সেই যে বুলবুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতায় নজরুলের বাড়ি এসেছিল পিংলা, তারপর থেকে বহুদিন তার খবর নেই কোন। বাইরের থেকে যারা দেখছে তারা জানে নজরুলের কাজকর্ম চলছেই পূর্ববৎ, এমনকি হয়তো কাজের চাপ সে আগের তুলনায় বাড়িয়েওছে অনেকটা। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, পুরোনো ছোট গাড়ির জায়গায় নতুন ক্রাইসলার, সদর দরজায় দারোয়ান। মঞ্চে এতদিন নজরুলের গানেরই জয়যাত্রা চলছিল, এবার সে ধ্রুব নামের বাংলা সিনেমায় শুধুই সঙ্গীত-পরিচালক নয়, অভিনয়ও করেছে নারদের চরিত্রে। বাংলা যাত্রাপালা এবং মঞ্চে এতদিন নারদ নামে বোঝা যেত শ্বেতশ্মশ্রুধারী এক সাধক-বাউল জাতীয় উপস্থিতি; নজরুল আমূল বদলিয়ে দিল সেই ধারণা, সে তরুণ নারদ হিসেবে অবতীর্ণ হল এই সিনেমায়। এই নিয়ে যখন হৈ-হল্লা, নজরুল তখন তার অননুকরণীয় ভঙ্গিতে প্রশ্ন তুলল, নারদের বয়েসের উল্লেখ কোথায় আছে? আর যদি ইঙ্গিতেও তার বয়েসের বার্ধক্যের কথা থাকেও কোন পুরাণে; চেহারায় গোঁফ-দাড়িতে তার বয়েসের ছাপ যে ফেলতেই হবে, তার কী মানে? মনের দিক থেকে তো সে চিরতরুণই, তা না হলে অনবরত স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আর মর্ত্য থেকে স্বর্গে যাতায়াত করে এর-কথা-ওকে-ওর-কথা-তাকে সে চালায় কীভাবে? চলচ্চিত্রে তাই তরুণ নারদেরই উপস্থিতি সার্থক হবে।
বাংলা সিনেমা এখন একেবারেই প্রাথমিক স্তরে; গ্রামোফোনের গান, মঞ্চের নাটক বা মঞ্চবিহীন নানারকমের যাত্রাপালা বা লোকনাট্যই এখনও ছাপা-বইয়ের বাইরে বাংলায় বিনোদনের প্রধান মাধ্যম, যদিও সবাক এবং নির্বাক বিদেশী সিনেমার আকর্ষণও বোঝা যাচ্ছে একটু একটু। সিনেমা যে সম্পূর্ণ নতুন একটা মাধ্যম এবং ভাষা, এবং প্রতিভাবান শিল্পীর হাতে সে মাধ্যমের ভবিষ্যত যে অত্যুজ্জ্বল সে-কথা রবীন্দ্রনাথও বলেছেন। রাশিয়ায় গিয়ে তিনি আইজেনস্টাইনের ব্যাট্ল্শিপ পোটেমকিন দেখে এসেছেন। এমনকি তাঁর নৃত্যনাট্য নটীর পূজার একটা চলচ্চিত্র-সংস্করণও তিনি প্রযোজনার চেষ্টা করেছিলেন যদিও সে প্রযোজনা তাঁর নিজেরই পছন্দ হয়নি। নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র-শৈলজানন্দ এই নতুন মাধ্যমকে ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করছে। সিনেমা-সংক্রান্ত পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। কবিতা রচনায় ভাঁটা-পড়া নজরুল তো তার গানের সুবাদে শুধু মঞ্চে নয়, সিনেমার শিল্পীদেরও কাছাকাছি। এই অবস্থায় সিনেমায় তার উৎসাহ স্বাভাবিক ভাবেই হতে পারত। এমন সময় হঠাৎ পিংলার একটা চিঠি পৌঁছল তার কাছে, সম্পূর্ণ নতুন একটা সম্ভাবনার কথা জানিয়ে:
গোসাবা, সুন্দরবন, ১লা বৈশাখ, ১৩৪১
প্রিয় কাজিদা,
শিবপুরের সেই 'ভীমদার তেলেভাজা'র ভীমদাকে মনে আছে? ভীমদা বলেছিল, স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের ডাকে মেদনীপুর থেকে সপরিবার তার বাবা এসে বাসা বেঁধেছিল গোসাবায়। যতীন দাদার Young Bengal Zamindari Urban Cooperative ছিল ওই গোসাবাতেই সাহেবের কাছ থেকে লীজ নেওয়া জমিতে। আজ এতদিন পর আমি সশরীরে সেই গোসাবায়। অবাক হচ্ছ? ব্যাপারটা খুলে বলি।
ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের সম্বন্ধে ভীমদা যতটুকু বলেছিল, সেটা সামান্যই। সাহেব পাক্কা স্কটিশ, আঠের শতকের স্কটিশ কোঅপারেটিভ আন্দোলনের উত্তরসুরী সে। ভারতের জনসাধারণের আর্থিক-সামাজিক অবস্থা বদলাতে হলে, সে মনে করতো, ক্যালিডোনিয়ন সমাধানই একমাত্র রাস্তা।
এখানে একটা সত্যি কথা তোমাকে বলে রাখি। ক্যালিডোনিয়ন শব্দটার অর্থ, সাহেব যখন বলেছিল, তখন আমি একেবারেই বুঝিনি। এখনও যে পুরোপুরি বুঝেছি এমনটা নয়। এতদিনে, একটু একটু এই কথাটা বুঝতে পারি যে, স্কটল্যাণ্ডের অর্থনৈতিক বিপদের দিনে সে দেশের সমস্যা এবং আমাদের সমস্যার একটা মিল দেখেন সাহেব, অতএব সমস্যার সমাধানের একটা মিলের কথাও ভাবেন তিনি। নতুন করে নোট ছাপিয়ে – যা বোধ হয় সরকারি ছাপা নোটের হিসেবের বাইরেই থাকবে – তাকে বাজারে চালু করিয়ে দেবার একটা কায়দা সাহেবের মাথায় আছে বলে মনে হয়। এখন শান্তিনিকেতনে ফিরে, আমার স্যর অতুলবাবুকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো শুধু ইংরিজি থেকে বাংলা অর্থ নয়, ব্যাপারটা আসলে কী, এবং স্কটল্যাণ্ড আর বাংলার সমস্যার আর সম্ভাব্য সমাধানের মিলটা কোথায় খানিকটা তিনিই বুঝিয়ে দিতে পারবেন। সাহেব নিজেও বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু স্যরের কথাই আলাদা! সে কথায় পরে আসছি।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আদেশে, অতুলবাবু স্যরের নির্দেশ এবং উপদেশে, আর প্রথমে এল্ম্হার্স্ট সাহেবের আর এখন পর্যন্ত কালীমোহন ঘোষ স্যরের ছকে-দেওয়া কাজ করতে করতে পতিসর সুরুল এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলে এতদিন ধরে গ্রামোন্নয়নের কাজ যথাসাধ্য করছি। যে-সব জায়গায় কাজ করেছি এতদিন, সেগুলো প্রতিষ্ঠিত গ্রাম। হয় ঠাকুরবাড়ির অথবা অন্য কোন জমিদারির অন্তর্গত। জমিদারি তো শুধু জমি দিয়েই হয় না, সেই জমিতে বসবাসকারী এবং উৎপাদনকারী নানা রকমের মানুষ, আর তাদের নানা সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না দিয়েই গড়ে ওঠে এক-একটা গ্রাম, একটা অঞ্চল এবং সে অঞ্চলের এক বা একাধিক জমিদারি। জমিদার যখন জমিদারি বংশপরম্পরায় অর্জন করে, তখন জমিদারির অন্তর্গত মানুষগুলোর অর্থাৎ প্রজাদের বহুদিনের সঞ্চিত সংস্কার, আদর্শ, উদারতা, আলস্য, পরশ্রীকাতরতা, দয়ামায়া – সবই, না-চাইলেও জমিদারের অর্জন। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের যাবতীয় গ্রামোন্নয়নের কাজ এই প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের উৎসাহিত করেই করতে হয়েছে।
