সেপ্টেম্বর ২০০৬
আয়তনে পশ্চিম ইউরোপের সমান, যার পনেরো শতাংশ ইউরোপে। সেখানে কাজাখস্তানের তিরিশ শতাংশ মানুষ বাস করেন। বাকিটা এশিয়া মহাদেশে। তুরস্ক দেশকে ইউরোপীয় মনে করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে প্রকট, কিন্তু মনে রাখা ভালো—সে দেশের জমির তিন শতাংশ ইউরোপে। দারদানেলেস প্রণালীর পাড়ে সুইস হোটেলের ব্যালকনি অথবা চিরান প্যালেসের বাঁধানো প্রমেনাদে দাঁড়ালে এশিয়া মহাদেশকে দেখা যায়। ফেনারবাচের ফুটবল খেলা দেখে ফেরার সময়ে ইউরোপকে! সেই সাক্ষাৎকার অতি অল্পক্ষণের জন্যে। একে অপরকে বুড়ি ছোঁয়ার মত, সাগরের খাঁড়ির এপার ওপার।
কাজাখস্তানে এশিয়া ইউরোপের মুখ দেখাদেখি চলে কয়েকশ’ কিলোমিটার যাবত। উরাল পর্বত এবং নদী ইউরোপ এশিয়ার সীমানা নির্দেশ করে। নদীর পশ্চিম তীর ইউরোপ—সেখানে প্রায় তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জমি (আমাদের পশ্চিমবাঙলা-বিহার-ওড়িশাকে জুড়লে যা হয়, তার চেয়ে বেশি) কাজাখস্তানের দখলে। ইউরোপের শেষ লেবেনসরাউম! ইউরোপে একটা পা আছে বলেই কাজাখস্তান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল খেলার অধিকার পায়, অন্য স্তানেরা নয়। ইউরোপিয়ান ইনটিগ্রেশান শব্দটা অবশ্যই শোনা যায় আজকাল।
উরাল নদী ও পর্বতমালাকে ঠিক কেন যে ইউরোপের পুব সীমানা বলে চিহ্নিত করা হয়, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে তার কোনো সদুত্তর পাইনি। তবে এটা ঠিক, যে, এই নদী ও পর্বতের বর্তমান নামটি এক জার্মান মহিলার দেওয়া, জারিনা ক্যাথারিন দি গ্রেট। ১৭৭৫ সালে কসাকরা এই অঞ্চলে বেজায় গণ্ডগোল করছিল বলে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে তিনি কেবল আন্দোলন দমন করলেন না, পুরনো কসাক নামটাই ( ইয়াইক ) বদলে নতুন নাম দিলেন, উরাল!
পুব পাড়ের এশিয়ান অংশের পরিমাপ কুড়ি লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। উরাল নদীর উত্তর প্রান্তের শহর উরালস্ক (রাশিয়ান ওরাল), অন্য প্রান্তে বিশ্বের বৃহত্তম অন্তর্দেশীয় হ্রদ, কাস্পিয়ান সাগরের ব-দ্বীপের মুখে খনিজ পদার্থে অসম্ভব ধনী বন্দর শহর আতিরাউ। একবার ফ্লাইটে কোনো ডাচ কেমিকাল এঞ্জিনিয়ারের কাছে গল্প শুনেছিলাম—উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে লাস ভেগাসকে হার মানাতে পারে এ শহর! এখানে রাত্তির হয় না! আতিরাউয়ের বাতাসে টাকা ওড়ে, তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু!
