১৯৯৮ সালের গ্রীষ্মকাল শেষ হওয়ার আগে অনেক পশ্চিমী ব্যাঙ্কিং মহারথী নিজের হাত ও মুখ পুড়িয়ে এবং তাঁদের ব্যাঙ্কের প্রভূত অর্থ অপব্যয় করে মস্কো থেকে পশ্চিমমুখী শেষ বিমানটি ধরলেন। চাচার আপন প্রাণ বাঁচানোর দৃপ্ত দৃষ্টান্ত। কিন্তু দেশটা আর কোথায় যাবে? মস্কো থাকে সেই মস্কোতেই। চোর অনেক দূরে চলে গেলেও বুদ্ধি বাড়বার অবকাশ থেকে যায়। রুবলের মূল্যহ্রাস করার ফলে লগ্নি বাড়ল। তার সঙ্গে বাড়ল মুদ্রাস্ফীতি (১৯৯৯ সালে সেটি গিয়ে দাঁড়ায় ৮৫%)। খনিজ তেলের দাম বাড়তে থাকে। রাশিয়ান সরকারের খাজানায় অর্থের টঙ্কার। যেমন দ্রুত ছিল অর্থনীতির অধোগতি, প্রায় তেমনি শুরু হল ঊর্ধ্বগতি। তৈলং শরণং গচ্ছামি! একাধিক তেল কোম্পানি বাজারে এলেন। তাঁদের তেলের ভবিষ্যৎ বিক্রিকে বন্ধক নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অর্থসংগ্রহ করার কাজ চলছে। রাশিয়ান ব্যাঙ্কগুলিকে সযত্নে এড়িয়ে গেছি।
১৯৯৯ সালে ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন দেশের হাল ধরলেন।
আমি সিটি ব্যাঙ্ক ছেড়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে যোগ দিই ২০০১ সালের শেষদিকে। পূর্ব ইউরোপে এ ব্যাঙ্কের কোনো কাজকর্ম নেই। তবু একই বাজারে ওঠাবসা। খবরাখবর রাখি। ডট কম বুমের বেলুনটি ফেটে গেল একদিন। দুর্দম বেগে আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ সংগ্রহের ব্যাবসা চলছে। সবাইকে কোনোমতে করে খেতে হবে। তেল ছাড়া আরেকটি রাশিয়ান ব্যাবসা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটি নিকেল সহ নানান রকমের ধাতুর রপ্তানি। সে ডিলের গঠন একই। শোধ দেওয়ার ঝুঁকি রাখা হয় পশ্চিমের আমদানিকারির ওপর। ইউক্রেন এই দলে যোগ দিলো। নানান কনফারেন্সে নতুন ঋণের প্রকল্প শুনি। তার অন্যতম প্রবক্তা ডয়েচে ব্যাঙ্কের জন ম্যাকনামারা (ম্যাক নামে সুপরিচিত)। ম্যাক অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট। বাকভঙ্গি ও বক্তৃতায় তার পরিচয় মেলে। এই বিশেষ ঋণ প্রকল্পকে বলা হত সুরক্ষিত বা স্ট্রাকচারড ঋণ। যার মূল মন্ত্র হল ধার শোধ দেওয়ার ঝুঁকিটিকে উন্নততর দেশে পাঠানো। নতুন কিছু নয়, যেমন আমরা গাজপ্রমের ক্ষেত্রে করেছিলাম, তবে গাজপ্রমের গ্যাস যায় পাকাপোক্ত পাইপলাইন দিয়ে। ইউক্রেন বা রাশিয়ার ধাতু রপ্তানি হয় জাহাজ যোগে। অদূর ভবিষ্যতে ম্যাকের এই ব্যাবসায় দুর্দিন আসবে।
