গদানসক / ডানজিগ
জার্মানিতে আমার প্রথম কর্মস্থল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসের ঠিকানা: ২৬-২৮ গোয়েথে স্ত্রাসে। নামে ব্যাঙ্ক, কিন্তু সেখানে আমাদের আপন হিসেবের খাতা খোলার অনুমতি জার্মান কর্তৃপক্ষ দেয়নি । অগত্যা ব্যাঙ্ক হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া সেই গোয়েথে স্ত্রাসেতেই ড্রেসনার ব্যাঙ্কের একটি ছোট ব্রাঞ্চে আমাদের অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। তার অবস্থান ফ্রাঙ্কফুর্টের পুনর্নির্মিত অপেরা হাউসের ঠিক কোনাকুনি। মাইনে জমা হত, টাকা তুলতে যেতে হত। এটিএম নামক জনহিতকর প্রতিষ্ঠানটির ধরাধামে আবির্ভূত হতে পুরো দশ বছর বাকি। সে আমলে মানুষজন কাজে বা অবসরে ব্যাঙ্কে হাজিরা দিতেন, কাউন্টারে ক্যাশিয়ারদের সঙ্গে গল্প গুজব করতেন। পারস্পরিক খবরাখবর নিতেন ও দিতেন। সবার হাতেই সময় থাকত!
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। জার্মানি ছেড়েছি। কিন্তু ব্যাঙ্কের খাতাটি সেখানেই থেকে গেছে। তার একটা মস্ত বড় কারণ মাক্সিমিলিয়ান রিখটার, ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এক সদাশয় আধিকারিক। তিনি আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। হের রিখটার আমাকে একটু করুণার চোখে দেখতেন। যখন আমার বেতন ছিল মাসে ৮০০ মার্ক (সে সময়ের হিসেবে ৩২০০ টাকা), তিনি অবলীলায় ধার দিয়েছেন ৩০০০ মার্ক অবধি। চার্বাক তিনি পড়েননি, কিন্তু আমি যে – ঋণং কৃত্বা বিয়ারং পিবেত – এই সদ্ভাবনায় পরিচালিত হই, তা তিনি সহজে অনুমান করতে পারতেন। ড্রেসনার ব্যাঙ্কের ঠিক পিছনেই ফ্রেসগাসে নামক যানবাহন-বর্জিত পথচারী এলাকায় আমাদের নিয়মিত হাজিরা ছিল ওঙ্কেল মাকস পাবে। সেখানে তিনিও আসতেন, তবে দূর থেকে হাস্যবিনিময় করে চলে যেতেন। আমাদের টেবিলে কখনও বসেননি। খদ্দেরের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা হয়তো তাঁর বাঞ্ছনীয় মনে হয়নি।
ইংল্যান্ডে চলে এসেছি কবে। কাজের সূত্রে জার্মানির সঙ্গে আমার বন্ধন অটুট। আসা-যাওয়া লেগে আছে। ধার নেওয়ার প্রয়োজন আর নেই, কিন্তু হের রিখটার সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেননি। তাঁর অনুরোধ ছিল, আমি যেন মাঝেমধ্যে কিছু মার্ক, পরে ইউরো, জমা দিই, তাতে করে আমার অ্যাকাউন্ট জীবন্ত থাকে। আর যখনই ফ্রাঙ্কফুর্ট আসি, একবার যেন দেখা করে যাই। আমি এক অদৃশ্য মানুষ নই, আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, মাঝেমধ্যে আমাকে যে চাক্ষুষ করেছেন, সেটা ড্রেসনার ব্যাঙ্কের জানা দরকার। তবেই আমার অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব বজায় থাকে।
একদিন তাঁর ফোন পেলাম লন্ডনে। সুপ্রভাত, কেমন আছেন – ইত্যাকার আমড়াগাছি নয়। সোজা প্রশ্ন।
-আপনি গত সপ্তাহে কোথায় ছিলেন?
অবাক হলাম। একে তো তিনি আমাকে কখনো ফোন করেন না। সে আমলে বিদেশে ফোন করা খরচার ব্যাপার, ইন্টারন্যাশনাল কল বলে কথা। পুরোনো জমানার কায়দায় চিঠি লেখেন – সেটাও ক্বচিৎ। আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে তিনি পড়লেন কেন? কণ্ঠস্বরে একটু উত্তেজনা। বাজে গল্প হের রিখটার কখনো করেন না। ব্যাঙ্কের ব্যয় বাড়ানো তাঁর বাসনা নয়।
-পোল্যান্ডে।
-পোল্যান্ডের কোথায়?
-কেন?
-আপনার ওয়ালেটটা খুলুন।
আদেশমত খুললাম।
-দেখুন আপনার ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ডটা আছে কিনা।
এবার আমার চিন্তার পালা। না, নেই। জানালাম।
-আপনি হয়তো সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার টাকা তোলার পরে আপনার কার্ডটি ডানজিগের পেকাও ব্যাঙ্কের একটি এটিএমে ফেলে এসেছেন। কার্ডের পিছনে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের নাম-ঠিকানা দেখে তাঁরা নিতান্ত ভদ্রতা ও গ্যাঁটের পয়সা খরচা করে আমাকে জানিয়েছেন। আপনার ব্যাঙ্ক কার্ডটি আপাতত বাতিল করলাম।
-খেয়াল করিনি। খুব ভুল হয়ে গেছে। কেউ টাকা তোলেনি তো?
-না, আপনার ভাগ্য ভাল। কেউ সুযোগ নেওয়ার আগেই পেকাও ব্যাঙ্কের এক কর্মচারী এটা মেশিন থেকে তুলে নেয়।
তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন নামাতে যাচ্ছি। তিনি বললেন,
- ডানজিগ শহরটা ঘুরে দেখেছেন?
