পশ্চিমের তাবৎ স্বাধীনতাকে আজ আমাদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করি। সেই সঙ্গে মাত্র ৩০/৪০ বছরের সাম্প্রতিক ইতিহাস ভুলে যাই। ছয়ের ও সাতের দশকে ফিনল্যানডাইজেশন বলে একটি শব্দ ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে শোনা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আপাত দৃষ্টিতে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবিত ওয়ারশ চুক্তিভুত বলয় থেকে দূরে, মুক্ত দুনিয়ার অংশ বলে পরিগণিত। কিন্তু নিকটতম শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে অর্থনৈতিক গাঁটছড়ার কারণে রাজনৈতিক দিক দিয়েও ফিনল্যান্ডকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ল্যাজটি ধরে চলতে হত। ১৯৯১ অবধি অলিখিতভাবে ফিনল্যান্ডের বিদেশ নীতি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কব্জায়। এই শব্দটি জার্মান রাজনৈতিক মহলে প্রথম শোনা যায় ছয়ের দশকে: শক্তিশালী প্রতিবেশীর আজ্ঞা অনুযায়ী চলার যে প্রক্রিয়া, তার নাম দেওয়া হয় ফিনল্যান্ডাইজেশন (ফিনলান্ডিজিয়েরুং)। আজকে তার চলন হয়তো অন্য কোন দেশেও আছে, নাম যাই হোক না কেন।
নয়ের দশক। বাণিজ্যিক কারণে আমার রাশিয়া আসাযাওয়া শুরু হয়নি। তবে খুব কাছের দেশ ফিনল্যান্ড-সুইডেনে ব্যবসার খোঁজে চক্কর লাগাই। হেলসিঙ্কির চার নম্বর আলেকসান্দারইনকাটুতে (আলেকসান্দার-সরণী) আমাদের অফিসে বসে এই নিয়ে গল্প হচ্ছিল আন্নেলি ব্রুমারের সঙ্গে। ফিনল্যান্ডের অনান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে সিটি ব্যাঙ্কের ব্যবসা বানিজ্যটা আন্নেলি দেখে। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে। সেই উচ্চারণে ইংরেজি বলে। তার হাতে সর্বদা ধূমায়িত সিগারেট দেখেছি। হয়তো তারই জন্য সব অফিসে ধূমপান নিষিদ্ধ হবে একদিন। আন্নেলির কণ্ঠস্বর ছিল একটু উঁচু পর্দায় বাঁধা। চোখে বিশাল চশমা। ভীষণ হাসিখুশি। সব ব্যাপারেই একটা মজা খুঁজে পায়। উত্তরের চারটি দেশের মধ্যে ফিনরা সবচেয়ে মনমরা গোছের, যেন দুনিয়ার সব সমস্যা তাঁদের ঘাড়ে। আন্নেলি তার ব্যতিক্রম।
হেলসিঙ্কির ফিনিশ বিজনেস স্কুল (স্থানীয় সুইডিশ বিজনেস স্কুলের সঙ্গে তার ভীষণ রেষারেষি) থেকে সদ্য পাশ করা সিটি ব্যাঙ্কের নবীনতম কর্মী আন্তেরো রান্তা বললে ফিনল্যান্ডাইজেশন শব্দটা বাজারে আর চালু নয়, কিন্তু আমরা এখন জড়িয়ে পড়েছি নর্ডিকাইজেশনে।
সেটা কী?
আপনাকে বোঝাই। এই দেখুন, নর্ডিকে আমরা সবাই ভাই-ভাই, শুধু ফিনিশ ভাষাটাই যা একটু আলাদা। রাশিয়ান খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়েছি। এখন আমরা অন্য তিনটি দেশের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজে নামি। বহু জিনিসের উদ্ভাবনা করি, সারা দুনিয়াতে সেগুলো বিক্রি করি। যেমন নোকিয়া ফোন, ইলেক্ট্রোলাক্সের ফ্রিজ, লেগোবোর্ড – মনে রাখবেন যখনই নতুন কিছুর কথা ভাবা হয়, সেটির পরিকল্পনা ও ডিজাইন করে ফিনিশরা, সুইডিশ ইঞ্জিনিয়ার সেটা বানায়, ডেনিশ বিক্রেতা বাহিনী দুনিয়া চষে বিক্রি করে আর নরওয়েজিয়ানরা এই সাফল্যে নিজেদের ভীষণ গর্বিত বোধ করে।
নাইজেল বললে, তাহলে বালটিকের কথাও হোক!