জনসংখ্যা দু’কোটিরও কম। উরালের দু’পাশ বাদ দিলে প্রায় জনবিরল দেশ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭ জন লোক বাস করেন (ইউরোপীয় এলাকায় তার দ্বিগুণ) তুলনামূলক ভাবে সেটি ভারতে ৪৭০, ব্রিটেনে ২৮০ হল্যান্ডে ৫০৮ জন। জনগণনার তোয়াক্কা না করেই এ দেশটিকে প্রায় জনশূন্য ঘোষণা পূর্বক (যদিও সেটা সার্বিক মিথ্যে) স্টালিনের যোগ্য সাথী বেরিয়া স্থির করেন এখানেই পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে দেখা হোক। লোকজন তো নেই, কারো প্রাণহানির সম্ভাবনা ক্ষীণ, আর চেল্লাচিল্লি করলে শুনছেই বা কে। সে খবর প্রাভদা অবধি পৌঁছুবে না।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে (১৯৮৯ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বোমা ফাটানোর সামর্থ্য বা রুবল কোনটাই ছিলো না) বহুবার আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করার ফলে দক্ষিণের একটা বড়ো অঞ্চল, সেমিপালাতিনসক, রেডিও একটিভ হয়ে আছে। চেরনোবিলের চেয়েও বহুগুণে খারাপ। এই জমিদারিতে আরও জায়গা খালি দেখে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অন্তরীক্ষ প্রকল্পের কেন্দ্র স্থল নির্ধারিত করে কাজাখের বৈকানুরে। মনে রাখা ভালো, আমেরিকানরা যখন মহাশূন্য থেকে ফিরতি জাহাজকে গালফ অফ মেক্সিকোর জলে নামাত, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নামিয়েছে কাজাখের শক্ত স্টেপভূমিতে।
কাজাখস্তানের স্বাধীনতা অনুমোদনের কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বিশেষ শর্ত আরোপ করে—সেমিপালাতিনসক, বৈকানুরের মালিকানা রাশিয়ার থাকবে, ২০৫০ সাল অবদি। এটি রাশিয়ার কেপ ক্যানাভেরাল! যদিও কাজাখে তার অবস্থিতি, সেখানে ঢুকতে রাশিয়ান ভিসা লাগে।
“কাজাখস্তানে আসুন, মানুষ সমেত মহাশূন্যে রকেট নিক্ষেপের দৃশ্য উপভোগ করুন”—এমন প্রলোভন দেখাতে বুকিং ডট কম অথবা বিশ্বরূপ ট্রাভেলস আজো অক্ষম। রাশিয়ান বিদেশ মন্ত্রক এই লাভজনক স্টার্ট-আপ ব্যবসায়ের পথের প্রধান বাধা।
কোনো এক সুপ্রভাতে হয়তো মন ভালো ছিল, তাই প্রকৃতি কাজাখকে দিলেন ইউরেনিয়াম, তামা, শিসে, ক্রোমিয়াম, দস্তা, লোহা, হীরে এবং অগাধ খনিজ তেলের ভাঁড়ার। কিন্তু এই আশ্চর্য ধন সম্পদ খুঁজে দেখেননি, তার পরোয়া করেননি যাযাবর জনতা। সে অমৃত পড়ে রইল আসা যাওয়ার পথের ধারে। এ দেশের মানুষ স্থায়ী ভাবে বাস করতেন না কোথাও। মোঙ্গল রক্ত শরীরে আর মন উড়ু উড়ু। যাযাবরের মত আসা যাওয়া—আজ এখানে, কাল ওখানে। দেশটা এত বড়ো, যে, চরৈবেতি বলে চরে খাওয়ার কোনো অসুবিধে ছিল না।
দীর্ঘ জনযাত্রায় তাঁদের চোখে পড়েছে দেশের বিস্তৃত প্রান্তরে একটি ক্ষিপ্র গতির প্রাণী এখানে ওখানে দৌড়ে বেড়ায়। হেঁটে ক্লান্ত যাযাবরেরা হঠাৎ কোনো এক সময়ে তার ওপর চড়ে বসলেন। সে প্রাণী খুব একটা প্রতিবাদ হয়তো করেনি, করলেও তার কথা লিখে রাখবার মতন ট্রাভেল রাইটার জোটেনি।