বেল পাকিলে কাকের কী? আমাদের ব্যাঙ্ক তো পুবমুখী হবে না। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে নতুন লোকেরা কাজে যোগ দিয়ে প্রশ্ন করতেন – দক্ষিণ আমেরিকায় বা ইউরোপে আমাদের শাখাপ্রশাখা নেই কেন। ব্যাঙ্কের ইতিহাস তাঁরা পড়েননি। বক্তিমে না দিয়ে এর একটা খুব সহজ উত্তর দিতাম। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের শাখা বা অস্তিত্ব মাত্র সেই সব দেশেই দ্রষ্টব্য, যেখানে ব্রিটিশ পতাকা অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য উত্তোলিত হয়েছে (ব্যতিক্রম পেরু-চিলি-ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা)।
অন্যান্য ব্যাঙ্কের মানুষজন রাশিয়াতে ‘ডিল’ খোঁজায় ব্যস্ত। উদ্যোগী, লোভী ব্যাঙ্কার ১৯৯৮ সালের কথা মনে রাখেননি। আবার নতুন করে রাশিয়া আবিষ্কার শুরু। এক আমেরিকান ব্যাঙ্কারের গল্প মনে পড়ে। নিউ ইয়র্কের বারে বসে বলেছিলেন, সিটির মত আমেরিকান ব্যাঙ্কেরা হঠাৎ করে একটা নতুন ব্যাবসা আবিষ্কার করে ফেলে। তৎক্ষণাৎ সেখানে যাবতীয় রিসোর্স দেওয়া হয়। ধন-প্রাণ-মন। ঠিকমত না চললে আবার সেইরকম অকস্মাৎ দোকানপাট গুটিয়ে কেটে পড়ে। কেন যে সেখানে যাওয়া আর কেনই বা পলায়ন – তার যুক্তি মেলে না। এরা কেউ লম্বা দৌড়ের ঘোড়া নয়!
একটি ব্যতিক্রম চোখে পড়ল।
ভারতের একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ততদিনে ইউরোপে শাখা বিস্তার করে চলেছে। তাদের লন্ডন অফিসকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক থেকে আমরাই প্রথম আন্তর্জাতিক ঋণের ব্যবস্থা করে দিই। পরে তাঁরা জার্মানি রাশিয়া ইত্যাদি নানান দেশে ব্যাঙ্ক খুলেছেন। তাঁদের চেয়ারম্যানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বাজারে সে ব্যাঙ্ক এক বড় খেলোয়াড়ের ভূমিকা নিতে বদ্ধপরিকর। যদিও আফ্রিকাতে সে ব্যাঙ্ককে আগে কখনো দেখা যায়নি, সে বাজারেও তাঁরা নেমে পড়লেন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররূপী বীরের ছাঁদে। ঋণের আয়োজন করছেন, বিশেষ করে নাইজেরিয়াতে। সে দেশে তাঁদের অবস্থিতি নেই। কিন্তু সেখানে সুদের হার, ফি এবং প্রলোভন বেশি।
আমাদের বেসিংহল অ্যাভেন্যুর অফিসে তাঁদের এক তরুণ অফিসারের সঙ্গে মিটিং। ইউরোপের নানান দেশে আমরা কোথায় কী বাণিজ্য করছি, আমরা সমবেতভাবে ঝুঁকি নিয়ে ব্যাবসা বিস্তার করতে পারি কিনা – এমনি সব বাক্যালাপ চলছে। ইউরোপে আমরা গোণাগুণতি কয়েকটি কর্পোরেটের সঙ্গে ঋণসংগ্রহের কাজ করি, কারণ এশিয়া আফ্রিকা অঞ্চলে আমরা তাঁদের স্থানীয় ব্যাংকার। আমি বলতাম বাস করি ইউরোপে কিন্তু মন ও ব্যাবসা আমার আফ্রিকা, এশিয়াতে।