আন্নেলির কাজের এবং আড্ডার অন্যতম প্রধান সাগরেদ ইংরেজ যুবক নাইজেল বুল। লন্ডন আসা যাওয়ার পথে সে নিয়মিত হেলসিঙ্কির শুল্ক বিভাগকে ফাঁকি দিয়ে আন্নেলির সিগারেট সরবরাহ করে। দু’বছরের জন্য সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডন থেকে হেলসিঙ্কি এসেছিল নাইজেল। আর ঘরে ফেরে নাই! তার টেবিলে একটা পেল্লায় স্টিকার থাকত – “সেম বুল, অ্যানাদার ডে”। হেলসিঙ্কি ছোট শহর, তার কেন্দ্র আরও ছোট। সেখানে নাইজেলের সঙ্গে পথ চলতে গেলে বারে বারে থামতে হত। নাইজেলকে ব্যাঙ্কিং জগতের সবাই চেনে। তার দৌলতে আমারও চেনাজানার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এমনকি আন্নেলির মত সর্বজনবিদিত ব্যাঙ্কার মানতে বাধ্য হত, নাইজেল কফি হাউসে বসেই বাণিজ্য করতে পারে, আলেকজানদারইনকাটুর অফিসে নিত্যি হাজিরা দেওয়াটা তার পক্ষে অর্থহীন!
নাইজেল জানালে, নর্ডিকের মতন বালটিকের তিন দেশ লাটভিয়া-লিথুয়ানিয়া-এস্টোনিয়া নিতান্ত অন্তরঙ্গ ভ্রাতা ও ভগিনী। কিন্তু তাদের কাজের পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।
একই দিনে তিন দেশের রাজধানীর মাঝখানে লেনিনের স্ট্যাচু ভেঙে পড়েছে। সংস্কার প্রয়োজন। ভিলনিউসের পূর্ত বিভাগ টেন্ডার ডাকলেন: তাদের খাম খুলতে, বিচার বিবেচনা করতে ছ’মাস। রিগার সরকার বললেন, খুঁজে বের কর সেই রাশিয়ান কোম্পানিকে, যারা মূর্তি বানিয়েছিল। পাততাড়ি গুটিয়ে তারা কবে কেটে পড়েছে! সাম্প্রতিকতম সংবাদ অনুযায়ী রিগায় লেনিন এখনও ধরাশায়ী।
টালিনের এস্টোনিয়ান সরকার এর কোনটাই করলেন না, হেলসিঙ্কিতে খবর পাঠালেন। কাজটা দু’দিনে হয়ে গেল।
গপ্পের শেষে নাইজেল বললে, উপসাগরের এ’কুলে ও’কুলে ফিনল্যান্ড ও এস্টোনিয়া – এই দুই বিভিন্ন কেলাবের সদস্য – কিন্তু আসলে এই দেশ দু’টি যমজ ভাইয়ের মতন। তাদের ভাষা এক, এমনকি জাতীয় সংগীত এক। দুনিয়ার আর কোনো মানুষ এই দুর্বোধ্য ভাষাটা আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেনি। তাই ফিনল্যান্ড আর এস্টোনিয়া এই টু মাস্কেটিয়ারস নিজেদেরই দেখাশোনা করে!
নয়ের দশকে ফিনল্যান্ডের আর্থিক সিতারা একেবারে তুঙ্গে। দীর্ঘদিন সরকারি শেকলে বাঁধা আর্থিক আইন কানুন ঢিলে হয়েছে, টাকা উড়ছে হাওয়ায়। আন্নেলি একেবারে নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করেছিল – ফিনিশ ব্যাঙ্কের এমনি পাখা গজিয়েছে, যে মাটিতে আছড়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। দুর্দিন আসন্ন – ভাল দিনেই খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই ব্যাঙ্কগুলি বেশিরভাগ লগ্নি করলেন পশ্চিমের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে, এমনকি টেক্সাসে। অথচ পুবপানে কেউ তাকালেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন পনেরো টুকরো হয়েছে। নতুন নতুন রিপাবলিক আপন ঝাণ্ডা, মুদ্রা ও ব্যাঙ্ক খুলেছে।। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনবিধি বাজারি অর্থনীতির সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে – কিন্তু সেদিকে ফিনিশরা গেলেন না। আন্নেলির মতে তার একমাত্র কারণ ওই ফিনল্যান্ডাইজেশন। ১৮১২ অবধি সুইডিশ রাজত্বের অধীনে, পরের একশ’ বছর জারের শাসনে এবং বিগত ৫০ বছর সোভিয়েত প্রভাবে থাকার ফলে ক্লান্ত ফিনল্যান্ড এবারে নিজেকে “মুক্ত” মনে করতে আরম্ভ করেছে। কোনোমতেই পুবের পানে যাবে না! অথচ ফিনিশ কাগজের বৃহত্তম বাজার রাশিয়া। সিটি ব্যাঙ্ক তখনো রাশিয়াতে বিশেষ কিছু করছে না। আমাদের ইচ্ছেটা অবিশ্যি প্রবল।