কাজাখের যাযাবর পৃথিবীকে দিলেন একটি নতুন পরিবহন ব্যবস্থা। পরের কয়েক হাজার বছর ধরে অশ্ব মনুষ্য সভ্যতাকে দেবে গতি, এমনকি মোটর গাড়ির ক্ষমতা মাপা হবে অশ্বশক্তি দিয়ে।
গরু-ছাগল চরিয়ে দিন গুজরান করতেন কাজাখ মানুষ। কালক্রমে রাশিয়ান জারের দৃষ্টিপাত পড়ল। দীর্ঘ সীমা জুড়ে বানালেন অনেক দুর্গ, পাহারাদারের চৌকি। এ জমি লইব কল্য—এই রূপ বাসনা সুস্পষ্ট। বিগত শতাব্দীর শুরুতে তৈরি হল রাশিয়ান ওরেনবুরগ থেকে তাসকেন্ত অবদি ট্রান্স উরাল ব্রড গেজ রেললাইন। এই নতুন রেল লাইন গেল কাজাখস্তানের মধ্য দিয়ে। জমি অধিগ্রহণের আইনি ডকুমেন্ট পাওয়া যায় না। কিন্তু এই বিশাল কর্মকাণ্ডে অনেকে এলেন রাশিয়া থেকে। তাদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ভোলগা জার্মানরা।
ব্রিটেনের রাজপরিবারের মত অনেক রাশিয়ান জারের ধমনিতে বয়েছে জার্মান রক্ত (সর্বশেষ জারিনা আলেকসান্দ্রা ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী ডারমস্টাডের রাজকন্যা—সে পরিবারের সঙ্গে ব্রিটেনের প্রিন্স ফিলিপের আত্মীয়তা ছিল)। প্রাশিয়ান রাজকুমারী সোফি ফ্রিদেরিকে আউগুস্তে ফন আনহালট—নাম বদলে একাতেরিনা বা ক্যাথারিন—বিয়ে করেছিলেন রাশিয়ান জার তৃতীয় পিটারকে। জারিনা একাতেরিনা (১৭২৪-১৭৯৬) আপন স্বামী পিটারকে সরিয়ে ৩৪ বছর দক্ষ হাতে রাশিয়া শাসন করেন। দেশের সার্বিক ও দ্রুত উন্নয়নের জন্য তিনি চাইলেন ইউরোপের বিভিন্ন পেশার মানুষকে রাশিয়ায় বসবাস করার অনুমতি ও নাগরিকত্ব দিতে। অবশ্যই ইহুদি সম্প্রদায় বাদে। আমেরিকার দরোজা খুলে গেছে তখন, এলিস আইল্যান্ডে ট্রাফিক জাম। সেখানে যেতে লোক বেশি উৎসুক। শেষটায় নিজের বাপের বাড়ির মানুষজনদের বিশেষ অনুরোধ জানালেন রাশিয়া আসার জন্য। সঙ্গে রাজ সম্মতি—আগন্তুকরা জার্মান ভাষা, সংস্কৃতি, প্রটেস্টান্ট বা ক্যাথলিক ধর্ম বজায় রাখার পূর্ণ অধিকার সহ নাগরিকত্ব অর্জন করবেন। প্রটেস্টান্ট ক্যাথারিন বিয়ের পরে অবশ্য প্রথামত রাশিয়ান অর্থোডক্স ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন—নইলে সম্রাজ্ঞী হওয়া যায় না। দক্ষিণ জার্মানি থেকে রাশিয়ায় বাসা বাঁধলেন অনেকে। ভোলগা নদীর সবুজ উপকূল বরাবর বসতি বলে এঁদের মুখ চলতি নাম ভোলগা জার্মান। বলশেভিক বিপ্লবের পরে তাঁদের ছোট প্রদেশের নাম হল ভোলগা জার্মান এএসএসআর (অটোনোমাস সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক ) – রাজধানী এঙ্গেলস্ক। ১৯৩৬ সালে স্তালিনের শুদ্ধিকরণ শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চলে আরেক লম্বা ছুরির দিন ও রাত। জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ—এরা পিতৃভূমির চর বনে যাবে, এই আশঙ্কায় ভোলগা জার্মানদের ছোট রিপাবলিক এবং স্বায়ত্ব শাসনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। ট্রেন ভর্তি করে স্তালিন তাঁদের