- কাজে গেছি তো। শহরটা একটু দেখেছি। আবার শিগগির যাব। কাজ আছে।
অন্যদিকে নৈঃশব্দ্য। ফোনটা কাটেননি।
-রাজকীয় পথ দিয়ে হেঁটেছেন? লম্বা বাজার (লাঙ্গে মারকট)?
-হ্যাঁ, মানে – এক অফিস থেকে অন্য অফিসে যাবার পথে। হাঁটা ছাড়া তো উপায় নেই। সব রাস্তাই শুধু পথচারীদের জন্য।
আবার নিস্তব্ধতা। লাইনে আছেন। বুঝতে কেন, আন্দাজ করতেও পারছি না।
- আবার যদি যান, ১৬ নম্বরের সামনে একবার দাঁড়াবেন। পারলে ছবি তুলবেন। ওই বাড়িতে আমার জন্ম।
এক লহমায় প্রায় ষাট বছরের ইতিহাসের পাতা উলটে গেল। সাত শতাব্দীর পুরোনো প্রাশিয়ান শহর। প্রাশিয়ানদের খ্যাদালেন নাপোলেওঁ। ডানজিগকে প্রাশিয়া থেকে বিযুক্ত করে তাকে মুক্ত শহরের আখ্যা ও সম্মান দিলেন। সেটা বেশিদিন টিকল না। ভিয়েনা কংগ্রেসে নাপোলেওঁর ভাল-মন্দ সকল কর্মকে বাতিল করা হল। ডানজিগ আবার প্রাশিয়া! ১২৩ বছর বাদে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পোল্যান্ডের পুনর্জন্ম, তবে সেটাও আধখানা। প্রাশিয়ান রাজত্বকে কেটে-ছেঁটে পোল্যান্ডকে দেওয়া হল সমুদ্র অবধি পৌঁছানোর অধিকার, কিন্তু ডানজিগ, তার ৯৫% জার্মান নাগরিক সহ, রয়ে গেল একটি মুক্ত শহর। এর শাসনভার জার্মানির হাতে নয়। লিগ অফ নেশনস দ্বারা নিযুক্ত একজন গভর্নর সেই দায়িত্ব নিলেন। ডানজিগ থেকে পোল্যান্ডের জমির ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যায় জার্মানি। পোল্যান্ডের সঙ্গে নিঃশুল্ক বাণিজ্য। শুধু ডানজিগ নয়, চারপাশের ২৯৫টি গ্রাম ও পঞ্চায়েত মিলিয়ে পাঁচ লক্ষ নাগরিকের একটি ছোট প্রদেশ। ভারতবর্ষে র্যাডক্লিফের ছুরি যেরূপ অশান্তির সৃষ্টি করেছে, ভারসাই সন্ধি চুক্তি তার তুলনায় কিছু কম করেনি। পোল্যান্ড দেশটা আবার জন্ম নিল বটে, তার পূর্বপ্রান্তে রইল জার্মান পূর্ব প্রাশিয়া, দক্ষিণে জার্মান সাইলেশিয়া, উত্তরে মুক্ত স্বাধীন শহর ডানজিগ! ভবিষ্যতের তোলপাড়ের বীজ এখানেই বপন করা হল।
১৯৩৯ সালে জার্মানি এসে তাদের পুরোনো প্রাশিয়ান জমিদারির পুরো দখল নিল।
ডানজিগে জার্মান অধিবাসনের ইতিহাস হাজার বছরের বেশি পুরোনো। হের রিখটারের পূর্বপুরুষ ছিলেন সেখানকার বাসিন্দা। ১৯৪৫ সালে ছিন্নমূল রিখটার পরিবার কিশোর মাক্সিমিলিয়ানকে নিয়ে হেঁটে জার্মানি এসেছেন। মাক্সিমিলিয়ান কখনো ফিরে যাননি ডানজিগে। লৌহ যবনিকার সময় সেটা শক্ত ছিল। হের রিখটার ডানজিগকে ভুলেই গিয়েছিলেন বা মনে রাখতে চাননি। ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড সামলানোর ব্যাপারে আমার দক্ষতার অভাবে তাঁর একটা সূত্র যোগ হয়ে গেল ডানজিগের সঙ্গে। আমাদের সংক্ষিপ্ত সংলাপের পরে তাঁর মন নিশ্চয় চলে গিয়েছিল ডানজিগের অলিতে গলিতে। ঠিক যেভাবে আজ এপার বাংলার অনেক অশীতিপর মানুষের মন চলে যায় বিক্রমপুরের গ্রামে।
আমার পোল্যান্ড পরিক্রমায় বারে বারে জেনেছি – বালটিক দেশগুলির মত পোল্যান্ড থেকেও ছিন্নমূল এক বিশাল জার্মান জনতার দেশান্তর যাত্রার কাহিনি।
সিটি ব্যাঙ্কের ডরোটা কালওয়া তখন পোলিশ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তাদের পরিষেবার কাজ করে। তারই আমন্ত্রণে আমার একাধিকবার ডানজিগ সফর। এর আগে অবশ্য গদিনিয়া জাহাজ কারখানায় গেছি। সেখানে যেতে হলেও আমাকে ডানজিগ বিমানবন্দরে নামতে হত। সেটি তখন (১৯৯৩-৯৪) এত ছোট, যে চেক ইন করা সামগ্রী বিমানবন্দরের বাইরে একটা বেল্টে পাওয়া যেত। আমার, নবগঠিত বা পুনর্গঠিত এই সব পোলিশ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে সিটি ব্যাঙ্ক আয়োজিত সেই ঝাকশেভোর ট্রেনিংয়ের সময়। এর পরের বহু বছর অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই সব ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে কাজ করেছি – ততদিনে তাঁরা সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন। উদাসীনভাবে সেই সংস্কৃত প্রবাদ স্মরণ করেছি – পুত্র এবং ছাত্রের কাছেই মানুষ পরাজয় ইচ্ছা করে!