আন্নেলি বললে, চল তোমাকে এক ফিনিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। তাঁর ব্যবসা সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেখানেই থাকেন। রাশিয়ান বউ।
হাতে সেদিন তেমন কাজ নেই। তাছাড়া, কে জানে, নতুন কোনো ধান্দা জুটেও যেতে পারে। গেলাম এসপ্লানাদির কাফেতে, যেন আমাদের চেনা কলকাতার কফিহাউসের হেলসিঙ্কি শাখা! নাইজেল আগেভাগেই ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে।
আন্নেলি ইয়ুহাভার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। লম্বা, কালো চুল, মুখে সামান্য দাড়ির আভাস। প্রাক্তন ব্যাঙ্কার। বহু বছর কানসালিস ওসাকে পানক্কিতে (ফিনিশ ভাষায় ব্যাঙ্কের প্রতিশব্দ পানক্কি!) কাজ করার পরে তাঁরই এক খদ্দেরের কোম্পানিতে যোগ দেন, তাঁরা কাগজ বানান। গাছে ভরা ফিনল্যান্ডে কাগজ এক বিরাট ব্যবসা। আর রাশিয়া তার প্রধান খদ্দের। সেই কোম্পানির সেন্ট পিটার্সবুর্গ অফিসে কাজ করেন ইয়ুহাভা। সোনায় সোহাগা – তিনি ফিনল্যান্ডের কাগজ নির্মাতা ও বিক্রেতাদের হাঁড়ির খবর রাখেন আর সেই ফিনিশ কাগজ আমদানি করেন রাশিয়াতে। আমার একটু বিদ্যে জাহির করার অভ্যেস। বললাম, পুশকিন গোগলের শহর একদিন দেখার আশা রাখি। ইয়ুহাভা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললেন, একবার আসুন। ভদ্রতা করে বলছি না। আপনাকে আমরা সে শহর ঘুরিয়ে দেখাব।
নিউ ইয়র্ক, লন্ডনে আমরা আকছার বলি, লেট আস হ্যাভ লাঞ্চ। সেটা কবে কোন বছরে কোথায় কোন রেস্তোরাঁয় হবে, তার কথা স্পষ্ট করে কেউ বলেন না। দু’পক্ষই সেই লাঞ্চের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে ‘ইট ইজ এ গুড আইডিয়া’ বলে যে যার পথে চলে যায়, বেশিরভাগ লাঞ্চ আর হয় না। ফিনিশদের একটা বদভ্যাস আছে। আপনি যেই বলেছেন, লেট আস হ্যাভ লাঞ্চ – তাঁরা তৎক্ষণাৎ কাগজ-কলম (সেকালে) অথবা আইফোন (একালে) বের করে দিন-তারিখ নির্ধারণ করবেন। তবে আপনার মুক্তি!
মার্চ ১৯৯৪। তখনো বেজায় শীত। একটা কাজে রাশিয়া যেতে হল। এবার বনপথে নয়। হাওয়া পথে, সরকারি কাজে – সিটি ব্যাঙ্ক একাধিক নতুন রাশিয়ান ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত করতে আগ্রহী। সে একটা আশ্চর্য সময় ছিল। শুধু দেওয়াল ভাঙা নয়, দরোজা-জানালা খুলে যাওয়ার সময়। মুক্তি ছবির শুরুটা কেবলই মনে পড়ে যায়। প্রমথেশ বড়ুয়া হাঁটছেন। পিছন ক্যামেরা পিছন থেকে তাঁকে অনুসরণ করছে – একের পর এক দরোজা খুলে যায়, তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।
রাশিয়াতে যদি একটিমাত্র শহর দেখতে চান, সেটির নাম, অনেক বার বদলিয়ে, এখন সেন্ট পিটার্সবুর্গ। অপিচ শীতকালে যাবেন না, দীর্ঘদিনের বরফে তুষারে মৃতপ্রায়। আমি প্রচণ্ড ঠান্ডায় ভুগেছি, যদিও মাথাটি যথা সম্ভব মুড়ে রেখেছিলাম। প্রতিবেদনের ছবিতে সেটি ভয়াবহ রূপে প্রকট হয়েছে।।