সাইবেরিয়া পাঠালেন—গরু-ছাগল-বাহী ওয়াগনে ন’লক্ষ মানুশকা পাঠানো হয়—আদ্ধেকের বেশি পথেই মারা যান। বিগত একশ বছরে অনেকে দেশ ত্যাগ করলেও এখনো অন্তত কয়েক লক্ষ জার্মান বংশোদ্ভূত মানুষ রাশিয়ার নানান অঞ্চলে বাস করেন। ১৯৪৯ সালের জার্মান সংবিধান মোতাবেক তাঁদের জার্মানি ফেরার পথ সর্বদা খোলা আছে। তাঁদের সবার শেষ নাম মায়ার মুইলার শুলতস কিন্তু ভাষাটি প্রায় ভুলেছেন—এমন একজনের আলাপ হয় হামবুর্গে।
ভোলগা জার্মানদের পাশে দাঁড়িয়ে শাবল হাতুড়ি পিটিয়ে রেল লাইন বানানোর কাজে যোগ দিলেন রাশিয়ান, গ্রিক এমনকি রাশিয়াতে ঢুকে পড়া কিছু ইহুদি—আজকের ভাষায় প্রায় চার লক্ষ ঘুসপেতিয়া কাজাখস্তানে ঘুসে গেলেন। ১৯০৬ সালে রেললাইন তৈরি হয়ে গেলেও যে রেল কোয়ার্টারে বাসা বেঁধেছিলেন সেখান থেকে তাঁদের কোনো পুলিশ উৎখাত করেনি। রাশিয়ান পাসপোর্ট পকেটে রেখে সে দেশেই রইলেন। কোনো পুলিশ তাঁদের দোরগোড়ায় এসে ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিটের প্রসঙ্গ তোলেনি। কাজাখের ঘাড়ে ক’টা মাথা, যে, জারের সামনে ঘর ওয়াপ্সির দাবি জানাবে?
কাজাখরা বুঝলেন গরু-ছাগল চরানোর দিন শেষ।
হাজার বছরের যাযাবর কাজাখ আস্তানা গাড়তে আরম্ভ করলেন এই বিশাল দেশের মাঠে মাঝারে। প্রসঙ্গত আজকের রাজধানী নুর সুলতানের পুরনো নাম ছিল ‘আস্তানা’: ফারসি শব্দ (রাজধানী বা বড়ো বিরতির স্থল)। আমাদের ‘আস্তানা’ শব্দের আত্মীয়, একই অর্থ!
জারেরা এই প্রকাণ্ড ভূখণ্ডটি কখনো পুরো কবজা করতে পারেননি। বছর দশেক লাগলেও স্তালিনের সোভিয়েত সরকার সেই কর্ম সুসম্পন্ন করল। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজাখস্তান মহান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে ১১ নম্বর রাষ্ট্র হিসেবে চাঁদ তারা ত্যাগ করে দাঁড়ালো কাস্তে হাতুড়ি শোভিত পতাকার তারার নীচে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দু’বছর জার্মানির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করেছে আরও তিনটি দেশ—লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়া। তাদের ‘ইউনিয়ন’ সম্পূর্ণ। রাশিয়ানরা সেই ইউনিয়ন আবার এমন সুচারুভাবে বানালেন, যাতে এক রিপাবলিক আরেক রিপাবলিকের ওপরে ভরসা করতে বাধ্য হয়। ভাইচারা কেবল মুখের কথা নয়—সেটি ব্যবহারিক বা প্র্যাকটিকাল হওয়া চাই।
নমুনা দেখেছি লিথুয়ানিয়াতে, সেখানকার একটি রিফাইনারির পোলিশ (অরলেন) অধিগ্রহণের সময়ে। যদিও কাঁচা তেল পৌঁছুতে পারে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে বুতিঙ্গে অয়েল টার্মিনালে, কিন্তু লিথুয়ানিয়ার মাজেইকিয়াই শহরে তৈরি হয়েছিল বৃহৎ তেল পরিশোধনাগার—যেটি চলবে কেবকোতে (কাজাখ এক্সপোর্ট ব্লেনড ক্রুড অয়েল)। হাজার মিটার খুঁড়লেও তেল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই লিথুয়ানিয়াতে, আশে পাশের দেশেও নয়। তাহলে?