যুবকটির নাম জল্পেশ (পদবি জানালে চিনতে পারেন, তাই সেদিকে যাচ্ছি না)। আলোচনা যত এগোয়, ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ব্যাবসায়ে আমাদের ব্যাঙ্কের সামগ্রিক অথর্বতা দেখে সে অধৈর্য হয়ে পড়ে। তাকে কী করে বোঝাই, যে এই বেসিংহল অফিস ছাড়া সারা ইউরোপে অন্য কোথাও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড নামের কোনো বোর্ড সে দেখতে পাবে না (২০০৮)! খানিকটা অধৈর্য হয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হঠাৎ উঠে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আপনারা রাশিয়াতে কিছু করছেন না কেন? আমরা এত ব্যাঙ্ককে বাজারে নিয়ে আসছি, আপনারা দূরেই থাকছেন। আবার বলতে হল, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড একটি গেঁড়ে ব্রিটিশ কলোনিয়াল প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ পতাকা যেসব দেশে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য ওড়েনি, সেখানে বানিজ্য করায় আমাদের একটা স্বাভাবিক কুণ্ঠা আছে। জল্পেশ সেই একই সুরে বলল, আপনারা মস্ত বড় সুযোগ হারাচ্ছেন।
১৯৯৮ সালে জল্পেশের বয়েস কত ছিল? ভাববার চেষ্টা করলাম।
ক্রমশ আমার কৌতূহল জাগরিত হতে থাকে। এই বেসরকারি ভারতীয় ব্যাঙ্কটি রাশিয়াতে এত প্রাণ, মন, অর্থ, প্রয়াস ঢেলে দিয়েছে? আপন দেশে তাদের বাণিজ্য বেশ ভালো। তাহলে অচেনা, অজানা গলিতে ঘোরাঘুরি কেন? তাদের কাছ থেকে আমাদেরও কিছু শেখার আছে? আমি ভারতীয় ব্যাঙ্কের বিদেশি শাখায় কাজ করেছি এককালে। সেখানে আমাদের ব্যাবসা সীমাবদ্ধ ছিল ভারতীয় টাকার লেন দেন, আমদানি রপ্তানি, ক্বচিৎ কোনো দেশি প্রতিষ্ঠানকে ধার দেওয়ার মধ্যে। তবে বিদেশি কোম্পানি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দুয়োরে আসবেই বা কেন? এলে পরে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।
রাশিয়াতে তখন পাঁচশোর বেশি ব্যাঙ্ক। ২০০৫ সালে এই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নিতান্ত নামমাত্র মূল্যে আই কে বি নামের একটি রাশিয়ান ব্যাঙ্ক কিনেছিলেন বলে জানি। দেশের লিগ টেবিলে তার স্থান ১৫১। সে ব্যাঙ্কের তিনটি শাখা মস্কোতে, পশ্চিম দিগন্তে বেলারুশের কাছে কালুগা শহরে দু’টি। একটি বৃহৎ ভারতীয় ব্যাঙ্ক দ্বারা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ক্ষুদ্র একটি রাশিয়ান ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণে কিছু মানুষের ভ্রূ উত্তোলিত হয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যখন অনুমোদন দিয়েছেন, আমরা প্রশ্ন করার কোন হরিদাস পাল। তবু মনে হয়েছে – আর কিছু পেলেন না? উত্তরে তাঁরা জানিয়েছেন ব্রাঞ্চ খোলার চেয়ে একটি চালু ব্যাঙ্ককে শাখায় পরিবর্তিত করাটা সহজ। তাঁরা ঠিক একটা ব্যাঙ্ক কেনেন নি, কিনেছেন লাইসেন্স মাত্র। আই কে বি ব্যাঙ্ককে সেই ভারতীয় ব্যাঙ্কের নতুন প্রকল্প ইউরেশিয়া ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হল। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সালে মস্কো শাখার উদ্বোধন করলেন ব্যাঙ্কের প্রধান। তিনি জানালেন ব্যাঙ্কের বিশ্বযাত্রায় এটি বিরাট পদক্ষেপ। দেড় বছর বাদে সেন্ট পিটার্সবুর্গ শাখা খোলা হল। ব্যাঙ্কের সহ প্রধান তাঁর ভাষণে জানালেন রাশিয়ান ফেডারেশনে একের পর এক নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে তাঁদের চোখের সামনে। সেই স্বপ্নের সওয়ার হতে চান।
জল্পেশের সঙ্গে আমার এই সংলাপ ২০০৮ সালে, সেন্ট পিটার্সবুর্গ শাখা খোলার অব্যবহিত পরে। তার বাস লন্ডনে, কাজ ইউরোপ, আফ্রিকা জুড়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কি করা। গত দু’বছর তাদের ব্যাঙ্ক রাশিয়াতে অধিষ্ঠিত, খদ্দের এবং দেশটার সম্বন্ধে জানবুঝ অনেকটাই বেড়েছে। সে বিষয়ে কারো সংশয় থাকার কথা নয়। আমি সাত বছর রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কবিহীন। দূর থেকে দেখি। জল্পেশের উচ্ছ্বাস দেখে ভাবলাম আমরা না হয় সে দেশে কিছু করছি না, এরা কী করে সেটা বোঝার চেষ্টা করি। আমি বললাম রাশিয়াতে ভারত বিষয়ক ব্যাবসা তেমন তো নেই। অতি স্বল্প সংখ্যক ভারতীয়ের বাস রাশিয়াতে। তাহলে সেটি কি রাশিয়া কেন্দ্রিক শুধু? শুনি রাশিয়ান ব্যাঙ্কের জন্য বাজারে ঋণ সংগ্রহ করছ, খানিকটা তোমাদের খাতায় রাখছ। টপ নাম যারা, তারা হয়তো সিটি বা চেজ কে ম্যানডেট দেবে। ক্রম অনুসারে সবচেয়ে নিচের কোন ব্যাঙ্ককে তোমরা ঋণ দিতে প্রস্তুত?
জল্পেশ বললে, সার, ৯৩ নম্বর ব্যাঙ্ক অবধি (পাঁচশ’র মতন ব্যাঙ্ক তখন সে দেশে)।
সেদিনের রাশিয়ায় ৯৩ নম্বর ব্যাঙ্কটির জন্য এই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আপন ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে প্রস্তুত?
এ ব্যাবসায় আমরা যাব না জানি। এই মিটিঙে সময় দিচ্ছি দ্যাশের লোকের সঙ্গে গল্পগুজব ও বাজারি খবর যোগাড় করতে – যাকে বলি মার্কেট রিড। সেখানে তারা কোন হরিণের পিছনে ছুটছে? এতক্ষণ অলস বাক্যালাপ করে যাচ্ছিলাম। চমৎকার দিন, ছ’তলার জানলা দিয়ে লন্ডন গিল্ড হলের চুড়ো দেখা যায়। এবার ৯৩ নম্বর ব্যাঙ্ক শুনে আমার মনোযোগ একেবারে তীব্র হল – যাকে বলে কমপ্লিটলি ফোকাসড। সিটি ব্যাঙ্ক ছেড়ে এসেছি, কিন্তু আর্ট গ্র্যান্ডির কথা ভুলিনি। জিজ্ঞেস করলাম “জল্পেশ, তোমাদের ক্রেডিট বা ঝুঁকি নির্ণয় করার ব্যাপারটা কে দেখে? সেটা কি তোমাদের মুম্বাই অফিস করে, না লন্ডন অফিস?”