মস্কোর বয়েস ন’শ’ বছর। মাত্তর ১৮ শতকে জার পিটার দি গ্রেট এই ভুঁইফোড় শহরটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম নাম সাঙট-পিটার-বুর্খ (ডাচ)। জার্মান প্রভাবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় সাঙট পেটার্সবুর্গ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান শব্দ ব্যবহার জনবিরোধী বিবেচিত হল। নাম বদলে পেত্রগ্রাদ – পিটারের গড়! এই সময় ব্রিটেনেও দু’টি নামের পরিবর্তন হয় একই কারণে। লর্ড বাটেনবের্গ (ফ্রাঙ্কফুর্টের অনতিদূরের গ্রাম) হলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন (বের্গ = পাহাড় = মাউন্ট: বাটেন হল ব্যাটেন)। ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরিচয় হাউস অফ হানোভার (জার্মান শহর, যেখান থেকে রাজা জর্জকে খুঁজে এনে সিংহাসনে বসানো হয় ১৮ শতাব্দীতে – পরবর্তী ছয় রাজার ধমনিতে ছিল জার্মান রাজরক্ত, প্রত্যেকে জার্মান বলেছেন) বদলে হাউস অফ উইনডসর। সহজ ব্যবস্থা। জার্মানির সঙ্গে যখন লড়াই চলছে, পিতৃপুরুষের নাম বদলে ইংরেজ সাজাটাই তো বাঞ্ছনীয়।
লেনিনের পুণ্যস্মৃতিতে শহরের নাম হল লেনিনগ্রাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে নাম নির্বাচনের জন্য গণভোট নেওয়া হয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পুরোনো নামটি গৃহীত হয়েছে – সেন্ট পিটার্সবুর্গ। রাশিয়ানে অবশ্য এস বিবর্জিত – সেন্ট পিটারবুর্গ। লোকমুখে শুধুই পিটার।
সুইডেনকে যুদ্ধে হারিয়ে পিটার শুধু এই শহর প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি আধুনিক রাশিয়ারও প্রতিষ্ঠাতা। ইউরোপ সন্ধান করে আনলেন ইতালিয়ান, ডাচ, ফরাসি স্থপতি। তৈরি করলেন এক অনবদ্য শহর। উত্তর ইউরোপে এর তুল্য কোনো শহর নেই। নেভা নদীর ওপর যে কোনো সেতুর ওপর দাঁড়ালে ভেনিসকে তুচ্ছ মনে হবে – সেখানে মাত্র ৩০০ সেতু, পিটারে ৩৪২। ওয়ান ডে ক্রিকেটের হিসেবে বেয়াল্লিশ রানে জিতে যায় পিটার।
এরমিতাজ / উইন্টার প্যালেস এক অসাধারণ সংগ্রহশালা – সেখানে দিন সাতেক কাটানো যায় অনায়াসে। কেবল ল্যুভরের সঙ্গে তুলনীয়।
ইয়ুহাভার কথা মনে ছিল। ভদ্রতার খাতিরে ফোন করলাম। তিনি মহা উল্লসিত হয়ে বললেন, আমাদের বাড়িতে এসে উঠুন। আমি বললাম না, মানে আমি তো ব্যাঙ্কের কাজে এসেছি। তারাই ব্যবস্থা করেছে। তিনি শোনার পাত্র নন। “ব্যাঙ্কের দুটো পয়সা বাঁচান”। তাঁকে কোনোমতে নিরস্ত করা গেল। সেদিনের সন্ধ্যা ও পরের দিনটা, শনিবার, একসঙ্গে কাটানোর কথা হল। আমার আস্তানা ছিল নেভস্কি প্রসপেকত বা অ্যাভেন্যুর ওপর। সেটি এই শহরের ধমনী। এর এক মাথায় স্বয়ং আলেকসান্দার নেভস্কি (যার জন্ম নভ গরদ শহরে – নভ মানে নব, গরদ মানে গড় – নব গড়!) ঘোড়ায় চড়ে বসে আছেন হাজার বছর। আর অন্য মাথায় পিটারের উইন্টার প্যালেস চত্বর। এই সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে এ শহরের, রোমানভ রাশিয়ার ইতিহাস ইটে পাথরে কানালের ফ্রেমে বাঁধানো আছে। আমার দীর্ঘ ভ্রমণে নেভস্কি প্রসপেকতের মত ঐতিহাসিক এবং কালানুক্রমিক ধারা বিবরণীর জিতা জাগতা সবুত কম দেখেছি।
আমার হোটেলের সামনেই কাজান ক্যাথিড্রাল আর তার বিশাল কলোনেড – রাশিয়ান বিপ্লবের পরে ৭৫ বছর এটি ছিল ধর্ম বিষয়ক এবং নাস্তিকদের মিউজিয়াম। সেখান থেকে গ্রিবয়দোভ কানাল ধরে ময়কা নদীর উদ্দেশ্যে উত্তরদিকে এগুলে ডান হাতে পড়ে একটি অত্যন্ত বর্ণময় পেঁয়াজ আকৃতির গির্জে, রক্তপাতের মুক্তিদাতা, যার তুলনা একমাত্র মস্কোর লাল চত্বরে আছে – সন্ত বাসিলের ক্যাথিড্রাল (সবোর ভাসিলিয়ে)। ১৮৮১ সালের ১৩ই মার্চ দ্বিতীয় জার আলেকসান্দার এখানে আততায়ীর বোমায় আক্রান্ত হন। তাঁর ঘোড়াগাড়ির কোচ বোমা-বুলেট প্রুফ: প্রথম বোমায় তিনি অক্ষত ছিলেন। পুলিশের বারণ সত্ত্বেও ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত করার জন্য কোচ থেকে নামলেন এবং দ্বিতীয় আততায়ীর বোমায় নিহত হলেন।