ডানজিগ শহরের দু’প্রান্তে দু’টি রাজকীয় তোরণ। যে পথটি তাদের যোগ করেছে, তার নাম রাজকীয় পথ। সেখানেই সেই লাঙ্গে মারকট। দু’পাশে ব্যারক ছাঁদের বাড়ি, ঠিক যেমনটি ছিল সেকালে। কিন্তু এখানে একটু ছলনা আছে। যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ডানজিগকে পুরোনো চেহারা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে – সামনের খোলসটা ১৫ শতাব্দীর। তার ভেতরে আধুনিক দোকানপাতি। হলিউডের ইউনিভারসাল স্টুডিও ব্যাকলট সফর যারাই করেছেন, তাঁরা জানেন এই ব্যাপারটা।
সামান্য কয়েকটিকে আদ্যোপান্ত সাজানো হয়েছে প্রাচীন ধাঁচে। যেমন সালমন হোটেল! ডানজিগে ধনী মানুষেরা বাড়ির নম্বর না দিয়ে, নাম দিতেন পশুপাখি বা মাছের নামে। তাই এই বাড়ির নাম সালমন আর এখানে আপনি পেতেন এক বিখ্যাত পানীয়, যার নাম সোনালি জল (গোল্ডভাসার)! ১৭ শতাব্দীতে ফেরময়লেন নামে একজন এক ডাচ ভদ্রলোক একদিন দারচিনি লবঙ্গ ইত্যাদি ১৫ রকমের মশলা দিয়ে একটি লিকিওর বানালেন এবং তাতে ভাসিয়ে দিলেন ২২ ক্যারেট সোনার পাতলা পাতা! তাই এর নাম সোনালি জল! এর মাদক শক্তি (আলকোহলিক কন্টেন্ট) ৪০%! রাশিয়ান জার পিটার দি গ্রেট একবার এটি পান করে এমন মুগ্ধ বা মত্ত হন যে তিনি একটি স্থায়ী অর্ডার দেন: তাঁর জীবৎকালে প্রতিমাসে একটি বোতল যেন তাঁকে অতি অবশ্য তাঁর সেন্ট পিটার্সবুর্গের ঠিকানায় পাঠানো হয়। মূল্যটা চেকে বা অনলাইনে দেওয়া হত কিনা জানা যায় না!
পুরোনো গল্প ভাঙিয়ে বিক্রিবাটা বাড়ে বটে, কিন্তু এর উৎপাদন এখন ডানজিগে নয়, জার্মানিতে হয়। সেদিন দেখলাম এটি আমাজনেও প্রাপ্তব্য! হায়, আমাদের ঐতিহাসিক গল্পগাছার দিন ফুরোল!
ডানজিগ শহরের সন্ত মেরির গির্জে প্রাশিয়ান স্থাপত্যের অসাধারণ উদাহরণ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ইটের গির্জে। তিরিশ মিটার উঁচু, ২৭টি স্তম্ভ। সেখানে পঁচিশ হাজার মানুষ একত্র উপাসনা করতে পারে। সমস্ত দেয়ালে, মেঝেতে জার্মানে লেখা, খোদাই করা, হাজার হাজার স্মৃতি সংবাদ – কারো জন্মে, কারো মৃত্যুতে, কোনো উৎসবে, কোনো বিষাদে। দশ আদেশ এখানে লিখিত নয় – ভারত চিত্রকথার মত ফ্রেমে আঁকা।
দেওয়ালের মেঝের শেষ জার্মান লেখাগুলো এই মাত্র ৫০ বছর আগের। কাল গণনার ইতিহাসে ৫০ বছর তো ব্রহ্মার পলকপাত! জার্মানি নামক কোনো দেশ ছিল না ইউরোপে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত। জার্মান ভাষাভাষী এক জাতি ছিল। তাঁরা যেখানে বাস করেছেন, সেটাই তাঁদের দেশ। ১৮৭১ একটি সময়রেখা সমগ্র জার্মান জাতির জন্য, যেদিন তাঁরা একটি ভূখণ্ডকে আপন দেশ হিসেবে পেলেন, একটি পতাকার তলায় দাঁড়ানোর অধিকার পেলেন।
বিগত কয়েকশ’ বছরের জার্মান স্মারক থেকে গেল ইউরোপের পথে প্রান্তরে। ফ্রান্সের অরশউইলারে (আলসাস) দেখেছি প্রাশিয়ান রাজাদের তৈরি প্রাসাদ – কোয়েনিগসবুর্গ – যার সুউচ্চ প্রাকারে জার্মান ভাষায় প্রাশিয়ান রাজার বন্দনা খোদিত আছে। বেলজিয়ামের মালমেদি, এসটোনিয়ার টালিন, লাটভিয়ার রিগা, লিথুয়ানিয়ার কাউনাস, চেকের প্রাগ, স্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভা, স্লোভেনিয়ার মারিবর, হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট/দেব্রেচেন, রোমানিয়ার ব্রাসভ – সর্বত্র ছড়িয়ে আছে জার্মান স্মৃতি। তার খানিকটা অবশ্যই অস্ট্রিয়ান, কিন্তু মূলটি এক। এই পাথরে লেখা নাম, সে নাম রয়ে গেছে। ডানজিগের মেরি মাতার নামাঙ্কিত গির্জেতে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল, ইতিহাসকে যেন ধরাছোঁওয়া যায়। এই তো গেল রবিবার সপরিবারে জার্মানরা প্রার্থনা করে বাড়ি ফিরলেন। আজ তাঁরা কোথায়?