পাঠক, জল্পেশের উত্তর আমার মনে আছে। প্রতিটি শব্দ মনে আছে।
“আমরা যে ব্যাঙ্কটা কিনেছি, সেই ব্যাঙ্কের প্রধান, এক রাশিয়ান মহিলা, তিনি আমাদের ক্রেডিট বা ঝুঁকির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাজারের সব্বাইকে চেনেন। তাই ওটা আমাদের ব্যাঙ্কের কাছে চিন্তার কোনো ব্যাপার নয়”।
পরের কয়েক বছর প্রভূত অর্থ অপচয় করে এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পরে সেই বেসরকারি ব্যাঙ্কটি তাদের ইউরেশিয়া ব্যাঙ্কসহ রাশিয়ান ব্যাবসা ২০১৫ সালে সোভকমব্যাঙ্ককে বেচে দিয়ে গতস্য শোচনাং নাস্তি বলে দেশে ফেরে। সোভকম এখন রাশিয়ার পনেরো নম্বর ব্যাঙ্ক। সেই বেসরকারি ভারতীয় ব্যাঙ্কটির কোনো অস্তিত্ব রাশিয়াতে নেই। তাদের বিজনেস প্ল্যান এখন ভারত কেন্দ্রিক।
চেয়ারম্যান ততদিনে অন্য জুতসই কাজ ধরেছেন।
জানি কোনো ব্যাঙ্কার আমার এ লেখা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না। তবু যদি কেউ পড়েন, তাঁকে ব্যাঙ্কিং, আর্থিক ঝুঁকি, ঋণ দান বিষয়ে একটি সতর্কবাণী, একটি চেতাবনি দিতে পারি। সেটি নিহিত আছে জল্পেশের শেষ উক্তিতে। মস্কোর এক রাশিয়ান মহিলা ঋণদানের ঝুঁকি বহনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, কেননা তিনি বাজারের সব্বাইকে চেনেন। এই ব্যাঙ্ক বা এই যুবক – ঠিক তাই ভাবছিলেন – যা মাত্র দশ বছর আগে গোল্ডম্যান, সলোমন, মেরিলের মত বরণীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ভেবেছিলেন এবং তার মাশুল দিয়েছিলেন?
আমরা কি কিছুই শিখি না?
হোয়েন উইল দে এভার লার্ন? ও, হোয়েন উইল দে এভার লার্ন?
রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক না হোক, মানবিক সম্পর্ক রয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ অধমকে মনে রেখেছেন বলে রাশিয়া সংক্রান্ত সেমিনারে আমন্ত্রণ জোটে। সংগঠিত ঋণদানের সভাতেও। রাশিয়ান কমার্শিয়াল অ্যাতাশে এই রকম একটি ব্যাঙ্কার সমাবেশের আয়োজন করতেন লন্ডনের পশ্চিম প্রান্তে বছরে একবার। আমি তখন আফ্রিকা, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যস্ত। তবে ফিরিতে খাদ্য এবং পানীয় উপেক্ষা করার মূর্খতা আমার কোনোদিন হয়নি। এক সন্ধ্যায় এমনি মজলিশে গেছি অনেক রাশিয়ান ব্যাংকারের সঙ্গে আবার দেখা। “এতদিন কোথায় ছিলেন? বাজারে দেখি না কেন?” জাতীয় সম্বোধন চলল। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটি ভালোই ছিল। তার সঙ্গে ওয়াইন।
দ্রুত বলে নিই, স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় একবার কোনো পাটের কল পরিদর্শনে গেছি ভাইজাগ। প্রভূত আপ্যায়ন চলছে। আমার কবজি ডুবিয়ে খাওয়া দেখে আমাদের বয়স্ক সহকর্মী কুণ্ডু মশায় পাশে থেকে ফিস ফিস করে বললেন ‘খাওয়াটা ফ্রি, সিংহরায়। কিন্তু শরীরটা আপনার। এটা মনে রেখে পান ভোজন করবেন’।
আমার স্ত্রী ঠিক এই বাক্যি বর্ষণ করে থাকেন। মাঝেসাঝে ভুলে যাই।
অ্যাতাশের সহকারী গ্রিগরিকে ভালো চিনতাম। গল্প গুজব করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ঝালিয়ে নিচ্ছি। এক সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন সিটি ব্যাঙ্কের সময় আপনি বেশ ব্যস্ত ছিলেন আমাদের দেশে। আপনার নতুন ব্যাঙ্কে রাশিয়ার সঙ্গে কোনো কাজকরবার করেন না কেন? তাঁকে ওই ব্রিটিশ পতাকার কাহিনী শোনালাম। আরও খানিকক্ষণ এ কথা সে কথার পরে গ্রিগরি বললেন, আপনারা তো দেখি নানান আফ্রিকান দেশকে প্রভূত ঋণ দিচ্ছেন, বাজার থেকে তুলছেন। আবার সবিনয়ে পতাকার কথা মনে করালাম। আরও কিছুক্ষণ রেড ওয়াইন চলার পরে গ্রিগরি বললেন, এটা বুঝি না। আপনারা এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ চেনা প্রতারকদের দিব্যি ধার দেনা দিচ্ছেন, আর রাশিয়াকে দিচ্ছেন না। কেন?