তেত্রিশ বছর বাদে সারায়েভোতে আততায়ীর নিক্ষিপ্ত বোমায় সম্পূর্ণ অক্ষত অস্ট্রিয়ান রাজকুমার ফ্রান্তস ফারদিনান্দ ও রাজকুমারী সোফি পুলিশের বারণ না শুনে মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন সকালবেলার বোমবাজিতে আহত মানুষদের দেখতে। ল্যাটিন ব্রিজের কোণায় দাঁড়ানো গাভ্রিলো প্রিন্সিপ সেকেন্ড চান্স পেলেন – দু’টি গুলি, দু’টি মৃত্যু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
কাজান ক্যাথিড্রালের উলটো দিকে গ্রিবয়দোভ কানালের কোণায়, ২৮ নম্বরে, দেখবেন বিখ্যাত আমেরিকান সেলাই মেশিন কোম্পানির সিঙ্গার হাউস – উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এটি তৈরি হয়েছিল রাশিয়া থেকে তুরস্ক অবধি বাণিজ্য বাড়ানোর মানসে। মালিকদের ইচ্ছে ছিল নিউ ইয়র্ক স্টাইলে আকাশচুম্বী অট্টালিকা বানানোর, কিন্তু পৌরপিতারা জানান পিটার্সবুর্গে কোনো বাড়ির উচ্চতা জারের উইন্টার প্যালেসের মাথা ছাড়াতে পারে না! অতএব একটি কাচের ডোম যোগ করা হয়েছিল। সোয়া শ’ বছর আগে তৈরি অসাধারণ আর্ট নুভো স্থাপত্য। পদে পদে থমকে দাঁড়াবেন। সে পথ শেষ হয় এক বিশাল চত্বরে, উইন্টার প্যালেস – একশ’ পাঁচ বছর আগে অক্টোবর মাসের এক সন্ধ্যায় সেখানে সমবেত হয়েছিলেন যে জনতা, তাঁরা তৈরি করলেন আরেক ইতিহাস।
আমাদের সাক্ষাৎ হবে ময়কা নদীর ব্রিজের কোণায় সাহিত্যিক কাফেতে। উইন্টার প্যালেস থেকে তিন মিনিটের হাঁটা। সে পথে ময়কা পেরিয়েই এই কাফেটি। ইয়ুহাভা এলেন সস্ত্রীক। আনা মধ্যবয়সিনী ক্ষীণকায়া ব্লন্ড। দর্শন ও ইংরেজি পড়েছেন। সেন্ট পিটার্সবুর্গে বড় হয়েছেন। ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। হেলসিঙ্কি তো নয়ই। সেটা একটা গ্রাম। ইয়ুহাভাকে বলেন, দেশের কথা মনে হলে একবার স্টেশনে যেও! সেন্ট পিটার্সবুর্গ স্টেশনের নাম ফিনলান্ডস্কি। রাশিয়ান জার হেলসিঙ্কি থেকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ রেললাইন বানান আর তার স্মৃতিতে শেষ স্টেশনের নাম! এখান থেকে হেলসিঙ্কি তিনশ’ কিলোমিটার, ঘণ্টাচারেক লাগে। রাশিয়ান রেলের গেজ ১.৫২৪ মিটার, ইউরোপীয় গেজ ১.৪৩৫ মিটার। জার্মানরা যখন রাশিয়া আক্রমণ করে, তাদের অস্ত্র শস্ত্র ও সৈন্যবাহী ট্রেনকে থামতে হত রাশিয়ান সীমান্তে। আবার মাল ওঠানো নামানো (উমলাদুং)। এই কারণে হিটলারের রাশিয়া অভিযানের সাপ্লাই লাইন প্রলম্বিত হয়। বালটিক এবং ফিনল্যান্ড আক্রমণের সময়ে রাশিয়ান সৈন্য চলাচলের কোন অসুবিধে হয়নি – তাদের রেলওয়ে গেজ একই!
প্রসঙ্গত মস্কোর প্রধান ট্রেন স্টেশনের নাম সাঙ্কট পিটারবুর্গ (পুরোনো লেনিনগ্রাদ) এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গের স্টেশনের নাম মস্কভস্কি। মনে করুন হাওড়া ব্রিজ দেখতে পাচ্ছেন, এমন সময়ে ট্রেনের ঘোষণা শুনলেন – আমাদের পরবর্তী এবং অন্তিম স্টেশন – বর্ধমান! অথবা সবে বাঁকা নদী পেরুচ্ছে কোলফিল্ড এক্সপ্রেস দৈববাণী হল – আগামী স্টেশন হাওড়া।
মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গের প্রধান স্টেশন একে অপরের কার্বনকপি।
আনা বললেন আপনার কথা শুনেছি ইয়ুহুভার কাছে। রাশিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে জানি। আপনাকে এখানে আমন্ত্রণ করার একটা মুখ্য কারণ এই, যে এই কাফেতে পুশকিন এবং তাঁর চেয়ে বিশ বছরের ছোট দস্তিয়েভস্কি এখানে বসে গুলতানি করতেন!