ডরোটা বললে, আজকের মত অফিসের কাজ শেষ। চল, আরেকটা জায়গায় যাই। সে আমাকে নিয়ে গেল ১৩ নম্বর লেলেওেলা। যেটা আমি জার্মানে লাবেসভেগ বলে জানি। ১৬ অক্টোবর ১৯২৭ এই বাড়িতে গুন্টার গ্রাস জন্মান – বাবা জার্মান, মা কাশুবিয়ান পোলিশ।
কলকাতার সঙ্গে ভালয়-মন্দয় জড়িয়ে আছেন গুন্টার গ্রাস। কী খুঁজেছিলেন সেখানে জানি না। তবে বলেছিলেন, কলকাতার মানুষ উঠিতে বসিতে অভিযোগ করে না, জার্মানরা করে! জিহ্বা প্রদর্শন কর (তসুঙ্গে তসাইগেন) পড়িনি। আমার জার্মান শেখার প্রথম দিকে গোথে ইন্সটিট্যুটের প্ররোচনায় ব্লেখ ট্রোমেল (টিন ড্রাম) বেশ কষ্ট করে পড়তে হয়েছিল। ছোট্ট অস্কার মাজেরাথ এই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে দুনিয়া দেখত। টিন ড্রাম (ব্লেখ ট্রোমেল), ইঁদুর বেড়াল (কাতস উনড মাউস) এবং কুকুরের বছর (হুণ্ডেইয়ারেন) মিলে বিখ্যাত ডানজিগ ট্রিলজি – ১৯৯৯ সালে পেলেন নোবেল পুরস্কার।
ডানজিগকে তিনি কখনো ভোলেননি।
নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করে সম্মানী সভায় বললেন, “আমার জন্মভূমি, এক হাজার বছরের ইতিহাস আজ হারিয়ে গেছে। আমার গল্পে যদি সেই হারানো ও বিধ্বস্ত শহর ডানজিগের ছবি সঠিক আঁকতে না পারি, কল্পনার ভেল্কি অন্তত দেখাতে পারি! যা বাস্তব থেকে হারিয়ে গেছে, তাকে কল্পনায় বাঁচাতে পারি”।
ডানজিগ গির্জেয় চোখ বন্ধ করে আমি গুন্টার গ্রাসের কথা ভেবেছিলাম।
এককালের প্রাশিয়ান রাজধানী কোয়েনিগসবেরগ কখনও যাইনি। সেটা এখন কালিনিনগ্রাদ, রাশিয়া। তবে পূবে লিথুয়ানিয়ার মেমেল থেকে পশ্চিমে পোজেন অবধি যা প্রাশিয়ান শহর দেখেছি, তার মধ্যে ডানজিগ আমার কাছে অবিস্মরণীয়। ডানজিগ ছিল হানসা লিগের সদস্য। মটলাভা নদীর কূল-বরাবর দীর্ঘ বিহার! হেঁটে বেড়ালে চোখে পড়বে ছ’শ’ বছরের পুরোনো একটি ক্রেন। নৌ-বাণিজ্য তার প্রাণ। এই ক্রেন একটি হুক লাগিয়ে জাহাজ থেকে দু’টন ওজনের সামান ৯০ ফিট উঁচুতে তুলে দিত। কোনো যন্ত্র দিয়ে নয়। নিতান্ত পেশির জোরে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভেঙে গেলে পর, পুনর্নির্মাণ হয়েছে পুরোনো চেহারায়। এই বর্ণময় বন্দরে দাঁড়ালে মনে হবে ইতিহাসের ভেতরে হাঁটছি।
ডানজিগ পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অগ্নি সাক্ষী। ডরোটা সেখানে নিয়ে গেল আমাকে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোনো যোগ না থাকলেও, এটি তার কাছে তীর্থ পরিদর্শনের মত। ১৯৬৮ সালে প্রাগের বসন্ত। রাশিয়া-প্রভাবিত কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে চেক প্রতিবাদ যখন সরব হল, ডানজিগের এক ছাত্রনেতা তার সমর্থনে আওয়াজ তুললেন। তিনি যোগ দিলেন ডানজিগ জাহাজ নির্মাণ কোম্পানিতে। একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে। তাঁর অগ্নিগর্ভ সন্দেশ তাঁর কর্মদাতা বা পোল্যান্ডের শাসকদের পছন্দ হল না। কাজ গেল। এখানে-ওখানে কাজ করে এবং মাঝেসাঝে জেলে দিন কাটে। ক্রমে দেশে বাড়ছে অসন্তোষ। রুটির দাবি পথে পথে। এমনি সময় ৩১শে আগস্ট, ১৯৮১ এই লেনিন শিপইয়ার্ডের এক কর্মী-সমাবেশে পদচ্যুত মানুষটি তারের বেড়া টপকে সেই বিক্ষোভে যোগ দিলেন। পোল্যান্ডের জনতার অসন্তোষকে একটা চেহারা, একটা নাম দিলেন – সলিদারনোশ। সংহতি। দু’বছর বাদে নোবেল পুরস্কার। তার এক দশক বাদে, ৬৩ বছর বাদে পোল্যান্ডের ইতিহাসে লেখ ভালেন্সা হলেন প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।
আজকের ডানজিগে জার্মানির অতীত আর পোল্যান্ডের বর্তমান মিলেমিশে একাকার।
পুনশ্চ: লাঙ্গে মারকট-এর ১৬ নম্বর বাড়ির ছবি তুলে আমি মাক্সিমিলিয়ান রিখটারকে পাঠিয়েছিলাম, ডাকযোগে। সেটি তিনি পেয়ে ফোনে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। স্মৃতি কি সুখের ছিল, না বেদনার? তাঁর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়নি। রিটায়ার করে হাঙ্গেরি চলে গেছেন। ড্রেসনার ব্যাঙ্ক অতীতের আস্তাকুঁড়ে বিলীন। কমারতসব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে গিয়ে নাম, চরিত্র এবং বহু শাখা খুইয়েছে। আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সরিয়ে এনেছি নাসাউইশে স্পারকাসে নামের একটি সেভিংস ব্যাঙ্কে। কালের ধারা অনুযায়ী সেখানে সুদের হার শূন্য।