ড্যানিয়েল সাহেবের সঙ্গে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের অনেক দিন ধরেই চলছিল। বোধ হয় বর্ধমান শহরে কোঅপারেটিভ আন্দোলনের বিষয়ে একটা সেমিনারে তাঁদের কিছুক্ষণ মুখোমুখি কথাবার্তাও হয়। শুনেছি শান্তিনিকেতনেও সাহেব এসেছিলেন, তবে সেই সময়ে যে-কোন কারণেই হোক আমি ছিলুম না। উনিশশো বত্তিরিশের তিরিশে ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত সাহেবের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ গোসাবায় দু'রাত্তির কাটিয়েও আসেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে তিনি গোসাবায় কী দেখে এলেন প্রায় দিন-দশেক সে-বিষয়ে অন্তত আমার পরিচিত কারো সঙ্গে কোন আলোচনাই করেননি। কিছুদিন আগে কবি রাশিয়া থেকেও তাঁর এজন্মের তীর্থদর্শন অসমাপ্ত না-রেখে ফিরেছেন গভীরভাবে আপ্লুত হৃদয় নিয়ে। মাসখানেক আগে কবি একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন; বললেন, গোসাবা থেকে ঘুরে আয়। কেন তোকে ঘুরে আসতে বলছি আমি নিজে জানিনা; অতএব, ধরে নিতে পারিস, আমার কোন নির্দেশ নেই। কতদিনের জন্যে যাবি তা-ও বলছি না, যতদিন ভালো লাগে, থাকবি। ভালো না লাগলে ফিরে আসবি, আবার যেতে ইচ্ছে হলে আবারও যাবি। ড্যানিয়েল সাহেবকে বলা আছে, তোর জন্যে ব্যবস্থা থাকবে। কবে যেতে পারবি?
বললুম, আমার তো কোন বিশেষ কাজ নেই এখন, আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই যাব। কাল বললে কালই রওনা হতে পারি।
তোর সঙ্গে টাকাপয়সা কত আছে?
শ'দুয়েক টাকা আছে আমার, বললুম আমি।
দুশো? ঠিক আছে, বললেন গুরুদেব। আমি কিন্তু তোকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে বলছি না। শান্তিনিকেতনে তুই কারো দয়ায় থাকিস না, এখানে থাকার অধিকার তোর স্বোপার্জিত। আমি শুধু তোকে নিজের চোখে, অন্যের প্রভাব ছাড়া, সম্পূর্ণ নিজের দৃষ্টিতে জায়গাটা দেখতে পাঠাচ্ছি। যতদিন ভালো লাগে, থাকবি। ফিরে আসতে ইচ্ছে না করে যদি, আসবি না। যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে, কারোকে জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। এখানে তোর নির্দিষ্ট কাজ তো আছেই।
পরের দিন সকালে যখন বোলপুর স্টেশন থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরলুম, মনটা কেমন জানি ভারি হয়ে উঠল। শান্তিনিকেতনে প্রথম এসেছি, সে তো দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় গ্রামোন্নয়নের কাজ করতে পতিসরে যেতে চেয়েছিলুম, কবি আমাকে বলেছিলেন, অতুলবাবু যদি পতিসরের ব্রতীবালক সংগঠনের কাজে তোমাকে লাগিয়ে দেন, তাহলে কিন্তু তুমি একজন ব্রতীই। ধর্মীয় ব্রত পালনের মতোই এই ব্রতও ব্রতীর কাছ থেকে প্রধানত কষ্টসহিষ্ণুতাই দাবি করে। এই কষ্টের মধ্যে প্রাপ্তি এক ধরণের আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওইটুকু প্রাপ্তিই যে সব, এই কথাটা ব্রতীকে অহরহই মনে রাখতে হয়। জবাবে আমি বলেছিলুম, আমি মনে রাখব গুরুদেব। সেই থেকে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, অতুলবাবু স্যর আর কালীমোহন স্যর যা শিখিয়েছেন, শিখেছি; যা বলেছেন, করেছি; এখান থেকে চলে যাবার কথা কখনও ভাবিইনি। শান্তিনিকেতনকে যদি একটা পরিবার মনে কর কাজিদা, তাহলে নিজের অজান্তেই সেই পরিবারের একজন সভ্য – যত নগণ্যই হই – যে আমিও এর মধ্যে হয়ে গেছি সে-বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। আমার কি তাহলে নির্বাসন হচ্ছে?