আনাকে জানালাম, ভারতীয়দের কথা বলা শক্ত। তবে বাঙালি হিসেবে বলতে পারি, এখন কেউ পড়েন কিনা জানি না, তবে আমাদের বাল্যকালে বাংলা ভাষায় প্রচুর রাশিয়ান সাহিত্য পড়েছি। ঝরিয়ার বঙ্গ বিদ্যালয়ে বারো বছর বয়েসে প্রাইজ পেয়েছিলাম গোর্কির মা! চেলকাশের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি বরানগরের স্কুলে। চেকফের অনেক নাটক, গোগোল, দস্তিয়েভস্কি (এই উচ্চারণটা সঠিক বলে রাশিয়ানরা জানিয়েছেন) আমাদের চেনা, জানা, পড়া। নান্দীকারের মঞ্জরি আমের মঞ্জরি দেখা! রাশিয়ান সাহিত্য এককালে রীতিমত সরগরম করে রেখেছিল আমাদের বাজার। তবে বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করলাম, ডন ট্রিলজি পড়ি নি এবং টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি পড়ার ধৈর্য ছিল না। আমার বিশেষ আগ্রহ আপনাদের তিন মহান সন্তানকে নিয়ে – পুশকিন, দস্তিয়েভস্কি, গোগোল। শুনে আনা যারপরনাই সন্তুষ্ট হলেন। ইয়ুহাভা দ্রুত যোগ করে দিলেন, ইনি আফ্রিকাতেও বাণিজ্যের ব্যপারে আসা-যাওয়া করেন। আনা এমন আকস্মিক ব্যাঘাতে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত বোধ করলেন না। পুশকিনের প্রপিতামহ যে আফ্রিকান – সেটি আমার জানা ছিল না। আজকের পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন দেশ থেকে আট বছরের এক বালক আব্রামকে ছিনিয়ে এনে তুর্কির অটোমান রাজদপ্তরে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে তিনি আবার বিক্রিত হন রাশিয়ান জার পিটারের কাছে। পিটারের স্নেহ বর্ষিত হল এই বালকের প্রতি। তাকে জার্মানি ও ফ্রান্সে পাঠালেন অঙ্ক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে। অল্প সময়ের মধ্যে আব্রাম তার মেধার পরিচয় দেন। পিটারের রাজ্যে অনেক খাল, প্রাসাদ তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি। আব্রাম ও সুইডিশ রাজকুমারী কাথারিনের কন্যা নাদেজদা আমাদের পুশকিনের মাতা। গোগল ইউক্রেনের লোক, তবে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এই শহরে। যেমন কাটিয়েছিলেন চাইকোভস্কি, রিমস্কি, করসাকফ – আমার তিন ছেলেমেয়ের পিয়ানো-চর্চার দৌলতে এ নামগুলি বেশ চেনা।
আড্ডা বেশ জমে উঠেছে, এমন সময়ে “কাক দেলা (কেমন, কী খবর)” বলে আনার পরিচিত জনাতিনেক এগিয়ে এলেন আমাদের টেবিলের পানে, যেমন পাড়ার হারুর চায়ের দোকানে হয়। আসন গ্রহণ, দ্রুত আলাপ – এঁরা সকলেই ডাক্তার। সেন্ট পিটার্সবুর্গের কাছে সেসত্ররেস্ক অঞ্চলে থাকেন। ওলগা, ওলেগ এবং আনা। তাঁদের মতন ঝরঝরে অ্যাকসেন্ট বর্জিত ইংরেজি আমি রাশিয়াতে কম শুনেছি। এঁরা আই হ্যেভ বলেন না। এই পরিচয় সেদিনের পুশকিন কাফেতে শুরু হয়ে সেসত্ররেস্ক অবধি গড়িয়েছিল। এঁরা আমাকে ভদকা পানের সঠিক তরিকা শেখান। সেটার গল্প পরে হবে।
কথায় কথায় কখন যে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল।
সেন্ট পিটার্সবুর্গে, সর্বত্র সস্তায় যাতায়াত ঘোরাফেরা করার শ্রেষ্ঠ বাহন হল পিটারবুর্গস্কি মেত্রপলিতেন – মেট্রো। প্রতিটি স্টেশন কোনো না কোনো শিল্পকলার নমুনা। স্থির হল, পরের দিন দেখা হবে একটি স্টেশনে, যার রাশিয়ান নাম ছেরনায়া রেচকা বা কালো নদী বা কালো স্রোত।
ছেরনায়া রেচকা সেই জনস্থান, যেখানে মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে সম্ভবত রাশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আলেকসান্দার পুশকিন এক সম্পূর্ণ অর্থহীন ডুয়েলে ফরাসি অফিসার দান্থেসের গুলিতে প্রাণ হারান। ডুয়েলের কারণটা জানা গেল বটে, তবে সেটার বর্ণনা আজ অবান্তর। সেখানে একটি স্মারক আছে, যার সামনে শ্রদ্ধা জানালাম। শহরের বাইরে জারের গ্রামের বাসভবন, জারস্কি সেলোর নাম এখন পুশকিন।
