পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৮ অক্টোবর ২০২১ | ৫১৪৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
একটা পিঁড়িতে উবু হয়ে বসে মা রান্না করত। রান্না হয়ে গেলে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে উনুন নিকোনো হত আর উনুন থেকে একটা সুন্দর সোঁদা গন্ধ উঠত, ঠিক বৃষ্টি পড়লে যেমন হয়, তেমন। আমার বোন ঐ গন্ধের লোভে উনুন চাটত। অনেক বারণ, বকাঝকা করলেও তাকে থামানো যেত না। উনুনে সোঁদা গন্ধ উঠলেই, পিলপিল করে দৌড়ে ছোট্ট জিভ বার করে উনুন চেটে দিত। ভাঁড়ে রসগোল্লা বা দই এলেও সেই সব ভাঁড় কামড়াত। এত দুরন্ত, সামলানো যেত না – বাবা ওর নাম দিয়েছিল বিলবিলে বাহাদুর। সকলে যখন জিজ্ঞেস করত, বাবা কি নাম দিয়েছে? – গরবিনী উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করত – বিব্বিলে ভা-দুর। আমি বইপত্র নিয়ে থাকতাম, রান্নাঘরের দিকে অত নজর ছিল না, কিন্তু বোনের ছিল। দুপুরবেলা যখন কেউ দেখত না, ও-ই গিয়ে শিক দিয়ে, বড়দের মত উনুন খোঁচাত।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ৩১২৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
আমাদের গ্রামের বাড়ি বসিরহাটের আড়বালিয়ায়। সেখানে একরকম ছোটো দানা লালচে কমলা রঙের পাতলা পাতলা ভাঙা মুসুর ডাল পাওয়া যেত। দোকানে বলত, মারুতি-ভাঙা ডাল। ঐ ডালে মা ফোড়ন না দিয়ে, শুধু ডালসেদ্ধ করত। কাঁচা ডালে জল দিয়ে, তাতে কাঁচা সর্ষের তেল, নুন, মিষ্টি, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বসিয়ে দিত। সে ডালে কি যে ছিল! ঐ সেদ্ধ ডাল যেন অমৃত লাগত খেতে। আমার বিয়ের পরেও কিছু বছর আড়বেলেতে ঐ ডাল পেয়েছি। আমার কর্তাও ঐ ডালসেদ্ধর প্রেমে মজেছিলেন। কিন্তু এখন আর পাই না। আর মাঝে মাঝে মা রাতে সাদা কাপড়ে ডাল বেঁধে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ফেলে দিত। তারপর সেই টাইট ডালের বল কাঁচা সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে মাখা হত। বেশ খেতে লাগত।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১১ নভেম্বর ২০২১ | ২৭৫৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
মা রকমারি সরবৎ বানাতে পারত। দেশি লেমোনেড – লেবু চিনির সরবৎ তো ছিলই, এছাড়া কাঁচা আমপোড়া সরবৎ, পাকা আমের ভাজা মশলা দেওয়া সরবৎ, রোজ সিরাপ মিশিয়ে তরমুজের সরবৎ, মিষ্টি দইয়ের ঘোল, টক দই আর পুদিনার সরবৎ - এইসব। হাতিবাগানে সিনেমা দেখতে গেলে, বাবা একটা দোকানে গুঁড়ো বরফ দেওয়া আম আর দইয়ের সরবৎ খাওয়াত। আর ধর্মতলায় গেলে প্যারামাউন্টের সরবতের ভাণ্ডার তো ছিলই। সর্দি-কাশি হলে মা মিছরি, গোলমরিচ, তেজপাতা আর আদা ফুটিয়ে, গরম সরবৎ বানিয়ে, কাপে করে নিয়ে এসে বলত, খেয়ে নে। গলায় খুব আরাম হত।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৮ নভেম্বর ২০২১ | ২৫৯৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
বড়জ্যাঠাইমা খুব ভালো গুড়-আমের মোরব্বা করতে পারত আর সেজজ্যাঠাইমার মা দারুণ চিনি দিয়ে আমের মোরব্বা করতে পারতেন। মোরব্বার ক্ষেত্রে কাঁচা আমের নির্বাচন যদি ঠিক না হয়, তবে ব্যর্থ হতে হবে। আমের আঁটি হয়নি – এতটা কচি আম যেমন চলবে না, তেমন আঁটি শক্ত হয়ে গেছে – এমন আমও নিলে হবে না। দুইয়ের মাঝামাঝি দরকার, মানে নরম আঁটি যুক্ত আম চাই। এবারে আঁটির কষি বাদ দিয়ে আমগুলোকে লম্বায় চারফালি বা ছয়ফালি করতে হবে। কয়ফালি কাটা হবে, সেটা আমের আকারের ওপর নির্ভর করবে। এবারে বড়জ্যাঠাইমা আমগুলো নুনে জরিয়ে রোদে শুকিয়ে নিত। এবারে কড়াতে পরিমাণমত ঘি দিয়ে ঐ শুকনো আমগুলো ভাজত। ভাজা হয়ে গেলে গাঢ় চিনি বা গুড়ের রসে আমগুলো ফুটবে। কারোর ইচ্ছে হলে ঐ পাকে আদার রস মেশানো যায়। মোরব্বা তৈরি হলে আঁচ থেকে নামিয়ে এলাচ গুঁড়ো মেশাতে হবে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০২ ডিসেম্বর ২০২১ | ২৬২১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৮
প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কলিকাতার ইতিবৃত্ত বইতে পড়লাম, কলকাতার বহু প্রাচীন পরিবারে এখনও সতীর সিঁদুর পুজো করা হয়। তার অর্থ, আমার মামার বাড়ির পরিবার, বইয়ে বর্ণিত তেমনই একটি পরিবার। জেনে-ইস্তক আমার শরীরের শিরা উপশিরা কাঁপছে। চোখে ভাসছে সেই দৃশ্য – বইতে যেমন পড়েছি, সালঙ্কৃতা, মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা, আলুলায়িত কেশ, খালি পা, বধূকে পথ দিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে নাপিতানীরা। সিদ্ধি জাতীয় কিছু খাইয়ে চেতনা কিছুটা বিস্রস্ত করে দেওয়া হয়েছে। পথে মাঝেমাঝেই লোকেরা এসে সতীর সিঁদুর নিয়ে যাচ্ছে। চিতার ওপরে মৃত স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে চিতায় বসেছেন বধূ, ডালপালা দিয়ে ঢাকা দেওয়া হল। অগ্নিসংযোগ করা হল, লোক ভেঙে পড়েছে, চারিদিকে ঢাক-ঢোল বাজছে, জয়ধ্বনি উঠেছে – লেলিহান আগুনের শিখায় জ্বলে যাচ্ছে বাংলার উজ্জ্বল ইতিহাস, চৈতন্যের ভক্তিবাদ, সন্ন্যাসীদের শিবজ্ঞানে জীবসেবা – কান মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। ছি ছি ছি! আর আমি ভাবতে পারছি না। ছয় প্রজন্ম আগে, কে মা তুমি প্রাণ দিয়েছ? তোমার মৃত্যু নয়, জীবন জানতে চাই আমি। তুমি কোন বাড়ির মেয়ে, কি তোমার নাম? কোনো সূত্র তো নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ২৫২৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
কুমোরটুলিতে দুটো বড় পুজো। সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে মদনমোহনের বাড়ি। ও’ বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠে, বিশাল ঠাকুর-দালান পেরিয়ে, অপরূপ মদনমোহন দর্শন করতাম আমরা চারজন – বাবা, মা, আমি, বোন। তখন ঘুণাক্ষরেও জানতাম না – ইনি বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের মদনমোহন, যিনি দলমাদল কামান দেগে শত্রু তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একদিন ঐ বিষ্ণুপুরে আমি দাঁড়াব, বালুচরী নিয়ে পিএইচডি করার জন্য। আর মদনমোহনের মন্দিরে দাঁড়িয়ে শুনব, তিনি তো এখানে নেই, বাগবাজারের গোকুল মিত্রের বাড়িতে বাঁধা পড়ে আছেন। দু’কুড়ি বয়সে মন্দির-চত্বরে এ কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও মাথা দুলে গিয়েছিল আমার। বালিকা-বেলায়, অবোধ বয়সে দেখেছিলাম তোমায়, বড় সুন্দর। তুমিই কি নিয়ে এলে আমায় এখানে গবেষণার জন্য!
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ | ২৪৮৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
... - ভালো ভাজা হল কিনা, বুঝব কি করে?
- আঁচ বাড়িয়ে প্রথমে নাড়বি, তারপর আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে দিবি। একটু পরে আবার খুন্তি দিয়ে নিচের আনাজ ওপরে করে দিবি। ভাজা হয়ে এলে দেখবি, একটা সুবাস পাবি। কড়ায় আনাজের পরিমাণ কম মনে হবে। মানে, আয়তন কমে আনাজগুলো জরে যাবে। আনাজ কড়ায় দেবার আগে হলুদ মাখিয়ে নেয় অনেকে। না নিলেও অসুবিধে নেই। হলুদ পরে দেওয়া যাবে। কাঁচা রাঁধুনির হাতে হলুদে পোড়া ধরে যেতে পারে। আর নুনটা প্রথমেই দিবি না। একটু ভাজা হবার পর দিবি। নুন দেবার পর আনাজ থেকে জল বেরিয়ে যায়।
- বাবা! অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় দেখছি।
- অনেক কিছুর ব্যাপার নয়। ধারণা হয়ে গেলে দেখবি থোড় বড়ি খাড়া। রান্নাও তো বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান। নিয়ম, সূত্র, পরিচ্ছন্নতা, শৈলী, ঘরানা সব মিশে আছে। ...
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ | ২০৯৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
গাঁজা গাছের ডগার কচি পাতাগুলোকেই সিদ্ধি পাতা বলে। সেই পাতা সরবত করার আগে বারবার খুব চটকে চটকে ধুয়ে নিতে হয়। সব কষ বেরিয়ে গেলে পাতা ধোয়া জল একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন সেই পাতা বেটে সরবত বানানো হয়। পাতা বাটার সঙ্গে আরও কয়েকটা জিনিস বাটতে হয়, যেমন – গোলমরিচ, চারমগজ আর মৌরি। এই বাটাটা একেবারে চন্দনের মত মিহি করে বাটতে হয়, তারপর ছেঁকে নিতে হয়, যাতে কোনো দানা না থাকে। এখন মিক্সার গ্রাইন্ডারের যুগে মিহি করে বাটা খুব সহজ, তবে যে যুগের কথা বলছি, তখন তো যন্ত্রের ব্যাপার ছিল না। শিলনোড়ায় মেয়েদের হাতের জোরেই এসব কিছু করতে হত। এর সঙ্গে পরিমাণমত দুধ, চিনি আর জল মিশিয়ে পাতলা সরবত বানানো হত। এতে ওষধি গুণ আছে, ঘুম এসে যায়। দশমীতে এই সিদ্ধির সরবত বানানো খুব প্রাচীন প্রথা। কি জানি, আমার মনে হয়, ....