ভারশাভা / ওয়ারশ
কাজেকর্মে ওয়ারশ গেছি অনেকবার। এমনকি দু’বছর আগেও। অনেক যুদ্ধ দেখেছে এ শহর। তার দাগ হয়তো আজ মিলিয়ে গেছে, কিন্তু ঐতিহাসিক ওয়ারশ কোথায় গেল? সেটি একমাত্র দেখা যায় পুরোনো ওয়ারশতে (স্টারে মিয়াসতো)। সেখানে চারশ’ বছরের পুরোনো দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে নতুন ঝকঝকে বাড়ি! আমার মতে তার একমাত্র তুলনা ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রাচীন শহর (আলট স্টাড) – যেটি মোটেও প্রাচীন, পুরোনো কিছু নয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের মতই যুদ্ধোত্তর ওয়ারশ গড়ে উঠেছে এবড়োখেবড়ো ভাবে। বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানো মাত্র।
ব্যবসা-বাণিজ্যে দেশ ঘোরা হয়। হোটেল আর ট্যাক্সির জানলা দিয়ে দেশ দেখা হয় না।
ওয়ারশ দেখেছি আনিয়ার সঙ্গে। ভ্রতস্লাভ থেকে ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমেস্তারে পড়তে এসেছে সে। সিটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে দু’সপ্তাহের ইন্টার্নশিপ তখন। আনিয়ার গল্প অনুযায়ী ভার নামে এক মেছুরে ভিসতুলা নদীতে সাভা নাম্নী এক জলপরীর প্রেমে পড়ে। একদিন শহর গড়ে তারা। সেই থেকে নাম হল ভারশাভা। অন্য তত্ত্ব হল, ভারস নামক এক ধনবান জমিদারের বাসস্থান ছিল এখানে। আসল থিওরি যাই হোক, আমার স্বল্প পোলিশ জ্ঞানে এটা বলতে পারি, কোনো পোলিশ স্থানের নামের শেষে “আ” থাকে না। সেদিক দিয়ে ভারসাভা বিশিষ্ট!
ওয়ারশ-র পুরোনো শহর (স্টারে মিয়াসতো) আমার খুবই প্রিয়। ১৩শ শতাব্দীতে তার প্রতিষ্ঠা। পাথরে বাঁধানো চত্বরের চারপাশে বর্ণাঢ্য বাড়িঘর। এখানে পা ফেললে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে পাঁচশ’ বছর পিছিয়ে গেলেন যেন। এই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে, যখন জানবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত স্টারে মিয়াসতোর পুনর্নির্মাণ হয়েছে হলিউডি কায়দায়। ফিল্ম সেটের মতন। সেটা ভুলে যেতে পারলে আপনি বহু শতাব্দীর পুরোনো ওয়ারশ-র সুঘ্রাণ পাবেন। তখন ফেব্রুয়ারি মাস। প্রচণ্ড ঠান্ডা। সেই প্রথম ওয়ারশ দেখা, যেখানে এসেছি অনেকবার পরের দুই দশকে। এই স্টারে মিয়াসতোর উঁচু দেয়ালে দাঁড়ালে, দেখা যায় নীচে ভিসতুলা নদী। মনে করে নিতে অসুবিধা হয় না, রাশিয়ান সৈন্যরা সেখানে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে দেখেছে কীভাবে জার্মানরা শেষ পোলিশ প্রতিরোধের মুকাবিলা করছে, ৬৩ দিন ধরে। জার্মানদের তো আমরা একটু পরে দেখে নেব। আপাতত জার্মানরা পোলিশ প্রতিরোধকে ঝাড়েবংশে নির্মূল করুক। কী যে দুর্ভাগ্য এই দেশের! একবার জার্মান আরেকবার রাশিয়ানরা এসে মেরে যায়।
শহরের মাঝে একটি বহুতল রাশিয়ান স্থাপত্যের নমুনা আছে – স্টালিনের সংস্কৃতি ও বন্ধুত্বের প্রাসাদ (অনেক ঘষাঘষি করে স্টালিনের নামটি মুছে দেওয়া হয়েছে)।
মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির সামনের টিলায় দাঁড়ালে পায়ের নীচে শহরের যে স্কাইলাইন দেখা যায়, সেখানে এই ধাঁচায় তৈরি সাতটি বহুতল বাড়ি চোখে পড়ে। প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য হল ২০/৩০ তলা পর্যন্ত প্রশস্ত, তারপরে একটু ক্ষীণ আকার নিয়ে ৩০/৪০ তলা অবধি উঠে যায়। মাথাটি খুবই সরু। এদের নাম দেওয়া হয় তারকা অথবা ভগিনী (সেভেন সিস্টারস)। মস্কোর বাইরে ওয়ারশ একমাত্র “তারকা”। রাশিয়ানরা তাঁদের পোলিশ-প্রীতি ও বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে এটির নির্মাণ করেন। আমার চেনাজানা যাবতীয় পোলিশ মানুষজন এই বন্ধুত্বের স্মারকে অবিশ্যি ইয়ে করেন। আনিয়া সেখানে নিয়ে যায় তার আন্তরিক অবজ্ঞা সত্ত্বেও। এটা যে কী খারাপ সেটা দেখাতে। যেমন আমাদের কালে কলকাতায় বলতাম ওই ছবিটা দেখনি? সে কী কথা! এটা যে কতটা বাজে, সেটা আমার কথা শুনে বিশ্বাস কোরো না। চাক্ষুষ দেখে এস!
তিন হাজার ঘর আছে সেখানে, সুইমিং পুল, কংগ্রেস হল। গ্রানিট পাথরে তৈরি। পরের দু’হাজার বছর মেরামতির কোনো প্রয়োজন হবে না। অবশ্য গত দশ বছর যাবত পোল্যান্ডের পথেঘাটে, এমনকি সরকারি স্তরে এই রাশিয়ান প্রতীকটি বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার দাবি জেগেছে!
