয়াম হজম করে ফেলেছে, পলিসি লিখে দিয়েছে। এবার যেই আপনি পলিসি মোতাবেক প্রথম দাবি জানালেন, সেটি নাকচ করার জন্য তারা আদা-জল খেয়ে লেগে গেল।
জার্মানিতে এসে দেখলাম, ঋণের জামিনদার দিচ্ছেন আশ্বাস-বার্তা বা অভয়-বাণী। হাইনরিখ কোম্পানিকে টাকা ধার দিতে পারি—তার জামিনদার কার্ল, এক বৃহত্তর কোম্পানি। কিন্তু হাইনরিখ টাকা শোধ দিতে না পারলে কার্ল কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে তা ফেরত দেবেন—সে কথা খোলসা করে বলা নেই। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে পর আমার ক্রেডিট কর্তা বললেন, “কথাটা কে বলছে দেখুন! কার্ল হেলমের বোর্ড চেয়ারম্যান। এ লেভেলের জামিনদাতাদের প্রতি কোনো অবিশ্বাস পোষণ সঙ্গত নয়”। এই বলে আমার জার্মান আধিকারিক বাঙালির গেঁড়েমিকে উপেক্ষা করলেন। ক্রমশ এই ধারার আশ্বাস-বার্তামূলক চিঠি আসা কম হয়ে গেল। ও রকম চিঠি লিখলে জামিন দাতার অডিট কর্তৃপক্ষ একটু গুঞ্জন তোলেন – যেমন রয়্যাল ডাচ শেল কোম্পানি। তারা এমনকি নিজেদের কন্যাসম প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যারান্টি দিতে অস্বীকার করেন—কোম্পানি পলিসি! আমরা তো এ কোম্পানির পিছনে আছিই, সেটা আপনারা জানেন। চিঠির আবার কী দরকার? অর্থাৎ অন্তর্নিহিত আশ্বাস (ইমপ্লিসিট গ্যারান্টি) — আমার না লেখা বাণী!
যোগ হল মৌখিক আশ্বাস (ভারবাল সাপোর্ট – পাত্রনাতসএরক্লেয়ারুং)। আজকে তার বর্ণনা শুনলে অতি নাটকীয় মনে হতে পারে—হলফ করে বলতে পারি নিজের চোখে দেখা—কনটিনেন্টাল ব্যাঙ্ক ফ্রাঙ্কফুর্টের অফিসার জামিনদাতার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরে তাঁর বিবরণীতে (কল নোট) লিখছেন: “আমাদের দীর্ঘ মধ্যাহ্ন ভোজনের শেষে, কফি পান করার সময়, তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সি-ই-ও জামিনদাতা—হের ফিশার—বললেন, তাঁরা এই কোম্পানির সমর্থনে আছেন ও থাকবেন”। তখন ঠিক কটা বাজে, কোন দিন, কফির আগে না পরে এই রূপ আশ্বাসবাণী দেয়া হয়েছিল, তার ফিরিস্তি দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল কে জানে। জার্মানি ছেড়ে আসার আগেই এই আশ্বাসবাণী যে ঋণ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি, তার বহুত নমুনা দেখে এসেছি। ইংল্যান্ডে সেই একই ছবি। কত ঢিলেঢালা ভাবে যে ঋণের জামিনদারি করা যায়, তার অনেক রকমফের দেখলাম। গুচ্ছের কথা লিখে চারপাতা ভরিয়ে দিয়ে কিছুই না বলার শিল্পকীর্তিতে অবশ্যই ইংরেজি ভাষার একচেটিয়া অধিকার।
এই নাতিদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকাটি করার কারণ আছে। আপনাদের ধৈর্যের ওপরে অহেতুক দাবি রেখে জামিন বা জামিনদারির ব্যাপারে আমার বিশ্বাসের পরিসমাপ্তির যে কাহিনিটি বাখানিয়া বলতে চাই, তার অকুস্থল ক্রোয়েশিয়া।
রিয়েকা একটি বন্দর শহরের নাম
সমুদ্রের জলে যেখানে-সেখানে নৌকো ভাসানো যায় না! ক্রোয়েশিয়ার তটরেখা দীর্ঘ, কিন্তু জাহাজের নোঙ্গর ফেলার জন্য উত্তাল সমুদ্রের পাশে শান্ত খাঁড়ি বা মেরিনা বিরল। তাই কভারনার উপসাগরের কোনায় অবস্থিত রিয়েকা (ক্রোয়েশিয়ানে নদী) বন্দরের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে দেশের অর্থনীতিতে। অপূর্ব সুন্দর এই শহরের পথে চলতে কম করে দু-হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে ঠোক্কর খাবেন! প্রথম রোমান নাম ফ্লুমেন (ল্যাটিনে নদী!), জার্মানে সাঙ্কট ফাইট আম ফ্লাউম। হাত বদল হয়েছে অনেকবার। পালা করে রোমান, জার্মান, ভেনিশিয়ান, অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গ শক্তি তলোয়ার ঘুরিয়ে বন্দরঘাটায় আপন জাহাজ লাগানোর অধিকার অর্জন করেছেন। ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ে অর্থায়নের পরে সিটি ব্যাঙ্কের নজর গেল দেশটার ওপরে, কিন্তু কোনো শাখা খোলা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আন্দ্রেয়া আরভাই তখন হাঙ্গেরিতে ট্রেড ফাইনান্স দেখে – তাকে দেওয়া হল ক্রোয়েশিয়াতে বাণিজ্য বিস্তারের ভার—এই যেমন এককালে হাঙ্গেরিয়ানরা এ দেশ চালিয়েছে! সে সময় আমরা একত্র কাজ করেছি। আন্দ্রেয়া আমাদের লন্ডনের বাড়িতে এসেছে এবং আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ এখনও বজায় আছে। দু-বছর আগে আমরা বুদাপেস্টে ক্রিসমাস একত্র কাটাই।
রিয়েকার বন্দর বিস্তারের কাজ সবে শুরু হতে যাচ্ছে—এ শুধু ক্রোয়েশিয়ার জন্য নয়, ল্যান্ড লকড প্রতিবেশী দেশ হাঙ্গেরিও খুঁজছে সমুদ্র বন্দরের দ্বার। সেখানে বিশাল অর্থনিবেশের প্রয়োজন। আমরা অনেক ছানবিন, পর্যবেক্ষণ, পরিভ্রমণ সেরে সিটি ব্যাঙ্কের বড় সাহেবদের কাছে প্রোজেক্ট ফাইনান্সের একটি পেল্লায় প্রস্তাব পেশ করি। ক্রোয়েশিয়ার যুদ্ধ ততদিনে শেষ—ইয়ুগোস্লাভ তথা সারবিয়ান সৈন্য বাহিনি স্বস্থানে প্রস্থান করেছে। এবার দেশ গড়ার পালা। ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ে ডিলের বাণিজ্যিক সাফল্যের পরে আমাদের উৎসাহের সীমা নেই—একটা নতুন কিছু করার সুযোগ সময় আসন্ন! এ প্রস্তাব অবশ্য বেশি দূর এগোয়নি—রাশিয়ান এবং দূর প্রাচ্যের অর্থনৈতিক সঙ্কট দীর্ঘ মেয়াদি নিবেশে বাদ সাধল।
তখন জানি না—রিয়েকার সঙ্গে আবার মোলাকাত হবে!
রিয়েচকা বাঙ্কা (রিয়েকার ব্যাঙ্ক)
জার্মানির প্রত্যেকটি লান্ড বা প্রদেশের একটি করে নিজস্ব সরকারি মালিকানার ব্যাঙ্ক ছিল—যেমন ধরুন আমাদের দেশের জন্যে একটা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বদলে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল বা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ বিহার যদি থাকত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানির পুনর্গঠনের কাজে এই ব্যাঙ্কগুলির অবদান অসামান্য। সে কাজটা চুকে গেলে অন্য সমস্যা দেখা দিল। অর্থনীতির অবস্থা ভালো, অঢেল ডিপোজিট জমা পড়ছে, বিশ্বের বাজারে বহু সংস্থা নিতান্ত অল্প সুদে টাকা ধার দিচ্ছে – যাকে বলে প্রবলেম অফ প্লেন্টি। যত সামান্যই হোক, আমানতকারীদের সুদ দিতে হবে, অতএব জমা টাকা খাটানো দরকার।
বাভারিয়াতে সরকারি মালিকানার ব্যাঙ্ক বায়ারিশে লান্দেসব্যাঙ্ক বা বায়ার্ন এল বি। আপন দেশে বাণিজ্য বৃদ্ধির বিশেষ সম্ভাবনা না দেখে আকারে প্রথম এবং ধনের হিসেবে দ্বিতীয় এই জার্মান প্রদেশের ব্যাঙ্কটি পূব পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন—কাছের দেশ ক্রোয়েশিয়া। আমরা আগের পর্বে দেখেছি, সে দেশের অর্থমন্ত্রী পিরকা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আশ্বাস দিয়েছিলেন—ক্রোয়েশিয়া দ্রুত তার ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের কাজটি সম্পূর্ণ করবে (১৯৯৫)—পরের তিন বছরের ভেতরে সেটি সম্পন্ন হল। সে সময়ে জার্মানি, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার অনেক ব্যাঙ্ক সরকারি মালিকানায় চলে।