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৬ জানুয়ারি ২০২২ | ২২০৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
.... এই পাতুরি ভাজার সব চেয়ে সুবিধে হল, কোনো সুতো, দড়ি কিচ্ছু লাগবে না। এমনিই সুন্দর মুড়ে থাকবে, কিন্তু মচমচে হবে। পরে আমার এক অধ্যাপিকা বন্ধু একটা খুব দরকারি পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেইমত বাড়িতে ইলিশের পাতুরি করতে গেলে আমি আর বাজারওলাদের পিছনে পড়ি না একটু কলাপাতার জন্য। আমার কর্তামশাইয়ের বাগানের শখ। ফ্ল্যাটের বারান্দায়, জানলায় মাচা বেঁধে শাকপাতি, শসা সব ফলান। তাই চালকুমড়ো, কুমড়ো, লাউ যখন যেমন পাই, টুক করে পাতা কেটে নিয়ে ওতেই পাতুরি বানাই। একেবারে পাতাসমেত খাওয়া যায়। শহরে কলাপাতা পাওয়া ভীষণ মুশকিল। তাই ইলিশ পাতুরির জন্য অন্তত আমার বাড়িতে এখন নো কলাপাতা বিজনেস।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২০ জানুয়ারি ২০২২ | ২৫৪৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৬
ছেলেটি আগামীকাল “ভোর” চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে। ওর বাড়িতে নাকি ‘দুর্গো’ পুজো হয়। শুনেছিলাম দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দুর্গা। তবে এমন সরাসরি দুর্গোপুজো করতে কাউকে দেখিনি। ওর কথাবার্তায় বাংলাটা অন্যরকম। ও ভোরে বেরোয় না, ভোর ভোর বেরোয় না, ‘ভোর’ বেরোয়। কচুরির দোকান থেকে খায় না। কচুরি দোকান, মিষ্টি দোকান, পান দোকান, মুদি দোকান থেকে জিনিস কেনে, ষষ্ঠী বিভক্তির অস্তিত্ব ওর বাংলায় নেই। ল্যাবে আড়ালে সবাই মজা করে। সে অবশ্য, জগাদার কথাও এরকম। ‘চলে গেলাম’ – বোঝাতে বলে, ‘পালিয়ে গেলাম’। চলে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া আমাদের কাছে আলাদা, ওদের কাছে এক।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৭ জানুয়ারি ২০২২ | ২৪৯৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১১
বিয়ের চারদিনের দিন এক ঘটনা ঘটল। এখানে বাসি বিয়ে হয় না। চৌথী হয়। ঐদিন রাতে শাড়ির আঁচলে পাঁচটা ফল বেঁধে ঘুমোতে হয়। ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভোররাতে বর ঘুম থেকে ডেকে বলে, নিচে কলটানার আওয়াজ। মা উঠে পড়েছে। তুমি উঠে পড়। আমার আর হুঁশ নেই। শেষে দরজায় ঠকঠক। নভেম্বরে বালির ঠান্ডা, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে খিল খুললাম। দেখি বাইরে মোটা শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি মা। পুকুরে নামা অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডায় শাল জড়িয়ে... বলির পাঁঠা হয়ে চললাম। পুকুরের সামনে শাশুড়ি বললেন, গাছের আড়ালে জামা বদলে নাও। বলে আমার পরনের শাড়িটা পুকুরে কেচে মেলে দিলেন। আর বললেন, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমার ওপরে যা চলেছে তা বৌয়ের ওপর হতে দেব না।
মনে ভাবি, আড়বালিয়ায় যদি এমন হত, জ্যাঠাইমারা বলতেন – একটা দিন মানতে হয়। ওষুধ খেয়ে নেবে। রীতি-রেওয়াজ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে আমার প্রাণরক্ষা করলেন ইনি। না হলে হাসপাতালের শয্যা অপেক্ষায় ছিল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৫) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২৩৯৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ১১
তবে জাউ হলে দারুণ আনন্দ হত। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। শীতের সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি, খুব হৈ হৈ হচ্ছে। সবাই খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তড়বড়িয়ে খড়ের গাদাটা কাছ থেকে দেখতে গেলাম। দেখি, খড়ের গায়ে অনেক সাদা সাদা ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে, ঠিক যেন খড়ের ফুল। আর মাটির কাছের ছাতাগুলো লালচে। এগুলো দেখে সবাই আনন্দ করছে। এবার আমার সঙ্গে কর্তার যা কথোপকথন হল, তা এইরকম –
- এগুলো কী?
- ছাতু ফুটেছে, খড়-ছাতু।
- মানে? মাশরুম?
- হ্যাঁ, দারুণ খেতে। মাংসের মত। মাকে বলব আজ সকালে জাউ করতে।
- ঝাউ করা কী?
- আরে দূর! ঝাউ নয় জাউ। খেলে বুঝবে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২০০৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৮
মাঝেমধ্যে দেখতাম, ঐ মেয়ে-বৌরা মশলাপাতি, আটা-ময়দা, চিনি কিছু কিছু নিয়ে যাচ্ছে আড়াল করে। শাশুড়ি মায়ের কানে তুললাম কথাটা। তিনি হাসলেন। বললেন কিছু বাসনও গেছে এভাবে। পুকুরে মাজা হয় তো। মাজার সময়ে ভাসিয়ে বা ডুবিয়ে দেয়। অন্ধকারে তুলে নিয়ে যায়। বললাম, সে কী, তুমি কিছু বল না? তিনি বললেন, সে অনেক কথা। বড় কিছু না হলে সব জিনিস দেখতে নেই। কথাটা শুনলাম, কিন্তু মানতে পারলাম না। কর্তার কানে তুললাম। কর্তা বললেন, খবরদার এসব ব্যাপারে নাক গলিও না। মা যেমন বলছে, তেমনিভাবে চল। আমরা এখানে থাকি না। দু’দিনের অতিথি। আমরা ওদের রাগিয়ে দিয়ে ঝামেলা করে চলে যাব, তারপর সারাবছর কী হবে? যার হাতে রান্নাঘর, তার হাতে জীবন। ওসব মায়ের হাতে ছেড়ে দাও। পরে অবশ্য অনেক দাম দিয়ে বুঝেছি, কেন শাশুড়ি মা বলেছিলেন, সব জিনিস দেখতে নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২৪৩৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ১১
মেজ নন্দাই যখন শ্বশুর বাড়িতে আসতেন, আমাকে বক্সীবাজারে নিয়ে যেতেন। কতরকম যে নোনামাছ বাজারে, তাদের চেহারা, আকৃতি সব কিছু অদ্ভুত। আমি অবাক হয়ে যেতাম। মাছগুলো বেশ স্বাদু, কিন্তু দামে কম। কম তো হবেই, স্থানীয় সমুদ্রের মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। শহরের মানুষ তো খেতে জানে না, তাই দামও ওঠে না। কিন্তু এই মাছগুলো এখানকার মানুষের শরীরে সস্তা প্রোটিনের যোগানদার। আর দীঘা-মোহনায় ইলিশ উঠলে, বাড়িতে ফোন চলে আসে। তখন বর, দেওর, আরো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কাকভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। কারখানা থেকে থার্মোকলের বাক্স কিনে রেখেছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে টাটকা ইলিশ ঠেসে বরফ দিয়ে চওড়া সেলোটেপ দিয়ে সিল করে নিয়ে আসে। শহরেও এভাবে ইলিশ নিয়ে আসি আমরা। প্রতিবেশী, নিকটজন ইলিশ উপহার পেলে খুবই খুশি হয়। হাওড়া স্টেশনের পাশে ইলিশের নিলাম হয়। সেখানেও যাওয়া হয় কখনো-সখনো।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২২৩১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১১
‘চোদ্দ বছর বয়সে এ সংসারে এসেছি। তারপর চারপাশে কত মেয়ের যে না খেয়ে, মার খেয়ে মৃত্যু দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। যখন যেভাবে পারি, যতটা পারি এদের বাঁচানোর চেষ্টা করি, তবু অনেক লড়াই হেরে যেতে হয়। এইসব মেয়েগুলো যে বাড়ির লোকের কাছে মর্যাদা পায় না, তাদেরই কিছু সুরাহা করার জন্য রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে যায়। সবসময় চাইতে হয়তো মানে লাগে। তাই এদের কিছু বলতে পারি না। আজ দশটাকার জিরেগুঁড়ো নিয়ে যাকে বকব, কাল পরশু হয়তো সে কাঁচা বয়সের কাজল চোখে চিতেয় উঠবে। এমন আগে ঘটেছে, তাই কিছু বলতে পারি না। ওসব সংসারের খরচ হিসেবে ধরে নিই।’ শাশুড়ি-মার কথাগুলি মর্ম ভেদ করে আমার।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (১৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৭ মার্চ ২০২২ | ১৮৩৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
রাস্তাগুলো দিয়ে খরস্রোতে বৃষ্টি আর জোয়ারের জল চলল খলবলিয়ে। চারিদিকে নদী আর মাঝখানে বাড়িগুলো যেন দ্বীপ। এমন জিনিস তো দেখিনি বাপের জন্মে। ল্যান্ডফোন বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। কেবল উপকূলের মানুষের অভিজ্ঞতার জোরে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম সকলে। বৃষ্টি একটু কমতে, রাস্তার ধারে গিয়ে দেখি চুনো মাছের স্রোত চলেছে রাস্তা দিয়ে। সবাই জলের স্রোতে ঝুড়ি আড় করে দাঁড়িয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। কয়েক মিনিট পরে পরে তুলে নিলে আধঝুড়ি করে মাছ উঠছে। আমিও ঝুড়ি পাতলাম। হঠাৎ দেখি সবাই চেঁচিয়ে কী একটা ইশারা করছে আমাকে। তাকিয়ে দেখি আমার খুব কাছে কিছু একটা গোল্লা পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি কি আর জানি ছাই যে ওটা চিংড়ি মাছের ঝাঁক।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৪ মার্চ ২০২২ | ২৩১৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
এমনি গোঁজ করে থাকা প্যাঁচা মুখ এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি আমি। অল্পবয়সে একবার পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি ছিলাম কয়েকদিন। একদিন গভীর রাতে দেখি ওয়ার্ডের সব আলো জ্বলে উঠল। ডাক্তার, নার্স – সব খুব ছোটাছুটি করে বেড রেডি করছেন। তারপর বেনারসী পরা এক সালঙ্কারা মেয়েকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হল। আনতে আনতে মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিল। বিশাল ওয়ার্ডের সেই অনন্ত সংখ্যক বেডে পড়ে আছি পেটকাটা মেয়ের দল। কিছুটা নির্বিকার উদাসীনতা, কিছুটা ক্রোধ, কিছুটা উদ্বেগ – সব খেলা করে মেয়েদের মনে। গরীব কিংবা বড়লোক, হিন্দু নাকি মুসলমান, বিয়েওলা বা অনূঢ়া, অল্পবয়সী না পাকাচুলো - সব ধরণের মেয়ে সাক্ষী রইল ঘটনার। চোখের পাতা এক হল না। এরপর সকাল হলে ...
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ৩১ মার্চ ২০২২ | ১৪৫৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
কখনও মনে পড়ে – সরস্বতী পুজো হচ্ছে, সদর দরজার কাছে বাঁদিকে প্রথম ঘরে ঠাকুর। ঘর জুড়ে অনেক কিছু সাজানো। দূরে ঠাকুরের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ওপরেরটা আমার। নীল মলাটের ওপর লাল আর সাদা দিয়ে লেখা। আমার বইটা নিয়ে নিয়েছে সবাই। এত জিনিস টপকে আমি যেতেও পারছি না যে তুলে আনব। মা সমানে বোঝাচ্ছে, যে, ঠাকুরের কাছ থেকে বই তুলে নিতে নেই। কিন্তু আমার ভবি ভোলার নয়। বারবার দরজা দিয়ে বইটা দেখছি, সদর দরজা অবধি দৌড়োচ্ছি আর প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কাঁদছি। আচ্ছা, কী বই ছিল ওটা? দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, মা কোলে করে ক্যালেন্ডারের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলছে, ‘এটা কে? আমি বলছি বিবেকান্দ-নন্দ।’ মা হাসছে, আমি হাততালি দিচ্ছি।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৭ এপ্রিল ২০২২ | ২৩১৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
- মা দেওয়ালে এত রাক্ষুসী কে আঁকে বল তো?