কোপারনিকাসের জন্ম তোরুণ (জার্মান থরন) শহরে। ওয়ারশ-তে তাঁর স্ট্যাচু ও স্মৃতি-বেদিটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। গালিলিওর সাত দশক আগে তিনি বাইবেলকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে (“সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে। ফিরে যায় আপন স্থানে”) বললেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। আমাদের আর্যভট্ট এই সারসত্যটি তারও বহুকাল আগে যে জানিয়ে গেছেন, এ কথাটি পদার্থবিজ্ঞানী আনিয়াকে জানালাম। শূন্য থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান - সবইযে আমরা পৃথিবীকে দিয়েছি, এ বড়াই করার সুযোগ ছাড়া গেল না। সে আমাকে জানাল, কোপারনিকাসের আরেকটা দিক – যা আগে জানতাম না।
-তুমি অর্থনীতি পড়েছ, তোমার জানা আবশ্যক – কোপারনিকাস প্রাশিয়ান আমলের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছিলেন।
কোপারনিকাস মুদ্রার ধাতুর মান রক্ষার ব্যাপারে প্রাশিয়ান রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যে ধাতব মুদ্রায় রুপো বা সোনার পরিমাণ কম, সেগুলি বাজারে চলতে থাকে। বেশি ভাল বা মূল্যবান মুদ্রা লোকে বাড়ির সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে! তিনশ’ বছর বাদে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ হেনরি ম্যাকলাউড এটি লক্ষ করেন, তত্ত্বের নাম দেন একদা খ্যাত ব্যবসায়ী গ্রেশামের নামে। আমরা অর্থনীতির ক্লাসে এটিকে গ্রেশাম’স ল বলে চিনেছি। কেন যে পদার্থবিদ্যার মত শুদ্ধ বিজ্ঞানীরা অর্থনীতির মত ধোঁয়াটে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়!
পরবর্তীকালে কাজেকর্মে ওয়ারশ গেছি বহুবার, কিন্তু আনিয়ার সঙ্গে সেই প্রথম ভ্রমণ মনে থেকে যাবে চিরকাল। ফিরে যাব লন্ডন। সপ্তাহান্তে আনিয়া যাবে রাদোম, বাবা-মার কাছে, ঘণ্টা দেড়েকের পথ। তাকে ট্রেনে তুলে দিতে গেছি। ট্রেন ছাড়ার আগে সে বললে, “লন্ডনের হাওয়াই জাহাজ ধরতে তুমি যে বিমানবন্দরে যাবে, সেটি যার নামে – সেই শোপাঁর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল না”।
ফরাসি পিতা, পোলিশ মাতার সন্তান ফ্রেডারিক ফ্রান্তসিসেক শোপাঁ জন্মেছিলেন ওয়ারশ থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে জেলাজভা ভোলা গ্রামে। মাত্র উনচল্লিশ বছরের জীবনে সেই অসামান্য সুরকার পোল্যান্ডকে সঙ্গীতসভায় এক উচ্চ আসন দিয়ে গেছেন। ওয়ারশ বিমানবন্দর তাঁর নাম বহন করে। ছবি দেখেছি, তবে সে বাড়ি আজও দেখা হয়নি। তাঁর “বৃষ্টি ধারা” আমার মনে এনে দেয় অজস্র স্মৃতির ঝড়।
একদিন জেলাজভা ভোলার রাস্তা দিয়ে হাঁটব। বৃষ্টিধারাকে স্মরণ করে বলব, এসেছি!
কোনো এক দিন।
লন্ডনের পোলিশ ক্রিসমাস
পোলিশ ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্কারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ঝাকশেভো পৌঁছুনোর অনেক আগে, আটের দশকে। তখনকার কম্যুনিস্ট দেশ পোল্যান্ডের একমাত্র বৈদেশিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যাঙ্ক হানডলোভের একটি শাখা ছিল লন্ডনের মনুমেন্ট স্টেশনের পাশে, ইস্টচিপে। সে অফিসের কর্তা ছিলেন জিয়েরজিন্সকি, পরে তাঁর সঙ্গে ওয়ারশতে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। সিটি ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে তাঁকেই আমরা প্রথম পোলিশ ঋণ বিক্রি করি। অব্যবহিত কাল পরে একদিন একটি ক্রিসমাস পার্টির আমন্ত্রণ পেলাম বাঙ্ক হানডলোভে লন্ডন অফিস থেকে, তলায় জিয়েরজিন্সকির লম্বা সই।
ঠান্ডা লড়াই চলছে তখন পুরোদমে। বার্লিন দেওয়াল বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে। পূর্ব ইউরোপের যে কোনো সীমান্তে সশস্ত্র প্রহরীর পায়চারি অব্যাহত।
কিং উইলিয়াম স্ট্রিটে রাশিয়ান মস্কো নরোদনি ছাড়া তৎকালে পূর্ব ইউরোপের আর কোনো কম্যুনিস্ট দেশের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ লন্ডনে ছিল না। ভাবনায় পড়লাম – কমপ্লায়েন্স বিভাগ বস্তুটি সে আমলে আমাদের অচেনা। তবে আমেরিকার মতন কট্টর ধনতান্ত্রিক দেশের প্রাচীনতম ব্যাঙ্কের পক্ষে কি বামপন্থী কোনো ব্যাঙ্কের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার সমীচীন হবে?
আমার কর্তার অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক মনে করে তাঁর কাছে হাজির হলাম। জিয়েরজিন্সকির সই করা কার্ডটি জো কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, যেতে পার। তুমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে আমেরিকান ধনতন্ত্র বা সিটি ব্যাঙ্কের সর্বনাশ হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে প্রচুর ভদকা পান করিয়ে ওরা সিটি ব্যাঙ্কের বাণিজ্যপদ্ধতির খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে!