এর উত্তরে যা বলেছিলাম, সেটি মনে আছে হুবহু। বরাবর ভেবেছি, একদিন কোথাও সেটা লিখে যাওয়া উচিত। আজ সেই ক্ষণ আবির্ভূত।
“গ্রিগরি, এতক্ষণ আপনি আমি দু’জনেই প্রভূত রেড ওয়াইন পান করেছি। একটা ল্যাটিন প্রবাদ আছে – ভিনো ভেরিতাস। মদ্যে নিহিত আছে সত্য। তাই বলি, আমরা আফ্রিকাতে যাদের সঙ্গে কারবার করি, তাঁদের পূর্ণ সততা সম্বন্ধে সন্দিহান হওয়া স্বাভাবিক। সে সন্দেহ আমাদের আছে। যে ঋণ গ্রহীতাদের কথা বলছেন, নিজেরাও জানেন তাঁদের সততা বিবাদিত। তাঁরা এটাও জানেন যে আমরা ব্যাঙ্কাররা সেই একই সন্দেহ পোষণ করি। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। তাই যে বৃহৎ খনিজ তেলের ডিলগুলির কথা আপনি ভাবছেন – যেমন এঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, কঙ্গো – সেখানে আমরা সম্যক সাবধানতা পূর্বক ঋণ দিয়ে থাকি। এক পয়সা মারা যায়নি। আমাদের রাশিয়ান অভিজ্ঞতা বলে আপনাদের দেশেও সেই একই সমস্যা। আপনাদের ব্যাবসায়িক কর্মকর্তারা আরমানি স্যুট পরে দারুণ আমেরিকান ইংরেজিতে বক্তিমা দিলেও আমাদের সন্দেহ দূরীভূত হয় না। সেটি প্রকাশ করলে আবার আপনারা ক্ষিপ্ত হন”।
গ্রিগরিকে নিতান্ত অপ্রসন্ন মনে হল। তবে তূণীর হতে তীর ততক্ষণে নিক্ষিপ্ত। অপ্রিয় সত্য না বলার গুরুবাক্যটি উল্লঙ্ঘন করার অপরাধ সেদিন করেছিলাম। এ যেন বাড়ি বয়ে এসে গাল দেওয়া।
বাড়ি ফেরার সময় মনে হয়েছিল, কী লাভ হল বলে?
গর্কি পুশকিনের দেশবাসী আমার ঔদ্ধত্যকে ক্ষমার চোখে দেখেন। রাশিয়ান দূতাবাসের অ্যাতাশের নিমন্ত্রণ তালিকা থেকে আমার নামটি কাটা যায়নি।
আমার বস ফিলিপ হংকং থেকে ফোন করলেন আমার ভোরবেলায়। আমাদের দুই দেশের মধ্যে আট ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য। তাই আমার সকাল ছ’টা থেকে বেলা দশটার মধ্যেই সব কাজের কথা সেরে নিতে হত। ফিলিপ বললেন, তোমার একটা সুপ্ত বাসনা এবার পূর্ণ হল। আমরা আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কটি কিনছি। আমি জানি এ ব্যাঙ্কে এসে থেকে ভেবেছ পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক হারালে। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের শাখা আছে মস্কো, কিয়েভ, আলমাতি ইত্যাদি শহরে। তবে এদের ব্যাবসা কেবলমাত্র অন্যান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে, কোনো কর্পোরেট নয়।
অনেক দিনের অনেক স্মৃতি জাগরূক হল। রাশিয়া! আবার আসিব ফিরে!