- রাক্ষুসী? ও! ঐ ইন্দিরা গান্ধীকে আঁকে।
- ই-ন্দি-রা গান্ধী! সে তো দারুণ দেখতে। দিল্লীতে থাকে। সিনেমার আগে, যার সিনেমা হয় – সে-ই তো? তার হাতে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে থাকে? রাক্ষুসীর পাশে আঁকা থাকে।
- আমি ওসব বলতে পারব না। বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
বাবা ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিল। মাঠে ফুটবল খেলা হলে যেমন কয়েকটা দল থাকে, দেশ চালাতে গেলেও তেমন। ... যে জিতে যায়, সে দিল্লিতে থাকে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে থাকে, মানে জিতে গেছে। ... তবে কি বড় হলে ইন্দিরা গান্ধীই চিঠি দেবে আমাকে? কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম ইন্দিরা গান্ধী খেলায় হেরে গেছে। থমথমে মুখে ঘুরতে লাগলাম, আমার চিঠির কী হবে?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৪ এপ্রিল ২০২২ | ১৭০৪ বার পঠিত
প্রত্যেকটা মানুষ, সে তিনি মনীষী হোন আর যেই হোন, তিনি সেই যুগের হাতে বন্দি। হয়তো উনি আজকের যুগে থাকলে, সেযুগে নিজের বলা অনেক কথাই ফেলে দিতেন। আমি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম – রমাতোষ সরকারের লেখা। সেখানে উনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন, কেন দেড় হাজার বছর আগেকার গণনার সূর্যসিদ্ধান্ত না মেনে আধুনিক সরকারি বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মানতে হবে। ঐ বইতে একটা জায়গায় উনি লিখেছেন, যে সূর্য সিদ্ধান্ত রচয়িতা সে যুগের মানুষের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কারণ পূর্বপ্রচলিত বেদাঙ্গ জ্যোতিষ না মেনে, ঐ বইতে তৎকালীন আরব এবং রোমান গণিত ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই তিনি আজকে কোনোভাবে এসে পৌঁছলে নিজের আগের গণনা বর্জন করে, আধুনিক বিজ্ঞানটাই নিতেন। আজকে যে ঐ পঞ্জিকার গণনায় ভুল থাকছে, সেটা ঐ গ্রন্থকারের পক্ষে অগৌরবের নয়।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২১ এপ্রিল ২০২২ | ১৮৩৫ বার পঠিত
ময়দানকে বলা হয়, কলকাতার ফুসফুস। কারণ ফাঁকা জায়গা, গাছগাছালি আছে। পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে বলা হয় কলকাতার কিডনি। কারণ উত্তর কলকাতায় বাগজোলা খাল, মধ্যে কেষ্টপুর খাল আর দক্ষিণ কলকাতার টালি নালা – এই তিনটে প্রবাহ কলকাতার সব ময়লা জল টেনে নিয়ে ঐ জলাভূমিতে ফেলে। জলাভূমির মধ্যে মাছ চাষ হয়, মাছগুলো ঐ ময়লা জলের সঙ্গে ভেসে আসা জৈব পুষ্টিকর পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। অন্য কোনো খাবার দেওয়া হয় না। জলাভূমিগুলোর মাঝখানে আবার সবজি চাষও হয়। মাছ ময়লা খেয়ে ফেলে বলে, ঐ জলাভূমিতে কলকাতার নোংরা জল পরিষ্কার হয়ে যায়। ঐ ভাল জল জলাভূমি থেকে যায় কুল্টি গাঙ বলে একটা নদীতে। সেই নদী আবার মিশেছে মাতলা নদীতে। ঐ নদীপথ ধরে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে কলকাতার ব্যবহৃত জল চলে যায় বঙ্গোপসাগরে। যদি এতবড় শহরের ময়লা জল সরাসরি যেত, তবে সুন্দরবনের অনেক বেশি ক্ষতি হত। মাঝখানে ময়লা টেনে পরিষ্কার করে দেয় বলে ঐ জলাভূমিকে কলকাতার কিডনি বলে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৫ মে ২০২২ | ২০২৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
সমাজ রাধাকান্ত দেবের সতীদাহের পক্ষে আর বিধবাবিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই বেশি করে মনে রেখেছে। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম, স্কুল-কলেজ স্থাপনগুলি ততটা মনে রাখেনি। একথাও মনে রাখেনি, যে রামমোহনের পরিবারেও সতীদাহ হয়েছে, দেব পরিবারে একটিও হয়নি। অবশ্য এতে সমাজকে দোষ দেওয়া যায় না। রেঁনেশার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাধাকান্ত আজও ভিলেন। তবে একথা আমি মন থেকে মানি – ঐ বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল বলেই রামমোহনের আর বিদ্যাসাগরের জয় চিরস্থায়ী
বৃন্ত কুসুম : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : ইদের কড়চা | ০৬ মে ২০২২ | ১২৭৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
- কী হয়েছে? তোমরা কোনটা করতে পারনি?
- সব পেরেছি মেডাম, কিচ্ছু ছাড়িনি।
- তাহলে? ভাইভা কেমন হয়েছে? কে ভাইভা ধরেছেন, কোনো ম্যাডাম নাকি স্যার?
- একজন স্যার, একজন মেডাম – দু’জন মিলে ভাগ করে।
- যিনি ভাইভা ধরছিলেন, তিনি ঐ কলেজের ইন্টারনাল নাকি এক্সটার্নাল, সেটা জেনেছ?
- সেটা জানি না মেডাম, বুঝতে পারিনি।
- কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তোমরা কি ভালো করে উত্তর দিতে পারনি? মুখগুলো কেমন ভারভার ঠেকছে।
(এবার সমস্বরে)
- উত্তর কী দেব মেডাম? দু’জনের কেউ তো ভূগোলের প্রশ্ন তেমন করলেনই না।
- সে কী! তাহলে কী ভাইভা হল?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১২ মে ২০২২ | ১৭৩৭ বার পঠিত
– ব্রাহ্ম বৌরা বুঝি সিঁদুর পরে না জেঠিমা?
– সঠিক জানি না, তবে না পরাই উচিত। বইতে পড়েছি, ১৮৫০ নাগাদ যে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন হয়, তাতে আন্তর্বর্ণ বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সমর্থন, বাল্যবিবাহ রদ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত ছিল। বিবাহের রীতি হিসেবে বলা যায়, সাবালক পাত্র-পাত্রীরা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উপস্থিত হয়ে স্ব-স্ব ধর্মে বহাল থেকে ব্রাহ্ম রীতিতে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সাবালক হবার বয়স ধরা হয়েছিল চোদ্দো বছর। ব্রাহ্ম বিয়েতে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ হয়৷ শেষে বর-কনে, অভিভাবক, উপস্থিত অতিথিরা প্রার্থনা সভায় অংশ নেন এবং ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেন। যৌতুক দেওয়া নেওয়া ও বিরাট লোক খাওয়ানো, বিলাসিতা, আড়ম্বর এসব চলে না।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (২৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৬ মে ২০২২ | ১৭৬৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
আচ্ছা জেঠিমা, আমরা তিনজন যে মোহনবাগানের মেয়ে হলাম, সেটা কি ধোপে টিকবে?
কেন? টিকবে না কেন?
আমরা যে খুব ইলিশ খাই।
তাতে কী? মোহনবাগানীরাও ইলিশ খায়, ইস্টবেঙ্গলীরাও চিংড়ি খায়। তাতে ভালবাসা কমে না।
লাবণ্যর হাতের একটা রেসিপি করতে পারি, খাবি? কৃষ্ণার কাছে শিখেছি, কাঁচা ইলিশের ঝাল।
মা, রান্নাটা কিন্তু দেখব, কীভাবে কর। কুমুদিনী-লাবণ্য-কৃষ্ণা-শারদা – আর একটা নাম জুড়ে যাবে রঞ্জাবতী। মানুষ থাকবে না, রান্নার ঘরানা চলতে থাকবে।
কাল কাঁচা ইলিশের ঝাল করলে পরশু ডাব চিংড়ি করবে জেঠিমা।
ঠিক হ্যায়, করতেই হবে। আজ ইস্টবেঙ্গলী ইলিশ রান্না হলে কাল তো মোহনবাগানী চিংড়ি রান্না হতেই হবে।
তাহলে আমি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিচ্ছি, কাল, পরশু বাড়িতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের নামে ফুটবল – খাদ্য উৎসব হবে, অরগানাইজড বাই আওয়ার টু প্রিন্সেসেস।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০২ জুন ২০২২ | ২০৯৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
তরকারিতে নুন কম বেশি হলে কী করতে হয় গো মা?
– কম হলে খুব একটা অসুবিধে নেই, দিয়ে খাওয়া যায়। বেশি হলে বিপদ।
– বেশি হলে কী করব?
– রান্না অনুযায়ী হবে। ধর, মাংসের ঝোলে নুন বেশি হয়েছে। তখন গরম জল মিশিয়ে ঝোল পাতলা করতে পারিস। যদি দেখিস আর জল মেশালে গামছা কাঁধে ঝোল পুকুরে নামার অবস্থা হবে, তখন এক দেড় চামচ টক দই, এক চিলতে হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে দিতে পারিস। টকে নুন টেনে নেবে, ঝোলও পাতলা হবে না। দইয়ে হলুদ, লঙ্কা মিশিয়ে দিলে রংটাও হাল্কা হবে না। আবার ধর ঘুগনি জাতীয় কিছুতে নুন বেশি হলে তেঁতুল গোলা জল বা লেবুর রস মেশানো যেতে পারে। যদি টমেটো দেওয়া রান্না হয়, তবে টমেটো ঘিসনিতে ঘষে পিউরি বানিয়ে আলাদা ফোড়ন কড়ায় একটু ফ্রাই করে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হাল্কা ফ্রাই না করলে আবার কাঁচা টমেটোর গন্ধ উঠবে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১০ জুন ২০২২ | ১৫২৪ বার পঠিত
- সেনবাড়ির ঝোল আর মাছের ঝালের তফাৎটা কি?
- তফাতের বদলে তুলনা বলছি।
১। দুটোতেই তেলে পাঁচফোড়ন আর লঙ্কা ফোড়ন পড়ে। কাঁচা লঙ্কা অথবা শুকনো লঙ্কা - আপরুচি খানা। মা কাঁচা লঙ্কা দিত, আমিও তাই।
২। ঝোলে নানারকম সব্জি দেওয়া যাবে। কিন্তু ঝালে সেটা হয়না। ঝালে আমার মা মাঝে মাঝে আলু বা বেগুন, অথবা শীতের সময়ে পেঁয়াজ কলি বা কচি শিম ভেজে দিতো, যেকোনো একরকম।
৩। আজকাল সারাবছর টমেটো পাওয়া যায় বলে, দুটোতেই টমেটো দেওয়ার চল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় টমেটোর এত ব্যবহার ছিলনা।
৪। হলুদ দুটোতেই কমন।
৫। ঝোল বা ঝাল হবে নোনতা স্বাদের। কোনো মিষ্টি পড়বেনা।
৬। ঝোলের মশলা হচ্ছে প্রধানত ধনে; জিরে দিলে খুব অল্প, মা জিরে দিতনা। ডালনা বা দমে জিরে হল প্রধান, কিন্তু ঝোলে নয়। বেগুন দিয়ে ঝোল হলে হাল্কা সর্ষে ধোওয়া জল দেওয়া যাবে।
আমার একটা পৃথিবী আছে : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | আলোচনা : শিক্ষা | ১৪ জুন ২০২২ | ২৫৭৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৫
- এই অবস্থায় অফ লাইন পরীক্ষা হলে তো নম্বর কমে যাবে ম্যাডাম, সবার কাছে অসম্মান হবে, যদি পাশ করতে না পারি! ইউনিভার্সিটি কি কোনোদিন আমাদের কথা বুঝবে না?