বড়দিনের দু’সপ্তাহ আগে থেকে প্রতি সন্ধ্যায় লন্ডনের কোনো না কোনো ব্যাঙ্কে চলে ক্রিসমাস পার্টির পানভোজনের হুল্লোড়। আমার মতে লন্ডনের ব্যাঙ্কারগোষ্ঠী এই সময়টা একটা অন্তহীন নেশার ঝোঁকে থাকে (ইন এ স্টেট অফ কনটিনিউয়াস ইনটকসিকেশান)! ব্যাঙ্ক হানডলোভের আমন্ত্রণ আবার সন্ধ্যেয় নয়, দুপুরে অন্নগ্রহণের। মধ্যাহ্নে মদ্যপানের ঠেলা আছে। অফিসে ফিরে যদি বসের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে হয়, তাহলেই তো চিত্তির।
মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কের রজার তখন সব লন্ডনের পার্টি আলোকিত করে রাখত। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার তো এদের পার্টিতে আসা-যাওয়া আছে। দুপুরের ড্রিঙ্ক কীভাবে ম্যানেজ কর? শ্যাম রাখি, না কুল রাখি?
ভাবলেশহীন মুখে রজার বললে, যদি সঠিকভাবে আপ্যায়িত হতে চাও, অফিসে ফিরো না। আর তুমি যদি সভ্য সমাজে পোল্যান্ডের শ্রেষ্ঠতম অবদানকে তুচ্ছ করতে পার (আমাদের ভাষায় হেলায় পদাঘাত), বেলা তিনটে নাগাদ ট্যাক্সি চড়ে নিজের অফিসে গিয়ে ব্যবসার হাল ধর। এতদিন তো এরা তোমাকে কলকে দেয়নি তাই জানো না। বাঙ্ক হানডলোভের লাঞ্চ পার্টির প্রত্যাশায় পাবলিক হাঁ করে থাকে (মোস্ট ইগারলি অ্যাওয়েটেড)!
রজারের কথা ষোল আনা সত্যি। সব কাজ বা কাজের বাহানা ফেলে রেখে ভর দুপুরে লন্ডনের এত ব্যাঙ্কারকে সমবেত হতে আগে কখনও দেখিনি। পানভোজন শুরু সাড়ে বারোটা থেকে। বাইরের তাপমান যাই হোক না কেন, দুটো নাগাদ অনেকেই টাই খুলে ফেলতেন, তিনটে নাগাদ জ্যাকেট। আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পরের দশ বছর ভদকাসিক্ত পোলিশ আতিথেয়তার এই পরম পরাকাষ্ঠার সম্মানে অফিসে ফেরার তাগিদ অনুভব করিনি। বাড়ি পৌঁছুতে সন্ধে ঘনিয়েছে।
পরে জো-কে বলেছিলাম, প্রফেটিক মন্তব্যের সেরা উদাহরণ তিনিই দিয়েছিলেন! ঘণ্টাতিনেক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন সসেজ এবং ভদকা সেবার পরে সিটি ব্যাঙ্কের বাণিজ্যপদ্ধতি কেন, এটিএমের কোড দিয়ে দেওয়া যায়। সহকর্মী হিউকে নিয়ে গিয়েছিলাম একবার। বিকেল চারটে নাগাদ আমাকে জিজ্ঞেস করলে, বস, অফিসে কি ফিরতে হবে? নিজেই যাব না, হিউকে আর কোন সুপরামর্শ দেব? অফিসে ফোন করে এঞ্জেলাকে বললে, সে যেন তার ডেস্কে চাবি বন্ধ করে দেয়। আজ হিউ অফিসে ফিরবে না।
সব ভাল জিনিসের শেষ আছে। অদৃষ্টের পরিহাসে বাঙ্ক হানডলোভে অধিগ্রহণ করার পরে সিটি ব্যাঙ্ক অকারণ অর্থব্যয় বিবেচনা করে এই বাৎসরিক ক্রিসমাস পার্টি বাতিল করে দেয়। অনেক ব্যাঙ্কার বন্ধু আমাদের ক্ষমা করতে পারেননি। শোক ভুলতে সময় লেগেছিল। ইস্টচিপের সেই বাড়িটার পাস দিয়ে হেঁটে মনুমেন্ট স্টেশনে টিউব ধরতে গেলে খুব মনে পড়ে যায় সেই সব দিনের কথা।
বেহিসেবি উষ্ণ হৃদয়
সিটি ব্যাঙ্ক পোল্যান্ডের ঋণ দান বা ক্রেডিটের সর্বময় কর্তা তখন ইরানের রেজা ঘাফারি। সারা জীবন উন্নতিশীল দেশ গুলিতে কাজ করেছেন – ফিলিপিনস থেকে পেরু বা পাকিস্তান – কোথায় না গেছেন? তাঁর ভাঁড়ারে কখনও গল্পের কমতি হত না। কেউ ব্যাঙ্কের কোনো নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা করে বাজার মাত করতে চাইছে দেখলে খানিকটা ঘনাদার স্টাইলে বললেন, ও আর এমন কী? জানো, লুসাকাতে একটা কারেন্সি সোয়াপ (এক মুদ্রার পরিবর্তে আরেক মুদ্রার লেনদেন) ডিল করে কী ফ্যাসাদে পড়েছিলাম? জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্টকে কেউ বুঝিয়েছে এটা টাকা লুঠ করার আমেরিকান ষড়যন্ত্র – পুলিশ আমাকে ধরতে আসে। এক বস্ত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা পালাই!