সন্ত আইজাক (ঈসাকিয়েভস্কি সোবর) ক্যাথিড্রাল একটি বিশাল স্থাপত্য, ভ্যাটিকানের মাঝারি সাইজের কপি। বিবর্ণ। সামনে সম্পূর্ণ জনশূন্য প্রকাণ্ড চত্বর। কোথাও কোনো মানুষের দেখা নেই। জার প্রথম আলেকসান্দার অবিশ্যি ঘোড়ায় চড়ে বসে আছেন আপনার অপেক্ষায়, দেড়শ’ বছর যাবত। আনা জানালেন কম্যুনিস্ট আমলে এর প্রধান দ্বার গজাল দিয়ে বন্ধ ছিল, বাঁদিকের গেট দিয়ে ঢোকা যেত ধর্ম এবং নাস্তিকতার মিউজিয়ামে। মাত্র বছর দুয়েক হল দরোজা খুলেছে। ভেতরে ঢুকে দেয়ালে টাঙানো একটি ছোট কাস্কেটের খুব কাছাকাছি গিয়ে তিনি আমাকে একটি অর্থোডক্স আইকন দেখাতে গেলেন। এক উর্দি-পরা পুলিস এসে পড়ল অকস্মাৎ। তাঁকে কিছু বলল, হয়তো একটু দূরত্ব বজায় রাখতে আজ্ঞা দিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আনার চোখে একটা ভীতি খেলা করে গেল। তবে সামলে নিলেন। ৭০ বছরের পুলিসের হুকুম আর তার উর্দির ভীতি সহজে যাবার নয়।
দেড়শ’ বছরের পুরোনো মারিনস্কি থিয়েটার বিশ্ববিখ্যাত। একদা সার্কাস ও নাটক দু’-ই হত। চাইকোভস্কির অনেক অমর সঙ্গীত এখানে প্রথম শোনা যায়। তার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম ৭ নম্বর কাঝনাচেস্কায়াতে। সেই বাড়ির সামনে একটি ফলকে লেখা আছে, এখানে ফিওদর দস্তিয়েভস্কি বসবাস করতেন। আনা বললেন, আপনার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়া আছে তো? চলুন এবারে রাসকোলনিকভের বাড়িটা দেখাই। আমি বললাম, সে কী, ওটা তো কল্পিত চরিত্র! আনা বললেন, “কিছু লোক বইটা হাজারবার আদ্যোপান্ত পড়ে এবং এই অঞ্চলের ভূগোলটা গুলে খেয়ে এক মহাসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। নিকটবর্তী ১৯/৫ গ্রাঝানসকায়া হচ্ছে সেই অকুস্থল! বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানহাতে গিয়ে প্রথম ডানদিকে ঘুরলেই সে রাস্তায় পড়া যায়। সেখানে একটি গির্জে আছে, যেটির নিখুঁত বর্ণনা দস্তিয়েভস্কি তাঁর লেখাতে দিয়ে গেছেন”। ঠিক করলাম ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট আবার পড়তে হবে। মিলিয়ে দেখব!
কাছেই সেই ব্রিজ, যেখান থেকে রাসপুতিনকে ময়কার জলে নিক্ষেপ করা হয়। চারটে সাইনাইডের ক্যাপসুল, দু’টি বন্দুকের গুলিতেও নাকি কাজ হয়নি! শেষ অবধি সলিল সমাধি দিয়ে নিশ্চিন্ত। আনা বললেন, “পথে পড়ল বলে দেখালাম। রাসপুতিন আমার কাছে একটা বিড়ম্বনা মাত্র। এবার চলুন নেভস্কি প্রসপেকতের অন্যপ্রান্তে, যেখানে নেভস্কি ঘোড়ার ওপর সওয়ার। ঠিক তার পেছনে একটি অর্থোডক্স সন্ন্যাসীদের মঠ। তার বয়েস শহরের সমান। সেখানে একটি বিশেষ কিছু দেখার আছে”।
এর নাম শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ মানুষদের সমাধি! নেক্রোপলিস। চিরনিদ্রায় শায়িত রাশিয়ার অসামান্য মানুষেরা – দস্তিয়েভস্কি, চাইকভস্কি, রিমস্কি-করসাকফ, গ্লিঙ্কা (রাশিয়ান সঙ্গীতের পিতা), লমনোসোভ (রাশিয়ার নিউটন), যার নামে মসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি নামাঙ্কিত।
আমার হোটেল কাজান ক্যাথিড্রালের পাশে। আনা বললেন, আপনি ব্যাঙ্কার – তাই একটি বাড়ি আপনাকে দেখাই, ওই যে সিঙ্গার বিল্ডিঙের পরেই। সিরিলিকে লেখা, পড়তে পারবেন না যদিও। তাতে লেখা আছে ফার্স্ট মিউচুয়াল ক্রেডিট ব্যাঙ্ক – সেন্ট পিটার্সবুর্গের প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। এখন ওই লেখাটুকু আছে। আপনি হয়তো জানেন, ফরাসি ব্যাঙ্ক ক্রেদি লিওনে প্যারিসে অফিস খোলার আগে সেন্ট পিটার্সবুর্গে শাখা খোলে ১৮৭৮ সালে। এ’ শহরে তারাই প্রথম বিদেশি ব্যাঙ্ক।