মা ভৈ! তেল আসবে দ্রুঝবা (মৈত্রী) পাইপলাইন দিয়ে, তাতারস্তান হয়ে, এই মাত্তর চার হাজার কিলোমিটার দূরে কাজাখ ভাইয়েদের কুয়ো থেকে।
আত্মনির্ভর নয়, ভ্রাতৃনির্ভর সোভিয়েত ইউনিয়ন। কোনো ভাই বেগড়বাঁই করলে তাকে রুটিতে না হোক, তেলে মারবার ব্যবস্থা রইল।
ক্রমশ সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও মানুষ কাজাখস্তানে এলেন। কুণ্ডু স্পেশালে দেশ-দর্শন করতে নয়, স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে কাজাখদের ক্রমশ সংখ্যালঘু প্রমাণ করতে। একটি আশ্চর্য তথ্য জানা গেল তখন—এই গরু-ছাগল চরানো দেশের মানুষের স্বাক্ষরতার হার ভদ্র-সভ্য রাশিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি। সেটি জেনে তারা উল্লসিত হলেন না, বরং এত লেখাপড়া জানা ভালো নয় বলে কাজাখ ভাষার চর্চাটাই কমিয়ে আনার হুকুম দিলেন।
৫৫ বছর বাদে ১৯৯১ সালে কাজাখ আবার স্বাধীন হবে। যদিও অষ্টম শতকে কাজাখরা ইসলামকে (সুন্নি) গ্রহণ করেছিল, সকল তুর্কিক সোভিয়েত রাজ্যের মধ্যে একমাত্র কাজাখ সংবিধানেই ইসলাম শব্দের উল্লেখ নেই। শুক্রবার এখানে কাজের দিন।
আমরা অর্থের ব্যাপারী, তাই ঘুরে ফিরে মন চলে যায় ব্যাঙ্কিং দুনিয়াতে। সেখানে তখন কী ঘটনা, কী রটনা?
আজকের নবীন ব্যাঙ্কারদের বোঝানো শক্ত। কম্যুনিস্ট ইউরোপ প্রসঙ্গে উইনস্টন চার্চিলের লৌহ যবনিকা মন্তব্য* সকলেই জানেন, দেশে থাকতে শুনেছি। তার মানেটা বুঝিনি। কোথাও একটা যবনিকা বা পর্দা (একই শব্দ কাজাখ, তুর্কি ভাষায়—পেরদে) টাঙানো দেখলে কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। তার আড়ালে কী লুকোনো? হলফ করে বলতে পারি, ১৯৭৭ সালে যখন ইউরোপে আসি, জানতে চাইনি পরদার পিছনে কী আছে। সেদিকে উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ওরা থাকে ওধারে। থাকুক। ফ্রাঙ্কফুর্টে আট বছর কাটিয়েছি। ফুলদা পেরিয়ে কম্যুনিস্ট পূর্ব জার্মানির সীমানা ১০০ কিমি দূরত্বে। এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়? তখন নীল রঙের ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল। পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে আমাদের ভিসা অবধি লাগত না। পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনে যাওয়া ছাড়া কখনো সীমানা পেরিয়ে পূবে পা দিইনি। কেউ তো বলেনি – ওইখানে যেও নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই মানুষের সাথে? তবে সেই পৃথিবীর অস্তিত্ব স্বীকার করিনি কেন? লৌহ যবনিকা কি আমার মনের ভেতরে টাঙানো ছিল?