দেড়শ’ বছর আগে আমেরিকান এক্সপ্রেস আত্মপ্রকাশ করেছিল কোন ব্যাঙ্ক নয়, এক্সপ্রেস সার্ভিস রূপে। এখানকার বাক্সো ওখানে পৌঁছানো। দেশে মেল ব্যবস্থা তেমন সুবিধের ছিল না (আমার মতে আমেরিকান সরকারি ডাক সরবরাহ ব্যবস্থা এখনো খুব একটা বদলায়নি)। ওয়েলস ফার্গো নামে আমরা যে ব্যাঙ্কটিকে চিনি, তার পত্তন করেন হেনরি ওয়েলস ও উইলিয়াম ফার্গো। তাঁরা ক্যালিফোর্নিয়াতে এই ইধার কা মাল উধার পাঠানোর ব্যাবসা খোলেন। পরে সে ব্যাবসা একটি ব্যাঙ্কে পরিণত হয়। আজো এই ব্যাঙ্কের প্রতীক একটি ডাকবাহী ঘোড়ার গাড়ি!
অনেক বাকসো অনেকের ঘরে পৌঁছে দেয়ার পরে আমেরিকান এক্সপ্রেস ধরলেন মানি অর্ডারের ব্যাবসা, আগে যেটি আমেরিকান ডাক বিভাগ চালাত। পরের পদক্ষেপ ট্রাভেলারস চেক যাকে ক্রেডিট কার্ডের পূর্ব পুরুষ বলতে পারি। এবার এলো আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড। এই ব্রান্ডটির দাম আজকাল ২৫০ কোটি ডলার বলে মনে করা হয়। সিটি বা চেজ ম্যানহাটান ব্যাঙ্কের মত আমেরিকান একসপ্রেস ছিল একটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে সাতের দশকে। তাদের কলকাতা ব্রাঞ্চে ১৯৭৬ সালে চাকরির দরখাস্ত করি, কাজও জোটে। তবে পিতৃপ্রতিম স্টেট ব্যাঙ্ক ছাড়তে মন ওঠেনি (আমার আফ্রিকা বইতে সে প্রসঙ্গ বিস্তারিত লিখেছি)। পরের বছর স্টেট ব্যাঙ্ক আমাকে ফ্রাঙ্কফুর্টে পাঠায়।
গত শতাব্দীর শেষদিকে আমেরিকান এক্সপ্রেস তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করে – বিদায় নেয় অনেক দেশ থেকে। কর্পোরেট ব্যাবসা বন্ধ। অন্যান্য ব্যাঙ্ককে পরিষেবা সরবরাহ করার কাজ তাদের একমাত্র বিজনেস মডেল। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক কেনে সেই আমেরিকান একসপ্রেস ব্যাঙ্ক – ক্রেডিট কার্ড নয়। এর ফলে আমাদের পূর্ব ইউরোপের দ্বার উন্মুক্ত হল।
এবার মস্কো দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে। একই শহর ব্যাঙ্কের ঠিকানা অন্য! ইতিমধ্যে বদলেছে অনেক কিছুই। ১৯৭৯ সালে প্রথম ভনুকোভো বিমানবন্দর দিয়ে কলকাতা যাই। তখন রাশিয়ান বিমান সংস্থা অ্যারোফ্লট কলকাতায় নামে। এখন তিনটি বিমানবন্দর। তার মধ্যে দোমোদেদোভো আজকাল বেশি জনপ্রিয়। রাস্তাঘাটের চেহারা অন্যরকম। নতুন নতুন বাড়ি। নানান জ্যামিতিক কায়দা। আবার ব্যাবসা শুরু। আমরা একটি ছোট অফিসের উত্তরাধিকারী হলাম। মনে আছে সেখান থেকে যে কোনো ব্যাঙ্কের অফিসে গেছি মস্কো মেট্রো দিয়ে লন্ডনের সায়েব বলে ওলগা ট্যাক্সি ডাকেনি! নৈব নৈব চ। মস্কো আর সেন্ট পিটার্সবুর্গের মেট্রো সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এক চিরস্থায়ী বিস্ময়!