মনে মনে দ্রুত হিসেব করে দেখলাম, সেই সময়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড কলকাতায় আর হংকং-সাংহাই ব্যাঙ্ক হংকং আর সাংহাইতে সবে তাদের প্রথম দোকান খুলেছে! ইয়ুহুভা মৃদু হেসে বললেন আনার অজ্ঞাত কিছুই নেই – এই শহরের ব্যাঙ্কের বয়েস কেন, শিল্পকলা থেকে ময়কা ব্রিজ অথবা উইন্টার প্যালেসের দরোজার মাপ – যে কোনো জিনিস নিয়ে সে পাঁচ মিনিট বলতে পারে! আমি কাগজের ব্যবসা নিয়ে পাঁচদিন। আনা তর্জনীর আঘাতে ইয়ুহুভাকে নিরস্ত করলেন।
এটা ১৯৯৪ সালের কথা। রাশিয়ার অর্থনীতি তখন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেয়ে খোলা বাজারের পথে হাঁটার রাস্তা খুঁজছে। ধুলোয় ঢাকা পথঘাটে ঐতিহাসিক লাদা গাড়ি, নেভস্কি প্রসপেক্তের অসাধারণ মহিমামণ্ডিত স্থাপত্যে চুনকাম হয়নি সত্তর বছরে। বাইরের দুনিয়ার কাছে এ’ দেশ এই সেদিন অবধি ছিল সুপার পাওয়ার।
ইয়ুহুভা, আনা আমাকে হোটেল পৌঁছুতে এসেছিলেন। কাজান ক্যাথিড্রালের পাশের রাস্তায় যেন একটা বাজার বসেছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হল, এটা ওই পুরোনো জিনিসের মেলা। ইংরেজিতে ফ্লি মার্কেট, ফরাসিতে ব্রোকান্ত। মানুষজন তাঁদের অপ্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী বেচেন এবং আরও কিছু মানুষ সেই সব কিনে আপন অপ্রয়োজনীয় বস্তুর তালিকায় যোগ করেন। ইংল্যান্ডে আরও একটা নাম আছে, গ্যারাজ সেল, সেখানে বিকিকিনি দ্বারা প্রাণধারণের কোনো প্রচেষ্টা থাকে না। এই বাজারকে অন্যরকম মনে হল। ব্রোকান্ত বা ফ্লি মার্কেটের মতন কেউ দোকান পেতে বসেননি। রীতিমত সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষজন দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়িতে। কারো হাতে একটা স্যুট, কোনো ভদ্রমহিলা একটি পোশাক দু’হাতে তুলে দাঁড়িয়েছেন। নিঃশব্দে। বিক্রি করার কোনো স্টল বা টেবিল নেই। আমি একটু বিস্মিত মুখে ইয়ুহুভার দিকে তাকালাম। আনা অন্যদিকে কিছু একটা দেখছেন। ইয়ুহুভা নিম্ন কণ্ঠে বললেন, একটা সম্পন্ন দেশের অর্থব্যবস্থা ভেঙে গেছে। র্যাশনের রুটি অনিশ্চিত। এঁরা জানেন না – কালকের অন্ন কোথা থেকে জুটবে। তাই ঘরের যা আছে, তাই বিক্রি করতে পথে বেরিয়ে পড়েছেন। কোনোদিন কিছু বেচেননি। জানেন না তার কায়দা কী। তাই চুপ করে হয়তো নিজের শেষ স্যুটটি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি কেউ কেনে, আজ অন্ন জুটবে। তিনি থামলেন। আমি কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আনা তখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। শেষ কয়েক কদম চুপচাপ হেঁটে গেলাম।
আমার সংগ্রহে যুদ্ধবিধ্বস্ত বার্লিনের সাদা কালো ছবি আছে – জার্মান বন্ধুর বদান্যতায় পাওয়া। সেটা জুলাই ১৯৪৫। সেদিন ঠিক এমনিভাবে মানুষজন ভাঙা বাড়ি থেকে যা উদ্ধার করতে পেরেছেন তা নিয়েই পথে দাঁড়িয়েছেন, যদি সে সব বেচে এক দিনের খাবার জোটে। সে কথাটা আনাকে বলা গেল না।
হোটেল অবধি আনা চুপ করেছিলেন। অনেক ধন্যবাদ দিয়ে যখন বিদায় নিচ্ছি, আনা বললেন “যাদেরই বুদ্ধি-বিবেচনা আছে আর হৃদয় আছে, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা পাওয়া অবধারিত। কে বলেছেন জানেন? দস্তিয়েভস্কি!”