এই যে লোকে কথায় কথায় ভারতকে তৃতীয় বিশ্ব বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্ব যে কোনটা—তা কেউ জানত? সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক একটি পেল্লায় দেশ ছিল। মস্কো তার রাজধানী। একটি সুপার পাওয়ার। তারা অ্যাটম বোমা ফাটায়, মহাশূন্যে গাগারিনকে পাঠায়, অলিম্পিকে সোনা রুপো জেতে সারা দুনিয়াকে টক্কর দিয়ে। আমেরিকা নামক এক সর্বশক্তিমান দেশের সঙ্গে তারা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। এই অবধি জানা ছিল।
৯ নভেম্বর ১৯৮৯ বার্লিন দেয়ালের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চক্ষু উন্মীলিত হয়নি। আমি ব্যাঙ্কার সম্প্রদায়ের কথা বলছি। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে কারো চিত্ত ঝলমল করলেও আমাদের বিত্তবিভাগের ঋণ বণ্টনকারীদের মন চঞ্চল হয়নি। তাঁরা অনেক শক্ত ধাতুতে তৈরি—ধার দেওয়া টাকা ফেরত না এলে চাকরি সঙ্কট হতে পারে। অধিক বাচালতায় না গিয়ে নির্ভয়ে বলতে পারি, ম্যানহাটানে লিখিত ঋণদানের সংবিধান পড়ে অভ্যস্ত সিটির মত আমেরিকান ব্যাঙ্কের অন্তত দুটো বছর লেগেছে পুবের খদ্দেরকে ধার দেনা দিতে, তাও আবার একমাত্র সরকারি মালিকানার প্রতিষ্ঠানকে। কমিউনিস্ট আমলে এই সব দেশে বেসরকারি মালিকানার অস্তিত্ব ছিল না। তাই কেউ হঠাৎ ব্যক্তিগত দোকান খুলে ফেললে তার ওপর আস্থা রাখা বিদেশি ব্যাঙ্কের পক্ষে কঠিন ব্যাপার। আর ঠিক এই কারণে সব দেশে গড়ে উঠল বেসরকারি মালিকানার ব্যাঙ্ক—যারা শিল্প বা সমতুল্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে প্রস্তুত। অশুভ আঁতাত? সেটা বলা হয়তো সমীচীন হবে না, যদিও রাশিয়াতে তার নমুনা দেখা গেছে। সবচেয়ে উত্তরের দেশ এস্টোনিয়া থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে ক্রোয়েশিয়া, ম্যাসিডোনিয়া অবধি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে কমিউনিস্ট-উত্তর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় একটা বড়সড় গণ্ডগোল হয়নি।
শুধু সময়ের ব্যাপার।
আলমাতি
*“From Stettin in the Baltic to Trieste in the Adriatic, an iron curtain has descended across the Continent. Behind that line lie all the capitals of the ancient states of central and Eastern Europe: Warsaw, Berlin, Prague, Vienna@, Budapest, Belgrade, Bucharest, and Sofia. All are subject, in one form or another, not only to Soviet influence but to increasing measure of control from Moscow”
— Winston Spencer Churchill
Westminster College, Fulton, Missouri
March 5, 1946
পুনশ্চ: ১৯৫৫ সাল অবধি অস্ট্রিয়াতে সোভিয়েত বাহিনী মোতায়েন ছিল। তাই ১৯৪৬ সালের ভাষণে চার্চিল ভিয়েনাকে লৌহ যবনিকার আড়ালে দেখেছেন।