ক্যানিং থেকে বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে গোসাবায় যেতে দু'জায়গায় নৌকো বদলাতে হল। লোককে জিজ্ঞেস করে যেতে অসুবিধে হল না, বুঝতে পারলুম ও-অঞ্চলের লোকদের মধ্যে গোসাবা অপরিচিত জায়গা একেবারেই নয়। আমার পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল শেষ হয়ে প্রায় সন্ধ্যের গোধূলি। পৌঁছিয়ে বোঝা গেল, বোলপুর-শান্তিনিকেতন থেকে কোন একজনের যে-কোনদিনই এখানে আসবার কথা জানতেন সাহেব, কিন্তু ঠিক কবে কেউ আসবে তাঁর জানা ছিল না। সাহেব তাঁর বাংলোতেই ছিলেন, প্রথমেই আমার খাবারদাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। আমার খাওয়া শেষ হতে হতে যে-ঘরে গুরুদেব কাটিয়েছিলেন দু-রাত্তির, পরিষ্কার করে সেই ঘরেই আমার রাত কাটাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন সাহেব। বললেন, এ-যাত্রায় যে-ক'দিন তুমি থাকবে, এই ঘরেই তোমার ব্যবস্থা। তোমার যদি গোসাবা ভালো লেগে যায়, আর এখানেই স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাব, তখন কী ব্যবস্থা হবে সেই সময়েই ভেবে দেখব। আজ আর বাইরে বেরিও না, কাল সকাল থেকে শুরু হোক তোমার পর্যটন।
সাহেব চলে গেলে আমি সন্তর্পণে একটা-দুটো চাদর কবির ব্যবহৃত শয্যা থেকে তুলে নিয়ে মেঝেতে পাতলুম। গুরুদেব নিজে যেখানে শুয়েছিলেন সেই শয্যায় শুতে সাহস হল না। ক্লান্তি ছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর যখন বাংলোর বাইরের জমিতে খানিকটা হাঁটাচলা করছি, একজন এসে আমাকে বলল, সাহেব ডাকছেন। দেখলুম, সাহেব বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকেই লক্ষ্য করছেন, চোখাচোখি হতে বললেন, গূড মর্ণিং, টী?