চমকে উঠি ওদের কথা শুনে। এই তো কদিন আগে লকডাউন চলাকালীন ওদের কত ভয় ছিল, ‘আমাদের সবাই করোনা ব্যাচ বলবে, আমরা কোথাও চাকরি পাব না’ – সেই দূরের ভয়গুলো তুচ্ছ হয়ে এখন কাছের ভয়গুলো বড় হয়ে উঠেছে! সত্যিই তো, গত দু’বছর প্রাণ খুলে হাসা হয়নি, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি হয়নি, টিফিন ভাগ হয়নি। বন্ধু, বা শিক্ষক কাউকে মনের কাছাকাছি পায়নি – তাই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্মতা হয়নি। এরা নিজেদের খুব একা ভাবছে মনে হচ্ছে। আর সেজন্যই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিপক্ষ ভাবছে। হায় হায়! এতদিন আমি কেবল নিজের দুঃখ নিয়ে বিলাস করছিলাম। এদের দুঃখ, ভয়, টানাপোড়েন আমার চেয়ে শতগুণ বেশি। বরং এই প্রৌঢ়ত্বে এসে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সামলে আমি নিজে যতটা শান্তভাবে এই মনখারাপের মোকাবিলা করছি, এরা তো সেটাও পারছে না। হঠাৎ চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় এক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্রীর কথা শুনে,
- ম্যাডাম দিল্লির দিকে তো বেশ কিছু করোনা কেস হচ্ছিল। পরীক্ষার আগে যদি এদিকে একটু বেড়ে যায়, তাহলে খুব ভাল হয়।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৬ জুন ২০২২ | ১৪৭৪ বার পঠিত
উনি নাকি লিফলেট ছাপাতেন। তাতে সহজ বাংলায় লেখা থাকতো স্বাস্থ্য বিধি, তারপরে মেয়েদের কেন লেখাপড়া করা দরকার, দেশের ভালোর জন্য কী কী করা উচিত - এইসব। বাগবাজারের বিশ্বকোষ লেনে একটা প্রেস ছিল। সেই প্রেসে ছাপানো হত। কুমুদিনীর বই দুটোও ঐ প্রেসেই ছাপানো হয়েছিল। তাছাড়া অন্য লেখালেখি ছিল। পরিবারের সকলেই বলেছে, কিন্তু চোখে কিছু দেখিনি। আর একথাও শুনেছি, লেখালেখির থেকে ওঁর নিজস্ব উপার্জন ছিল। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মা বলেছিল, উনি শোভাবাজার রাজবাড়িতে থাকা কালীনই নিয়মিত সাহিত্য সভা করতেন। সেখানে সমাজের বড় মানুষেরা আসতেন। ধীরে ধীরে সেইসব সংসর্গে আরও অনেক সভা সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। সবগুলো নিরামিষ সাহিত্যের ব্যাপার ছিলনা। সেখানে সক্রিয় ইংরেজ বিরোধিতার গল্প ছিল। স্বামী শরৎ মারা যাবার পরে, উনি যে রাজবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তার এটাও একটা কারণ। শরতের দাপটে সব চুপ থাকতো। কিন্তু তিনি না থাকাতে পরিস্থিতি ঘুরে গেল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৩ জুন ২০২২ | ১৬০৫ বার পঠিত
এ বাড়িতে পশু পাখিকে, গাছকে, ঘাসকে, পুকুরের মাছকে খেতে দেওয়ার, সম্মান করার এক প্রাচীন প্রথা আছে। আমার বাপের বাড়ির গ্রাম আড়বালিয়াতে এমন কখনও দেখিনি। সেই প্রথা হল গমা পূর্ণিমাতে প্রকৃতি পুজো। পুজোতে সকল পশুপাখির প্রতিনিধিত্ব করে গমা বুড়ি অর্থাৎ গোমাতা। এইদিন খুব সকালে গোয়ালের যত গরু আছে তাদের পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে দুই শিঙে রাখী বেঁধে দেওয়া হয়। সারাদিন ধরে পুজোর জন্য আস্কে পিঠে তৈরি করা হয়। সেদ্ধ চাল আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকাল সকাল বেটে নেওয়া হয়। এবার তাতে একটু নুন আর অল্প অল্প করে গরম জল মিশিয়ে খুব ভালো করে ফেটানো হয়। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখা হয়, যাতে মণ্ডটা একটু ফেঁপে যায়, তারপর মাটির সরায় পাতার জ্বালান দিয়ে একটা একটা করে আস্কে পিঠে তৈরি হয়।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ৩০ জুন ২০২২ | ১৭৭২ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
আমার কর্তা বলে, যে ওরা প্রায়ই ছোটবেলায় নারকেল তেলে ভাজা লুচি খেত। খুবই স্বাভাবিক। কারণ উপকূল অঞ্চলে নারকেল খুব সুলভ। বাড়িতেই তেল বানানো হত। আমার খুব আগ্রহ ছিল – এই তেল বানানোর পদ্ধতিটা নিজের চোখে দেখব। আমাদের রান্নাঘরের মতি বৌ নারকেল তেল বানিয়ে আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। ব্যাপারটা দেখলাম তেমন শক্ত কিছু নয়। নারকেল কুরে গরম জলে ফেলে দুধ বের করতে সকলেই জানে। এক্ষেত্রে খুব ঝুনো নারকেল যেগুলোর জল শুকিয়ে ফোঁপর বেরিয়ে যায়, অঙ্কুরোদ্গম হয়ে যায়, তেমন কয়েকটা নারকেল ধৈর্য ধরে কুরে নিতে হবে। তারপরে রাঁধুনিরা সেই কোরা নারকেল গরম জলে কিছুক্ষণের জন্য ভিজিয়ে রাখল। আধঘণ্টা-খানেক পর, ঐ জলেই বেশ দু’-তিনবার ভাল করে কোরা নারকেল চটকে দুধ বার করে নিল। এইবার এই দুধটুকু কড়ায় ফোটাতে ফোটাতে জল সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে, তেলটুকু ভেসে উঠবে। রাঁধুনিদের অনুরোধে তেল থেকে ছেঁকে নেওয়া বাদামি রঙের নারকেলের ছিবড়ে খেয়ে দেখলাম। এখানে বলা হয় নারকেলের চড়া। মিষ্টি মিষ্টি বেশ খেতে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৫) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৪ জুলাই ২০২২ | ১৯৫৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
- এই দেখ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজ নিয়ে কী লিখছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত:
‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। আগে গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। কিন্তু একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিত বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না। ’
- একদল লোক খুঁত ধরে খাওয়াদাওয়া পণ্ড করে দিত?
- হ্যাঁ রে, নিন্দেমন্দ, খুঁত ধরা, গাল পাড়া, ঘোঁট পাকানো, জাতপাত তুলে ভোজ বয়কট – এইসব নষ্টামি খুব ছিল।
- এ বাবা!
- আবার এটা কি জানিস, কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত জুতো চুরি করতে। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে। বিয়েবাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি আর পালকির পার্কিং প্লেস বানাতে হত।
- হি হি।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২১ জুলাই ২০২২ | ২৩০০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
- যাই বল জেঠিমা, মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ হওয়াটা কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। মেয়েদের কী দোষ?
- দোষ গুণের কথা নয়, এ হল এক একটা পরিবারের রীতি।
- তাই বলে, মেয়ের বিয়েতে কোফতা কাটলেট, ফ্রাই, কালিয়া, পাতুরি কিচ্ছু হবে না? সব ছেলেদের হবে?
- কেন হবে না? সব হবে।
- কী করে হবে? বলছ তো নিরামিষ।
- নিরামিষে তুই যা যা বললি – সব হয়।
- অসম্ভব।
- হয় রে হয়। এঁচোড়ের, মানে গাছ পাঁঠার কালিয়া হয়, ছানার পাতুরি হয়, লাউ পাতায় মশলা পোরা পাতুরি হয়, মুড়িঘণ্টের বদলে মোচার চণকান্ন, চালপটল হয়, কাঁচকলার কোফতা, থোড়ের কোফতা হয়, আর কাটলেট কত নিবি? বিটের কাটলেট, সয়াবিনের কাটলেট, পনির কাটলেট, বাঁধাকপির কাটলেট – সব হয়। মাশরুমের ফ্রাই দারুণ খেতে হয়। তাছাড়া পটলের দোরমা, ওলের ভর্তা – এসবও হয়। আমাদের দেশে নিরামিষ রেসিপি আমিষের থেকে কম কিছু নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৮ জুলাই ২০২২ | ২০২০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৯
- দেখ মা, আমাদের বাড়িতেও গোপীনাথ কৃষ্ণ। আবার তোমার আড়বালিয়ার বাড়িতেও যে সতীমা, আউলচাঁদ – সেখানেও কৃষ্ণের প্রভাব তুমি বলেছিলে। সারা বাংলা জুড়ে এত কৃষ্ণ কী করে এল মা? কৃষ্ণ তো মথুরা, বৃন্দাবনের লোক – মানে উত্তর প্রদেশের। মৃত্যু গুজরাটে। পশ্চিম থেকে এভাবে পূর্বে চলে এল?
- সে তো আসবেই। এক দেশ, এক সংস্কৃতি। কিন্তু তুই যেটা ভাবছিস কৃষ্ণের প্রভাব – পুরোটা তা নয়। বহিরঙ্গে আমরা অনেক বেশি দুর্গাপুজো আর কালীপুজো করছি। মাছ, মাংস খাওয়ারও কমতি নেই। কিন্তু গৃহদেবতা হিসেবে যে কৃষ্ণ থেকে গেছেন, সেটা হল চৈতন্যের প্রভাব।
- শ্রীচৈতন্যদেব? কিন্তু তাঁর কথা তো খুব একটা ভাবি না। মানে আলাদা করে তাঁর পুজো বা স্মরণ – এসব তো হয় না।
- হয়, তুই বুঝতে পারিস না।
- কেন বুঝতে পারব না? তুমি বোঝাও।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৪ আগস্ট ২০২২ | ১৮০৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
- উড়িষ্যার ভিতরকণিকায় অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে হাজার হাজার অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে – সেটা জানিস তো?