এহেন রেজা ঘাফারি একদিন আমাদের বললেন, যখনই মনে হল সব দেখা, সব শোনা হয়ে গেছে (বিন দেয়ার, ডান দ্যাট), একটা নতুন পালা শুরু হতে দেখলাম এই পোল্যান্ডে এসে। রেজার গল্পটি এই রকম:
পিকেএন রিফাইনারি সে আমলে সরকারি মালিকানার অধীনে এক বৃহৎ তেলের কারবারি। আমরা তাদের দুয়োরে প্রায় কড়া নাড়ছি। তাদের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করতে সিটি ব্যাঙ্ক দারুণ আগ্রহী, কিন্তু সমস্যা হল, তারা আজ অবধি তাদের ব্যাল্যান্স শিট দেখাচ্ছে না। পোলিশ সরকার এই কোম্পানির মালিক বলে কি আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না? রেজা মাঝেমধ্যে ব্যাঙ্কের অফিসারদের তাড়া দেন – কী হল, একটু হিসেবপত্তর কবে দেখাবে? মাস দুই বাদে রিফাইনারির ভারপ্রাপ্ত সহকর্মী মারেক একদিন রেজাকে খবর দিল, ওদের কোষাধ্যক্ষ শ্রী মাতেউস জানিয়েছেন সময় লাগল বটে, তবে সব হিসেব প্রস্তুত। রেজা যদি কোম্পানির অফিসে পদার্পণ করেন, মাতেউস কোম্পানির ব্যাল্যান্স শিট স্বহস্তে তাঁর করকমলে সমর্পণ করবেন।
কনফারেন্স রুমে টেবিলের একদিকে বসলেন মাতেউস, অন্য দিকে মারেক ও রেজা। কফির সঙ্গে খানিকটা নাটকীয়তা সহকারে পিকেএন কোম্পানির নবতম ব্যাল্যান্স শিট রেজার হাতে তুলে দিলেন মাতেউস। ফুলস্ক্যাপ বা এ ফোর কাগজের দুটো পাতা – একটা লাভ-লোকসান (প্রফিট অ্যান্ড লস), অন্যটি ব্যাল্যান্স শিট, পেন্সিলে লেখা। রেজা সেগুলি পাঠ করেন আর তাঁর মুখে ক্রমশ মেঘ ঘনিয়ে আসে। কোনো কথা বলছেন না। উলটো দিকে গরুড়ের মতন প্রায় হাতজোড় করে বসে আছেন মাতেউস।
বেশ কয়েক মিনিট সবাইকে সাসপেন্সে রেখে রেজা বললেন, আপনাদের আর্থিক অবস্থার হিসেব নিকেশ তো আমার মোটেও ভাল ঠেকছে না।
বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মাতেউস বললেন, হিসেবটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না? বদলে দিতে পারি। পেন্সিলে লেখা তো, কোনো অসুবিধে হবে না।
গল্প শেষ করে রেজা বললেন, কী বুঝলে? পূর্ব ইউরোপে ব্যাঙ্কিং করতে গেলে ১৮১২ সালে ম্যানহাটানে লেখা সিটি ব্যাঙ্কের ঋণদান সংবিধানটি আলমারিতে বন্ধ করে রাখ!
রেজার এই কথাটি মনে পড়েছিল কয়েক বছর বাদে। সিটি ব্যাঙ্ক তখন খুব তোড়জোড় করে কয়েকটি নির্বাচিত উন্নয়নশীল দেশের মাঝারি সাইজের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর কাজে নেমে পড়ে, বিশেষ করে পোল্যান্ডে। শিগগির বোঝা গেল, সে বাজারে আমাদের ঢোকার মুরোদ নেই – ম্যানহাটানি ঋণের সংবিধান দিয়ে এ সব দেশে বাণিজ্য করা যায় না। বহু অর্থ-অপব্যয়-অন্তে সিটি ব্যাঙ্ক এই সত্যটি অনুধাবন করে রণে ভঙ্গ দেয়।
উর্দু লিখতে পড়তে পারি না। কিন্তু হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে আর পাকিস্তানি বন্ধুবর্গের পাল্লায় পড়ে সেটা খানিক বলতে বুঝতে পারি – এইরকম বড়াই করেছিলাম। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই রেজা আমাকে ফারসির সঙ্গে উর্দুর মেলবন্ধন বোঝাতেন। একদিন বললেন, ফারসি ক্রিয়াপদ তোমার অজানা। কিন্তু অনেক বিশেষ্য বা বিশেষণ চেনো উর্দুর দৌলতে। ধর, আপিসে দু’জন ফারসিতে কথা বলছেন – কান খাড়া করে শুনলে, কী নিয়ে কথা হচ্ছে তার মাথা বা মুণ্ডু খানিকটা বুঝবে। কিছু শব্দে আবার মজার খেলা আছে। এই যে তোমরা বল, খামখা। এটা আদতে কোনো ফারসি শব্দ নয়! ফার্সিতে ইচ্ছে হল খোয়াইশ। সেটাকে কেটে বলি ‘খা’ আর মার অর্থ ‘না’। খোয়াইশ মা খোয়াইশ – ইচ্ছে না ইচ্ছে। তা ইচ্ছেরই যখন অভাব, তখন শর্টকাটে বলা গেল, খা ম খা – ইচ্ছে না ইচ্ছে!
এই ছিল আমাদের সিটি ব্যাঙ্ক – যেখানে সেখানে আড্ডা দিয়ে জ্ঞান আহরণ করার অনাবিল অবকাশ।
ওয়ারশ থেকে রেজার বদলির হুকুম এল একদিন – এবার কাসাব্লাঙ্কা, মরক্কো। ফোনে জানালেন। আমি বললাম সুখবর। প্রচণ্ড ঠান্ডার দেশ থেকে গরম দেশে যাচ্ছেন! একটু চুপ করে থেকে রেজা বললেন, দেশটা ঠান্ডা হতে পারে, তবে মানুষের হৃদয়ে আছে উষ্ণতা।
তারপরে তো তিরিশ বছর কেটে গেল। পোল্যান্ডের সঙ্গে, কিছু মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমনি অটুট তেমনি মধুর। রেজা ঘাফারি আজ কোথায় আছেন জানি না। যদি কোনোদিন দেখা হয়, বলব, সে দেশের মানুষের অন্তহীন উষ্ণতার স্পর্শ পেয়ে আমি আপনাকেই স্মরণ করেছি বারংবার।
কোহাম পোলস্কে!