বাংলোর বারান্দাতেই চায়ের বন্দোবস্ত ছিল, খেতে খেতে আমাকে সাহেব বললেন, এত জায়গা থাকতে আমি গোসাবাকেই আমার কাজের জায়গা হিসেবে কেন বেছে নিলুম, তোমার জানতে কৌতূহল হচ্ছে? কৌতূহল তো ছিলই, সে-কথা জানাবার পর সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে জলখাবার খেয়ে নাও। আজ থেকে তিন দিন আমি চব্বিশ ঘন্টা তোমার সঙ্গে থাকব। তোমাকে নিয়ে ঘুরব, তোমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেব। তিন দিনের মধ্যে এখানকার অনেকের সঙ্গেই তোমার পরিচয় হয়ে যাবে। আমি আশা করব তুমি সবায়ের সঙ্গে মেলামেশা করবে। এই মেলামেশা থেকেই তোমার গোসাবা প্রজেক্টের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারণা তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত।
সেই যে ধারণা তৈরি হল, তাই নিয়েই আমার এই গল্প।
ভীমদা আমাদের ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী নামের এক জাহাজ-কম্পানীর কথা বলেছিল, মনে আছে? বলেছিল, স্যর ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন কলকাতার এই কম্পানীর কর্তা ছিলেন। এই যে ম্যাকিনন, যে-নামটা মনে হচ্ছে সাহেবের নামের মধ্য-অংশ, এটা আসলে সাহেবের মায়ের বংশের নাম। অর্থাৎ জাহাজী এই ব্যবসাটা সাহেবের খানিকটা উত্তরাধিকারও। আঠেরোশো আশি সালে সাহেব প্রথম ভারতে আসেন। প্রথমে বোম্বাই, কিছুদিন পরেই কম্পানীর প্রধান কার্যালয় কলকাতায়। কলকাতায় তখন স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল হাওয়া। সেই আন্দোলনের প্রভাব সাহেবের উপর কতটা পড়েছিল সাহেব আমাকে বলেননি, কিন্তু সাধারণ পল্লীবাসী ভারতীয়র দারিদ্র সেই সময় থেকেই তাঁর কাছে বড়ই পীড়াদায়ক মনে হয়। সাহেব আমাকে বলেছেন ষোল শতকে স্কটল্যাণ্ডে একবার খুব বড় দুর্ভিক্ষ হয়। সেখান থেকে কোনমতে সামলিয়ে ওঠার পর আঠের শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবার একবার ভয়ঙ্কর অর্থসঙ্কটে পড়ে স্কটল্যাণ্ড। এমনিতে, সাহেবের মতে, স্কটল্যাণ্ডের মানুষ সাধারণভাবে সৎ, মিথ্যে কথা প্রায় বলেই না তারা। এমনও নয় যে তারা অলস। কিন্তু সারাদিন ধরে প্রবল পরিশ্রম করেও যথেষ্ট অর্থাগম না হয় যদি, তাহলে সেই পরিশ্রম তো প্রায় নিষ্ফলাই। এক-একজনের পরিশ্রমের ফলে উপার্জিত ধন যদি অন্যের পরিশ্রমের উপার্জনের ফসল সঠিক মূল্যে না-ই কিনতে পারে, তাহলে সার্বিক অর্থোন্নতি হবে কীভাবে? সেই সময় স্কটিশ সমাজের যাঁরা নেতা তাঁদের মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি আসে; কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কিছুদিন অন্তর ছেঁড়া-পুরোনো-প্রায়-নষ্ট-হয়ে-যাওয়া যেসব নোট পুড়িয়ে দেয় বা ধ্বংস করে ফেলে, সেগুলোকে বাঁচিয়ে তার থেকে বেছে বেছে কিছু কিছু এক-পাউণ্ডের নোট দিয়ে শ্রমিকের উপার্জিত ধনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যায় না? ফেলে-দেওয়া নোট বাঁচিয়েই হোক বা ব্যাঙ্কের আলাদা-করে ছাপানো বাড়তি নোটই