- হ্যাঁ।
- কিছু কচ্ছপ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যায়। আর চোরাশিকারিরা তো আছেই। তারা ঐ কচ্ছপ ধরে। এই এলাকার লোক কচ্ছপ খায়, মানে এমনি তো পায় না। কচ্ছপ ধরা, বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু পেলে ছাড়ে না। আর বড় অলিভ রিডলেকে বলে বালিগড়। একটা বালিগড় চোরাগোপ্তা পেয়ে গেলে এদিকের মানুষের ঘরে উৎসব লেগে যায়। গতকাল আমাদের যে দুর্গাবৌদি রান্না করে, সে খুব হেসে হেসে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিল, “তুমি কী খেয়েছ?” বাচ্ছাটা আধো আধো করে বলছে – বালিগল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৩৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১১ আগস্ট ২০২২ | ১৫২৬ বার পঠিত
আমুদী মাছটাও বেশ সুস্বাদু। বিয়ের আগে খাওয়া দূরস্থান, এসব মাছের কখনও নামও শুনিনি আমি। একটু ছোট আকারের লালচে স্বচ্ছ ধরণের চেহারা মাছটার। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা হয়, তবে ফ্যাসার মত কড়া করে নয়। সর্ষের তেলে কয়েক দানা চিনি ফেলে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হয়। পেঁয়াজ কুচো, আদা রসুন বাটা, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষে তেল ছেড়ে গেলে টমেটো বাটা মেশায় রুনাদা। আবার মশলাটা কষে। এইভাবে দু’বার করে কষে ধৈর্য ধরে এক একটা রান্না করে রুনাদা, আমি দেখি। এবার অল্প জল দিয়ে মাছগুলো ঢেলে দেয়। এবারে বেশ ছ’-সাতটা নধর কাঁচালঙ্কা আস্ত আস্ত ঝোলে ফেলে চাপা দিয়ে দেয়। আর এমন চৌখস, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে দেবে ঠিক সময়ে, কিন্তু ঢাকা খুলবে না। পুরো ভাপটা ঠান্ডা হয়ে রান্নার ঝোলে ঢুকে যাবে। আর খাওয়ার সময়ে ঝোলে একটা অসাধারণ কাঁচালঙ্কার গন্ধ বেরোয়, কিন্তু ঝাল হয় না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি রান্নায় ঐ কাঁচালঙ্কার ফ্লেভার আনার, এখনও সফল হতে পারিনি।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৮ আগস্ট ২০২২ | ১৬৮৪ বার পঠিত
রুনাদা আসলে খিচুড়ি হোক, কি মাংস – রান্নার স্বাদটা দারুণ করে। তার কারণ আমিষ নিরামিষ কী সব সিক্রেট মশলা বানিয়ে রাখে। কাঁচা এবং ভাজা দু’রকম। কাঁচা মশলা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে, ওটা দিয়ে রান্না হয়। আর ভাজা মশলা উনুনের আঁচে চাটুতে শুকনো ভেজে গুঁড়ো করে বানায়। ওটা রান্না হয়ে গেলে ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হয়। ধীরে ধীরে মিশে যায়। মশলাগুলো বানিয়ে যত্ন করে আলাদা আলাদা কাগজে মুড়ে কৌটোয় তুলে রাখে, যাতে গন্ধ না উড়ে যায়। এই রান্নাঘরের মাইনে করা মেয়ে বৌদের ঐ মশলা ছোঁয়ার জো নেই। রুনাদার ধারণা, এই মশলা ওদের হাতে পড়লে নষ্ট হবে। যেখানে সেখানে খোলা রেখে দেবে, হয়তো বেশি ঢেলে দেবে বা কম। সবচেয়ে বড় কারণটা অবশ্য মুখে বলে না। যদি আঁচলে ঢেলে নিয়ে পালায়, এত কষ্টের জিনিস।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৫ আগস্ট ২০২২ | ১৫২১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
এখানে বা কলকাতায় সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায় না? আমি খেতাম তবে।
- এখানে না, তবে কলকাতায় পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দোকান নদীয়া সুইটস, আমার মায়ের হট ফেভারিট। সেখানে পাওয়া যায়।
- ও, তাহলে তো কলকাতাতেই খেয়ে নেব। কৃষ্ণনগর যেতে হবে না।
- আরে পাগলি, এক এক জায়গার এক এক স্পেশালিটি। অধর দাসের সরপুরিয়ার সোয়াদ কোনোদিনই অন্য দোকানে পাওয়া যাবে না।
- কেন পাওয়া যাবে না? একই তো মিষ্টি।
- না রে বাবু। কোনো জায়গার মিষ্টি সোয়াশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় – এ কি কখনও এমনি এমনি হয়? আমরা তো সার্ভের কাজে গিয়েছিলাম। তখন এই দোকানের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। এই দোকানটা উত্তম-সুচিত্রার সবার উপরে সিনেমাতেও আছে।
- তাহলে তো ঐতিহাসিক দোকান বলা যায়। মিষ্টিটা কেমন খেতে? কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে বানানো হয়?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪৭০ বার পঠিত
অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, ছোট জা আমাকে চোখ মটকাচ্ছে। ... একটু দূরে আছে বলে ওর ইশারা বুঝতে পারিনি, খাওয়ার দিকেই একতানমন হয়ে ছিলাম। পরে কথা বলে বুঝলাম, জা আমার খাওয়া দেখে ইশারা করছিল, এখনই অতটা পরিমাণ খেয়ে না নিতে। ওর কথাটাকে সত্যি করে, চাটনির পরে এল সাদা ভাত আর ঘি। তারপর একে একে পোস্ত ছড়ানো লাল শাক ভাজা, মুড়োর ডাল, ছ্যাঁচড়া, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, ঘন টমেটোর চাটনি, দই, মিষ্টি, পান। এমন দুই পর্বের খাওয়া দেখে, খেয়ে আমার মনটা ভীষণ অবাক, আর পেটটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৩৩৬ বার পঠিত
পরে আমি অনেক ভেবেছি জানিস। সকালের পায়েস, বিকেলে সেটা কয়েকমাসের বাচ্চার পক্ষে বিষ, গ্রামে তো অত ঢাকা-চাপা দেবার অভ্যেস নেই। আর এ বাড়িতে সব কিছু কাজের লোকের ওপরে নির্ভর। রুপোর টাকার কোনো দরকার ছিল না। তাও যখন দেওয়া হল, সেটা মুখে লাগানোর আগে গরম জলে ফুটিয়ে নেওয়া দরকার ছিল। আর এ জায়গাটা ঊপকূল। ভূগর্ভস্থ জলস্তর মাটির খুব কাছে। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টার হওয়ার সুযোগ পায় না। তাই জলের কোয়ালিটি খুব খারাপ। এখন আমরা বড়রা কেনা জল খাই। ঐ জলে ধুয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া অন্যায় হয়েছিল। আমি কিন্তু তখন প্রফেসর। পুঁথিগত জ্ঞান-বিজ্ঞান সবই জানা ছিল। কিন্তু আমি হাতেকলমে রান্নাবান্না নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। বইয়ের জগতে বাস করতাম। সবকিছুতে বড়দের ওপরে নির্ভর করে চোখ বুজে বসে থাকতাম। আমি তখন মা হয়েছি, তবে প্রকৃত মা হতে পারিনি। অযোগ্য ছিলাম। সেই ঘটনা থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, রান্না আমায় শিখতে হবে। আর হেঁশেলে কর্ত্রী হতে হবে। মূর্খ রাঁধুনিদের ওস্তাদি বন্ধ করতে হবে। আর সন্তানের খাওয়া দাওয়ার জন্য গুরুজন, লঘুজন কারোর ওপরে ভরসা করব না, ভগবান এলেও না।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৬৭২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
– জেঠিমা, তার মানে পুতুল দিদা যে এমন হৈ চৈ করে, সেটা মনের দুঃখ ঢেকে রাখার জন্য? এসব এত কিছু তো জানতামই না।
– মানুষের মনের খবর কেই বা রাখতে পারে বাবু।
– জেঠিমা, তুমি মোহনবাগানের গল্প বলতে গিয়ে বলেছিলে, স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। পুতুলদিদাও কি ভেঙে পড়েছে?
– এসব কথা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। বুঝে নিতে হয়। তবে আগের পিসি আর এখনকার পিসির মধ্যে কিছুটা তফাৎ তো আছেই। তোর জেঠুও ঐজন্য সবসময়ে দেখিস না পিসির সঙ্গে টরেটক্কা করে যায়? আগের পিসিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর রইল কুমুদিনীর কথা। নিজের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৫) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৩৮২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
– সুমিতাদিদা আর নিনাদিদা এখন কেমন আছেন, মা?
– আছেন বলতে জরাগ্রস্ত, নব্বই ছুঁই ছুঁই। আর নিনাদিদা তো মানসিকভাবে সুস্থ নয়, অল্পবয়সে উত্তমকুমারকে বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই বিয়ে-থাও হয়নি।
– মানে? উত্তমকুমারকে বিয়ে করতে চাইতো?
– হ্যাঁ, হাসছিস? বহুমেয়েই তখন এমন পাগল ছিল। স্টার থিয়েটারে শ্যামলী দেখে নিনাদিদা পাগল হয়ে গেল। রোজ স্টারের দরজায় বসে থাকত। উত্তমকুমার কখন ঢুকবেন, কখন বেরোবেন। তারপর ধীরে ধীরে বিকার গ্রাস করলো। বলতো, উত্তমকুমার ওকে নিয়ে যাবে। মেহগনি কাঠের কারুকাজ করা পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে সেজেগুজে বসে থাকতো, উত্তমের সঙ্গে বেরোবে বলে ....
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৩৩২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
একবার মামারা রাজরাপ্পার মন্দির থেকে বলির মাংস নিয়ে এল। বড়দিদা রান্না করল পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া। ওভাবে যে পাঁঠার মাংস রান্না করা যায়, সেও আমার রাঁচীতেই দেখা। আর মাংস রাখতে হলে আমরা তো ফ্রিজে রাখি। রাঁচীতে শীতকালে কাঁচা মাংস একরাত রাখতে হলে বালতি করে ঢাকা দিয়ে বারান্দায় রাখা হত। বাইরে যা ঠান্ডা, ওটাই ফ্রিজের কাজ করবে বলে। আরও একটা জিনিস রাঁচীতে শিখেছিলাম। যদি দু’-তিন দিন ধরে ট্রেন বা বাস জার্নি করতে হয়, আর বাইরের খাবার খেতে অসুবিধে থাকে, তাহলে দুধ দিয়ে ময়দা মেখে লুচি করতে হয়। তিনদিন ঠিক থাকে, খারাপ হয় না। সঙ্গে আচার নিতে হবে। নইলে তরকারি অতদিন তো থাকবে না।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৩ অক্টোবর ২০২২ | ১৬৪১ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
উমমম, দারুণ জিনিস এনেছে আজ, মাঝারি সাইজের একেবারে টাটকা জীয়ন্ত চিংড়ি মাছ। পুরোনো স্মৃতি মনে আসে। ওয়েটল্যান্ডে যখন দু’জনে চাকরি করতাম, কর্তা একবার পুকুরের গলদা চিংড়ি রান্না করে অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। চিংড়িগুলো এতটাই তাগড়া ছিল, যে দুটো চিংড়ি ছ’ টুকরো করে আমরা ল্যাবের ছ’জন প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট টিফিনে হাপুস হুপুস করে খেয়েছিলাম। সে গলদার দাঁড়াগুলো একেবারে নেভি ব্লু আর মোটা মোটা। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দাঁতে চেপে ভেঙে খেতে হয়েছিল। কিন্তু এগুলো গলদা নয়, চাপড়া চিংড়ি। রান্নার বৌদের হাতে ছাড়লে ওরা সেই একটাই জানে – সেটাই করবে। ডুমো ডুমো আলু, নারকেল বাটা, আর সেই কাঁচা কাঁচা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঝোল। ওরা যা পারে করুক। আমি একটু চিংড়ি আলাদা করে চিংড়ি থেঁতো বানাব।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২০ অক্টোবর ২০২২ | ১৪৯৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
– রাঁচীর দেহাতি চিকেন রান্নাটা কি ফণীজেঠুর আনা চিকেন দিয়ে করা সম্ভব? যদি হ্যাঁ হয় তা'লে কোন কথা নেই। যদি না হয়, তবে কেন সম্ভব নয়? দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেনের তফাৎ কী?
– দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেন – ব্যাপারটা একই। ওটা ভাষার তফাৎ। পোল্ট্রির বাইরে যেসব মুরগি বাড়িতে পোষা হয়, স্বাভাবিক খাদ্য খেয়ে বাঁচে, ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে মাংস বাড়ানো হয়না, তেমন চিকেন। তবে হ্যাঁ, বাংলায় যে জাতের মুরগি পোষা হয়, আর ঝাড়খন্ডী আদিবাসীরা যেমন পোষে, তাদের মধ্যে কিছু আলাদা থাকতে পারে। দিশি মোরগের জাতিভেদ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৩ নভেম্বর ২০২২ | ১৫৪১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
একদিন হল কী, আমি দোতলায় বাচ্চাদের মাংস রান্না করেছি, তেল কড়াটা বারান্দায় একপাশে সরিয়ে রেখেছি। কর্ণাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিলনা। একজায়গায় বসিয়ে খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে, পিঠ চাপড়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়তো। ওর পর্ব মিটিয়ে ছুটকীকে নিয়ে পড়তাম। ও দৌড়োতো, আমিও থালা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতাম। মেয়ে মাংসের তেলকড়া নিয়ে তেল মাখতে বসল, সেই ফাঁকে আমি দুটো দুটো গাল মুখে ঢুকিয়ে দিই। এমন সময়ে রুণাদা বাটি ভরা টমেটোর চাটনি দিয়ে গেল। আমি জানি রুণাদা যে বাটিটাতে চাটনি এনেছে, সে বাটিটাও আগে খাবার জলে ধুয়ে নেয়। এখানে সমুদ্র কাছে বলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি। তাই মাটির স্তরে জল প্রাকৃতিক ভাবে ফিল্টার হবার সুযোগ পায়না। টিউবয়েল খুঁড়লে এক পাইপে জল পাওয়া যায়, লোকে তাই আরও গভীরে যাবার জন্য খরচ করেনা। আর এই জল খেয়ে ঘরে ঘরে পেটের বালাই। আমরা যতদিন থাকি খাবার জল কিনতে হয়। বাড়িতে খরচ করে মেশিন বসাতে ভয়। পরের বার এসে হয়তো দেখবো, ভোল্টেজের জন্য মেশিন পুড়ে গেছে, বা ঝেড়ে মুছে সব ফাঁকা।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১০ নভেম্বর ২০২২ | ১২৭৭ বার পঠিত
ইণ্ডাকশন ওভেনটাও আবার মতি বৌয়ের খুব পছন্দ। কালো কাচের কুকটপটা ও ছোট্ট টেবিলের মত ব্যবহার শুরু করল। বাসন মেজে ধুয়ে জল সমেত ওটার ওপরেই রাখতে লাগলো। যত বোঝাই যে ওটা বৈদ্যুতিন যন্ত্র, হাজার বললেও শোনেনা। শেষে বিদ্যুতের দেবতা একদিন আর সহ্য করতে না পেরে দিলেন রামধাক্কা, মতি উলটো দিকের দেয়ালের ওপরে ছিটকে পড়লো। তার পরে ঐ কাজ বন্ধ হল। মিক্সার গ্রাইণ্ডার নিয়েও মতির দারুণ কৌতূহল। সব দেখিয়ে দিলাম, কোন বাটিতে কী হয়, কিন্তু মতির পরীক্ষা নিরীক্ষা করা স্বভাব। ও আবার যেকোনো বাসন ছোট সাইজের হলে বেশি পছন্দ করে। একদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি মিক্সি খারাপ হয়ে গেছে। কারণ হল মতি মিক্সির চাটনি বানানোর ছোট বাটিটায় ঘণ্টা খানেক ধরে আদা রসুন বাটার পরীক্ষা চালিয়েছে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৭ নভেম্বর ২০২২ | ১৫৮৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
এর মধ্যে আবার শুনলাম মতির ছেলেরা ফের বাবার কাছে গিয়েছিল বলতে যে অভিযোগ যেন তুলে নেয়। বাপ বলে পাঠিয়েছে, তোদের মাকে বল আমাকে নিঃশর্ত আইনি বিচ্ছেদ দিয়ে দিতে, তবে মামলা তুলব। সপ্তাহ খানেক পর কোর্টের খবর আসে, জানা যায় কাগজটা ভুয়ো। এমন কোন কাগজ আদালতে জমাই পড়েনি। সবই মতির বরের চালাকি। মা আর তিন ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুলিশ আসবে শুনে সকলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওরাও তো আর সব সময়ে সোজা পথে চলে না। তবে ডামাডোলে রেশন কার্ড ফেরৎ পাবার কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। শহর থেকে বিস্তর ফোনাফুনি করে মতি যাতে চাল গম পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মতি অনেক জ্বালিয়েছে ঠিকই, ওর এই দুর্দশার দিনে মোটেই খুশি হতে পারি না। বরঞ্চ কপালে করাঘাত করে ভাবি, এই মতি এখনও স্বপ্ন দেখে যে তার যোগ্য বর ওকে আবার ঘরে নেবে, আবার ও তার সঙ্গে সংসার করবে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৪ নভেম্বর ২০২২ | ১৫৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
ভারি মুশকিল হল তো। অনেক বছর আগে একবার যেদিন সংসদে জঙ্গি হামলা হল, সেদিন সবাই মিলে ঘরে ঘরে, ল্যাবরেটরিতে আঁতিপাঁতি খুঁজে সব ছাত্রছাত্রীকে বাইরে বার করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। ছেলেমেয়েগুলো অনেকেই রেলপথে দূর থেকে আসে। কখন কী ঘটে যায় আশঙ্কা ছিল। এখন তো সেসব কিছু হয়নি রে বাবা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা দূর, মারপিটও হয়নি কোথাও। চারদিক শান্ত। অসুখের জন্য কলেজ বন্ধ হয় – এ কেমন অসুখ! আশ্চর্য তো।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১০৮৬ বার পঠিত
স্বর্গে গেছেন মা, সেই পঞ্চাশের দশকে। আমাদের জন্মের দু’দশক আগেই তিনি গত হয়েছেন। আমরা শুধু গল্প শুনেছি। আমার মা বাবার বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে। মায়ের তখন চোদ্দ বছর বয়েস। ভব আপা মায়ের পিসশাশুড়ি। বারো বছরে বিধবা। মায়ের কাছেই শুনেছি – তাঁর লম্বা চওড়া চেহারা, ফর্সা রং, টিকোল নাক, ধবধবে থান পরা, সবাই ডাকত ভবপা – ভব আপাকে দেখে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। কিন্তু কেউ কাছে ভিড়তে পারত না, এমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব। কারোর তোয়াক্কা রাখতেন না। তাঁর দাপটে বাড়ি থেকে পাড়া কাঁপত। সেই যুগের গ্রামে এমনধারা মহিলা একেবারেই ব্যতিক্রমী। নিজের আলাদা ঘর, স্বপাক আহার। সঙ্গে থাকত পনেরো-ষোলোটা বিড়াল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৮ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪০৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
পালো একটা কন্দ জাতীয় ছোট গাছ, হলুদ গাছের মত দেখতে, পাতাটা হলুদের থেকে সামান্য মোটা। তার থেকে লম্বাটে গোল একধরণের কন্দ বেরোয়। ঐ কন্দ তুলে কুচি কুচি করে কেটে জলে চটকে তার ক্বাথটা বের করে নেওয়া হয়। অনেকটা নারকেল থেকে দুধ বার করার মতন। তারপর ঐ জলটা রেখে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সাদা একধরণের পদার্থ মানে পালোর শ্বেতসারটা নিচে থিতিয়ে পড়ে। তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। মাটি ফুটিফাটা হলে যেমন দেখতে লাগে, সেই আকারে ঐ সাদা অধঃক্ষেপটা অসমঞ্জস টুকরোতে ভেঙ্গে যায়। কেউ আবার ঐজলে একটু এলাচ বা অন্য কোন মশলা মিশিয়ে দেয়। তাতে একটা সুন্দর ফ্লেভার চলে আসে। এবারে ঐ টুকরোগুলো বয়ামে ভরে রাখা হয়। জলে মিশিয়ে এর শরবত আমার ভীষণ প্রিয়। আর পৈটিক গোলমালে একেবারে ঘরোয়া অব্যর্থ টোটকা। পুজোয় অবশ্য এটা সুজির মত রান্না করা হয়, কাচের অস্বচ্ছ ক্রিস্টালের মত দেখতে লাগে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৫) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৫২৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
- সাতরকম ভাজা কী কী?
- যেদিন যেমন বাজারে ওঠে—চাকা চাকা গোল আলু ভাজা, লম্বা লম্বা পটল ভাজা, পাতলা করে কাটা কুমড়ো ভাজা, বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, চাকা করে কাঁচকলা ভাজা—এগুলো রোজই হবে, যতদিন পুজো চলবে। তার সঙ্গে ধর ডুমো করে ঢ্যাঁড়শ ভাজা বা ফুলকপি ভাজা হল – সব মিলে সাতরকম। অষ্টমীর দিন আর একটা বাড়বে—ধর কলমি শাক ভাজা হল, নবমীর দিন ধর এগুলোর সঙ্গে নারকেল ভাজা হল—এইরকম। সবসময়ে যে এই যা বললাম, সেগুলোই হবে, তা নাও হতে পারে। উচ্ছে ভাজা, গাজর, শিম বা কুঁদরি ভাজা—কতরকম হতে পারে। ভাজার কি আর শেষ আছে? বাড়িতে এতগুলো কলা গাছ, থোড় ভাজা হতেও বাধা নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩৪৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
অন্নদা দিদি হলেন গল্পের ভাণ্ডার। আমি তাঁকে খুবই পছন্দ করি, তিনিও আমাকে ভালোবাসেন। কারণ বুড়ো মানুষের কথা কেউ শুনতে চায়না, সময় নষ্ট মনে করে। আর আমি তাঁকে ডেকে ডেকে গল্প শুনি। অন্নদা দিদি বলেন, আগের দিনে কথা ছিল, “যার আছে মাটি, তাকে দাও বেটি।” অর্থ খুব পরিষ্কার। যার জমিজমা আছে, সঙ্গতি আছে সে ঘরেই মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। সেই আপ্ত বাক্য মেনে, আমার দাদা শ্বশুর তারিণী প্রসাদের সাত বোনেরই বিয়ে হয়েছিল জমিদারের ঘরে। বড় জনের বিয়ে হল বালিসাইতে। তার পরের জনের বালেশ্বরের খরসুয়াতে, পরের জন মানে তৃতীয়া গেলেন বালিসাইয়ের কাছাকাছি গড় মুহুরি ওরফে গড় ভৌঁরিতে।, চতুর্থ জন কেয়াবটতলায়, পঞ্চম জন মোহনপুরে, ষষ্ঠ কন্যা মানে দ্য গ্রেট ভব অপার শ্বশুর বাড়ি ছিল এগরায়। সপ্তম কন্যে গেলেন কাঁথির দুরমুঠে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৪৭৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
যে রাজা কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরি করেছিলেন, সেই রাজাই রেমুনার এই গোপীনাথের মন্দির তৈরি করেন। এখন ঘটনা হল, শ্রীচৈতন্যের গুরু যে ঈশ্বর পুরী, তাঁর গুরু হলেন মাধবেন্দ্র পুরী। তিনি একবার এই মন্দিরে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। মন্দিরে থাকার সময়ে তিনি জানতে পারেন এই মন্দিরে গোপীনাথকে ক্ষীর নিবেদন করা হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির স্থানীয় ভাষায় পায়েস, ক্ষীর এইসব ভোগকে বলা হয় ক্ষীরিভোগ। একদিন পুজোর আগে ঠাকুরের সামনে পরপর ক্ষীরের পাত্রগুলি এনে রাখা হচ্ছিল। মাধব ঠাকুরের মনে হল, ইশশ্, যদি একবার চেখে দেখতে পারতাম কেমন স্বাদ, তবে আমার আশ্রমেও আমি ঠিক এমনই ভোগের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু এই ভাবনা আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চমকে উঠলেন, এ কী সর্বনাশ করে ফেললেন। তিনি যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁর কি সাজে দেবতার ভোগ দেবতাকে নিবেদন করার আগে নিজে সেবন করার ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেওয়া?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১২ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২৪৪ বার পঠিত
আসলে মা দুর্গা তো বাড়ির মেয়ে। মেয়ে যখন বাপের বাড়ি আসে, তখন কিছু না কিছু উপহার আনে। সেই সূত্র ধরে বাড়ির দুর্গার তরফ থেকে গ্রামের প্রাচীন শীতলা মন্দিরে মায়ের জন্য শাড়ি পাঠানো হয়, মানে শাড়ি পাঠিয়ে শীতলা মাকে বাড়ির উৎসবে আসার জন্য নেমন্তন্ন করা হয়। মায়ের সঙ্গে মন্দিরে ছোট গণেশ আছেন। তাঁর জন্য বাড়ি থেকে একটা ছোট কমলা পাড়ের ধুতি যায়। আবহমানকাল থেকে এই নিয়ম মানা হচ্ছে। এখন শাড়িটা ভুল করে পাঠানো হয়নি। বিসর্জন হয়ে গেলে প্রতিমা থেকে মা মুক্ত হয়ে যাবেন। তখন তো আর বাড়ির মেয়ে থাকবেন না। নেমন্তন্নও করা হবেনা। প্রথায় ছেদ পড়বে, তাই হুড়োহুড়ি।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৫৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩১৭ বার পঠিত
—বাবা, কীসব ব্যাপার! আচ্ছা মা, তুমি বলেছিলে আমাদের বাড়ির পুজো দুশ বছরের পুরোনো। দশমীতে লোকজন ডেকে খাসির মাংস খাওয়ানোও কী দুশ বছর ধরে চলছে?