বেশিরভাগ সরকারি ব্যাঙ্কের মালিকানা অধিগ্রহণ করল ইতালি অস্ট্রিয়া ও জার্মানির ব্যাঙ্ক—ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! বলাবাহুল্য, এই তিনটি দেশ পালা করে ক্রোয়েশিয়াকে শাসন ও শোষণ করেছিল! মিউনিকের বায়ার্ন এল বি ক্রোয়েশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্ক, রিয়েচকা বাঙ্কার ষাট শতাংশ শেয়ার কিনে পরিচালনার দায়িত্ব (ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল) গ্রহণ করলেন। মাত্র তিন বছর আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চিফ ইউঙ্কারস ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের যে আদেশ দিয়েছিলেন, সেটি সম্পূর্ণ প্রতিপালিত হল, ঠিক যেমন অর্থমন্ত্রী পিরকা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। ফ্রান্স অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সেটি করে উঠতে আরও কয়েক বছর লাগবে। ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ের আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহে সিটি ব্যাঙ্কের সাফল্য দেখে উৎসাহিত হয়ে বায়ার্ন এল বি রিয়েচকা বাঙ্কার জন্য একটি পেল্লায় আন্তর্জাতিক ঋণের আহ্বান জানাল বিশ্বের ব্যাঙ্কগুলিকে। এখানে সিটি ব্যাঙ্কের কোনো নেতৃত্ব ছিল না — আমরা খানিকটা রবাহূত হয়ে এই ঋণটির ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ প্রকাশ করলাম। পাশার দান উলটো। এখানে তাঁরা ঋণের আয়োজক, আমরা ক্রেতা। চাপান-উতোর শুরু হল। নানান প্রশ্ন করলাম বায়ার্ন এল বিকে। রিয়েচকা বাঙ্কার স্বাস্থ্য খুব সুবিধের মনে হয়নি। মিউনিকে বায়ার্ন এল বির কাছে আমাদের সংশয় ব্যক্ত করে জানতে চাইলাম—আমাদের স্বস্তি সাধনের জন্য তাঁরা কি এই ঋণের জামিনদার হবেন? দেখতে গেলে তো এটি তাদের কন্যা স্বরূপ, দুই তৃতীয়াংশ শেয়ার তাদের হাতে। বেশ মনে আছে—অপর প্রান্তের জার্মান ভদ্রলোক সাতিশয় অপ্রসন্ন হলেন। তিনি বললেন—আমরা রিয়েচকা বাঙ্কার বৃহত্তম অংশের মালিক, আমরা এদের সঙ্গে আছি, থাকব। বায়ার্ন এল বি সরকারি ব্যাঙ্ক, একই সঙ্গে বাভারিয়া ও খোদ জার্মান সরকারের প্রতিভূ—তারা কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিত্যাগ-পূর্বক পলায়ন করে না। এদের ঋণ দেওয়া আর জার্মানির প্রতিষ্ঠান বায়ার্ন এল বি কে ঋণ দেওয়া একই ব্যাপার। আমরা জামিন দিতে যাব কী দুঃখে?
মানে ঐ ইমপ্লিসিট সাপোর্ট; শ্রমিক তুমি এগিয়ে চল, আমরা তোমার অনেকটা পেছনে আছি।
তিনি আবার জানালেন—বায়ার্ন এল বি কখনো লিখিত জামিন দেয় না। বড়জোর মৌখিক সমর্থন (ভারবাল সাপোর্ট) জানাতে পারেন।
আমার পরম ক্রেডিট গুরু আর্ট গ্র্যান্ডি বললেন, এতই যদি বিশ্বাস, ভালবাসা—তাহলে কাগজে লিখে দিচ্ছেন না কেন? ভালো ঠেকছে না (আই ডু নট লাইক ইট!)। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সিটি ব্যাঙ্ক এই ঋণে অংশ না নেবার সিদ্ধান্ত নিল। মিউনিকের ব্যাঙ্কের কিছু সাথী খুশি হলেন না। অক্টোবর ফেস্টে অনেক আপ্যায়ন করেছেন; সেটা জলে গেল। আমাকে বলতে হল—কী আর করা। ক্রেডিটের বড়ো কর্তার আদেশ! আমাদের জন্য দুনিয়া থেমে থাকে না। বাজারে বকরার অভাব নেই—বায়ার্ন এল বি কাঙ্ক্ষিত ঋণটি সংগ্রহ করল।