আগের অবতারে আমেরিকান এক্সপ্রেস রাশিয়ান ব্যাঙ্কের লোন মেলায় অংশ নিয়েছে খানিকটা পার্শ্ব চরিত্রাভিনেতার মতন। অন্যান্য রাশিয়ান ব্যাংককে এই ভাবে ঋণ না দিলে তাদের অতিরিক্ত পরিষেবা, যেমন ডলার ক্লিয়ারিং, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করে দু’ পয়সা ফি কামানোর রাস্তা বন্ধ। আমার বড় সাহেব ফিলিপ বললেন, এবার মূল ভূমিকায় নেমে পড়ো। আমরা ম্যানডেট আদায় করে অন্যান্য ঋণ দাতাদের, মানে সহ অভিনেতা বা এক্সট্রাদের যোগাড় করব!
আমাকে এ কথা বলা আর ষণ্ডকে লাল শালু দেখানো একই কথা। ১৯৯৮ সালের দুঃস্বপ্ন এখন অনেক দূরের স্মৃতি। যাঁদের এবার বাজারে নিয়ে যাব, তাঁদের আমরা, মানে আমেরিকান এক্সপ্রেস আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দুই ব্যাঙ্ক মিলিয়ে চিনি। আমাদের অনুমতি যিনি দিলেন, তিনি আমার নতুন ক্রেডিট গুরু বব স্ক্যানলন। এক অসাধারণ ক্রেডিট বেত্তা, ক্রিকেট উন্মাদ এবং রাগবি-পাগল ব্যাংকার ববের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললে কিছু শিখেছি। কিছু ব্যাঙ্কের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা গেল, তবে দশ বছর আগের সেই উন্মাদনার রেশ খুঁজে পাইনি।
ব্যাবসায়ের বৃদ্ধি দু’ভাবে হতে পারে। দেশে ও বিদেশে আপন বাণিজ্যকে বিস্তার করা অথবা দেশে ও বিদেশে অন্যের ব্যাবসাকে অধিগ্রহণ করা। একদা সিটি ব্যাঙ্কের প্রকাশিত অভিলাষ ছিল নিজের মতো করে ব্যাবসা বাড়ানো, যার কেতাবি নাম জেনেরিক গ্রোথ। নতুন দেশে নিজেদের মানুষ এবং আই বি এম কম্পিউটার পাঠিয়ে ঘর ও ড্রাইভার ভাড়া করে দোকান খোলা হয়েছে। অধিগ্রহণ করে নয়। এই ভাবে আমরা একশ’ একটি দেশে শাখা বিস্তার করি (কিয়েভ ছিল একশ’ নম্বর)। নিউ ইয়র্কের সলোমন ব্রাদারস সিটিকে দখল করার পরে সে পদ্ধতি বদলে দেয়। তার ফল মোটেও সুখের হয়নি। কোনটা সঠিক পদ্ধতি জানি না।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কেও সেই একই জিনিস হল। ক্রমশ বোঝা গেল, এই ব্রিটিশ ব্যাঙ্কে পূর্ব পশ্চিমের মিলন কঠিন হবে। পূবের জগতে আমাদের আগ্রহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হল – কিয়েভ আলমাতি শাখা বন্ধ, শেষ পর্যন্ত মস্কো শাখা একটি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক বা ধনী ব্যক্তিদের পরিষেবায় নিয়োজিত হল।
রাশিয়া দূর থেকে দূরে সরে যায়।
আর এক অধ্যায়ের সমাপ্তি।