— সেটা আমি নিশ্চিত নই। অবশ্য আগে তো শাক্ত মতে পুজো হত, বলিও হত, তখন রেওয়াজ ছিল কিনা শুনিনি কখনও। তারিণীপ্রসাদ পুজো বৈষ্ণব মতে চালু করলেন। তখন থেকে দেবীর নিরামিষ ভোগ। মাংস উনি খেতেন না। আর তোর বাবা বলে যে বাড়িতে মাংস ঢোকাও তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
— তাহলে এই খাওয়াটা কবে থেকে শুরু হল?
— তোর ঠাকুরদা অমরেন্দ্রনাথের আমলে।
— হঠাৎ এমন কেন হল?
— খুব সম্ভবত এর ওপরে আছে ইংরেজ আমলে মেদিনীপুরের সশস্ত্র বিপ্লবের প্রভাব।
— সেকী? ব্যাপারটা একটু খোলসা কর তো।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৩৬৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
— তোর ঠাকুরদার জন্ম ১৯২৩ সালে। ঐ সময়ে বাংলার অবস্থাটা আগে মন দিয়ে বোঝ। অমর যখন সাত বছরের বালক, তখন ঘরের পাশে পিছাবনিতে হয় লবণ সত্যাগ্রহ।
— আরে পিছাবনি দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ঢোকে, তখন বাজারে ইস্কুলের কাছে একটা স্তম্ভ আছে, সেইটা? বাবা বারবার দেখায়?
— হাঁ সেইটাই ঐ সত্যাগ্রহের স্মারক স্তম্ভ। জেলাশাসক পেডির সামনে মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছিল, ‘আমরা পিছাবনি’।
— তারপর?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১২৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
বিয়ের পরে নতুন বউ, শ্বশুর বাড়িতে দুর্গাপুজো, শাশুড়ি বরণ শেখাচ্ছেন, সিঁদুর খেলা, বরের ক্যামেরায় সিঁদুর মাখা মুখের ছবি, মত্ত হয়ে ছিলাম। বাড়িসুদ্ধ সবাই মাতোয়ারা। হঠাৎ চোখে পড়লো, সবার প্রিয় বড়দি, আমার বড় ননদ ঘরে মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে। বিধবা বলে এই আনন্দে তার অধিকার নেই, নিজের বাড়িতেও। সেদিন বিজয়ার আর একটা নির্মম মানে বুঝলাম - সধবার স্বীকৃতি আর আনন্দের তলায় বিধবার দুঃখ। সধবার অধিকারের উলটো দিকে রয়েছে বিধবার নিঃসঙ্গতা - একরকম সামাজিক বহিষ্কার। এ চাবুক চোখে দেখা যায়না, তাই আসল চাবুকের চেয়ে অনেক কঠিন আর ধারালো, চামড়া কেটে গভীরে বসে যায়। ঐ দৃশ্য দেখার আগে বিজয়া দশমী যে কিছু মেয়ের জন্য এতটা অপমানের তা বুঝতে পারিনি। এখন দশমীর বরণে পারুল কে ডাকি। অল্প বয়সে পারুলের বর সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডসে মারা যায়। তিনটি শিশু সন্তানসহ একঘরে পারুলকে শাশুড়ি আশ্রয় দেন। পারুল বলে, "হ গো বৌদি, মো কি ঘরো পূজা করিনা? শুধু সিন্দুর দিবানি, প্রদীপ, ধূ্প, মিষ্টি, জড়ো, পানো সবু দিবা"। প্রথাগত শিক্ষার নাগালের বাইরে থাকা আত্মবিশ্বাসী নারীকে বড় ভালো লাগে।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০২ মার্চ ২০২৩ | ১২৪০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
— চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে খুব একটা ঢোকেনি। টিভিও খুব কম ঘরে ছিল। তাই ব্যাপারটা লেখাপড়ার জন্য নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওসব জায়গায় খুব ভালো ভাবেই ছিল। তারিণীপ্রসাদ আর তাঁর বয়স্যরা মিলে স্বাধীনতার পরে তৈরি করেছিলেন ঐ এলাকার ছেলেদের জন্য প্রথম হাইস্কুল। আর মেয়েদের ইস্কুল শুরু হয়েছিল তোর ঠাকুমা বেলারানীর তত্ত্বাবধানে, তোদেরই বাড়ির দাওয়াতে।
— এই তো, এবার ইস্কুলের গল্প চলে এসেছে। বল, বল পুরোটা। কিন্তু আমি তো জানতাম ইস্কুল, হাসপাতাল সব কিছু বুড়ো ঠাকুরদা তারিণী করেছেন। এর মধ্যে ঠাকুমাও ছিল! ঠাকুমা লেখাপড়া জানতো? একটু খুলে বল দেখি।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৯ মার্চ ২০২৩ | ১০৫৮ বার পঠিত
— চট্টগ্রামের জালালাবাদের যুদ্ধে তিনি মাস্টারদার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ওঁর ভাই টেগরা সেই যুদ্ধেই মারা যায়। আমরা ওঁর বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। শিখাদির মা তখন বেঁচে ছিলেন, ভীষণ আমুদে একজন দিদা। ঐ বাড়িতে লোকনাথ বলের একটা বড় অয়েল পেন্টিং ছিল। ছোটবেলায় দেখলে গায়ে কাঁটা দিত আমার।
— ওঃ আর কাউকে জানো?
— পারিবারিক সূত্রে লেডি অবলা বসুর গল্প জানেন, এমন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি।
— কী বলছ মা? বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী?
— বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী বটে, তবে সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়।
— তাহলে?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৬ মার্চ ২০২৩ | ৯৮২ বার পঠিত
— ঠাকুমা বলেছিলেন যে, প্রতি সন্ধেবেলাতেই বাড়ির দুর্গামন্ডপে বয়স্ক জ্ঞানীগুণী লোকেরা আসতেন। চা, তামাক, জলখাবার চলত। তারিণী বসে গড়গড়া টানতেন। আর সকলে মিলে নানা বিষয় আলোচনা হত। একদিন সেই সভায় তারিণী বৌমাকে রান্নাঘর থেকে ডেকে পাঠালেন, সবার সঙ্গে বসতে বললেন। বৌমা এত গুরুজনদের সঙ্গে বসবে কী, লজ্জায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে রইল। তারিণী বললেন, 'এই লজ্জা সংকোচ ভাঙতে হবে বৌমা, তোমাকে মেয়েদের ইস্কুলের ভার নিতে হবে। নতুন ইস্কুলের দরখাস্ত করা হচ্ছে।'
— তখন ঠাকুমা কী করল?
— ওরে ঠাকুমা পণ্ডিত বাড়ির মেয়ে, বাড়িতে টোল, চতুষ্পাঠী - এসব জন্ম থেকে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু নিজে কীকরে করবে, এই ভেবে পা কাঁপছিল, বুকের ভেতর ভয় করছিল।
— তারপর?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৫) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৩ মার্চ ২০২৩ | ১২৮৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
ভারি আশ্চর্য। এখানকার কোন মেয়ে বসে থাকেনা। ঘরের কাজের সঙ্গে মাঠে কাজ করে, কাজু বাদামের বিচি থেকে শাঁস ছাড়ায়, বিড়ি বাঁধে। সরকারি ভাতাও পাচ্ছে। একটু সম্পন্ন ঘরে পরিচারিকা বা রান্নার কাজও করছে। আবার শ্বশুরবাড়িতে বরের মার খাচ্ছে, অভিভাবকদের বকুনি খাচ্ছে - এমন অল ইন ওয়ান উপযোগী প্রাণী যার ঘরে থাকবে তার লাভ। মেয়ে কমার তো কথা নয়। পড়াশোনা জানা ঘরে মেয়েরা কেউ কেউ শিক্ষিকা হয়, কিন্তু বেশিরভাগ নার্সিং পড়ে। বোধ করি সারা দেশে এখানকার নার্স আছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে টপ করে একটা চিন্তা আসে। মেয়ে কমেছে না কি ছেলে বেড়েছে?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১৬৭০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৮
এসে গেল শীতকালের দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাকসিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে শিগগির। আনলক চতুর্থ পর্ব চলছে। যেহেতু কলেজ এখনও খোলেনি, তাই আমার লকডাউন বহমান, থামার জো টি নেই। লকডাউনের অবসরে কর্তামশাই আমার এই একচিলতে বাসার জানলাগুলো বাগান করে ভরিয়ে দিয়েছেন। জানলা থেকে পুঁইশাক কেটে খাওয়া চলল নানারকম, কখনো শাক, কখনও শুধু ডাঁটা অথবা পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি। বিলোনোও হল কিছু নিকট আত্মীয় আর প্রতিবেশীকে। এখন ঐ জানালার একফালি রোদে তার বীজ শুকনো হচ্ছে আবার নতুন করে বোনার জন্য। বারান্দাকে তো একটু বড়সড় জানলা হিসেবে ভাবাই যায়, সেখানে তিনি ফলিয়েছেন ছোটো ছোটো বেগুন, দুরকম - সাদা আর বেগুনি। এখন শীতকালে দক্ষিণের জানলায় রোদ আসে বেশ। ছোটোবেলার স্মৃতি আর ইউ টিউবের পড়া মিশিয়ে, রান্নার মেয়েটির সঙ্গে যুক্তি করে থালায় থালায় দিলাম বড়ি। শুকোতে দিলাম সেই জানলায়।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ৩০ মার্চ ২০২৩ | ১০৯৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
আমাদের কর্তা গিন্নি দু'জনের জীবনেই ঝুলন পূর্ণিমার স্মৃতি মনের ঝিলের গভীর স্তরে সাজানো আছে। আমার স্মৃতিতে ভরে আছে - কাঠকলে গিয়ে বস্তা করে কাঠের গুঁড়ো আনা, সেগুলো নানারকম রঙ করা, গ্রাম, শহর, জঙ্গল সব পাশাপাশি, একধারে পাহাড়, নদী, ঝরনা - সেই পাহাড়ের মাথায় শিব ঠাকুর। প্যাকিং বাক্স ওপরে ওপরে রেখে, কাদা জলে ছোপানো কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পাহাড়, কায়দা করে শিব ঠাকুর বসানো। নিচে বড় মোটর সাইকেলের পাশেই ছোট ছোট হাতির সারি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে করা একরত্তি পুকুরে উত্তরাধিকারে পাওয়া এক মস্ত পোর্সেলিনের হাঁস। আর ঝুলন যেদিন শেষ হয়, সেদিন হল রাখী।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৬৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৩ এপ্রিল ২০২৩ | ১১২৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
আমার কর্তা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে, যতদিন আমরা আড়বালিয়ায় থাকব, বড়জেঠু, মেজজেঠু, সেজজেঠু কারোর পরিবারে আলাদা হাঁড়ি চড়বেনা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হবে। সে বড়ঘরের ছেলে, বাড়িতে অনেক লোকজনের থাকা খাওয়ার আয়োজনের জন্য কীভাবে সুচারু বন্দোবস্ত করতে হয় - এসব বিষয়ে অল্প বয়স থেকেই বেশ পাকাপোক্ত। তাই আমাকে কিছুই মাথা ঘামাতে হয়নি। ওর এই ব্যবস্থায় আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, কারণ কয়েকদিনের জন্য হলেও আমার ছোটবেলা যেন ফিরে এসেছিল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১১ মে ২০২৩ | ১২৫৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
জীবনের এক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাজের পরিসরে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ভিতরে। শালিক পাখির গল্প লেখার জন্য আমার নামে পুরষ্কার উঠেছে। আজই অনুষ্ঠান। হাসিমুখে দাঁড়াই মঞ্চে, মাইক ধরে দু চার কথা বলি নিপুণ পেশাদারিত্বে। আজ এই দৃশ্য দেখে যারা সবচেয়ে খুশি হত, তারাই আজ নেই। এ যে কী শূন্যতা বলে বোঝানো যায় না। আত্মীয় স্বজনের গুঞ্জন কানে ভাসে, 'তোমার খুব মনের জোর।' 'তুমি তো একটা ছেলের কাজ করছ'। এদের কাছে অন্তর ঢেকে রাখি সঙ্গোপনে। অসুস্থ বোনটা বাবা মায়ের কাছেই থাকত। এখন তাকে নিয়ে এসেছি সব পাট চুকিয়ে। আর আমার দুটো মেয়ে নয়, তিনটে। মনে ভাবি সামলাতে পারব তো সব দায়িত্ব!