হোক, বাজারে সেগুলো আসায় প্রত্যাশিত ফলও পাওয়া গেল। কেনাবেচা বাড়ল, চাহিদা থাকায় এবং চাহিদা অনুযায়ী ক্রয়ের সঙ্গতি বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পাওয়া গেল হাতেনাতে। সাহেব আমাকে বলেছেন, পাউণ্ড যে-কাজ করেছিল স্কটল্যাণ্ডে, এক টাকার নোটই সেই কাজ করতে পারবে ভারতে। প্রয়োজন শুধু কাজ করতে ইচ্ছুক সৎ শ্রমিকের, মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা সুঠাম সামাজিক সম্পর্ক, এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা।
ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জী কম্পানীর পেনিনস্যুলার অ্যাণ্ড ওরিয়েন্টাল স্টীম নেভিগেশন লাইনের জাহাজে সব শ্রেণীর যাত্রী এবং কর্মচারির জন্যে দু'বেলা অতি আকর্ষক খাদ্য পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল। একুশ পদের ভোজ, প্রায় যথেচ্ছ মাছ-মাংস-সব্জী-ফলমূল রোজ। কোথা থেকে এত খাদ্য আসে? সাহেব খোঁজ নিয়ে জানলেন কম্পানীর নিজস্ব কয়েকটা খামার আছে, তার মধ্যে একটা কলকাতার কাছেই; ক্যানিং অঞ্চলে, সুন্দরবনে। সেই থেকে সুন্দরবন সম্বন্ধে সাহেবের কৌতূহল আর আগ্রহ।
আগেই বলেছি, কোঅপারেটিভ আন্দোলন সম্বন্ধে ড্যানিয়েল সাহেবের আগ্রহ অগাধ। কলকাতায় আসার পর থেকেই সাহেব নিজের এই আগ্রহ এবং বিশ্বাস নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। জাহাজী ব্যবসার সাফল্যে তাঁর তো টাকাপয়সার কোন অভাবই নেই, ভারতবাসী ইংরেজদের মধ্যে তিনি অর্থকৌলিন্যে প্রধানদের একজন, তার উপর তখনকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের তিনি সমবয়েসী, বন্ধুস্থানীয় এবং তাঁর কাউন্সিলের একজন সভ্য। কমবেশি দশ হাজার একর জঙ্গল-সমুদ্র-দ্বীপের জমি তিনি লীজ নিলেন সরকারের কাছ থেকে, মূলত গোসাবা ব-দ্বীপ এবং সুন্দরবন জঙ্গলের একশো তেতাল্লিশ আর একশো উনপঞ্চাশ নম্বর দ্বীপগুচ্ছ। জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদী এবং বাসযোগ্য জমি তৈরি করা তাঁর প্রতিশ্রুতি, সরকারের প্রতিশ্রুতি সে ক্ষেত্রে দশ বছরের জন্যে জমির নিষ্করতা। এই দশ হাজার একর ক্রমে প্রায় দেড়লক্ষ একরে পৌঁছবে। জনহীন এই জঙ্গলের জমিতে সাহেব তৈরি করবেন বসতি, যা হবে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। সাহেব আমাকে বলেইছিলেন তখন তাঁর প্রয়োজন ছিল শুধু কাজ করতে ইচ্ছুক সৎ শ্রমিকের, আর মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা সুঠাম সামাজিক সম্পর্ক এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা। যারা থাকতে আসবে এখানে, পারিবারিক জাত-ধর্ম-বর্ণ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েই আসতে হবে তাদের, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। প্রথম থেকেই সাহেব এখানে সুদখোর মহাজন, দালাল জাতীয় মানুষ আর পরোপজীবীদের প্রবেশ সাধ্যমতো প্রতিহত করেছেন। এখানে বলে রাখি কাজিদা, ড্যানিয়েল সাহেব নিজে ধর্মভীরু চার্চগামী ক্রিশ্চান হয়েও ক্রিশ্চানদের জন্যেও কোন বিশেষ সুবিধের কথা ভাবেননি, গোসাবায় কোন ধর্ম-প্রচারকের খ্রীষ্টিয় বা অন্য কোন ধর্মের প্রচার বরদাস্ত করেননি। গোসাবাতে সাহেব তৈরি করতে চেয়েছেন এমন এক মনুষ্যগোষ্ঠী যাদের ধর্ম পরিশ্রম করা এবং পরিশ্রমের ফসল উপভোগ করা; বিশ্বাস শুধু পরস্পরকে; আর বল শুধুমাত্র মিলিত শক্তিতে – কোঅপারেশন যার নাম।
জমি তো পাওয়া গেল, এখন জঙ্গল পরিষ্কার করে বাস-আবাদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রথমেই চাই একদল সাহেবের-ভেবে-রাখা মনের মতো মানুষ। ভূমিহীন পরিশ্রমী মানুষের সন্ধান করতে লাগলেন সাহেব নানা জায়গায়, সুন্দরবন-সংলগ্ন মেদনীপুর-খুলনা থেকে শুরু করে বাংলার বাইরে বিহার-যুক্তপ্রদেশ এমনকি মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। তোমার মনে পড়ে কাজিদা, ভীমদার বাবা পাণ্ডু লস্করের কথা? সাহেবের ডাকে মেদনীপুরের বাসস্থান ছেড়ে স্ত্রী আর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছিল যে গোসাবায়? তারই মতো আরও মানুষ এল; কেউ একা, কেউ সপরিবার, কাজ শুরু করবার জন্য যত মানুষের প্রয়োজন ধীরে ধীরে এই জনবহুল দেশে তাদের অভাব হল না। কিন্তু এসে তারা থাকবে কোথায়, খাবে কী? সাহেবের প্ল্যানমাফিক কুমির-ব্যাঘ্রসঙ্কুল সুন্দরবনের বড় বড় গাছের ওপর বাঁশের সঙ্গে দড়ি বেঁধে শক্তপোক্ত কাঠের তক্তায় শোয়ার ব্যবস্থা করা হল। এখানকার রয়্যাল বেঙ্গল আবার গাছে চড়তেও পটু, কাজেই গাছের নীচে আগুন জ্বালিয়ে রাতে শোওয়া। খাবার-দাবারের মালমশলা বাইরের থেকে এনে রান্না করে খাওয়া চলতে পারে, কিন্তু খাবার জল? চারিদিকে জল থৈ থৈ, কিন্তু খাবার জল কৈ? সমুদ্রের লোনা জলকে পরিষ্কার করার এক মেশিন কেনা হল প্রথমেই, তা-ছাড়াও মসজিদবাটী নামে খানিকটা দূরের এক বসতির মিষ্টি জলের পুকুর থেকে খাবার জল আনবার বন্দোবস্ত হল। যার পুকুর, তার পুরস্কার পঞ্চাশ বিঘে জমি। এ তো গেল তখনকার মতো কাজ চালাবার ব্যবস্থা। কিন্তু জলের সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান না-হলে বসতি তো গড়ে তোলা যাবে না। গভীর জলের পুকুর কাটানো শুরু হল, সেই পুকুর ঘিরে বড় বড় গাছ। জঙ্গল পরিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল মাটি দিয়ে ড্যাম তৈরির কাজও। পাঁচ বছর একটানা পরিশ্রমের পর গোসাবা আর বাঁশঘেরিয়ায় বেশ খানিকটা উঁচু-জমি তৈরি হল, ড্যামের যতটুকু হলে আপাতত কাজ চলতে পারে, তা-ও শেষ। এই ক-বছরের বৃষ্টিতে জমির উপরিভাগের নুন গেছে ধুয়ে, ফলত জমি এখন আবাদযোগ্য।
ভালো থেক।
পিংলা
পুঃ - এই চিঠিটা এইমাত্র শেষ করলুম। কাল যতটা সকাল সকাল পারি, বেরিয়ে যাব। ভেবেছিলুম, ফেরার পথে একবার মাইয়ার সঙ্গে দেখা করে যাব। এখন মন বদলিয়েছি। তোমার চিঠিটা তোমার বাড়ির ঠিকানায় পোস্ট করে দেব শেয়ালদা থেকে। হ্যাঁ, তোমার একেবারে হালের ঠিকানাটা আমার কাছে আছে, জোগাড় করে রেখেছি। শান্তিনিকেতনেই ফিরব সোজা। অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি পারি কথা বলতে হবে।