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৮ মে ২০২৩ | ১২৮৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
আমি একটা ফেসবুকের পাতা বানিয়েছিলাম, সেখানে নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা লেখা, আঁকা, মোবাইলে তোলা ফটো, নিজের করা হাতের কাজ, রান্নার ছবি, গান, নাচ বা আবৃত্তির ভিডিও - লকডাউনে যে যা পাঠাত, সেগুলো আপলোড করতাম। এছাড়া ওদের মন ভাল করার অন্য কীই বা উপায় ছিল! বেশিরভাগ তো সব দূরদূরান্তে অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি, কলেজের কাছে মেস করে থাকে। নিজেরা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। একবার একটা পিজি ব্যাচ পাশ করে মেস ছাড়ার আগে আমাদের নেমন্তন্ন করে মাংস ভাত খাইয়েছিল। যা হোক, আলটপকা দু সপ্তাহের লকডাউন হতে দু তিনটে জামাকাপড় নিয়ে সব বাড়ি চলে গিয়েছিল। বই খাতা মেসে পড়েছিল, আর যে ওগুলো নিতে ফিরতে পারবেনা, তা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। বাড়িতে বসে লেখা পড়া যে করবে, উপকরণ ছিলনা। আমি যখন বলতাম এই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী এসে গেল, কিছু লিখে পাঠাও। অনেকে বলেছিল, ঘরে কাগজ নেই ম্যাডাম। তখন আমি বললাম, যে ওমা! লিখতে বুঝি সব সময়ে কাগজ লাগে? আমি তো মোবাইলে লিখি। তখন আর্জি এলো কোন, জয়ন্তী নয়, শুধু আমাদের জন্য মোবাইলে লিখুন ম্যাডাম।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৫ মে ২০২৩ | ১২৫৪ বার পঠিত
লকডাউনের দ্বিতীয় ঢেউয়ের অতি নিদারুণ এই দিনগুলি কোনমতে কাটছিল। খেয়াল করলাম, আমাদের অনার্সের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে গ্রুপ চ্যাটে অনেকদিন কোন কথা বলছেনা। ফোন করলেও ফোন ধরছেনা। কী করে যোগাযোগ করি ভেবে পাইনা। শেষে তাদের বন্ধুদের কাজে লাগিয়ে জানলাম, প্রত্যেকের বাড়িতেই একাধিক নিকটাত্মীয় মারা গেছেন। এদিকে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি তলানির দিকে, যারা আসে, তারাও ঠিকমত সাড়া দেয়না। বুঝি মনটা ওদের ভালো নেই। এর মধ্যে অনেক গুলিই ঘটনা ঘটল - তার মধ্যে দুটো বলছি। পিজি ক্লাসের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হঠাৎ করে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেল, সব যোগাযোগ বন্ধ। অনেকবার ধরে ফোন করতে করতে জানতে পারলাম, ছেলেটার কারণ কী।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৩) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০১ জুন ২০২৩ | ১২০৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
আমরা মনখারাপের সঙ্গে লড়াই করার জন্য কলেজে মাঝেমাঝেই মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে ওয়েবিনার করছিলাম, যাতে তাঁরা আমাদের বাঁচার কোন পথ বাতলে দিতে পারেন। তাঁরা বলেছিলেন বই পড়তে, বিশেষ করে জীবনীমূলক বই। পরীক্ষা শেষ হবার পর, আমি পূর্ব দিনের মহামারীগুলি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম স্বামী বিবেকানন্দের লেখা প্লেগ ম্যানিফেস্টোর প্রথম কয়েক লাইন বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই যেন করোনার সাবধানতার সঙ্গে মিলে যায়। সেই একই পরিচ্ছন্নতার বার্তা, টাটকা আর পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ। ডাক্তার আর জি করের প্লেগের ওপরে লেখা একটি বই হাতে এলো। নতুন করে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় কুমুদিনীর বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মচরিত পড়লাম। হজরত মহম্মদের ওপরে লেখা তাঁর বইটি আন্তর্জালে খুঁজে পেলাম। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জগৎ ভুলে পাগলের মত কেবল পড়েই যেতে লাগলাম। বই থেকে মুখ তুললে যত রাজ্যের আতঙ্ক এসে ধরে, তাই কেবল বইয়ের আড়ালে আড়ালে আমার দিন কাটতে লাগল।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৪) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৯ জুন ২০২৩ | ১০৭৬ বার পঠিত
আমাদের ধারণা ছিল কলেজের ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়েছে, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওদের সচেতনতার শিক্ষা খুব বেশি প্রয়োজন নেই, কারণ টেলিভিশন বা সমাজ মাধ্যমের কারণে এরা সব কিছুই দেখেছে, শুনেছে, জেনেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম একেবারেই ভুল ভেবেছি। যেহেতু প্রথম ঢেউয়ে গ্রাম তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি, তাই এই ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই অসুখটার ণত্ব ষত্ব কিছু জানেনা। টেলিমেডিসিন কি, অসুখের প্রোটোকল কি? কতদিনের মধ্যে কী ধরণের পরীক্ষা করাতে হবে, পরীক্ষা কোথায় হয়? অক্সিজেন কেন, কখন লাগতে পারে এগুলো তারা বিশেষ কিছুই জানেনা। তাছাড়া বেশিরভাগের বাড়িতে অক্সিমিটার তো দূর থার্মোমিটার পর্যন্ত নেই।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৬) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২২ জুন ২০২৩ | ১২৪৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
- মা, শ্বেত পাথরের টেবিলের গল্পটা বলবে বলেছিলে!
- টেবিলের গল্প? টেবিলের তো আর আলাদা কোন গল্প হয়না রে বাবু, এ হল টেবিলের চারপাশের মানুষের গল্প।
- সেটাই বল শুনি।
- শোন তবে। আমাদের ছোটবেলায় খুব রেডিওতে নাটক শোনার চল ছিল। যেদিন যেদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেত পাথরের টেবিল নাটকটা হত, সেদিন মা, মামা, মাসিরা সব কাজ ফেলে রেডিও ঘিরে বসত আর নানান মন্তব্য করত। নাটকটা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ সেই আড্ডা চলতেই থাকত। আলোচনার মূল কথা হল, এ তো আমাদের বাড়ির গল্প, সঞ্জীব বাবু কীভাবে জানলেন? ইত্যাদি। সেই সব গল্প থেকেই প্রথম জানতে পারি যে, আমার মামার বাড়িতে এককালে বিশাল এক নকশাকাটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল।
- নাটক থুড়ি গল্পটার সঙ্গে মিলটা কী?
- গল্পটা তোকে পড়তে হবে, তবে তো? মোবাইলে খোল, গুগলে আছে।
- আচ্ছা, ওয়েট, দেখি,
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৮২) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৩ আগস্ট ২০২৩ | ১৫৯১ বার পঠিত | মন্তব্য : ২০
- মা কী বলবে বলেছিলে মনে আছে?
- কী রে?
- দাদুরা আড়বালিয়ার বাড়ি ছেড়ে শহরে কেন গিয়েছিল?
- ইচ্ছে হয়েছিল তাই গিয়েছিল।
- না, বল ঠিক করে, বলতেই হবে। তোমার মামার বাড়ির কথা তো অনেক শুনলাম। আমার মামার বাড়ির কথা জানবোনা বুঝি? আড়বালিয়ার অমন প্রাচীন ইতিহাস নেই?
- সে তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কিনা রাজা মহারাজাদের সাত পুরুষ, দশ পুরুষ সব নাম নথি পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের সেসব লেখা থাকেনা, তাই হারিয়ে যায়। আমাকে নিয়ে কেবল চার পুরুষের কথাই জানি।
- সেটাই বল, আমাকে তো জানতে হবে।
- জানতে হবে? সংক্ষেপে জানবি নাকি বিশদে?
- ওসব জানিনা, তুমি যা জানো আমাকে বলতে হবে।
- তাহলে তোকে কিন্তু ধৈর্য ধরে অন্তত সোয়াশো বছর আগের আড়বালিয়ায় যেতে হবে। পারবি?
- তাই নাকি! চল, চল, শিগগির।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৮১) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৭ জুলাই ২০২৩ | ১২১৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান।
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৮০) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২০ জুলাই ২০২৩ | ১৩০৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি?
- সব গেছে, দেবে কী করে?
- গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল,
- আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’
- যাঃ জানা হলনা তবে?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৯) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ১৩ জুলাই ২০২৩ | ১১৬৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে?
- বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল -
- ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৮) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ১১৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
- তোমার ছোটবেলার সিনেমার গল্প বল।
- আরে তখন যুগটাই ছিল, যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন- বন্ধু বান্ধব মিলে সিনেমা দেখতে যাবার যুগ। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকে অসিত বরণ, উত্তম কুমারের সিনেমা দিয়ে হাতেখড়ি। মামার বিয়ে হল - নতুন বৌকে নিয়ে মায়ার সংসার। রবিবার এলো তো বাবা মার হাত ধরে সব্যসাচী। মাসিমণির বিয়ের কথা চলছে, নতুন পাত্রকে নিয়ে চিরন্তন। কালে কালে বাবার হাত ধরে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী, এন্টার দ্য ড্রাগন, গ্রেট এসকেপ, গানস অফ নাভারোন। অবশ্য হিন্দি সিনেমায় বাধানিষেধ ছিল। স্কুল পাশ করে কলেজ পর্যন্ত শুধু সফেদ হাতি আর পার। কলেজে উঠে ও ব্যথাও মিটে গেল। নুন শোয়ে ফুল অর কাঁটে, প্রতিবন্ধ, লমহে - আহা কীসব দিন।
- দাঁড়াও, কলেজে উঠি, তারপর আমিও যাব।
- যাবি।
- সিনেমা দেখে দেখে সিনেমা প্রীতি?
- না না তা কেন? আসল হল, চরিত্র চিত্রণ, কোন সিন কীভাবে তোলা হচ্ছে, এসবের চুলচেরা আলোচনা।
- কীরকম?
পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৭৭) : শারদা মণ্ডল
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ২৯ জুন ২০২৩ | ১১৬০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
- "মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি।
- গান জানিনা তো।
- তাহলে বাজাচ্ছো কি করে?
- আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা।
- হলনা কেন?
- হারমোনিয়ামটা হারিয়ে গেল।
- কীকরে?
- সে অনেক কথা, পরে বলব।"
ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে?